#যখন_আমি_থাকবোনা
#পর্ব_৬
#লেখক_দিগন্ত
মুক্তি সকালে ঘুম থেকে উঠে চলে যায় রান্নাঘরে। আলেয়া চৌধুরী সাথে খুব জরুরি কথা আছে যে তার। রান্নাঘরে প্রবেশ করেই মুক্তি দেখতে পায় আলেয়া মাথা নিচু করে রান্না করে চলেছে। মুক্তিকে দেখে গতরাতের প্রসঙ্গ তুলে বলে,
-“গতকাল রাতের জন্য তুমি চাইলেই আমাকে দোষ দিতে পারো। আমি কিছু মনে করবো না। কিন্তু একটা কথা…আমি চেষ্টা করেছিলাম। তোমাকে ধোকা দেওয়ার কোন অভিপ্রায় আমার কখনো ছিল না, এখনো নেই। আমি তোমার পাশে আছি।”
মুক্তি মুচকি হেসে বলে,
-“আমি জানি আপনি আমার সাথেই আছেন। আপনাকে আমি কোন কিছুর জন্যই দোষ দেবো না।”
মুক্তির কথায় আলেয়া চৌধুরী স্বস্তি পায়। কিন্তু তার এই স্বস্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। তাদের বাড়ির এক কাজের মেয়ে দৌড়ে এসে খবর দেয়,
-“সর্বনাশ হয়ে গেছে ম্যাডাম। পাশের ডোবা থেকে আব্দুল্লাহ হকের গ*লা*কা*টা মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। স্যার ওখানেই আছেন। আমার তো শুনেই পুরো শরীরটা কাপছে। মানুষটাকে কেউ কেন এত নিষ্ঠুরভাবে হ*ত্যা করল আমি বুঝতে পারছি না।”
আলেয়া চৌধুরীর বুক কেপে ওঠে। যাই হোক না কেন একসময় পাগলের মতো ভালবাসতো সে আব্দুল্লাহকে। তার মৃত্যুর সংবাদে কষ্ট পাওয়াই অবশ্য স্বাভাবিক। এরমধ্যে আলেয়ার মস্তিষ্কে কিছু চিন্তার উদয় হলে সে সন্দেহের দৃষ্টিতে মুক্তির দিকে তাকায়। ইশারা করে কাজের মেয়েটাকে চলে যেতে বললে মেয়েটা চলে যায়।
আলেয়া চৌধুরী মুক্তিকে প্রশ্ন করে,
-“তুমি কি এসবের পেছনে রয়েছ? কাল রাতে তো আমরা আব্দুল্লাহকে অপহরণ করার পরিকল্পনা করেছিলাম। তার থেকে সব সত্য জানার কথা ছিল আমাদের। তারপর তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার কথা ছিল। এর কিছুই হলো না। কাল রাতে আমরা তো আব্দুল্লাহর কোন খোঁজই পেলাম না। তাহলে এখন কিভাবে এসব হলো?”
মুক্তি দৃঢ়তার সাথে বলে,
-“আমি এই ব্যাপারে কিছু জানি না। আমি আলাদা করে কোন পরিকল্পনা করি নি। এর পেছনে অন্য কারো হাত আছে। এবার আমাদের তাকেই খুঁজে বের করতে হবে।”
_________________
বিপ্লব আজ অফিসে যায় নি। কোন শারীরিক সমস্যা না, আজ সমস্যা তার মনের। কেন জানি আজ ভেতর থেকে কোন চাপা কষ্ট অনুভব করছে। মন খারাপের অছিলাতেই আজ অফিসে যায় নি সে। জানে এর কারণে বসের অনেক কথা শুনতে হবে কিন্তু সে নিরুপায়। মনের অসুখ যে বড় অসুখ। শারীরিক অসুখের অনেকে মনের অসুখকে তুচ্ছ মনে করে কিন্তু সত্যিকার অর্থে মনের অসুখ শরীরের অসুখের থেকে বেশি ভয়ানক।
বিপ্লব ঘুমানোর চেষ্টা করছিল কিন্তু তার চোখে ঘুম আসছিল না। এমন সময় স্নেহা তার রুমে প্রবেশ করে। বিপ্লবকে শুয়ে থাকতে দেখে বলে,
-“বেশ ভালোই তো আছো দেখছি। নতুন বউ, নতুন সংসার। সবকিছু নিয়ে বেশ আনন্দেই দিন পার করছ। এটাই হয়তো তোমার আসল রূপ৷ সব পুরুষ মানুষই এক। একজনকে পেলে আরেকজনকে ভুলে যায়। তাই তুমিও খুব সহজেই…”
বিপ্লব স্নেহাকে তার কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই বলে,
-“আমি তাকে ভুলিনি ভাবি। এখনো আমার বক্ষমাঝে সে অবস্থান করে।”
কথাটা বলে নিজের বুকে থাকা লকেট থেকে ছবিটি বের করে স্নেহাকে দেখায় বিপ্লব। ছবিটি দেখে স্নেহা আবেগ্লাপুত হয়ে বলে,
-“নেহা…”
বিপ্লব হালকা হেসে বলে,
-“এই পৃথিবীর সবাই ওকে ভুলে গেলেও আমি কখনো নেহাকে ভুলতে পারবো না। নেহা আমার হৃদয়জুড়ে থাকবে সবসময়। অন্য কেউ আমার মন থেকে নেহার যায়গা দখল করে নিতে পারবে না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো এই ব্যাপারে।”
স্নেহা প্রসন্ন হয়ে রুম থেকে বের হয়। রুম থেকে বের হতেই তার কেমন জানি একটা মন খারাপ আগে। নিজেকে বড্ড স্বার্থপর মনে হয় তার।
-“নেহা তো এখন আর নেই। তাহলে বিপ্লব কেন তাকে আজীবন মনে রাখবে? এই পৃথিবীতে তো কোনকিছুই থেমে থাকে না। আমি কি স্বার্থপরতা করছি না? মুক্তির প্রতি হওয়া অন্যায়কে কি সমর্থন করছি না আমি? মুক্তি তো এখন বিপ্লবের বউ। তার পূর্ণ হক আছে বিপ্লবের উপর। সেখানে বিপ্লব…না এটা ঠিক নয়। কিন্তু আমি যে এই বেঠিক কাজেই সায় দিচ্ছি। কি করব? আমি যে স্বার্থপর অনেক বেশিই স্বার্থপর।”
___________________
আব্দুল্লাহ হকের মৃত্যুতে খুব ভেঙে পড়েছেন বাকের চৌধুরী। যতই হোক তার বিশ্বস্ত বন্ধু, তার ডানহাত বলে কথা। সেই ছোটবেলা থেকে তাদের এই সুন্দর বন্ধুত্ব। আব্দুল্লাহ হকের মৃত্যু তাই সত্যিকার অর্থেই তার কাছে বেদনাদায়ক।
এত সবকিছুর মাঝে বাকের চৌধুরীকে সবথেকে বেশি অবাক করেছে আলেয়ার মৌনতা। বাকের চৌধুরী জানে আলেয়া ও আব্দুল্লাহর ভালোবাসার কথা। সেই কলেজ লাইফ থেকেই তো আলেয়া ভালোবাসতো আব্দুল্লাহকে। যেই ভালোবাসা ছিল সীমাহীন। ভাগ্যের খেলায় তারা এক হতে পারে নি। ভাগ্যের খেলা যে বড় নিষ্ঠুর। যার থেকে রেহাই পায়নি বাকের চৌধুরীর মতো মানুষও। নিজের প্রাণপ্রিয় বন্ধুর ভালোবাসার মানুষটাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে।
আলেয়া নতুন সংসার করলেও আব্দুল্লাহ জীবনটা একাই কা*টিয়ে দিল। বিয়েশাদি করে নি সে। এসব থেকেই খুব ভালোভাবে বোঝা যায় আব্দুল্লাহ কত ভালোবাসতো আলেয়াকে। আলেয়াও কি ভুলতে পেরেছিল আব্দুল্লাহকে? হয়তো স্বামী সংসার এসব নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু মনের কোণে কিছুটা হলেও যায়গা জুড়ে তো আব্দুল্লাহ রয়েই গিয়েছিল।
আলেয়া যখন চা নিয়ে বাকের চৌধুরীর সামনে আসে তখন বাকের চৌধুরী আর থাকতে না পেরে সরাসরি প্রশ্নই করে বসে,
-“তুমি এত নিশ্চুপ কেন আজ? আব্দুল্লাহর মৃত্যুর খবর কি তুমি শোনোনি? যাকে একটা সময় ভালোবাসতে তার মৃত্যু কি বিন্দুমাত্র কষ্ট দেয়নি তোমাকে?”
আলেয়া স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলে,
-“বিশ্বাসঘাতকদের জন্য নষ্ট করার মতো জল আমার চোখে নেই।”
বাকের চৌধুরী দমে যায় আলেয়ার কথাটা শুনে। কারণ তার কাছে বলার মতো আর কিছু নেই। সে নিজেও সবটা জানে।
আলেয়া বাকের চৌধুরীকে চা দিয়ে রান্নাঘরে ফিরে এলে মুক্তি বলে,
-“চায়ে ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছেন তো?”
আলেয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। আলেয়ার চোখেমুখে ভয় আর দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। যেটা মুক্তির চোখ এড়ায় না। মুক্তি আলেয়াকে অভয় দিয়ে বলে,
-“চিন্তা করবেন না। আপনার স্বামীর কোন ক্ষতি আমি করবোনা। তার কাছ থেকে কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইব শুধু। আর বেশি কিছু নয়।”
মুক্তির কথায় আলেয়া স্বস্তি না পেলেও ভরসা পায়।
অন্যদিকে চা খাওয়ার কিছুক্ষণ পর ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়ে বাকের চৌধুরী। মুক্তি ও আলেয়া নিজেদের কাজে লেগে পড়ে।
•
বাকের চৌধুরীর জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে একটি আবদ্ধ করে আবিষ্কার করে। চোখ মেলেই মুক্তিকে দেখতে পায়। মুক্তি ভেবেছিল তিনি হয়তো অবাক হবেন কিন্তু মুক্তিকেই অবাক করে দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বসে থাকেন বাকের চৌধুরী।
মুক্তির দিকে একপলক তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলে,
-“বাকের চৌধুরীকে তুমি এখনো চিনতে পারো নি। আমি বড্ড জেদি। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার সাথে কেউ কিছু করতে পারে না। তুমি আমাকে এখানে নিয়ে আসতে পেরেছ তার কারণ আমি চেয়েছি এখানে আসতে। আমি না চাইলে তুমি কখনো পারতে না।”
মুক্তি নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-“একটা মানুষের যে কত রূপ, কত ছলনা থাকতে পারে সেটা আপনাকে না দেখলে বুঝতাম না৷ আপনি কেন জামিলাকে দিয়ে আমার তথাকথিত বাবা মিরাজ হোসেনকে মে-রে ফেলার ব্যবস্থা করেছেন আর কেনই বা নিজের প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে নিজের হাতে…”
বাকের চৌধুরী ইশারা করে থামিয়ে দেয় মুক্তিকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
-“মিসেস মতিয়া মান্নানকেও আপনি শে-ষ করেছিলেন তাইনা?”
বাকের চৌধুরী বলেন,
-“যাকে ভালোবাসা যায় তাকে কখনো মে*রে ফেলা যায়না।”
(চলবে)