মোহনেশা পর্ব-০৭

0
736

#মোহনেশা (৭)
সকালে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মিতুল ফ্ল্যাটটা ঘুরে দেখতে শুরু করে। ছোটখাটো একটা ফ্ল্যাট। একটা রুম,একটা এডজাস্ট বারান্দা, একটা বাথরুম, একটা রান্নাঘর ও একটা ডাইনিং রুম। দুজন থাকার জন্য একদম পার্ফেক্ট।

দুপুরে ইরফান অফিস থেকেই বাসার এ্যাড্রেস দিয়ে ফুড পান্ডায় মিতুলের জন্য দুপুরের খাবার অর্ডার করে দেয়। ইরফান ফোন দিয়ে মিতুলকে বলে দেয় ত্রিশ মিনিট পর একজন রাইডার তাকে ফুড ডেলিভারি দিয়ে যাবে। এটাও বলে দেয় যতক্ষণ না সে কল দেবে মিতুলকে ততক্ষণ যেন সে দরজা না খোলে। রাইডার দরজার সামনে পৌছালেই মিতুলকে ইরফান কল দিয়ে দরজা খুলে খাবারটা নিতে বলে।

দুপুরে গোসল করে নামাজ আদায় খাবার খেয়ে নেয় মিতুল। তার আগে ইরফানকে কল দিয়ে জিজ্ঞাসা করে নেয় সে খেয়েছে কিনা। তারপর সারাটাদিন ফোনে কার্টুন দেখেই কাটিয়ে দেয় মিতুল। অবশ্য মাঝে মাঝে কল দিয়ে ইরফান তার খোজ খবর নিয়েছে।
সন্ধ্যায় মিতুলের জন্য কয়েক প্যাকেট চিপস আর রামেন নুডলস কিনে নিয়ে ক্লান্ত শরীরে অফিস থেকে বাসায় ফেরে ইরফান। খাটের ওপর ব্যাগ রেখে বসে পড়তেই মিতুল এক গ্লাস ঠান্ডা লেবুর সরবত নিয়ে রুমে হাজির হয়। মিতুলকে তার দাদী শিখিয়ে দিয়েছিল যে, ইরফান যখন অফিস থেকে ফিরবে তখন তাকে যেন সে লেবুর সরবত এগিয়ে দেয়। বাসায় লেবু আছে কিনা তা জানা না থাকায় মিতুল বাড়ি থেকেই তার গাছের টাটকা লেবু ছিড়ে নিয়ে এসেছিল। মিতুলের হাত থেকে সরবতের গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নেয় ইরফান।

-থ্যাংকিউ মিতুল। অনেকটা সতেজ লাগছে এখন। (ইরফান)
-উহু শুধু থ্যাংকিউ বললে তো হবেনা মিঃ সাইক্লোন। আজ রাতে আমার সাথে বারান্দায় বসে চন্দ্রবিলাস করতে হবে। (মিতুল)
-এটুকু পুচকি মেয়ে তুই এত রোমান্টিক হলি কবেরে? (ইরফান)
-চন্দ্রবিলাসের সাথে রোমান্টিকতার কি সম্পর্ক হ্যা? (মিতুল)
-একজন ছেলের সাথে একটা মেয়ে কখন চন্দ্রবিলাস করেরে? তার ওপর আবার তারা যদি হয় বিবাহিত। (ইরফান)
-তা আমি আমার জামাইর সাথে চন্দ্রবিলাস করি আর যাই করি তাতে আপনার কি? (মিতুল)
মিতুলের কথায় ইরফানের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়। বলে কি এই মেয়ে! মিতুল তাতে তোয়াক্কা না করে এক প্যাকেট চিপস তুলে নিয়ে খুলে খেতে খেতে বিছানার ওপর পা তুলে বসে। ইরফান এখনও টাসকি খেয়ে মিতুলের দিকেই চেয়ে আছে।
-মিতুলরে তুই কিন্তু বেশি পেকে যাচ্ছিস! (ইরফান)
-পাকা ছিলাম না কবে আমি? (মিতুল)
এই মেয়ে বলে কি! ইরফান যেন টাসকির ওপর টাসকি খেয়েই যাচ্ছে।
ভিষণ ক্লান্ত লাগায় ইরফান আর রাতের রান্না করতে পারেনা। বেচারি মিতুলের তো বাড়িতে থাকতে কখনো রান্নাঘরে ঢোকার প্রয়োজনই পড়েনি। তাই সে চা বানানো আর নুডলস রান্না ছাড়া তেমন কিছুই রান্না করতে পারেনা। রাতে দুজনে নুডলস খেয়ে নেয়। ইরফানকে এত রাতে চা বানাতে দেখে মিতুল অবাক হয়।
-এত রাতে চা বানাচ্ছেন যে? (মিতুল)
দুটো কাপে চা ঢেলে নিয়ে ইরফান বলে ওঠে-
-এখান থেকে একটা কাপ নে আর সোজা বারান্দায় চল। (ইরফান)
বারান্দায় এসে দাড়াতেই মিতুল বলে ওঠে,
-এত রাতে বারান্দায় কেন এলেন? (মিতুল)
মিতুলের হাত টেনে নিয়ে বারান্দায় রাখা টুলে গিয়ে বসে পড়ে ইরফান।
-নিজেই এখন ভুলে গেলি? তুই না আমার সাথে আজ রাতে চাঁদ দেখবি বলছিলি? (ইরফান)
-ওহ হ্যা আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। আচ্ছা আপনি কি আপুটাকে অনেক ভালোবাসেন? (মিতুল)
-হঠাৎ এই কথা? (ইরফান)”
-বলুন না? (মিতুল)
-বাসি না বাসতাম। অনেক ভালোবাসতাম। কিন্তু সবার যে এত ভালোবাসা সয় না মিতুল। তারও সয়নি। নিজেই চলে গেছে। বিশ্বাস কর মিতুল কত কেঁদেছি। কত বলেছি একটাবার ফিরে আসো। কিন্তু আসল না মিতুল। আমার প্রতি একটু মায়া হলোনা তার।
কন্ঠ ভারী হয়ে আসে ইরফানের। থেমে যায় সে। মিতুলের বুকের ভেতরটা যেন পুড়ে ওঠে। প্রিয় মানুষটার মুখে অন্য মেয়ের কথা শুনলেই তো সকলেরই বুকটা পুড়ে যায়। ছারখার হয়ে যায় সব।
-কষ্ট পাস না আমার কথায় মিতুল। আমি বলতে চাই না এসব তোকে। তুই আর কখনো আমাকে এসব জিজ্ঞাসা করিস না মিতুল। তুই নিজেও কষ্ট পাবি আর আমার কথা তো বাদই দিলাম। আমি এসব থেকে বেরিয়ে আসতে চাই মিতুল। (ইরফান)
-আচ্ছা বাদ দেই এসব কথা। চলুন ঘুমাতে যাই। অনেক রাত হয়েছে। (মিতুল)
-আর পাঁচটা মিনিট বসনা মিতুল। ভালো লাগছে। (ইরফান)
বসে যায় মিতুল। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ইরফানের দিকে।

রাতে ইরফানের পাশে শুয়ে মিতুল বলে ওঠে,
-আচ্ছা মনে আছে ছোটবেলায় একবার ঘেরে গিয়ে নৌকায় উঠেছিলাম আমরা। ঝুকে শাপলা তুলতে গিয়ে নৌকা থেকে পানিতে পড়ে গিয়েছিলাম। আর আপনি তখন সাঁতার না জানা সত্বেও পানিতে ঝাপ দিয়েছিলেন আমাকে ওঠাতে।
-তোর দেখি সব মনেও আছে। সেদিনের পর বহু চেষ্টা করে মাত্র দুদিনের মধ্যেই সাঁতার শিখেছিলাম। আর তোকেও শিখিয়েছিলাম। (ইরফান)
-ইশ কত্ত সুইট ছিলেন আপনি ইরফান ভাই। অবশ্য এখন আরও সুইট হয়েছেন। বলেই ইরফানের গাল টেনে দেয় মিতুল।

মিতুলের কান্ডকারখানা ইরফানকে অবাকের ওপর অবাক করেই যাচ্ছে। এই মেয়ের হয়েছেটা কি?
-মিতুল তুই ঠিক আছিস তো? ভু/তে ধরেনি তো? সন্ধ্যার পরে কখনো চুল খোলা রেখে বারান্দায় যাবিনা বুঝলি? (ইরফান)
মিচমিচ করে করে হেসে ওঠে মিতুল।
-আচ্ছা আপনি কি আমার পুতুলটা নিয়ে এসেছেন? (মিতুল)
-হ্যা আমি মাকে বলে দিয়েছিলাম যেন ব্যাগপত্র গোছানোর সময় তোর পুতুলটা মনে করে ব্যাগে রেখে দেয়। (ইরফান)
-থ্যাংকিউ থ্যাংকিউ। (মিতুল)
-উহু শুধু থ্যাংকিউতে তো হবেনা। (ইরফান)
-ওহ আচ্ছা আমার বুদ্ধিই আমার ওপর খাটাচ্ছেন? তা বলুন কি চান। (মিতুল)
-আমি যেই টাইম রুটিন করে দেব। তা সবসময় মেনে চলতে হবে। আর রোজ রাতে আমার সাথে চাঁদ দেখতে বারান্দায় বসতে হবে সাথে এক কাপ চা নিয়ে। ওকে? (ইরফান)
-ওকে ওকে। আচ্ছা আমাকে টুকটাক রান্না শেখাবেন? আপনার তো এভাবে কষ্ট হয়ে যাবে। (মিতুল)
-আগে বড় হ। তারপর নিজের সংসার নিজেই সামলাস। এখন আমি যতটুকু পারি করব। তুই শুধু মাঝে মাঝে আমাকে চা বানিয়ে আর আর নুডলস রান্না করেই খাওয়াস। (ইরফান)
-এত ভালো হয়েন না মিঃ সাইক্লোন। আমি তো বারবারই তাহলে আপনার প্রেমে পড়তে পড়তে ল্যাং/ড়া হয়ে যাব। বিড়বিড় করে বলে ওঠে মিতুল।
-কি তুই ল্যাং/ড়া হবি? কেন? (ইরফান)
-আরে আমি কেন ল্যাং/ড়া হবো? আপনাকে বানাবো যদি অন্য মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছেন তো। (মিতুল)
মিতুলের কথা খুকখুক করে কেশে ওঠে ইরফান।
-এই পুচকি মেয়ে ঘুমা এখন। ফজরে উঠতে হবে আবার। (ইরফান)


কি করছেন? (মিতুল)
চোখ মুছতে মুছতে ইরফান বলে ওঠে,
-পেয়াজ কাটছি। তুই এত সকালে উঠেছিস কেন? যা ঘুমা। কদিন বাদে এমনিই কলেজের জন্য ভোরেই উঠতে হবে। (ইরফান)
-আপনি হয়ত ভুলে গিয়েছেন যে আমার ভোরে ওঠাই অভ্যাস। দিন আমি ট্রাই করি। (মিতুল)
-একদম হাত দিবিনা। দা,ব/টি, ছু/রি থেকে একশ হাত দূরে থাকবি তুই। একটা কথা মাথায় রাখবি তোকে আগলে রাখা আমার দায়িত্ব। (ইরফান)
-এই নিন আপনার টিফিন। (মিতুল)
-তুই গুছিয়ে এনেছিস? (ইরফান)
-হ্যা। আমার বরের জন্য আমি টিফিন গোছাবো না তো কে গোছাবে? (মিতুল)
-বাবাহ মেয়ের কথা শোনো? (ইরফান)
-আপনাকে ফরমাল লুকে অনেক সুন্দর লাগে জানেন? এত সুন্দর কেন আপনি? সুন্দর হওয়ার অপরাধের যদি কোনো বিচার থাকত তবে আপনার শতবার ফাঁ/সি হতো। (মিতুল)
-আচ্ছা সত্যি বলতো। আসলেই কি তোকে ভু/তে ধরেছে? (ইরফান)
মিতুল ইরফানের দিকে এগিয়ে গিয়ে পায়ের গোড়ালি উচু করে তার কলার চেপে ধরে বলে ওঠে,
-হ্যা ধরেছে তো আমাকে ভু/তে। ভালোবাসার ভু/তে ধরেছে মিঃ সাইক্লোন।

চলবে…
আফিয়া অন্ত্রীশা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে