#মেহেরজান
#পর্ব-৯
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগার টেনে চলেছেন অর্ণব। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই এভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগার খান তিনি। আম্রপালি তার ঘরের দরজায় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে এক দৃষ্টিতে অর্ণবকে দেখে চলেছেন। হয়তো ভাবছেন ছেলেটাকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। হাতের বাইরে বেরিয়ে গেছে একদম।
“অর্ণব।”
আম্রপালিকে দেখে অর্ণব দ্রুত সিগারটা ফেলে বললেন,
“ভেতরে আসুন মা।”
আম্রপালি চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে অর্ণবের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,
“শুভ জন্মদিন।”
“ধন্যবাদ মা।”
আম্রপালি অর্ণবের মাথায় হাত রাখলেন। চুলগুলো কেমন অগোছালো উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে। হাত দিয়ে ঠিক করে দিতে দিতে বললেন,
“বাড়ির সবার সাথে তো ঠিকমতোই কথা বলিস। আমার সাথে এমন কেন করছিস?”
অর্ণব খেয়াল করলেন আম্রপালি তাকে তুই বলে সম্বোধন করছেন। যা আগে কখনো করেননি। বুঝতে পারলেন বিশ বছরের দূরত্ব ঘোচানোর একটা প্রয়াস।
“কি করেছি?”
“মনে হয় আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস। সবসময় দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করিস।”
“এরকম কিছু নয় মা। এটা আপনার ভুল ধারণা।”
“তাই যেন হয়। কতো বছর পর তোকে ফিরে পেয়েছি। মায়ের ওপর আর অভিমান করে থাকিস না বাবা।”
“আমি আপনার ওপর অভিমান করে নেই মা।”
“আচ্ছা? তাহলে এতোগুলো বছর আসিসনি কেন? আমার কথা কি একবারও মনে পড়েনি তোর?”
“পড়েছে মা। আপনার কথা আমার সবসময় মনে পড়েছে। আপনাকে কি করে ভুলে থাকতে পারি আমি? আপনি মা হন আমার, যাকে আমি পৃথিবীর সবকিছুর চেয়ে, নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। আপনার ওপর অভিমান করে থাকা আমার সাধ্যে নেই।”
অর্ণবের কথা শুনে আম্রপালির মনে যেন এক শান্তি অনুভূত হলো।
“তোর জন্য ক্ষীর বানিয়েছি। খাবি?”
“আমার জন্য বানিয়ে আবার আমাকেই জিজ্ঞেস করছেন?”
আম্রপালি সামান্য হাসলেন।
“দাঁড়া। পদ্মাকে দিয়ে পাঠাচ্ছি।”
আম্রপালি চলে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার বললেন,
“চিড়ের পোলাও খুব পছন্দ করিস না তুই? আজ অপেক্ষা কর। কাল বানিয়ে দেবো।
আম্রপালি চলে গেলে অর্ণব চায়ের কাপ নিয়ে আবার বারান্দায় এলেন। কাপে চুমুক দিতে দিতে চারদিক পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। বাড়ির চেহারা আর আশেপাশের সব অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বাড়িতে এখন সবকিছুর দায়িত্ব শকুন্তলার এবং সে বেশ ভালোভাবেই সব সামলাচ্ছেন। বাড়িতে নতুন রঙ করা হয়েছে। মনে হয় তার আসার কারণে। বাড়ির পেছনে একটা অর্জুনগাছ, গগণশিরীষ গাছ আর কিছু ফলের গাছ ছাড়া বাড়ির আশেপাশে তেমন একটা গাছগাছালি ছিল না। তবে এখন বাড়ির সামনে বিশাল বড় একটা ফুলের বাগান হয়েছে। শমিতের থেকে জেনেছেন এইসব পদ্মার বোনা। বাড়িতে আগের মতো কাজের লোকজন তেমন নেই। শুধু রামু ছাড়া, যিনি এখন ফুলগাছে পানি দিচ্ছেন। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা রাখতেই দেখলেন বাড়ির গেইট দিয়ে মেরুন রঙের আনারকলি পরা এক মেয়ে ঢুকছেন। মোহিনীকে চিনতে অর্ণবের অসুবিধা হয়নি। সেদিন প্রথম দেখার পর আবার বিজয়াতে দেখেছিলেন তাকে। কিন্তু সামনাসামনি কথা হয়নি। বাড়ির ভেতরে ঢোকার সময়ই রামু এক বালতি পানি ঢেলে দিলেন তার সামনে। মোহিনী চেঁচিয়ে উঠলেন।
“দিলে তো ভিজিয়ে।”
রামু দাঁত দিয়ে জিভ চেপে ধরলেন। বললেন,
“ভুল হইয়া গেছে মোহিনী মা। আমি দেখছিলাম না।”
“এতো বড় একটা শরীর নিয়ে হাঁটছি তাও দেখতে পাও না হুহ?”
“আর হইবো না। এইবারের মতোন মাফ কইরা দেন।”
“মাফ চাইতে হবে না। বাদ দাও। পদ্মা কোথায় কাকু?”
“মালকিনের সাথেই তো দেখছিলাম।”
“কোথায় দেখেছিলে? বড়মা কোথায়?”
“ঠিক মনে পরতাছে না কইযে দেখলাম।”
“থাক। আর বলতে হবে না। আমিই খুঁজে নেবো।”
বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে ঘটা সম্পূর্ণ বিষয়টা দেখলেন অর্ণব। মুচকি একটা হাসি দিয়ে ঘরের ভেতরে এসে বুকশেলফ থেকে একটা বই হাতে হাতে নিতে দেখলেন পদ্মাবতী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ঘরে উঁকিঝুঁকি মারছেন। অর্ণবকে ঘরে দেখতে পাননি হয়তো তাই এভাবে খুঁজছেন।
“ঘরে এভাবে উঁকি মারছো কেন? কিছু চুরি করার মতলব নাকি? ভেতরে এসো।”
“ইশ,,এভাবে বলতে পারলেন? আপনি যেন কেমন একটা মানুষ। যা মুখে আসে বলে দেন। একটুও ভেবে দেখেন না সামনের মানুষটার কেমন লাগতে পারে।”
“এমনভাবে উঁকিঝুঁকি মারছিলে, আমি তো ভাবলাম চুরি করতেই এসেছো। আমার ঘরে কতো দামি দামি জিনিসপত্র আছে জানো?”
“আপনার ব্যবহার একদম ভালো না।”
“ঠিক আছে। ভালো করে জিগ্যেস করছি। কেন এসেছো?”
পদ্মাবতী ক্ষীরের বাটিটা উঁচু করে অর্ণবের সামনে ধরলেন।
“বড়মা ক্ষীর পাঠিয়েছে আপনার জন্য।”
“জানি। টেবিলে রেখে যাও।”
পদ্মাবতী বাটিটা টেবিলে রেখে বললেন,
“চায়ের কাপটা দিন।”
“চা খেয়েছি কি খাইনি তুমি কি করে জানো?”
“আমিই রেখে গিয়েছিলাম সকালে আপনার ঘরে। বাড়ির সবার জন্য চা আমিই বানাই। আর না খেলেও এতোক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গেছে। ওটা আর খাবেন না নিশ্চয়ই।”
“ওখানে রাখা আছে নিয়ে যাও।”
পদ্মাবতী এগিয়ে কাপটা নিয়ে দেখলেন অর্ণব চা খেয়েছেন। চলে যেতে নিলে অর্ণব বললেন,
“শোনো, আমার অনুমতি ছাড়া আমার ঘরে আর ঢুকবে না।”
“শয়তান একটা। এতো কথা শোনানোর পরও আর কোনোদিন চা দেব নাকি আপনাকে।”
পদ্মাবতীর বলা কথাগুলো কর্ণকুহর হয়নি অর্ণবের। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
“আমাকে কিছু বললে তুমি?”
“না। আপনাকে বলিনি কিছু। আর হ্যাঁ, দিদা সকালে একবার আপনার কথা জিজ্ঞেস করছিল।”
“কখন?”
“যখন খাবার খাওয়াতে গিয়েছিলাম।”
“ঠিকাছে। আমি যাচ্ছি একটু পর। তুমি এবার যেতে পারো।”
পদ্মাবতী একটা ভেংচি দিয়ে চলে গেলেন। সে চলে গেলে অর্ণবও একটা তোয়ালে নিয়ে স্নান করতে চলে গেলেন।
.
.
.
“চিত্রা, পদ্মা কইরে?”
“ওকে তো দাদার ঘরের দিকে যেতে দেখেছিলাম।”
“তোর দাদার ঘর কোনটা?”
“দোতলার ডান দিকের শেষ ঘরটা।”
মোহিনী কথা না বাড়িয়ে সিড়ি দিয়ে উপরে চলে গেলেন। সোজা অর্ণবের ঘরে ঢুকে গেলেন। কিন্তু পদ্মাবতীকে পেলেন না। ফিরে আসার সময় চোখ পরলো টেবিলে রাখা ক্ষীরের বাটিটার উপর। ঢাকনা উঠিয়ে দেখে কোনো রকম ভাবনাচিন্তা না করে চামচ দিয়ে খাওয়া শুরু করলেন। এরই মাঝে মাথা মুছতে মুছতে স্নানঘর থেকে অর্ণব বেরিয়ে এলেন। মোহিনীকে পেছন থেকে দেখেও তাকে দিব্যি চিনতে পেরেছেন অর্ণব।
“অন্যের জন্য রাখা ক্ষীর চুরি করে খেতে লজ্জা করে না?”
চকিতে পিছনে ঘুরলেন মোহিনী। সুঠাম দেহি এক যুবক দাঁড়িয়ে আছেন। দেখতে কিছুটা উত্তম কুমারের মতো। মুখে থাকা খাবারটুকু গিলে বললেন,
“নাম লেখা আছে নাকি এতে? যার ভাগ্যে ছিল তার পেটেই গেছে। এখনো অর্ধেক বাকি আছে। আপনি চাইলে আপনাকেও দিতে পারি একটু।”
“লাগবে না। অন্যের এঁটো করা খাবার আমি খাইনা।”
“আপনার ইচ্ছা।”
মোহিনী গপগপ করে পুরোটা খেয়ে নিলেন। অর্ণব এক দৃষ্টিতে তার খাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
“আমার খাওয়ায় নজর দিচ্ছেন নাকি?”
“না। খেতে বোধহয় একটু বেশিই পছন্দ করেন আপনি। অথবা খিদে পেয়েছে।”
“দুটোই। আপনি কে?
“অর্ণব চৌধুরী।”
“ওহহহ। বড়মার ছেলে।”
“হুম।”
“আপনি নাকি রাগ করে বিলেত চলে গিয়েছিলেন?”
“আমি রাগ করে যাইনি আর যেতেও চাইনি। পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমার মায়ের ওপর রেগে থাকা যায় না।”
“এটা ঠিক বলেছেন। বড়মার ওপর রেগে থাকা যায় না। এতো সহজ-সরল মানুষ এর ওপর আবার রাগ কিসের? আপনি তো অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন।”
“কোনোটাই নয়।”
“আপনি স্বীকার করতে চান না।”
“বড্ড বেশি কথা বলেন আপনি।”
“এতোটাও না। যাই হোক, এখানে এসেছিলাম পদ্মাকে খুঁজতে। ও যেহেতু নেই, আমারও কোনো কাজ নেই এখানে।”
“দাঁড়ান মেহেরজান।”
“আপনি আমার নাম জানলেন কি কিভাবে?”
“জেনেছি কোনোভাবে।”
“উহু। মোহিনী বলে ডাকলে জিজ্ঞেস করতাম না। কারণ এখানে এমন কেউ নেই যে আমাকে চেনে না। কারও না কারও কাছে নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন আমার নাম। কিন্তু মেহেরজান বলে আমাকে কেউ ডাকে না। একমাত্র আমার তারামা ছাড়া। তবুও বেশিরভাগ সময় ছোট করে মেহের ডাকেন। আচ্ছা, আপনি গিয়েছিলেন সেদিন নাচ দেখতে?”
“গিয়েছি কি যাইনি সেটা কোনো বড় বিষয় নয়। চিড়েও পোলাও খেতে পছন্দ করেন?”
হঠাৎ অর্ণবের এহেন প্রশ্নে অবাক হলে মোহিনী। তবুও চেহারার ভাব স্বাভাবিক রেখে বললেন,
“হ্যাঁ, অনেক পছন্দ করি।”
“ঠিকাছে।”
মোহিনী আর কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই অর্ণবও বের হয়ে আসলেন। নিচে নেমে দু’জন দু’দিকে চলে গেলেন। অর্ণব এসে শান্তি দেবীর ঘরে ঢুকলেন।
“ঠাম্মা।”
শান্তি দেবীর পূর্বের মতোই নিজের চশমা খুঁজতে লাগলেন। অর্ণব এসে নিজেই চশমাটা তাকে পরিয়ে দিলেন। শান্তি দেবী আলতো করে অর্ণব এর গালে হাত রাখলেন।
“কেমন আছো ঠাম্মা?”
অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে জবাব দিলেন শান্তি দেবী।
“এতোদিন পর মনে পরেছে তোর ঠাম্মার কথা?”
“তোমার কথা তো আমার সবসময় মনে পরে ঠাম্মা।”
“কবে এসেছিস?”
“কয়েকদিন আগেই তো এলাম।”
“আমার সাথে দেখা করলি না কেন? এতোদিন পর আসলি কেন?”
অর্ণব কিছুটা অবাক হলো।
“ঠাম্মা, আমি এসেই তো আগে তোমার ঘরে এসেছিলাম। কালও তো তোমার কাছে এসেছিলাম ঠাম্মা। মনে নেই তোমার?”
শান্তি দেবী নির্বাক। এক ধ্যানে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে আছেন। অর্ণব বুঝতে পারলেন তার কিছু মনে নেই। পেছন থেকে এক মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো।
“দিদার কিছু মনে থাকে না। এই মনে আছে তো এই ভুলে গেছে। আবার পরে মনেও পরে। একটু আগে কিন্তু নিজেই আপনার কথা বলছিলেন।”
শান্তি দেবী বলে উঠলেন,
“পদ্মা, এসেছিস তুই?”
“হ্যাঁ, এসেছি আমি। সাথে তোমার ওষুধ নিয়ে।”
অর্ণব উঠে চলে গেলেন। পদ্মাবতী শান্তি দেবীকে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে তার কোলে মাথা রেখে শুইয়ে পরলেন।
চলবে…
#মেহেরজান
#পর্ব-১০
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
পরী দৌঁড়াচ্ছে। তার পেছন পেছন রজনী দৌঁড়াচ্ছেন। হাতে খাবারের থালা। রজনীর হাতে খেতে কিছুতেই রাজি হচ্ছে না মেয়েটা।
“দেখ পরী, আমি এভাবে খাবার নিয়ে তোর পেছনে দৌঁড়াতে পারবো না। চুপচাপ খেয়ে নে বলছি। নয়তো না খেয়ে থাকবি।”
“উহু। আমি তোমার হাতে খাবো না রজনী দিদি। সবসময় তো তুমি আর মোহিনী দিদি খাইয়ে দাও। আজ আম্মা খাইয়ে দিক। তাহলে খাবো।”
“মার খেতে খুব মন চাচ্ছে বুঝি তোর? আম্মা খাইয়ে দেবেনা তোকে। চুপচাপ খেয়ে নে।”
“আমি খাবো না।”
সামনেই তারানা বসে ছিলেন। সবকিছুই নিরবে দেখে চলেছেন তিনি। রজনী তারানার দিকে তাকালেন। তারানা ইশারা করলে রজনী খাবারের থালাটা তার হাতে দিয়ে গেলেন।
“পরী, এদিকে আয়।”
মেয়েটা চুপচাপ এসে তারানার পাশে বসল। তারানা পরীর মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন,
“আজ খাইয়ে দিচ্ছি বলে রোজ রোজ দেবো এটা ভাবিস না পরী। রজনীর হাতে না খেলে নিজের হাতে খাবি। তাও যদি না পারিস তাহলে না খেয়ে মরবি।”
“কেন? মরবো কেন? তুমি খাইয়ে দেবে না কেন?”
“মেহের এর সাথে থাকতে থাকতে তুইও বড্ড বেশি প্রশ্ন করা শিখেছিস আজকাল। তোকে খাইয়ে দেওয়ার কাজ আমার নয়। বুঝলি?”
“হুম। বুঝেছি।”
দোতলায় দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনাটা দেখে বিদ্রুপাত্মক হাসি হাসলেন সৌদামিনী। নিজের ঘরে এসে হাঁসতে হাঁসতে হঠাৎ করে কাঁদতে লাগলেন।
“রজনী?”
“বলো আম্মা।”
“ওই মেয়েটাকে খেতে দিয়েছিলি দুপুরে কিছু?”
“এখনো তো না।”
“দিয়ে আয় তাহলে।”
পরী বলে উঠলো,
“আমি দিয়ে আসি আম্মা?”
“না, রজনী যাচ্ছে দিতে।”
“না, আমি দিতে যাবো।”
কথাটা বলেই খাওয়া থেকে উঠে পড়লো সে। রজনীর কাছে এসে বলল,
“চলো খাবার বেড়ে দাও। আমি নিয়ে যাবো।”
“মার খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে তোর পরী? এখন কিন্তু বেশি বেশি শুরু করেছিস তুই। সবটা হচ্ছে মোহিনীর সাথে থাকার ফল।”
“ওকে নিয়ে যেতে দে রজনী।”
“আম্মাও বলে দিয়েছে এখন। এবার চলো।”
রজনী আর কিছু না বলে পরীকে নিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ বাদে সৌদামিনীর ঘরে খাবার নিয়ে ঢুকলো পরী। তার সামনে খাবার রেখে বললো,
“এই নাও দিদি। তোমার খাবার নিয়ে এসেছি। আম্মা পাঠিয়েছে। তুমি তো দুপুরে কিছু খাওনি। খিদে পেয়েছে না তোমার?”
সৌদামিনী জবাব দিলেন না। পরী আবার বললো,
“আমি চলে গেলাম। তুমি তো বড়। নিজের হাতে খেয়ে নিও। নইলে আম্মা খুব বকবে।”
“দাঁড়াও।”
“কি হলো?”
“ওই তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিটাকে তোমরা আম্মা ডাকো কেন? ও তোমাদের মা নাকি ওর মধ্যে কোনো মমতা আছে।”
রজনী এসে ঠাস করে সৌদামিনীর গালে চড় বসিয়ে দিলেন। পরীর পেছন পেছনই এসেছিলেন তিনি।
“নিজে তো মা হতে পারিসনি। শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বাপের বাড়িতেও জায়গা হয়নি। তুই এতো কথা বলিস কিভাবে? আমরা কাকে কি ডাকবো, তোকে ঠিক করতে হবে না। আমাদের জন্য উনিই আমাদের মা।”
কথাটা বলেই পরীর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেলেন রজনী। রাগে-দুঃখে থরথর করে কাঁপছেন সৌদামিনী। নিজের রাগ খাটাবার মতো কিছু না পেয়ে সামনে থাকা খাবারের থালাটাই ছুড়ে ফেলে দিলেন তিনি।
.
.
.
দুপুরের খাওয়া শেষ করে বিকেলের দিকে একত্র হয়েছেন কিছু লোকজন। মধ্যবয়সী থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও রয়েছেন সেখানে। গোল হয়ে বসে হুক্কা খেতে খেতে খোশগল্পে মগ্ন তারা। তাদেরই মাঝে একজন হলেন অভ্র বাবু। বিলেতে থাকার নিজের বাইশ বছরের অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছেন সবাইকে। হুক্কার ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন,
“না চাচা। কোথাও-ই একটু শান্তি পাই না। এতোদিন হয়ে গেলো নিজের দেশে, নিজের গ্রামে, নিজের পরিবারের কাছে ফিরেছি। তবুও মনে যেন কিসের একটা অশান্তি লেগেই আছে।”
পাশে থেকে একজন বৃদ্ধ বলে উঠলেন,
“বিলেতের হাওয়া গায়ে লেগেছে। এখানে এসে শান্তি পাবে কিভাবে?”
“কি যে বলেন চাচা। ওখানকার চেয়ে হাজার গুণ ভালো আছি এখানে।”
“তাও তো বাইশটা বছর ঠিকই কাঁটিয়ে এলে সেখানে।”
“কাঁটিয়েছি কি আর সাধে? যা করেছি সব তো নিজের পরিবারের জন্যেই করেছি।”
“তা ফিরে যাবে নাকি আবার?”
“না চাচা, অনেক হয়েছে টাকা কামানো। এখন বাকী সময়টা নিজের পরিবারের সাথেই থাকতে চাই। ভাবছি এখানেই নাহয় কলকাতায় একটা ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করবো।”
“এখানে আর কি করবে? করলে ওই কলকাতাতেই যেতে হবে।”
“তাই-ই হয়তো।”
পাশে থেকে আরেকজন বললেন,
“ব্যবসা যখন করবেই তাহলে সাথে ওই শমিত আর অর্ণবকেও নাও। কম তো বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ালে না তাদের। তোমার বোনই বা কি বলো তো। এত বড় একটা ছেলেকে নিজের আঁচলের সাথে বেঁধে রেখেছে একদম। বেকার তো বেকারই, তোমার বোন বিয়েটাও করতে দেয়নি এখনো অব্দি তাকে। শুনেছি গোবিন্দ দাসের মেয়ের সাথে নাকি সম্পর্ক আছে ওর। ওই মেয়ের পেছন পেছন ঘুরে। আবার একসাথেও নাকি দেখা গেছে তাদের। তোমার বোন তো এসব দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। তাই তোমাকে বলছি, কোনোকিছু ঘটার আগেই একটা ব্যবস্থা করে ফেলো।”
“তাই নাকি! তাহলে আমি কথা বলবো অনুরাধার সাথে এ বিষয়ে। আর ব্যবসার ব্যাপারেও বলবো। আপনি আমাকে জানিয়ে ভালোই করেছেন।”
প্রথম বৃদ্ধ আবার বললেন,
“আর অর্ণবের কি হবে? সেও তো তোমার মতো বিলেত ফেরত। আবার পড়ালেখাও করেছে অনেক। সে কি আর ছোটখাটো ব্যবসা করতে চাইবে?”
“বলে দেখবো। যদি না করে তো করলো না। জোর করবো না। সেখানে থাকতে তো খুব বড় একটা কোম্পানিতে চাকরি করতো। মাস গেলে বেশ মোটা অঙ্কের মাইনেও পেত।”
“বলো কি! তাহলে ছেড়ে চলে এলো কেন?”
“আমিও তো তাই ভাবি। একসময় তো আসতেই চাইতো না। হঠাৎ করে যে কি হলো। সবকিছু একদম ছেড়ে ছুড়ে এখানে ফেরার জন্য উতলা হয়ে উঠলো ছেলেটা। আমিও আর না করলাম না।”
“যাই হোক। অর্ণব শমিত দুজনেই তোমার সন্তানের মতো। বড় হয়ে গেছে মানে এই না যে সব বুঝে গেছে। দুজনেই বাবাহারা। এখন মায়েরা যদি তাদের ব্যাপারে উদাসীন হয় তাহলে আর কি করার। ওদের ভালোটা তোমাকেই দেখতে হবে।”
“সেটাই।”
টুকটাক এ বিষয়ে আরও কিছু কথা বলে প্রসঙ্গ পাল্টালেন তারা। বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা, হাসি-তামাশায় ভরে উঠলো তাদের আসর।
.
.
.
গাঢ় নীল আকাশে পেজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাতাসে শুভ্র সাদা কাশফুলগুলো বারবার দোল খেয়ে উঠছে। মাঝি নৌকা পারে এনে ভীড়াতেই অর্ণব চিত্রা আর পদ্মাবতীসহ আরও কয়েকজন মেয়েকে দেখতে পেলেন। তবে তার চোখ খুঁজছে মোহিনীকে। একটু খোঁজাখুঁজি করতে মোহিনীকেও দেখতে পেলেন তিনি। অর্ণব আর শমিত চটপট নৌকা থেকে নেমে গেলেন। শমিত নৌকা থেকে নামা মাত্রই একটা মেয়ে তার দিকে এগিয়ে এলে তিনি মেয়েটার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অর্ণব সেদিকে খুব একটা তোয়াক্কা না করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। পদ্মাবতী এক গুচ্ছ কাশফুল নিয়ে ছোটাছুটি করছিলেন। অর্ণবকে দেখে তার দিকে দৌঁড়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনি এখানে কি করছেন?”
“কেন? আসতে পারি না এখানে? নাকি কাশফুল দেখতে শুধু মেয়েরা আসে। কই লেখা আছে এটা?”
মুহুর্তেই পদ্মাবতীর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। মনে মনে অর্ণবকে হাজারটা কথা শুনিয়ে বললেন,
“সব কথার টেরা জবাব না দিলে আপনার পেটের ভাত হজম হয়না না? নাকি শুধু আমার সাথেই এমন করেন?”
“তোমার সাথে এমন করার আলাদা কোনো কারণ নেই অন্তত। আমি সবসময় এভাবেই কথা বলি।”
পদ্মাবতীর আর আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলার ইচ্ছে হলো না। মোহিনী এসে বললেন,
“বাড়ি চল পদ্মা। অনেক্ষণ তো হলো এসেছি।”
“হুম। আপনি কি আমাদের সাথেই যাবেন অর্ণববাবু নাকি আলাদা?”
অর্ণবের উদ্দেশ্যে শেষবারের মতো প্রশ্ন করে নৌকায় উঠে বসলেন পদ্মাবতী। মোহিনী বললেন,
“যেতে চাইলে বলতে পারেন। আমরা তিনজন মাত্র। আপনারা দুজন মিলে পাঁচজন। এক নৌকাতেই হয়ে যাবে।”
অর্ণবের মনে হলো পদ্মাবতী এই প্রথম কোনো ভালো কাজ করলেন। তাছাড়া সবসময় অকাজ করে বেড়ান।
“ঠিকাছে।”
অর্ণব হাত দিয়ে ইশারা করে শমিত আর চিত্রাকে ডাকলেন। তারা এক নৌকায় উঠলেন না। চিত্রা বললেন,
“আমি তো শেফালীর সাথে এক নৌকায় এসেছিলাম। পরে পদ্মা আর মোহিনী এসেছে। আমি শেফালীর সাথেই যাবো।”
তার দেখাদেখি শমিত বললেন,
“ওরা দুজন একা যাবে নাকি। আমি নাহয় ওদের সাথেই যাই। তোরা এক কাজ কর। তুই, পদ্মা, মোহিনী তিনজন এক নৌকায় ওঠ আর আমি, চিত্রা, শেফালী এক নৌকায় উঠি।”
অগত্যা তারা আলাদা দুটো নৌকায় চড়ে যাত্রা শুরু করলেন। শমিতের হাবভাব অর্ণবের কাছে আগে থেকেই সন্দেহজনক ছিল। এখন ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার। নৌকার এক কোণায় মোহিনী আর আরেক কোণায় অর্ণব বসেছেন। শরতের শেষ বিকেলের রোদ এসে লাগছে মোহিনীর মুখে। কি মায়াবিনী লাগছে তাকে দেখতে! অর্ণব অপলক মোহিনীর দিকে তাকিয়ে আছেন। এমনকি মোহিনীর সাথে চোখাচোখি হওয়ার পরও নিজের নজর সরাননি তিনি। ব্যাপারটা মোহিনীর যতটা না অদ্ভুত লাগছে, তার থেকে বেশি অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে। এই দৃষ্টিতে আজ পর্যন্ত অন্তত কেউ তাকায়নি তার দিকে। এমন চাহনির সাথে পরিচিত নন তিনি। নৌকার একদম মাঝখানে বসেছেন পদ্মাবতী। নৌকা ছোট হওয়ায় হাত বাড়িয়ে মোহিনীর হাত শক্ত করে ধরে আছেন তিনি।
“আমাকে শক্ত করে ধর মোহিনী। পড়ে যাবো তো।”
“পড়বি না তুই। ধরেছি শক্ত করে। বেশি চেঁচাবি তো ধাক্কা মেরে ফেলে দেবো।”
“ভয় দেখাস না মোহিনী।”
“এই তুই ছাড় তো আমাকে। আসতে যেতে সবসময় তোর এক নাটক।”
“মোটেই নাটক না। সত্যিই ভয় পাই তো।”
চারদিক কিছু সময়ের জন্য নিরব হয়ে গেল। নদীর কলধ্বনি ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। শমিতদের নৌকাটা অর্ণবদের নৌকার থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। হঠাৎই কারও চিৎকার আর নদীতে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শোনা গেল। চিত্রা দূর থেকে চেঁচিয়ে বললেন,
“ওকে ধরো। ও সাঁতার জানে না।”
মোহিনী পদ্মা বলে চিৎকার দিয়ে নদীতে ঝাপ দিলেন। তার পেছন পেছন অর্ণবও নদীতে ঝাপিয়ে পড়লেন। দুজনে মিলে পদ্মাবতীকে দ্রুত নৌকায় তুললেন। বেশ খানিকটা জল খেয়ে ফেলেছেন তিনি। অনবরত কেঁসে চলেছেন। অর্ণব মোহিনীকেও নৌকায় উঠতে সাহায্য করে নিজেও উঠে এলেন।
“আপনাকে কেও নামতে বলেনি নদীতে। পদ্মাবতীতে আমিই তুলতে পারতাম।”
“কিন্তু আপনার আগে আমি ঝাপ দিয়েছিলাম।”
পদ্মাবতী বললেন,
“দেখলি তো। বলেছিলাম আমাকে শক্ত করে ধর। তুই ধরলি না। তাই-ই তো আমি পড়ে গেলাম।”
“এখন সব দোষ আমার?”
“নয়তো কার?”
পদ্মাবতী অর্ণবের দিকে তাকালেন। চুলগুলো মুখের সামনে এসে গেছে তার। মাথা থেকে জল ভ্রুজোড়া হয়ে কপোল বেয়ে চিবুক থেকে টপটপ করে পড়ছে। এক নজর অর্ণবকে দেখে মাথা নামিয়ে মুচকি হাসলেন পদ্মাবতী। নৌকা ঘাটে এসে থামাতেই সবাই নেমে পড়লেন। চিত্রা দৌঁড়ে এসে পদ্মাবতীকে ধরে বললেন,
“তুই ঠিক আছিস তো পদ্মা?”
“হ্যাঁ। কিছু হয়নি আমার। তবে মোহিনী আর অর্ণববাবু না তুললে নিশ্চিত মরতাম।”
“বাজে কথা বলিস না। বাড়ি চল।”
আম্রপালি ঘষে ঘষে পদ্মাবতী আর মোহিনী মাথা মুছে দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে পদ্মাবতী হাঁচি দিতে আরম্ভ করে দিয়েছেন। চুলে টান পড়তেই বললেন,
“আহ। আস্তে।”
“চুপ মেয়ে। নৌকার মাঝখানে বসে তুমি নদীতে পড়ে যাও আবার কথা বলো।”
“ইচ্ছে করে পড়েছি নাকি আমি?”
কথাটা বলেই পদ্মাবতী আবার হাঁচি দিলেন। আম্রপালি আলমারি থেকে দুটো শাড়ি বের করে বললেন,
“তাড়াতাড়ি দু’জনে কাপড় পাল্টে নে।”
“আমি শাড়ি টারি পরতে পারবো না বড়মা।”
“চুপ কর মোহিনী। আমি যা বলেছি তাই করবি।”
“জানেনই তো আমি শাড়ি পরলে হোঁচট খেতে খেতে জান যায়।”
“একদিন শাড়ি পরলে হোঁচট খেয়ে মরে যাবি না তুই।”
“বড়মার কথা শোন মোহিনী। পরে নে।”
অগত্যা তাকে শাড়ি পরতে রাজি হতে হলো। একটা লাল হলুদ রঙা শাড়ি নিলেন তিনি। আম্রপালি বললেন,
“বাহ! কি সুন্দর লাগছে তোকে। কেন যে পরতে চাস না।”
মোহিনী ভেজা কাপড় হাতে নিয়ে বললেন,
“আমি এখন বাড়ি যাই বড়মা।”
“কাপড় গুলো রেখে যা। ধুয়ে শুকিয়ে রাখবোনি। পরে নিয়ে যাস।”
মোহিনী ঘর থেকে বের হতেই পেছন থেকে অর্ণব ডাকলেন তাকে।
“পদ্মাবতী।”
মোহিনী দাঁড়িয়ে পড়লেন। অর্ণব যে তাকে পদ্মাবতী ভেবে ডেকেছেন তা বুঝতে পারছেন। পেছনে ঘুরে বলতেই যাবেন তার আগেই অর্ণব আবার বললেন,
“মোহিনীকে দেখেছো কোথাও?”
ঘুরতে গিয়েও ঘুরলেন না মোহিনী।
“ডাকো তো ওকে।”
এবার পেছনে ঘুরলেন তিনি।
“কি দরকার বলুন।”
মোহিনীকে দেখে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলেন অর্ণব। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে মোহিনীর দিকে একটা পাত্র এগিয়ে দিলেন।
“ধরুন।”
মোহিনী ঢাকনা খুলে দেখলেন চিড়ের পোলাও। অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,
“পদ্মা আমার থেকে লম্বা আর ওর চুলও কোমড় ছাড়িয়ে। আমার চুল এতো বড় না। এছাড়াও আরও অনেক পার্থক্য আছে। খুব একটা মিল নেই আমাদের মাঝে। পেছন থেকে দেখলেও চেনা যায়। একদিন শাড়ি পরলেই তো আর পদ্মা হয়ে যাবো না। চিড়ের পোলাও এর জন্য ধন্যবাদ।”
চলবে…