মোহনেশা পর্ব-০৪

0
715

#মোহনেশা (৪)
“আই লাইক ইউ মিতুল।“
আরাফের সেন্ড করা ম্যাসেজটা পড়তেই মুহূর্তের মাঝে ভয়ে হাত-পা কাঁপতে শুরু করে মিতুলের। ঠাস করে ফোনটা হাত থেকে বিছানায় পড়ে যায়। নিজের চোখকে যেন মিতুল কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। আরাফ স্যারের থেকে তো সে কখনো এটা আশা করেনি। মিতুলের আজকের রাতটাও কেটে যায় নির্ঘুম। কিন্তু গত রাতের মতো বুক ফাটা ক/ষ্টে নয় একরাশ অজানা ভয় নিয়ে।


-কি ব্যাপার মিতুল আজকে কেন ব্যাচে যেতে চাচ্ছিস না। আগেরদিন না হয় শরীর ভালো ছিল না তাই যাস নি। কিন্তু আজকে কি হয়েছে তোর? আবার শরীর খারাপ লাগছে নাকি? (মিতুলের মা)
-না মা। ইয়ে মানে… (মিতুল)
-কি সেই কখন থেকে ইয়ে মানে ইয়ে মানে করছিস মিতুল? কিছুদিন বাদে টেস্ট পরীক্ষা। আর এখন যদি এমন করিস তাহলে কি হয়? (মিতুলের মা)
মিতুল কোনো বাক্য ব্যয় না করে মাথা নিচু করে নেয়। দূর থেকে মিতুলের হাবভাব লক্ষ্য করছে ইরফান। দ্রুত গতিতে হেটে এসে মিতুলের পাশের চেয়ারটা দখল করে নেয় সে। আজ দুদিন হয়েছে ইরফান বেশ ভালোভাবেই মিতুলের অস্বাভাবিক আচার-আচরণ ফলো করছে।

-কোনো প্রবলেম হয়েছে মিতুল? আমাকে বলতে পারিস কিন্ত। দুদিন ধরে লক্ষ্য করছি কেমন অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছিস তুই। রিলেশন কেস নাকি? (ইরফান)
ইরফানের কথায় বুক ধক করে ওঠে। কিভাবে বোঝায় সে ইরফানকে তার মনের কথা? তার যে প্রিয় মানুষ আছে। কোন বিবেকে সে ইরফানের কাছে তার প্রিয় মানুষ হতে চাওয়ার সুযোগ দাবী করবে?
-না তেমন কোনো বিষয় নেই ইরফান ভাই। শরীরটা ভালো লাগছে না এই দুদিন। (মিতুল)
-সত্যি বল আমাকে। কোনো ছেলে কি ডিস্টার্ব করছে নাকি? (ইরফান)
মিতুল ভাবতে শুরু করে , আরাফের পাঠানো ম্যাসেজটার কথা বলবে ইরফান কে? বলা কি আদৌ ঠিক হবে? এই বাসার প্রতিটা ছেলেই মেয়েদের সেফটি নিয়ে খুব সেন্সিটিভ। ব্যাচে মেল টিচারের কাছে পড়তে দিয়েছে তাও বহুত যাচাই বাছাই করে। তবুও যে আরাফ স্যার এমনটা করবে তাতো সবার কল্পনাতীত। আরাফ স্যারের কথাটা জানলে তো তাকে একদম পুতে রেখে দিবে তার বাবা চাচারা। আরাফ তো তাকে শুধু তার পছন্দের কথা জানিয়েছে কোনো ক্ষতি তো করেনি। না আজকে স্যারকে ভালো করে বুঝিয়ে ঠিক করে দেবে।

-না ইরফান ভাই কারো এতো সাহসই নেই যে আমাকে ডিস্টার্ব করবে। (মিতুল)
-যাক তাহলে এখন পেট ভরে খা। ঠিক হয়ে যাবে শরীর। আর সন্ধ্যায় আমার আর মেহনাজের সাথে যাবি ডাক্তার দেখাতে। (ইরফান)
-আচ্ছা। মা তাড়াতাড়ি নাস্তা দাও আমি ব্যাচ পড়তে যাব।(মিতুল)


-কোনো এন্সার দিলে না যে মিতুল। (আরাফ)
-কিসের এন্সার স্যার? (মিতুল)
-গতকাল যে ম্যাসেজটা দিলাম। দেখোনি তুমি? (আরাফ)
-আমি তেমন টাইপ মেয়ে না স্যার। আর আমি এসব পছন্দও করিনা। আমার ফ্যামেলি এসব জানলে কিন্তু তুলকালাম বেধে যাবে। আর স্যার আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কাল হতে আমি আর পড়তে আসছি না। (মিতুল)
-এটা একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না মিতুল? আজকাল এসব তো স্বাভাবিক। তাছাড়া আমিতো ছেলে খারাপ না তাইনা? আমার বাবা কিন্তু নাম করা বিজনেসম্যান। তোমার ফ্যামিলির মতো আরো বিশটা ফ্যামিলি চালানোর ক্ষমতা আমার এবং আমার বাবার আছে। তোমার মতো মেয়েরা লাইন ধরে পেছনে পড়ে আছে আমার বাবার টাকার লোভে। তোমাকে একটু পাত্তা দিয়েছি বলে বেশি ভাব দেখাচ্ছো তুমি? (আরাফ)
-আপনার বাবার অনেক টাকা বুঝলাম। তো তার সাথে গিয়ে বিজনেস সামলান না। কেন এভাবে শিক্ষকতার পেশাকে হেয় করছেন? আর আমার মতো মেয়ে মানে কি? আমাকে কি ফা/ল/তু লোভী মেয়ে মনে হয় আপনার? সামনে থেকে সরে দাড়ান। সরুন বলছি!।
আরাফকে ধাক্কা দিয়ে কোচিং এর ক্লাস রুমে প্রবেশ করে মিতুল।

-আমি বাসায় যাচ্ছি, আমার শরীরটা খারাপ লাগছে অনেক। তোরা পড়া শেষ করে চলে যাস। ্কাউকে আর জবাব দিতে না দিয়েই কোচিং থেকে বের হয়ে আসে মিতুল। একটা রিকশা ডেকে নিয়ে তাতে উঠে বসে। সারা পথ নিরবে চোখের পানি ফেলতে ফেলতেই বাসায় ফেরে মিতুল।


সন্ধ্যায় ইরফান আর মেহনাজ মিলে মিতুলকে ডাক্তার দেখিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে সব ভাই-বোনকে ফোন দিয়ে এক ঠিকানায় চলে আসতে বলে। সকলে মিলে একটা খোলা পার্কে গিয়ে বসে। ডাক্তার বলেছে অতিরিক্ত টেনশন আর প্রেশার নেয়ার জন্য মিতুলের শরীর আর মন দুটোই দূর্বল হয়ে গেছে। তাই মিতুলকে একটু রিফ্রেশ করার জন্য এই নিরিবিলি জায়গাটায় নিয়ে আসে ইরফান। এখানে সকলে রিল্যাক্স হওয়ার জন্যই আসে মূলত। সকলে মিলে ফুচকা,চটপটি ও আইস্ক্রিম খেয়ে,একটা রেস্টুরেন্ট থেকে বাসার সবার জন্য রাতের খাবার নিয়ে সকলে একসাথে বাসায় ফেরে।
রাতে খাবার শেষে মিতুল তার বাবার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
-বাবা সারাদিন স্কুল করে আর গিয়ে ব্যাচ পড়তে ইচ্ছা করেনা। বাসায় একটা টিউটর ঠিক করে দাও। বাসায় বসেই এখন থেকে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেব। আর স্কুলও তো বেশি দিন নেই।
মেয়ের কথা যুক্তিযুক্ত হওয়ায় মিতুলের বাবা সম্মতি জানিয়ে বলে ওঠেন,
-আচ্ছা আমি কালকের মধ্যেই নতুন হোম টিউটির ঠিক করছি মা।

-আচ্ছা তবে ডেট কিন্তু ফাইনাল। আগামী শুক্রবার কিন্তু আমাদের মেহনাজ ও সারার ছোটখাটো ভাবে বিয়ে সম্পন্ন হবে এবং মিতুলের পরীক্ষা শেষ হলেই অনুষ্ঠান করে ফেলব। (মিতুলের বড় চাচা)
-বাবাহ ডেট ও ফিক্সড আর আমি ব্যাচ পড়তে গিয়ে এটা মিসও করে ফেললাম? যাও রাগ করেছি। (মিতুল)
-হা হা আমাদের মিতুলরাণী রাগ করেছে সবাই শুনেছো? না মা রাগ করিস না। কালকে তো বিয়ের জন্য কেনাকাটায় যাওয়া হবে তো সবাইকে তো একটা ড্রেস,একটা জুতা মানে সবই একটা একটা করে দেয়া হবে। আর আমাদের মিতুলরাণীকে সবকিছু ডাবল ডাবল দেয়া হবে। এবার কি রাগ ভাঙ্গবে আমাদের মিতুলের? (মিতুলের বড় চাচা)

-ওহ আচ্ছা এইভাবেই তাহলে বুদ্ধি করে হাতিয়ে নেয় আমাদের মিতুল? (আকিব)
-তা তোমরাও নেও না। মানা কে করছে? (মিতুল)
-আমার শা/লীকে আমিও একটা ড্রেস কিনে দেব কাল। কি শা/লি খুশিতো? (ইরার হাসবেন্ড)
-খুশি মানে? এতো গুলো খুশি। (মিতুল)
ডাইনিং রুমে উপস্থিত সকলে হোহো করে হেসে ওঠে।



রুমে এসেই মিতুল আরাফের আইডিটাকে ব্লক করে দেয়। আর ব্যাচের গ্রুপ থেকে লিভ নিয়ে নেয়। প্রয়োজনীয় ঔষুধগুলো খেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে সে।
রাত প্রায় ১টা ছুই ছুই, দুই নাম্বার সিগারেটে প্রথম টানটা দিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায় ইরফান। ফোনের স্ক্রিনে একটা ছবিতে একটা মেয়ে তার পাশে বসে তার দিকে লজ্জা ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চোখের কোণে জমে আসা অশ্রুটুকু মুছে নিয়ে একে একে মেয়েটার সকল ছবিগুলো ডিলিট করে দিতে থাকে ইরফান। শেষ ছবিটা স্ক্রিনের সামনে আসতেই কিয়ৎক্ষণ তার দিকে চেয়ে থাকে সে। কি সুন্দর লাগছে তাকে আর নিসাকে। ফোনের স্ক্রিনের ওপর একটা চুমু খেয়ে শেষ ছবিটাও গ্যালারি থেকে ডিলিট করে দেয় ইরফান।
-এখনো ছাড়তে পারিসনি অভ্যাসটা? (মেহনাজ)
আচমকা পাশে মেহনাজকে দেখে ক্ষানিকটা চমকে ওঠে ইরফান।
-অভ্যাস কি আর বললেই চলে যায়? একটা অভ্যাসকে আজ চিরতরে জীবন থেকে মুছে ফেললাম। সব ছবি ডিলিট করে দিয়েছি। আজকের পর থেকে মন থেকেও ডিলিট করে দেব। কিন্তু ভাই এই সিগারেটের অভ্যাস ছাড়লে আমি বাচতে পারব নারে। (ইরফান)
-কি লাভ ভাই একটা মেয়ের জন্য নিজেকে কষ্ট দিয়ে? তুই যেটাকে শান্তি মনে করছিস সেটাই তোর সাথে আড়ালে আড়ালে নিসার চেয়ে খুব খারাপ ভাবে বেঈ/মানি করছে। এই সিগারেট যে একটা মানুষকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। ছেড়ে দে ভাই এই অভ্যাস। নিসা তো তোকে ঠকিয়ে এখন নিত্য নতুন বয়ফ্রেন্ড ছাড়ছে ধরছে। এদের মতো মানুষদের জন্য নিজেকে কষ্ট দেয়া বো/কা/মি ভাই। এরা কোনোদিন আমাদের জন্য যোগ্যই না। (মেহনাজ)
-আস্তে আস্তে ছেড়ে দেব। একবারে তো আর পারা যায়না কিছুর অভ্যাস পালটিয়ে ফেলা। (ইরফান)
-বিয়ে করে ফেল ভাই। (মেহনাজ)
মেহনাজের কথায় মৃদু হাসে ইরফান।
-চল ঘুমাতে যাই। (ইরফান)


দেখতে দেখতে মেহনাজ আর সারার বিয়েও সম্পন্ন হয়ে যায় ঘরোয়াভাবে। ইরফানসহ বাকি কাজিনেরাও ঢাকায় ফিরেছে বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে। আরাফ এর মাঝে বেশ কয়েকটা আইডি থেকে মিতুলকে ম্যাসেজ দিয়েছে। নানারকম হুমকি-ধামকি দিয়েছে। ভয়ে মিতুল কাউকে কিছু বলেনি। সিদ্ধান্ত নিয়েছে টেস্টের পরেই ইরফান আর মেহনাজকে বলে দেবে সব।
মিতুলের টেস্ট পরীক্ষাও প্রায় শেষের পথে। আজকে শেষ পরীক্ষা দিয়ে স্কুল থেকে একাই বাড়ি ফিরছে মিতুল। এতদিন মিতুলের মা ই সাথে করে নিয়ে গেছে আবার নিয়ে এসেছে। আজ বাড়িতে মিতুলের নানাবাড়ির আত্মীয়-স্বজনেরা এসেছে সারাকে দেখতে। তাই আজ মিতুলের মা যেতে পারেনি মিতুলকে আনতে।
-তোর কত বড় সাহস তুই আমাকে ইগ্নোর করিস ব্লক করে রেখে দিস।
হঠাৎ মিতুলের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় আরাফ।
-আপনি আমার পথ আটকাচ্ছেন কেন? সরুন আমার পথ হতে। আজই আমি আমার বাবাকে সব জানিয়ে দেব। রেগে গিয়ে বলে ওঠে মিতুল।
-আহা রাগ করছো কেন মিতুল? (আরাফ)
রাস্তায় লোকজন না থাকায় বেশ ভয় অনুভূত হয় মিতুলের।।আরাফকে তোয়াক্কা না করে সামনে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে তার হাত ধরে বসে আরাফ। থমকে যায় সে মিতুল।। ধীরে ধীরে গা হিম ধরে যাচ্ছে তার। বুঝতে পারছে কাউকে কিছু না জানিয়ে বেশ বড়সড় ভুল করেছে সে।
চলবে…
আফিয়া অন্ত্রীশা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে