যদি তুমি বলো💌
পর্ব ১৪
আফনান লারা
তিথি সিনেমায় বহুবার দেখেছে শাড়ীর গহনা পরতে পরতে নায়িকা শুনছে, বিয়েটা করার আগে তার আরও একবার ভেবে নেয়া উচিত।
আজ তার বিয়ের দিনে তাকেও এইসব শুনতে হচ্ছে।সে ইশানকে ২য় বার দেখেনি বলে তার মনে যে খচখচ করছিল তা শুনেই মা তাকে আরও একবার ভেবে নিতে বলছিলেন ঠিক সেইসময়ে যখন পাত্রপক্ষ আসার সময় হয়ে গেছে।
তিথি হাসিমুখে লিপস্টিক টা ঠিক করতে করতে বলে,’তোমরা দেখেছো না?আমার আর কোনো অভিযোগ নেই’
মা এ কথা শুনে হাসিমুখে তার কাজ করতে চলে গেছেন।
বর এসেছে বর এসেছে শুনে তিথি তার জানালার দ্বারে এসে দাঁড়ায়।এখান থেকে বরের গাড়ী এবং গেইট দুটোই দেখা যাবে।
গাড়ী থেকে ইশান নেমেছে।তিথির বোনেরা সবাই মিলে গেইট আটকে দাঁড়িয়ে আছে।তিথি ইশানের পিঠ ছাড়া আর কিছুই দেখছেনা।এরই মাঝে আরিয়ানের মুখের এক ঝলক দেখে সে হাসলো তারপর ওখান থেকে চলে আসলো আবার।আর দেখতে হবেনা তাকে।
ইশান ইচ্ছে করে আরিয়ানকে একই রঙের পাঞ্জাবি পরিয়েছে।
সবাই ইশানকে নিয়ে ব্যস্ত। এরই মাঝে রিদম ইশানের কয়েকটা ছবি তুলে নেয় এবং ছুট লাগায় তিথির কাছে।তিথিকে সে দেখাবে তার বর আজ কত সুন্দর দেখতে লাগছে।
ছুটতে ছুটতে হঠাৎ তার হাত আটকে ধরে ইশানের বোন তামিয়া।
‘আপনি তিথি টুকুর ননাস না?’
‘হ্যাঁ’
‘হাত ধরলেন কেন?আমার সাথে প্রেম করবেন?’
তামিয়া রিদমের হাতটা টেনে আরও কাছে নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলে,’সিনিয়র মেয়েরা একমাত্র জুনিয়র ছেলেকে ভালবাসা দিয়ে বড় করে নিতে পারে।তা জানো তুমি?’
‘আমার আর বড় হতে হবেনা।এমনিতেই একটু বড় হয়েছি বলে আমাকে দিয়ে বাসার সব তরকারি বাজার করায়।হাত ধরেছেন কেন সেটা বলুন’
‘তুমি আমার ছবি তুলবেনা?’
‘আপনার ছবি আমি কেন তুলবো?’
‘আমি তোমার বেয়াইন না?’
রিদম ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে এরপর গাল ফুলিয়ে দুটো ছবি তুলে নেয়।
তামিয়া মুচকি হেসে ফোনটা ওর হাত থেকে নিয়ে নেয় ছবি দেখার জন্য।সেই সুযোগে ইশানের সব কটা ছবি সে ডিলেট করে দেয়।এরপর বলে,’ইশ রে ভুলে তোমার তোলা কয়েকটা ছবি ডিলেট হয়ে গেলো’
‘আমি বুঝলাম না আমার ফোন থেকে বেছে বেছে দুলাভাইয়ের ছবিগুলো কেন ভুলবশতই ডিলেট হবে!ধুর ভাল্লাগেনা!’
রিদম রাগ করে চলে গেলো।তামিয়া মুচকি হাসি দিয়ে ইশানের কাছে এসে বসে এরপর।হুজুর ইশানের সই নিয়ে এবার তিথির রুমে আসলেন তার থেকে সই নেবার জন্য।
সই নিয়ে এবং কবুল শুনে তিনি বের হয়ে আসলেন।তিথি কবুল বলেছে শুনে ইশান জয়ের হাসি হেসে নিলো।এরপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো তার অফিসের একটা কাজে ঢাকার বাহিরে যেতে হবে।তিথি যেন তার খালা,বোনদের সাথে ওদের বাসায় চলে আসে।ওর ফিরতে রাত হবে।
এই বলে সে চলে যায়,সাথে আরিয়ানকেও নিয়ে আসে।
ওর কথামতই ইশানের খালারা তিথিকে নিয়ে বাসায় ফেরেন।ইশানের মা রাগ করে তিথির মুখ যেন না দেখতে হয় তাই নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে রেখেছেন।
তিথিকে মিষ্টি মুখ করিয়ে ইশানের রুমে নিয়ে রাখা হলো।ওর রুমেই বাসর ঘর সাজানো।
সবাই চলে যাবার পর তিথি ইশানের সারা রুম তন্নতন্ন করে খুঁজেও একটা ছবি পেলোনা।ছবি পেলে সেটা হাতে নিয়ে কথা বলতো সে।
যাই হোক!ছবি নেই যখন,তখন অন্য কিছু দেখা যাক।
এই ভেবে সে ইশানের বারান্দায় আসে।সেখান থেকে ঘুরে পুরো রুমে দুবার চক্কর কাটে।
সব ডাবল করে রাখা।মনে হয় ইশান চায়না তার জামাকাপড়ের সাথে তিথির জামাকাপড় থাকুক,তার ড্রেসিং টেবিলের সামনে তিথি দাঁড়াক।এটা কি মহৎ কাজ নাকি হিংসামি কে জানে!
দেখে তো হিংসামিই মনে হচ্ছে!
বেশ অনেকক্ষণ হাঁটা চলা করেও ইশান আসছেনা বলে তিথি রুম থেকে বের হয়।রুম থেকে বেরিয়ে সে আশ্চর্য হয়ে যায়।
তখন রাত আটটা বাজে,বেশি না।অথচ একটা মানুষ ও বাহিরে নেই।বিয়ের দিন এরকম নিরব থাকে বাসা?
একা একা ঘুরেফিরে তিথি সেই আবার ইশানের রুমে ফিরে আসে।
এখন তার কি করা উচিত মনে করে তানিয়াকে একটা কল দেয় সে।
তানিয়া তখন টায়ার্ড হয়ে ঘুমাচ্ছিল।তাও তিথির কলে সে উঠে বসে কলটা রিসিভ করে।
‘শোন তানিয়া!তোর তো এগুলাতে জ্ঞান বেশি।তোর দুলাভাই আসতে দেরি করছে।কি করবো আমি?’
‘নাচো’
‘আরেহ মজা করছিস কেন!এই ভারী শাড়ীটা পরে আমার অসহ্য লাগছে।খুলে ফেলি?’
‘জোস হবে।নাইটি একটা আছে তোমার ব্যাগে।নিয়ে সেটা পরে নাও’
‘ছিঃ!কি বলিস!প্রথম দেখাতে আমাকে উনি নাইটিতে দেখবে?না না এটা হবেনা।লজ্জায় মরে যাব আমি’
‘তাহলে জামা আছে সেটা নিয়ে পরো’
তিথি কলটা কেটে গিয়ে ব্যাগ খোলে।ব্যাগ খুলে সে মাথায় হাত দিয়ে ফেললো।এটা অন্য একটা ব্যাগ।সম্ভবত তাদের বাসায় বেড়াতে আসা ঝুমু আন্টির ব্যাগ এটা।ব্যাগে সব তার জামাকাপড়।
এত মোটা মোটা জামা পরলে কি যে বিশ্রি লাগবে!
ঝুমু আন্টির ছেলের বউয়ের জন্য মা এক সেট নাইটি দিছিলো।সেগুলোও আছে ব্যাগে।
তিথি ঘড়ির দিকে চেয়ে ভাবলো ইশান আসার আগে আবার শাড়ীটা পরে নিবে।আপাতত সে নাইটিটা পরে একটু রেস্ট করবে।এই ভারী শাড়ী পরে বেশিক্ষণ থাকা আর যাবেনা।
তাই নাইটিটা প্যাকেট থেকে খুলে তিথি ওয়াশরুমে চলে যায়।
ফ্রেশ হয়ে এসে তিথি যেইনা বের হয়ে দাঁড়ালো রুমে ওমনি বরের পোশাকে একজনকে দেখে সে থমকে দাঁড়ায়।ইশান এত দ্রুত এসে পড়বে তা সে ভাবতেই পারেনি।
এদিকে তার শাড়ীটা বিছানার উপর খুলে রেখেই সে ওয়াশরুমে গেছিলো।
কি করে যে শাড়ীটা নেবে আর আবার গিয়ে চেঞ্জ করবে তাই ভাবছিল সে।ওমনি খুব বিকট একটা আওয়াজ হলো।
আওয়াজটা ইশানের সামনে থেকেই এসেছে।সম্ভবত সে তার হাতে থাকা পারফিউমের কাঁচের বোতলটা ফেলে দিয়েছিল।
তিথি নিচে পড়ে থাকা ভাঙ্গা কাঁচগুলো দেখছে। সে ধরে নিয়েছে এটা ভুলবশত পড়েছে,কিন্তু আসলে ইশান সেটা ইচ্ছে করেই ফেলেছিল।
তিথি ভয়ার্ত গলায় বললো,’আমি চেঞ্জ করে আসি?’
এই বলে সে দ্রুত হেঁটে বিছানার কাছে এসে শাড়ীটা হাতে নেয়। এরপর ওয়াশরুমে যাবার সময় যখন সে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় এক নজর চোখ রাখে তখন ইশানকে দেখে তার পা আপনা আপনি থমকে যায়।
সে আয়নার দিকে আরও একবার তাকায়।
ইশান মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে তার আয়নায় সে নিজেকে দেখছে।
তিথি ইশানকে দেখে ধীর পায়ে কাছে আসে এরপর অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,’ইশতিয়াক! ”
নিজের নামটা তিথির মুখে শুনে ইশান পেছনে ফিরে তাকায়।
ইশানের চাহনি দেখে তিথি শাড়ী দিয়ে গা ঢেকে বলে,’ইশান কোথায়?’
ইশান অগ্নি চাহনি নিয়ে কেবল তাকিয়েই থাকে।
তিথি এক পা এক পা করে পিছিয়ে বলে,’ইশান কোথায়?’
‘এতদিন পর দেখা হলো।কেমন আছি জানতে চাইবেনা?’
তিথি ঢোক গিলে দরজার কাছে এসে ছিটকিনি খুলে বের হতেই দেখে আগেরমতন অবস্থা, কোথাও কেউ নেই।যেন পুরো বাসাটা খালি।তিথি তাও সাহস করে ইশানের খালার রুমের বাহিরে গিয়ে দরজা ধাক্কাতে থাকে।
অনেকক্ষণ যাবত দরজা ধাক্কানোর পর খালা চোখ ডলতে ডলতে এসে দরজাটা খুললেন।জানতে চাইলেন ওর কিছু লাগবে নাকি।
তিথি কাঁপা গলায় বলতে লাগলো ইশান কোথায়।
তখন খালা আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বললেন,’ইশান তো তোমার পেছনেই’
তিথি ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকায়।এই ইশতিয়াক ইশান আর তার যে ইশানের সাথে বিয়ে হয়েছে,দুটো মানুষই কি এক!
ইশান দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল।তিথি ওভাবে দাঁড়িয়ে আছে দেখে সে বললো,’বাসায় আমার অনেক কাজিন আছে,স্পেশালি ছেলে কাজিন।নতুন বউকে নাইটিতে দেখা কেউ ভাল নজরে নেবেনা।ভেতরে আসো’
এটা বলে ইশান চলে যায় রুমের ভেতর।তিথির ভয় কাটছেনা।মাথা ঘুলিয়ে আসছে।সে চারিদিকে তাকিয়েও কাউকে পায়না।খালা আবার দরজা লাগিয়ে ফেলেছেন।
বাধ্য হয়ে সে শাড়ীটা পেঁচিয়ে আবারও সেই রুমে আসে,কিন্তু ভেতরে ঢোকেনা।করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকে।
ইশান নিচে বসে কাঁচের টুকরাগুলা একটা বক্সে ভরছে।কোনো কথা বলছেনা।
তিথি নিরবতা ভেঙ্গে বললো,’আমার যার সাথে বিয়ে হয়েছে, তিনি কোথায়?’
‘তিনি কাঁচ কুড়াচ্ছেন’
তিথি এবার রেগে যায়।
চিৎকার করে বলে,’এটা কোন ধরনের অসভ্যতামি?আমি এখনই আমার বাসায় চলে যাবো’
এই বলে তিথি শাড়ীটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে যায় কিন্তু পারেনা।ইশান এসে আটকায় ওকে।ওর চোখের দিকে যতবার তিথি তাকাচ্ছে ততবার তার গায়ের সব পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ভয়ে। এই চোখ সেইই চোখ যাকে সে এতদিন দরে দেখেছিল কিন্তু চিনতে পারে নাই।আর আজ সব স্বচ্ছ হয়ে আসছে।
ইশান ওয়াশরুমের দরজা থেকে হাত সরিয়ে ওয়ারড্রবের সাথে হেলান দিয়ে বলে,’মনে আছে?আজ থেকে অনেকগুলো বছর আগের কথা? হয়ত মনে নেই।মনে থাকবেই বা কি করে!
এক গরীব মুদি দোকানদারের ছেলে কিভাবে এত বড় বিজন্যাসম্যান হলো,কিভাবে তার পুরো জীবন বদলে গেলো!
তুমি কেন বলছি!
এটা মনে আছে যে আমি তোকে ঠিক এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তিথি!মনে আছে তোর?
মনে নেই।যদি থাকতো তবে ডেং ডেং করে প্রেম করতে চলে যেতি না।বিয়ে বসতে চলে যেতি না!তুই আমাকে কথা দিয়েছিলি আমি বড়লোক হয়ে আসলে তুই আমায় বিয়ে করবি।কোথায় গেলো তোর সেই প্রতিশ্রুতি?
আমার মাকে কাঁদিয়েছিলি মনে আছে?তোর খুব রুপের দেমাগ ছিল,তোর খুব টাকার অহংকার ছিল।এখন দেখ!আমি তোর চাইতে শত গুনে বড়লোক হয়ে এসেছি।ইশতিয়াক ইশান ইজ ব্যাক!
তোর থাকার বাসা দশটা কেনার টাকা আমার ব্যাংকে আছে।
আমার জায়গায় অন্য কোনো ছেলে হলে এখন কি করতো জানিস?তোকে কোনোদিন বিয়ে তো দূরে থাক,তোর জীবন যত নিম্ন আকারে নষ্ট করা যেতো সেটা করতো।কারণ তুই একটা ছলনাময়ী!তুই কথা দিয়ে কথা রাখিসনি!তুই লোভী!
তোকে আমি পায়ে ধরে বলেছিলাম আমি তোকে কতটা ভালবাসি,তোর জন্য আমি আকাশের চাঁদ এনে দিতে পারবো!তুই বলছিস তোর চাইতে বড়লোক হয়ে দেখাতে,তোর চাইতে শিক্ষিত হয়ে দেখাইতে।তবেই নাকি তুই আমায় বিয়ে করবি!ততদিন তুই অপেক্ষা করবি!
আমার মা পর্যন্ত তোর কাছে রিকুয়েস্ট করেছিল।তুই সেদিন আমার মায়ের সাথে কতই না খারাপ ব্যবহার করেছিলি!’
তিথি বুঝতে পারলো ইশানের মনে তাকে নিয়ে হাজারটা স্বীকারোক্তি।
এগুলো সে কিভাবে বুঝালে ইশান বুঝবে তা ওর জানা নেইই।
চলবে♥
যদি তুমি বলো💌
পর্ব ১৫
আফনান লারা
ইশানের চোখের দিকে তাকিয়ে তিথির ভীষণ ভয় হচ্ছিলো।অথচ কত গুলো বছর আগে ইশান তার চাহনিতে ভয় পেতো।
বছর কত কতকিছু পাল্টে দিতে পারে।
তিথিকে চুপ করে থাকতে দেখে ইশান এক চিৎকার দিয়ে বললো,’আমাকে যা নয় তা বলে অপমান করেছিলি।তা নাহয় বাদই দিলাম,কিন্তু তুই তাতেও ক্ষান্ত হোসনি সেদিন।আমার মা যখন সেদিন আমার কান্না দেখে তোর কাছে আমার জন্য প্রেম ভিক্ষা চাইতে গিয়েছিলো তুই আমার মাকে এত অপমান করার সাহস কই পেয়েছিলে?সেদিন হয়ত আমার কোনো ক্ষমতা ছিল না আমার মায়ের চোখের পানির প্রতিশোধ নেয়ার।কিন্তু আজ আছে’
এই বলে ইশান তিথির হাতটা শক্ত করে ধরে এরপর টানতে টানতে নিয়ে যায় রুমের বাহিরে।করিডোর দিয়ে শেষ কোণার রুমের কাছে নিয়ে আসে সে তিথিকে।এরপর দরজায় আলতো ভাবে নক করে বলে,’মা। জেগে আছো?’
‘ইশান?কি হয়েছে বাবা?’
মায়ের মৃদু স্বরের আওয়াজ শুনে ইশান দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে।
ইশানকে দেখে মিসেস আরাফাতের মুখে হাসি ফুটলেও, তার পাশে নাইটি পরে দাঁড়িয়ে থাকা তিথিকে দেখে মোটেও মনে শান্তি পাননি তিনি।তার মুখটা গোমড়া হয়ে গেলো তৎক্ষনাৎ।
ইশান তিথিকে টান দিয়ে মায়ের সামনে ছুড়ে মারলো এরপর বললো,’মায়ের পা ধরে তার কাছে তোর যত কৃতকলাপ ছিল সে বিষয়ে ক্ষমা চা।’
তিথি ছলছল চোখে মিসেস আরাফাতের দিকে চেয়ে ছিল।কোনো কথা বলছিল না বলে ইশান তাকে আবারও ধমক দিয়ে বলে ক্ষমা চাইতে।
তিথি চোখ মুছে উনার পা ধরে বলে,’আন্টি সেদিন আমি ইশানের উপর রাগ টা আপনার উপর ঝেড়ে ছিলাম।আমার সেই কাজটা করা উচিত হয়নি।বড়দের সাথে সেরকম ব্যবহার কোনো ভদ্র ঘরের মেয়ের কাজ নয়।আমি তো অভদ্র তাই সেদিন এত দূর ব্যবহার করেছিলাম।আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিবেন’
মিসেস আরাফাত সব ভুলে গেলেও অপমান কোনোদিন ভুলেন না।আর তিথির করা অপমানটা না ভুলার মতই ছিল।সে ইশানের উপর ক্ষেপে মিসেস আরাফাতকে সেদিন যা নয় তাই বলে মনে আঘাত করেছিল।সেই আঘাত উনার এখনি কাঁচা আছে।
মা কিছু বলছেনা দেখে ইশান বললো,’আমার মা তোকে ক্ষমা করবেনা।কারণ তুই ক্ষমার অযোগ্য কাজ করেছিস।এর মাশুল তোর থেকে আমি আজীবন ধরে নিবো।মনে রাখিস!’
এই বলে ইশান চলে যায়।তিথি চোখ মুছতে মুছতে আবারও চেপে ধরে মিসেস আরাফাতের পা।এরপর ধীর গলায় বলে,’আমি জানিনা এখন আমার কি করা উচিত।সব কিছু কল্পবা মনে হচ্ছে।আমার মতো মেয়ে আপনার ছেলের বউ হবার যোগ্যতা রাখেনা।আমি আসলে….’
‘থাক!আমার রুম থেকে যাও এখন।রাত বারোটা বেজে গেলো।আমি এত রাত জাগিনা,জাগলে দিনে মাথা ধরে।যাবার সময় দরজা লাগিয়ে যাবে।আর এইসব রঙঢংয়ের পোশাক জামাইর রুমের ভেতরে পরে থাকবে।বাহিরে নয়।আমার বোনের ছেলেপেলে আছে বাসায়।সবাই ইশানের বয়সী।তারা কি চোখে দেখবে?’
তিথি তার হাতের শাড়ীটাকে গায়ে পেঁচিয়ে চলে যায়।ইশানের এমন ব্যবহারে তিথির মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে।
একের পর এক অবাক করার মতন পরিস্থিতির সামনে পড়ছে সে।
অবশ্য তার কপালে এটাই ছিল।সে ওদের সাথে যা যা করেছে এটাই তার প্রাপ্য!
তিথি হাঁটতে হাঁটতে ইশানের রুমের কাছে চলে আসে।ইশান তার বারান্দায় ছিল তখন।
তিথি দরজাটা আলতো করে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে যায়,
ইশানকে বারান্দায় দেখতে পেয়ে সে ওয়াশরুমে গিয়ে নাইটিটা বদলে বিয়ের শাড়ীটা পরে বের হয়।এরপর বিছানায় বসে তানিয়ার নাম্বারে কল করে।
তানিয়া ঘুমে ছিল বলে রিসিভ করেনি।তিথি ওর জামাকাপড়ের ব্যবস্থা করার জন্য ওকে কল করছিল বারবার।কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো উত্তর না আসায় সে রুমের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে।শুয়ে তো পড়েছে ঠিক,কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই।
হুট করে তার দুনিয়া এভাবে বদলে যাবে তা সে কল্পনাও করে নি।যাকে ঘৃনা করতো,আজ সেই মানুষটা তার স্বামীর আসনে বসেছিল আর সে বুঝতেও পারেনি।
‘আচ্ছা তানিয়া তো ইশানকে চিনতো।তাহলে সে বিয়েতে ইশানকে দেখে কেন আমাকে একবারও জানায়নি?
নাকি তার মনে নেই!
তখন তানিয়ার বারো বছর ছিল।মনে হয় সে ভুলে গেছে।হতে পারে!নাহয়।তানিয়ার তো এই বিষয় লুকানোর কোনো মানে দাঁড়ায় না।’
এসব ভাবতে ভাবতে তিথি উঠে বসে।কাঁদলে তার মাথা ভীষণ ব্যাথা হয়।এখন মাথাটা ধরে সে বারান্দার দিকে তাকায় একবার।ইশান সেখানে নেই।এই অল্প সময়ে কোথায় গেলো!
তিথি বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় চলে আসে।ওখানে ইশানকে না দেখে সে পেছনে তাকায়।অন্ধকারে ইশানের রুমের সোফায় কাউকে বসতে দেখে তিথি রুমে ঢুকে আলো জ্বালায়।ইশান কপালে হাত রেখে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে।
তার সামনে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ।
তিথির লোভ হলো!তার ও এক মগ কফি খেতে ইচ্ছে হলো।তাই সে ইশানের সামনে দিয়ে হেঁটে বাহিরে গিয়ে রান্নাঘর খুঁজে বের করে দেখে সবই আছে কিন্তু কফি শেষ।
তিথি মন খারাপ করে রুমে চলে এসে দেখে ইশান রুমে কোথাও নেই।ওয়াশরুমের থেকে শাওয়ারের আওয়াজ পেয়ে তিথি বুঝলো ইশান গোসল করতে গেছে।তিথি টেবিলের কফির মগটা দেখলো তখন।কফিতে মনে হয় ইশান দুইটা চুমুকই দিয়েছিল।এখনও সব কফি পড়ে আছে।
তিথি মুচকি হাসি দিয়ে কফিটা হাতে নেয়।
আরেকজনের মুখের খাওয়া কিছু ওর পছন্দ না হলেও এখন তার হাতে আর কোনো উপায় নেই।
কফির মগটা নিয়ে সে বিছানায় এসে বসে। এক টানে পুরোটা খেয়ে নেয়।
ইশান গোসল করে বেরিয়ে দেখে তার কফির মগটা আগের জায়গায় ঠিকই কিন্তু সেটা খালি।
আর তিথি বিছানায় অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে আছে।
কফিটা ইশান ইচ্ছে করেই রেখেছিল,কারণ সে জানে তিথি কাঁদলে অনেক বেশি পরিমাণে চা,কফি খায়।তাই কাজের লোককে ডেকে সে কফি বানিয়েছিল।
চুল মুছতে মুছতে সে তিথির সামনে এসে দাঁড়ায়।
তিথির ঘুমন্ত মুখটার দিকে চেয়ে থেকে ইশান বলে,’আমি কাঁদাবো,আবার আমিই কষ্ট তাড়াবো!’
এরপর সে রুমের আলো নিভিয়ে আবারও সোফায় এসে বসে।তিথি হয়ত ভুলে গেছে ইশান কফি খায়না।
যদি মনে রাখতো তাহলে এখন ওর সব বোঝা হতো।
“যাকে এত কিছু দিয়ে ভালবেসেছিলাম সে কেবল বাহিরেরটাই দেখে গেলো!
না আমায় চিনলো,না আমায় বুঝলো আর না আমায় ভালবাসলো কোনোদিন!
কি পেলাম তাকে ভালবেসে!
কি পেলাম এত পরিশ্রম, এত পরিকল্পনা করে?সেই মানুষটা স্বার্থপর হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকলো।’
—–
পরদিন ভোর ৫টা ৩মিনিটে তিথির কানের কাছে এলার্ম বেজে ওঠে।
এমনিতে তিথি প্রতিদিন সকাল নয়টায় উঠলেও আজ ভোর পাঁচটার এলার্ম কে দিলো তার জানা নেই।সে লাফিয়ে উঠে বসে ঘুম ঘুম চোখে ঘড়িটা খুঁজতে থাকলো বন্ধ করার জন্য।ঘড়িটা হাতে নিয়ে বন্ধ করে সে চোখ ডলে ডানে বামে তাকায়।
ইশান রুমে নেই।তাহলে এলার্মটা কে দিছে!
এদিকে তিথির ঘুম গায়েব।
বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে যায় তিথি।
এলার্মটা ইশান দিয়েছিল।তার আজ ভোরভেলা বিদেশ থেকে একজন ক্লায়েন্ট আসবে তাকে নতুন নুডুলসের প্রোডাক্টের মান চেক করাতে।তাই খুব ভোরে যাবার পথে সে তিথিকেও জাগিয়ে দিতে চেয়েছিল।তিথির যত পুরান অভ্যাস আছে সব বিপরীত রেখায় জুড়ে দিবে সে।
তিথি চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখছে।
এত ভোরে ওঠা তার অভ্যাস নেই।
দরজা খুলে বাহিরে বেরিয়ে সে রান্নাঘরে কারোর কাজের আওয়াজ পেয়ে ওদিকে যায়।গিয়ে দেখে দুইজন বুয়া মিলে সকালের নাস্তা তৈরি করছে।তিথিকে দেখে তারা মুচকি হাসি দেয় দুজনে কিন্তু কিছু আর বলেনা।
তিথি ওদের কাছে গিয়ে বলে,’বাসায় দেশি কলা আছে?আসলে আমি সকালে কলা দিয়ে মুড়ি খাই’
‘ছিল ম্যাডাম।কিন্তু স্যার দেখলাম কাল সব কলা আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য বলে দিছিলো।তাই আমরাও নিয়ে গেছিলাম’
তিথি মনে মনে ভাবছে ইশান এইসব ইচ্ছে করেই করেছে নির্ঘাত!
চলবে♥