#মোহনেশা (৬)
-আজ থেকে তোমার এই সিগারেটের নেশা ক্রমশ শূণ্য হতে থাকবে । আই প্রমিস, একদিন তুমি এই মিতুলের মোহনেশায় আসক্ত হবেই হবে মিঃ সাইক্লোন।
-কিরে পিটপিট করে কি বলতেছিস সুজির হালুয়ার সেফ? (ইরফান)
-নাহ কিছুনা। (মিতুল)
-তা তুই নাকি আরাফের মুখে গো/ব/র ছুড়ে মেরেছিলি? ডান হাত দিয়ে নাকি বাম হাত দিয়ে? (ইরফান)
-ডান হাত দিয়ে মারতে কেন যাব? বাম হাত দিয়েই মেরেছিলাম। এমন পিটুনি দিয়েছিলাম যে আজীবন মনে রাখবে। শোনেন! আপনাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি আপনি যদি ওই শা/ক/চু/ন্নির কথা মুখে এনেছেন তো আপনার মাথায় চুল একটাও আস্ত থাকবেনা। বুঝেছেন?(মিতুল)
মিতুলের কথায় মুচকি হাসে ইরফান। মিতুল সেই হাসির দিকেই এক ধেয়ে চেয়ে থাকে। মিতুল মনে মনে প্রার্থনা করছে আজকের এই রাতটা এখানেই থেমে যাক। ইরফান সারাটাক্ষণ তার সামনে হাসতে থাকুক। অসীম সুখ বিরাজ করুক শুধু ইরফানের মনে। কোনো যন্ত্রণা যেন তাকে ছুতে না পারে। প্রতিজ্ঞা করে সারাজীবন এই মানুষটাকে নিজের সব ভালোবাসা দিয়েই আগলে রাখবে সে।
-আচ্ছা ইরফান ভাই আপনি আমার ওপর রেগে নেই তো? আপনি যখন আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন আমার তখন দম বন্ধ হয়ে আসত বিশ্বাস করুন। (মিতুল)
-না আর রাগ করে নেই আমি। আচ্ছা তুই কি এই ভাই ডাকা বন্ধ করবি? আমি এখন তোর লিগ্যাল হাসবেন্ড। হাসবেন্ডকে ভাই ডাকতে হয়না গা/ধী। (ইরফান)
ইরফানের কথায় মিতুলের লজ্জায় কান গরম হয়ে আসে। ঠিক তো! তার মা আর ফুফুও তো কতবার মানা করেছে ভাই না ডাকতে।
-তা আমি আপনাকে কি বলে ডাকব? (মিতুল)
-তোর যা ইচ্ছা হয় ডাকবি। (ইরফান)
-ওকে মিঃ সাইক্লোন। (মিতুল)
মিতুলের কথা শুনে তার দিকে চোখ মুখ কুচকে তাকায় ইরফান।
ছাদ থেকে নিচে নামার পর পরই মিতুলকে তার দাদী টেনে নিজের রুমে নিয়ে যান। পেছনে পেছনে ইরফানও যায়। মিতুলের দাদী তার আলমারীর ড্রয়ার খুলে স্বর্ণের একজোড়া মোটা বালা বের করে মিতুলের হাতে পরিয়ে দিয়ে দুহাতের তালুতে চুমু খান।
-আমার সব নাতী আর পোতার বউগো লাইগা আমি এক একজোড়া বালা রাইখা দিছিলাম। এই জোড়া ইরফান নানুভাইর বউর লাইগা রাখছিলাম। তোরে পরাইয়া দিলাম বু। যত্ন কইরা রাখিস। তোগো বইনগো জন্য আমি চেন গড়াইয়া রাখছি এইবার ঈদের সময় যখন সব বইন এক লগে হবি তখন সবাইরে সবারটা পড়াইয়া দেব। (মিতুলের দাদী)
কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে নানীর কান্ড দেখে মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে নানীকে জড়িয়ে ধরে ইরফান বলে ওঠে,
-তুমি আমাদের বেস্ট নানী আর দাদী। আমাদের সব ভাই-বোনকে সমান ভালোবাসো তুমি। সবাইকে নাকি সমানভাবে ভালোবাসা যায়না। কিন্তু তুমি এই কথা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছো নানী। আমরা তোমাকে অনেক ভালোবাসি। (ইরফান)
রুমে উপস্থিত তিনজনেরই চোখে পানি চলে এসেছে। ইতোমধ্যে মিতুলের বড় চাচার ডাক পড়েছে খেতে যাওয়ার জন্য। তিনজনে মিলে ডাইনিং রুমে চলে যায়।
আজ মিতুলের এসএসসি এর রেজাল্ট বেরিয়েছে। জিপিএ ৫ পেয়েছে সে। সারাবাড়ি আনন্দে মুখোরিত হয়ে উঠেছে। মিতুলের বাবা চাচারা মিষ্টি কিনে সারা মহল্লায় সকলের বাসায় বাসায় পৌছে দিয়েছেন। কিন্তু মিতুলের মনটা একদম ভালো নেই আজ। সে এত ভালো রেজাল্ট করেছে অথচ ইরফান একটাবার কল দিয়েও জিজ্ঞাসা করল না? নিজের মনকে আবার বুঝ দেয় হয়ত খুব ব্যস্ত সে। রাতে ইরফান কল দিয়ে রেজাল্ট শুনে মিতুলকে শুভেচ্ছাবার্তা জানায়। মিতুলের যেন খুশির সীমা নেই। আবার একটা কথা শুনে মুখ আধারে ছেয়ে যায় মুহূর্তের মাঝেই। ইরফান নাকি দুদিন পরেই তাকে নিতে আসবে। ঢাকার একটা কলেজেই তাকে ভর্তি করে দেবে।বাড়ির সকলকে ছেড়ে দূরে গিয়ে থাকতে হবে ভাবতেই মিতুলের প্রাণ হুহু করে কেদে ওঠে।
ইরফান এসেছে মিতুল কে নিতে। রাতে পৌছে আবার রাতের বাসের টিকিটই বুক করে রেখেছে। মিতুলকে নিয়ে এখনই ফিরবে সে। মা,ফুফু,দাদী আর চাচীদের জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাদতে শুরু করে মিতুল। কিছুতেই তার বাড়ির সবাইকে রেখে ঢাকা যেতে মন চাইছে না। ইরফান এক হাতে মিতুলের ট্রলি ব্যাগ নিয়ে অন্য হাতে মিতুলকে আগলে ধরে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরে ঢাকার উদ্দেশ্যে।
বাসে ওঠার আগে মিতুলের জন্য পানি,চকলেট আরও টুকটাক কিছু খাবার কিনে নেয় ইরফান। মিতুলের চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে রাতে কিছুই খায়নি বা কেউ তাকে কিছু খাওয়াতে পারেনি। তাই ব্যাগ থেকে হটপট দুটো আর চামচ বের করে নিয়ে একটা হটপট আর চামচ মিতুলের দিকে এগিয়ে দেয় ইরফান। ঢাকনা খুলতেই বিরিয়ানির সুগন্ধে দুজনের পেটের মধ্যে ক্ষুধায় আকুপাকু শুরু হয়ে যায়। মিতুলের বড় চাচী জোর করে হটপট দুটো ভর্তি করে বিরিয়ানি দিয়ে দিয়েছেন যাতে গাড়িতেই রাতের খাবার খেয়ে নিতে পারে তারা।
খাওয়া শেষ হতেই ইরফান পানির বোতলের মুখ খুলে মিতুলের দিকে এগিয়ে দেয়। ঘুমে ঢলু ঢলু চোখে একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে মিতুল আনমনে ইরফানের কাধে মাথা রেখে ঘুমের অতলে হারিয়ে যায়। ইরফান ক্ষানিকটা অপ্রস্তত হয়ে পড়লেও স্থির হয়ে বসে থাকে যেন মিতুলের ঘুম না ভেঙে যায়।
শেষ রাতে বাস এসে গন্তব্যস্থলে থামতেই মিতুলকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে ইরফান। এখনো চোখ থেকে ঘুম যায়নি তার। আধো ঘুম আধো জাগ্রত অবস্থা যাকে বলে। ট্রলি ব্যাগ এক হাতে নিয়ে মিতুলকে অন্য হাতে জাপটে ধরে বাস থেকে নেমে একটা রিকশা ডেকে নেয় ইরফান। যদিও এখন রিকশা পাওয়াটা খুব টাফ তাও ভাগ্যক্রমে পেয়েই গেছে। রিকশা এসে একটা চারতলা বাড়ির সামনে থামে। মিতুল এখনো ঝিমাচ্ছে আবার উঠে বসছে। ইরফান মৃদু হেসে মিতুলকে ধরে নামিয়ে নিয়ে গেট পার করে বিল্ডিং এর ভেতরে প্রবেশ করে। সিড়ি বেয়ে ওঠার সময় মিতুলের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঢলু ঢলু চোখে বেশ দেখতে পাচ্ছে সে ভারী ট্রলি ব্যাগটা সিড়ি দিয়ে ওপরে ওঠাতে ইরফানের বেশ কষ্ট হচ্ছে। তিনতলায় উঠে নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢুকে দুজনেই ফ্রেশ হয়ে নেয়। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে মিতুল দেখে ইরফান বিছানা ঠিক করছে ।
-ঘুম তো তোর এখনো যায়নি। নে এখন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড় নাহলে মাথা ব্যথা হবে। (ইরফান)
ইরফানের কথায় মাথা নাড়িয়ে মিতুল বিছানার একপাশে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ইরফান ঘড়িতে পাচটায় এলার্ম সেট করে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে বিছানার আরেক পাশে।
ভোর পাচটায় উঠে ইরফান মিতুলকে টেনে তোলে নামাজ আদায় করার জন্য। দুজনে মিলে নামাজ আদায় করে নেয়। মিতুলকে আবার ঘুমাতে দিয়ে রান্নাঘরে চলে যায় ইরফান। রাইস কুকারে সকালের জন্য ভাত চড়িয়ে দিয়ে ডিম আর চিংড়ি মাছ ভেজে নেয়। মিতুলের মাথা ব্যথার প্রবলেম থাকায় তাকে আর ডাকেনা ইরফান। সারারাত জার্নি করেছে আবার ফজরেও উঠেছে। নিজে গোসল করে ,খেয়ে-দেয়ে সাড়ে আটটায় অফিসের জন্য বের হয়ে যায় সে।
সকালে ১০টায় ঘুম ভাঙে মিতুলের।আড়মোড়া ভেঙে উঠতেই দেখে পাশে তার পুতুল রয়েছে। পুতুলটা দেখে সে বেশ অবাক হয়। এটা এখানে কিভাবে? আর এটাকে ছাড়া তো সে একদম ঘুমাতে পারে। ইরফান রেখেছে বুঝতে পেরেই মুচকি হাসে মিতুল। পরক্ষণেই ইরফানের বালিশের ওপর একটা ভাজ করা সাদা কাগজ দেখতে পায়। কাগজটা খুলে পড়তে শুরু করে মিতুল।
“রিডিং টেবিলের ওপর হটপটে ভাত,ডিম আর ইলিশ মাছ ভাজা আছে। ঠিকঠাক মতো খেয়ে নিয়েন সুজির হালুয়ার সেফ। আমার ফিরতে সন্ধ্যা হবে। একদম ভয় পাবেননা ঠিক আছে? এন্ড্রয়েড ফোন রেখে যাচ্ছি কার্টুন দেখে সময় কাটাবেন আর ঠিকঠাক নামাজ আদায় করে নেবেন। আমি সময় পেলেই কল দেব।“
লেখাটুকু পড়া শেষ করেই মৃদু হেসে ওঠে মিতুল।
চলবে…
আফিয়া অন্ত্রীশা