যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৪
আফনান লারা
তিথি হাতে এতটাই ব্যাথা পাচ্ছিল যার কারণে সে ইশানের থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নেয় তৎক্ষনাৎ।কিন্তু তার এই কাজে যেন ইশান একটা সুযোগ পেয়ে যায়।ওমনি সে গাড়ীটা স্টার্ট দিয়ে তিথির চোখের সামনে দিয়ে উধাও হয়ে গেলো।
তিথি হাত ঝাড়তে ঝাড়তে ইশানের চোখ দুটো কল্পনা করছে।ওর মাথার রক্তের কারণে চোখ দেখেও আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারেনি তিথি।তবে খারাপ লাগলো সে অনেক বেশি আঘাত দিয়ে ফেলেছে ভেবে।
তার এই হাতের ব্যাথার কাছে ঐ ছেলের মাথা ফাটা আরও অনেক বেশি!
তিথি ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিল,ওমনি তার হাতের ফোনটা বেজে ওঠে।বাবার নাম্বার থেকে কল।
তিথি শুরুতে ভয় পেয়ে যায়।সুরাইয়াদের গেইটের পাশে থাকা সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে ঢোক গিলে সে কলটা রিসিভ করে।
ওপাশ থেকে বাবা বলে উঠলেন,’তিথি মা!মাফ করে দিয়েছি।চলে আয়’
‘সত্যি বাবা?আবার জোর করবেনা তো?’
‘জোর করতে যাবো কেন!তোর বোন তানিয়াকে রকিবের পরিবার পছন্দ করেছে,এখন তারা আমার ছোট মেয়েকেই বউ করে নিয়ে যাবে বলে সকলে সম্মতি দিয়ে রিং পরিয়ে চলে গেছে’
তিথি মাথায় হাত দিয়ে ফেললো এ কথা শুনে।রিদমের মুখ থেকে তানিয়ার কৃতকলাপ শুনে সে ভেবেছিল তানিয়া ঠাট্টা করছে।কিন্তু সে যে এরকম সত্যি সত্যি বিয়েটা পাকাপোক্ত করে নেবে তা তিথি কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি।
যাই হোক!এক দিক দিয়ে ভালই হলো।তিথিকে আপাতত কয়েক মাস কেউ জোরাজুরি করবেনা বিয়েতে।
এই খুশিতে তিথি এক ছুটে সুরাইয়ার বাসায় ঢুকে তার ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে ভাবে সে এখন গেলে এত বড় বাসার দরজা লক করবেটা কে!
পরে তার মনে পড়লো সুরাইয়া তিথিকে একটা এক্সট্রা চাবি দিয়ে গেছিলো,প্রয়োজনে বের হতে চাইলে যাতে বের হতে পারে।তাই সে ঐ চাবি দিয়ে বাসার দরজা লক করে বের হয়।কিন্তু এত রাতে রাস্তায় একটা রিকশাও তার চোখে পড়েনা।তিথি মনে মনে ভাবছিল ইশানের কথা,ওমনি তার সামনে এসে দাঁড়ায় ইশানের গাড়ী।তিথি ভয় পেয়ে যায় প্রথমে তারপর নিজেকে ঠিক করে সে গাড়ীর ভেতর তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে।গাড়ীতে এখন অন্য একটা লোক বসা।
লোকটা তিথির দিকে চেয়ে বললো উঠতে।তিথি তখন মানা করে দেয়।তখন সেই লোকটি বলে তাকে বলা হয়েছে তিথিকে তার বাসায় দিয়ে আসার জন্য।
কিন্তু তিথির ভয় হতে লাগলো তাই সে নাকচ করে দেয় আবারও।সে কিছুতেই যাবেনা।
তিথির এতবার করে মানা করে দেয়ায় গাড়ীটা চলে যায়।এর ঠিক পাঁচ মিনিট পর একটা সিএনজি আসে সেই রোড দিয়ে।তিথি খুশি হয়ে ঐ সিএনজিটাই ভাঁড়া করে।
কিন্তু সে জানেনা সিএনজিটা ইশানের পাঠানো।
সিএনজিতে করে তিথি তার বাসায় পৌঁছায় খুব দ্রুত।সেখানে এসে দেখে সকলের মুখে মুখে হাসি।এভাবে তাদের সম্মান বেঁচে যাবে তারা কেউই ভাবতেই পারেনি।পাত্রপক্ষ চলে গেছে একটু আগে।
তানিয়া নতুন বউয়ের মতন বসে বসে হাতের আংটিখানা দেখে চলেছে।তিথিকে কেউ পাত্তাই দিচ্ছেনা।তিথি মুখ বাঁকিয়ে তার রুমে যাওয়া ধরতেই দেখে রুমটা ভেতর থেকে বন্ধ।
দরজায় লেখা—–
“”””
আপনি ভু্ল জায়গায় এসেছেন।এই রুমটি এখন আর আপনার নেই।মনে আছে? আজ সকালে এগারোটা বারো মিনিটে সই করেছিলেন?দলিল দেখতে হলে ৫ চাপুন।দলিল দেখতে না হলে ৩ চাপুন। আর রুমে থাকতে হলে পা চাপুন’
তিথি দরজা ধাক্কিয়ে বললো,’এই রিদইম্মা!বাদাইম্মা!দরজা খোল!আমার ঘুম আসতেছে’
রিদম তখন বলে,’সরি!এখানে রিদম নামের কেউ থাকেনা ‘
তিথি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’মহারাণী ভিক্টরিয়ার নাতিন !দরজা খুলেন প্লিজ!’
ওমনি রিদম এসে দরজা খুলে বলে,’দলিলে লেখা আছে তুমি যদি বাসায় আবার ফিরে আসো তবে আমার পা টিপে দিবা ডেইলি পনেরো মিনিট।আর আমাকে রুহ আফজা মিল্ক শেক বানিয়ে খাওয়াবা সপ্তাহে সাতদিন’
‘করবো রে ভাই।থাম! ‘
এটা বলে তিথি রুমে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ে।শুতেই তার চোখে রাজ্যের ঘুম এসে যায়।
সকালে তিথির ঘুম ভাঙ্গে সুরাইয়ার কলে।তিথি ঘুম ঘুম চোখে কলটা রিসিভ করে কানে ধরতেই সুরাইয়া বললো আজ তাদের ইংরেজী ক্লাসে ম্যাম নাকি যারা অনুপস্থিত থাকবে তাদের সাময়িক পরীক্ষায় নাম্বার কমিয়ে দেবে।এটা শুনে তিথি লাফ দিয়ে উঠে বসে।তারপর ঘড়িতে দেখে আর আধ ঘন্টা আছে ম্যামের ক্লাস শুরু হবার বাকি।
তিথি জলদি উঠে ওয়াশরুমের দিকে ছোটে।দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে টেবিলের উপর থেকে ব্রেড আর কলা একটা নিয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সে বেরিয়ে যায়।যাবার সময় দেখা হয় বাবার সাথে।বাবা ওর একটু আগেই বেরিয়েছিলেন অফিসের জন্য।বাবা তিথিকে বললেন বাইকে উঠতে। তিনি ওকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দেবেন।
যাবার অনেকটা পথে বাবা চুপই ছিলেন।তিথি মনে করলো বাবা তার উপর রাগ করে আছেন।তাই কিছু সময় পর সে বললো,’আচ্ছা বাবা তুমি কি আমার উপর রেগে আছো?’
‘নাহ রে মা’
‘সরি বাবা’
‘ইটস ওকে।তুই তো জানিসই আমি তোকে সব স্বাধীনতা দিয়ে বড় করেছি।তাও কাল ভয় পেয়ে গেছিলাম।রকিবের পরিবারের সামনে কি করে মুখ দেখাবো সেইসব ভাবতে গিয়ে।কিন্তু আমার তানিয়া মা আমার মান রাখলো।এখন তোকে একটা কাজ দেবো।তানিয়া আসলে আমাদের সম্মান বাঁচাতে রকিবকে বিয়ে করতে চায় নাকি নিজের মতেই চায় সেটা তোকে জানতে হবে।জানিস তো,তানিয়া একটু অন্যরকম,ছোট কাল থেকেই। ওর মন বুঝতে আমার বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়।তাও বুঝিনা তার মনের ভেতর কি আছে।তুই মা আমার এই কাজটা করে দিবি?’
‘দেবো।করে দিলে,কি দিবে বলো?’
‘তোর পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিবো তোকে’
‘পছন্দ নেই বাবা’
তিথির মলীন মাখা সুরের কথাটি শুনে বাবা বললেন,’কেউ কষ্ট দিয়েছে মা?তবে একটা কথা শুনবি?কেউ যখন কারোর হৃদয় ভাঙ্গে,ঠিক তখনই অন্য একটা জায়গায় অন্য একটা মানুষের হৃদয় তৈরি হয় এই ভাঙ্গা হৃদয়টাকে জোড়া লাগাবার জন্য।তোর জন্য ও তাই আছে।ভাবিস না’
তিথি খুশি হলো বাবার কথা শুনে।খুশি মনে সে তার ডিপার্টমেন্টে আসা ধরতেই দেখে ম্যাম আসছে এদিকেই। এটা দেখে তিথি খুব দ্রুত ঢুকতে যায় ক্লাসে, ওমনি তার সাথে ধাক্কা লাগে একটা ছেলের।
ধাক্কা খেয়ে তিথি তার কালকে রাতের হাতের চোটে ব্যাথা পায়।তারপর বিরক্ত হয়ে বলে,’দেখে হাঁটতে পারো না!’
এটা বলে সে তাকিয়েই ছিল।কিন্তু যে ছেলেটা তাকে ধাক্কা দিয়েছে সে ওর দিকে আর তাকায়নি।সোজা গিয়ে একটা সিটে বসে পড়ে।তিথি হাত ঘঁষতে ঘষতে এসে সুরাইয়ার পাশে বসে আবারও তাকায় ছেলেটার দিকে।ছেলেটির মুখে মাস্ক ছিল।তখন তিথির মনে পড়ে সাবিনা ম্যাম মাস্ক নিয়ে অনেক কথা শোনান।এটা মনে পড়ায় সে ব্যাগ হাতায় কিন্তু কোনো মাস্ক পায়না,তার স্পষ্ট মনে আছে সে তার ব্যাগে মাস্ক সবসময় রাখে।
তিথি যখন এসব ভাবছিল তখন সেই ছেলেটা তার হাতে থাকা তিথির নীল রঙের মাস্কটা জানালা দিয়ে ফেলে দেয়।
তিথি তার মাস্ক ব্যাগের বাহিরে পিন দিয়ে আটকে রাখে।ছেলেটা তখন ধাক্কা দেয়ার সময় মাস্কটা নিয়ে নিছিলো।
সাবিনা ম্যাম ক্লাসে ঢুকে পুরো ক্লাসরুমে চোখ বুলিয়ে দেখলেন তিথি বাদে সবাই মাস্ক পরে এসেছে।
তখন ম্যাম ওকে দাঁড়াতে বললেন।
‘কি ব্যাপার তিথি?মাস্ক পরোনি কেন?’
‘ম্যাম মাস্ক আনতে ভুলে গেছি।আমার ব্যাগেই ছিল!কিন্তু এখন পাচ্ছিনা’
‘পুরোনো বাহানা।যাই হোক ক্লাস থেকে বের হও।বাহিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো ক্লাস এটেন্ড করবে’
তিথি মাথা নিচু করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকলো।
ম্যাম বই বের করে পড়ানোতে মন দিয়েছেন।সেই ছেলেটা এক দৃষ্টিতে তিথির দিকে তাকিয়ে ছিল।তার চোখে তিথির এই হাল দেখে আনন্দ ফুটছিল। সে এতটাই খুশি হচ্ছিল যে তার জোরে জোরে হাসতে মন চাইলো কিন্তু সে হাসবেনা!কাউকে বুঝতে দেয়া যাবেনা সে ইচ্ছে করে তিথিকে বকা খাইয়েছে ম্যামকে দিয়ে।
তিথি গাল ফুলিয়ে রেখে ম্যামের দিকে তাকিয়ে আছে।এভাবে আর কত তাকানো যায় বলে সে ক্লাসের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল আজ কারা কারা এসেছে।সবাইকে চিনলেও একটা ছেলেকে সে চিনতে পারলোনা।সেই মাস্ক পরা ছেলেটা।তখনই ম্যাম এটেন্ডেন্স ডাকলেন সে ছেলেটার।নাম ইশান আরাফাত।ম্যাম এটাও বললেন ইশান নতুন স্টুডেন্ট।
তিথি চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে ছিল।ছেলেটা তখন ওকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছে এটা সে বেশ বুঝতে পেরেছিল।
ম্যামের ক্লাস শেষ হবার পর তিথি এসে সুরাইয়ার পাশে বসে।তখন সুরাইয়া তার কালকে রাতের লং ড্রাইভ নিয়ে কথা বলা শুরু করে।তিথির মন সেদিকে নয় বরং ইশানের উপর ছিল।কিন্তু ইশান এমন ভাবে তার পাশের ছেলেটার সাথে কথা বলছে যেন সে জানেই না তিথি তার দিকো তাকিয়ে আছে কিন্তু সে বেশ জানে তিথি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।জেনেশুনেও না জানার ভান করে সে পাশের ছেলেটির সাথে তার কলেজ লাইফ নিয়ে কথা বলছে।
ছেলেটির নাম রাজু।রাজু ইশানের কাছে জানতে চায় সে কোন কলেজে পড়েছে।ইশান যখন কলেজের নাম বলে তখন ছেলেটি আশ্চর্য হয়ে যায়।এত বড় কলেজ থেকে পড়ে এসে ইশান কিনা এই ভার্সিটিতে ভর্তি হলো, তখন রাজু জানতে চাইলো সে কি চান্স পায়নি ভাল ভার্সিটিতে।
ইশান মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো,’নাহ পাইনি।আমি দূর্বল ছাত্র’
‘দূর্বল ছাত্র হলে এতো বড় কলেজে পড়লে কিভাবে?’
‘তখন মেধাবী ছিলাম।এখন দূর্বল হয়ে গেছি। অনেক দূর্বল!’
এটা বলে ইশান পেছনে ফিরে তিথির দিকে তাকায়।তিথি সেইসময় সুরাইয়ার ফোনে ওর ছবি দেখছিল।
চলবে♥
যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৫
আফনান লারা
সাবিনা ম্যামের ক্লাস শেষ হয়ে যাবার পর ছিল মিজান স্যারের ক্লাস।সম্ভবত স্যার আজ আসবেননা।পঁয়তাল্লিশ মিনিটের এই ক্লাসটি তাই অনেক বেশি বোরিং হয়ে গেছে।তিথি সুরাইয়াকে বললো তারা ক্যানটিন থেকে ঘুরে আসবে।কিন্তু তিথিদের ভার্সিটির নিয়ম হলো ক্লাস টাইমে কেউ ক্যানটিন কিংবা ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি করতে পারবেনা।
এখন যেহেতু স্যারের ক্লাস নেই,তারা যেতেই পারে।এই ভেবে ওরা দুজন বেরিয়ে গেলো।
ইশান মুচকি হেসে পকেট থেকে ফোন বের করে ডিপার্টমেন্টের অফিস সহকারী কামালকে কল দেয়। কল দিয়ে খবরটা সে সাবিনা ম্যামের কাছে জানাতে বলে,নিজের পরিচয়টা দেয়না আর।
ঠিক তাই হলো।কামাল সোজা গিয়ে সাবিনা ম্যামকে বলে এসেছে ক্লাসের কিছু স্টুডেন্ট ক্লাস টাইমে বাহিরে আড্ডা দিতে গেছে।ম্যাম তো রেগে আগুন।
ম্যাম সোজা ক্লাসে ছিলেন এরপর জানতে চাইলেন ক্লাসে কারা উপস্থিত নেই।
একজনে জানিয়ে দিলো ওটা তিথি আর সুরাইয়া।
ম্যাম নাম শুনে যাবার সময় বলে গেলেন ওরা আসলে যেন ডিপার্টমেন্টের অফিসে যেতে বলে।
তিথি আর সুরাইয়া ক্যানটিনে বসে চাউমিন খেয়ে খুশি মনে ক্লাসে আসতেই জানতে পারে ম্যাম ওদের ডেকেছে।
তিথি কিছু বুঝতে না পারলেও সুরাইয়া আন্দাজ করে নেয় তারা যে ক্লাসে ছিল না তাই হয়ত ম্যাম শাস্তি দেবে বলে ডেকেছিল।সে ভয়ে চুপসে যায়,এদিকে তিথি বলে এ কারণে না।ক্লাসে তো স্যার আসেনি তবে বের হলে কি সমস্যা!
সে বেশ সাহস নিয়ে ডিপার্টমেন্টোর অফিস রুমে আসে।
ম্যাম তখন একটা ছেলেকে ঝাড়ি দিচ্ছিল।ওদেরকে দেখে ছেলেটাকে বিদায় করেন তিনি এরপর তিথির দিকে তাকিয়ে বললেন,’তোমরা কি ভার্সিটির রুলস গুলা সব ভুলে গেছো?’
ওমনি সুরাইয়া কানে ধরে বললো,’ম্যাম সরি,আর এমন হবেনা’
‘ভুল করে সরি বলে কোনো লাভ নেই আমার কাছে।আজ যে এসাইনমেন্ট আমি দিয়েছি সেটা ডাবল লিখে আনবে,ফটোকপি দিতে পারবেনা।যাও এখন’
তিথি মন খারাপ করে ক্লাস থেকে বের হতেই দেখে ইশান নামের ছেলেটা অন্যদিকে মুখ করে হাঁটা ধরেছে।এতক্ষণ সে এখানেই ছিল।
তিথি সুরাইয়াকে ক্লাসে যেতে বলে সে ইশানের পিছু পিছু এসে দ্রুত হেঁটে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়।
ইশান ভাবেনি তিথি হঠাৎ সামনে চলে আসবে।সে মাথা নিচু করে রাখে।তিথি হাত ভাঁজ করে বলে,’তোমার বাসা কোথায়?’
‘গুলশান’
‘গুলশান?এতদূর থেকে আসো?’
‘হ্যাঁ’
‘কিসে করে আসো?’
‘কা…. নাহহহ,বাসে করে আসি’
‘বাসে আসতে তো পাঁচ ঘন্টা লেগে যাবার কথা।তুমি রওনা হও কখন?আচ্ছা তোমার কপালে কি হয়েছে দেখি’
ইশান হাত দিয়ে কপাল ঢাকতে ঢাকতে বলে,’জন্মদাগ’
‘জন্মদাগ?দেখে তো নতুন দাগ মনে হলো।কিভাবে ফাটলো?’
‘ফাটেনি।এটা জন্মদাগ’
‘বয়স কত তোমার?ফেইল করেছো কলেজে?তোমাকে কেমন বড় বড় লাগে’
‘২৩বছর’
‘আমার তো মনে হয় সাতাশ বছর।মাস্ক খুলো তো!তোমাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে’
ওমনি ইশান ওখান থেকে চলে যায়,আর একটা কথাও না বলেই।তিথির সন্দেহ আরও গাঢ় হয় তখন।ছেলেটাকে এত চেনা চেনা লাগছে কেন!
সুরাইয়ার ডাকে তিথির মন ঘুরে যায়।সে চলে যায় ওর কাছে।এদিকে ইশান যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।আরও সাবধানে থাকতে হবে।কিন্তু ম্যামের শাস্তিটা আরও কঠিন হলে ভাল লাগতো।এত সহজ শাস্তিতে তো মন ভরছেনা!
ভার্সিটি ছুটি হবার পর তিথি ভাবলো একবার তানিয়ার কলেজে গিয়ে ওকে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরবে।তাই সে বাহিরে বেরিয়ে বাসের অপেক্ষা করছিল, ইশান সবেমাত্র তার গাড়ীতে উঠবে ওমনি তার আর তিথির চোখাচোখি হয়।তিথি আর একটুর জন্য ওকে ধরে ফেলতো কিন্তু তার আগেই ইশান তার গাড়ী থেকে দশ হাত সরে দাঁড়ায়।
তিথি গাড়ীটার দিকে তাকিয়ে অন্যদিকে ফিরে যায় আবার।এটা অন্য রঙের গাড়ী ছিল।কালকের গাড়ীটাতে তো তিথি ইট দিয়ে নাজেহাল করে রেখে দিয়েছে।
তিথি ওদিকে চোখ বুলাতে যেয়ে আবার ইশানকে দেখে ফেলে।তারপর একটু এগিয়ে বললো,’কি হলো বাসে উঠবে না?’
ইশান এ কথা শুনে ভয় পেয়ে যায়।সে ভাবে তিথি বুঝে গেলো নাকি সব!কিন্তু তখনই তিথি সামনের বাসটাতে ওঠার সময় বললো,’এটা মনে হয় গুলশানের একটু আগে যাবে,চলো’
এই বলে রীতিমত জোর করেই সে ইশানকে বাসে ওঠায়।ইশান ওর পাশে বসে পকেট হাতাচ্ছিল।তার কাছে কার্ড বাদে খুচরো পয়সা নেই।তিথির সাথে টেক্কা দেয়া যে কঠিন তা সে জানতো,কিন্তু এত কঠিন তা জানতোনা।ইশান বারবার এদিক সেদিক করছিল বলে তিথি জানতে চাইলো কোনো সমস্যা কিনা।তখন ইশান না বলে চুপ করে থাকে।একটু পরেই কন্ডাকটর আসলো ভাড়া নেয়ার জন্য।ইশান না পারছে কার্ডের কথা বলতে আর না পারছে তার কাছে টাকা না থাকার কথা বলতে।তিথি তার ভাড়া বের করে দিয়ে দিয়েছে,ইশান দিচ্ছেনা বলে সে কিছু বলতে যাবে ওকে ওমনি পিছনের সিট থেকে আদিল হাত বাড়িয়ে ইশানের ভাড়াটা দিয়ে দেয়।
ইশান পেছনে ফিরে আদিলকে দেখে মুচকি হাসে।আদিল যে এ বাসে উঠেছে তা ওরা কেউই জানতোনা।তিথি তো আদিলকে দেখে রেগে আগুন।সে ইশানের কাছে জানতে চাইলো ও আদিলকে চেনে কিনা।ইশান কিছু বলার আগেই আদিল বললো,’আমার ছোট ভাইয়ের ক্লাসমেট হয়”
‘তোমার ছোটভাই আমার থেকে এক বছরের ছোট।তার ক্লাসমেট এই বুইড়া বেটা?’
‘বুড়ো কোন বলছো!ইশান আমার চাইতেও ইয়াং”
‘আমি চোখ দেখেই বয়স বলে দিতে পারি।যাই হোক তোমার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।আগে যদি জানতাম তুমি এই ছেলের পরিচিত তবে এই ছেলেটার সাথে আমি কোনো কথা বলতাম না’
এট বলে তিথি বাস থামাতে বলে।কিন্তু বাস তখন এমন রোডে ছিল যে থামানোর প্রশ্নই আসেনা।
তিথি তাও দাপট দেখিয়ে চলন্ত বাস থেকে নামার চেষ্টা করে।ইশানকে হটিয়ে নিচে পা রাখতে যেতেই বাসের গতির সাথে না পেরে হোচট খায় সে।আদিল উঠে গেছিলো ওকে ধরার জন্য কিন্তু ইশানই বোধহয় তিথির জন্য যথেষ্ট।
ইশান এক হাতেই তিথিকে ধরে ফেলেছে।তবে যেভাবে ধরেছে সেটা তিথির পছন্দই হয়নি।সে হাতটা সরিয়ে ইশানের দিকে আঙ্গুল দিয়ে বললো,’আর কোনোদিন টাচ করলে!!’
এরপর সে চলে যায়।আদিল এসে ইশানের পাশে বসে তখন ।
ইশান আদিলের ঘাড়ে হাত রেখে বলে,’তুমি টাচ করেছিলে কখনও?’
‘না স্যার’
‘অনেক ঝাঁঝালো হয়ে গেছে তিথি’
‘আগে কেমন ছিল স্যার?’
‘আগে নম্র ছিল,মুখ দিয়ে কথা বের হতোনা।আর এখন সে পুরোটাই বদলে গেছে। আগেকার তিথি আর এখনকার তিথির মাঝে আমি আকাশ পাতাল তফাৎ দেখি।তবে এই রুপটাই ভাল,গেমস খেলতে দারুণ লাগছে আমার’
‘কিন্তু স্যার বিপদ তো বাঁধিয়ে ফেললেন।মাথা কতটা ফেটে গেছে।বড় ম্যাডাম দেখলে কাঁদতে কাঁদতে বন্যা বানিয়ে দেবেন’
‘আর তাই কাল রাত থেকে আমি বাসায় ফিরিনি।হোটেলে ছিলাম।এখনও হোটেলেই যাবো।তোমায় আরেকটা কাজ দিবো।সেটা আগামীকাল করবে।আমি টেক্সট করে জানিয়ে দিবো।কাজটা সাবধানে করবে।’
‘ঠিক আছে স্যার’
কন্ডাকটর ওদের দুজনের কথা শুনলো।আর ভাবলো এতক্ষণ আদিল ইশানকে তুই তুকারি করে কথা বলছিল,কিন্তু তিথি চলে যাবার পর সে আবার স্যার ডাকছে।কাহিনী কি!!!
———-
তিথি গাল ফুলিয়ে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে।যে আদিলকে দেখলে তার মনে ফুলের মেলা বসতো,আজ সেই আদিলকে দেখে তার গায়ে আগুন জ্বলছে।লাভা ভাসছে চারিদিকে!
কতটা ধোকাবাজ!! তাও একটুও অনুতপ্ত না সে!দিব্যি আরামসে অফিসে যাচ্ছে!
‘আমার দরকার ছিল ধরে বাসে সবার সামনে গনপিটুনি দেয়া।এরপর বাসে দেখলে একবার হলেও মাইর খাওয়াবো।আমাকে নিয়ে গোমস খেলার ফল ওকে ভুগতেই হবে!’
আদিল নেমে যাবার পর ইশান ও নামে বাস থেকে।হোটেলে যাবে নাকি বাসায় যাবে সেটা নিয়ে কনফিউশানে আছে।
কপালের দাগ ডাক্তারকে বলেও মেটানো গেলোনা।সার্জারি করা ছাড়া নাকি উপায় নাই।
সার্জারি করতে হলে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে,ততদিন বাসায় না ফিরলে মা অন্য কিছু ভেবে আবারও দুঃচিন্তা করবে।
যাবো তো কোনদিকে যাবো!!
ইশান পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোন বের করে মুখ থেকে মাস্কটা সরিয়ে নেয়।দম বন্ধ হয়ে আসে এভাবে মাস্ক পরে থাকতে থাকতে।ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে চিন্তা করছিল কি করবে না করবে ওমনি তার সামনে এসে দাঁড়ায় মিয়াজুল করিম আঙ্কেল।
ওনাকে দেখে ইশান শুরুতে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো।তারপর কি আর করবে কথা না বললে আরও বিপদ হবে ভেবে সে সালাম দেয় ওনাকে।
‘ইশান!কত বড় সারপ্রাইজ! তুই কোথায় ছিলি এত বছর?’
‘এ্যাব্রোড’
‘বাহ!একেবারে সাহেব হয়ে ফিরেছিস!তোকে তো শুরুতে চিনতেই পারি !তিথি কোথায়?’
ইশান ঢোক গিলে এদিক ওদিক তাকায় তারপর বলে,’তিথি বাসায়।’
‘বাচ্চা কয়টা এখন তোদের?তিথিও কি তোর সাথে বিদেশ ছিল?আমাকে তোর বাসায় নিবিনা?আমি তো এখানেই থাকি।একটু হাঁটতে বেরিয়েছি।চা খেতে মন চাইলো।আমার বউয়ের হাতের চা ভাল না বুঝলি!তিথির হাতের চা খাবো।চল!’
চলবে♥