মোহনেশা পর্ব-০৩

0
721

#মোহনেশা (৩)
ইরফান ম্যাথ বুঝিয়ে যাচ্ছে একাধারে আর মিতুল নিশ্চুপ হয়ে টলমল চোখে খাতার দিকে চেয়ে আছে। চোখের পলক ফেললেই যেন অশ্রুর ঢেউ উপচে পড়বে চোখের কোণ হতে।
-কিরে কাদছিস কেন তুই? শরীর খারাপ লাগছে?
-না কাদছিনা আমি। চোখের মধ্যে মনে হয় কিছু একটা গেছে। দুই মিনিট ওয়েট করেন আমি বাথরুম থেকে একটু চোখে পানি দিয়ে আসি তাহলে ঠিক হয়ে যাবে। (মিতুল)
-আচ্ছা ফাস্ট যা। (ইরফান)

চোখে যে কিছু যায়নি তা ইরফান বেশ বুঝতে পেরেছে। সকাল থেকেই লক্ষ্য করছে মিতুল কেমন একটা করছে। রাতে ঠিকঠাক ঘুমায়ও নি যার দরুণ সারাদিন মাথা ব্যথায় ছটফট করেছে।
বাথরুমে গিয়ে ঝটপট চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে নেয় মিতুল। বড় করে একটা নিশ্বাস টেনে নিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে।
-ওই যে টাওয়াল রাখা আছে মুখ মুছে নে মিতুল। (ইরফান)
-ইফফান ভাই সকালে একটু কষ্ট করে আমাকে ম্যাথটা আবার বুঝিয়ে দিয়েন। আমার মাথাটা খুব ব্যথা করছে আমি আমার রুমে চলে যাচ্ছি।
ইরফানকে জবাবে কিছু বলতে না দিয়ে বই খাতা গুছিয়ে নিয়ে মিতুল নিজের রুমে চলে যায়। ইরফান ভ্রু কুচকে মিতুলের যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে। মিতুল রুমে এসে বই আর খাতাটা পড়ার টেবিলের ওপর রেখে সোজা দাদীর রুমে যায়। দাদীকে বিছানায় বসে পান সাজাতে দেখে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে তার কোলে মাথা রেখে বিড়ালছানার মতো গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ে।

-কিরে ছেমরি আইজকা এতদিন পর দাদীর কোলের মধ্যে আইসা শুইলি যে? পান খাওনের লাইগা? (মিতুলের দাদী)
-না দাদী আমার পান লাগবেনা। একটু শুয়ে থাকি কিছুক্ষণ। (মিতুল)
মিতুলের দাদী আস্তে আস্তে মিতুলের চুলে বিলি কেটে দিতে থাকেন।
-আচ্ছা দাদী ধরো একটা মানুষের ওপর আমাদের অনেক টান অনুভব হয়, এখন ওই মানুষটার যদি অন্য কোনো বিশেষ মানুষ থেকে থাকে তবে আমাদের কেন খুব কষ্ট হয়? কেন বুক চিরে যাওয়ার মতো যন্ত্রণা হয় দাদী? (মিতুল)
দাদী খুব মনোযোগ দিয়ে তার পুত্নির প্রশ্ন শোনেন। তারপর পান চিবোতে চিবোতে বলে ওঠেন,
-যখন ওই মানুষটাকে আমাদের ভালো লাগতে শুরু করে বা আমরা তাকে ভালোবাসতে শুরু করি তখন তার যদি অন্য কোনো বিশেষ মানুষ থাইকা থাকে তাইলে আমাদের খুব কষ্ট হয়। ওইযে বু তুই যে টানের কথা কইলি না? ওই টানটা হইলো ভালোলাগা বা ভালোবাসার টান। এখন এইটা ভালোলাগা নাকি ভালোবাসার স্তর সেইটা আমরা সময় হইলেই বুঝতে পারি। বুঝলি?
-হুম বুঝলাম। (মিতুল)
দাদীর কথায় মিতুল বেশ গভীর চিন্তায় ডুব দেয়। তবে কি সে ভালোলাগার স্তরে আছে নাকি ভালোলাগার স্তর পার করে ভালোবাসার স্তরে চলে এসেছে?
ইতোমধ্যে ইরফান গরম গরম এক কাপ ধোয়া উড়ানো মশলা চা নিয়ে দাদীর রুমে হাজির হয়।
-কিরে মিতুল তুই বললি তোর রুমে যাচ্ছিস মাথা ব্যথা করছে নাকি। তা নানীর রুমে কি করিস এখন তুই? (ইরফান)
-একা একা রুমে ভালো লাগছিল না। (মিতুল)
-তা আমার রুমে যেতে পারছিলিনা তুই? কথাটা বলতে বলতে রুমে প্রবেশ করে আতিফা (মিতুলের বড় চাচার মেয়ে)
-আতিফা এই চায়ের কাপটা মিতুলকে দে তো। মাথা ব্যথা এক নিমিষে কমে যাবে। (ইরফান)
ইরফানের কথায় আতিফা চায়ের কাপটা মিতুলের হাতে দেয়।



রাতে শুয়ে শুয়ে মিতুল চিন্তা করছে, ”নাহ এভাবে নিজে কষ্ট পেলে তো চলবে না। নিজেকে সামলে নিতে হবে।“

সকালে,
-মিতুল আরাফ স্যারের হোমওয়ার্ক করেছিস? (রিফা)
চমকে উঠে মিতুল বলে ওঠে,
-এইরে আজকে আমি শেষ । আমি তো ভুলেই গেছিলাম হোমওয়ার্ক এর কথা। এখন কি হবে ভাই?
-রিল্যাক্স ডার্লিং আমরা করেছি। স্কুলের টিফিন টাইমে খাতা দেখে কপি করে নিস। তাছাড়া হাতে বেশ সময় আছে, আরাফ স্যারের পড়া তো স্কুল ছুটির পরে। আর এখন দ্রুত পা চালা স্কুলের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে। (রিফা)

-মিতুল শোনো?
আরাফের ডাকে পিছে ফিরে তাকায় মিতুল
-জ্বী স্যার বলেন। (মিতুল)
-বাসায় গিয়ে আজকে একটু সন্ধ্যার দিকে ম্যাসেঞ্জারে থেকো তো। জরুরি কথা আছে। (আরাফ)
-আচ্ছা স্যার। (মিতুল)

রাতে খাবার টেবিলে আজকে পরিবারের সবাই একসাথে বসেছে। ছেলে-মেয়েরা চাকরী বা লেখাপড়ার সুবাদে ঢাকায় থাকায় পরিবারের সকলে একত্রিত হয়ে রোজরোজ খেতে বসা হয়না। সকলের নিরবতার মাঝে হুট করেই মিতুলের বাবা বলে ওঠেন,
-ইরফান তোমাকে বড় ভাইজান বলেছিল আমাদের মেহনাজের জন্য মেয়ে দেখতে। কোথাও কি কারো খোজ পেয়েছো?
-মেঝো মামা আমাদের মাঝেই যদি ভদ্র-মার্জিত শিক্ষিত মেয়ে থেকে থাকে তবে কেন বাহিরে খুজতে যাব? (ইরফান)
-মানে বুঝলাম না। (মিতুলের বাবা)
-সকলের খাওয়া শেষ হলে ড্রইং রুমে বসে এই বিষয়ে কথা বলি মেঝো মামা?(ইরফান)
-আচ্ছা বাবা। (মিতুলের বাবা)


-হ্যা কি যেন বলছিলে ইরফান? (মিতুলের বড় চাচা)
-বলছিলাম মেয়ে তো আমাদের মাঝেই আছে মামা। (ইরফান)
-কে? (মিতুলের চাচা)
-কেন আমাদের সারা। আমাদের সারা আর মেহনাজ একে অপরকে বেশ আগে থেকেই পছন্দ করে মামা। আপনারাও ভেবে দেখুন যে, সারার জন্য মেহনাজের মতো বেটার কেউ হবেনা আবার মেহনাজের জন্য আমাদের সারার মতো বেটার কেউ হবেনা। (ইরফান)
-হুম খারাপ বলোনি তুমি। আর এতদিনে বুঝলাম আমার ছেলে কেন বিয়ের কথা তুললেই এড়িয়ে যায়। (মিতুলের বাবা)
লজ্জায় সারার কান গরম হয়ে গেছে। এত দ্রুত যে সব সামনে এসে যাবে তাতো সে কল্পনাও করেনি।

-বড় আপা তুমি কি বলো? (মিতুলের বাবা)
-আমার কোনো নিষেধ নেই। ছোটকে জিজ্ঞাসা কর ও রাজি কিনা। (ইরফানের মা)
-কিরে ছোট তোর কি আপত্তি আছে? (মিতুলের বাবা)
-আমাদের ছেলে-মেয়েরা যেহেতু একে অপরকে পছন্দ করে তবে আমাদের আর মানা করে লাভ নেই। আমি রাজি। (মিতুলের ছোট চাচা)
ড্রইংরুমে উপস্থিত সকলে জোরে আলহামদুলিল্লাহ বলে ওঠে।

-এবার আমি একটা সত্যি কথা বলি? (ইরফান)
-কি কথা বলো? (মিতুলের বড় চাচা)
-আসলে আমার অফিস থেকে ছুটি দেয়নি। আমিই একমাসের ছুটি নিয়ে এসেছি। কিছুদিন আগে মেহনাজ কাঁদো কাঁদো হয়ে ফোন দিয়ে বলে যে সবাই নাকি বিয়ের জন্য ওকে প্রেশার দিচ্ছে। আমি যেন ম্যানেজ করি। কি আর করা তারপর সব ভাই-বোনদের সাথে আলোচনা করে সবাই বাড়িতে চলে আসলাম এই দুটোর বিয়ের জন্য সবাইকে মানাতে। আমাদের মিতুলের যেহেতু সামনে এসএসসি আবার নভেম্বরে টেস্টও তাই অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের মধ্যেই আমরা ওদের কাবিন সম্পন্ন করে ফেলি আর মিতুলের এসএসসির পরে মেহনাজ আর সারার বিয়ের অনুষ্ঠান করে ফেলব। (ইরফান)

-মন্দ না ব্যাপারটা। তবে তাই ই হোক। কাল তো শুক্রবার। আমরা কাল সকালে বসে সবাই ডেট ফিক্সড করে ফেলব। এখন ঘুমাতে চলে যাও সবাই। (মিতুলের বড় চাচা)
একে একে সবাই ড্রইংরুম হতে নিজের রুমে চলে যেতে থাকে। মিতুল হা হয়ে ইরফানের দিকে চেয়ে ভাবতে থাকে, “কি আছে এই লোকের মাথায়? সাইক্লোনের মতো কিভাবে দ্রুত সব ম্যানেজ করে নিলো।“সে ঠিক করেছে আজ থেকে ইরফানকে মিঃ সাইক্লোন বলেই ডাকবে। কিয়ৎক্ষণ বাদে মিতুলের বেশ রাগ ও ওঠে, তার আপন হয়ে ভাই তাকেই এতদিন কিছু বলল না? সে কি সবাইকে বলে দিতো নাকি?

-কিরে সুজির হালুয়ার সেফ ফোস ফোস করছিস কেন? তোকে কিছু আগে জানানো হয়নি বলে? তোর যে পেট পাতলা কখন না কখন গিয়ে কাকে বলে দিতি আর আমার সব প্ল্যান ঢিসমিস হয়ে যেত। তাই তোকে কেউ কিছু বলেনি বুঝেছিস? (ইরফান)
-এই এক মিনিট এক মিনিট আপনি আমাকে সুজির হালুয়ার সেফ কেন বললেন? (মিতুল)
-এইযে তুই উদ্ভট উদ্ভট কথা বলিস। সম্মানকে কিভাবে সুজির হালুয়া বানায় বল? আমদের তো জানা নেই। অবশ্যই তোর স্পেশার রেসিপি এটা? তাই তোকে সুজির হালুয়ার সেফ বললাম। আর কন্টিনিউয়াসলি বলা হবে। (ইরফান)
-হুহ সাইক্লোন কোথাকার। বিড়বিড় করে বলে ওঠে মিতুল
-কি বললি? (ইরফান)
-বললাম আপনি একটা সাইক্লোন। (মিতুল)
-তবে রে দাড়া তুই। (ইরফান)

মিতুল দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসে। বালিশে মাথা রাখতেই খেয়াল আসে বিকালে আরাফ স্যারের বলা কথাটা। ঝটপট মায়ের ফোন নিয়ে আইডি লগ ইন করে মিতুল। ম্যাসেঞ্জারে ঢুকে আরাফের ইনবক্সে যেতেই মিতুলের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।

“আই লাইক ইউ মিতুল।“
আরাফের সেন্ড করা ম্যাসেজটা পড়তেই মুহূর্তের মাঝে ভয়ে হাত-পা কাঁপতে শুরু করে মিতুলের।

চলবে…

আফিয়া অন্ত্রীশা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে