যদি তুমি বলো💌
পর্ব ১৬
আফনান লারা
এদিকে এত ভোরে ওঠায় তিথির না ঘুম আসছিল আর না কিছুতে মন বসছিল।তাই সে রুমে ফিরে ফোন খুঁজে তানিয়ার নাম্বারে একটা কল করে।কিন্তু গাধীটা তখনও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল।বিরক্ত হয়ে সে বাসার নাম্বারে কল দেয় এবার।
কাল সকলে মিলে দেরি করে ঘুমালেও রিদম ঘুমিয়েছিল জলদি জলদি।যার কারণে এই ভোরবেলা উঠে সে বাসায় হেঁটে হেঁটে অন্নের সন্ধান করছিল।ফ্রিজ খুলে কেক দেখতে পেয়ে সেটাতে হাত দিতেই ধুমধাম রিংটোন বেজে বাসার যে ফোনটা আছে সেটা বেজে উঠলো।রিদম শুরুতে হকচকিয়ে গিয়েছিল।এরপর বুকে থুথু দিয়ে গালের ভেতর এক পিস কেক পুরে ফোনটা কানে ধরে।
‘হ্যালো,রানবীর কাপুর স্পিকিং।হু আর ইউ?’
‘আমি’
‘টুকু?এই ভোরবোলা?আজ কি আদৌ সূর্য উঠবে?’
‘চুপ থাক!তানিয়া কোথায়?’
‘মরা লাশের মতন ঘুমাচ্ছে।উঠাবো লাশটাকে?’
‘না থাক।ও উঠলে বলবি আমায় একটা কল দিতে’
‘তা দুলাভাই কই টুকু?’
তিথি রাগ করে কলটাই কেটে দেয়।এরপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে নরম বিছানায়।
মখমলের বিছানার চাদর।হাত লাগলেই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।সেটাতে শুয়ে তিথি ছাদ দেখতে দেখতে ভাবছে ইশানের সেই পুরোনো বাড়ির কথা।
মরিচা ধরা টিনের ঘর ছিল তাদের। তিথিদের বাড়ির গলিতেই ইশানদের বাড়ি ছিল।
তিথি টিউশনে যাবার পথে রোজ রোজ ইশানকে সে দেখতো।
তার বান্ধুবীরা সকলেই তার চাইতে অধিক সুন্দরী ছিল বলে তিথি কখনও কল্পনাও করেনি ওদের বাদ দিয়ে এই হ্যাংলা ছেলেটা শেষমেশ ওকে সেই লেভেলের ভালবেসে বসবে।
তার এই ভুলধারণা একদিন ইশান গুছিয়ে দিলো।সেই দিনটা ছিল ভ্যালেন্টাইনস ডে।
তাজা নীল রঙের গোলাপ তিনটা হাতে ইশান তিথিকে প্রোপোজ করতে আসে।
নীল গোলাপ ছিল না মোটেও,লাল গোলাপকে নীল রঙের কৌটায় চুবিয়ে নীল করেছিল সে,এরপর রোদে শুকিয়ে নিয়েছিল।কারণ তিথির নীল রঙ ভীষণ পছন্দের।প্রায় সময় সে নীল জামা পরে টিউশনে আসতো।
ইশান তাই এই কারবার করে।
সকলে যার যার বাড়ির রাস্তায় ঢুকে গেলেও তিথির বাড়ি ছিল সবার পরে।
তিথিকে একা পেয়েই ইশান ওকে প্রোপোজটা করে বসে।
চোখের সামনে রোদে পোড়া,পায়ে কাদা শুকানো।গায়ের পোশাক এবং গন্ধ শুঁকে তিথির মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেলো।
সে তখন উঠতি বয়সী মেয়ে।চোখে মুখে তার রিত্তিক রওশানের মতন ছেলেদের নিয়ে স্বপ্ন।সেই জায়গায় কিনা এই রকম একটা ছেলে এসে তার কপালে জুটলো!
তিথির ভাবভঙ্গি দেখে ইশান ফুলটা আরেকটু এগিয়ে ধরে।
তিথি এদিক ওদিক তাকিয়ে ফুলটা হাতে নেয়।এরপর উল্টে পাল্টে বলে,’নীল গোলাপ পেলে কই?’
‘এটা লাল গোলাপ।তোর তো নীল পছন্দ তাই নীল রঙ করিয়ে এনেছি’
‘আমাকে তুই করে বলছো কেন?’
‘আমার অনেক ছোট তো তাই’
তিথি কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’কত ছোট?’
‘এই যে তুই ক্লাস এইটে পড়িস।আর আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে।’
‘আমাকে তুই বলবানা।আর ধরো তোমার গোলাপ।’
‘তোর ভাল লাগেনি?’
‘ফুল ভাল লেগেছে,কিন্তু তোমাকে ভাল লাগেনি’
সেবার তিথির এই কথাটা শুনে ইশান বলেছিল “আচ্ছা” এর বাহিরে আর কিছুই বলেনি।রোজ সে আগের মতন করে তিথির জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো টিউশনের বাহিরে।
তিথির এটা অনেক বিরক্তিকর মনে হতো।
একদিন তো সে ইশানকে!!
সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে তার এখন ভয় হয়।ইশান যদি সেই ব্যবহার গুলো ওর সাথে আবারও করে যেগুলো সে অতীতে করেছিল তার সাথে?
কত অত্যাচার সে ইশানকে করেছিল।তাও শেষ পর্যন্ত ইশান তার ভালবাসা পাবার অপেক্ষায় রয়ে যেতো।
চোখের কোণার পানি মুছে তিথি বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
সকাল সাতটা বেজে গেছে।বাসার সামনে বিয়ের গেট লাগানোর লোক চলে এসেছে।
তিথি সেটা দেখছিল হঠাৎ তার ডাক পড়ে ইশানের খালার।
খালার ডাক শুনে তিথি শাড়ীর আঁচলের কোণা টেনে কাঁধ ঢেকে তার কাছে চলে আসে।তিথিকে দেখে খালা চমকে উঠলেন প্রথমেই।
‘একি বউ!গোসল করো নাই?’
‘করেছি’
‘তাহলে আগের শাড়ী কেন পরেছো?নতুন একটা পরবে।রিসিপশানের আগে পরার জন্য আমরা একটা কাঞ্জিভরম শাড়ী দিয়েছিলাম তো বেগুনী রঙের।সেটা কোথায়?’
‘আসলে খালামণি ওটা ভুলে বাসায় রেখে এসেছি’
‘সেকি!কাল রাত থেকে এই ভারী শাড়ীটা পরে আছো তুমি?দাঁড়াও আমি তামিয়া থেকে নিয়ে দিচ্ছি’
এই বলে খালা চলে যাওয়া ধরতেই তিথি তাকে বাধা দিয়ে বলে সে তার বাবাকে কল দিয়ে বলেছে।তারা রিদমকে দিয়ে ব্যাগটা পাঠিয়ে দেবে।
খালা তিথির থুুতনি ধরে টেনে বলে,’খিধে পেয়েছে তোমার?কিছু খাবে?’
‘নাহ’
তিথি লজ্জায় বলতে পারছেনা সে আসলে সকালে কি খায়।আপাতত নতুন বউয়ের মতন লাজুক হয়ে মাথা নিচু করে রইলো।
তখনই খালা বলে উঠলেন ইশান এসে গেছে।এ কথা শুনে তিথির বুকের ভেতর ঝড় এসে গেলো।ভয়ে সে পেছনে তাকালোনা।ইশান সামনে দিয়ে তার রুমে চলে গেছে।
ও চলে যাবার পর তিথি পেছনে তাকাতেই
খালা ওকে জোর করে ইশানের পিছন পিছন ওর রুমের দিকে পাঠিয়ে দিলেন।তিথি কতবার করে বললো সে এখন যাবেনা।কিন্তু কে শুনে কার কথা।তাকে জোর করে পাঠিয়ে দেয়া হলো।
রুমের বাহিরে এসেও তিথি ভয়ে ঢুকছিল না।
ইশান ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতের ঘড়ি খুলছে।
তিথি ধীরে ধীরে রুমে এসে বিছানায় অন্য দিকে মুখ করে বসে থাকলো।ইশান হাতের ঘড়ি আর টাইটা খুলে নিজের আলমারি থেকে পাঞ্জাবি বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেছে।তিথি ওমনি চুপিচুপি ইশানের মানিব্যাগের কাছে এসে হাজির হয়।
শেষবার ইশানের মানিব্যাগে তিথি তার নিজের ছবি দেখেছিল।এখনও আছে কিনা সেটা পরোক করতে সে আবারও মানিব্যাগটা ধরে।
কিন্তু এবার তিথির কোনো ছবি নেই।তিথি মন খারাপ করে সেটা রেখে দেয়।কিন্তু তিথি জানতোনা ইশানের মানিব্যাগে দুইটা পার্ট।তিথির ছবি অন্য পার্টে ছিল যেটা তিথি খুলেই নাই।
ওটা আগের জায়গায় রেখে তিথি আবার বিছনায় এসে বসে।
ইশান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে হঠাৎ তিথির দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে থাকলো।তিথি বসে বসে একটা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছিল।ইশান তার দিকে তাকিয়ে আছে খেয়াল করে সেও ওর দিকে তাকায়।কিন্তু ইশান এমনভাবে কেনোই বা তাকিয়ে আছে সে বুঝতে পারেনা।শেষে ও বাধ্য হয়ে বললো,’কি হয়েছে?’
তার উত্তরে ইশান কিছু বলেনা।হনহনিয়ে রুম থেকে চলে যায়।তামিয়ার রুমে গিয়ে ওর নতুন শাড়ীর সেট থেকে একটা সেট নিয়ে এসে তিথির মুখের উপর মারে সে।তিথি এটার জন্য প্রস্তুত ছিল না।শাড়ী মুখ থেকে সরিয়ে সে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকলো আগের মতন।ইশান ধমকে বললো,’কাল রাত থেকে এই শাড়ীটা পরে থেকে কি বুঝাতে চাচ্ছিস?আমি তোকে শাড়ী কিনে দেই না?এটাই তো?এক ব্যাগ শাড়ী বাঘে নিছে?’
তিথি তার হাতের শাড়ীটা দেখে চুপ করে থাকলো।কিছু আর বললো না।
এর কিছু সময় বাদেই তার কেন যেন খুব রাগ হলো।সে বিছানা থেকে নেমে শাড়ীটা ইশানের দিকে পাল্টা ছুড়ে ফেলে বললো,’বাঘে নেয়নি।আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই পরিনি।এই শাড়ীটা আজকেও পরে থাকবো।তোমার কোনো সমস্যা আছে?’
ইশান তার পায়ের কাছে শাড়ীটার দিকে তাকিয়ে থেকে নিচু হয়ে শাড়ীটা তুলে নিলো হাতে।এরপর বললো,’যতক্ষণ না তুই এই শাড়ী পরছিস, ততক্ষণ এই রুমেই থাকবি’
এই বলে ইশান বের হয়ে রুমের দরজা বাহিরে দিয়ে আটকে রেখে চলে যায়।যাবার পথে খালাকে দেখে বলে যায় এ দরজা যেন কেউ না খোলে।
তিথি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।ভেবেছিল তার সেই পুরোনো রুপ থেকে ইশান হয়ত ভয় পাবে।এদিকে ভয় তো পেলোই না পাল্টা ওকে শাস্তি দিয়ে চলে গেলো!
কি হলো এটা!
—
ইশান সোফার মাঝখানে বসে আছে।তিথিকে রুমে সে আটকে রেখে এসেছে এটার কথা মিসেস আরাফাত তার বোন থেকে শুনেছেন।তাই ছেলের কাছে আসলেন সোজা।
ইশান রাগে বসে বসে টিভির চ্যানেল একটার পর একটা পাল্টাতে লাগলো।
মা তখন ওর হাত থেকে রিমোটটা নিয়ে বললেন,’ওকে কষ্ট দিতে চাইছিস মানছি।কিন্তু এভাবে লোক হাসিয়ে কি লাভ হলো?কাজের লোকেরা এসব জানলে পাঁচ কান করবে মানুষ কি ভাববে?’
‘ভাবুক।তারাও জানবে কেনোই বা আমি এসব করছি!’
চলবে♥
যদি তুমি বলো💌
পর্ব ১৭
আফনান লারা
কিছু সময়ের মাঝেই রিদম এসে হাজির হয় সেই ব্যাগটা নিয়ে।ইশান ওকে তিথির রুমে দিয়ে আসতে বলে ব্যাগটা।
রিদম দরজা খুলতেই দেখে তিথি তেড়ে আসলো কিসব বলতে বলতে।একটা লাইন ও রিদম বোঝেনি।শেষ লাইনটা বুঝতো কিন্তু ইশানের জায়গায় রিদমকে দেখে তার মুখ বন্ধ হয়ে যায়।
রিদম ব্যাগটা এগিয়ে ধরে বলে,’আমি কার্তিক আরিয়ান বলছি।এই নিন আপনার ব্যাগ’
তিথির হাসি আসলোনা।মনের ভেতরের চাপা কষ্টটা তাকে হাসতে দিচ্ছেনা।তার পরেও সে জোর করেই মুচকি হাসলো।যাতে রিদম কিছু টের না পায়।
সত্যিই রিদম টের পেলোনা।তিথির কাছ থেকে এসে সে ইশানের পাশে বসে পড়ে।
বিয়ের গেট সাজালেও রিসিপশান হবে কমিউনিটি সেন্টারে।
রিদম ইশানের পাশে বসে নিজেকে কেমন যেন গরীব মনে করছিল।ইশানের চোখের সামনে ভেসে উঠলো রিদমের ছোটকালের কথা।ইশান যখন তিথিকে প্রথম প্রথম চিনতো তখন রিদম ছিল চার বছরের শিশু।প্রতি বিকেলে ওকে কোলে নিয়ে তিথি ক্ষেতের মাঝ দিয়ে হাঁটতো।সেই সময়টা ইশান নিজের কলিজা ঠাণ্ডা হওয়া অবধি তিথিকে দেখতো।
রিদম ছিল নাদুসনুদুস বাচ্চা।তিথির সাথে ওকে দেখলে ইশানের হাসি পেতো।কারণ রিদমের চেহারাটাই ওরকম ছিল।পুরো তিথির কপি,জাস্ট জেন্ডার আলাদা।
ইশান সোফায় হাত মেলে বসে বললো,’এখন আর তিলের খাঁজা খাও?’
রিদম চোখ বড় করে ইশানের দিকে তাকালো।মা বলতো ছোট থেকেই নাকি সে তিলের খাঁজা খেতে পছন্দ করে।এই বড়বেলায় এসেও সে তিলের খাঁজা খায়।কিন্তু এ কথা ইশান ভাই জানলো কি ভাবে?তিথি বলেছে নাকি?
রিদমকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইশান তার একটা লোককে ডেকে রিদমের জন্য এক বক্স আনিয়ে রাখা তিলের খাঁজা টেবিলের উপর রাখতে বলে।
রিদম তো মহা খুশি।এতই খুশি যে সে ইশানকে ধরে চুমুই দিয়ে দিলো।
তখন ইশান একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে,’শালাবাবু। এর বিনিময়ে তোমায় যে একটা কাজ করতে হবে’
‘কি বলুন।করে দিবে অবশ্যই’
তখন ইশান একটা নেটের ওড়না রিদমের দিকে ধরে বলে,’তোমার আপুকে সারপ্রাইজ দেবো বলে আর দেয়া হয়নি।দিয়ে আসবে?খবরদার আমার নাম নিবেনা।’
রিদম এক সেকেন্ড ও দেরি না করে ওড়নাটা নিয়ে তিথির কাছে চলে আসলো।তিথি শাড়ীর কুচিতে সেফটিপিন লাগাচ্ছিল।রিদম দরজায় টোকা দিয়ে বলে,’টুকু আমি।দরজা খুলো।কাজ আছে’
তিথি আঁচলটা পরে,কাছে এসে দরজা খুলতেই রিদম ওর হাতে একটা ওড়না ধরিয়ে দেয়।এরপর বলে,’এই ওড়নাটা আপুরা বাহিরে রেখেছিল,আলাদা প্যাকেট।নাও ধরো,দিতে ভুলে গেছিলাম’
তিথি ওড়নাটা নিয়ে বিছানার উপর রাখে।এরপর শাড়ী সম্পূর্ণ পরা শেষ করে মাথায় সেই ওড়নাটা পরে নেয়।আয়নায় নিজেকে দেখে হাসিমুখ নিয়ে সে রুম থেকে বের হয়।কিছুদূর যাবার পর ওর গলার দিকটায় চুলকানি শুরু হয়।শুরুতে সে ভেবেছিল নতুন শাড়ী পরায় এত অস্বস্তি লাগছে।কিন্তু তার এই অস্বস্তি এখন অসহ্যকর হয়ে উঠেছে।সে রুমে আবার ফেরা ধরতেই ইশানের আত্নীয় যারা ওখানে উপস্থিত ছিলেন তারা তিথিকে চেপে ধরলো।
তিথি হাত দিয়ে বারবার গলার দিকটা চুলকাচ্ছে,পিঠের দিকটা চুলকাচ্ছে।এরই মাঝে সেই দিকগুলো লাল টুকটুকে হয়ে গেছে।
ইশান সোফায় বসে বসে তিথির এমন করুণ দৃশ্য দেখছিল।
ইশানকে খুবই খারাপ লোক মনে হলেও আজ থেকে কত গুলো বছরআগে ইশানের থেকে মুক্তি পাবার জন্য তিথি ঠিক একই কাজ করেছিল।
ইশান সেগুলো মনে করে হাসতে হাসতে টিভি দেখছে।
তিথির রজনীগন্ধা ফুলে এলার্জি আছে।
আর ইশান সেটার পারফিউমই ওড়নাটাতে মাখিয়ে দিয়েছিল।
একটা সময়ে আর থাকতে না পেরে সবার সামনে থেকেই তিথি ছুটলো ইশানের রুমের দিকে কিন্তু ওর পথ আটকে দাঁড়ায় মিসেস আরাফাত।তিনি রাগী চোখে চেয়ে থেকে বললেন,’সবাই তোমায় দেখে গিফট দিবে।এসেই এত পালাই পালাই করছো কেন?যাও ইশানের পাশে বসো’
তিথি আর যেতেই পারলোনা।ইশানের পাশে এসে বসলো তাই।কিন্তু তার গলা পিঠ যেন এলার্জি নিয়ে চলে যাবে।বারবার হাত দিয়ে চুলকাচ্ছিল সে।সবার আগে ইশানের ফুফু রত্না হানিফ এসে তিথির গলায় মোটা স্বর্ণের চেইন একটা পরিয়ে দিতে গিয়ে দেখলেন তিথির গলায় লাল রঙের মোটা দাগ।
দাগটা এলার্জির জন্য হলেও তিনি অন্য কিছু মনে করে মুচকি হেসে চেইনটা পরিয়ে সরে গেলেন।
এরপর আসলেন ইশানের ছোট দুষ্টু একটা ফুফু।তিনি তিথির গলায় একই দাগ দেখে সবার সামনে বলে উঠলেন,’ইশান!তোর কি বিবেক নাই?বৌভাতের দিন বউয়ের গলা প্রতি টা মানুষ দেখে,বিশেষত মহিলা কমিটির সবাই।এমন করে কেউ দাগ রাখে?’
এই শুনে ইশানের চোখ কপালে।সে চট করে তিথির দিকে তাকায়।তিথি তখনও গলা চুলকাচ্ছিল।ইশান ওর গলায় দাগ দেখে চমকে যায়,আর চুপ করে থাকে।ফুফু নিজের কাজটা করে চলে গেছেন।এদিকে তার কথা নিয়ে সবাই খিলখিল করে হাসছে।
তিথি আর থাকতে না পেরে উঠে চলেই গেলো।তখন ইশানের মা রেগে রেগে বললেন,’তুই না ওরে দু চক্ষে দেখতে পারিস না?
তাহলে এইসব কি?তুই বোকা নাকি আমিই আসলে বোকা!’
এই বলো তিনিও চলে গেলেন হনহনিয়ে।ইশান কোনো পাত্তা দিলোনা কারোর কথায়।কারণ সে তো জানে সে তেমন কিছুই করে নাই।এটা যে এলার্জির কারণে হয়েছে তা ইশান বেশ ভালমতন বুঝতে পেরেছে।
তিথি রুমে এসেই তড়িঘড়ি করে শাড়ীটা বদলে নেয়।মাথার ওড়নাটাকেও সরিয়ে ফেলে।এরপর ছুটে শাওয়ারের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়।তার সারা শরীর চুলকাচ্ছে। রজনীগন্ধা ফুলের গন্ধ তার নাকে এসেছিল কিন্তু সে ভাবলো সেই ফুল তো ধারের কাছে কোথাও নেই।হয়ত ভু্ল হচ্ছে।
পাগলের মতন ছুটে গোসল করতে আসার পথে কিছুই তো আনা হলোনা।এদিকে দরজাও মনে হয় খোলা।
তিথি পানির নিচে দাঁড়িয়ে এসব নিয়েই ভাবছিল। অনেক ভেবে দরজাটা একটু খুলে সে বাহিরে তাকাতেই দেখে ইশান তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে কিসের যেন কাগজ নিচ্ছে। তিথি ওকে আচমকা দেখে ভয় পেয়ে আবারও দরজা লাগিয়ে দিলো।কি করে সে এখন বের হবে!
পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হবার পর তিথি আবারও দরজা একটু খুলে।
এবার দেখে ইশান কোথাও নেই।কিন্তু তামিয়ার যে শাড়ীটা ইশান ওকে এনে দিয়েছিল সেটা বিছানার উপর গুছিয়ে রাখা।
তিথি দেখলো দরজাটাও টেনে গেছে ইশান।
সে খুশি হয় তাতে।চটজলদি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আগে দরজাটা লাগিয়ে সে দ্রুত শাড়ী পরে নেয়।এরপর চুলগুলো মুছে এলার্জির জায়গায় ভেসলিন লাগিয়ে সে রুম ছেড়ে বের হতেই মুখোমুখি হয় মিসেস আরাফাতের।উনি রেগেই ছিলেন কিন্তু এত মানুষের ভীড়ে তো কিছু বলা যায়না।তার পরেও বললেন,’এইবার আবার মুখ ডুবাইও না।ভাল করে পিঠ কাঁধ ঢেকে যাও।আমার শ্বশুর বাড়ির অনেক লোক এসেছে ।’
তিথি মাথা নাড়িয়ে ওদিকেই যায়।ইশান কোথাও ছিল না।
যেতে যেতে তিথির হঠাৎ সেইদিনের কথা মনে পড়ে যায় যেদিন সে ইশানের এলার্জির একটা ফুল ওকে উপহার দিয়েছিল।সেদিন ইশানের যে হাল হয়েছিল!তিথি খুব খুশি হয়েছিল সেদিন।তার সেই অট্টহাসি আজ তাকে সবার সামনে ছোট করলো।
‘আচ্ছা এটাতে কি ইশানের হাত আছে?
ওড়না তো রিদম দিয়ে গেছিলো।ইশানের হাত থাকবে কি করে!’
তামিয়ার নতুন শাড়ীটাতে তিথিকে অনেক ভাল লাগছিল।সবাই এবার ভাল করে ওর প্রশংসা করছে।
ইশান গালে হাত রেখে টিভিই দেখছে শুধু।তখন তামিয়া এসে ওর পাশে বসে।এরপর বলে,’মাহফুজুর রহমানের গান তুই দেখছিস?নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছিনা।এটা সত্যিই নাকি বউকে দেখে হীতাহীত জ্ঞান হারিয়ে বসে আছিস?’
এ কথা শুনে ইশান বললো,’হাসবেনা।উনি আসলেই সুন্দর গান করেন।জীবনের মায়া চলে গেলে, উনার গান শুনে সে মায়া বাপ বাপ বলে ফিরে আসে।একবার শুনে দেখো’
‘তোর তো জীবনের মায়া ফিরে এসেছেই।তাহলে কেন শুনছিস?’
‘খুশিতে।তুমি যাবে?’
তামিয়া হাসতে হাসতে চলে গেলো।
ইশানদের রান্নাঘরে সেই সব খাবার আছে যেগুলো খাওয়ার জন্য রিদম প্রতিদিন মাটিতে গড়াগড়ি খায়।
সে আর দেরি না করে সব নিয়ে এক এক করে খেয়ে চলেছে সেজন্য।
তখন একজন কাজের লোক এটা দেখে ওকে বললো,’এইসব হাবিজাবি খেয়ে যেন পেট না ভরায়।কারণ বৌভাতের খাবারে আরও ভারী আয়োজন করা আছে এগুলো খেলে আর দুপুরের খাবার সে খেতে পারবেনা।
চলবে♥