#মোহনেশা (৫)
-আপনার সাহস কি করে হয় আমার হাত ধরার? (মিতুল)
-আরাফের সাহসের এখনো দেখেছিস কি তুই? তোর সাহস কি করে হয় এই আরাফকে রিজেক্ট করার? বিয়েতো তোকে আমি করেই ছাড়ব। আর তোর নামের পাশে এমন ট্যাগ লাগিয়ে দিয়ে তোকে ডিভোর্স দেব যে আর দ্বিতীয়বার কেউ তোকে বিয়ে করবেনা। তোর পরিবার থেকে শুর করে সমাজের প্রতিটা মানুষ তোকে বিতাড়িত করবে। এই আরাফ কতটা ভয়ংকর তা তুই হারে হারে টের পাবি। (আরাফ)
মিতুল সমানে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে আরাফের থেকে। ভয়ে তার চোখ ফেটে কান্না আসছে। আচমকা আরাফের পেট বরাবর একটা লা/ত্থি বসিয়ে দিতেই আরাফ মিতুলের হাত ছেড়ে দিয়ে দুই কদম দূরে সরে যায়। এই সুযোগে মিতুল রাস্তার পাশে থেকে বালি উঠিয়ে আরাফের চোখে মেরে দেয়। আরাফ কাতরাতে কাতরাতে রাস্তায় বসে পড়ে।
-শা/লা ফকিন্নি লু/চু ব্যাটা তোর এতো বড় সাহস? তুই আমাকে বিয়ে করবি? আমার নামে বদনামের ট্যাগ লাগিয়ে দিবি।
মিতুলের চোখ চলে যায় রাস্তার পাশে পরে থাকা গো/ব/রের দিকে। বাম হাত দিয়ে এক খাবলা গো/ব/র উঠিয়ে আরাফের মুখের ওপর মেরে দেয়।
-নে গো/ব/র খা খ/বি/শ ব্যাটা। আমাকে বিয়ে করতে পারলে তো তুই আমাকে ডিভোর্স দিবি? তাই আঙুল না চুষে বসে বসে গো/ব/র আর বালি খা পেট ভরে। (মিতুল)
আরাফ এখনো হাত দিয়ে চোখ কচলাচ্ছে যন্ত্রণায়। সারা মুখে আর গায়ে গো/ব/র লেগে আছে। মিতুল দৌড়ে গিয়ে রাস্তার পাশে রাশিবদ্ধ কচাগাছ থেকে ডাল ভেঙে নিয়ে আরাফকে বেদমভাবে পিটাতে শুরু করে। আরাফ না পারছে ঠেকাতে আর না পারছে সহ্য করতে। দশ পনেরটা ঘা দিয়ে ডালটা রাস্তায়ই ফেলে দিয়ে ফাইলপত্র নিয়ে মিতুল বাড়ির দিকে ছুটতে শুরু করে।
ড্রইংরুমে মিতুলের নানাবাড়ির সকল আত্মীয়-স্বজনসহ বাড়ির সকল সদস্য বসে গল্প করছিল। সদর দরজা হতে হাপাতে হাপাতে ছুটে এসে ড্রইংরুমের মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মিতুল। মিতুলের মা আর ছোট চাচী ছুটে এসে মিতুলকে মেঝে থেকে তুলে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দেয়।
-কি হয়েছে মিতুল এভাবে ছুটে ছুটে এসেছিস কেন? কিছু হয়েছে মা? (মিতুলের মা)
ড্রইংরুমে উপস্থিত সকলে চিন্তিত দৃষ্টিতে মিতুলের দিকে চেয়ে আছে। মিতুলের বড় চাচী এক গ্লাস পানি এনে মিতুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে ওঠেন,
-মেঝো আগে মেয়েটাকে শান্ত কর তারপরে জিজ্ঞাসা কর কি হয়েছে। দেখছিস কিভাবে হাপাচ্ছে!
মিতুল ঢকঢক করে সব পানিটুকু খেয়ে নেয়।
-মা মা ওই আরাফ স্যার… (মিতুল)
-কি আরাফ স্যার? কি করেছে আরাফ? (মিতুলের মা)
ফোপাতে ফোপাতে মিতুল সবকিছু খুলে বলে সবাইকে। মেয়ের কান্নামিশ্রিত কন্ঠে সকল কথা শুনে মিতুলের বাবা চাচারা রাগে তেঁতে ওঠে। যেন এখনই জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে আরাফকে। মিতুলের সাহস দেখে তারা খুশিও হন বটে আবার তার এ ব্যাপারে সকলকে খুলে না বলার মতো বোকামিতে বেশ রাগও হন। মিতুলের মতো বুদ্ধিমতি মেয়ের দ্বারা এমন ধরনের আচরণ তারা কখনোই আশা করেন নি।
-এই আরাফের মতো ছেলে এমন কাজ করতে পারে তাতো কল্পনাও করতে পারিনি। এদের মতো জা/নো/য়ারদের জন্য শিক্ষকতা পেশার অপমান হয়। আরাফকে তো আমি পুলিশে দিয়ে ছাড়ব। (মিতুলের বাবা)
-মেঝো ভাই মাথা ঠান্ডা করো। এই ছেলের বাবার বিশাল ক্ষমতা। ছেলেকে ছাড়িয়ে নিতে বেশি সময় তার দরকার হবেনা। আর একবার ছাড়া পাওয়ার পরে আমাদের মিতুলের ক্ষতি করার চেষ্টা করবেনা তার গ্যারান্টি কি? এই ছেলেকে অন্যভাবে টাইট দিতে হবে আর আমাদের মিতুলের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আপাতত মিতুলের বাইরে যাওয়ারও দরকার নেই। আমাদের এবার আরও সচেতন হতে হবে মিতুলের দিক থেকে। (মিতুলের ছোট চাচা)
-হুম ছোট কিন্তু ভুল কিছু বলেনি। মিতুলের সেফটি আগে বাড়াতে হবে। বাড়িতে আমরা ব্যতীত অন্য পুরুষের যাতায়াত বন্ধ আজকে থেকে। সবাই কান খুলে শুনে রেখো। (মিতুলের বড় চাচা)
।
।
দুদিন ভিষণ জ্বরের কারণে বিছানায় পড়ে রয়েছে মিতুল । রাতে মিতুলের ফুফু এসে তার ফোনটা মিতুলকে দিয়ে গেছেন। ইরফান ভিডিও কল দিয়েছে।
-আমাকে আগে কেন বলিসনি? (ইরফান)
রাগে ইরফানের চোখ লাল হয়ে গেছে। পারলে ফোনের অপর পাশ থেকে মিতুলকে গিলে খায় সে।
-ইরফান ভাই! ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে ওঠে মিতুল)
-চুপ একদম আমাকে ডাকবিনা তুই। আর কখনো আমার সাথে কথা বলবিনা। রাখছি। (ইরফান)
মিতুল হুহু করে কেঁদে ওঠে। সে কি করতো? সে যে ভয়ের জন্য কাউকে কিছু বলেনি। তার বাবা চাচারাী যেভাবে ক্ষেপেছে আরাফের ওপর ইরফান আর মেহনাজকে বললে তো এতক্ষণে আরাফকে মেরে ফেলত একদম। সে যে চায়নি তার জন্য কোনো সমস্যার সৃষ্টি হোক। কিন্তু ইরফান যে আর কখনোই তার সাথে কথা বলবে না। বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে মিতুলের। কিভাবে ইরফানকে বোঝাবে সে যে ইরফান তার সাথে কথা না বললে অনেক কষ্ট হয়। পাগল পাগল লাগে তার নিজেকে। সিগারেট যেমন ইরফানের নেশায় পরিণত হয়েছে তেমনি ইরফান যে তার মোহনেশায় পরিণত হয়েছে।
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ড্রইংরুমে আসতেই মিতুল দেখে সকলে সোফায় চুপচাপ হয়ে বসে আছে। ইরফান নাকি গতকাল রাতেই তার বন্ধুকে দিয়ে থানায় আরাফের নামে জিডি করিয়েছে। পুলিশ আজ ভোরেই আরাফকে অ্যারেস্ট করেছে। এই কথা শুনেই মিতুলের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেছে। ইরফান এমনটা করবে তা ভাবতেও পারেনি মিতুল।
এর মাঝে ইরফান সাতদিনের ছুটিতে এসে আরাফের নামে মামলা করেছে। খুব দ্রুত সাজাও হয়ে যাবে তার। এদিকে বাড়িতে তুলকালাম বাধিয়ে ফেলেছে সে। কেন আরাফের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়নি তার মামারা। মিতুলের বাবা চাচারা লজ্জায় মাথা নামিয়ে নেন।
-কেন আপনারা ভয় পান? কেন আপনারা বোঝেন না প্রশাসন সবার জন্য। আমরাই তো ওই ক্ষমতাসীন লোকদেরকে সুযোগ করে দেই অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দেখানোর। আমরা যদি রুখে দাড়াই তাহলে প্রশাসনও ন্যায়ের পক্ষে থাকতে বাধ্য। ওই ধনী ক্ষমতাসীনেরা আর সাহস পাবেনা। দয়া করে এমার মামা হয়ে আপনারা ভয়ে পিছ পা হবেন না। আপনাদের এমনটা মানায় না। (ইরফান)
কেউ মুখ থেকে একটা কথাও বের করেনা ।
সাতদিনের ছুটে শেষে ঢাকায় ফিরে যায় ইরফান। এই সাতদিনে একবারও মিতুলের সাথে কথা বলেনি ইরফান। দুঃখে-ক/ষ্টে সকলের আড়ালে গিয়ে কত যে কেঁদেছে মিতুল।
এর মাঝে মিতুলের এসএসসি পরীক্ষাও শেষ । আরাফকে এক বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। এর মাঝে একদিন ড্রইংরুমে উপস্থিত সকলের সামনে মিতুলের ফুফু ইয়াসমিন বলে ওঠে,
-মিতুলের এসএসসি পরীক্ষাও শেষ। তো আজকে আমার মনে জমে থাকা কথাটা বলেই ফেলি। আমি চাচ্ছিলাম মিতুলের বিয়েটা আমার ইরফানের সাথে দিতে। আমার ইরফানের চেয়ে আশা করি কেউ মিতুলকে নিরাপদভাবে আগলে রাখতে পারবে না তা তোমরাও ভালো করে জানো। তাই এবার ইরফান আসার পরেই আমাদের মিতুল আর ইরফানের বিয়েটা ঘরোয়াভাবে করে সেরে ফেলব। আর এই মুহূর্তে মিতুলের সেফটি খুব করে দরকার। কখন আরাফ ছাড়া পেয়ে যাবে আমরা কেউ জানিনা। ইন্টারে মিতুল ইরফানের কাছে ঢাকা থেকেই ওখানের কলেজে পড়াশুনা করবে। মিতুলের ১৮ বছর তো পরের বছরই হয়ে যাবে তখন বড় করে সকলকে জানিয়ে অনুষ্ঠান করব।তোমরা কি বলো এখন? মেঝোর কি মতামত?
-আপা তুমি আমাদের সকলের বড়। তুমি যেটা ভালো বুঝবে সেটা অবশ্যই খারাপ হবেনা। আর ইরফান অবশ্যই মিতুলের জন্য সবচেয়ে বেস্ট হবে। আর ইরফানের সাথে মিতুলের বিয়েই মিতুলের জন্য সবয়েছে বড় উপকারী হবে এই মুহূর্তে। কিন্তু ইরফান কি রাজি? (মিতুর বাবা)
-তা আমি কি ইরফানকে না রাজি করিয়ে তোদের সকলকে এটা জানালাম? (ইয়াসমিন)
-আলহামদুলিল্লাহ তাহলে আমাদের কারো কোনো আপত্তি নেই। আর আমাদের মিতুলেরও নিশ্চয়ই কোনো আপত্তি থাকবেনা। (মিতুলের বাবা)
ইয়াসমিন খানম মিতুলকে টেনে নিয়ে তার পাশে বসান।
-আমার এই ছোট পুতুলকে সারাজীবন আমাদের কাছেই রেখে দেব। কথাটি মিতুলের থুতনি ধরে বলে ওঠেন ইয়াসমিন খানম।
মিতুলের এই মুহূর্তে দম বন্ধকর অনুভূতি হচ্ছে। খুশিতে মরে যেতে মন চাইছে। কিন্তু পরক্ষণেই মনের মাঝে এক রাশ বিষাদের ছায়া নেমে আসে তার। ইরফান যে অন্য কাউকে ভালোবাসে। তাহলে তাকে কেন বিয়ে করতে রাজি হলো ইরফান? মনে হাজারো কনফিউশন এসে জমা হতে থাকে মিতুলের।
পরের মাসেই মিতুল আর ইরফানের বিয়ে সম্পন্ন হয়। ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে মিতুল আর ইরফান।
-আপনার তো গার্লফ্রেন্ড আছে তবে আমাকে কেন বিয়ে করলেন ইরফান ভাই? সে আপনাকে ভুল বুঝবেনা? (মিতুল)
-তোকে কে বলেছে আমার গার্লফ্রেন্ডা আছে? (ইরফান)
-সেদিন যে আপনার কাছে ম্যাথ বুঝতে আপনার রুমে গিয়েছিলাম তখন দেখেছিলাম আপনি একটা মেয়ের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছিলেন।
মিতুলের কথা শুনে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে থাকে ইরফান। পরক্ষণে হোহো করে হেসে ওঠে।
-ওহ আচ্ছা এই ব্যাপার? ওটা স্ক্রিন রেকর্ড ছিল। যে ছিল সে তো তিন বছর আগেই আমাকে ধোকা দিয়ে অন্য ছেলের কাছে চলে গিয়েছে। (ইরফান)
-মানে আপনার গার্লফ্রেন্ড নেই এখন? (মিতুল)
-না নেই। ভাবিস না তার শোকে পাথর হয়ে তোকে শো কল্ড হাসবেন্ডদের মতো মেন্টালি টর্চার করব। একটু মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে কিন্তু মানিয়ে নেব। (ইরফান)
-যাক আপদ বিদায় হয়েছে। মুচকি হেসে বিড়বিড় করে বলে ওঠে মিতুল)
-কি বললি? (ইরফান)
-না কিছুনা। (মিতুল)
মিতুলের বুকের ওপর থেকে যেন কনফিউশনের পাথরটা নেমে গিয়েছে। মিতুল ইরফানের দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দেয়। ইরফান সিগারেটটা নিয়ে ভ্রু কুচকে মিতুলকে প্রশ্ন করে,
-কোথায় পেলি তুই?
-আপনার বালিশের নিচে থেকে নিয়ে এসেছি। (মিতুল)
ইরফান সিগারেটটা ধরিয়ে মুখে গুজে নেয়।
মিতুল ইরফানের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
-আজ থেকে তোমার এই সিগারেটের নেশা ক্রমশ শূণ্য হতে থাকবে । আই প্রমিস, একদিন তুমি এই মিতুলের মোহনেশায় আসক্ত হবেই হবে মিঃ সাইক্লোন।
চলবে…
আফিয়া অন্ত্রীশা