যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৬৪(শেষ)
আফনান লারা
পান্নাকে পাবার জন্য কত বছর পরিশ্রম করে আজ এই পর্যায়ে গিয়ে কিনা পান্নার বিয়ে দেখতে হবে অন্য কারোর সাথে?
সকলে এমন ভাব করছে যেন রিদম এখনও সেই ছোট রিদমই আছে,যে নিজেকে রিত্তিক,সালমান খান,শাহরুখ খান মনে করতো।আজ তার মাঝে বিদ্যমান ম্যাচিউরিটি,সুবোধ,আবেগের বদলে বাস্তুবিকতা।এই পর্যায়ে এসে কি সে দেখবে পান্না অন্য কারোর?
সেইদিন সারাটা রাত ধরে রিদম ঘুমায়নি।তার অসহ্য লাগছে সব।সহজ করে দেখলে বিষয়টা সহজ হবে কিন্তু মনে হয় সহজ সহজ করেও বিষয়টা বড়ই জটিল।
গিয়াস সাহেবকে ব্যাংক ব্যালেন্স শুনিয়ে রাজি করাটা এক মিনিটের ব্যাপার।কিন্তু জানা দরকার পান্না কি চাইছে।সে কি রিদমকে পেলে খুশি নাকি সাবিদ হলেও তার চলে।
রিদমকে তার স্পেশালি কেন লাগবে সেটা জানা খুব দরকার।কিন্তু আগের চেয়ে পান্নার লজ্জাবোধ একটু বেশিই হয়ে গেছে বলে মনে হয়।
ইশান দুলাভাই থাকলে এটা খুব ইজিলি ক্লিয়ার করা যেতো,এখন এটা সম্ভব না কারণ ইশান ভাইয়াকে না জানিয়ে সে দেশে এসেছে।নিশ্চয় উনি রেগে আগুন হয়ে আছেন।কি করা যায়!
ভাবতে ভাবতেই রিদম ঘুমিয়ে পড়ে।তখন বাজে ভোর পাঁচটা।
জাপানের একটি বিমান বাংলাদেশে এসে পৌঁছায় সেই মূহুর্তে।
তানিয়াকে তিথি জানিয়েছে তাদের আসার কথা।কিন্তু রিদমকে জানাতে মানা করে দেয়া হয়।
তিথি আগে ওর শ্বশুর বাড়ি যাবে।শাশুড়ি অসুস্থ
তাকে দেখা জরুরি।
সকাল দশটা বাজার পরেও রিদম উঠছিলনা বলে,তানিয়াই ওকে উঠিয়ে দেয়।রিদম ঘুম থেকে ওঠার পর তার হুশ আসে পান্নার সাথে কথা বলার কথা।
তড়িঘড়ি করে সে তৈরি হয়ে নেয়।কিছু না খেয়েই বেরিয়ে পড়ে পান্নাদের বাসার দিকে।কিছুদূর যেতেই সে দেখে মাইক্রো কতগুলা আসছে এদিকে।সম্ভবত গাড়ীগুলো পিংকির শ্বশুর বাড়ি যাবে,আজ তো তার বৌভাত।
রিদম একটা গাড়ীর ভেতর সামনের সিটে পান্নাকে দেখতে পায়। ওমনি সে গাড়ীটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গাড়ীটাকে থামিয়ে দেয়,এরপর পান্নার পাশের দরজা খুলে ওকে গাড়ী থেকে বের করিয়ে গাড়ীর ভেতর মাথা ঢুকিয়ে দেখে পান্নার দুইজন খালা আর খালু, আরও অন্যান্য আত্নীয়ারা বসে আছেন।
‘সবাইকে হাই/হ্যালো।আমি রিদম,পাশের বাসায় থাকি।পান্নার সাথে আমার বিবাহসূত্রীয় কিছু আলাপ আছে,আমি তাকে যথাসময়ে পাঠিয়ে দিব।এই খবর যেন গাড়ীর বাহিরে না যায় তার জন্য এই নিন দু হাজার টাকা।আঙ্কেল এই টাকা দিয়ে গাড়ীর সবাইকে এক প্লেট করে ফুচকা খাওয়াই দিবেন।টাটা’
এটা বলে রিদম সবাইকে চলে যেতে বলে পান্নাকে নিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা ধরে।
‘আচ্ছা আমরা কোথায় যাচ্ছি?এটা কি ঠিক হলো?’
‘হ্যাঁ,খুব খারাপ হলো।আর কিছু বলবে?’
‘নাহ’
রিদম হাঁটতে থাকে।যতদূর গেলে নির্জনতা পাওয়া যাবে ঠিক ততদূর।পান্না ভারী লেহেঙ্গা পরেছিল বলে হাঁটতে পারছিলনা ঠিকমত, কিন্তু রিদম ওসব ভাবছেনা,তার দুচোখ প্রশান্ত পথ খুঁজে চলেছে।
একটুদূর আসার পর রিদম থামে,ফলে পান্নাও থেমে যায়।
আশেপাশে কেউ নেই, জনমানবশূন্য পথ।রিদম পান্নার দিকে হঠাৎ করে তাকায়।পান্না ভয় পেয়ে গেলো আবারও।রিদমকে আগে এতটা ভয় লাগতোনা যতটা এখন ভয় লাগছে।ও এমন কেন?সুন্দর করে,মায়া চোখেও তো তাকানো যায়,আশ্চর্য!
‘আমাকে বিয়ে করবে?’
‘কিই???’
‘কিই?এটার উত্তর হ্যাঁ কিংবা না তে দিবে। কিই আবার কি?’
‘না আসলে….’
‘না?জানতাম!একজনকে দশ পনেরো বছর খাটিয়ে পরে রেডিমেড কাউকে বিয়ে করাই হলো তোমাদের মেয়েদের কাজ!’
‘আরেহ ক্ষেপছেন কেন?আমি বুঝতেছিনা এখন এটা কেন জানতে চাইছেন?’
‘এখন জানতে চাইবোনা তো কি তোমার বিয়ে হয়ে যাবার পর জানতে চাইবো?’
পান্না পা দিয়ে কঙ্করের পথটাতে ঘঁষতে থাকে,নিরব পরিবেশ থাকলেও হুট করে একটা যক্ষ্মা রুগী ওখানে এসে হাজির।হাওয়া খেতে এসেছেন।কপোত কপোতী দেখে আর যাবেন না।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবেন আর কথা শুনবেন আর কাশবেন।
রিদম কাশিতে বিরক্ত হয়ে ছেলেটার গলা চেপে ধরে বললো,’যক্ষ্মাতে শুনেছি রোগী মরেনা,চিকিৎসা করলে ভাল হয়ে যায়।কিন্তু আমি তো তোকে এখানেই মেরে দিবো।সুন্দর একটা সময়,জরুরি কথার সময় ডিস্টার্ব করতে ভাল লাগে তোর?’
ছেলেটা রিদমের থেকে ছাড়া পেতেই কাশতে কাশতে চলে গেলো এক দৌড়ে।পান্না অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল।উত্তর তার মুখের কাছেই চলে এসেছে কিন্তু সে বলবেনা।
ঐ সময়ে পান্নার হাতে থাকা ফোনটা বেজে ওঠে।বাবার কল,রিদম কলটা দেখে চুপ করে থাকে,পান্না রিসিভ করার পরপরই শোনা গেলো,’পান্না রে জলদি আয়,সাবিদের চেয়ে জাক্কাস একটা ছেলের সন্ধান পেয়েছি।তারা এই বৌভাতের অনুষ্ঠানেই আসছে,পিংকির শ্বশুর বাড়ির আত্নীয় সম্ভবত,তোকে দেখলেই নাকি বিয়ে পাকা করবে।তাদের ছেলের পছন্দ অপছন্দ নাই,তারা যেটা বলবে সেটা।’
পান্না রিদমের দিকে তাকায়।রিদমের মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে সবটা শুনেছে।কলটা কাটা যেতেই রিদম ওকে ধরে একটা সিএনজিতে উঠলো।পান্না ভাবলো এই বুঝি পালিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে।কিন্তু নাহহ,সে দেখতে চায় পান্না তার বাবার মুখের উপর না করার সাহস পায় কিনা,বাবার পছন্দ আর রিদমের মাঝে কোনটাকে সে বেছে নিতে পারে সেটাই দেখতে রিদম ওকে নিয়ে পিংকির শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয়েছে।
পুরোটা পথে কোনো কথাই বলেনি রিদম।ঐ বাসার কাছে আসতেই সে নেমে যায় ভাড়া দিতে।
পান্না চুপচাপ বাসার ভেতরে ঢোকে,ঢুকতেই মা পেছন থেকে এসে ওর গায়ের ওড়না মাথায় তুলে দিলেন,এরপর হাসতে হাসতে সোফায় বসা সাতজনের একটা দলকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন এই হলো পান্না,তাদের আদরের ছোট মেয়ে।সাতজনের মাঝে তিনজন মেয়ে আর চারজন ছেলে।সকলকে দেখে বাহিরের দেশের মনে হচ্ছিল,পোশাক আশাকে অন্যরকম ভাব।ছেলেদের বড় বড় দাঁড়ি আর মেয়েদের মাথায় বড় বড় ঘোমটা।
পান্না মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো নিঃশব্দে।সোফা থেকে উঠে এসে একজন হঠাৎ করেই ওর আঙ্গুলে রিং ও পরিয়ে দেয় এক মিনিটের ব্যবধানে।পান্নার চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকলো।চোখে পানি থাকতেই সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় মেঝেতে।রিদম বাহিরে থেকে ভেতরের হট্টগোল শুনে দেখতে এসে দেখে সবাই পান্নাকে নিয়ে ব্যস্ত।
‘এ কেয়া হুয়া,লারকি জ্ঞান কিঁও হারাইয়া’🐸
‘আপ চুপ রাহিয়ে,আপকি বাজাছে এসাব হুয়া।কেয়া দরকার থি রিং পরানেকি’
কাপলটির আবোলতাবোল হিন্দি শুনে রিদম ওদের মুখের দিকে তাকায়।কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।
তাও ওসব বাদ দিয়ে সে হাঁটু গেড়ে বসে পান্নার পাশে।
এরপর তাচ্ছিল্য করে বলে,’এমনই হবার কথা ছিল।বাবার বিরুদ্ধেও যাবেনা আর আমাকেও না বলতে পারবেনা।পারবে শুধু জ্ঞান হারাতে।করো তুমি বাবার পছন্দের বিয়ে।আমি গেলাম,বিদেশে সুন্দরীর অভাব নাই,তাও করলাম না বিয়ে।বিয়ে না করলো তো আর মরে যাবোনা’
এই বলে রিদম উঠে দাঁড়াতে যেতেই পান্না চোখ মেলে হাত বাড়িয়ে ওকে আটকায়,এরপর উঠে বসে ওকে সবার সামনে জড়িয়ে ধরে বলে,’নাহ!আমি পারবোনা এটা।আমি অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা কখনও ভাবিনি বিশ্বাস করুন।তারপরেও দেখেন সবাই কি তোড়গোড় করছে।বাবাকে বুঝাতে পারছেন না???আপনি নিজেও তো বাবাকে ভয় পান।আর দোষ কেবল আমাকে দিয়ে চলেছেন।এটা অন্যায়’
পান্নাকে দেখতে আসা সেই পরিবারের একজন বলে ওঠে,’হা এ বহুত বাড়া অন্যায় হুয়া।আব উচিত সাদি কারওয়াকে দোনোকো বিদায় দে দেনা’
‘উফ!আপনি থামুন তো,তখন থেকে উল্টোপালটা হিন্দি বলেই যাচ্ছেন।কেমন পাত্রপক্ষ আপনারা?মেয়ে দেখতে এসে দেখলেন মেয়ের আরেক জায়গায় লাইন আছে।মেয়ের বাবাকে দু চার লাইন কথা শোনাতে পারেননা?আবার আমাদের বলছেন চলে যেতে বিয়ে করে!’
গিয়াস সাহেব তখন রেগে মেগে বললেন,’আমি কিছুতেই রিদমের সাথে আমার কলিজার টুকরার বিয়ে দিবো না।এ হতে পারেনা’
‘আগার,, ও হামারা শালা হুয়া তো??’
এ কথা শুনে গিয়াস সাহেব পেছনে মুড়ে দেখলেন পাত্রের দুলাভাই পরিচয় দেয়া লোকটি তার নকল দাঁড়ি,পাগড়ী খুলছেন।
‘ইশান?’
‘জ্বী,আর এই রিদমই আমার সেই শালা যার গুনকীর্তন এতক্ষণ গাইছিলাম’
রিদম ওদের সবার আসল রুপ দেখে পান্নার পাশে বসে গেছে মেঝের উপর।সব মাথার উপর দিয়ে গেলো।তবে এত সবের মাথে একটা কাজ হলো,তা হলো পান্না স্বীকার করেছে তার ভালবাসার কথা।
যদি তুমি বলো নামটা সার্থকতা পেয়েছে সবেমাত্র।
গিয়াস সাহেব গাল ফুলিয়ে বসে পড়লেন ইশানদের সাথে আসা বাকি লোকজনদের পাশে।
‘আপ বহুত আচ্ছা হে,হামারা লারকে কো ইতনি জালদি মান লিয়া’
‘কচু মান লিয়া!আমি এখনও মান লিয়া করি নাই।’
ইশান হাত ভাঁজ করে বললো,’রিদমের কিছু নাই বলে,ওর চালচুলো নাই বলে ছোট থেকেই ওকে অবহেলা করেছেন।তাই আমি ওকে অল্প বয়স থাকতেই নিয়ে গিয়েছিলাম সবার থেকে দূরে।এত গুলো বছর শুধুমাত্র আপনার মেয়ের জন্য সে পরিশ্রম করে গেছে।আপনি আমায় বলেছিলেন আমার আনা সেইই ছেলেটির সাথেই পান্নার বিয়ে দিবেন।এখন রিদম সেই ছেলে শুনে আপনি পিছু হটছেন?’
গিয়াস সাহেব অনেক ভেবে বললেন,’আমার মেয়েকে দেখতে পারবোনা বছরের পর বছর।তাই রাজি হতে মন সাঁই দিচ্ছেনা’
ইশান পকেট থেকে একটা খাম বের করে ওনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,’মেয়েরা যৌতুক দেয় শুনেছিলাম,আমি না হয় ছেলের হয়ে যৌতুক দিলাম’
গিয়াস সাহেব ভ্রু কুঁচকে খামটা খুলে দেখলেন ভেতরে পাসপোর্ট আরও কতগুলো কাগজপত্র।
‘এগুলা তো পেন্ডিং ছিল এত বছর।কে রিনিউ করলো?
আচ্ছা আমি জাপান যাবো নাকি?’
‘যখন ইচ্ছা তখনই ফ্লাইট ধরে চলে আসবেন,তাও আন্টিকে সাথে নিয়ে।খরচ আপনার হবু মেয়ে জামাই দিবে।বেতন তো তারে কম দেই না’
‘তাও আমি রাজিনা😏,আমাকে কি আপনাদের লোভী মনে হয়?আমার এত লোভ নাই।
কিন্তু আমার কর্মচারী কুদ্দুসকে বিদেশ না নিলে আমি বিয়া দিতাম না’
হাসির হট্টগোল পড়ে গেলো।রিদম পান্নার হাতটা ধরতেই তার ডান হাতে কলম দিয়ে লেখা একটা লাইন দেখতে পায় পান্না।তাতে লেখা “যদি তুমি বলো”
♥সমাপ্তি♥