যুগলবন্দী পায়রা পর্ব-১৩+১৪

0
910

#যুগলবন্দী_পায়রা🕊️
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
#পর্ব-১৩
প্রতিবারের মতোই সেদিনও চিঠি লিখে পায়রার মাঝে বেঁধে উড়িয়ে দিয়ে ছিলো ইয়ামিন । প্রায়ই করতো৷ উত্তর মিলতো না কখন-ও। কিন্তু একদিন সব পালটে গেল। আকাশসম বিস্ময় নিয়ে ফিরে এলো উড়ো চিঠির উত্তর। সেদিন ইয়ামিন কিছুক্ষণ থম মেরে বসে ছিলো। উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছিলো।গলা শুকিয়ে কাঠ। ইয়ামিন চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ সিলিং এর দিক তাকিয়ে লাফিয়ে উঠে। চিঠিটি কাছে টেনে বার কয়েক পড়ে ফেললো। মরীচিকা নামের চিঠি মিতা তার চিঠি সঙ্গী হয়ে যায়। ধীরে ধীরে হতে থাকে গভীর। দু ধারেই চলতে থাকে ভাসমান স্রোত। ইয়ামিনের গভীর মন দ্বিতীয় বার প্রেমে পরে গেলো। অনুভূতি দোটানা পিছনে ফেলে লিখে ফেললো একখানা রঙ্গিন চিঠি।

মরিচীকা,

আমি হয়তো কখনো কোনো রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে পারবো না তোমাকে। দামি কিছু উপহার দিতে না পাড়লেও উপহার হবে বেলিফুলের মালা, হাত ভর্তি কাঠ গোলাপ বা কখনো একটি টকটকে লাল গোলাপ। আমি নিজ হাতে গুজে দেবো তোমার খোপায়। তোমার বড় কোনো আবদার পুরন করতে হয়ত অক্ষম হবো আমি। কিন্তু কোনো এক শেষ বিকেলের, সিঁদুর রাঙ্গা মেঘের আলোয় কোনো এক পথ ধরে হাটবো আমরা। হাতে থাকবে ভাজা বাদামের ঠোঙ্গা। একটা একটা করে ছুলে আমি তোমার সামনে ধরবো বলবো,,

“আমার স্বপ্নের রানী গ্রহন করুন”

তুমি হয়তো হাসবে। ভাববে তোমার নিশ্চুপ পাগলাটে প্রেমিক বুঝি সত্যি পাগলো। সত্যি বলি? হে পাগল আমি পাগল, সেই না দেখা, না ছোঁয়া মানুষটির জন্য পাগল।

ইতি
নিশ্চুপ পাগল প্রেমিক।

এর পরবর্তী কোনো উত্তর আসেনি। এসেছিলো একটি লকেট। মাঝে হার্ট এর ভিতরে একটি পায়রা, যার ঠোঁটে একটি চিরকুট। ইয়ামিন সেদিন খুশিতে চোখের জল ছেড়ে দিয়েছিলো। এর পর তারা ঠিক করলো তারা দেখা করবে। কিন্তু সেদিন সব পাল্টে গেলো। তার মরীচিকা এলো না। ঘন্টার পর ঘন্টা ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু যখন এলো তখন জানালো তার নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে। সে যেন আর তার জন্য অপেক্ষা না করে।

এটুকু বলেই থামলো ইয়ামিন। চোখের জল বন্যা রূপ নিলো। মহুয়াও কাদতেছে। মুখ চেপে কাঁদছে। ভাগ্য তাকে চিঠি প্রেমিকেরই দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছে। অথচ সে? পুরো দুনিয়া খুঁজে বেড়াচ্ছে। পরক্ষণেই মাথায় ঘন্টি বাজিয়ে যাচ্ছে, কার সাথে ইয়ামিন সেদিন কথা বলেছিলো? সেদিন মহুয়া আসতে চেয়েও পারেনি তার বাবার এক্সিডেন্ট হয়েছিল সেদিন। তার পরই তো তাকে খুঁজতে এত দূর আসা। মহুয়া কান্না থামাতে ঢুক গিললো। ইয়ামিনের সামনে তুলে ধরলো সেইম লকেট৷ ইয়ামিন অশ্রু বিদ্ধ চোখে হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো। ইয়ামিন হাটু মুড়ে ফ্লোরে বসেছিলো। মহুয়ার তার কাছে এসে বলল,

“আমি সেদিন আসতে চেয়ে ছিলাম ইয়ামিন। কিন্তু সেদিন আমার আব্বুর চাকরি চলে যায়। আব্বু টেনশনে বাসায় ফিরার সময় এক্সিডেন্ট হয়। আমাকে বাসা থেকে কল করাতে যেতে হয় সেখানে। কিন্তু আমি তো আমার এক বান্ধবীকে পাঠিয়েছিলাম আপানাকে জানাতে।”

ইয়ামিন এখনো ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। মাথা ফাকা ফাকা লাগচ্ছে, তার ফিলিংসের সাথে মেয়েটি কি খেলা করছে? কে এসে বলে সে চিঠি মিত্র তার বিয়ে ঠিক, আর ফেলে চলে গেলো। আর আজ যাকে বিয়ে করেছে? সেও দাবিদার। ইয়ামিনের এবার নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। পুরো পৃথিবী জালিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কি পেয়েছে সবাই? তার অনুভূতি, ভালবাসা এতটাই তুচ্ছো? ইয়ামিনের মুখের রং মুহূর্তেই পাল্টে গেলো। রাগে কাপচ্ছে তার শরীর। মহুয়া এক ধাক্কা মেরে গগনবিদারী এক চিৎকার করে বলে উঠলো,,

“আমার ভালোবাসা, অনুভূতি এতো টাই ঠুনকো? যে যখন যা ইচ্ছে এসে বলে যাবে? নো! আই উইল নেভার দেট হ্যাপেন্ড। ”

মহুয়া ইয়ামিনের ধাক্কা সামলাতে না পেরে ফ্লোরে বসে ফুপাচ্ছে। কি ভাবে সে বিশ্বাস করাবে? সেই তার পত্র প্রেমিকা? মহুয়া কিছু একটা ভাবলো। তার পর উঠে দাঁড়িয়ে ইয়ামিনের কাছে গেলো। ইয়ামিন তখন বাহিরের পানে চেয়ে। মহুয়া দু হাত মুচরাতে মুরাতে মিনমিন করে বলল,,

“মনে পরে কি আপনার? আপনার বোনের সম্পর্কে আপনি আমাকে চিঠিতে কি লিখে পাঠিয়ে ছিলেন?”

ইয়ামিনের বুকে ধক করে উঠলো। মহুয়ার দিক ফিরে জিজ্ঞেস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মহুয়া তখনো থুতনি বুকে সাথে লাগিয়ে আছে। মহুয়া বলল কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,

“আপনার বোন আপন ছিলো না আপনার। সে আপনার বাবার অবৈধ সন্তান। ”

ইয়ামিন নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো। পর মুহূর্তেই তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,

“হতেই পারে তুমি আমাকে ধোকা দেয়ার চোষ্টা করছো। হতে পারে এসব তোমার সাজানো নাটক। হতে কেন আমি সিউর তুমি মিথ্যা বলছো! জীবন টা সিনেমেটিক নয়। যা বললে তাই হয়ে গেলো।আমার এসবে এখন বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে সব কিছু থেকে। প্লিজ আমাকে একা থাকতে দাও আমি নিতে পারছি না। প্লীজ।”

শেষ কথাটি ইয়ামিন জোরেই বলল। কেঁপে উঠলো মহুয়া। ছলছল চোখে রুম থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে গেলো।

ইয়ামিন সেখানেই ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। জীবন তার সাথে আর কত মজা করবে ভেবেই পাচ্ছে না। রাত থেকে ভোর হয় ইয়ামিনে ভাবনা শেষ হয় না। সে দুরের আকাশের সূর্যের হাসি উদয় হতে দেখলো। রাতে ঘন আকাশের আধার কাটিয়ে আলোকিত করে তুললো, এক মুঠো রোদ। দরজা খটখট করে শব্দ হতেই ইয়ামিন বিরক্ত হয়। মহুয়া এসেছে ভেবেই রেগে বলে,

” আমি এখন কোনো কথা বলতে চাইছি না!”

তখনি ভেসে উঠলো চিকন কন্ঠ। দরজা ঠেলে ঢুকলো আয়দা, মন খারাপ করে একটি কাগজ এগিয়ে দিলো ইয়ামিনের দিক।

“এটা কি?”

“তোমার চিঠি!”

ভ্রুকুচকায় ইয়ামিন। বলে,

“কিসের চিঠি!”

আয়দা বলল,

“ভাবি চলে গেছে!”

ইয়ামিনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।

“চলে গেছে মানে? তোরা আটকাস নি!”

আয়দা সুপ্তপর্ণে শ্বাস ছাড়লো। বলল,

“আমরা কেউ ঘুম থেকে উঠে ভাবিকে পায়নি। আমার রুমেই ছিলো রাতে। সকালে এ চিঠি পাই। আর… জানতে পারি সে চলে গেছে!”

ইয়ামিনের কি করবে ভেবে পেলো না। দাঁড়িয়ে ছিলো সে। বসে পড়লো। হাতের চিঠি মেলে ধরলো। থক করে উঠলো বুক, সেই লেখা, সেই ঘ্রাণ, সেই যেন পরিচিত অনুভূতি। ইয়ামিন চিঠিতে চুমু খেলো। বুকে চেপে ধরে বসে রইলো। হুট করে উঠেই বেরিয়ে গেলো মহুয়াকে খুঁজতে। কিন্তু হয়! সে আজ-ও ধরা দিলো না। গাড়ির সিটে হেলে পড়লো ইয়ামিন। চোখের সামনে ভেসে উঠলো জঙ্গলে কাঁটানো মহুয়ার বাচ্চা বাচ্চা মুখ খানি। ইয়ামিন হারিয়ে গেলো। চোখের সামনে ঘোলা হয়ে গেলো। দূর থেকে ভেসে এলো চিৎকার, চেচামেচির শব্দ। ইয়ামিন জ্ঞান হারালো।

চলবে,

#যুগলবন্দী_পায়রা🕊️
#পর্ব-১৪
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি

চোখের উপর অপরিচিত কত গুলো মুখ দেখে ভ্রু কুঁচকায় ইয়ামিন। পিটপিট করে তাকিয়ে আশেপাশে দেখে বুঝতে পারলো সে এখন হসপিটালের সাদা চাদরে লেপ্টে আছে। হাসপাতালের এই রুমটিতে ভিন্ন যন্ত্রপাতি। ইয়ামিনকে চোখ খুলতে দেখেই, সাদা ফিনফিনে ড্রেসের এক নারী চেঁচিয়ে উঠে, “জ্ঞান ফিরেছে উনার” বলে বেরিয়ে গেলেন। আরেকজন নার্স ইয়ামিনের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ইয়ামিন চোখ ঘুরিয়ে চাইলো। রুমের মাঝে থাকা বড় জানালা দিয়ে আসা রোদের ঝকঝকে আলো পড়ছে তার পায়ে। ইয়ামিন শুধালো,

“আমি এখানে?”

নার্সটি এগিয়ে এলো। সাদা ফিনফিনে কাপড়ে শ্যাম বর্ণের ছিপছিপে শরীরের তরুণী। স্মিত হেসে বলল,,

“আপনি হাসপাতালে!”

ইয়ামিনের মাথায় চিন্তা ভাজ পড়লো। বলল,

“আমি এখানে কি করে এলাম?”

“আপনার এক্সিডেন্ট হয়েছিল স্যার!”

চমকে উঠে বলল ইয়ামিন,

“এক্সিডেন্ট? কই আমার তো মনে পরছে না কিছু?”

নার্সটি কি বলবে বুঝতে পারলো না। তার মাঝেই ঘরটিতে ঢুকলেন সাদা পোশাকে আধা-পাকা চুলের এক মাঝ বয়সি লোক। হাসি হাসি মুখে বলল,

“এখন কেমন আছেন আপনি?”

“আমার কি হয়েছে? বুঝতে পারছি না!”

লোকটির মুখে অন্ধকার নেমে এলো যেন। ঘামতে লাগলো কিছুটা। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে বলল,

“আপনি এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। আজ দশ দিন যাবত কোমায় ছিলেন।”

ইয়ামিন অবিশ্বাসের সাথে বলল,

“অসম্ভব। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি গাড়িতে ছিলাম। চোখের সামনে আবাছা হয়েছিলো শুধু। এক্সিডেন্ট হয় নি। আপনি মিথ্যা বলছেন!”

“আমি কেনো মিথ্যা বলবো?”

“ইয়ামিন বাবা তুই উঠেছিস?”

ডাক্তারের কথার মাঝেই কালো ছাপের সাদা শাড়ি পরা এক মধ্য বয়সী নারী কেবিনে প্রবেশ করলো। মুখে মাধুর্য ভরপুর। ছেলের এমন বেহাল দেখে দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরলো। পিছনেই ইয়ামিনের বোন আয়দা দাঁড়িয়ে ফুপাচ্ছে। জাম রঙ্গা সুতি জামায় আবরিত তরুণীর বাচ্চা সলুভ কিশোরী মুখ লাল হয়ে আছে। ইয়ামিন অবাক হয়ে বলল,

“তোমরা কাঁদছো কেন?”

মা ইয়ামিনের মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,

” আজ কতদিন পর তোকে চোখ খুলতে দেখেছি বাবা। সেই যে গেলি রাগ করে, মেয়েদের ছবি দেখিয়ে ছিলাম বলে, আর হবে না বাবা। তুই যখন বলবি! তখনি বিয়ে করাবো!”

ইয়ামিন আকাশসম বিস্ময় নিয়ে বলল,

“কিসের বিয়ে মা? আমার বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি আবার কিসের বিয়ের কথা বলছো?”

আয়দার দিকে তাকিয়ে ইয়ামিন জিগ্যেস করলো,

“আয়দা? তুমি তোমার ভাবি খোঁজ পেয়েছো? কোথায় আছে জানো কিছু?”

আয়দা আর তার মা একে অপের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। দুজনেই কান্না ভুলে গেলো। ইয়ামিন যেন আজিব কথা বার্তা বলছে। দুজনেই হতবাক, হতবিহ্বল হয়ে বলল,,

“কি যা তা বলছো ভাইয়া কিসের বিয়ে? কিসের ভাবি? বাই এনি চান্স! তুমি লুকিয়ে চুরিয়ে বিয়ে করোনি তো? ”

ইয়ামিনের মা হতাশ হলেন। আবেগী হয়ে বললেন,,

“আমরা চাই তুমি বিয়ে করো! তাই বলে আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললে? কত শখ ছিলো, এক মাত্র ছেলেকে বিয়ে করাবো ধুমধম করে! আর…”

কথার মাঝেই ইয়ামিন চিৎকার করে উঠলো। হাতের মাঝে লাগানো ক্যানুলার টেনে ছিঁড়ে ফেললো। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল,

“আমার সাথে তোমরা মজা করছো মা? আমি কি মিথ্যা বলছি? এক জলজ্যান্ত মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। দাদাজান আমাদের সেই মাতাব্বরের কাছ থেকে আমাদের ছুটিয়ে আনলেন! আর তুমি বলছো কিসের বিয়ে? ”

ইয়ামিন অনেক বুঝাতে চাইলো লাভ হলো না। কেউ বিশ্বাস করতেই চাইছে না। ইয়ামিন তার মা-বোনকে সব বললো। তাতেও লাভ হলো না উল্টো তার মা কান্না জুড়ে দিলো ছেলের হলো কি? লাষ্ট না পেরে সে বলল,,

“মা দাদাজানকে ডাকো উনি সব জানেন!”

“তোর দাদাজান আউট ওফ টাউন!”

ইয়ামিনে রাগে গা রি রি করে উঠলো এবার। সবার উপর চাপা রাগ নিয়ে বের হয়ে যেতে চাইলো। ডাক্তার পথ আটকাতেই আরো ক্ষেপে গেলো ইয়ামিন। কেবিনের সব তছনছ করে বেড়িয়ে গেলো । ডাক্তার সহ নার্সরা আতঙ্ক নিয়ে এক কোনায় দাঁড়িয়ে। ইয়ামিনের পিছনে ছুটলো তার বোন আয়দা। ভাইয়া, ভাইয়া বলে পিছন থেকে ডেকেও লাভ হলো না বিশেষ।

—————
আকাশে ফট ফট করছে জ্যোৎস্না। কী নিথর, সুন্দর এই রাত্রি। রাত্রির আকাশে সব তারাইএখন খুব স্পষ্ট। ইয়ামিন তাকিয়ে আছে রাতের আকাশের এই বিশাল উদারতায়।চোখ দুটি শূন্যে ফেলেই ইয়ামিন অস্ফুষ্ট ভাবে বলল,

” মহুয়া তুমি আমার কল্পনা নয়, আমার অংশ আমার অর্ধাঙ্গিনী। আমি খুঁজে বের করবোই তোমাকে।যে যাই বলুক আমার মন জানে আমি ভুল নই, তোমার সাথে কাটানো সময় গুলো ভুল নয়। সব সত্যি, বাস্তব। ”

আজ হাসপাতাল থেকে ফিরেছে দু দিন। মহুয়া খোঁজ করেও ইয়ামিন পায়নি। মাতব্বর নিজেও অস্বীকার করে বসে আছে সব। তাকে জিজ্ঞেস করতেই বলল,,

“কি যাতা বলছেন ছোট সাহেব? আপনারা সম্মানী মানুষ আপনাদের সাথে এসন করলে আল্লাহ পাপ দিবো আমাগে তবা, তবা। এত বড় পাপিষ্ঠ আমি কল্পনায় ও হইতে পকরবো না।”

ইয়ামিনের মনে চাপা সংশয় জাগে। ডাক্তারের কাছে যেতেই তারা জানায়,

“আপনার মাথায় চাপ পড়েছে বেশি। ইউ হ্যাভ ইমাজিনড এভরিথিং। ”

ইয়ামিনের বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। হাসপাতাল থেকে ফিরে সে তার ফোন চেক করেছিলো। কিছু পায়নি। কিন্তু তারিখের দিক তার চোখ আটকায়। একদিনের ব্যবধানে সব কিভাবে পাল্টে যায়? নিশ্চয়ই সবাই মিথ্যা বলছে? আচ্ছা সবাই কি তাকে পাগল ভাবচ্ছে? সে কি পাগল হয়ে গেছে??ইয়ামিন নিজের চুল টেনে ধরে। মহুয়া দেয়া শেষ চিঠিটির কথা মনে পড়তেই তার গাড়ির দিকে ছুঁটে। কিন্তু কি আশ্চর্য গাড়ি নেই! তার গাড়ি কই গেলো? ইয়ামিন তার মাকে জিজ্ঞেস করতেই জানায়,

“গাড়ি ড্যামেজ হয়েছিল। সার্ভিসিংয়ের পাঠিয়েছি কাল চলে আসবে!”

ইয়ামিন শুধু সময় গুনতে লাগলো। একমাত্র সেই চিঠিটি তার সব রহস্য খুলতে পারে। মহুয়া নামের চিঠি প্রেমিকা আছে,তার ভালবাসা, অনুভতি, অনুযোগ এত ঠুনকো না। সে তার মহুয়াকে খুঁজে বের করবেই। ইয়ামিন আকাশের দিকে তাকালো,আর্তনাদ করে বলল,,

“কোথায় লুকিয়ে আছো তুমি! আমি জানি তুমি আমার বাস্তবতা। আমার কল্পনা নয়। প্লীজ কাম ব্যাক!”

———

সন্ধ্যা হয়েছে অনেকখন। আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে হুট করেই চারিদিকে স্ব স্ব বাতাস বইছে। সারা দিনের ভ্যাপসা গরম মলিন হয়ে মিষ্টি বাতাসে সতেজ করে তুলেছে চারপাশ। দূরের গাছ-পালা গুলোও বাতাসে সরলতায় মুগ্ধ হয়ে দোল খাচ্ছে যেন। কেউ কেউ মিষ্টি বাতাস গায়ে মাখাতে ঘর ছেড়ে বাহিরে বের হয়েছে। কিছুক্ষণের মাঝেই যেন আকাশের বুক চিঁড়ে নেমে আসবে হিমশীতল বাড়িধারা। মহুয়া যেন তারই অপেক্ষাতে ছাঁদের কার্নিশ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। এলো-মেলো চুল গুলো বাতাসের তালে তাল মিলাচ্ছে। মহুয়া তাকিয়ে আছে দূরের সেই দোল খাওয়া গাছের দিকে। সারা দিনের ক্লান্ত শরীর আর ঘন কালো মেঘের ন্যায় জমে থাকা কষ্ট মুছে ফুরফুরে করে দিচ্ছে মুহুর্তে। মহুয়ার বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। চোখের কোনের জল ছলছল করে উঠলে গড়িয়ে টুপ করে ঝড়ে যেতে পারলো না। ইচ্ছে করলেও মন খুলে হু হু কান্নার করতে পারেনা। তার বেলায় যেন নিষিদ্ধ কান্না করা। তাহলে যে বলে, ” কিছু হলেই মেয়েরা কাঁদে! কান্না নাকি মেয়েদের অস্ত্র! “কই তার বেলা এই অতি সত্যটি মিথ্যা কেন হয়ে যায়??

পুরো দুনিয়া আলোকিত করে ভয়ংকর এক বাজ পড়লো কোথাও। নিচ থেকে জাহানারার কন্ঠ ভেসে আসতেই নেমে যেতে গিয়েও থেমে গেলো মহুয়া। ততক্ষণে বৃষ্টি আকাশের বুক চিঁড়ে নিচে নেমে আসচ্ছে ফোঁটা ফোঁটা। বৃষ্টির গরম ফোঁটা মাহুয়ার শরীর-ও ভিজিয়ে দিচ্ছে যেন। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই মহুয়ার। না আছে এখন নেমে যাওয়ার তারা। মহুয়া তাকিয়ে আছে ছাদের কার্নিশে উড়ে এসে মাত্রই বসা শুভ্র পলকের একটি কবুতরের দিক। মাহুয়া ধীরে পায়ে এগিয়ে গেলো। বৃষ্টিতে ভিজা থেকে রক্ষা করতেই কোলে তুলে নিলো কবুতরটিকে।মনে পরে গেলো তার হাজারো স্মৃতি, ভালোবাসা, আবেগ অনুযোগ। সে কবুতরটি চিলেকোঠার ঘরে রেখে নেমে এলো। বুকে মাঝে চাপা কষ্ঠে দু ফোঁটা জল মনের অজান্তেই গড়িয়ে পরলো। ইয়ামিনের জন্য মন পুড়ে ছাই হচ্ছে। আচ্ছা? ইয়ামিন কি তাকে খুঁজবে? নাকি সে সত্যি ভুলে যাবে তার মরিচীকা কে??

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে