#মৌনতা
#পর্ব_২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
“শোন পুষ্পি, তোর রাগের যে কোনো ভিত্তি নেই তুই জানিস?”
আমি সুমার কথা শুনে ভ্রু কুঞ্চন করে তাকালাম। কলেজে আমার সবথেকে কাছের বান্ধবী সুমা। পান থেকে চুন খসলেও সেটা সবার আগে আমার ওকে বলা চাই। ওর ক্ষেত্রেও সেইম। আমরা একে-অপরের নাড়ি নক্ষত্র পর্যন্ত জানি। কেউ কাউকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকার কথা ভাবতেও পারি না। কোনোদিন আমি অথবা সুমা না এলে স্যার, ম্যামরা সবসময় মজা করে জিজ্ঞেস করবে,
“কী ব্যাপার? আজ সাথেরটা আসেনি?”
প্রশ্ন শুনে আমরা মলিন হাসি দিলেও সেদিন সারাটা দিন খুব বাজে কাটত। এমন না যে আমাদের সাথে কেউ মেশে না কিংবা মিশতে চায় না। অনেকেরই আমাদের প্রতি অগাধ কৌতুহল থাকা সত্ত্বেও কেন জানি আমরাই মিশতে পারি না। আমাদের এটাই মনে হয় যে, আমরা দুজনই দুজনের জন্য যথেষ্ট। আমাদের বন্ধুত্ব সম্পর্কে আমাদের দুই পরিবারও অবগত। সুমার ভাবি তো মজা করে এটাও বলে যে, শেষমেশ আমরা সতিন না হয়ে যাই। এরকম হওয়ার অবশ্য একদম চান্স নেই। সুমার যে বয়ফ্রেন্ড সে খুব সরল মনের। আমাকে আপু ছাড়া কখনো কোনো কথা বলে না। সত্যি বলতে আমিও তাকে ভাইয়ের চোখেই দেখি। জিজু, দুলাভাই ডেকে আধিঘরওয়ালী এরকম মশকরা কেন যেন আমার ধাতে নেই। এমনকি আমার নিজের দুলাভাইকেও আমি ভাইয়া বলেই ডাকি। এজন্য শুরুতে অনেকেই অনেক কথা বলতো। আমি রসকষ ছাড়া, আনরোমান্টিক ইত্যাদি ইত্যাদি। সেদিন ভাইয়া অর্থাৎ আপুর স্বামী আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল,
“মানুষের কথায় কান দেবে না। তুমি আমাকে ভাইয়া বলেই ডাকবে কেমন?”
আমি বোধ হয় এক প্রসঙ্গ ছেড়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম। সুমার কাছেই বরং আবার ফিরে আসা যাক। মেহরাব ভাইয়াকে আমি যে বাড়াবাড়ি রকমের অপছন্দ করি সেটা বোধ হয় সুমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। প্রতিবার লটকা-লটকি সাহেবের ওপর করা রাগ আমি সুমার ওপরই প্রয়োগ করি। সুমা কিছু বলে না। নিরবে আমার রাগ সহ্য করবে প্রথমে। তারপর বোঝাবে, ঐ লোকের ওপর রাগ করে কোনো লাভ নেই।
আমি সুমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করলাম,
“রাগের ভিত্তি কেন থাকতে হবে?”
“না থাকলে রাগ কেন করতে হবে? তুই কি রাস্তার অপরিচিত কারও ওপর রাগ করবি কখনো অযথা?”
“কিন্তু তিনি তো আমার পরিচিত।”
“আমি জানি। সে তোর পরিচিত। শুধুই পরিচিত। কাছের কেউ কিন্তু নয়। আমরা রাগ তাদের ওপরই করি, যারা আমাদের কাছের মানুষ। আপন মানুষ। পরিচিত হলেই যে তাদের ওপর রাগ করার অধিকার আমাদের আছে তা তো নয়।”
“এখন রাগ করার জন্য আমাকে অধিকার আদায় করতে হবে?”
“তা নয়। আমাকে একটা কথা বল তো, তার ওপর রাগ করে তোর লাভ কী? তোর কি আদৌ কোনো ফায়দা আছে? সে কি তোর বয়ফ্রেন্ড নাকি হাজবেন্ড?”
“ছি! সারাদিন মেয়েদের সাথে লটকে থাকে ওরকম একটা ছেলে আমার হাজবেন্ড অথবা বয়ফ্রেন্ড কী করে হতে পারে?”
সুমা শব্দ করে হেসে ফেলল। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“তুই হাসছিস কেন?”
“তোর কথা ভেবেই হাসছি।”
“হাসির কী এমন করলাম আমি?”
সুমা উত্তর না দিয়ে আমার আরেকটু কাছে এসে বসল। আমার গলা জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে শুধাল,
“বাই এনি চান্স, তুই তাকে ভালো-টালো বেসে ফেলিসনি তো?”
প্রশ্নটায় হয়তো এমনকিছু ছিল আমি যেন চমকে গেলাম। ভালোবাসা! আর মেহরাব রেহমান? উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু কি কখনো এক হতে পারে? আমি তৎক্ষণাৎ সুমার হাত সরিয়ে দিয়ে বললাম,
“পৃথিবীতে অনেকগুলো অসম্ভব কিছু থাকলে তার মধ্যে এটাও একটা অসম্ভব সম্ভাবনা।”
“তাই? তাহলে মেহরাব ভাইয়া মেয়েদের সাথে লটকে থাকলে তুই কেন জেলাস হোস? তোর কেন রাগ হয় বল তো?”
“কারণ সে মেয়েদের সঙ্গে একটু বেশিই মেশে। দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।”
“আমাদের ক্লাসের রাকিব তো পাক্কা প্লে বয়। আজ এই মেয়ে তো, কাল ঐ মেয়ে। কতগুলো মেয়ের সাথে রিলেশন করে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এসব তো তুইও জানিস। কই তোকে তো কখনো দেখলাম না রাকিবকে নিয়ে মাথা ব্যথা করতে।”
“এসব বলে তুই কি প্রমাণ করতে চাইছিস?”
“আমি কিছুই প্রমাণ করতে চাচ্ছি না। আমি শুধু জানতে চাচ্ছি, তোর মনে তার জন্য ভালোবাসা আছে কিনা। তুই নিজেও নিজেকে প্রশ্ন কর। ভাব। আমার মনে হয়, উত্তর পেয়ে যাবি। এখন চল ক্লাসে যাই। টিফিন টাইম শেষ।”
আমি এই বিষয়ে আর কোনো কথা না বলে ওর সাথে ক্লাসে চলে গেলাম। কিন্তু সুমার বলা শেষ কথাগুলো তখনো আমার মাথায় ঘুরছিল। বাড়িতে ফেরার পর আবার যেই লাউ, সেই কদু। সন্ধ্যায় ছাদে কাপড় আনতে গিয়ে দেখি লটকা-লটকি সাহেব ফোনে যেন কার সাথে লটকে আছেন। কথা বলছেন হেসে হেসে। পারছে না শুধু হেসে ছাদের ফ্লোরে গড়াগড়ি খেতে। বিরক্তিকর লোক একটা!
কিছুদিন পরের কথা। আপুর পরীক্ষা শেষ হয়েছে গতকাল। আজ ভাইয়ার আসার কথা ছিল আপুকে নিতে। কিন্তু গতকাল রাত থেকে সে বিছানায় পড়ে আছে। তাই আর কয়দিন আপুকে আমাদের বাসায় থাকতে বলল। কিন্তু ভাইয়া অসুস্থ শুনে আপু অস্থির হয়ে পড়েছে। এমন হওয়ারই কথা। ভালোবেসে বিয়ে করেছে দুজন। আমার আপু যতটা না ভালোবাসে তারচেয়েও বেশি ভাইয়া ভালোবাসে। দুজনই দুজনকে চোখে হারায়। পরীক্ষার এই কয়টা দিন আপু আমাদের বাড়িতে থাকলেও মন তো পড়েছিল ভাইয়ার কাছেই। ভাইয়ার অফিস দূরে বলে ওরা আলাদা ফ্ল্যাটে থাকে। আপু এখানে মানে বাসায় ভাইয়া একা। দেখাশোনা করার মতো কেউ নেই। ভাইয়া অসুস্থ শুনেই আপু ব্যাগপত্র সব গোছানো শুরু করেছে। বাবা সকালেই অফিসে চলে গেছে। ছয় মাসের বাবু আবার এত ব্যাগ নিয়ে আপু তো একা যেতে পারবে না। তাই কলেজে ফোন দিয়ে আমাকে মা বাড়িতে নিয়ে এসেছে। এখন আপুর সাথে আমিই যাব। মা যেতে পারত। কিন্তু মা চলে গেলে আবার বাবার খাওয়া-দাওয়ায় কষ্ট হবে। কারণ আমি এখনো রান্না-বান্না রপ্ত করতে পারিনি। একটা প্লেট ধুয়েও বাড়িতে খেতে হয় না আমার। সেই মেয়ে কি আর বাড়ি সামলাতে পারবে? তাই আপুর সঙ্গে আমিই রওনা দিলাম।
বাড়ি ফিরে আপু ভাইয়াকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাবু আমার কাছে। শুধু খাওয়ার সময় আপুর কাছে দিয়ে আসি। এছাড়া ঘুম পাড়ানো, গোসল করানো, কোলে নিয়ে হেঁটে বেড়ানো এসব আমিই করেছি। এজন্যই বোধ হয় খালামনিদের দ্বিতীয় মা বলা হয়। বাবুর নাম তো বলা হয়নি। ওর নাম পৃথা। আমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছে। নামটা সুন্দর না? আমি ঘুমন্ত পৃথার মুখে চুমু খেলাম। কীভাবে যে দেখতে দেখতে পাঁচটা দিন কেটে গেল বুঝলামই না। বিকেলে বাবা আসবে নিতে। আজ আসলেও অবশ্য আজ যাওয়া হবে না। কাল সকাল সকাল চলে যাব। পৃথা হওয়ার পর থেকেই আমি ঘনঘনই আপুর বাসায় আসতাম। মাঝে মাঝে বায়না করতাম আমাদের বাসায় নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু এত ছোটো বাচ্চাকে তো আর মা ছাড়া রাখা যাবে না। পৃথাকে ছেড়ে যেতে মন সত্যিই খুব কাঁদছিল। তবে এই পাঁচদিনে আমি অদ্ভুত একটা জিনিস উপলব্ধি করেছি। সেই জিনিসটা হলো শূন্যতাবোধ, টান। আর মানুষটা কে জানেন? মেহরাব রেহমান। সেই কুৎসিত নামের বিরক্তিকর মানুষটা। সারাক্ষণ মেয়েদের সাথে লটকে থাকা মানুষটাকে কেন যে এত মিস করেছি আমি নিজেও সেটা জানিনা।
তার ফোন নাম্বার আমার কাছে না থাকলেও ফেসবুক আইডি আছে। আমার সঙ্গে এডও আছে। কিন্তু বদলোকের একটিভ স্ট্যাটাস অফ করে রাখা। নিশ্চয়ই লুকিয়ে-চুড়িয়ে প্রেম করে। প্রেম করে! মানে তার জীবনে কেউ আছে! কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতর এমন মোচড় দিয়ে উঠল কেন! আগে তো কখনো এমন হয়নি। অবশ্য আগে তো কখনো তাকে নিয়ে এমন ভাবিওনি আমি। ফেসবুকে এড থাকলেও এখনো পর্যন্ত একটা হাই, হ্যালো হয়নি আমাদের। না সে আমাকে কখনো ম্যাসেজ করেছে, আর না আমি করেছি। তাই এই পাঁচদিনে একটুখানি কথা বলার প্রবল তৃষ্ণা জাগলেও ইগোকে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য আমিও আর ম্যাসেজ করিনি। লুকিয়ে লুকিয়ে আইডি স্টক করেছি, ছবি দেখেছি। ব্যস এই পর্যন্তই।
পৃথাকে রেখে আসার কষ্ট বুকে নিয়েও বাড়িতে ফিরলাম আনন্দের সাথে। এর অবশ্য একটা কারণও আছে। অনেকদিন বাদে বিরক্তিকর লোকটাকে সামনে থেকে দেখতে পারব হয়তো তাই। আমাদের সকালে আসার কথা থাকলেও ভাইয়া আর আপু আসতে দেয়নি। আমরা রওনা দিয়েছি বিকেলে। বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যাও পেরিয়ে গেছে। রুমে গিয়ে আগে গোসল করে নিলাম। ভাবছি টুম্পার খোঁজ করার বাহানায় মাকে নিয়ে একটু ওই বাড়িতে যাব। এই সুযোগে বদলোকটাকেও দেখা হয়ে যাবে।
গোসল শেষ করে চুল আঁচড়ে ড্রয়িংরুমে যাওয়ার পর মা বলল,
“তোর নাস্তা টেবিলে দেওয়া আছে। খেয়ে নিস। আমি একটু ঐ বাসায় যাচ্ছি।”
“ঐ বাসায় মানে? টুম্পাদের বাসায়?”
“হ্যাঁ।”
এটা যেন ‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি’ স্বরূপ ছিল আমার জন্য। আমি আনন্দে আটখানা হয়ে বললাম,
“আমিও যাব না। কতদিন হলো টুম্পাকে দেখি না।”
“আয় তাহলে।”
আমি খুশি মনে মায়ের সঙ্গে ঐ বাসায় গেলাম। বুকের ভেতর কেমন যেন ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে। এই বাসায় আগেও আমি বহুবার এসেছি। কই তখন তো এমন হয়নি। আজ তাহলে এমন হচ্ছে কেন? মা কলিংবেল চাপার পর দরজা খুলে দিলেন সেই লোকটাই, যাকে দেখার জন্য আমি তৃষ্ণার্ত ছিলাম। আজ শুক্রবার বলে পাঞ্জাবি পরেছেন। কী সুন্দর লাগছে দেখতে! এমন সুন্দর ছেলে দেখলে মেয়েরা তো লটকে যাবেই! তিনি চমৎকার হাসি দিয়ে আগে মাকে সালাম দিলেন। পরে আমাকে বললেন,
“আরে পুষ্পিতা! কেমন আছো তুমি?”
আজ আর একটুও রাগ হলো না আমার। আমিও হেসে বললাম,
“ভালো আছি। আপনি?”
“আমিও ভালো আছি। এসো ভেতরে এসো।”
আমি আর মা ভেতরে গিয়ে দেখলাম ড্রয়িংরুমে অনেক মানুষজন। এদেরকে আমি চিনি। সবাই তার আত্মীয়-স্বজন। বাসায় কোনো অনুষ্ঠান ছিল নাকি কে জানে! মেহরাব ভাইয়ার মা আমাদের দেখে আনন্দিত হয়ে বসতে দিলেন। এরপর মিষ্টিসহ আরও অনেক নাস্তা এনে আমাদের খেতে দিয়ে তিনিও পাশে বসলেন। আমি চুপ করে বসে থাকলেও আড়চোখে বারবার তাকে দেখছিলাম। তিনি তখন টুম্পার সাথে খুনসুটিতে ব্যস্ত। আন্টি বারবার খেতে বলায় আমি চামচ দিয়ে কেটে একটু মিষ্টি মুখে পুরলাম। মাও মিষ্টি খেতে খেতে বলল,
“তাহলে বিয়ে কি ফাইনাল?”
আন্টি সহাস্যে বললেন,
“হ্যাঁ, ভাবি। অনেক চেষ্টার পর ছেলের মেয়ে তো পছন্দ হয়েছে। আল্লাহর রহমতে এখন বিয়েও ঠিক। আগামী মাসের দশ তারিখে বিয়ের ডেইট ফিক্সড করা হয়েছে। ওরা আজ এসে মেহরাবকে আংটি পরিয়ে গেছে। আমরা আগামীকাল যাব মেয়েকে আংটি পরাতে।”
মিষ্টি আর আমার গলা দিয়ে নামল না। আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আন্টির দিকে তাকিয়ে আছি আর তার বলা কথাগুলো শুনছি। সবকিছু কেমন যেন ঘোরের মতো লাগছে। মেহরাব ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]