যুগলবন্দী পায়রা পর্ব-১০

0
868

#যুগলবন্দী_পায়রা🕊️
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
#পর্ব-১০
মল্লিক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইয়ামিন আর মহুয়া। দোতলা পাকা দালানটি পুরে কালো ছোপ ছোপ দাগ লেগে আছে। দূর থেকে দেখে ভুতুড়ে বাড়ি বলে মনে হচ্ছে। এই গ্রামের লোকেরা নাকি বাড়িটিকে ভুতের বাড়ি হিসেবে চিনে। মজা কথা হচ্ছে এখানে এসে বাড়িটির কথা এক বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করতেই তার মুখ আতঙ্কে এতটুকু হয়ে গেছে। বিড়বিড় করে বুকে থুতু দিয়ে আতঙ্কিত কন্ঠে তিনি জিজ্ঞেস করেছেন,

“বাবা ওখানে কেন যাইবা? ওটাতো ভুতের বাড়ি। গাছের পাতায় পাতায় ভুত। বাড়ি আনাচে কানাচে ভুত। ”

ইয়ামিন কঁপাল কুঁচকে ফেললো। ডিজিটাল যুগে এসেও এরা ভুত বিশ্বাস করে? ব্যপারটা খুবই অদ্ভুত। ইয়ামিন বলল,,

“আপনি ভুত দেখেছেন?”

লোকটি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললেন,

“আমি দেখি নাই। আমার ভাই দেখেছেন। বাড়ির ভিতর মেয়ে ছেলে হেসে, খেলে বেড়ায়, গান করে। মাঝে চোখ ও মারে।!”

“ভুত চোখ মারে?”

“হে মারে!”

“আপনাকে মেরেছে?”

লোকটি খুশি খুশি কন্ঠে বললেন,

“নাহ্ আমার ভাইকে মেরেছে!”

ইয়ামিন বিরক্তবোধ করলো। শক্ত গলায় বলল,,

“আপনি অতিরিক্ত কথা বলেন! যার কোনো ভিত্তি নেই। এ যুগে ভুত টুত নেই। আর থাকলেও আমরা তার সাথে কথা বলে আসবো। পারলে দাওয়াত করবো। এবার রাস্তা দেখান!”

বৃদ্ধার মুখ চুপসে গেলো, বড্ড আফসোসের সাথে বলল,

“জোয়ান ছাওয়ালপাওয়াল টগবগ শরীর। ডরভয় নাই। আমরাও ছিলাম এখন নাই। বয়সের সাথে সব ফুস। ”

ইয়ামিন এবার রাঙ্গানিত দৃষ্টিতে তাকাতেই লোক পথ দেখিয়ে উল্টো পথে হাটা ধরলো। ইয়ামিন সেদিকে তাকিয়ে ছোট শ্বাস ফেললো। গ্রামের মানুষ গুলো একটু বেশিই কথা বলে। এদের ক জিগ্যেস করলে ঁ বিন্দু পর্যন্ত বলে দেয়। মহুয়া ততক্ষণে ঘাট থেকে উপরে এসে সাথে দাঁড়ালো। ইয়ামিন এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। মেয়েটি কেঁদে কুটে কি হাল করেছে মুখের। তাতেও যেন সুন্দর লাগচ্ছে তাকে। খুব সুন্দর, ভয়ঙ্কর সুন্দর। মহুয়া ভাঙা গলায় বলল,,

“ঠিকনা পেয়েছেন?”

“হে!কিছুটা হাটতে হবে!”

ইয়ামিনের পিছু পিছু এলো মহুয়া। মল্লিক বাড়ি চৌকাঠ পরোতেই হু হু করে কেঁদে উঠলো। বুকের ভেতর যেন ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে।বাড়ির প্রতিটি ইট যেন চিৎকার করে মহুয়াকে বলছে, “ওহে পত্র প্রেমিকা তুমি এসেছো? এসেছো আমার বুকে?”

ইয়ামিন সুক্ষ্ম ভাবে তা লক্ষ করছে। মেয়েটি কাঁদছে। কান্নার শব্দেই। শরীর কাঁপাচ্ছে শুধু। ইয়ামিনের আজ বড্ড মনে পড়চ্ছে তার প্রাক্তনের কথা। ইয়ামিন প্রথম প্রেমে পড়েছিলো জেবিন নামের একটি মেয়ের সাথে। চুটিয়ে প্রেম চলেছিলো তাদের। ঢাকা শহর দাপিয়ে বেড়াতো তারা। জেবিন ছিলো ময়মনসিংহের। তাদের সম্পর্কে যখন ৩ বছর পূর্ণ হবে তার আগেই ঘটলো দুর্ঘটনা। বাড়ি থেকে ফিরার সময় বাস এক্সিডেন্টে হারিয়ে গেলো জেবিন। সেদিন ঠিক এভাবেই কেঁদেছিলো ইয়ামিন। পুরোনো স্মৃতি ভেসে উঠতেই চোখ দুটি ভিজে উঠলো ইয়ামিনের। কষ্ট গুলো গোপন করে এগিয়ে এলো মহুয়া কাছে, মহুয়ার মাথায় আলতে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,,

“মিস মহুয়া দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামচ্ছে। দিনের অবস্থাও ভালো না। এবার আমাদের যেতে হবে। ”

মহুয়া মাথা নাড়লো। মেয়েটির মুখে আজ রা নেই। তারা কিছুক্ষন হেটে ঘাটে এসে দাঁড়ালো।ঘাটে মাঝি নেই। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ইয়ামিন ফোনের ফ্লাশ লাইট ওন করলো। দূর দূর পর্যন্ত মানুষ নেই। এর মাঝেই বিপদ বাড়াতেই হুড়মুড় করে নামলো বৃষ্টি। এবার যেন ইয়ামিন পড়লো গভীর অথৈ জলে। একলা একটা মেয়েকে নিয়ে এত রাতে কই ঠায় নিবে? ভাবতেই মহুয়ার কন্ঠ ভেসে এলো। মহুয়া ছাউনি ওয়ালা এক নৌকা থেকে ডাকচ্ছে। ইয়ামিন দৌঁড়ে গেলো। দুজনেই হাঁপাচ্ছে। তাদের মাঝে কোনো কথা নেই। পিনপতন নিরবতা। শুধু শোনা যাচ্ছে বৃষ্টি শব্দ৷ মেঘের গুরগুর শব্দ। নিরবতা ভেঙ্গে এবার মহুয়াই কথা বলল,

“আপনাকে ধন্যবাদ। আমার জন্য এত কষ্ট করলেন।”

ইয়ামিন কিছু বলল না। ঠোঁটে হাসি নিয়ে ভেজা চুল টানতে লাগলো। মহুয়া আবার বলল,

“আচ্ছা আপনার সম্পর্কে আমিতো কিছুই জানি না? কিছু বলুন?”

ইয়ামিনের দাম্ভিক মুখখানায় আবারো হাসি ফুঁটে উঠলো।বলল,

“আমি একজন মানুষ। এটি আমার প্রথম পরিচয়।”

মহুয়া হেসে দিলো। বিষন্ন মুখটি এবার যেন একটু আলোকিত হলো। ইয়ামিন বলল,,

“এবার কি করবেন?”

মহুয়া মুখে আবারো বিষন্নতা ছেয়ে গেলো। দূরের অন্ধকারে তাকিয়ে থেকে বলল,

“যার জন্য বাড়িঘর ছেড়ে এসেছি! সে তো নেই। আর কি করবো। ফিরে যাবো!”

“আপনার বাসায় সবাই মেনে নিবে?”

“নিবে না টিক। কিন্তু ফেলবেও না। আমার বাবা বাহিরে শক্ত কিন্তু ভিতরটা নরম।”

ইয়ামিন হাসলো। বলল,

“বাবারা হয়ই এমন!”

দুজনের মাঝে কিছু কথা চললো মাঝ রাত পর্যন্ত। বৃষ্টির বেগ তখন কমে নি। যাওয়ার মতো জায়গাও তার পাচ্ছি লো না। আজো একটি বর্ষণের রাত কাঁটাতে হলো খোলা আকাশের নিচে।নদীর বুকে এক ডিঙ্গি নৌকার মাঝে। সময় যেন সেখাই থেমে গেছে তাদের। সামনের আসা বড় ঝড়ের কেউ অবগত নয়। ভাবতে ও পারবে না। সময় তাদের কত দূর নিয়ে ফেলবে। রাতটি কোনো মতে কেঁটে গেলো। ভোড়ে আলো ফুঁটে উঠলো চারিদিক। কাক ডাকা ভোরে শুধু পাখি না শোনা গেলো মানুষে গুঞ্জন। তাদের কিছু তিক্ত কথা কানের পর্দায় পৌঁছাতেই ঘুম ছুটে মহুয়ার। নিজেকে ইয়ামিনের বুকে আবিস্কার করে ভরকে গেলো। চটজলদি উঠতে গিয়ে ভেসে উঠলো কৌতূহল পূর্ণ কয়েকটি মুখ। ভেসে আসলো কিছু তুচ্ছতাচ্ছিল্য বাক্য। ইয়ামিনকে ঝাকিয়ে তুললো এবার মহুয়া। ইয়ামিন যখন উঠলো তখনি একজন বলে উঠলো,

“ফষ্টিনষ্টি করার জন্য আমার নৌকাই পাইছিলা? এসব এই গ্রামে চলবো না। মাতবর ডাকো তোমরা!”

মুহূর্তেই অজানা, অচেনা ভয় ঝেঁকে বসলো মহুয়াকে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসচ্ছে তার। ইয়ামিন নিজেো হতবিহবল। কিছু বলবে তার আগেই কিছু লোক নৌকা থেকে টেনে নামালো ইয়ামিন কে। আর দুজন ধরলো মহুয়াকে। নিয়ে গেলো তাদের এলাকার মাতবরের কাছে। মাতবর গ্রামবাসিকে বুঝিয়ে বিদায় করলেন। মহুয়া একটি ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছে, সে ফুপিয়ে কাঁদচ্ছে আর দরজা ধাক্কাচ্ছে ।ইয়ামিনকে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার মুখ খোলা। সে বার বার বলছে,

“আপনাদের ভুল হচ্ছে? আমাকে কিছু বলতে দিন?”

মাতবর ধমকে উঠে বললেন,,

“নষ্ট ছেলে মেয়েদের আবার কি কথা? বাহির থেকে আইসা আমার এলাকা নষ্ট করবা? আমি ছাইড়া দিবো?”

ইয়ামিন চেতে গেলো। গলা ছেড়ে বলল,,

” আপনি আমাকে চিনেন না? চিনলে এসব বলার সাহস পেতেন না! ”

মাতবর বললেন,

“পোলার দেমাক দেখছো? দোষ করছে আবার বক বক করে? সাহস কত??”

ইয়ামিন দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

” আমরা এখানে আজে বাজে কাজ করতে আসিনি। মল্লিক বাড়ি এসেছিলাম। ফিরার সময় ঘাটে মাঝি ছিলো না। বৃষ্টি পড়ছিলো নৌকায় অপেক্ষা করছিলাম আমরা!”

মাতবর হু হা করে হেসে উঠলেন। যেন কৌতুক বলছেন। বললেন,

“চোরের মার বড় গলা!”

ইয়ামিন ক্ষেপে গেলো। গলা উঁচিয়ে বলল,

” আপনার মতো ফালতু লোক আর একটাও দেখিনি। আপনি জানেন না? আমার একটা পোনে আপনার মাতবর গিরি ছুটে যাবে?”

মাতবর রেগে এক থাপার মারলো ইয়ামিনকে। ইয়ামিন থেমে নেই হিংস্র বাগের ন্যায় তাকিয়ে বলল,,

“একটা ফোন করতে দে। দেখ তোর কি হাল করি?”

মাতবর তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। নবজের জায়গায় বসে তার সহকর্মীকে জিজ্ঞেস বললেন,

“এ পোলার ডিটেইলস বের কর!”

কর্মী তাই করলো। আদ ঘন্টার মাঝে জানালো। বান্দরবানের এমপির নাতি হচ্ছে ইয়ামিন। মাতবরের ঠোঁটে শয়তানী হাসি ফুঁটে উঠলো। কর্মীকে ফিসফিস করে বলল,

“কাজী ডাক। প্রতিশোধ নিয়ার সঠিক সময় এখন!”

লোকটি তাই করলো। মিনিট দশকের মাঝে ফিরে এলো কাজি নিয়ে। মাতবর হাঁক ছেড়ে বললেন,

“এক শর্তে তোমারে ছাড়তে পারি বাবা! হয় নষ্ট মাইয়ারে বিয়া করো? ”

ইয়ামিন সাথে সাথে নাকচ করলো,

“এই বিয়ে আমি করতে পারবো না? আর ও নষ্ট মেয়ে নয়। মুখ সামলে কথা বলুন!”

মাতবর হাসলেন। একজন মহিলাকে ইশরা করলেন মেয়েটিকে আনতে। মহিলাটি আসতেই মাতবর মহুয়ার শরীরে দিকে বিশ্রী ভাবে চাইলো। বলল,

“বিয়া করো নইলে, আমার দাসী বানায় রাখবো। আর তোমাকে আমার লোকজন ওই পারে দিয়া আসবে!”

ইয়ামিনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সে কি বলবে? কি করবে ভেবে পাচ্ছে না! মহুয়া অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। মাতবরের পায়ের কাছে বসে বলল,

“উনাকে ছেড়ে দেন! উনার কোনো দোষ নেই। উনি আমাকে সাহায্য করতেই এত দূর এসেছেন। প্লীজ এত বড় শাস্তি দিবেন না!”

মাতবরের দয়া হলো না। উল্টো তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

“নষ্টামি করার পর ধরা পড়লে এমন ন্যাকামি সবাই করে! কি গো বাবাজী? চুপ কেন? বিয়ে করবা? নাকি তারে আমি আমার কাছে রাইখা দিমু? আমার অবশ্যি ছোট মাইয়াগো উপর টান বহুত।”

ইয়ামিনের গা জ্বলে উঠলো। মাতবরে মুখে থুতু মেরে বলল,

“তোর মতো জানোয়ার এই গ্রামের মাতবর কিভাবে হতে পারে? আমি তোকে জেলের ভাত না খাইয়া ছাড়ছি না!”

মাতবর ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগলেন। বললেন,,

” নিজে নষ্টামি করলে দোষ নাই আমি করলেই যত দোষ? এটা তো ঠিক না? আমারো তো কচি মাল ভালো লাগে!”

মাতবরের কথা গা গুলিয়ে এলো মহুয়ার। চোখ বন্ধ করে বসে রইলো সে। ইয়ামিন মহুয়ার দিক এক পলক তাকিয়ে বলল,

“আমি বিয়েতে রাজি!”

চলবে

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে