মৌনতা পর্ব-০৪

0
708

#মৌনতা
#পর্ব_৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
এতদিন শুনে এসেছি বিয়ের পর নাকি অনেক কিছু বদলে যায়। বিশেষ করে বদলে যায় একটি মেয়ে। বদলে যায় তার পরবর্তী গোটা জীবন। কিন্তু একটা মানুষ যে এতটা পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে সেটা মেহরাব ভাইকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না আমি। আমার মধ্যে বিশেষ কোনো পরিবর্তন নেই। পড়াশোনা, পরিবার সব ঠিকঠাক আছে আগের মতো। যখন যেই বাসায় ইচ্ছে থাকছি। কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। তবে বিয়ের প্রায় একটা সপ্তাহ্ ভীষণ ব্যস্ততায় কেটেছে। দুই পরিবারেরই আত্মীয়-স্বজনরা দলে দলে এসেছে। যতটা সম্ভব আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে সবার। সবাই আবার চলে যেতেই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছিল। কেবলমাত্র বদলে গেছিল আমার আর মেহরাব ভাইয়ের মধ্যকার কথাবার্তার আদান-প্রদান। বিয়ের দিন থেকেই প্রয়োজন ছাড়া সে আমার সাথে কথা বলে না। এমনকি আমি তাকে আমার সামনে হাসতেও দেখিনি। এক বিছানায় ঘুমানোর পরও কখনো ভুল করেও তার হাত আমার গায়ে পড়েনি। রাতে যে কাৎ হয়ে ঘুমাত, সকালে সেই কাৎ-এই ঘুম থেকে উঠত। একটা মানুষ এভাবে কেমন করে ঘুমাতে পারে আমি বুঝি না। প্রথম প্রথম বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবে নিলেও এখন কেমন যেন লাগে। সবচেয়ে খারাপ লাগে সে আমার সাথে কোনো কথা বলে না বলে। আগে তো খুব খোঁজ-খবর নিত। রাগারাগি করতো। ঝগড়াও হতো আমাদের। আর এখন কাছাকাছি থেকেও মনে হয় মাঝখানে কত দূরত্ব!

সুমার সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছি আমি। সুমার সাজেশন ছিল, আমি যেন সরাসরি মেহরাব ভাইয়াকেই কথাগুলো জিজ্ঞেস করি। গতকাল রাতে আমাদের বাসায় ছিলাম। সুমার সাথে ফোনে কথা বলে মনে হলো, আসলেই কিছু বিষয় তার সাথে খোলাশা করা দরকার। আমি ঐ বাড়িতে যাওয়ার পর শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে দেখা হলো। আমি তাকে কখনো মা, আবার কখনো আন্টি বলেও সম্বোধন করি। তিনি বললেন,

“এত দেরি করে আসলে কেন? নাস্তা করবে আসো।”

“আমি খেয়ে এসেছি। মেহরাব ভাইয়া বাসায় নাকি হাসপাতালে চলে গেছে?”

মা মুচকি হেসে বললেন,

“বোকা মেয়ে! এখনো ভাই ডাকো?”

আমি কিছুটা লজ্জা পেয়ে মাথা নত করে ফেললাম। মা বললেন,

“ঘরেই আছে। বের হবে একটু পর।”

“আচ্ছা।” বলে আমি রুমে গেলাম।

তিনি রেডি হচ্ছিলেন। একবার দরজায় আমার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিলেও সব যেন এলোমেলো হয়ে গেল। যা যা বলব বলে ভেবে এসেছিলাম তা তো বলতে পারলামই না উলটো কাঁদোকাঁদো স্বরে জিজ্ঞেস করে ফেললাম,

“আপনি আমার সাথে এমন করছেন কেন?”

তিনি বেশ স্বাভাবিকভাবেই বললেন,

“কেমন?”

“এইযে ভালোমতো কথা বলেন না। ভালোমতো কথা বলা তো দূরে থাক; আপনি তো আমার সাথে কথাই বলেন না।”

“বলি তো!”

“দরকার ছাড়া একটা কথাও বলেন না আপনি আমার সাথে। রাগ করেছেন আমার ওপর?”

“রাগ করব কেন?”

“এইযে আমার সাথে বিয়ে হয়েছে তাই।”

“সেরকম কিছু না।”

“তাহলে কি ভালোবাসি বলে অবহেলা করছেন?”

তিনি এবার আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিলেন। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“সবকিছু আসলে এত দ্রুত ঘটে গেছে যে আমি এখনো সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে পারছি না।”

“এর মানে কী?”

“কিছু না। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার যেতে হবে।”

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। তাকে আটকাতেও পারলাম না। শুধু খুব স্পষ্টভাবে তার সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে চলাটা বুঝতে পারছিলাম। আর সব বুঝেও আমার কিছু করার নেই শুধুমাত্র মৌনতা ছাড়া।

তার পরিবর্তনের সাথে সাথে আমার মনও বিষিয়ে যাচ্ছিল। আগের সেই চঞ্চলতা যেন কোথায় পালিয়ে গেল। হঠাৎ করেই আমি হাসতে ভুলে গেলাম। ভালোবাসায় যে এত যাতনা তা তো জানতাম না। ভালো তো আরও অনেকেই বাসে। কই তারা তো আমার মতো যন্ত্রণায় নেই। তারা তো ঠিকই ভালো আছে ভালোবাসার মানুষটার সাথে। তাহলে আমার ভালোবাসায় কমতিটা ঠিক কোথায়? তার পরিবর্তনের রেশ আমার মাঝেও এমনভাবে প্রবেশ করে যে আমি বাড়ির কারও সাথে স্বাভাবিক কথাটাও পর্যন্ত বলি না। চারপাশের সবকিছু নিয়ে বিরক্ত হয়ে গেছি আমি। বিয়ের প্রথমদিকে চেষ্টা করতাম তার কাছে কাছে থাকার। দুষ্টুমি করার।

এইতো সেদিনের কথা। ভেবেছিলাম, আমার চঞ্চলতা তার পছন্দ। খুব শখ করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু খেয়েছিলাম। তিনি গম্ভীরস্বরে বলে উঠেছিলেন,

“সবসময় সবকিছু ভালো লাগে না পুষ্পিতা। এসব একদম করবে না।”

সেই যে তার রাগী স্বর আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করল! সেই সাথে প্রস্থান করল আমার ভেতরকার সকল চঞ্চলতা, শখ, ইচ্ছে সব। সেই থেকে আমি নিজেও যেন গুটিয়ে গেলাম কিছুটা। দূরত্ব গড়ে নিলাম। এই বাড়ির চেয়ে নিজের বাড়িতেই বেশি থাকতাম। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলতাম, আমার ঐ বাসায় ঠিকমতো পড়া হয় না। ঘুম হয় না। বড়োরা কী বুঝেছে জানিনা কিন্তু তারা হঠাৎ করেই একটা সিদ্ধান্ত নিলেন।

সন্ধ্যায় দুই পরিবার একসাথে বসলেন। আমাদেরও ডাকা হলো। তারা আমাদের আলাদা স্পেস দেওয়ার জন্য ঘুরতে যেতে বলল। যাকে আধুনিক ভাষায় হানিমুন বলে সবাই। সবার সামনে তিনি কিছু না বললেও রাতে আমাকে একা বললেন। মা জোর করাতে আজ রাতে এখানেই থেকে যেতে হয়েছে। যখন ঘুমানোর জন্য রুমে এলাম, তিনি শান্তকণ্ঠে ডাকলেন,

“পুষ্পিতা?”

“হু?”

“আমি এখন অনেক ব্যস্ত। কিন্তু বাড়ির মানুষ তো সেটা বুঝবে না। তুমি ওদেরকে বলবে যে, এখন কোথাও যাব না আমরা।”

আমি তাচ্ছিল্য করে হাসলাম। অন্ধকার রুমে সেই হাসি নজরে এলো না হয়তো তার। অবশ্য তার চোখে যখন আমার পরিবর্তনটাই আটকায়নি সেখানে এই হাসি আর এমনকি? আমি কোনো দ্বিমত না করেই বললাম,

“আচ্ছা বলব।”

“থ্যাঙ্কিউ।”

“কেন?”

“আমার কথা রাখার জন্য।”

“ব্যাপার না। ঘুমান।”

সে উলটোপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। আমিও অন্যদিক ফিরলাম। বুকের গহীন থেকে বেরিয়ে এলো ভারী দীর্ঘশ্বাস। অন্ধকার রুমটিতে এখন বিরাজ করছে পিনপতন নিরবতা।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে