যদি তুমি বলো💌
পর্ব ২৪
আফনান লারা
তিথির এরকম একটা প্রশ্নে ইশান আরও বেশি রেগে যায়।সে চিৎকার করে বলে,’ছেলেটা যদি আমার বোনকে পাগলের মতন ভালবেসে থাকে তবে অবশ্যই তার সাথে আমি বিয়ে দিবো,কিন্তু সে চাকরি পাওয়া পর্যন্ত আমার বোন তার জন্য অপেক্ষা করবে তার মানে এই নয় যে আমার বোন তাকে দূরছার করে দূরে ঠেলে দিবে,কিংবা কথা দিয়ে এরপর কথার খেলাপ করবে।আমার বোনকে আমি সেই শিক্ষা দিই নাই।’
তিথি কি আর বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।যাই বলে ইশান তারই একটা না একটা উত্তর গুছিয়ে বলে দেয়।
তিথিকে চুপ করে থাকতে দেখে ইশান ওকে ছেড়ে দিয়ে কিণারায় উঠে বসে পড়ে।তখন তিথিও আর দাঁড়িয়ে থাকেনা।সেও উঠে বসে।
দুজনেই চুপচাপ ছিল যতক্ষণ না বৃষ্টি থামে।ইশানের ফোনের আলোটাও নিভু নিভু করছে।
শেষে আলো থাকতে বাসায় পৌঁছানোর কথা ভেবে সে উঠে হাঁটতে থাকে।তিথিকে একবার আসতেও বলেনা।
তিথি রাগ করলে তারই লস হবে তাই সেও ওর পিছু পিছু আসতে থাকে।দুপাশে সুপারি গাছ আর মাঝ দিয়ে ইটের রাস্তা।তিথি চলতে চলতে বললো,’আপনি কি করে জানলেন এখানে নদী আছে?’
‘আমার থেকে পালানোর জন্য এক মাস ধরে নানুর বাড়িতে ছিলি, আর আমি নানু বাড়ি চিনবোনা?’
‘তার মানে আপনি জানতেন সব?’
‘শুধু তাই নয়।আমি এই এক মাসে অনেকবার এসে তোকে দেখেও গেছি। তুই টেরও পাসনি।জানিস?যে খুব করে ঘৃনা করে সে এক সময় ঐ মানুষটাকে প্রচণ্ড ভালবেসেছিল।
ভাল না বাসলে এত ঘৃনা জন্মায় না।’
তিথি অনেকটা পথ আসার পর হঠাৎ থেমে গিয়ে বললো,’আচ্ছা এই প্রতিশোধ কতদিন ধরে চলবে??’
তিথির এই কথায় ইশানও থামে। পেছনে ফিরে বলে,’আজীবন’
‘আমি মুক্তি চাই,আপনার সাথে সংসার করতে চাইনা।’
ইশান মুচকি হেসে আবারও হাঁটতে লাগলো।তিথি বিরক্তি নিয়ে ওর সামনে এসে উঁচু গলায় বলে,’বললাম না আমি এই সংসার করবোনা?’
‘করিসনা,যা চলে যা’
ইশান কথাটাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছেই না।এর কিছুক্ষণ পর নানুর বাড়িতে এসে দুজনে দেখে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।নির্ঘাত মামা দরজা খোলা দেখে আটকে দিয়েছেন।রাতের দুইটা বাজে।এখন কি হবে!
ইশান অনেকক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কিয়েছে,কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি,নানু,মামার নাম্বার তিথির মুখস্থ নেই।তিথি বললো ওনারা সবাই গভীর ঘুমে।উঠবেনা হয়ত।তিথির এমন কথাশুনে ইশান বললো তবে সারারাত তারা কি এই বৃষ্টির মধ্যেই ভিজবে!
এরপর হঠাৎ ওর খেয়াল হয় তার তো ওপাশে কার থামানো আছে।সেটাতে গিয়ে বসলেই পারে।কিন্তু সমস্যা হলো কারের চাবি সে টেবিলের উপর রেখে এসেছে।
ওমনি তিথি বুদ্ধি দেয় তারা জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে চাবিটা নিতে পারে।
আর তাই দুজনেই সেই জায়গায় এসে উপস্থিত হয়।তিথি হাত বাড়িয়ে চাবিটা নেয়ার অনেক চেষ্টা করে কিন্তু তার হাতটা ওতোদূরে পৌঁছাচ্ছিলই না।
শেষে ইশান ওকে সরিয়ে নিজে হাত ঢুকাতে গিয়ে দেখলো তার হাতটা ঢুকছেই না।
তিথি খিলখিল করে হেসে ওঠে এই দৃশ্য দেখে। তখন ইশান রেগে গিয়ে বললো,’এতই যখন পারো তবে নিজের ঐ লিলিপুট হাত দিয়ে আবার চেষ্টা করে দেখো না”
তিথি কোমড়ে এক হাত রেখে অন্য হাত দিয়ে আবারও চেষ্টা করতে থাকে।অনেক কষ্টে সে চাবিটা নেয়।দুজনেই এবার তাড়াহুড়া করে গাড়ীর ভেতরে ঢুকে বসলো,পেছনের সিটে।
তিথি ভিজে একাকার হয়ে আছে।
ইশান ও ভিজে আছে কিন্তু তিথি একটু বেশি কারণ তার বড় চুলের কারণে।তার চুল দিয়ে অনবরত পানি পড়ে যাচ্ছিলো।
ইশানের ফোনটাও অফ হয়ে গেছে। বৃষ্টি আরও বারতি।এত অন্ধকার!সব মিলিয়ে বাজে এক অবস্থা।
তিথি এই মূহুর্তে ইশানকেই ভয় পাচ্ছে।আবার কি করে বসবে কে জানে।সব ভয়ে থাকলেও ইশানের ভয় একাই যথেষ্ট তাকে ভীতু করে তোলার জন্য।
তিথি একটু একটু করে গ্লাসের সাথে লেগে বসেছে।যাতে ওর সাথে ইশানের শরীর না লাগে।
অস্বস্তিকর পরিবেশে ঘুম না আসাটাই স্বাভাবিক। দুজনেই জেগে বসে বসে সময় গুনছে। কখন ভোর হবে আর কখন নানু দরজা খুলবেন।
তিথি হাত দিয়ে নিজের চুল থেকে পানি বের করতে করতে বললো,’কি দরকার ছিল এত রাতে এইসব নাটক করার?আমার জ্বর হলে কি করবেন!’
‘নাচবো!বেশি বকবক করলে গাড়ী থেকে বের করে বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখবো তোকে।’
তিথি আর কিছু বলেনা।বারবার নিজের হাত ঘঁষতে থাকে।হাত ঘঁষলে গরম সৃষ্টি হয়।
ইশান নিজের গাড়ীর ডেস্কে খুঁজে একটা তোয়ালে বের করে।এটা তার পার্সোনাল।দূরে ট্র্যাভেল করলে এটা দিয়ে মুখ মুছে।আপাতত এটা পরিষ্কার বলে সে তিথির দিকে বাড়িয়ে ধরলো আঁধারের মধ্যে।
তিথি কিছুই বুঝলোনা তাই জানতে চাইলো সে হাত বাড়িয়ে কি দিয়েছে এবং কোনদিকে দিয়েছে।সে দেখছেনা।
ইশান বিরক্ত হয়ে কাছে ঘেঁষে তেয়ালেটা ঘুরিয়ে ওকে পরিয়ে দিয়ে বললো,’আপন মানুষের অবয়ব অন্ধকারেও চেনা যায়।অবশ্য আমি তো তোর আপন মানুষ নই’
তিথি চুপ থেকে যায়।মাঝে মাঝে মনে হয় সে যে অন্যায় করেছিল তা হলো আকাশচুম্বী। যার কারণে ইশান আজও সেটা ভুলতে পারছেনা।আবার কখনও মনে হয় ইশান বাড়াবাড়ি করছে।
বাড়াবাড়ি ভেবে মনে পড়লো একটা কথা।ওমনি সে বলে ওঠে,’আমি যদি মাফ চাই,মাফ করবেন?’
‘সরি বললেই সব সমাধান হয়না।তুই যে অপরাধ করেছিস তার হাজার সরিতেও ভোলার মতন না’
তিথির হাতের চুড়িগুলা ওর হাত নাড়ার কারণে এত এত আওয়াজ করছিল যে ইশানের মাথা ব্যাথা আরও দিগুণ বাড়িয়ে তোলে।সে বিরক্ত হয়ে আন্দাজ করে তিথির হাত ধরে চুড়ি গুলো খুলছিল।তখনই তিথি বললো,’আপনি কি করবেন এখন? সব খুলছেন কেন?’
ইশানের হাত থেমে যায় তিথির কথা শুনে।সে বলে,’সব খুলছি মানে?আর কি খুলছি?তোকে না বলছি আমি ঐসব কিছু তোর সাথে করবোনা।তাহলে বারবার ঐসবের দিকে টেনে নেস কেন?অশ্লীল কোথাকার!’
তিথি দাঁতে দাঁত চেপে বলে,’তবে চুড়িতে কি সমস্যা আপনার?’
‘মাথা ধরছে আমার।যেভাবে চুড়ি দিয়ে বাজনা বাজাচ্ছিস তাতে এইবার মাথা ফেটে যাবার উপক্রম’
‘আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি?আপনার কি জাপানে কারোর সাথে প্রেম হয়েছিল?’
‘হয়েছিল,অনেকগুলো।তাদের সাথে ফিজিক্যালি এটাচড ও হয়েছিলাম।সবগুলোর পেটে বাচ্চাও হয়েছিল।কিন্তু আফসোস,জাপানি মেয়েদের সব চেহারা এক রকম।বাচ্চা গুলো সব আমার মতন দেখতে হয়েছে শুধু চোখ গুলো ভেতরে ঢুকানো জাপানিদের মতন।সবগুলোর চেহারা এক লাগতো’
‘আপনি সিরিয়াস?’
‘তোর কি মনে হয়?’
তিথি আর কিছু বলেনা।ইশান তাকে ক্ষেঁপানোর জন্য এমন করছে নিশ্চয়।
তিথির চুড়িগুলো হাতে নিয়ে বসে আছে ইশান।সেইকালে তিথির হাতের চুড়ি ওর বান্ধবীকে দিয়ে চুরি করিয়েছিল সে।তিথির কিছু জিনিস স্মৃতি হেসেবে সে রেখে দিয়েছিল।তা হয়ত কোনোদিনও তিথি জানবেনা।
তিথির হুশ ফেরায় সে তার চুড়িগুলো ইশানের থেকে চাইলো।কিন্তু ইশান তাকে ওগুলা ফেরত না দিয়ে বললো,’তুই যদি আমার হাত থেকে চুড়িগুলো উদ্ধার করতে পারিস তবে তিনদিনের জন্য তোর শাস্তি মাফ’
তিথি তো মহাখুশি হয়ে যায়।সে তোয়ালেটা গা থেকে ফেলো অন্ধকারে তীর ছোঁড়ার মতন কাজে লেগে পড়ে।সে ইশানের সাথে হাতাহাতি করছে চুড়িগুলো নেবার জন্য।কিন্তু কিছুতেই পারছিলনা।তখনই তার মনে পড়ে কারে তো লাইট থাকে।
সে এবার চুড়ির পেছনে না ছুটে গাড়ীর আলোটা জ্বালানোর চেষ্টা করে এবং সে পারে ও।
ইশান বুঝে যায় তিথির জন্য কাজটা এবার সহজ হবে।তার এই ভাবনার কালেই তিথি তার চুড়ি জোড়া নেবার জন্য ইশানের দিকে এগিয়ে যায়।ঠিক তখনই ইশান তার হাতটাকে পিঠের পিছনে লুকিয়ে ফেলে।
তিথি ও হার মানার মেয়ে নয়।সে কাছে এসে ওর পিঠের পেছনে হাত নিয়ে চুড়িটা নিতে চাইলো কিন্তু ইশানের বুকে তার মাথাটা লাগতেই তার হাতাহাতি বন্ধ হয়ে যায়।ইশান ও থেমে যায়।
যে জড়িয়ে ধরার জন্য সে এক সময় ভিক্ষা করতো,আজ সেই জড়িয়ে ধরা নিজেই ধরা দিলো।
তিথি ইশানের বুক থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে।হাতাহাতি করতে গেলে আরও কাছে যেতে হবে,যেটা সে আর ইশান, কেউই চায়না
চলবে♥
যদি তুমি বলো💌
পর্ব ২৫
আফনান লারা
ইশান চুড়িগুলো ফিরিয়ে দেয় তিথিকে।চুড়ি হাতে পেয়ে তিথি জানতে চাইলো আসলেই কি তার তিন দিনের জন্য শাস্তি মাফ?
তার উত্তরে ইশান কড়া জবাব দেয়।সে বলে এ শাস্তি মাফ হবার নয়।কথাটা বলে সে সামনের সিটে গিয়ে বসে এরপর লম্বা লম্বি ভাবে শুয়ে পড়ে।তিথি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল।ইশান খুবই শক্ত একটা মানুষ।শক্ত বলার পর তার মনে আসলো একটা কথা।
আগেকার ইশান খুবই নরম ছিল।একেবারে মাটির মতন। মাটি কখনও শক্ত হয়না।যে আকারই থাকুক ঝরে পড়বেই।ইশান ছিল সেরকম।তিথি তাকে কত অপমান,কত ধুরছার করেছিল তার পরেও দিনের পর দিন সে কেবল তিথিকেই চাইতো।তিথির কাছে তার কত আবদার ছিল তখন।
তিথি তার একটি আবদার ও কখনও পূরণ করেনি,বরং তার বদলে দিয়েছে হাজার হাজার দুঃখ যা বলে কয়ে শেষ করা যাবেনা।ইশান তিথিকে ভালবাসে বলে সে দুঃখ গুলো সে মাঝে মাঝে ভুলে গিয়ে তিথিকে আবারও আগের সেই ভালবাসা ফিরিয়ে দিতে চায় কিন্তু যখনই তার মনে পড়ে এই মেয়েটা তার জন্মদাত্রী মাকে কষ্ট দিয়েছিল,কাঁদিয়েছিল তখন তার বুক ফেটে আসে।ইচ্ছে করে মেয়েটাকে খুন করে প্রতিশোধ নিতে।ভালবাসা,প্রতিশোধ, মায়ের মমতা,অশ্রু সব মিলিয়ে তাকে পাগল করে তুলছে দিনের পর দিন।
মাথার উপর হাত রেখে এইসবই ভাবছিল ইশান।তিথি ও ওর মতন করে পিছনের সিটে লম্বা হয়ে শুয়েছে।কিন্তু চুল ভিজা থাকার কারণে তার ঘুম আসছিল না।সে শুয়ে শুয়ে ভাবছে সংসারটা কি ছেড়ে দেবে নাকি ইশানের কাছে মন থেকে ক্ষমা চাইবে।ইশান হয়ত ক্ষমা করবেনা।তবে কি সংসারটা ছেড়ে দেয়াই শ্রেয়?
তিথি সিদ্ধান্ত নেয় সে ইশানের সঙ্গে যাবেনা।বাসায় ফিরে যাবে।অতীতের করা ভুল নিয়ে এত মাশুল সে আর দিতে পারবেনা।তার ও তো জীবন আছে,শখ আছে,সুখ আছে।এভাবে দিনের পর দিন সে কেন কষ্ট করে যাবে?যদি সে জানতো তার সাথে ইশানের বিয়ে হচ্ছে তবে সে কখনওই রাজি হতোনা কারণ যাকে এক সময় কটু কথা বলে সে আঘাত করেছিল,তার সংসারে যে শান্তি মিলবেনা এটা তো জানা কথা।
দুজনার ভাবনার বেড়াজালে ভোর হয়ে গেলো।মামা ফজর নামাজ পরতে টুপি পরে দরজা খুলে চললেন মসজিদের দিকে।দরজাটা মুখোমুখি দেয়া ছিল,আটকানো ছিলনা।কারণ আর বাকিরা সবাই ঘুমে।নানু হয়ত নিজের রুমে নামাজ পড়ছেন।
তিথি শুয়ে থেকে মামাকে যেতে দেখে উঠে বসে।মামা চলে যাবার পরই সে গাড়ীর দরজা খুলে বের হয়ে যায় সোজা নানুর রুমে।
নানু নামাজ পড়ছিলেন।
তিথি চেয়ারে বসে নানুর নামাজ পরা দেখছিল।নানু নামাজ পড়ে জায়নামাজ নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই তিথিকে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে চমকে ওঠেন।এরপর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’কিরে তিথু!কি হলো তোর?কাল থেকে দেখছি মুখ ভার করে আছিস।কতবার যে জানতে চাইলাম কি হয়েছে,কিছুই তো বলিসনি।আমায় বল!বললে মন হালকা লাগবে।আমি হয়ত কিছু উপদেশ ও দিতে পারি যা তোর কাজে লাগবে’
তিথি তখন বলে,’নানু তোমার মনে আছে? আমি একবার একমাসের জন্য তোমার বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করেছিলাম? তখন তোমাকে বলতাম না যে আমার পড়ার টেবিলের জানালা দিয়ে মনে হয় কেউ আমায় দেখছে? তুমি বলতে মনের ভুল।
আসলে সে ইশতিয়াক ছিল।’
‘কোন ইশতিয়াক? ঐ যে এক কালে তোর পিছু নিছিলো,তোর জন্য পাগল হই গেছিলো,সে?’
‘পাগল হয় নাই।বরং দেখিয়ে দিয়েছে কি করে অসম্ভব কোনো কিছু নিজের করে নিতে হয়।’
‘সে এখন কেমন আছে?দেখা করেছিস নাকি?’
‘সেই তো ইশান’
এ কথা শুনে নানু অবাক হয়ে গেলেন।কিছু সময় চুপ থেকে বললেন,’তুই যখন জন্মেছিলি তখন তোর বাবার হাতের অবস্থা ভাল ছিল না।আমার খুব ইচ্ছে ছিল তোকে হাসপাতালেই সোনার চামচ দিয়ে মধু খাওয়াবো যাতে তোর ভাগ্য সোনার হালে বাড়তে থাকে।
আমার এ কথা কেউ শোনে নাই।তারপর আমি আমার হাতের একটা চুড়ি বিক্রি করি নিজে নিজে।কাউকে বলিনি।তারপর একটা চামচ ও বানাই।হাসপাতালে তোকে সেই চামচ দিয়ে মধু ও খাইয়েছিলাম।সবাই বকছিল কুসংস্কার বলে।তাও আমি করেছি।তারপর থেকে শুরু হয় তোর বাবার পদন্নোতি। সবাই বলতো তুই তোর বাপের ভাগ্য খুলে দিয়েছিস।তোর গায়ের রঙ তোর বয়সের সাথে সাথে যেন আরও উজ্জ্বল হতে লাগলো।শুধু কি ইশান?আরও কত ছেলে যে তোর জন্য পাগল ছিল।হিসাব নাই সেসকলের।শুধু হিসাব আছে ইশানের।কারণ সে শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছে।আসলেই এখন বলতে হয় তোর সেদিনের সোনার চামচের মধুর গুণ আছে!
এই বলে নানু হাসতে থাকলেন।হঠাৎ হাসিটা থামিয়ে বললেন,’আচ্ছা তবে যদি সেই ইশানই তোর জামাই হয়ে থাকে,তবে তোর চোখে পানি কেন?’
‘সোনার চামচ কখনও ভাগ্য বদলায় না নানু।বরং যারা সোনার চামচ মুখে নিয়ে বড় হয় তাদের অনেকের সাথেই নিকৃষ্ট কিছু ঘটে!যেমন আমার সাথে হলো।
আমি সেই ছেলেটার এবং তার মায়ের সাথে এত বাজে ব্যবহার করেছি যার মাশুল আমাকে এতগুলো বছর পর দিতে হচ্ছে।তিনি কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন আমি কখনও স্বামীর সোহাগ পাবোনা’
নানু তিথির চোখ মুছে দিয়ে বলেন,’মানুষ অভিশাপ দিলেই যদি ফলে যেতো তবে দুনিয়াতে কেউ টিকতোনা।ওসব ভাবিস না।তোর ভাগ্য ভাল বলেই ইশানের মতন একটা ছেলের বউ হয়েছিস।সে তোকে অতীতে যেমন পাগলের মতন ভালবাসতো,এখনও তাই বাসে।যে একবার প্রেমে পাগল হয় তার বাহ্যিক পরিবর্তন আসলেও পাগলামি কোনোদিন যায়না।বিশ্বাস হয়না তোর, তাই তো?নিজ থেকে একবার ধরা দিয়ে দেখ!তোর পুরো জীবন বদলে যাবে’
এই বলে নানু তার ছেলের বউকে ডাকতে চলে গেলেন।
তিথি চুপচাপ ওখানেই বসেছিল।অনেক ভেবে ইশানের কাছে না গিয়ে সে নানুর বিছানাতেই শুয়ে পড়ে।
——
ইশান গাড়ীতেই ঘুমিয়েছিল।মামা নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরবার সময় ইশানকে গাড়ীর ভেতর দেখে জানালায় ধাক্কা দিয়ে ওকে জাগানোর চেষ্টা করলেন।
‘ইশান বাবা?কি হয়েছে?এখানে ঘুমাও কেন?’
আওয়াজে ইশান জেগে যায়।উঠে বসে দেখে চারিদিকে আলোতে ভরে গেছে।মামা দাঁড়িয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন।সে চোখ ডলে গাড়ী থেকে বের হয়ে কিছু বলবে তখনই মামা বললেন সে যেন ভেতরে গিয়ে ঘুমায়।
উনি চলে যাবার পর ইশান তিথিকে ডাকার জন্য পেছনে তাকিয়ে দেখে সে নেই।তার মানে সে আগেই চলে গেছে।
তাই সেও ভেতরে চলে আসে।কিন্তু ভিতরে এসে দেখে তিথি রুমে নেই।
ইশান আর খোঁজেনা ওকে।চুপচাপ বিছানায় মাথাটা এলিয়ে শুয়ে পড়ে।হঠাৎ মনে পড়ে ফোনে চার্জ লাগবে।অফিসের জরুরি কল মিস হতে পারে।তাই তাড়াহুড়া করে সে ফোন নিয়ে এসে চার্জ দেয়।এরপর আবার শোয় কিন্তু তার আর ঘুম আসেনা।তাই খাটে হেলান দিয়ে বসে হাই তুলতে তুলতে কালকে রাতের কথা ভাবতে থাকে।
‘ইশান নাতি,, সকালে কি খাও? ‘
নানুর কথা শুনে ইশান ঠিকঠাক হয়ে বসে।নানু হাতের এক কাপ চা ওর সামনে রেখে বললেন,’শুনলাম তুমি সকালে রঙ চা খাও।ঘরে মশলাপাতি শেষ তাই দুধ চা দিলাম।’
‘সমস্যা নেই’
‘আচ্ছা একটা কথা বলবে?’
‘কি বলুন?’
‘তিথিকে ভালবাসো?’
ইশান চুপ করে তাকিয়ে থাকে।নানু ওর পাশে বসে বললেন,’জানো?ভালবাসার মানুষের কোনো দোষ থাকেনা।যদি ভালোই বাসো তবে ওর দোষ নিয়ে পড়ে আছো কেন?ভালবাসায় দোষ গুণ জায়গা পায়না।যদি জায়গা পায় তবে সেটা ভালবাসা হতে পারেনা।তুমি তিথিকে সেই কোন বছর থেকে পাগলের মতন ভালবেসে এসেছো!এখন তার চোখে পানি কেন তবে?
যে ভালবাসায় মানুষটা কাঁদে সেটা আবার কিসের ভালবাসা?
জানো,, তোমাদের নানা আমার গুণ যেমন দেখতেন না তেমনই দোষও দেখতেন না।
রাঁধলে মজা করে খেতেন।রান্না মজা হলে আনন্দর সহকারে খেতেন আর খারাপ হলে চুপচাপ খেতেন।কখনও বলতেন না ভাল হয়েছে কিংবা খারাপ।আমার শুরুতে খারাপ লাগতো কিন্তু দিন এগোতেই বুঝতে পারলাম পারুলের রান্না খারাপ হওয়ায় ওর স্বামী ওকে মেরেছিল আর আমার সাহেব নিরব ছিল তখন নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করলাম।সেদিন বুঝলাম কাউকে ভালবাসলে তার দোষগুণ খুঁজা চলবেনা’
চলবে♥