#মেহেরজান
#পর্ব-৫
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
বৈশাখ মাসের অর্ধেক আজ। পড়ন্ত বিকেলের রোদে ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছেন কিছু মহিলা। বাড়ির ঝিঁ থেকে শুরু করে বউরাসহ আশেপাশের দু তিন বাড়ির মহিলারাও রয়েছে। আশেপাশে কোনো পুরুষের নামগন্ধও নেই। কেউ নিজের কাজ করছেন তো কেউবা বসে বসে গল্প করতে ব্যস্ত। দূর থেকে একটা দূরবীন এর সাহায্যে অনেক্ষণ ধরে তাদের লক্ষ্য করছেন তারানা। এতো পাড়াপড়শির ভীড়েও শকুন্তলাকে ঠিকই চিনতে পারছেন তিনি। ওইতো, আয়েশ করে বসে আছেন শকুন্তলা। একজন তার মাথায় তেল মালিশ করে দিচ্ছে তো আরেকজন পা টিপে দিচ্ছে। মেয়েটাকে অন্য এক মহিলার কোলে দিয়ে রেখেছেন। এতো বিলাসিতা ওর ব্যতীত ও বাড়িতে আর কারও নেই তা তারানা ভালো করেই জানেন। একমাত্র ওই এতো হুকুম চালায়। বাড়ির কর্তৃ আম্রপালি হলেও তার মধ্যে এতো শৌখিনতা নেই। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার দেখা পাচ্ছেন না তারানা। পেছন থেকে এসে কানের কাছে হঠাৎ করে কেউ বলে উঠলেন,
“কি দেখছো আম্মা?”
তারানা চমকিত হয়ে পেছনে ঘুরলেন। প্রমিতাকে দেখে বললেন,
“কানের গোড়ায় টেনে এক যখন মারবো তখন বুঝবি। শয়তান মেয়ে কোথাকার। যখনই আসিস একদম জানপ্রাণ বের করে দিস।”
“আহ। রাগছো কেন? বাদাম খাবে?”
প্রমিতা তারানার দিকে হাতে থাকা বাদাম তুলে ধরলেন। তারানা সেদিকে তোয়াক্কা না করে পুনরায় নিজের কাজে মননিবেশ করলেন।
“তুই খাচ্ছিস খানা। আমাকে জ্বালাস না তো।”
প্রমিতা বাদামের খোসা ছাড়িয়ে ঘষে ফুঁ দিয়ে তা মুখে পুরে নিয়ে বললেন,
“দেখছো কি ওদিকে এতো মনোযোগ দিয়ে?”
“জানিস না কি দেখছি? আম্রপালি সেই যে মেয়েটাকে নিয়ে গেল। এতোদিন হয়ে গেল অথচ এখনো দিয়ে যাবার খবর নেই।”
“ওমা! তিনি এখনো মোহিনীকে দিয়ে যাননি?”
তারানা প্রমিতার দিকে ঘুরে তাকালেন।
“কই ছিলি এতোদিন তুই?”
“মানে? আমি আবার কই যাবো? বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে নাকি আমাদের?”
“বাড়িতেই যখন ছিলি তাহলে এটা জানিস না মোহিনী বাড়িতে নেই?”
“উফফফ। জানবো না কেন? আমি তো মজা করে বলেছি।”
তারানা এসে প্রমিতার একদম সামনে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠাস করে গালে থাপ্পড় দিয়ে চুলের মুঠি ধরে বললেন,
“আমার সাথে মজা করার সাহসও করিস না প্রমিতা। মেরে ফেলবো একদম। তোর সাথে আমার মজা করার সম্পর্ক না।”
তারানা তাকে ছেড়ে দিলেন। গালে হাত দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন প্রমিতা। আর জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলেন। তারানা চলে যেতে নিলে পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,
“মোহিনীকে মনে ধরেছে তোমার ওই মালকিনের। তাই নিজের কাছেই রেখে দিতে চাইছেন। বড় হলে দেখবে ছেলের বউ করে নিয়ে যাবেন। যতই হোক, তিনিও একসময় এখানকার মেয়ে ছিলেন। অতীত ভুলবেন কি করে। শেকড়ের টানে বারবার ফিরে আসেন।”
.
.
.
ধীর পায়ে সিড়ি ভেঙে ছাদে উঠে এলেন শান্তি দেবী। শ্বাশুড়িকে আসতে দেখে মাথায় ঘোমটা টেনে উঠে দাঁড়ালেন শকুন্তলা। শান্তি দেবী তাকে ব্যস্ত না হয়ে বসতে ইশারা দিলেন। নিজেও এসে একপাশে বসলেন। নিচে পাটিতে বসে রানী চিত্রাকে নিয়ে খেলছে। শকুন্তলার উদ্দেশ্যে বললেন,
“মেয়েটাকা সবসময় কাজের লোকের কাছে না রেখে একটু নিজের কাছেও তো রাখতে পারো।”
“ও তো বেশিরভাগ সময় আমার কাছেই থাকে মা। এখন একটু রানীর কাছে দিয়েছি।”
শান্তি দেবী জবাব দিলেন না। শকুন্তলার এমন কথায় কথায় জবাব দেওয়া খুব একটা পছন্দ করেন না তিনি। প্রসঙ্গ বদলাতে জিজ্ঞেস করলেন,
“আম্র কোথায়?”
“দিদি তো মনে হয় নিজের ঘরে আছেন।”
“সেদিন যে বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছিল সে রয়েছে এখনো?”
“কে? মোহিনী? হ্যাঁ, ওই বাচ্চাটা তো এখনো দিদির কাছেই রয়েছে। দিদি তো এখন ওর আর পদ্মার সাথেই বেশি সময় কাঁটায়।”
“ওহ।”
“দিদি কিন্তু কাজটা একদম ঠিক করেনি মা।”
“কোন কাজ?”
“ওইযে ওখান থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে এলো। দিদি ওদের খোঁজখবর নিতে মাঝেমাঝে ওখানে যায় যাক। কিন্তু বাচ্চা তুলে আনার কি দরকার ছিল। এমনিতেই বাড়িতে দু দুটো বাচ্চা। আরেকটার বোঝা না বাড়ালেই নয়।”
শান্তি দেবী ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন।
“আম্র যখন বাচ্চাটাকে এ বাড়িতে এনেছে তাহলে ভেবেচিন্তেই কাজটা করেছে। তোমার এতো না ভাবলেও চলবে।”
চশমা ঠিক করতে করতে ছাদের কিনারায় আসতেই দেখলেন সামনের রাস্তাটা দিয়ে পালকি করে বউ আসছে। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে কিছু দূরের একটা জমিদার বাড়ির দিকে তাকালেন। দূর হলেও এখান থেকে বাড়িটা স্পষ্ট দেখা যায়। বাড়ির দেওয়ালে শ্যাওলা পড়ে গেছে। অথচ একসময় কতই না জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। সেদিকে হাত দিয়ে ইশারা করে পুনরায় বলতে শুধু করলেন।
“ওইযে জমিদার বাড়িটা দেখছো না শকুন্তলা? ওইটা ছিল আমার শ্বশুর বাড়ি। বিয়ে করে ওই বাড়িতেই উঠেছিলাম আমি। আমার শ্বশুর বেশ প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন। আর পাশের ওই বাগানবাড়িটা দেখছো? যেটা এখন বাইজীবাড়ি বলে জানে সবাই। যদিও আগেও ওখানে বাইজীরাই থাকতো তবুও সবাই বাগানবাড়িই বলতো। ওখানেই সবাই যেত নাচ দেখতে। এখন না আছে জমিদারী আর না আছে জমিদারবাড়ি।”
এসব কিছুই অজানা নয় শকুন্তলার। শ্বাশুড়ির থেকে বারবার এসব শুনতে একদম ভালো লাগে তার। তবুও তিনি প্রায়ই বলেন তাকে।
“দিদিও তো ওখানেই থাকতো তাই না মা। ছোট থেকে তো ওখানেই বড় হয়েছে। দাদা তো ওবাড়িতে গিয়ে তার নাচ দেখেই প্রেমে পরেছিলেন।”
শান্তি দেবী পেছনে ঘুরে দাঁড়ালেন।
“আম্রর মতো লক্ষী মেয়ে আমি দুটো দেখিনি শকুন্তলা। সেই স্বাধীনতার আগে বিয়ে হয়েছিল আমার। ওই বাড়িতে একদম রানীর মতো থাকতাম। আম্রও বউ হয়ে ও বাড়িতেই এসেছিল। কিছুদিনের জন্য হলেও ওখানকার পরিবেশ দেখেছে। যদিও তখন আমাদের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। তারপর যখন ওবাড়ি ছেড়ে এখানে এসে উঠলাম, আমার তো প্রাণ যায় যায়। এরকম জায়গায় থাকা যায় নাকি। যেখানে আগে সব কাজ করতে চাকরদের হুকুম করতাম সেখানে আমিই হয়ে গেলাম কাজের লোক। এসব কাজ করার একদম অভ্যেস ছিল না আমার। এইযে এখন বাড়ি ভর্তি লোক দেখছো, তখন আমরা চারজন ছাড়া কেউ ছিল না। সব কাজ আম্র একা হাতে করতো। ওই সামলে রেখেছে সবকিছু। তুমি তো এবাড়িতে এসেছো মাত্র দু’বছর হলো। তাই কিছু জানো না তুমি।”
শান্তি দেবী আরও কিছু বলতে যাবেন তার আগেই রুমকি এসে শকুন্তলাকে বললেন,
“বড় বউদি ডেকেছে তোমাকে। নিচে যেতে বললো এক্ষুনি।”
শ্বাশুড়ির কথা শোনা থেকে বাঁচতে শকুন্তলা বিনাবাক্য ব্যয়ে সেখান থেকে দ্রুত চলে গেলেন।
.
.
.
ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল অর্ণব। খাটে থেকে নেমে টেবিলের কাছে এসে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিল। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ভোর পাঁচটা বাজে। বাইরে পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে কিছু কিছু। বিছানার কাছে এসে নিচু স্বরে শমিতকে ডাকতে লাগলো।
“শমিত এই শমিত, ওঠ। তাড়াতাড়ি ওঠ। কিরে? ওঠনা।”
শমিত উঠে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললো,
“কি হয়েছে? ডাকছিস কেন? এখনো তো সময় হয়নি ওঠার।”
“হুশ…আস্তে বল। আমি চলে যাচ্ছি।”
“চলে যাচ্ছিস মানে? কই চলে যাচ্ছিস?”
“চলে যাচ্ছি মানে পালাচ্ছি। বাড়িতে।”
“সকাল সকাল আমার ঘুম ভাঙিয়ে মজা করছিস?”
“উহু। সত্যিই যাচ্ছি।”
বলেই নিজের কাপড়চোপড় বের করে ব্যাগে ভরতে লাগলো।
“এই অর্ণব, পাগল হলি নাকি রে? কই যাবি তুই? কেন যাবি আর কি করেই বা যাবি?”
“বললাম তো বাড়ি যাবো। মায়ের কাছে। মায়ের জন্য খারাপ লাগছে।”
“আর ক’টা দিনেরই তো ব্যাপার। তারপর বাবা তোকে দিয়ে আসবে। থেকে যা না।”
“উহু। এখনই যাবো। তুই বলেছিলি আমি এখানে দু’সপ্তাহের জন্য এসেছি। সে হিসেবে আমার গতকালই চলে যাওয়ার কথা ছিল।”
“সকালে বাবাকে বলবো তোকে দিয়ে আসতে। এখন একা যাস না। তুই গেলে আমি অনেক বকা খাবো। আর তুই যাবি কি করে?”
“হেঁটে হেঁটে।”
“পাগল হয়েছিস? এতো দূর হেঁটে যাওয়া যায় নাকি?”
অর্ণব শমিতের কাঁধে হাত রেখে বললো,
“আমি যাচ্ছি। বেশি দেরি করলে আবার পিসির কাছে ধরা পরে যাবো। ভালো থাকিস বন্ধু।”
“তুই সত্যিই যাবি?”
অর্ণব কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পরলো। এখনো চারদিক বেশ অন্ধকার। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছু দূর আসতেই পেছন থেকে কারও ডাক শুনতে পেল। পেছনে তাকাতেই দেখলো শমিত তাকে ডাকতে ডাকতে দৌঁড়ে আসছে। অর্ণবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
“এই নে। আমার কিছু জমানো টাকা ছিল। সামনে যাওয়ার জন্য কিছু না কিছু পেয়ে যাবি। এতে হয়ে যাবে। সাবধানে যাস।”
অর্ণব শমিতকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“ভালো থাকিস। আর আমার জন্য বকুনিটা হজম করে নিস।”
অর্ণব আবার হাঁটা শুরু করলো। যতক্ষণ তাকে দেখা যায় ততক্ষণ শমিত ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। ধীরে ধীরে আঁধারে মিলিয়ে গেল অর্ণব।
.
.
.
বাড়ির গেইটের সামনে এসে দাঁড়াতেই বাইরে থেকে কাউকে দৌঁড়ে আসতে দেখলেন রামু। কিছুটা কাছাকাছি আসতেই অর্ণবকে দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ। অর্ণব তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“মা কই?”
“বড় মালকিন তো তার ঘরে। আপনে তো পিসির বাড়ি গেছিলেন। এইহানে কেমনে আইলেন অর্ণব বাবা?”
“পরে বলছি।”
অর্ণব দৌঁড়ে বাড়ির দিকে চলে যায়। পেছন থেকে রামু তাকে দাঁড়ানোর জন্য বলতে থাকেন। অর্ণব তা কর্ণকুহর না করে নিজের মতো বাড়ির ভেতরে চলে যায়। আম্রপালিকে ডাকতে ডাকতে তার ঘরে এসে কাউকে না পেয়ে ফিরে যেতে নিলেই তার চোখ পড়ে খাটের উপর। দুটো বাচ্চা শুয়ে আছে। অর্ণব তাদের কাছে এসে বসলো। একজন ঘুমাচ্ছে তো আরেকজন চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক দেখছে। অর্ণব তাকে কোলে তুলে নিলো। বাচ্চাটা ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় জানালা দিয়ে বাইরে নজর যেতেই চোখে পড়লো শকুন্তলা চিত্রাকে কোলে নিয়ে কার সাথে যেন কথা বলছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
“পদ্মা তো ঘুমিয়ে আছে। চিত্রা ছোটমার কোলে। আর এটা চিত্রা হতেই পারে না। এটা কে তাহলে?”
বাচ্চাটা নিজের ছোট্ট হাত দিয়ে অর্ণবের গাল চেপে ধরেছে। না, ছোট্ট হলেও বেশ জোরেই চেপে ধরেছে।
“অর্ণব।”৷
আম্রপালি এসে ডাক দিতেই অর্ণব পেছনে ঘুরলো।
“মা।”
“তুমি এখানে কি করে এলে?”
মোহিনীকে কোলে থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো অর্ণব।
“কি হলো বলো? এখানে কি করে আসলে তুমি? তোমার পিসেমশাই এসেছেন সাথে? কোথায় উনি?”
“কেউ আসেনি।”
“তাহলে? কি করে এলে তুমি?”
“পা..পা..পালিয়ে এসেছি।”
চলবে…
#মেহেরজান
#পর্ব-৬
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে সৌরভ বাবু বললেন,
“আর বলবেন না বউদি। শমিত যখন বললো অর্ণব চলে গেছে, আমি আর অনুরাধা তো প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এইটুকু একটা ছেলে একা গেল কি করে। ঠিকমতো পৌঁছোতে পারলো কিনা। তাই তো শমিতকে নিয়ে পেছন পেছন আমিও বেরিয়ে পরলাম।”
আম্রপালি কোনো জবাব না দিয়ে সামান্য অধর প্রশস্ত করলেন।
অর্ণব এসে তার মায়ের পাশের দাঁড়িয়ে শমিতকে ইশারা করতেই শমিতও তাকে ইশারায় দাঁড়াতে বললো।
“এসেই যখন পরেছি তাহলে কাজটা ফেলে না রেখে আজই সেরে ফেলি বউদি? দাদাকে তাহলে নিয়ে যাই।”
“মা, পিসো বাবাকে কই নিয়ে যাবেন?”
“এখানে ভালো ডাক্তার নেই তাই তোমার পিসেমশাই ওনাকে শহরে নিয়ে যাবেন।”
“আমিও যাবো।”
“না। তুমি যাবে না।”
“কেন?”
“তুমি গিয়ে কি করবে? ওনারা তো ব্যস্ত থাকবেন। তোমার একা একা ভালো লাগবে না। আর শমিত তো এখানে আছে। তুমি চলে গেলে ও একা থাকবে নাকি এখানে?”
“আচ্ছা যাবোনা।”
“হুম।”
“আমি আর শমিত খেলতে যাই?”
“আচ্ছা যাও।”
শমিতকে ডাকতেই সে উঠে দাঁড়ালো। এরপর দুজনে তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে চলে এলো। যেন এখান থেকে সরে পরলেই বাঁচে।
“আমি চলে আসার পর কি হয়েছে? পিসি বকেছে তোকে?”
“বকেনি আবার। মা তো ঝাড়ু নিয়ে এসেছিল মারার জন্য। বাবা থামিয়েছে। তারপরই তো আমাকে নিয়ে এখানে চলে আসলো।”
“আমাকেও অনেক বকেছে মা। এখানে কি থাকবি কয়দিন?”
“হ্যাঁ। যতদিন না বাবা মামাকে নিয়ে ফিরে আসে।”
“পিসি বাড়িতে একা রয়েছে না?”
“উহু। রাশমণি দিদি এসে থাকবে রাতে এ কয়দিন।”
“সেদিন যার বাড়িতে গিয়েছিলাম সে?”
“হ্যাঁ।”
হাঁটতে হাঁটতে দুজনে আম্রপালির ঘরে চলে এলো।
“এরা কারা অর্ণব?”
“ও হচ্ছে পদ্মাবতী। বলেছিলাম না তোকে?”
“ওহহহ। আর এটা?”
“ও মোহিনী।”
“কে ও? তুই না বলেছিলি মামি একটা বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে। এখানে তো দুটো।”
“জানি না। মা নিয়ে এসেছে। আমি তো প্রথমে দেখে ভেবেছিলাম পদ্মা দুটো হয়ে গেছে। কোলে নিবি ওদের?”
“না থাক। যদি পড়ে যায়?”
“ঠিকাছে না নিলি। তোর অভ্যেস নেই। আমার আছে। চিত্রাকে নিতাম তো কোলে।”
“তুই বুঝি সারাদিন এদের সাথে খেলিস? ইশশশ… আমার যদি একটা বোন থাকতো! তোর তো তিনটা বোন এখন।”
“অর্ণব রাগান্বিত হয়ে বললো,
“এরা আমার বোন নয়।”
শমিত কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
“নিজের বোন না তাতে কি? বোন বলতে সমস্যা কোথায়?”
“নিজের বোন না হলে কেন বলবো এরা আমার বোন?”
শমিত কিছু বলার আগেই রামু এসে বললেন,
“অর্ণব বাবা, বড় মালকিন আপনাগোর দুইজনরে ডাকতাছে। নিচে আহেন তাড়াতাড়ি।”
“কেন ডাকেছে রামু কাকু?”
“বড় মালিকরে নিয়া আপনার পিসেমশাই যাইতাছে।”
“আচ্ছা তুমি যাও। আমরা আসছি।”
নিচে নেমে আসতেই সৌরভ বাবু তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,
“আমরা এখন বের হবো। তাড়াতাড়িই চলে আসবো। ভালো থেকো তোমরা। আর শমিত, একদম দুষ্টুমি করবে না এখানে।”
শমিত তার বাবার কথায় হ্যাঁবোধক মাথা নাড়ালো। সৌরভ বাবু আম্রপালির সামনে এসে বললেন,
“আসি বউদি। বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এখন আর দেরি করা ঠিক হবে না। ভালো থাকবেন।”
“জ্বি। আপনারাও ভালো থাকবেন। সাবধানে যাবেন।”
সৌরভ বাবু বেরিয়ে গেলেন। তার এরকম হঠাৎ করে এসে আদিত্য বাবুকে নিয়ে যাওয়া একদমই ভালো লাগছে না তার। কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। যদিও চারদিন পর তাদের যাওয়ার কথা ছিল। তবুও আজ হঠাৎ করে তাদের চলে যাওয়া বার বার খোঁচাচ্ছে আম্রপালির মনে।
.
.
.
সবেমাত্র রাতের খাবার শেষ করে যে যার যার ঘরে এসে বসেছে। অর্ণব আর শমিত নিজের ঘরে এসে কিছু একটা করছিল। আর ওদিকে আম্রপালি পদ্মা আর মোহিনীকে খাইয়ে দোলনায় ঘুম পারাচ্ছিলেন। বাইরে প্রচন্ড জোরে হাওয়া বইছে। মনে হচ্ছে ঝড় উঠবে। বলতে না বলতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। আম্রপালি উঠে এসে একটা মোমবাতি জ্বালালেন। এমন সময় রামুর ডাকাডাকির শব্দ কানে এলো। সাথে সাথেই সে ছুটে নিচে চলে গেলেন। একে একে সবাই চলে আসলেন। শকুন্তলা কোলে করে চিত্রাকে নিয়ে এসে বললেন,
“কি হয়েছে রামু? এতো চেঁচাচ্ছিস কেন? মাত্রই মেয়েটাকে ঘুম পারিয়েছিলাম। দিলি তো ভেঙে।”
রামু কাঁদতে শুরু করে দিল। আম্রপালি তার উদ্দেশ্যে বললেন,
“কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন? কিছু বলবি তো নাকি।”
রামু হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বললেন,
“সর্বনাশ হইয়া গেছে মালকিন। সব শেষ হইয়া গেছে।”
অর্ণব আর শমিত একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। আম্রপালি আবার প্রশ্ন করলেন,
“কি শেষ হয়ে গেছে? খুলে বলবি তো আগে।”
রামু কান্নার গতি বাড়িয়ে দিলেন। বললেন,
“বড় মালিক আর সৌরভ বাবুর গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটছে। তারা গাড়ির চালকসহ তারা দুইজনেই মইরা গেছে। পুলিশ নিয়া আইতাছে তাগোর লাশ।”
চলবে…