মেহেরজান পর্ব-৪৭+৪৮

0
393

#মেহেরজান
#পর্ব-৪৭
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

পেট নিয়ে দোতলায় ওঠা নামা করা শেফালীর জন্য আসলেই কষ্টসাধ্য। তাই নিচতলার ঘরটায় চলে আসতে হয়েছে। এখানে সে একা নয়। পদ্মাবতীও রয়েছেন। অনেক আগেই তিনিও এই ঘরটায় চলে এসেছিলেন। একা থাকতে হচ্ছিলো বলে শেফালীও আর অন্য কোনো ঘরে যাননি। রামুকে বলে এঘরেই আরেকটা খাট পাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জানালার বাইরে দৃষ্টি রেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন পদ্মাবতী। কিন্তু এতো শোরগোলে আর শান্তি মতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। নিজের প্রকাণ্ড পেটে হাত রেখে খুব সাবধানে খাটে এসে বসলেন তিনি। নয়মাসের বেশিই চলছে তার। যেকোনো দিন সন্তানের মুখ দেখতে পাবেন। তাই খুব সাবধানে চলতে হচ্ছে এখন তাকে। অন্যদিকে শেফালীর এখনো আরও দুমাস বাকি। বাড়িতে এক সঙ্গে দুজন পোয়াতি নিয়ে শ্বাশুড়িরাও বেশ বিপাকে পড়েছেন। এক্ষেত্রে শকুন্তলা খুব সাহায্য করছেন তাদের। দু’জনেরই দেখভালের দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন। সকাল থেকেই তিনি পদ্মাবতীর সাথে এঘরে রয়েছেন। এটা ওটা নিয়ে গল্প করেই চলেছেন। এমন সময় হাতে একটা খাম নিয়ে বিমর্ষ মুখ নিয়ে আম্রপালি এলেন ঘরে। কিছুটা চিন্তিতও। তাকে দেখেই শকুন্তলা বললেন,

“কী হয়েছে দিদি? মুখটা ওমন হয়ে আছে কেন? আর তোমার হাতে ওটা কী?”

পদ্মাবতীও কৌতূহলী হয়ে তাকালেন তার দিকে। আম্রপালি জবাব দিলেন,

“চিঠি। পদ্মার গ্রাম থেকে এসেছে। ওদিক থেকে একজন এসেছিলেন এখানে। তার হাতেই পাঠিয়েছেন। তিনি দিয়ে গেলেন এখন আমাকে।”

পদ্মাবতী বলে উঠলেন,

“কে পাঠিয়েছেন বড়মা? আর কী লেখা আছে ওতে?”

“তোর পিসি পাঠিয়েছেন। তোর ঠাকুমা মা/রা গেছেন। তাই তোকে একবার হলেও যেতে বলেছেন দ্রুত।”

পদ্মাবতীর মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বেরিয়ে এলো,

“ভগবান ওনার আ’ত্মাকে শান্তি দিক।”

শকুন্তলা একবার আম্রপালি আরেকবার পদ্মাবতীকে দেখে বলে উঠলেন,

“সে কী! পদ্মা এই অবস্থায় কী করে যাবে ওখানে? সম্ভব নাকি এটা? উনি কি পদ্মার ব্যাপারে জানেন না? কী বুঝে যেতে বললেন?”

“তার মা মা/রা গেছেন। তিনি কি আর এতোকিছু ভেবে লিখেছেন? কিন্তু এখন কী করবো? পদ্মাকে যে যেতে বললেন।”

“যেতে হবে না এখন ওকে। পরে নাহয় সময় করে একবার যাবে। তুমি এতো ভেবো না। উনি ঠিকই বুঝতে পারবেন।”

“হুম। হয়তো ঠিকই বলেছিস তুই।”

শকুন্তলার সাথে কথা বলে আম্রপালির চিন্তা যেন কিছুটা হলেও কমলো।
.
.
.
“আজ কোনো কবিতা শোনাবেন না স্যার?”

“স্যার বলো না অর্ণব। নিজেকে কেমন যেন ইংরেজ কর্তা ইংরেজ কর্তা বলে মনে হয়। তুমি বিলেতে বড় হতে পারো। কিন্তু আমি এদেশেই জন্মেছি আর এদেশেই ম/র/বো। তুমি আমাকে নাম ধরেই ডাকবে।”

“ঠিকাছে। আপনার কোনো কবিতা শোনাবেন না রুদ্র?”

“আমার কবিতা? আমি কবি নই। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রেমিকার উদ্দেশ্যে দুটো বাক্য বলি। আর সেটাকেই তোমরা কবিতা বলে ধরে নাও।”

“সে যাই হোক। আজ বলবেন কিনা বলুন।”

“না, আজ কবিতা বলবো না। গল্প বলবো একটা। গল্প না অবশ্য। আমার প্রথমবার চুরি করার অভিজ্ঞতা। শুনবে?”

অর্ণব সামান্য হাসলেন। রুদ্র পেশায় একজন লেখক। তবে টুকটাক কবিতাও লেখেন। সেদিন এই পানশালায়ই তার সাথে পরিচয় হয়েছিল অর্ণবের। দুজনের মাঝে বেশ ভালো সখ্যতাও গড়ে উঠেছে কিছুদিনের মাঝেই। রুদ্রর সাথে কথা বললে তাদের মাঝের বয়সের দীর্ঘ তফাৎটা খুঁজে পান না অর্ণব। আর এটাই হয়তো তাদের বন্ধুত্বের সবচেয়ে বড় কারণ। অর্ণব ঠোঁটে হাসি রেখেই বললেন,

“বলুন তাহলে।”

অর্ণবের জবাব পেয়ে রুদ্রও বলতে শুরু করলেন।

“আমি তখন সবে মাত্র কলেজ পাড় করে ছুটিতে গ্রামে এসেছি। তখন আম কাঁঠালের দিন। গাছ ভরা কাঁচা পাকা মিষ্টি আম। তো আমাদের বাড়ির কয়েক বাড়ি পরেই ছিল আম বাগান। কিন্তু বাগানের মালিক একটা আমও ছুয়ে দেখতে দিত না কাউকে। আমরাও কম কিসে? সব বন্ধুবান্ধব মিলে একদিন ঠিক করেই ফেললাম ওই বাগানের আম খাবোই খাবো। তা সে চুরি করে হলেও। যেই ভাবা সেই কাজ। সেদিন সব পরিকল্পনা করে রাখলাম। পরেরদিনই সন্ধ্যে নামতে না নামতেই চলে এলাম বাগানে। গাছে আমি উঠলাম। একটার পর একটা আম নিচে ফেলেই চলেছি। এমন সময় কই থেকে যেন বাগানের মালিক চলে এলো। আমার বন্ধুরা নিচে দাঁড়িয়ে আম কুড়িয়ে বস্তায় ভরতে ব্যস্ত ছিল। মালিকের আসার শব্দ শুনে সা/লা/রা সব আমাকে রেখেই আম নিয়ে পালালো। আমার অবস্থা এমন হলো যে গাছ থেকে নামতে গেলেও ধরা পড়বো। আর না নামলেও নিচ থেকে ঠিকই গাছে দেখা যাবে আমাকে। কী করবো বুঝতে না পেরে গাছেই বসে রইলাম। গাছে থেকে তাকে আসতে দেখলাম। মালিক নয়। অন্য একটা মেয়ে। এসেই বললো,

“গাছে লুকিয়ে থেকে লাভ নেই। আমি দেখে ফেলেছি সব।”

আমিও গাছ থেকে নেমে পড়লাম। বললাম,

“এই, তুই কে? আর কী দেখেছিস?”

“তোমাকে আম চু/রি করতে দেখেছি।”

“আম কে চু/রি করেছে?”

“তুমি চু/রি করেছো।”

“এই যে বললি তুই দেখেছিস সব। এটা দেখিসনি যে ওরা আমের বস্তা নিয়ে পালালো?”

“কারা পালালো? আমি তোমাকেই দেখেছি চু/রি করতে। আর বলেও দেব মালিককে।”

“কী বলবি?”

“বলবো যে তুমি আম চু/রি করেছো।”

আমি কী করবো বুঝতে পারলাম না। শেষ পর্যন্ত কিনা আম চু/রি করতে গিয়ে ধরা পড়লাম! শেষে আবার গাছে উঠে দুটো আম পেড়ে এনে ওর দিকে বাড়িয়ে বললাম,

“এই নে ধর। কাউকে কিছু বলবি না তুই।”

ও কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলো। এরপর বললো,

“তুমি শহর থেকে এসেছো না?”

“হ্যাঁ, তো?”

“এজন্যই তো সামান্য আমটাও চু/রি করতে পারলে না।”

“এই, মা/র খেতে চাস তুই?”

“সাহস কত! আমাকে মা/র/বে! নিজে আম চু/রি করতে পারে না আবার মা/র/তে এসেছে আমাকে।”

“কী চাই তোর? আম দিচ্ছি হচ্ছে না এতে?”

“চুক্তি যখন করতেই চাও তাহলে সেটা আমিই ঠিক করবো। তুমি না।”

“আচ্ছা, তুই-ই বল। কী চাস?”

“তুমি আমাকে লিখতে পড়তে শেখাবে।”

ওর কথা শুনে একটু অবাক হলাম। তারপর বললাম,

“আমার কি খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই নাকি যে এখন তোকে লেখাপড়া শেখাবো।”

“জিজ্ঞেস করিনি। আমার দাবি রেখেছি। হয় লেখাপড়া শেখাবে নয়তো সব বলে দেব। আরও বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলবো।”

“বাচ্চা একটা মেয়ে। তার আবার তেজ কত! ঠিকাছে। পড়াবো তোকে। কিন্তু মুখ বন্ধ রাখবি।”

আমার বাবা খুব কড়া লোক ছিলেন। তার কানে একথা গেলে আমাকে আস্ত রাখতেন না। তাই মেনে নিলাম ওর কথা। এভাবেই আমাদের মাঝে একটা চুক্তি হলো। কিন্তু একটু পর যা হলো তা সত্যিই আমার ভাবনার বাইরে ছিল। কোত্থেকে যেন বাগানের মালিক এলো লাঠি নিয়ে। এসেই জিজ্ঞেস করলো,

“এই, কী করছিস তোরা এখানে?”

মেয়েটা এক মুহুর্তও না ভেবে গড়গড় করে বলে দিল,

“চো’র ধরেছি দাদু। এ তোমার বাগানের আম চু/রি করছিল। এর মধ্যেই এখান থেকে তিন বস্তা আম পা’চার করেছে নিজের বন্ধুদের নিয়ে। আমি দেখে ফেলেছি বলে আমাকেও ঘুষ দিতে চাইছিল।”

মেয়েটা এক নিঃশ্বাসে সব বলে গেল। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কী সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা! এক বস্তার অর্ধেকও আম ভরেনি আর এ বলে কি না তিন বস্তা! বাগানের মালিকের দিকে তাকাতেই দেখি সে রক্তবর্ণ দুটো চোখ নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। পালানো ছাড়া আর উপায় নেই। তাই আমিও দিলাম ভোঁ দৌঁড়।”

বলা শেষ হতেই দুজনেই হেসে উঠলেন। অর্ণব বললেন,

“আমি ভুল না হলে আপনার সকল কবিতা এই মেয়েটার উদ্দেশ্যেই লেখা।”

“তুমি ভুল নও। ঠিকই ধরেছো।”

“এই একটা দিক দিয়েই হয়তো আমরা একই। দুজনেই প্রেমে ব্যর্থ।”

“উহু। ভুল বললে। তুমি নিজের জন্য তোমার প্রেমিকাকে ছেড়েছো। আর আমি তার কথায়, তার ভালোর জন্য তাকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। আমি ব্যর্থ নই। আমি এখনো তাকে আগের মতোই ভালোবাসি। সে একবার ডাকলে তার কাছে ফিরে যেতে রাজি। আমি নিজ হাতে তাকে বিয়ের মণ্ডপ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলাম। সবকিছু ঠিকই যাচ্ছিল। ততক্ষণ পর্যন্তই যতক্ষণ না আমি বুঝতে পেরেছিলাম বিয়ের দিন তার চোখে জল নিজের জন্য নয়, বরং আমার জন্য ছিল। কিন্তু আমি বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছিলাম। এরপর আর তার বাড়ির সামনে গিয়ে তাকে এক নজর দেখার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না আমার হাতে।”

“আপনার প্রেয়সীর নাম বলবেন না কাউকে কোনোদিন?”

রুদ্র অর্ণবের পরিচয় জেনে আগেই বুঝে গিয়েছিলেন সে কে। তবে তা প্রকাশ করেননি। অর্ণবের প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন,

“বলবো আজ। শুধু তোমাকে বলবো।”

“আমাকেই কেন?”

“সেটা তুমি এমনিই বুঝে যাবে।”

“কী নাম তার?”

“আম্রপালি। আম্রকাননে খুঁজে পাওয়া এক অন্যরকম আম্রপালি।”
.
.
.
“কেমন আছিস মোহিনী?”

খুব ক্লান্ত লাগছিল মোহিনীর। সে সাথে ঘুমও পাচ্ছিলো। তাই বালিশে মুখ গুজে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ডাকটা শোনা মাত্রই যেন সব ঘুম উড়ে গেল তার। তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

“তুই!”

পদ্মাবতী এগিয়ে এসে তার হাতে থাকা জিনিসগুলো একপাশে রাখলেন। বললেন,

“আমাকে দেখে তোর চোখ ওমন ছানাবড়া হয়ে গেল কেন? ভূ’ত দেখলি যেন।”

“কেন এসেছিস এখানে?”

“ওমা! এটা আবার কেমন প্রশ্ন? কতমাস হয়ে গেছে তোকে দেখিনি। তোকে দেখতে ইচ্ছে করলো তাই এসেছি। জানিস এখানে আসার জন্য বাড়িতে কত মিথ্যে কথা বলে বেরোতে হয়েছে! অনেক কথা বানিয়ে বানিয়ে বলার পর একা আসতে পেরেছি। নয় কেউ তো আমাকে এসময় একা ছাড়তেই চাচ্ছিলো না। বাড়িতেও সবসময় আমার সাথে কেউ না কেউ থাকেই।”

নিজের পেটে হাত বোলাতে বোলাতে কথাগুলো বলছিলেন পদ্মাবতী। মোহিনীর নজর যতবার পদ্মাবতীর পেটের দিকে পড়ছে ততবারই অর্ণবের করা প্রতারণার কথা মনে পড়ছে। আর মনটা বিষিয়ে যাচ্ছে।

“এখান থেকে চলে যা পদ্মা।”

“যাবো কি রে? সবে তো এলাম। দেখ আমি তোর জন্য কতকিছু নিয়ে এসেছি। শোনপাপড়ি, হাওয়াইমিঠাই, সন্দেশ। তোর এগুলো খুব পছন্দ তাই না? সেদিন শেফালীর সাধ এর অনুষ্ঠান হলো। আমি থাকতে পারিনি। আমার বেলায়ও ও থাকতে পারেনি। তোর কথা খুব মনে পড়েছিল তখন।”

মোহিনী জবাব দিলেন না। পদ্মাবতী মন খারাপ করে বললেন,

“ঠিকাছে। তুই যদি চাস তো আমি চলে যাবো। কিন্তু তার আগে তোকে কিছু কথা বলতে চাই।”

“কী কথা?”

পদ্মাবতী মোহিনীর আরও কাছে এসে বললেন,

“তুই অর্ণবকে খুব ভালোবাসিস না? কিন্তু তোর থেকেও যে আমি বেশি ভালোবেসেছি তাকে। তাই তো নিজের করে নিতে পেরেছি। আর এখন তার সন্তানের মাও হবো আমি।”

“তো? আমি কী করবো তাতে? তুই আমার ঘরে এলি কী করে? কেউ আঁটকালো না তোকে?”

বলেই মোহিনী উচ্চস্বরে তারানাকে ডাকতে লাগলেন। পদ্মাবতী বললেন,

“আঁটকেছিল। পরিচয় দেওয়ার পর আর আঁটকায়নি।”

মোহিনী ভ্রুকুটি করে চেয়ে রইলেন। পদ্মাবতী বললেন,

“জানিস, এতোগুলো মাসে অর্ণব একবারও আমার খোঁজ নেননি।”

“আমাকে বলছিস কেন একথা?”

“কারণ তিনি এখনো তোকে ভালোবাসেন। তুই তাকে আঁটকে রেখেছিস। তোর সাথে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ করেন তাই না? লুকিয়ে দেখাও করেন নিশ্চয়ই?”

“এমন কিছুই না। তুই চলে যাচ্ছিস না কেন আমার চোখের সামনে থেকে?”

“তুই চলে যা না।”

“মানে?”

“আমাদের জীবন থেকে। চলে যা তুই।”

“আমি কোথায় যাবো?”

পদ্মাবতী মোহিনীর দু-হাত ধরে ফেললেন। প্রচন্ড অস্থির লাগছে তাকে। কিসের ভয় যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে তাকে। পদ্মাবতী মিনতির স্বরে বললেন,

“অনেক দূরে কোথায় চলে যা। যেখানে তোকে কেউ চিনবে না। তোর আসল পরিচয় জানবে না। সম্মানের সাথে বেঁচে থাকতে পারবি। তুই বল কোথায় যাবি। আমি নিজে দিয়ে আসবো তোকে। টাকা পয়সার কোনো অভাব থাকবে না তোর। সব দেব আমি।”

মোহিনী এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,

“পাগল হয়ে গেছিস তুই?”

“এখন না হলেও একদিন ঠিকই হয়ে যাবো রে। এভাবে বেশিদিন বাঁচতে পারবো না আমি।”

“এসব নাটক বন্ধ কর পদ্মা। অর্ণবের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আর রাখতেও চাই না।”

মুহূর্তের মধ্যেই চেহারা পাল্টে গেল পদ্মাবতীর। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। সেই সাথে রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,

“মিথ্যে বলছিস। তোর সাথে সম্পর্ক না থাকলে উনি এখন আমার কাছে থাকতেন। আমার খোঁজ নিতেন। তাহলে নেন না কেন?”

মোহিনী তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,

“কারণ উনি তোকে ভালোবাসেন না। একটু আগেই তো বললি যে অর্ণব এখনো আমাকে ভালোবাসেন। তাহলে তোকে কী করে ভালোবাসবেন? একসাথে কখনো দু’জনকে ভালোবাসা যায় নাকি? ইশ! তোর জন্য বড্ড কষ্ট লাগেরে পদ্মা। এতো চেষ্টা করেও অর্ণবের ভালোবাসা পেলি না। নামে মাত্র তার স্ত্রী হয়েই রইলি। অর্ণব শুধু আমাকে ভালোবেসেছেন। তুই আজ এসব কথা বলে তার প্রতি আমার বিশ্বাস আবার ফিরিয়ে দিলিরে পদ্মা। ভেবে দেখলাম। আমি এখন আর তাকে ছেড়ে কোত্থাও যাবো না।”

সারা গা যেন জ্বলে গেল পদ্মাবতীর। উঁচু স্বরে বললেন,

“শেষ পর্যন্ত নিজের অবস্থান দেখিয়েই দিলি তুই? এর চেয়ে বেশি আর কিইবা করতে পারিস। যতই হোক, সামান্য একটা বাইজী বলে কথা। অন্যের স্বামীকে নিজের মায়ার জ্বালে ফাঁসিয়ে অন্যের সংসার ভাঙা ছাড়া আর কিইবা করতে পারিস তোরা? ঘরে বউ থাকতেও পুরুষ যখন অন্য নারীকে নিয়ে আসে তখন তাকে কী বলে জানিস? র/ক্ষি/তা। তুই সারাজীবন অর্ণবের র/ক্ষি/তা হয়েই থাকবি। বউ হতে পারবি না কোনোদিন। তোর তো বাপ-মায়েরও কোনো হদিস নেই। কে জানে তোর মা কী করেছিল। কার সংসার নষ্ট করেছিল যে তোর বাবাও তোকে কোনোদিন খুঁজতে এলো না। তোর মতো মেয়ের সাথে যে আমার এতো বছরের বন্ধুত্ব ছিল এটা ভাবতেও এখন ঘেন্না লাগছে আমার। গা গুলিয়ে উঠছে।”

বলেই পেছন ঘুরে হাঁটা দিলেন পদ্মাবতী। এসব কী বলে গেলেন তিনি! একদম সহ্য করতে পারলেন না মোহিনী। দৌঁড়ে বাইরে এলেন পদ্মাবতীর পেছন পেছন। সিড়ির কাছে আসতেই এক ধাক্কায় পদ্মাবতীকে ফেলে দিলেন। পদ্মাবতীর দেহটা সিড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়লো। নিচে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি। মোহিনী নিজের কান্ডে নিজেই হতভম্ব হয়ে গেলেন। মাথায় হাত দিয়ে সিড়ি ধরে সেখানেই ধপ করে বসে পড়লেন তিনি। সবার আগেই ছুটে এলেন তারানা। মোহিনীকে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে আর পদ্মাবতীকে নিচে পড়ে থাকতে দেখে সবকিছু বুঝতে এক মুহুর্তও লাগলো না তার। মোহিনীর উদ্দেশ্যে বললেন উঠলেন,

“এটা তুই কী করলি মেহের?”

আরও কিছু মেয়ে আসতেই সকলে মিলে পদ্মাবতীকে ধরাধরি করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে নিয়ে গেলেন। চরণকে পাঠালেন অর্ণবদের বাড়িতে খবর পাঠাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চরণ এসে এ-বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়ালেন। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন,

“ও বিবিজি, আপকি বহু সিড়িওছে নিচে গির গায়্যি হ্যে। আম্মাজিনে উসকো আসপাতাল লেকার গায়্যি হ্যে।”

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৪৮
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

বেশ চিন্তিত চেহারা নিয়ে মোহিনীকে ডাকলেন তারানা।

“মেহের।”

ছোলার ডাল দিয়ে গরম গরম কচুরি মুখে পুরে মোহিনী বললেন,

“হুম।”

“এর মাঝে অর্ণবের সাথে দেখা হয়েছে তোর?”

“কেন বলো তো?”

“এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম। ও তো ফিরেছে গ্রামে। দেখা করলো না যে?”

“তুমি কি আজকাল নে/শা টেশা করছো নাকি তারামা? উনি আমার সাথে কেন দেখা করতে যাবেন? এতোকিছুর পরও? এসব উল্টাপাল্টা কথাবার্তা না বলে ঠিক করে বলো তো তুমি কী বলার চেষ্টা করছো?”

“আমি আবার কী বলার চেষ্টা করবো? যা বলছি তাই-ই তো।”

“তোমার কথাবার্তা যেন কেমন অদ্ভুত লাগছে।”

“আমার মনে হয় না সেদিনের ব্যাপারে ও-বাড়িতে কেউ কিছু জানে।”

“পদ্মা এখনো চুপ থাকবে ভেবেছো?”

“ও যদি চুপ নাই থাকতো তো তুই এখন এখানে থাকতিস না। জে/লে থাকতে হতো।”

“ওহ। তুমি তাহলে এই নিয়ে চিন্তায় আছো? এতো চিন্তা করো না। কিছু হলে এতোদিনে হয়ে যেত।”

“চিন্তা করবো না মানে? তোর জন্য আমার কতটা চিন্তা হয় তা যদি বুঝতিস। আমি বুঝি না তুই এতো নিশ্চিন্তে কীভাবে আছিস।”

“ওর কিছু হলে নাহয় চিন্তা হতো। কিন্তু কোনো ক্ষতি তো হয়নি তেমন। আর তুমি থাকতে আমার কে কী করতে পারবে তারামা? এখন আরেকটা কচুরি দাও তো।”

তারানা মোহিনীর থালায় আরেকটা কচুরি দিতে দিতে বললেন,

“পদ্মাবতীর নাকি ফুটফুটে একটা ছেলে হয়েছে। অর্ণবও চলে এলো খবর পেয়ে। এবার মনে হয় ওদের সম্পর্কটা ঠিক হয়েই যাবে।”

“সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাবে এটা কী করে বলছো?”

“কেন?”

“অর্ণব পদ্মার জন্য নয়, নিজের ছেলের জন্য ফিরেছেন।”

“সে যাই হোক।”

“তারামা, ও এতো উঁচু থেকে পড়ার পরও ম/র/লো না কেন বলো তো?”

“তোর মুখে যতসব অলক্ষুণে কথা। ওর কিছু হলে তুইও এখানে শান্তিতে থাকতে পারতি না। জেলে পঁচে ম/র/তে হতো।”

মোহিনী তাচ্ছিল্যপূর্ণ হেসে বললেন,

“তাও শান্তি পেতাম।”

মোহিনীর কথায় তারানা চুপ করে রইলেন। মোহিনী বললেন,

“তারামা, আমি বলছিলাম কী, আমি ও-বাড়িতে একবার যাবো। পদ্মার ছেলেকে দেখতে।”

“কী! তুই যাবি ও-বাড়িতে।”

“হুম। দেখবো ওর ছেলে দেখতে কেমন হয়েছে। অর্ণবের মতো হয়েছে নিশ্চয়ই।”

“আজই যাবি?”

“উঁহু। ওর ছেলের নামকরণের অনুষ্ঠানে।”

“কিন্তু….।”

তারানা কিছু বলতে গিয়েও আবার থেমে গেলেন। মোহিনী বললেন,

“কী হলো? থেমে গেলে কেন? কী বলতে চাইছিলে বলো।”

“কিন্তু নামকরণের অনুষ্ঠান তো আজ দুপুরেই। তাই-ই তো জানি।”

মোহিনী খাওয়া থামিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,

“ঠিকাছে। আজই যাবো তাহলে। আমার মায়ের সব জিনিসপত্র কোথায় আছে তারামা?”

“আমার ঘরে। কেন?”

“লাগবে কিছু।”

মোহিনী উঠে হাত ধুয়ে নিলেন। এরপর তারানার ঘরে এসে খাটের নিচ থেকে একটা ট্রাংক বের করলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যেন পছন্দ মতো কিছু একটা পেলেন তিনি। ছোট্ট একটা বাক্সে একটা গলার চেইন। মোহিনী আর ওটা বের করলেন না। বাক্স বন্ধ করে ওভাবেই নিয়ে গেলেন। নিজের ঘরে এসে আলমারি থেকে আরও একটা জিনিস নিলেন। মোহিনীর এমন কাজে তারানা মোটেও সন্তুষ্ট নন। সেদিন মোহিনী কিছুক্ষণের জন্য ঘাবড়ে গেলেও তারপর থেকেই আবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলেন। তার ভয় যেন একদম কেটে গিয়েছে। কিন্তু এতোদিন পর এখনো তারানা নিজের ভয় কাটাতে পারেননি। তার চিন্তা যেন আরও বেড়েই চলেছে। যতই হোক, মোহিনীকে তিনি নিজের মেয়ে বলেই মনে করেন। তা নাহলে এতো ছাড় তিনি কাউকেই দেননি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সেই মেয়েকেই তার হারাতে হবে। মনের মধ্যে ভয়গুলো আরও বেশি করে গেঁথে যাচ্ছে। তবে প্রার্থনা করা ছাড়া এখন আর উপায়ই বা কী তার!
.
.
বাড়িতে আসা সব লোকজন চলে যাওয়ার পর মোহিনী ভেতরে প্রবেশ করলেন। আজ এ-বাড়িতে প্রবেশ করতে কেউ তাকে আটকায়নি। কেউ দেখেনি এমন নয়। দেখেছে, তবুও আটকায়নি। আটকানোর কোনো প্রয়োজন মনে হয়নি। মোহিনীকে সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখেই উপস্থিত সকলেই একদম স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। পদ্মাবতী নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন। মোহিনী অন্যকারও দিকে খেয়াল না করে সোজা পদ্মাবতীর কাছে চলে গেলেন। তার কোলের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“ঠিক বলেছিলাম আমি। একদম বাবার মতোই হয়েছে। আমি কোলে নিতে পারবো ওকে? নাকি আমার কোলে দিতে আপত্তি আছে?”

পদ্মাবতী আম্রপালির দিকে তাকালেন। আম্রপালি ইশারায় সম্মতি দিলে পদ্মাবতী বাচ্চাটাকে মোহিনীর কোলে দিলেন। কোলে নিয়ে বাচ্চাটাকে খুব আদর করলেন মোহিনী। জিজ্ঞেস করলেন,

“কী নাম রাখলি ওর?”

পদ্মাবতী জবাব দিলেন না। পাশে থেকে শেফালী আস্তে করে বললেন,

“অরণ্য।”

“ভালো তো। শেফালী, ওকে এটা পরিয়ে দে।”

বলেই শেফালীর হাতে ছোট্ট একটা বাক্স দিলেন মোহিনী। বললেন,

“ওর জন্য ছোট্ট একটা উপহার এনেছি। আমি নিজেও এটা ছুঁইনি। তাই এতে কোনো নর্তকীর স্পর্শও নেই। আশা করি ওকে এটা পরাতে কারও আপত্তি থাকবে না।”

শেফালী চেইনটা বাচ্চাটার গলায় পরিয়ে দিলেন। মোহিনী বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে আবার পদ্মাবতীর কাছে দিয়ে দিলেন। তার উপস্থিতিটা এখানে কেউ-ই যে পছন্দ করছেন না তা বেশ বুঝতে পারছেন তিনি। তার নিজেরও এখানে থাকতে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। তাই দ্রুত ফিরে যাওয়াটাই নিজের জন্য ভালো মনে করলেন। কিন্তু যাওয়ার আগে মোহিনীর চোখজোড়া অন্য কাউকে খুঁজতে লাগলো। কোণায় অর্ণবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন তিনি। এগিয়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালেন। শকুন্তলা কিছু বলতে যাবেন কিন্তু শুধু শুধু কথা বাড়বে বলে আম্রপালি তাকে থামিয়ে দিলেন। মোহিনী কিছুটা তাচ্ছিল্য করে অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“কেমন আছেন অর্ণব?”

মোহিনীকে দেখে অর্ণবের ভাবের কোনো পরিবর্তন হলো না। তিনি নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলেন,

“ভালো। আপনি?”

“যেমনটা ছেড়ে গিয়েছিলেন। শুধু একটা জিনিস পরিবর্তন হয়েছে আমার জীবনে। আবারও নাচতে শুরু করেছি।”

অর্ণব কোনো জবাব দিলেন না। মোহিনী আবার বললেন,

“আপনাকে আবার এভাবে দেখবো ভাবিনি। সে যাই হোক, আপনার পরিবারের একটা জিনিস আমার কাছে রয়ে গেছে। সেটাও ফিরিয়ে দিতে এসেছি।”

“কোন জিনিস?”

অর্ণবের হাতে বালাটা দিয়ে মোহিনী বললেন,

“এটা।”

“ওহ।”

“কাল সন্ধ্যায় আমাদের জলসায় আপনার আমন্ত্রণ রইলো।”

আর কিছু বললেন না মোহিনী। শোনারও অপেক্ষা করলেন না। চলে গেলেন। তার যাওয়ার পর সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। গোটা পরিবারের কাছে তিনি একটা আতংক ছাড়া যেন কিছুই নন। শান্তি দেবী অর্ণবের সামনে এসে বললেন,

“বালাটা তো আমি তোর বউকে দিতে বলেছিলাম। তুই মোহিনীকে দিয়েছিলি কেন?”

শান্তি দেবী মাঝেমাঝে যেমন সব ভুলে যান আবার তেমনই মাঝেমাঝে তার সবকিছু কীভাবে মনে থাকে এটা ভেবে পাননা অর্ণব। তবে তিনি যে রেগে যাননি তা কথা শুনে বুঝতে পারছেন। কিন্তু তার প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারলেন না অর্ণব।
.
.
.
বিছানায় শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করছেন পদ্মাবতী। কিছুতেই ঘুম আসছে না। মোহিনী চলে যেতে যেতেও তাকে কী একটা দুশ্চিন্তায় ফেলে গেলেন। অর্ণবকে কাল সন্ধ্যার জলসায় আমন্ত্রণ জানালেন। অর্ণব কি সত্যিই যাবেন সেখানে? না, অর্ণব যাবেন না। অর্ণব যে সেখানে আর যেতে পারেন না এব্যাপারে নিশ্চিত পদ্মাবতী। এই কয়দিনে তিনি খুব ভালোভাবেই বুঝে গেছেন মোহিনী নামক দুশ্চিন্তাটা তার জীবন থেকে চিরদিনের মতো চলে গেছে। এখন তার আর অর্ণবের সম্পর্কটা আর বাকি পাঁচটা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতোই ভালোবাসায় ভরপুর। অর্ণব এখন আর মোহিনীকে ভালোবাসেন না। শুধু তাকেই ভালোবাসেন। অনেক চেষ্টার পর এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে নিতে পেরেছেন পদ্মাবতী। এসব ভাবতেই তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। খাটের পাশেই দোলনাটায় নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে অরণ্য। ওই ভালো। আশেপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেসবে ওর কিচ্ছু যায় আসে না। ওরই এখন যত সুখের দিন। ঘরে হ্যারিকেন এর টিমটিম আলো জ্বলছে। বারান্দার দরজা দিয়ে হুহু করে শরীর হিম করা শীতল হাওয়া আসছে। যা গরম পড়েছে! হাতপাখায় আর কুলোয় না। এখন এই হাওয়াটাই ভরসা। পদ্মাবতী উঠে বারান্দায় এলেন। অর্ণব একটা সিগার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। পদ্মাবতী পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। তার পিঠে মাথা রেখে চোখ বুজে রইলেন। বাইরে প্রচন্ড জোরে বাতাস বইছে। সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। এরমধ্যে বিদ্যুৎ চমকে প্রথম বাজটা পড়লো। অর্ণব সিগার শেষ করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরের ভেতরে চলে এলেন। পদ্মাবতীর মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। একটু পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই সাথে চারপাশের পরিবেশটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠছে। পদ্মাবতী দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখতে দেখতে ভাবতে লাগলেন,

“আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চারজন। বড়মা, অর্ণব, আমার সন্তান আর মোহিনী। মোহিনী, যাকে আমি ভালোওবাসি আবার ঘৃণাও করি। যার সাথে বন্ধুত্বের মতো একটা পবিত্র সম্পর্ক আমি নিজের হাতে নষ্ট করেছি। যার ভালোবাসার পরিবর্তে আমি তাকে দিয়েছিলাম বিশ্বাসঘাতকতা। পৃথিবীতে যার কাছে আমি সারাটা জীবন দোষী হয়ে থাকবো। কিন্তু আমাকে তো না চাইতেও এসব করতে হয়েছে। নিজের স্বার্থের জন্য। কারণ আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণাও তাকেই করি। আর ঘৃণার পরিমাণটা হয়তো ভালোবাসার চেয়ে বেশিই ছিল। তাইতো কত ক্ষতি করার চেষ্টা করেছি আমি ওর। মে/রেও ফেলতে চেয়েছি। আবার নিজেই নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়েছি। কিন্তু আমার কর্মের শাস্তি যে আমাকে এভাবে পেতে হবে তা কোনোদিন ভাবতেও পারিনি। অন্যের ক্ষতি করতে গিয়ে আমি নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে ফেলেছি। যা আর কোনোদিন পূরণ হবার নয়। কোনোদিনও নয়। আমার সাথে যা যা হয়েছে তার জন্য আমি কোনোদিনও মোহিনীকে দ্বায়ী করবো না। এসবের জন্য দ্বায়ী আমি নিজেই। আমার সন্তান…”

আর ভাবতে পারলেন না পদ্মাবতী। তার আগেই ভেতর থেকে অর্ণবের ডাক এলো।

“ভেতরে এসো পদ্মাবতী। অরণ্য ঘুমের মধ্যে ভয় পাচ্ছে।”

ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো তার। ভেতরে এসে বারান্দার দরজা লাগিয়ে অরণ্যর কাছে এলেন। বাজ পড়ার শব্দে ঘুমের মধ্যেই কেঁপে কেঁপে উঠছে বেচারা। অর্ণব ইতোমধ্যেই উল্টো দিকে ঘুরে শুয়ে পড়েছেন। পদ্মাবতী সাবধানে অরণ্যকে কোলে তুলে নিলেন। বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকালেই তার সমস্ত দুশ্চিন্তা, হতাশা দূর হয়ে যায়। তার ভাগ্য থেকে দুঃখ দুরাশা দূর করতেই যে বাচ্চাটা এসেছে এটা বেশ ভালোই বুঝতে পারেন তিনি। অর্ণবের পাশে বাচ্চাটাকে বুকে নিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন পদ্মাবতী।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে