#মেহেরজান
#পর্ব-৪৫
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
★শমিতের সাথে কথা বলে মুঠোফোনটা রাখতেই পেছন থেকে আম্রপালি বললেন,
“পালাতে চাইছিস অর্ণব?”
আম্রপালির এখানে আসাটা টের পাননি অর্ণব। মনে হয় কিছুক্ষণ আগেই এসেছেন। শেষের কথাগুলো শুনেছেন নিশ্চয়ই। অর্ণব তার দিকে ঘুরে বললেন,
“মা!”
“সত্যের থেকে দূরে পালিয়ে গেলেই বুঝি সেটা মিথ্যে হয়ে যাবে? আর কাদের থেকে পালাতে চাইছিস? এরা সবাই তোরই আপনজন। দিনশেষে তোকে এখানেই ফিরে আসতে হবে।”
“আমি এসব চাই না মা। আপনারা জোর করে আমার ওপর একটা বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন। যেটা নিয়া চলা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।”
“তুই ভাবছিস তাই বোঝা মনে হচ্ছে। কখনো এই বিয়েটা সহজভাবে নিয়েছিস? মেনে নিয়ে দেখেছিস?”
“মানতে চাইও না। আপনারাও জানেন আর আমিও জানি মেহের আমার জন্য কী। ওকে ছাড়া আমার জীবন মূল্যহীন।”
আম্রপালি তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বললেন,
“এখনো মোহিনীর কথাই ভাবছিস? আমাকে একটা কথা বল তো অর্ণব। মোহিনীর সামনে তুই কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবি? ওর ভালোবাসার যে অমর্যাদাটা তুই করেছিস তারপরও ও তোকে মেনে নেবে?”
“মেনে নেবেন। সব মেনে নেবেন। আমি ক্ষমা চাইবো তার কাছে। তিনি আমাকে ফেরাতে পারবেন না মা।”
“ভুল ভাবছিস তুই। মিথ্যা বলে নিজের মনকে শান্তনা দিচ্ছিস মাত্র। ও তোকে কোনোদিন মানবে না। তুই এখনো ওকে চিনতে পারিসনি। আমি বড় করেছি ওকে। আমি জানি ও এসব মেনে নেবে না। ওর সাথে প্রতারণা করেছিস তুই। বারবার তোকে ক্ষমা করে, তোর প্রতি নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করে নিজের আত্মমর্যাদায় কখনোই আঘাত হানতে দেবে না ও।”
বিছানায় ধপ করে বসে পড়লেন অর্ণব। আম্রপালি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“অর্ণব, আমি তোর মা। তোর ভালো চাই সবসময়। বিয়েটা তুই যেমন নিজের অমতে গিয়ে আমার কথায় করেছিলি তেমন এবারও আরেকটা কাজ করবি?”
“কী?”
ছোট্ট একটা শব্দেও আম্রপালি বুঝতে পারলেন অর্ণব মাথা নিচু করে নিঃশব্দে কাঁদছেন। আম্রপালি তার মুখ দু’হাতে উঁচু করে ধরলেন। আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন,
“আমার সামনে কাঁদতে লজ্জা কীসের? নাকি ছেলে বলে লজ্জা পাচ্ছিস? ছেলেদের যে কাঁদতে নেই, এটা ভুল। আর মায়ের কাছে তার ছেলে-মেয়ে দুজনেই তার সন্তান। মায়ের কাছে মন খুলে কাঁদা যায়। তুইও আজ ইচ্ছেমতো কেঁদে নে। তাহলে বাকিটা জীবন অন্তত হাসিখুশি থাকবি।”
“কেন?”
“তোর আজ যত কষ্টই হোক অর্ণব, আমার আর মাত্র একটা কথা রাখ। মোহিনীকে ছেড়ে দে। ভুলে যা ওকে। তোর সামনে এখন দুটো দরজা আছে। এক দরজায় মোহিনী আর আরেক দরজায় পদ্মাবতী আর তোর সন্তান দাঁড়িয়ে। মোহিনীর দরজাটা ক্ষণিকের জন্য খোলা আর যে দরজায় পদ্মাবতী, সেটা চিরকাল খোলা থাকবে তোর জন্য। এবার বল, কার কাছে যাবি তুই?”
অর্ণব জবার দিলেন না। আম্রপালিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। আম্রপালি আবার বললেন,
“পদ্মাবতী আর মোহিনী, দু’জনকেই আমি বড় করেছি অর্ণব। একজন গড়তে ভালোবাসে তো আরেকজন ধ্বংস করতে। মোহিনী তোকে ধ্বংস করে দেবে। আর পদ্মাবতী সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে তোকে আবার গড়তে পারবে। তুই ওর সাথে খুব ভালো থাকবি।”
অর্ণব পাঞ্জাবীর হাতায় চোখ মুছে আম্রপালির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমি পারবো না মা। আমি পারবো না। মেহেরকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। পদ্মাবতীকে আমি আমার জীবনে জায়গা দিতে পারবো না। তবে হ্যাঁ, একটা কাজ করবো।”
“কী?”
“মেহেরকে ছেড়ে দেব। ঠিক বলেছেন আপনি। কোন মুখে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো? আর কোনোদিন তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো না আমি। ছোটবেলা থেকেই নিজেকে খুব সাহসী দাবি করে এসেছি কিন্তু তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে কিছু বলার সাহস আর আমার মাঝে নেই। আর কোনোদিন আমার মুখ দেখাবো না তাকে।”★
ছেলের জীবন নিজ হাতে সুন্দর করে গড়ে দেবেন বলে ঠিক করেছেন আম্রপালি। তাতে ছলনার আশ্রয় নিতে হলে তা-ই সই। মোহিনীর জীবনে যে অর্ণবের জন্য আর কোনো জায়গা নেই, এটা সত্যি হোক আর মিথ্যে, তা অর্ণবকে বিশ্বাস করাতে পেরেছেন তিনি। অর্ণবকে আর কোনোকিছু নিয়ে জোর করেননি সেদিন। চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সকালে হাসিমুখে বিদায় দিয়েছিলেন ছেলেকে। পানশালায় বসে পুরনো সেসব কথাই ভাবছিলেন অর্ণব। অভ্রবাবুর ডাকে স্মৃতিচারণে ব্যাঘাত ঘটলো তার। অভ্রবাবু জড়িয়ে আসা কণ্ঠে বললেন,
“শুনতে পাচ্ছো অর্ণব?”
“হু?”
“শুনতে পাচ্ছো আমি কী বলছি?”
অর্ণব নির্লিপ্তভাবে চেয়ে রইলেন। নেশা ধরে গেছে তার। অভ্রবাবু এতোক্ষণ কী বলেছেন তার কোনো কথাই কর্ণকুহর হয়নি অর্ণবের। অভ্রবাবু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“নিজেকে আয়নায় ভালো করে দেখেছো একবার? কী অবস্থা হয়েছে তোমার?”
অর্ণব ঘোরগ্রস্তের মতো জবাব দিলেন,
“হুম। মাথায় লম্বা চুল, বহুদিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর রাতে না ঘুমিয়ে থেকে থেকে চোখের নিচে কালি পড়ে যাওয়া সবসময় ঘুমাচ্ছন্ন থাকা রক্তবর্ণ দুটো চোখ। দেখেছি আমি নিজেকে।”
“তোমার মা তোমাকে এভাবে দেখলে খুশি হবেন না। তিনি তোমাকে এখানে আমার ভরসায় পাঠিয়েছেন। আমি চাই না তুমি এভাবে কষ্ট পাও।”
“আমি নিজের খেয়াল রাখতে জানি কাকু।”
“এতোমাস হয়ে গেল তুমি এখানেই আছো। তোমার একটু হাওয়াবদল প্রয়োজন। তুমি কিছুদিনের জন্য কুঞ্জনগরে ফিরে যাও অর্ণব। ঘুরেবেড়িয়ে এসো। তাছাড়াও তোমার স্ত্রী এখন সন্তানসম্ভবা। যেকোনো দিন তুমি বাবা হতে পারো। এখন ওর প্রয়োজন তোমাকে।”
“বাবা!”
“বাবা হওয়াটা মুখের কথা নয় অর্ণব। তোমার জীবন সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দিতে পারে এই একটা শব্দ। তুমি এখন শুধু নিজের কথা ভাবছো। তুমি কিসে ভালো থাকবে সেটা ভাবছো। কিন্তু বাবা হওয়ার পর তোমাকে দেখতে হবে তোমার সন্তান কিসে ভালো থাকে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে তোমাকে সব কষ্ট সহ্য করতে হবে। নিজের কথা ভুলে তার ভালোর জন্য ভাবতে হবে।”
অর্ণব সামান্য হাসলেন। অভ্রবাবু বললেন,
“হাসছো? আমি তোমাকে এ-বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি বলে হাসি পাচ্ছে নিশ্চয়ই তোমার। আমি পারিনি অর্ণব। আমি একজন ভালো পিতা হতে পারিনি। কিন্তু আমি জানি তুমি পারবে।”
“বাবা হব আমি? একজন ভালো বাবা।”
“আমার মতো ভুল তুমি করো না অর্ণব। নিজের স্ত্রী, সন্তান নিয়ে সুখী থাকো। বিয়ের পরও অন্য নারীর সাথে সম্পর্ক রাখাটা কখনো ভালো কিছু বয়ে আনে না। কিন্তু এই সন্তান তোমার জীবনে নিশ্চয়ই ভালো কিছু নিয়ে আসবে।”
শেষের কথাগুলো খুব ভালোভাবে অর্ণবের মাথায় গেঁথে গেল। আশেপাশের লোকগুলো তাদের দুজনের সম্পর্ক জেনে প্রায়ই তাদের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। এজায়গায় মানুষ সচরাচর নিজের পরিবারের সাথে এসে একসাথে বসে মদ খায় না। গুরুজনদের সাথে তো একদমই নয়। বরং লুকিয়েই আসে। অভ্রবাবু এটা বুঝতে পেরে অর্ণবের পাশ থেকে উঠে কিছুটা দূরে গিয়ে বসলেন। অর্ণব এখনো অভ্রবাবুর বলা কথাগুলো ভাবছেন। বিড়বিড় করে বললেন,
“যে সন্তান জন্মাবার পূর্বেই আমাদের বিচ্ছেদ ঘটালো, সে সন্তান আর কী ভালো নিয়ে আসবে আমার জীবনে। আমি এখনো ভাবতে পারি না মেহের, যে আপনি আর আমার নেই। অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছি আপনাকে আমি। প্রায় আট মাস হতে চললো আপনাকে আমি দেখিনা মেহের। তবুও প্রতিটা মুহুর্ত আমার চোখের সামনে আপনার চেহারা ভাসে। দিনে যতবার শ্বাস নিয়েছি, তার থেকেও অধিকবার আপনার কথা ভেবেছি আমি। আমার প্রতিটা শ্বাস-প্রশ্বাসে আপনার নাম লেখা আছে মেহেরজান।”
বিড়বিড় করতে করতে অর্ণব তার একটু দূরেই একটা লোককে বসে থাকতে দেখলেন। বয়স পঞ্চাশের কোঠায় হবে। অর্ণব চেনেন না তাকে। কথা হয়নি কখনো। কিন্তু যতবার এখানে এসেছেন ততবারই ওই লোকটাকে দেখেছেন। হয়তো প্রতিদিনই আসেন এখানে। প্রতিবার নতুন নতুন মুখের সাথে এই একটা পুরনো মুখ দেখতে পান অর্ণব। তাই সহজে নজরেও এসে গেছে। অর্ণব গ্লাসে থাকা মদটুকু এক নিঃশ্বাসে গিলে উঠে তার পাশে গিয়ে বসলেন।
.
.
.
আয়নার সামনে বসে কান থেকে ঝুমকো দুটো খুলে পাশে রাখলেন মোহিনী। চুড়িগুলো খুলতেই হাত ফসকে সব নিচে ছড়িয়ে পড়লো। মোহিনীর চেহারায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠলো। ঊর্মিলাকে ডেকে বললেন,
“চিরুনীটা আমার হাতে দিয়ে চুড়িগুলো ওঠাতো ঊর্মিলা।”
ঊর্মিলা যথারীতি চিরুনীটা মোহিনীর হাতে দিয়ে চুড়িগুলো খুঁজতে লাগলেন। কাজ করতে করতে বললেন,
“আজ মনে হলো পদ্মাবতীকে দেখলাম ছাদে উঠেছে।”
মোহিনী চুল আঁচড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ চুলে টান লাগতেই “আহ্” করে উঠলেন। এরপর বললেন,
“কীভাবে দেখলি? এখান থেকে ওতো ভালো করে মুখ বোঝা যায় নাকি?”
“দুপুরে লুকিয়ে লুকিয়ে আম্মার দূরবীক্ষণটা নিয়ে ছাদে উঠেছিলাম। আর মুখ দেখেও তো চিনতাম না। ওকে আগে কখনো দেখেছি নাকি আমি।”
মোহিনী সামান্য হাসলেন।
“তাহলে বুঝলি কী করে ওটা পদ্মাবতী?”
“পেট দেখে।”
মুহুর্তেই মোহিনী কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন। চিরুনীটা সামনে রেখে বললেন,
“তা ওর শ্বাশুড়ি ওকে এই অবস্থায় ছাদে উঠতে দিলেন?”
“সে আমি জানি না।”
ঊর্মিলা সবগুলো চুড়ি উঠিয়ে রেখে দিয়ে বললেন,
“মোহিনী।”
“হুম।”
“তোর অর্ণবদার কথা মনে পড়ে না?”
“কার কথা?”
“অর্ণবদা।”
“অর্ণব চৌধুরী আবার তোর দাদা হলো কবে থেকে?”
“ঠিকাছে। এবার বল। অর্ণব চৌধুরীর কথা কখনো মনে পড়ে না তোর?”
“না, মনে পড়ে না। তার কথা আমার কেন মনে পড়তে যাবে? মনে রাখার মতো কোনো মানুষ সে?”
“কিন্তু তুই তো ভালোবাসিস তাকে।”
“ভালোবাসতাম। কিন্তু সে প্রতারণা করেছে আমার সাথে। তাই আমিও ভুলে গেছি তাকে।”
“সত্যিই ভুলে গেছিস?”
“ভুলে না যাওয়ার কী আছে? আর আমাদের জীবনে একাধিকবার প্রেম আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। একটা গেছে তো আরেকটা আসবে।”
“অন্যকারও জন্য না হলেও তোর জন্য অবশ্যই অস্বাভাবিক।”
“তুই এখন বের হ তো আমার ঘর থেকে। খুব ক্লান্ত লাগছে। আমি এখন ঘুমাবো।”
বলেই ঊর্মিলাকে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন মোহিনী। আলমারি থেকে খুব গোপনে রেখে দেওয়া একটা বাক্স বের করলেন। বাক্সে অসংখ্য না পাঠানো চিঠি, অর্ণবের দেওয়া নুপুর আর বালাটা রয়েছে।। সেগুলো পাশে রেখে মোহিনী আরেকটা চিঠি লিখতে বসে গেলেন।
“কেমন আছেন অর্ণব? সবাইকে মিথ্যে বললেও সত্যি এটাই যে আপনার কথা আমার সবসময় মনে পড়ে। কতমাস হয়ে গেল আপনাকে দেখি না। আপনাকে দেখতে যে বড্ড ইচ্ছে করে। কিন্তু তার সব রাস্তাই যে আপনি বন্ধ করে গেছেন। আমাকে একা ফেলে চলে গেছেন। জানেন অর্ণব, আপনাকে আমি যতটা না ভালোবাসতাম, তার থেকেও অধিক ঘৃণা করি এখন। আপনার কথা মনে পড়লে এখন আর ভালোবাসা নামক শব্দটা মাথায় আসে না। শুধু একটা শব্দই মনে পড়ে। সেটা হলো ‘প্রতারক’।”
চিঠিটা লেখা শেষ করে বাক্সে রেখে আবার তা আলমারিতে তুলে রাখলেন মোহিনী। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বুজে বললেন,
“ঈশ্বরের কাছে আমার একটাই প্রার্থনা। ওদের সর্বনাশ।”
চলবে…
#মেহেরজান
#পর্ব-৪৬
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
গায়ে একটা ধবধবে সাদা শাড়ি জড়িয়েছেন মোহিনী। নিজের ঘরে বসে পায়ে আলতা দিচ্ছেন। আলতা লাগানো শেষ হতেই ঘুঙুর দুটো দু’পায়ে বেঁধে দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। চুপি চুপি ছাদে উঠে এলেন। আকাশে মস্ত বড়ো একটা চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমার আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। মোহিনী পুরো ছাদে হাঁটাহাঁটি শুরু করলেন। তার খোলা চুলগুলো বাতাসে সুতো কাটা ঘুড়ির মতো উড়ছে। ইশ! আজ যদি পূর্ণিমা না হয়ে অমাবস্যা হতো, তাহলে পরিবেশটা আরও বেশি ভয়ংকর লাগতো। রাতবিরেতে এমন দৃশ্য দেখলে যে-কেউ ভয় পাবে। মোহিনীও তাই চায়। কিছুক্ষণের মধ্যে হলোও তাই। একটা চিৎকার কানে আসলো। মোহিনী ওদিকে তাকাতেই কাউকে ছুটে চলে যেতে দেখলেন। খিলখিল করে হেসে ফেললেন তিনি। নিচে চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। মোহিনী ছাদের দরজার কাছে এসে কান পেতে শুনতে পেলেন,
“আমি বলেছিলেন এ-বাড়িতে ভূ’ত ঢুকেছে। কেউ বিশ্বাস করোনি আমার কথা। আজ নিজের চোখে দেখেছি। এতোদিন তো শুধু ঘুঙুর আর লাফালাফির আওয়াজ শুনেছি। আজকে নাচতেও দেখে এলাম। ও-মাগো, ও কি আমাকে দেখে ফেলেছে? আমাকে কি মে/রে ফেলবে এখন? আমার এখন কী হবে?”
“চুপ কর তো। আমাকে দেখতে দে।”
মুখ চেপে হাসি আঁটকানোর চেষ্টা করলেন মোহিনী। অন্যান্য মেয়েদের সাথে তারানার আওয়াজও শুনতে পেলেন। না, আর থাকা যাবে না এখানে। বেশিক্ষণ থাকলে ধরা পড়ে যেতে হবে। মোহিনী চলে যেতে উদ্যত হতেই দূরের বাড়িটার দিকে চোখ আঁটকে গেল তার। আলোকসজ্জায় সজ্জিত বাড়িটা। অজান্তেই মোহিনীর পা দুটো তাকে ছাদের কিনারায় নিয়ে এলো। না চাইতেও মোহিনী ভাবনায় ডুবে গেলেন। কিসের এতো আলো ও-বাড়িতে? আজ হঠাৎ আবার ও-বাড়ির সব খবর জানতে ইচ্ছে করলো মোহিনীর। ইশ! পূর্বাটা থাকলে ভালো হতো। কী হচ্ছে ওখানে সব জানা যেত। কিন্তু মেয়েটাও অর্ণব চলে যাওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় কাজ ছেড়ে দিল। এতোদিন অবশ্য ওখানকার কোনো খবরাখবর জানারও প্রয়োজনবোধ করেননি মোহিনী। কিন্তু এখন কী করে জানবেন? এক কানে ব্যথা অনুভব করলেন তিনি। কেউ তার কান মুচড়ে ধরেছে। “আহ” শব্দ করে পেছনে ফিরতেই দেখলেন তারানা দাঁড়িয়ে আছেন।
“তারামা, ছাড়ো। ব্যথা লাগছে।”
“লাগুক। এসবের পেছনে তাহলে তুই ছিলি? আগেই বুঝে যাওয়া উচিত ছিল আমার।”
তারানা মোহিনীর কান ছেড়ে দিলেন। মোহিনী আবার সেদিকে ঘুরে তারানার উদ্দেশ্যে বললেন,
“ও-বাড়িতে এতো রাত পর্যন্ত আবার কিসের অনুষ্ঠান হচ্ছে তারামা? জানো কিছু?”
“জানি না। আর ও-বাড়িতে কী হয় না হয় তা জেনে তোর কী?”
“আমাকে কষ্ট দিয়ে ওরা কীভাবে এতো ভালো আছে? এতো আনন্দ কীভাবে করে ওরা? আমার যে সহ্য হয় না।”
“তাহলে শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে নিজের জ্বালা বাড়াচ্ছিস কেন? নিচে চল। ওদের বলতে হবে ওরা এতোদিন কোন ভূ’তকে ভয় পেত। না, ভূ’ত নয়, পে’ত্নী। পে’ত্নী ধরেছি আজ। চল আমার সাথে।”
মোহিনীকে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেলেন তারানা। কিন্তু মোহিনীর মনে এখনো একই চিন্তা চলছে।
.
.
.
সকাল সকাল শেফালীকে রান্নাঘরে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন অনুরাধা। এক মুহুর্তে যেন পুরো বাড়িটাও মাথায় তুলে ফেললেন। মায়ের চেঁচামেচি শুনে শমিত দৌঁড়ে এলেন। কয়েকদিন আগেই এসেছেন তিনি। আজ আবার ফিরে যাবেন। গত সাত মাসে ইতোমধ্যে তাকে বহুবার আসতে হয়েছে শেফালীর জন্য। শমিতকে দেখে অনুরাধা বলে উঠলেন,
“এই তোর বউয়ের জন্য আমি কি কখনোই শান্তিতে থাকতে পারবো না? আর কত অশান্তি দিবি তোরা আমাকে?”
শেফালী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। শমিত বললেন,
“আরে কী হয়েছে সেটা তো বলবেন মা। কী করেছে ও?”
“কে বলেছে ওকে? কে বলেছে এই সময়ে ওকে রান্নাঘরে এসে কাজ করতে? শুনে রাখ শমিত। তোর বউয়ের জন্য যদি আমার নাতি নাতনির কিছু হয় তো ওকে আর এ-বাড়িতে ঠাই দেব না বলে দিলাম।”
“শেফালী, তুমি রান্নাঘরে কী করছো?”
“আরে আমি তো জল খাচ্ছিলাম। তাছাড়া অন্যকিছু করিনি।”
অনুরাধা আবার চেঁচিয়ে উঠলেন।
“জল খেতে এখানে আসতে হবে কেন? ঘরে জল ছিল না? আর না থাকলে আমাদের কাউকে বলতে। আর তাছাড়া এ-বাড়িতে কি ঝি চাকরের অভাব আছে নাকি? একটা গেলে আরেকটা আসে।”
শমিত মুচকি হেসে শেফালীকে নিয়ে ঘরে চলে এলেন।
“তোমাকে কে বলেছিল ওখানে যেতে? শুধু শুধু মায়ের কথা শুনতে হলো।”
“আমার কী দোষ? তোমার মা-ই একটু বেশি বেশি করেন। আমার বাচ্চা আমার পেটে। এদিকে আমার থেকে ওনার চিন্তা বেশি।”
“চিন্তা তো একটু করবেনই। প্রথমবার দাদি হচ্ছেন।”
“প্রথমবার মা তো আমিও হচ্ছি। আমি তো এতো চিন্তা করছি না।”
“এটা ভালো। আর ডাক্তারও বলেছেন তোমাকে বেশি চিন্তা না করতে।”
“কিন্তু তোমার মা তো সে হতে দিচ্ছেন না। সবসময় আমার চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন।”
“কী চিন্তা চিন্তা শুরু করলে বলো তো? আর মা তো তোমার জন্যই এতো চিন্তা করেন।”
শেফালী নিজের পেটে হাত রেখে বললেন,
“মা আমার জন্য নয়, তোমার সন্তানের জন্য চিন্তা করেন।”
“ওই একই হলো। এখন আর আমার সাথে ঝগড়া শুরু করো না। আমি বের হব এখন।”
“আজই চলে যাবে?”
“সময় পেলেই আবার চলে আসবো।”
শেফালীর কপালে চুমু খেয়ে শমিত নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তার পেছন পেছন শেফালীও গেলেন এগিয়ে দিতে।
.
.
.
বাজারের মাঝখানে মস্ত বড়ো একটা গয়নার দোকান। সন্ধ্যেবেলা এই একটা দোকানের আলোয়ই যেন পুরো বাজার ভরে ওঠে। এক মুহুর্তে সকলের নজর কাড়তে যথেষ্ট এই আয়োজন। অভ্রবাবু যে অল্প সময়েই ব্যবসায় অনেক উন্নতি করেছেন তা বেশ ভালোরকমই বোঝা যায়। এতে শ/ত্রুর সংখ্যাও যে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই উন্নতিতে শমিতের অবদানও কম নয়। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও এতোমাসে একদিনের জন্যও অর্ণবকে দোকানে বসাতে পারেননি। সে হিসেবে শমিত তাকে এ-কাজে বেশ সাহায্য করেছেন। দোকানের ভেতরেই অভ্রবাবুর একটা আলাদা কামড়া রয়েছে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। সেখানে বসেই বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। শমিতকে ঢুকতে দেখে বললেন,
“এসো শমিত এসো। তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম। তোমাকে ছাড়া যে এসব কত কষ্টে সামলাই, সে যদি বুঝতে তুমি! তা সোজা এখানে এলে নাকি বাড়িতে গিয়েছিলে?”
শমিত বসতে বসতে বললেন,
“সোজা এখানেই এসেছি। দোকানের একটু খোঁজখবর নিতে। অর্ণব এলে বাড়িতে যাবো ওর সাথে।”
“অর্ণব তোমার আসার খবর পেয়েছে?”
“হ্যাঁ, জানিয়েছি।”
“তাহলে দেখো এইতো এলো বলে।”
কথা শেষ করতে না করতেই অর্ণব প্রবেশ করলেন ভেতরে। তাকে দেখে অভ্রবাবু বললেন,
“ওইতো এসে গেছে।”
শমিত উঠে গিয়ে অর্ণবের সাথে করমর্দন আর কোলাকুলি করে বললেন,
“ভালো আছিস?”
“হ্যাঁ। তোর খবর বল।”
“দেখেই তো বুঝতে পারছিস আমি কতটা ভালো আছি।”
“তা আমার বোনটার কী খবর? শেফালী ভালো আছে?”
“ঔ ভালো। শুধু মায়ের সাথেই যা একটু লাগে।”
বলেই দুজনেই হেসে উঠলেন। শমিত আর অর্ণব দু’জনে দুটো চেয়ার টেনে বসলেন। অভ্রবাবু একজনকে ডেকে তিনটে চা পাঠাতে বললেন। অর্ণব বললেন,
“শুধু শুধু এখানে আসতে গেলি কেন আবার? ওখানে আরও ক’টাদিন থাকলেও পারতি ওর সাথে। কষ্ট হলেও এদিকটা কাকু ঠিকই সামলে নিতেন।”
অভ্রবাবু জবাব দিলেন,
“সে নিতাম। কিন্তু তোমাকেও তখন শান্তিতে বসে থাকতে দিতাম না আর। আমার কষ্টটা তোমাকেও বুঝিয়ে ছাড়তাম।”
শমিত বললেন,
“এদিকে কাজটা আরেকটু গুছিয়ে আবার যাবো।”
চা চলে এলে অভ্রবাবু নিজের কাপটা এগিয়ে নিলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,
“শমিতের যাওয়া-আসা তো চলছেই ওখানে। এবার তোমারও একটু যাওয়া উচিত।”
অর্ণব ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে তুললেন। অভ্রবাবু আবার শমিতের দিকে ইশারা করে বললেন,
“আমি ঠিক বলেছি না শমিত? তুমি কী বলো?”
শমিত জবাব দিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজের চা খাওয়ায় মনোনিবেশ করলেন।
চলবে…