#মৌনতা
#পর্ব_৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________
মাত্র পাঁচদিন বাড়িতে ছিলাম না আমি। এই কয়দিনে যে এত কিছু ঘটে যাবে কল্পনাতীত ছিল। এখনো সব অবিশ্বাস্য লাগছে। কিন্তু আন্টি মেয়ের ছবি দেখিয়েছেন। দেখতে বেশ সুন্দরী। নামটাও সুন্দর। রূপা। সেও পেশায় একজন ডক্টর। তবে নতুন। দু’মাস হবে ডাক্তারি পাশ করেছে। হোক নতুন, তবুও তো ডক্টর। মেহরাব ভাইয়া নিজে একজন ডাক্তার। সে বিয়ে তো একজন ডাক্তারকেই করবে। আমার মতো কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে তো আর বিয়ে করবে না। কিন্তু এসব আমি মনকে বোঝাতে পারছিলাম না কোনোভাবেই।
অনেকক্ষণ রুম থেকে বারান্দা, বারান্দা থেকে রুম পর্যন্ত পায়চারি করে সুমাকে ফোন করে সব বললাম। সব শুনে সুমা নিজেও স্তব্ধ। প্রথমে তো বিশ্বাসই করতে চাইল না। বরং কঠিন স্বরে বলেছিল,
“সবসময় মজা ভালো লাগে না।”
“তোর মনে হয় এই বিষয় নিয়ে আমি মজা করব?”
“তার মানে সত্যিই তার বিয়ে ঠিক হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“কী অদ্ভুত! নিজের অনুভূতিটা এত দেরি করে কেন বুঝলি রে পুষ্পি?”
সুমার আদুরে আশকারা পেয়ে আমার ভেতরে জমে থাকা কান্নাগুলো এবার বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এলো। কোনো জবাবও দিতে পারছিলাম বা আমি। ওপাশ থেকে সুমার বিস্মিত স্বর ভেসে আসে,
“তুই কাঁদছিস?”
আমি উত্তর না দিয়ে কল কেটে দিলাম। এত কষ্ট কেন হচ্ছে আমার?
এরপরের সময়গুলোতে আমাকে কঠিন পরীক্ষা দিতে হলো। ভালো না থেকেও, এক বুক কষ্ট পুষে রেখে বাড়ির মানুষের সামনে হাসি-খুশি থাকার অভিনয় করাটা যে কতটা কষ্টকর সেটা আমি এই প্রথম অনুভব করতে শিখলাম। এমনও হয়েছে যে কান্না করেছি পাঁচ মিনিট হয়নি, অথচ এরপরই আবার মায়ের সাথে হেসে কথা বলেছি। আস্তে আস্তে অবশ্য নিস্তব্ধ হয়ে যেতে লাগলাম। এই নিস্তব্ধতা যেন বাবা কিংবা মায়ের চোখে না পারে সেজন্য কলেজ থেকে ফিরে বেশিরভাগ সময়ই বই সামনে নিয়ে বসে থাকতাম। এর দুটো সুবিধা। এক. বাবা-মা ভাবত আমি পড়ছি তাই আর বেশি কাছে আসতো না। বিরক্ত করত না। দুই. এই সুযোগে আমি নিজের মতো করে কাঁদতে পারতাম। চেষ্টা করতাম নিজেকে ব্যস্ত রাখার। কলেজে গেলে সুমার সঙ্গ কিছুটা হলেও আমাকে স্বস্তি দিত। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হতো যখন আমি মেহরাব ভাইয়াকে দেখতাম। আগে তার হাসি দেখলে রাগ লাগতো। এখন তার হাসি দেখলে কষ্ট হয়। বারংবার মনে হয়, এটা তো সুখের হাসি। কিছুদিন পর বিয়ে করবে। বউ থাকবে তার। নিশ্চয়ই এসব ভেবে খুশিতে আটখানা হয়ে থাকে সবসময়।
কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাস থেকে নামার পর মেহরাব ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তার সঙ্গে তার বড়ো ভাই-ভাবি আর মা ছিল। আমাকে দেখেই তিনি একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলাম,
“কী ব্যাপার পুষ্পিতা, কলেজ থেকে ফিরলে নাকি?”
আমি মলিন হেসে মাথা দোলালাম। ভদ্রতাসূচক জিজ্ঞেস করলাম,
“আপনারা সবাই কোথায় যাচ্ছেন?”
“এইতো একটু শপিং করতে যাচ্ছি।”
ভাবি তখন মেহরাব ভাইয়াকে পিঞ্চ মেরে দুষ্টুমি করে বলল,
“শুধু শপিং বলছ কেন? বলো যে বিয়ের শপিং করতে যাচ্ছ।”
উনি হাসছেন। কিছুটা লজ্জাও পেয়েছেন বোধ হয়। তার এই সুখের হাসি আমার সহ্য হচ্ছিল না। বুকটা এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছিল। আন্টি তখন বললেন,
“যাবে নাকি আমাদের সাথে? চলো যাই। বিয়ের কেনাকাটায় আমাদের একটু হেল্প করলে না হয়।”
“আসলে আন্টি বাড়িতে থাকলে যেতাম। মাত্র কলেজ থেকে ফিরছি। একটু ক্লান্ত আরকি!”
“তাও তো ঠিক। সমস্যা নেই। তুমি বাড়িতে গিয়ে রেস্ট নাও।”
“ধন্যবাদ আন্টি। কিছু মনে করবেন না প্লিজ!”
“না, না পাগলি মেয়ে! কী মনে করব? সাবধানে যেও তুমি।”
“আচ্ছা।”
আমি আর মেহরাব ভাইয়ের দিকে তাকালাম না। বলা চলে তার সুখের হাসি পূণরায় দেখার সাহস হলো না আমার। রিকশায় উঠে পুরোটা পথ কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরলাম আমি। ভালোবাসায় এত বিরহ কেন?
মন থেকে চাইলেই আসলে সবসময় সবকিছু পাওয়া যায় না। এর জন্য ভাগ্য থাকা লাগে। কিন্তু এতটাও ভাগ্যবতী আমি নই। সময়ের প্রহর ফুরিয়ে মেহরাব ভাইয়ার বিয়ের দিন ঘনিয়ে এসেছে। ভেবেছিলাম তার বিয়ের আগ দিয়ে আমি আপুর বাসায় চলে যাব। কিন্তু আমার ভাবনায় পানি ঢেলে গায়ে হলুদের আগেরদিনই ভাইয়া আর পৃথাকে নিয়ে আপু আমাদের বাড়িতে চলে এসেছে। বাধ্য হয়ে বাড়ির সবার সঙ্গে আমাকেও গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যেতে হয়েছে। আমার বুকের ভেতরটা যন্ত্রণায় জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেলেও সবার সামনে প্রাণখোলা হাসি দিতে হয়েছে। চারপাশে সবার এত হাসি, আনন্দ সব আমার গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধছিল। ধীরে ধীরে মানুষটা অন্য কারও হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমি কিছুই বলতে পারছি না। কিছুই করতে পারছি না। সবচেয়ে আফসোস তো এটা ভেবে লাগে যে, মানুষটা জানেই আমি তাকে কত ভালোবাসি!
ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে যখন নানানরকম চিন্তা-ভাবনা করছিলাম আপু তখন পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,
“আর কতক্ষণ বসে থাকবি? চল তাড়াতাড়ি।”
“হুম।”
মেহরাব ভাইয়ার সাথে বরযাত্রীতে আমরাও যাচ্ছি। বাবা নিষেধ করলেও আঙ্কেল শোনেননি। দুজনের মাঝে সখ্যতা, বন্ধুত্ব বেশ গাঢ় কিনা! অন্যদিকে আবার মায়ের এবং আন্টির গলায় গলায় ভাব। সূতরাং আমাদের ‘না’ তাদের কাছে টিকে থাকতে পারল না। আল্লাহ্ যে এ কোন কঠিন পরীক্ষা নিচ্ছেন কে জানে!
বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে বসে ছিলাম। তখন গাড়ির জানালা দিয়ে দেখলাম মেহরাব ভাইয়া ও তার বন্ধুরা আসছে। সবাই বেশ হাসাহাসি করছে। আমার চোখ আটকে ছিল অফ হোয়াইট রঙের শেরওয়ানি পরে বর সাজা মেহরাব ভাইয়ার দিকে। বর সাজে তাকে এত সুন্দর লাগছে! সঙ্গে তার মিষ্টি হাসি। সে যখন ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িটাতে উঠে বসল তখন আমার বুক থেকে ভারী দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। একটু কাঁদতে পারলে ভালো লাগতো। বুকটা এত ফাঁকাফাঁকা লাগছে! আমি পৃথার তুলতুলে নরম শরীরটা বুকে জড়িয়ে নিয়ে আড়ালে চোখের পানি ফেললাম। কেউ যদি ভালোবাসার ব্যাপারে আমার কাছে পরামর্শ চায় তাহলে প্রথমেই তাকে ভালোবাসতে নিষেধ করব। ভালোবাসায় যে বড্ড বিরহ আর বিষাদ!
কনের বাড়ি পৌঁছানোর পর কনের পরিবার সবাইকে সাদরে গ্রহণ করলেন। চারপাশে কেমন যেন শিথিলতা। আমার কোনো কিছুই ভালো লাগছিল না। সবাইকে আগে খেতে দেওয়া হলো। আমার গলা দিয়ে কোনো খাবারই নামছিল না। খাবার নেড়েচেড়ে নষ্ট করে আমি উঠে গেছি। পৃথাকে কোলে নিয়ে একপাশে চুপ করে বসে ছিলাম। আর মাত্র কিছু সময়ের ব্যবধান। এরপরই সে চিরদিনের জন্য অন্য কারও হয়ে যাবে। অথচ আমি একটাবার নিজের মনের কথাটাও বলতে পারলাম না।
সবার খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে যাওয়ার পর কাজী সাহেব যখন বিয়ে পড়ানোর ব্যাপারে এগোতে চাইলেন তখনই শরীর শীতল করার মতো খবর পেলাম। কনে নেই। বরযাত্রী পৌঁছানোর আগেই সকালে পালিয়ে গেছে। কিন্তু এ কথা তারা কীভাবে বলবেন বুঝতে পারছিলেন না। তারা আঙ্কেলের হাতে ধরে ক্ষমা চাইলেন। অনুনয়বিনয় করলেন। এই খবরে কার কেমন মনের অবস্থা আমি জানিনা। তবে আমি এত বেশি খুশি হয়েছি যে ইচ্ছে করছিল এই নিরব পরিবেশে গান ছেড়ে একা একাই নাচি।
মেয়ের এমন কর্মকাণ্ডে কনের পরিবার লজ্জিত। তাদের ক্ষমা চাওয়ারও মুখ নেই। বড়ো মেয়ের বদলে এখন তারা তাদের ছোটো মেয়ে স্বর্ণালীর সাথে মেহরাব ভাইয়ার বিয়ে দিতে চাচ্ছে। এ কথা শুনে আমার খুশি সব উবে গেল। মেজাজ গেল চটে। এটা কেমন ধরণের কথা হলো? আমি মেহরাব ভাইয়ার দিকে তাকালাম। রূপা আপু পালিয়েছে কথাটা শোনার পর যেমন স্তব্ধ হয়ে ছিল, এখনো সেরকমই আছো। স্বর্ণালীর সাথে বিয়ের কথা শুনে বিশেষ কোনো পরিবর্তন হলো না।
আঙ্কেল বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
“ঠিক আছে। আমি একটু ছেলের সঙ্গে আলাদা কথা বলে ভেবে জানাতে চাই।”
কনের পরিবার রাজি হয়ে গেল। বরযাত্রী সবাইকে আলাদা কথা বলার সুযোগ দিয়ে কনের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন সবাই চলে গেলেন। এখন সবাই আলাপ-আলোচনা করছে কী করা যায়! সবার আগে আঙ্কেল মেহরাব ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি কী চাও?”
আমার ভীষণ ভয় হতে লাগল। তিনি যদি রাজি হয়ে যান? আমি আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। আমার মাথাও কাজ করছিল না। শুধু একটা জিনিসই আমার মস্তিষ্কে গেঁথে ছিল যে এই সুযোগটা আমাকে কাজে লাগাতে হবে। নিজের মনের কথা জানাতে হবে। ময়মুরুব্বি সব ভুলে গিয়ে, লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে আমি মেহরাব ভাইয়ার সামনে গিয়ে বললাম,
“আমি আপনাকে ভালোবাসি।”
উপস্থিত সবার রিয়াকশন কেমন হলো আমি জানিনা। মাথা তুলে তাকাতেও পারছি না। শুধু এতক্ষণ যে চাপা আলাপ-আলোচনা চলছিল সেসব থেমে গেছে। আমার দৃষ্টি নত। সেই মুহূর্তে হাতে টান পড়ল আমার। ফিরে তাকানোর পূর্বেই মা আমার গালে সজোরে থা’প্প’ড় দিয়ে বলল,
“মাথা ঠিক আছে তোর?”
আরও একটা থা’প্প’ড় দেওয়ার পূর্বেই মেহরাব ভাইয়ার বাবা আটকে ফেললেন। আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“আমার ছেলেকে ভালোবাসিস? বেশ তো! তাহলে তুই-ই হবি আমার মেহরাবের বউ।”
আমি বিস্মিত হয়ে তাকালাম। তিনি আমার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“কিরে, তোর মেয়েকে আমার পুত্রবধূ বানানোর অনুমতি দিবি না?”
বাবা তৎক্ষণাৎ কোনো উত্তর না দিলেও পরে ঠিকই রাজি হয়ে গেলেন। আঙ্কেল কনের পরিবারকে সব বুঝিয়ে বললেন। এমনিতেই মেয়ে পালিয়ে যাওয়ায় তাদের লজ্জার শেষ নেই। এখন তো আর ছোটো মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য জোর করতে পারেন না। তাই ইচ্ছেয় হোক কিংবা অনিচ্ছায় তারা কোনো টু-শব্দও করল না। কিছু কাছের আত্মীয়-স্বজন, মেহরাব ভাইয়ার বন্ধু বাদে বাকি বরযাত্রীদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। যারা ছিল তাদের এবং কাজীকে নিয়েই কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দিল আমাদের। আমার মনের ভেতর তখন রঙ-বেরঙের প্রজাপতি উড়াউড়ি করছিল। আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে তার মলিন মুখ দেখে মনে মনে বললাম,
“মিস্টার লটকা-লটকি সাহেব, এবার একবার যখন আমার সাথে লটকে গেছেন, এখন বুঝবেন আমি কী জিনিস!”
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]