মৌনতা পর্ব-০৫

0
662

#মৌনতা
#পর্ব_৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________
সম্পর্কের টানাপোড়নে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। আমি যদি আগে কখনো একটুও টের পেতাম যে, ভালোবাসলে এত কষ্ট পেতে হয় তাহলে বিশ্বাস করুন, কাউকে ভালোবাসার মতো এমন বিশাল দুঃসাহস দেখাতাম না। মনের জমিনে যখন ভালোবাসা নামক বীজের দৈহিকতা বাড়ছিল ঠিক তখনই উপড়ে ফেলে দিতাম। এখন আমার ভালোবাসায় ভয় হয়। ভীষণ ভয়! আমার জন্য এমনকিছু অপেক্ষা করছে জানলে হয়তো আমি কখনো বিয়েটাও করতাম না। তাছাড়া এই বিয়ের মানে কী? যাকে ভালোবাসি তাকে নিজের করে পেয়েছি ঠিকই; কিন্তু সেটা শুধুমাত্র কাগজে-কলমে। মানসিকভাবে, ভালোবাসায় আমি তাকে পাইনি। আমার এত বেশি কষ্ট হয় যে, মিথ্যে হাসি দিতে গেলেও বুকে টান পড়ে। চিনচিনে একটা ব্যথা হয়।

আমাদের হানিমুনে যাওয়া হয়নি। পড়াশোনার অজুহাত দেখিয়ে আমিই প্ল্যান ক্যান্সেল করেছি। এজন্য তিনি অবশ্য খুশি হয়েছিলেন। পরেরদিন রাতেও দিয়েছিলেন শুষ্ক ধন্যবাদ। আমি শুধু হাসি। এই হাসি আনন্দের নয়, বিষাদের। পরের সপ্তাহ্ থেকে আমার টেস্ট পরীক্ষা। কিন্তু আমি কিছুই পারি না। সারাক্ষণ বইয়ে মুখ গুঁজে থাকলে কী হবে? পড়া তো আর আমার হয় না। বাড়ির সবার ধারণা ছিল, মেয়ে খুব পড়ছে। একদম বিরক্ত করা যাবে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি যে পুরো শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম এটা কাউকে বোঝাতে পারছিলাম না। আমি চাচ্ছিলামও না, কেউ বুঝুক। বুঝেই বা আর কী হবে? আমার এই পরিণতির জন্য তো আমি নিজেই দায়ী। ভালোবাসার মতো দুঃসাহস দেখিয়েছি, শাস্তি তো আমার প্রাপ্য-ই।

আমি জানি, আমার পড়াশোনা কিচ্ছু হবে না। তবুও বই নিয়ে বসে আছি। আমার মা এল গরম দুধ নিয়ে। টেবিলের ওপর গ্লাসটা রেখে মাথায় হাত রাখল। নরমস্বরে ডাকল,

“পুষ্প?”

আমার ভেতরটা যেন মুহূর্তেই গুড়িয়ে গেল। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম আমি। মা আমার মাথাটা তার বুকে চেপে ধরে বলল,

“আমার পরীটার এত দুঃখ কেন?”

আমি উত্তর দিতে পারলাম না। এতটাদিন শুধু সুমা জানত, আমি কীসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। বুকে আগলে আমাকে মানানোর চেষ্টা করত। কিন্তু তবুও কোথাও কিছুর যেন একটা কমতি ছিল। আমার খুব ইচ্ছে করত, একটু মায়ের কোলে মাথা রেখে মন ভরে কাঁদি। কখনো বা ইচ্ছে করত ঐ মানুষটার বুকে মাথা রেখে সব কষ্টগুলো উগড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কেন আমায় একটু ভালোবাসেন না?’ কিন্তু সবার সব ইচ্ছে কি আর পূরণ হয়? হয় না। আমারও হয়নি। মা হোক কিংবা সে; কারও সামনেই আমি নিজেকে ভেঙেচূড়ে প্রকাশ করতে পারিনি। আজ মায়ের আদর, নরমস্বরে যেন আমার বাইরের শক্ত প্রাচীর চুড়মুড় করে ভেঙে গেল। মা আমাকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে বিছানায় বসাল। মুখোমুখি বসল নিজে। আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কী হয়েছে আমাকে বল তো? তুই এত বদলে কেন গেছিস?”

আমি কান্নার জন্য কথা বলতে পারছিলাম না। মা ফের বলল,

“বিয়ের পর কি তুই এতটাই বড়ো হয়ে গেলি যে, আমাকেও নিজের কষ্টের কথা বলা যায় না? আগে তো সব বলতি। এখন কি মা পর হয়ে গেছি? তোর নিরবতা, শুষ্ক হাসি, গালে লেগে থাকা চোখের পানির চিটচিটে ভাব, চোখের নিচে কালো দাগ, শুকনো মুখ সমস্ত কিছুই আমার চোখে পড়ে রে মা। আমি যে তোর মা। তোকে পেটে ধরেছি আমি। তোর সত্যি হাসি আর মিথ্যা হাসির পার্থক্য আমি বুঝি। ভেবেছিলাম, তুই নিজেই হয়তো আমাকে সব বলবি। কিন্তু তুই তো আমাকে পর করে দিয়েছিস।”

আমি মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,

“সে আমাকে ভালোবাসে না মা। আমি ভেতর থেকে একদম শেষ হয়ে যাচ্ছি।”

মা তৎক্ষণাৎ কিছু বলল না। হয়তো আমাকে সামলে নেওয়ার সুযোগ দিল। আমিও নিজের মনে লুকিয়ে থাকা সব কষ্টের কথা মাকে অনায়াসে আজ বলে দিলাম। লক্ষ্য করলাম, মায়ের শরীরও কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। তাকিয়ে দেখি আমার মা, আমার জান্নাত কাঁদছে।

মা আমার হাতে চুমু খেয়ে বলল,

“জোর করে মানিয়ে নিতে বলব না। শুধু বলব, সম্পর্কটাকে একটু সময় দে। কষ্ট তো অনেক সহ্য করলি। আরেকটু না হয় সহ্য কর। এরপর তুই যা চাইবি, যেটা তোর ভালো মনে হবে সেটাই হবে। তুই মেহরাবকে চেয়েছিস, আমরা রাজি হয়েছি। তোর যদি মনে হয় তুই আর ওর সাথে থাকতে চাস না তাহলে সেটাও আমরা মেনে নেব। কিন্তু তোকে আগে ধৈর্য ধরতে হবে। সময় দিতে হবে। নিজেকে, নিজের মনকে বুঝতে হবে। মেহরাবকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। ডিভোর্স কিন্তু কোনো সহজ বিষয় না মা। এতদূর অব্দি পৌঁছানোর আগে নিজের সমস্তটা দিয়ে চেষ্টা কর আর একবার।”

আমি কাঁদতে কাঁদতেই বললাম,

“আমি তো তাকে হারাতে চাই না মা। আমি তাকে ছাড়া থাকার কথা ভাবতেও পারি না। কিন্তু তার অবহেলা আমাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। আমি যে আর পারি না মা!”

মা এবার আমায় জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,

“পারতে হবে। ভালোবাসতে পেরেছিস আর নিজেকে শক্ত করতে পারবি না? আমি যেগুলো বললাম সেগুলো করার চেষ্টা কর। তার আগে পড়াশোনাও ঠিকমতো কর মা। আজকাল কোনো সম্পর্কের গ্যারান্টি না থাকলেও, সুন্দর ক্যারিয়ারের গ্যারান্টি কিন্তু ঠিকই আছে। তাই সাময়িক শোকে এমনকিছু করিস না যেটাতে তোর ক্যারিয়ার তৈরির পথ নষ্ট হয়। আমার পুষ্প, আমার কথা শুনবে না?”

আমি নিরবে মাথা দোলালাম। মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,

“আমি চেষ্টা করব মা।”

“ব্যস! আমার মেয়ে আমার জন্য চেষ্টা করবে। আমি এতেই খুশি।”

মায়ের সঙ্গে কষ্ট শেয়ার করার পর থেকে নিজেকে অনেকটাই হালকা লাগছিল। কষ্ট হলেও মায়ের কথাগুলো রাখার চেষ্টা করছিলাম। আমার খাওয়া-দাওয়া, ঘুমের ব্যাপারে মা সতর্ক দৃষ্টি রাখা শুরু করেছে। আজকাল আমি আর ঐ বাড়িতে যাই না। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি একবার হলেও এসে আমাকে দেখে যাবে। অফিস থেকে ফেরার পথে শ্বশুর আব্বা কিছু না কিছু খাবার এনে দিয়ে যায় আর বলে ঠিকমতো যেন পড়াশোনা করি। শাশুড়ি মা-ও এটা ওটা রান্না করে নিয়ে আসে। আমার ভাসুর প্রতিদিন না এলেও সপ্তাহে একদিন আসবে। জোর করে হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে যাবে। আমার জা তো নয় যেন আপন বোন। তার শপিং ভীষণ পছন্দ। অনলাইনে কোনো কিছু পছন্দ হলেই কিনে ফেলবে। আগে নিজের জন্য কিনলেও এখন থেকে দুটো করে কেনে। একটা আমার জন্য বরাদ্দ। দু, তিনদিন পরপরই এটা, ওটা নিয়ে এসে বলবে,’দেখো তো পুষ্পিতা, এটা কেমন হয়েছে? পরে দেখো।’ আমি মন থেকেই গ্রহণ করি। এমনকি ছোট্ট টুম্পাও আসে নিয়ম করে। আমার সাথে গল্প করে, হাসে, সময় কাটায়। আসে না শুধু ঐ মানুষটা। যার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকি, প্রতিক্ষায় থাকি। এমনকি আসে না তার কোনো ম্যাসেজ কিংবা ফোনকলও। মাঝে মাঝে ভাবি, সত্যিই কি তাকে ভালোবেসে বড়ো কোনো অপরাধ করে ফেলেছি?

আমি সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে চেষ্টা করছিলাম পড়ায় মনোযোগ দিতে। আগামীকাল থেকে পরীক্ষা। এতদিন কোনো চিন্তা না হলেও এবার হচ্ছিল। রীতিমতো ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল আমার। পড়া শেষ করে রাতে ঘুমানোর সময় অপ্রত্যাশিত একটা ম্যাসেজ পেলাম। তার ম্যাসেজ।

“ভালোমতো পরীক্ষা দিও। অল দ্যা বেস্ট।”

ছোট্ট একটা ম্যাসেজ। তবুও এইটুকু যে আমাকে কতটা আনন্দিত করেছে আমি তা ভাষায়ও প্রকাশ করতে পারব না। খুব আশা ছিল সকালে হয়তো দেখা হবে। আমি নিজেই ঐ বাসায় গিয়ে দেখা করে আসব। কিন্তু আমি গিয়ে তাকে পাইনি। মনটা এত বেশি খারাপ হয়ে গেল যে, আমার ইচ্ছে করছিল আমি চিৎকার করে কাঁদি। মানুষটা কি পারত না অন্তত আজকের দিনটা একবার দেখা করে একটু হাসিমুখে কথা বলতে? আসলে ভুলটা আমারই। আমিই হয়তো বেশি আশা করে ফেলেছি। আরও একটা জিনিসের শিক্ষা পেলাম যে, জীবনে আর যাই হোক কারও কাছে এক্সপেক্টেশন রাখতে নেই।

এর প্রভাব আমার ওপর ভালোভাবেই পড়ল। আবার কেমন যেন ঝিম মেরে গেলাম। চুপচাপ বই নিয়ে বসে থাকতাম। বাকি পরীক্ষাগুলোতেও আর ঐ বাসায় গেলাম না। নিজের মতো থাকার চেষ্টা করতাম। সব ভুলে একটু ভালো থাকার চেষ্টা করতে গিয়েও যে মুখ থুবড়ে পড়ব সেটা আশা করিনি। পরীক্ষা শেষ করে বান্ধবীরা ভাবলাম একটু ঘুরতে যাওয়া যায়। এর মাঝে সুমা আর আমি ক্লাসের বাকিদের সাথেও মেশা শুরু করেছি। সুমা নিজেই হেল্প করেছে। অনেক মানুষের মধ্যে থাকলে কষ্ট তো ভুলে থাকতে পারব এই আশায়। সুমার প্রচেষ্টা অবশ্য পুরোপুরি সফল না হলেও বিফলে যায়নি। সবার সঙ্গে যখন থাকি তখন আসলেই কষ্টকে এতটা প্রগাঢ় মনে হয় না। মনে হয়, এইটুকু তো কষ্ট! ঠিক মানিয়ে নিতে পারব।

পরীক্ষা যেদিন শেষ হলো তার পরেরদিনই আমরা সবাই মিলে বসুন্ধরা শপিংমলে ঘুরে কেনাকাটা করলাম। মুভি দেখলাম। কয়েকজন বলল, অনেকদিন কাচ্চি খাওয়া হয় না। আজ বরং সবাই মিলে কাচ্চি খাওয়া যাক। কাচ্চি আমার আহামরি কোনো প্রিয় খাবার নয়। কিন্তু ওদের জন্য রাজি হয়ে গেলাম। আসল চমকও রেস্টুরেন্টেই অপেক্ষা করছিল। ভেতরে যাওয়ার পর দেখলাম একটা টেবিল দখল করে বসে আছে আমার ভালোবাসার মানুষ এবং তার মুখোমুখি বসে আছে আমার অপরিচিত একটা মেয়ে। আমি সেখানেই থমকে গেলাম। পা বোধ হয় মেঝেতে আটকে ছিল এমনটা মনে হচ্ছিল আমার। আমি সুমাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

“তোরা গিয়ে বোস। আমি আসছি।”

সুমা চোখের ইশারায় কিছু বললেও সেদিকে আমার কোনো ধ্যান নেই। আমি মেহরাবের কাছে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে দুজনের মাঝখানে বসলাম। মেহরাবের চেহারায় কোনো পরিবর্তন না দেখলেও মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে বলল,

“কে আপনি?”

আমি এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,

“হাই আপু, আমি পুষ্পিতা। আপনি?”

মেয়েটা বোধ হয় ভড়কে গেছে। হাত বাড়াল না, এমনকি মুখেও কিছু বলল না। আমি নিজেই তার হাত টেনে হ্যান্ডশেক করে বললাম,

“সৌজন্যতা রক্ষা করতে হয়।”

“কী হচ্ছে এসব?”

আমি এবার তার দিকে তাকালাম। আমার কষ্টের চেয়েও রাগ বেশি হচ্ছিল। অন্য একটা মেয়ের সাথে আমি কিছুতেই তাকে মানতে পারছিলাম না। আমি তার প্রশ্নপর জবাব দিলামকঠিন গলায়। বললাম,

“কিছুই হয়নি। যা হওয়ার এবার হবে। শেষ হবে সবকিছুর।”

এরপর চেয়ার ছেড়ে উঠে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলাম। এতক্ষণের আটকে রাখা কান্না এবার বর্ষার বৃষ্টির ন্যায় পড়ছিল। আহ্! জীবনে কত বড়ো ভুল যে করেছি ভালোবেসে!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে