মেহেরজান পর্ব-৪৯ এবং শেষ পর্ব

0
580

#মেহেরজান
#পর্বঃ৪৯
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

সকাল থেকেই পদ্মাবতীর মাঝে একটা ভয় কাজ করছিল। বেলা যত গড়াতে থাকলো, ভয়টা যেন আরও জেঁকে বসলো। সন্ধ্যেবেলা থেকে অস্থির হয়ে উঠলেন। কোথাও একবিন্দু স্থির থাকতে পারছিলেন না। এই বুঝি অর্ণব তাকে ছেড়ে চলে গেলেন। সময় গেলেও তার অস্থিরতা সহজে গেল না। ঘড়ির কাঁটা এখন এগারোটা ছুইছুই। অর্ণবকে দেখলেন সিড়ির কাছে বসে অরণ্যর সাথে খেলছেন। এতোক্ষণে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি। আম্রপালি বললেন,

“নিচের সব বাতি নিভিয়ে দে তো পদ্মা। তার আগে গিয়ে বাইরের বাতিটা নিভিয়ে আয়।”

পদ্মাবতী ছুটে গেলেন বাইরের আলো নেভাতে। কিন্তু সদরদরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে থেমেছে। কেউ একজন নামলেন গাড়ি থেকে। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। পদ্মাবতী চোখ ছোট ছোট করে বোঝার চেষ্টা করলেন আর বিড়বিড় করে বললেন,

“এতো রাতে আবার কে এলো?”

আম্রপালি পেছন থেকে তাড়া দিতে লাগলেন।

“কী হলো পদ্মা? দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বাতিটা নিভিয়ে ঘরে চলে যা তাড়াতাড়ি।”

“কে যেন এসেছেগো বড়মা।”

“সে কি! এখন আবার কে আসবে।”

লোকটা আরেকটু কাছে আসতেই পদ্মাবতী বলে উঠলেন,

“শমিতদা এসেছে বড়মা।”

আম্রপালি এগিয়ে এলেন। শমিতকে ভেতরে ঢুকতে দেখে বলে উঠলেন,

“এই তোর আসার সময় হলো শমিত?”

“আমার কী দোষ মামী। ট্রেনটাই তো দেরি করলো। এক নয়, দুই নয়, পুরো চারটা ঘন্টা দেরি করে এলো।”

“ঠিকাছে। তুই ভেতরে আয়। হাতমুখ ধুয়ে নে। আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি। দিদি তো ঘুমিয়ে পড়েছেন মনে হয়। নয় উনিই করতেন।”

“থাক। মাকে আর ডাকতে হবে না। আর আপনাকেও নতুন করে কিছু রাধতেও হবে না। এখন যা আছে তাই দিন আপাতত। খুব খিদে পেয়েছে।”

“আহারে। কতটা সময় না খেয়ে ছিলিস। গরমে ঘেমে তো একদম ভিজে গেছিস। তুই বরং স্নানই করে নে।”

“হ্যাঁ, তাই করছি।”

আম্রপালির চলে গেলে পদ্মাবতী বললেন,

“ভাইপোকে দেখার এতোদিনে সময় হলো তোমার শমিতদা?”

“আর বলিস না। কাজের এতো চাপ।”

“থাক আর অজুহাত দিতে হবে না।”

“সত্যি রে। অজুহাত দিচ্ছি না। তা আমাদের নতুন সদস্য কই?”

পদ্মাবতী সিড়ির দিকে ইশারা করে অর্ণব আর অরণ্যকে দেখিয়ে দিলেন। শমিত সেখানে আসতেই অর্ণব বললেন,

“এতোক্ষণে তোর আসার সময় হলো?”

“আরে ওই ট্রেনটাই তো। থাক, বাদ দে। আমার ভাইপোকে দেখতে তো দে।”

“কোলে নিবি নাকি এখনো ভয় পাস বাচ্চা বলে?”

“ভয় পাই না আর। তবে এখন কোলে নেব না। বাইরে থেকে এসেছি। গায়ে ধুলোবালি লেগে আছে। আমি স্নানটা সেরে আসি।”

বলেই শমিত দোতলায় চলে যাচ্ছিলেন। শেফালী নিচে থেকে বলে উঠলেন,

“ওদিকে কোথায় যাচ্ছো? এঘরে এসো।”

শমিত শেফালীকে একটা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। বুঝলেন চলাচলে সুবিধার জন্য দোতলার ঘরটা ছেড়ে নিচের ঘরে এসেছেন তিনি। শমিতও নিজের পথ পাল্টে সেখানে চলে গেলেন। অর্ণবও অরণ্যকে নিয়ে ঘরে চলে এলেন। পদ্মাবতী গিয়েছিলেন আম্রপালিকে সাহায্য করতে। কাজ শেষ করে ঘরে এসে দেখলেন বাপ-বেটা দুজনেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
.
.
রাত প্রায় তিনটা বাজে। বাইরে প্রচন্ড জোরে হাওয়া বইছে। জানালার একটা কপাট ভুলবশত খোলা থাকায় তা বারবার বারি খেয়ে শব্দ হচ্ছে। অর্ণব বিছানা ছেড়ে উঠে জানালা বন্ধ করে দিলেন। পদ্মাবতী বেঘোরে ঘুমোচ্ছেন। হাতটা এখনো অরণ্যর দোলনা স্পর্শ করে আছে। গরমে একদম ঘেমে গেছেন তিনি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার। অর্ণব তার হাতটা ঠিক করে দিলেন। এরপর বৈদ্যুতিক পাখা চালু করে নিঃশব্দে দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার যাওয়া মাত্রই পদ্মাবতী উঠে বসলেন। একটা শুকনো ঢোক গিলে হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে তিনিও বেরিয়ে পড়লেন।

খুব সাবধানে অর্ণবের পিছু নিয়েছেন তিনি। এর মাঝেই কয়েকবার ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছেন। এখন তিনি শুধু একটাই প্রার্থনা করছেন, তিনি যেন ভুল প্রমাণিত হন। তিনি যা ভাবছেন তা যেন কখনোই সত্যি না হয়। অর্ণব সেখানে কিছুতেই যেতে পারেন না। নিশ্চয়ই অন্য কোথাও যাচ্ছেন। কোনো গোপন একটা কাজে। তাই এসময় এভাবে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু কোথায়? কোথায় যেতে পারেন? কিছুর সাথে লেগে হোঁচট খেলেন তিনি। সাথে সাথেই অর্ণব ফিরে তাকালেন। কিন্তু তার আগেই নিজেকে গাছের আড়ালে লুকিয়ে ফেললেন পদ্মাবতী। এবারও একটুর জন্য বেঁচে গেলেন। অর্ণব চলতে শুরু করলে পদ্মাবতী আবারও তার পিছু নিলেন। অর্ণব বাইজীবাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। পদ্মাবতীর হৃদস্পন্দন যেন ক্ষণিকের জন্য থেমে গেছে। এতো বাতাসের মধ্যেও আরও বেশি ঘামছেন তিনি। শুধু প্রার্থনা করছেন অর্ণব যেন ভেতরে না যান। কিন্তু তার সব প্রার্থনা বৃথা করে দিয়ে অর্ণব বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন পদ্মাবতী। তার শেষ আশাটাও আজ নিঃশেষ হয়ে গেল। আজ চোখে এক বিন্দুও জল জমেনি তার। যেন বহু আগেই সব জল শুকিয়ে চোখজোড়া মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ঘুরে দাঁড়ালেন পদ্মাবতী। ফিরে আসতে আসতে বারবার পেছন ফিরে বাড়িটা দেখতে লাগলেন। বাড়িতে ফিরে এসে লুকিয়ে দ্রুত ঘরে চলে আসলেন। শান্তি দেবী তখনও সজাগ ছিলেন। নুপুরের আওয়াজ পেয়ে একবার ঘরের বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলেন। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। পদ্মাবতী ঘরে আসা মাত্রই দেখলেন অরণ্য জেগে উঠে কাঁদছে। দৌঁড়ে এসে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলেন পদ্মাবতী। খাইয়ে অনেক্ষণ ভরে হেঁটে হেঁটে আবার ঘুম পাড়ালেন। অরণ্যকে দোলনায় শুইয়ে দিয়ে আলমারি থেকে নিজের বিয়ের শাড়িটা বের করে পরলেন তিনি। আয়নার সামনে বসে খুব সুন্দর করে সাজলেন। কপালে আর হাতে কলকা আঁকলেন। পায়ে আলতা পরলেন। একদম বিয়ের কনের মতো সাজলেন তিনি। সাজ শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে অরণ্যর দিকে তাকালেন। পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে বাচ্চাটা। কী মায়াবী মুখ! কারও হৃদয় পাথরের তৈরি হলেও যেন এ-মুখ দেখে তা মোমের মতো গলতে বাধ্য। কিন্তু পদ্মাবতীর আজ কেন যেন তার প্রতি কোনো মায়া হলো না। না কাজ করলো কোনো স্নেহ-মমত্ববোধ। এর কারণ কী? হাসপাতালে থাকাকালীন যখন মাথায় কারও হাতের শীতল স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলেছিলেন, দেখেছিলেন পাশে অর্ণব বসে। তখনই ভেবে নিয়েছিলেন এই সন্তান তার ভাগ্য বদলাতেই এসেছে। তার জীবন সুখ-শান্তি, আনন্দ আর ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে এসেছে। কিন্তু তাও আজ মিথ্যা প্রমাণিত হলো। বারবার চোখের সামনে এভাবে সকল আশা ধূলিসাৎ হয়ে যেতে দেখলে কারই বা ভালো লাগে? পদ্মাবতীরও লাগেনি। ভেতর থেকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে তাকে। তাই তো আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
.
.
ভেতরের কথা শোনার জন্য দরজায় কান পাতলেন রজনী। কিন্তু কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না। তাই নিজের ঘুম নষ্ট করে আর বৃথা চেষ্টা করলেন না। চলে গেলেন সেখান থেকে। ঘরে ম্রিয়মাণ আলো জ্বলছে। মোহিনী আরও কয়েকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলেন। লাল, নীল, হলুদ, সবুজসহ বিভিন্ন রঙের কাঁচের ভেতর থেকে আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। সম্পূর্ণ পরিবেশ জুরে একটা মাদকতা বিরাজ করছে। মোহিনী আলো জ্বালাতে জ্বালাতেই বললেন,

“আমি জানতাম অর্ণব। আপনি ঠিক আসবেন।”

“কেন ডেকেছেন বলুন।”

“আসতে বলেছিলাম তো সন্ধ্যেবেলায়। জলসা দেখতে। আপনি নিজেই তো এমন একটা সময় এসেছেন অর্ণব।”

অর্ণব জবাব দিলেন না। মোহিনী এসে দু’হাতে অর্ণবের দু’গাল আলতো করে স্পর্শ করে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। আলোক বর্ণালী এসে তার মুখে খেলা করছে। একটা সাদা আনারকলি পরেছেন তিনি। ওড়নাটা সুন্দর করে মাথায় দিয়েছেন। সাদায় যেন তাকে আরও শুভ্র, কোমল আর পবিত্র মনে হচ্ছে। এই ভ্রমরকৃষ্ণ মায়াবী চোখের মধ্যে অর্ণব নিজেকে বারবার হারিয়েছেন। শত চেষ্টা করেও এই মুখ থেকে চোখ ফেরাতে পারেন না তিনি। আজও যেন এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। তবুও নিজেকে সামলানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছেন তিনি। মোহিনী অর্ণবের চোখে চোখ রেখে বললেন,

“অর্ণব, আপনি আমাকে নাচতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু আপনি নিজেই আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। আপনি আর নাচ ছাড়া আর কিইবা আছে আমার? তাই তো আবার নাচতে শুরু করলাম। শত শত পুরুষ এখানে আসে। লোলুভ দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে। তাদের চোখে কামনা স্পষ্ট। এসব ভেবে কি আপনার রাগ হয় না অর্ণব?”

অর্ণব নিরুত্তাপ। এবারও কিছু বললেন না তিনি। তার এমন মৌনতা মোহিনীকে আরও উতলা করে তুলছে। মোহিনী দৃষ্টি নত করলেন। পরক্ষণে দৃষ্টি তুলতেই দেখা গেল চোখ থেকে উপচে পড়া অশ্রুধারা তার কপোল বেয়ে গড়াচ্ছে। প্রতিটি ফোঁটা থেকে যেন হীরের মতো আলোর বিচ্ছুরণ ঘটছে। যার ঔজ্জ্বল্যের তীব্রতায় অর্ণবের চোখ জ্বলসে যেতে বাধ্য। নিজেকে শক্ত রেখে অর্ণব মোহিনীর আঙুলগুলো নিজের দু’হাতের মুঠোয় পুড়ে নিলেন। মোহিনী সেদিকে দৃষ্টিপাত করে শান্ত কণ্ঠে বললেন,

“কেন চলে গেলেন অর্ণব? আমার কথা একবারও ভাবলেন না? একবার দেখা পর্যন্ত করলেন না আপনি। সামান্য একটা চিঠির মাধ্যমে সবকিছু শেষ করে চলে গেলেন আমায় ছেড়ে! বললেন, আমি নাকি কখনো ক্ষমা করবো আপনাকে। কেন? আমি কি এতোটাই নিষ্ঠুর? একটাবার অন্তত বলে দেখতে পারতেন অর্ণব। আপনার সব ভুল ক্ষমা করে দিতাম আমি। সবকিছু ভুলে আবার নতুন করে ভালোবাসতাম আপনাকে। কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন আপনি?”

কথার মাঝেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন মোহিনী।

“আপনি চুপ করে কেন অর্ণব? কিছু তো বলুন। আমি বলি? ফিরে আসুন অর্ণব। আপনাকে আমি ক্ষমা করে দিলাম।”

“কিন্তু আমি যে আপনাকে ক্ষমা করতে পারবো না মেহের।”

অবশেষে অর্ণব কিছু বললেন। কিন্তু তার কথা বোধগম্য হলো না মোহিনীর। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললেন,

“মানে?”

“আমি আপনাকে ক্ষমা করতে পারবো না কোনোদিন।”

“কী করেছি আমি?”

“খু/ন করেছেন। একটা নিষ্পাপ প্রাণকে। আমার সন্তানকে।”

অর্ণবের কথা শোনামাত্র ছিটকে সরে গেলেন মোহিনী। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,

“কী বলছেন আপনি এসব? আপনার সন্তান তো ঠিকই আছে। আমি ওকে কেন খু/ন করবো?”

“আমার একটা মেয়ে হয়েছিল মেহের। একদম পরীর মতো। কিন্তু মৃ/ত। পদ্মাবতী সিড়ি থেকে পড়ে যাওয়ায় মাথায় আঘাত লেগে বাচ্চাটা ওর গর্ভেই মা/রা গেছে। আমার ছেলেটাও মৃ/ত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছে।”

মোহিনী স্থির দাঁড়িয়ে অর্ণবের কথাগুলো শুনছেন। এমন কিছু যে হয়েছে তা ঘুণাক্ষরেও জানেন না তিনি। অর্ণব পুনরায় বললেন,

“সেদিন পদ্মাবতী সিড়ি থেকে পড়ে যায়নি মেহের। আপনি ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন। আর এ কথা পদ্মাবতী ভুলেও কাউকে বলেনি। আমাকেও না। আমি কী করে জানতে পারলাম জানেন?…আপনার তারামা জানিয়েছেন আমাকে সবটা।”

মোহিনী ছুটে এসে অর্ণবের দু পা জড়িয়ে ধরলেন। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন,

“দয়া করুন অর্ণব। আমাকে ক্ষমা করুন। আমি কখনো আপনার সন্তানের ক্ষতি চাইনি। আমি এসব কিছু জানতাম না। আমি কখনো এমনটা চাইনি। সেদিন পদ্মা আমার সাথে এমনভাবে কথা বলেছিল যে…। আমি নিজেকে আঁটকাতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করুন আপনি।”

“পা ছাড়ুন মেহের।”

“আগে আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন তারপর।”

অর্ণব মোহিনীকে উঠিয়ে বললেন,

“আপনাকে আমি আমার হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলাম মেহের। তাহলে এখন পা কী করে ধরতে দেই? তবে কী জানেন? আপনাকে আর আগের স্থানে কখনো বসাতে পারবো না আমি। আপনি তো এমন ছিলেন না মেহের। আমি যাকে ভালোবেসেছিলাম তার আর আপনার মাঝে অনেক তফাৎ। নাকি আমিই চিনতে ভুল করেছিলাম আমার মেহেরজানকে?”
.
.
শান্তি দেবী ঘরে বসে জপ করছিলেন। কিন্তু একটু পর পরই কিছু একটার বিকট শব্দ ভেসে আসছে। বেশ বিরক্ত হলেন তিনি। এতো রাতে বারবার এমন শব্দ হচ্ছে। অথচ কেউ একবার উঠে দেখার প্রয়োজনবোধও করছে না। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। শব্দের উৎস খুঁজতে খুব একটা সময় লাগলো না তার। ছাদের দরজাটা খোলা। সেটাই বারবার বাতাসে ধাক্কা খেয়ে এমন শব্দ করছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লাঠিতে ভর দিয়ে ধীর পায়ে ছাদে উঠে এলেন। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। তিনি দরজাটা লাগাতে যাবেন ঠিক তখনই কিছু একটা চোখে পড়লো তার। ভালো করে তাকাতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। চিৎকার করে বলতে লাগলেন,

“ও পদ্মা, তুই ওখানে কী করিস? নেমে আয় পদ্মা। নেমে আয় তুই।”

শান্তি দেবীর ডাকে পদ্মাবতী পেছন ফিরলেন। বললেন,

“সব শেষ হয়ে গেছে দিদা। সব শেষ। আর কোনো আশা রইলো না আমার। সব মিথ্যা ছিল দিদা। একটা ভুল ধারণার পেছন পেছন দৌঁড়েছি আমি এতোদিন। এখন আর কিছুই করার রইলো না।”

“কী সব বলছিস তুই? নেমে পদ্মা। নেমে আয়। পড়ে যাবি তো ওখান থেকে।”

পদ্মাবতী ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন। শান্তি দেবী ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলেন। কিন্তু কিছু করার আগেই পদ্মাবতী তার দিকে দৃষ্টি রেখেই নিজের দেহ নিচে ছেড়ে দিলেন। শান্তি দেবী চিৎকার দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ছাদের কিনারায় এসে দাঁড়ালেন। নিচে তাকাতেই পদ্মাবতীর নিথর দেহটা চোখে পড়লো তার। বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে সাথে দেখতে পেলেন নিচে র/ক্তে ভেসে যাচ্ছে। আর্তনাদ করে মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে বসে পড়লেন তিনি। চিৎকার করে বিলাপ করছেন। কিন্তু আফসোস! এই ঝড়বৃষ্টির শব্দে তার চিৎকার কারও কানে পৌঁছুবার ছিল না। ধীরে ধীরে উঠে সিড়ি দিয়ে নেমে গেলেন তিনি।
.
.
বাইরে আবছা আবছা আলো ফুটতে শুরু করেছে। তবে বৃষ্টি এখনও একেবারে থামেনি। গুঁড়িগুঁড়ি পড়ছেই। কিন্তু শেফালীর ঘুম প্রতিদিনের মতোই এ-সময় ভেঙেছে। ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে জানালা দরজা খুলে দিলেন তিনি। ঘর থেকে বেরিয়ে সবার আগেই সদরদরজা খুলে দিলেন। চলে যাবেন এমন সময় তার চোখে পড়লো সামনের জায়গাটা র/ক্তে ভেসে গেছে। র/ক্তের উৎসের দিকে তাকাতেই চিৎকার করে উঠলেন তিনি। তার চিৎকার শুনে সবার আগে শমিত ছুটে এলেন। এমন দৃশ্য দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন না শেফালী। চোখের সামনে সবটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে আসছে। শমিতকে ধরে নিচে বসে পড়লেন ধীরে ধীরে। শমিত শেফালীর চিৎকারের কারণ জিজ্ঞেস করতেই শেফালী ইশারা করে সামনে দেখালেন তাকে। পদ্মাবতীর লা/শের শিয়রে বসে আছেন শান্তি দেবী।

গাছের পাতা থেকে এখনো টুপটাপ ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছে। রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় জল জমেছে। অর্ণব জল ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে চলছেন। বাগানের কাছে আসতেই বাড়ির সামনে একটা জটলা দেখলেন। কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পারছেন। কেমন একটা থমথমে পরিবেশ। অর্ণব কাছে আসতেই হতভম্ব হয়ে গেলেন সে দৃশ্য দেখে। আম্রপালি অভিমানী সুরে অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“এসেছো তুমি? তা কোথায় গিয়েছিলে শুনি? ওই মেয়েটার কাছে নিশ্চয়ই। তা ফিরতে গেলে কেন? থেকে গেলেই পারতে ওর সাথে। এখন কি নাটক দেখতে এসেছো?”

“মা।”

আম্রপালি আর নিজেকে আঁটকে রাখতে পারলেন না। হুহু করে কেঁদে উঠলেন। বললেন,

“দেখ অর্ণব, মেয়েটা শেষ পর্যন্ত ম/রেই গেল। তবুও তুই বুঝলি না। আর কবে বুঝতে পারবি? আমি যে অনেক বড় একটা ভুল করেছিলাম তোদের বিয়েটা দিয়ে, তুই সত্যিই আজ সেটা প্রমাণ করে দিলি।”

অর্ণব ধপ করে পদ্মাবতীর লা/শের পাশে বসে পড়লেন। এক ধ্যানে চেয়ে রইলেন। আম্রপালি শমিত আর রামুর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

“দেহ সৎকারের ব্যবস্থা কর। আর রাখা যাবে না এখানে।”

প্রবল হরিধ্বনিতে শবযাত্রা যাচ্ছে। এতে মোহিনী কিছু যায় আসতো না। কিন্তু পেছনে নিজের সন্তানকে কোলে নিয়ে অর্ণবকে চলতে দেখে শিউরে উঠলেন তিনি। ভালো করে খেয়াল করতেই বাড়ির অন্য সদস্যদেরও দেখতে পেলেন। ছাদে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে এসব দেখছিলেন মোহিনী। ঊর্মিলা ছুটে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে পেছন থেকে বললেন,

“মোহিনী জানিস? পদ্মাবতী নাকি ম/রে/ছে।”

চকিতে পেছনে ঘুরলেন মোহিনী। বিস্মিত চোখে ঊর্মিলার দিকে চেয়ে রইলেন। ঊর্মিলা বললেন,

“কাল রাতে নাকি ছাদে থেকে লাফ দিয়ে আ/ত্ম/হ/ত্যা করেছে। মোহিনী, কাল তো অর্ণব এখানে এসেছিলেন। তাই না?”

ঊর্মিলার কথায় স্তব্ধ হয়ে গেলেন মোহিনী। এরপর ছুটে চলে গেলেন। শ্মশানের কাছে এসে অর্ণবকে দেখতে পেলেন। পেছন থেকে বললেন,

“অর্ণব।”

অর্ণব মোহিনীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

“চলে যান মেহের। আপনার এখানে থাকাটা ঠিক হবে না। কেউ কিছু বলে দিতে পারে আপনাকে যা আপনার শুনতে ভালো লাগবে না।”

“এসবের জন্য আমি দ্বায়ী। তাই না অর্ণব?”

“শুধু নিজেকে দোষারোপ করবেন না মেহের। এসবের জন্য যেমন আমরা দ্বায়ী। তেমন পদ্মাবতী নিজেও দ্বায়ী। আমরা সবাই সবার কাছে অপরাধী। আমাদের কী হতভাগ্য দেখুন। না পদ্মাবতী আমাদের কাছে ক্ষমা চাইলো আর না আমরা ওর কাছে ক্ষমার চাওয়ার সুযোগ পেলাম।”

মোহিনী করুণ সুরে কেঁদে উঠলেন। অর্ণব বললেন,

“মেহেরজান, আপনি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম একটা ভুল ছিলেন। আমাদের ভালোবাসার শুরুটা যতটা বেশি সুন্দর ছিল, শেষটা তার চেয়েও বেশি তিক্ত। আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি মেহের। পারলে আপনিও আমাকে ক্ষমা করে দেবেন সবকিছুর জন্য। আজকের পর থেকে আমি ভুলে যাবো আমি মেহেরজান বলে কাউকে ভালোবেসেছিলাম। আপনিও যত তাড়াতাড়ি ভুলতে পারবেন ততই ভালো। আমাদের সফর এপর্যন্তই ছিল।”

মোহিনী অশ্রুসিক্ত চোখে শুধু চেয়ে রইলেন। বলার মতো একটা শব্দও নিজের শব্দভান্ডারে খুঁজে পেলেন না। আম্রপালির সাথে চোখাচোখি হতেই ম/রে যেতে ইচ্ছে করলো তার। যে চোখে সারাজীবন তার জন্য স্নেহ মমতা দেখে এসেছেন, শেষবার সেই চোখে দেখতে পেয়েছিলেন রাগ আর অভিমান। কিন্তু আজ সে চোখে ঘৃণা ব্যতীত কিচ্ছু দেখতে পেলেন না মোহিনী। অর্ণব সামনে এগিয়ে চললেন। মোহিনী দূরেই একটা গাছের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। অর্ণব মন্ত্রভুত অগ্নি অরণ্যর হাতে ছুঁইয়ে চিতায় দিতেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। মোহিনী চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন। ওদিকে পদ্মাবতীর চিতা জ্বলছে। এদিকে মোহিনী পুড়ে ছারখার হচ্ছেন। কারণ প্রতিশোধের অনলের চেয়ে অনুশোচনার অনল মানুষকে বেশি পোড়ায়। আর সে অনলে তাকে চিরকাল পুড়তে হয়। মোহিনীর প্রতিশোধের স্পৃহা আজ অনুশোচনায় পরিণত হয়েছে। তাই তিনিও পুড়ছেন। নদীর ওপার থেকে আসা শীতল সমীরণ চিতার অনলে উত্তপ্ত হয়ে মোহিনীকে স্পর্শ করে যাচ্ছে। যা তার জ্বালাকে আরও তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলছে। শেষবারের মতো অর্ণবকে এক নজর দেখে গুটিগুটি পায়ে ফিরে গেলেন তিনি।

_________________________

চৌধুরী বাড়িটা এখন একদম নিস্তব্ধ। অভ্রবাবু শকুন্তলা আর শান্তি দেবীকে নিয়ে কলকাতায় চলে গিয়েছেন। শেফালীর নাকি একটা ফুটফুটে ছেলে হয়েছে। নাতির মুখ দেখে বউ শ্বাশুড়ির মাঝের দ্বন্দ্বটা যেন একটু হলেও হ্রাস পেয়েছে। তারাও এ-বাড়ি ছেড়ে শমিতের বাপ-দাদার ভিটায় ফিরেছেন। শমিতও সেখানেই একটা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেছেন। আর অর্ণব? সেও নিজের মা আর সন্তানকে নিয়ে বিলেতে পাড়ি দিয়েছেন। মোহিনী সেদিন খুব কেঁদেছিলেন। পদ্মাবতী চলে যাওয়ার তিনমাসের মাথায় বাড়িটা একটা শুনশান অট্টালিকায় পরিণত হয়েছে। একটা কাকপক্ষীর টিকিও দেখা যায় না সেখানে। আসলেই কি কেউ-ই থাকে না আর সেখানে? ওই বাড়িটার দিকে তাকালে মোহিনীর আজও মনে হয় পদ্মাবতী ছাদে দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে তাকে ডাকছেন।

“রোজ রোজ ছাদে দাঁড়িয়ে ও-বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকিস কেন মোহিনী?”

হঠাৎ করে পেছন থেকে প্রশ্ন করায় কিছুটা চমকে উঠলেন মোহিনী। পেছন ফিরে বললেন,

“ওহ ঊর্মিলা তুই। ভয় পাইয়ে দিস কেন এভাবে?”

“আমি কোথায় ভয় দেখালাম। উল্টো এই সন্ধ্যেবেলায় চুল ছেড়ে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকলে লোকে তোকে দেখেই ভয় পাবে।”

“ও-বাড়িতে এখন আর কেউ থাকে না নারে?”

“থাকলে তো দেখতেই পেতিস।”

“ঊর্মিলা, আমি তো সবসময় এটাই চাইতাম যেন ওদের ক্ষতি হয়। ওদের পরিবারটা যেন একদম ধ্বংস হয়ে যায়। তাহলে এখন আমার বুকটা ছিড়ে যায় কেন ওদিকে তাকালে? এতো কষ্ট হয় কেন আমার?”

“কষ্ট লাগলে তাকাবি না। আর তুই নিজেকে কেন দোষারোপ করিস?”

“আমিই তো সবসময় ঈশ্বরের কাছে ওদের অমঙ্গল কামনা করতাম।”

“তাতে কী? ওরা তোর সাথে যা করেছিলো তাতে এটাই স্বাভাবিক। তুই শুধু নিজেকে দোষ দিচ্ছিস। ওরা সব দোষ তোর ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা ঠিকই ভালো আছে। শান্তিতে আছে। এদিকে তুই-ই কিছু ভুলতে না পেরে জ্বলেপুড়ে ম/র/ছি/স।”

ঊর্মিলা কথাগুলো বলতে বলতে চলে গেলেন। মোহিনী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরে চলে এলেন। অর্ণবের উদ্দেশ্যে লেখা নিজের শেষ চিঠিটা লিখতে বসলেন তিনি।

“কালবৈশাখীর ঝড়ে জন্মানো সেই মেয়েটাই যে সবার জীবনে কাল হয়ে আসবে, এটা যদি আমার মা জানতেন তবে জন্মানোর পরই হয়তো আমাকে গলা টিপে হ/ত্যা করতেন। ওরা বলে এসবের জন্য নাকি আমি একটুও দ্বায়ী নই। শুধু শুধু নিজেকে দোষারোপ করছি। আদৌও কি তাই? আপনারা নাকি আমার ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা শান্তিতে আছেন। ভুল বলে ওরা। আমি বিশ্বাস করি না। আপনি সেদিন বলেছিলেন আপনি সবকিছু ভুলে যাবেন। আমাকে ভুলে যাবেন। আমিও যত দ্রুত সবকিছু ভুলে যেতে পারবো। আমার জন্য ততই ভালো। কিন্তু আপনি কি সত্যিই ভুলতে পেরেছেন? তবে আমি ভুলে যাবো। নিজের জীবনের একটা কালো অধ্যায় ভেবে সবটা ভুলে আবার নতুন করে বাঁচবো। অনুশোচনার এই অনলে নিজেকে আর পোড়াবো না। দ্বিতীয়বার কাউকে ভালোবাসার মতো ভুল আর করবো না। তবে আপনাকে হারানোর আফসোস চিরকাল থেকে যাবে অর্ণব। অধিকার খাটিয়ে আমার মেহেরজান বলে ডাকার মতো আমার আর কেউ রইলো না।

ইতি
আপনার মেহেরজান”

চিঠিটা লেখা শেষ হতেই দরজায় কেউ কড়া নাড়লেন। মোহিনী বলে উঠলেন,

“কে?”

“আমি রজনী। শহর থেকে বাবুরা সব চলে এসেছে। নিচে আয় তাড়াতাড়ি।”

“আসছি।”

মোহিনী দ্রুত নিজের ঘুঙুরগুলো পায়ে বেঁধে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে