মেহেরজান পর্ব-৪৩+৪৪

0
369

#মেহেরজান
#পর্ব-৪৩
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

চোখ বুজে মাথায় হাত দিয়ে সিড়িতে বসে আছেন অর্ণব। শকুন্তলার কান্নার শব্দ কানে আসছে। করুণ সুরে কাঁদছেন তিনি। ব্রেন্ডার পরিচয় জেনে শকুন্তলা যেভাবে অর্ণবের দিকে তাকিয়েছিলেন তা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না অর্ণব। নিজের কাছেই নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য তো খারাপ ছিল না। নিজের ছোটমাকে কষ্ট পেতে দেখতে চাননি বলেই সবটা লুকিয়েছেন। আর যা কিছু ছিল, সবটা তো পুরোনো কথা। ব্রেন্ডা যে এতো বছর পর এভাবে হঠাৎ করে ফিরে আসবেন তা-ই বা কে জানতো? মাথা তুলে সামনে তাকালেন অর্ণব। অভ্রবাবুও ঠিক তার মতোই মাথা নিচু করে বসে আছেন। না চাইতেও যত দ্রুত সম্ভব কলকাতা থেকে ফিরে আসতে হয়েছে তাকে। যে অঘটন ঘটা থেকে আটকাতে তিনি এতোদিন অর্ণবের ভরসায় ছিলেন, সেটাই ঘটেছে। একবার ভাবলেন বলবেন, “জমিদারের বংশধর আমরা। আমাদের জীবনে একাধিক নারী থাকা কোনো অস্বাভাবিক কিছু না। তোমরা এখন একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছো এ নিয়ে।” পরক্ষণেই কথাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলেন। এ কথা বলে নিজের পরিবারের কাছে আর ছোট হতে চান না তিনি। অন্তত এই বয়সে এসে শান্তি দেবীর হাতে মার খেতে চান না। এমনিতেই ছেলের এমন কাজে প্রচন্ড ক্রুদ্ধ তিনি। শকুন্তলার কান্নার শব্দে এখন বিরক্ত লাগতে শুরু করেছে অভ্রবাবুর। বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বললেন,

“আহ, তুমি কান্না বন্ধ কর তো এখন। অনেক হয়েছে।”

অভ্রবাবুর কথায় শকুন্তলার কান্না থামার পরিবর্তে কয়েকগুণ বেড়ে গেল। আরও উচ্চস্বরে কাঁদতে শুরু করলেন তিনি। অর্ণব হাতঘড়ির দিকে তাকালেন। ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুইছুই। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা অনুভব করছেন তিনি। আজ দুপুরে উনুনে হাড়ি চড়েনি। বাড়ির কারও তেমন খাওয়ার মন মেজাজ ছিল না। উপায় না থাকায় অর্ণবকেও বাকিদের মতোই অভুক্ত থাকতে হয়েছে। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ? মনে হচ্ছে পেটের ভেতর আগুন জ্বলছে। ক্ষুধার জ্বালা হচ্ছে সবথেকে বড় জ্বালা। এর আগে কিচ্ছু নয়। পূর্বাকে দেখলেন ড্যাবড্যাব করে সব দেখছেন। ইশারায় ডাকলেন তাকে অর্ণব। পূর্বা এলে বললেন,

“তোমাকে কি এখানে তামাশা দেখার জন্য রাখা হয়েছে? রাতের রান্না বসাওনি কেন এখনো?”

“কিন্তু…”

পূর্বা কথা শেষ করার আগেই অর্ণব বললেন,

“কিসের কিন্তু? তোমার কথা শোনার জন্য মাসে মাইনে দেবো না। এখুনি গিয়ে রান্না বসাও।”

পূর্বা দৌঁড়ে রান্নাঘরে গেলেন। কিন্তু কাজ করতে করতেও তার দৃষ্টি এদিকেই রয়েছে। পদ্মাবতী দূর থেকে বোঝার চেষ্টা করছিলেন অর্ণব কী বলছেন। নিচু স্বরে কথা বললেও রেগে কথা বলছিলেন এতটুকু বুঝতে পেরেছেন। পূর্বাকে রান্না ঘরে যেতে দেখে বাকীটাও বুঝতে পারলেন। অর্ণব একে একে ভালো করে সবাইকে দেখছেন। কার ভেতরে কী চলছে বোঝার চেষ্টা করছেন। ব্রেন্ডার দিকে চোখ যেতেই দেখলেন একদম শান্ত হয়ে বসে আছেন তিনি। তার মনে কী আছে বুঝতে পারছেন না অর্ণব। হঠাৎ এতোবছর পর কেন ফিরে এলেন? অর্ণব যতদূর জানতেন তার স্বামীর সাথে বেশ ভালোই ছিলেন ব্রেন্ডা। কিন্তু সেটাও সাত বছর আগের কথা। তারপর আর ব্রেন্ডার সাথে কোনো যোগাযোগ করেননি। এখন তাহলে কী চান তিনি?

ব্রেন্ডা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে উঠলেন,

“তুমি আমার সাথে ফিরে চলো অভ্র।”

শকুন্তলা কান্নার স্বর বাড়িয়ে আম্রপালিকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

“ও দিদিগো, ও কি আমায় ছেড়ে দেবে এখন?”

“শান্ত হ তুই। কিচ্ছু হবে না এমন।”

অভ্রবাবু ব্রেন্ডার উদ্দেশ্যে বললেন,

“তুমি ফিরে যাও ব্রেন্ডা। আমি আসতে পারবো না তোমার সাথে। আর তাছাড়া তোমারও স্বামী আছে।”

“নেই আমার কোনো স্বামী। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে আমার।”

অভ্রবাবু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এরপর বললেন,

“আমি তোমার সাথে ফিরবো না ব্রেন্ডা।”

“তাহলে আমাদের সন্তানের কী হবে? ও কি বাবা ছাড়া বড় হবে?”

ব্রেন্ডার কথা শুনে অর্ণবের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। সবাই কিছুক্ষণের জন্য পাথর হয়ে গেলেন। কেউ-ই যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। শকুন্তলার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। আম্রপালির ওপর ঢলে পড়লেন তিনি। সাথে সাথে পদ্মাবতী আর আম্রপালি তাকে ধরে বসিয়ে দিলেন।

“শেফালী, তাড়াতাড়ি জল নিয়ে আয়।”

পদ্মাবতী বলা মাত্রই শেফালী জল আনতে ছুটে গেলেন। অভ্রবাবু বললেন,

“আমাদের সন্তান?”

“হ্যাঁ, আমাদের ছেলে।”

“কী সব বলছো তুমি? আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলছো?”

“না, মিথ্যে নয়। সত্যিটাই বলছি। তোমার থেকে চলে যাওয়ার কিছুদিন পর জানতে পারি আমি গর্ভবতী। আমি নিজের সংসার নষ্ট করতে চাইনি। আর তোমার ব্যবসার অবস্থাও ভালো ছিল না তখন। তাই আর তোমার কাছেও ফিরে আসিনি। আমার স্বামী ভেবেছিল এটা ওর সন্তান। এতোবছর সব ঠিকই ছিল। কিন্তু ছ’মাস আগে ও কোনোভাবে জানতে পারে সত্যিটা। এরপর ও আমাদের ছেড়ে চলে যায়। আমার সন্তানের পিতৃ পরিচয় দিতেও অস্বীকার করে।”

“সেদিন তুমি নিজের লাভের জন্যই আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিলে আর আজ এতোবছর পর আবার নিজের লাভের জন্যই আমার কাছে ফিরে এসেছো তাহলে।”

“না, আমি এসেছি আমার সন্তানের জন্য। আমি চাই না ও ওর বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হোক। তুমি ফিরে চলো আমার সাথে। ওখানে তোমার ভবিষ্যৎ আছে। তোমার ছেলে আছে। এখানে কার জন্য পড়ে থাকবে তুমি? তোমার কোনো সন্তানও নেই এখানে।”

জল খেয়ে আর চোখেমুখে ছিটিয়ে শকুন্তলা কিছুটা শান্ত হয়েছেন। কিন্তু তার চোখের জলকে আটকাতে পারছেন না। পদ্মাবতীকে বললেন,

“আমাকে ঘরে নিয়ে চল, পদ্মা। আমি আর এখানে থাকতে পারছি না।”

পদ্মাবতী আর শেফালী মিলে শকুন্তলাকে ধরে দোতলায় নিয়ে এলেন। শকুন্তলা নিজের ঘরে না গিয়ে চিত্রার ঘরে ঢুকে ওদের চলে যেতে বললেন। এরপর দরজা আটকে মেয়ের জিনিসপত্র আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।

শান্তি দেবী এককোনায় বসে ছেলে কী বলে তা শোনার অপেক্ষা করছেন। শুধু তিনি নন, অন্যরাও একই কথা শোনার অপেক্ষায় আছেন। অভ্রবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। কত বছর তিনি শুধু একটা ছেলে সন্তান চেয়েছিলেন। যাও পেয়েছিলেন, তাও জন্মানোর আগেই ভগবান নিয়ে নিলেন। একটা ছেলের জন্য নিজের মেয়েটাকে কতই না অবহেলা করেছেন। সেও চলে গেল। আর আজ সেই ছেলে পেয়েও খুশির বদলে কষ্ট বাড়ছে তার। যে সন্তানকে তিনি কখনো দেখেননি, স্পর্শ করেননি, যার সম্পর্কে কিছু জানতেন না পর্যন্ত, তার জন্য আজ সবাইকে ছেড়ে গেলে পুরোটা জীবন তাকে একটা পরিবারের কাছে অপরাধী হয়ে থাকতে হবে। তার অপরাধের শাস্তি গোটা পরিবার কেন ভোগ করবে?

“তুমি কিছু বলছো না কেন অভ্র? যাবে তো আমার সাথে?”

অভ্রবাবু হাত জোড় করে ব্রেন্ডার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

“তুমি আমাকে ক্ষমা করো ব্রেন্ডা। আমি আমার স্ত্রী, পরিবার ছেড়ে যেতে পারবো না তোমার সাথে। আমার জীবনে তোমাকে কোনো জায়গা দিতে পারবো না। তবে আমার সন্তানের দায়িত্ব নিতে আমি রাজি। যদি তুমি চাও তো তার ভরণপোষণ দিতে রাজি আছি আমি। তুমি চাইলে ওকে আমার কাছে রেখে যেতে পারো।”

“অসম্ভব। আমার ও ছাড়া আর কেউ নেই। আমি ওকে এখানে রেখে যেতে পারবো না।”

অভ্রবাবু কী বলবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

“তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।”

অভ্রবাবু ক্ষমা চেয়ে নিজের জায়গায় এসে বসে পড়লেন। এতোক্ষণ শক্ত হয়ে থাকা মানুষটাও আর নিজেকে আটকাতে পারলেন না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন ব্রেন্ডা। তার কান্নার শব্দ যেন অন্য সব আওয়াজে ছাপিয়ে গেছে। পুরো বাড়ির কানায় কানায় ভরে উঠেছে তার করুণ সুর। বেশ কিছুক্ষণ কাঁদার পর শান্ত হলেন ব্রেন্ডা। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। আম্রপালি তাকে থামিয়ে বললেন,

“আপনি থেকে যান আজ রাতটা। এতো রাতে যাবেন না।”

“এখন আর এখানে থাকার কোনো মানে নেই। আমাকে আটকাবেন না। আমি ঠিকই নিজের পথ খুঁজে চলে যেতে পারবো।”

অর্ণবের সামনে এসে দাঁড়ালেন ব্রেন্ডা। বললেন,

“বিয়ে করেছো দেখলাম। সেদিন একবারও বললে না যে। এখানে না আসলে তো জানতেও পারতাম না কোনোদিন। খুব মিষ্টি দেখতে তোমার বউটা। তোমার কাকুর মতো, ওকে ছেড়ে আবার অন্য কোনো মেয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ো না কখনো। ওকে যেন কাঁদতে না হয়। এরকম দিন যেন তোমার জীবনে কোনোদিন না আসে। যাই হোক, বিবাহিত জীবনের জন্য শুভকামনা রইল।”

নিজের কথা শেষ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন ব্রেন্ডা। অর্ণব ভাবছেন ব্রেন্ডা এসব কী বলে গেলেন তাকে। বাকিরা এখনো যে যার জায়গায়ই বসে রয়েছেন। শান্তি দেবী এসে অভ্রবাবুর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,

“ফিরিঙ্গি মাইয়া মানুষের কাছে তো ঠিকই ক্ষমা চাইবার পারস। নিজের বউয়ের কাছে চাইতে লজ্জা করে ক্যান? ওরে কম দুঃখ দিছস? ওর কাছে ক্ষমা চাইবার পারস না?”

তাচ্ছিল্যভরে কথাগুলো বলে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন শান্তি দেবী।
.
.
.
অন্ধকারে হাতে হ্যারিকেন নিয়ে একটা কাঁচা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছেন পূর্বা। বাঁশঝাড়ের সামনে আসতেই কেউ ফিসফিস করে বললেন,

“পূর্বা দিদি, এদিকে এসো।”

পূর্বা ঝাড়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,

“মোহিনী, তুই এখানে? আমি তোদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলাম। ভালোই হয়েছে তোকে এখানেই পেয়ে গেলাম।”

“ওসব বাদ দাও। আগে বলো ও-বাড়িতে কী হলো।”

“বলছিরে বলছি। একটু গুছিয়ে নিতে দে।”

“বলো তাড়াতাড়ি।”

মোহিনীর চোখেমুখে তীব্র কৌতূহল প্রকাশ পাচ্ছিলো। কিন্তু কেন তা পূর্বা জানেন না। তার জানার প্রয়োজনও নেই। তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা মোহিনীকে খুলে বললেন। সবকিছু শুনে মোহিনী অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। হাসতে হাসতেই বলবেন,

“আমি যা ভেবেছিলাম, এ তো তার থেকেও অনেক বেশি দূর এগিয়ে।”

পূর্বার কাছে খুব অদ্ভুত লাগছে ব্যাপারটা। তিনি মোহিনীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“হ্যাঁ রে মোহিনী, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো তোকে?”

মোহিনী হাসি থামিয়ে বললেন,

“কী কথা?”

“কাল আমাকে বললি ও-বাড়িতে কাজের লোক লাগবে। আমাকে যেতে হবে। তুই যেতে বলেছিস একথাও গোপন রাখতে হবে। ওদের সব খবর এনে দিতে বললি। সবকিছু শুনে হাসার কথা নয় তবুও এমন পাগলের মতো হাসছিস। তা কেন? ও-বাড়িতে তুই আর যাস না?”

“এখন সব বলার সময় নেই দিদি। সময় হলে পরে জানাবো তোমাকে। তুমি আমায় বড় উপকার করেছো। এই নাও। এটা রাখো। বলেছিলাম তোমার মেয়ের চিকিৎসার সব খরচ আমি দেবো। ভালো একটা ডাক্তার দেখিও ওকে। তাড়াতাড়িই সুস্থ হয়ে উঠবে ও।”

কথাটা বলেই টাকার মোটা একটা বান্ডিল পূর্বার হাতে দিলেন মোহিনী। পূর্বার দু-চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো।

“তোর এই ঋণ আমি কোনোদিন ভুলবো না রে মোহিনী। সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো তোর কাছে।”

“এখন যাও তুমি। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমিও আসি।”

বলেই মোহিনী বাড়ির পথে হাঁটা দিলেন। বাড়িতে ফিরে তারানাকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত কথা বললেন। বলেই আবার হাসতে শুরু করলেন। এই হাসি তারানার মোটেও পছন্দ হলো না। তিনি বললেন,

“এসবে তোর কী লাভ?”

“লাভ নেই তারামা। কিন্তু শান্তি আছে। আমি চাই আমাকে দেওয়া কষ্টের স্বাদ ওরাও গ্রহণ করুক। প্রিয়জন দূরে সরে গেলে কেমন লাগে সেটা ওরাও বুঝুক।”

মোহিনীর চোখে প্রতিশোধের আগুন স্পষ্ট দেখতে পেলেন তারানা। মনের মধ্যে এক অজানা ভয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো তার। এই আগুনে যে শুধু ওরা নয়, মোহিনীকেও পুড়ে ছাই হতে হবে তা দিব্যি বুঝতে পারছেন তিনি।
.
.
রান্না ঘরে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে কাজ করছিলেন পদ্মাবতী। হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠায় চমকে উঠলেন। পেছনে ঘুরে দেখলেন শেফালী দাঁড়িয়ে আছেন। ঘুমঘুম চোখে শেফালী জিজ্ঞেস করলেন,

“রাতদুপুরে তুই রান্না ঘরে কী করছিস পদ্মা?”

“তেমন কিছু না। খিদে পেয়েছিল খুব। খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করছিল। তাই রাঁধছিলাম।”

“তাই বলে এখন?”

“হ্যাঁ, এখনই। এতোরাতে তুই এখানে?”

“জল খেতে উঠেছিলাম। আওয়াজ শুনে নিচে নেমে এলাম। ভেবেছিলাম বেড়াল-টেড়াল ঢুকেছে হয়তো। এসে দেখি তুই।”

পদ্মাবতী থালায় খিচুড়ি বেড়ে আচারের বৈয়াম খুলতে খুলতে বললেন,

“এতো সাবধানে কাজ করছিলাম যাতে কারও ঘুম না ভাঙে। কিন্তু তুই ঠিকই টের পেয়ে গেলি।”

“তোকে দেখে আমারও খিদে পেয়ে গেল মনে হচ্ছে।”

“খেতে না করেছে কে তোকে?”

“কিন্তু ঘুমও তো আসছে খুব। তুই আমার জন্য কিছুটা রেখে দিস। সকালে উঠে খাবো। এখন দাঁড়িয়ে থাকছে পারছি না।”

“ঠিকাছে। যা তাহলে তুই। আমি রেখে দেবো তোর জন্য।”

শেফালী চলে গেলে পদ্মাবতীও খাওয়া ছেড়ে হাত ধুয়ে নিলেন। আধখাওয়া খাবারটা ঢেকে রেখে আম্রপালির ঘরের দিকে চলে গেলেন।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৪৪
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

পেছন থেকে পা টিপে টিপে এসেই অর্ণবকে জড়িয়ে ধরলেন মোহিনী। অর্ণব বলে উঠলেন,

“এভাবে হুটহাট করে আমাকে জড়িয়ে ধরবেন না মেহের। আপনার স্পর্শে আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।”

মোহিনী হি হি করে হেসে উঠলেন। অর্ণবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

“বাঃ রে, আপনাকে জড়িয়ে ধরবো না তো কাকে ধরবো?”

“কাউকেই না।”

“আর আমি আপনাকে জড়িয়ে না ধরলে কে ধরবে? পদ্মা?”

অর্ণব ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লেন। পদ্মাবতীকে নিয়ে মোহিনীর বলা প্রতিটা বাক্য যে তার বুকে ছুরি চালায় তা কবে বুঝবেন মোহিনী? অর্ণবের নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়। তাকে কি সারাজীবন এই অপরাধবোধের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে?

“আপনার সবসময় ওই একটাই নাম ঠোঁটের ডগায় থাকে। আমাকে না রাগালে, কষ্ট না দিলে আপনি শান্তি পাননা? সারাজীবন কি এভাবে কথা শোনাবেন এটা নিয়ে?”

“সারাজীবন আর কথা শোনাতে পারবো কই? আপনি তো অন্য কারও। একদিন না একদিন ঠিকই আমাকে ভুলে যাবেন।”

“উল্টোপাল্টা বলবেন না একদম। আমি অন্য কারও? তাহলে আপনি আমার সাথে আছেন কেন? চলে গেলেই তো পারেন।”

“আছি কারণ পরের জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি হয়। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়।”

“চুপ। এখন একটু বেশি বেশিই হয়ে যাচ্ছে।”

“ঠিকাছে। রাগবেন না। আর করবো না মশকরা। আমার ঘরে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী ভাবছিলেন?”

“আপনি যেন সারাজীবন আমাকে কথা শোনাতে পারেন, তার ব্যবস্থা করছি। সে ব্যাপারেই ভাবছিলাম।”

“কী ব্যবস্থা? বিয়ে করে নিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হওয়ার কথা ভাবছেন নাকি আবার?”

“কেন? এতে কোনো অসুবিধা আছে নাকি আপনার?”

“আমার নেই। অসুবিধা তো আপনার বাড়ির লোকের। তারা মানবে কোনোদিন?”

“সেদিন আপনাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে বলেছিলেন না? কেউ না মানলে এবার সত্যি সত্যিই পালিয়ে যাবো আপনাকে নিয়ে। অনেক দূরে চলে যাবো আমরা। তারপর আপনি চিরদিনের জন্য শুধু আমার হবেন। আমার মেহেরজান।”

“দেখা যাবে কত পারেন।”

“কী?”

“পালাতে।”

“পালাতে যেন নাহয় তার জন্য এখন বাড়ি যেতে হবে।”

“সে কি! আমি তো মাত্রই এলাম। আপনি এখনই চলে যাবেন?”

“আমি আপনাকে একটা জিনিস দিতে এসেছিলাম।”

অর্ণব পকেট থেকে একটা মোটা একটা বালা বের করলেন। খুবই অদ্ভুত ও আকর্ষণীয় নকশা এর। বালার একপ্রান্তে ময়ূর, যার পেখমে ছোট ছোট গাঢ় নীল পাথর বসানো। আর সেই ময়ূরের গলা পেঁচিয়ে থাকা বালার অপরপ্রান্ত থেকে আসা এক সর্পিণী, যার মাথায় বড় একটা সবুজ রঙের পাথর বসানো। প্রথম দেখায়ই যে-কারও নজর কাড়তে সক্ষম এটি।

“এটা কার?”

“ঠাম্মার। জানেন, এই বালাটারও একটা গল্প আছে। বংশপরম্পরায় কিছু না কিছু শ্বাশুড়ির হাত থেকে বাড়ির বউদের কাছে আসে। কিন্তু আমাদের পরিবারেরটা অন্যরকম। আমাদের পরিবারে এই বালাটা ঠাকুমারা তার নাতবউকে দিয়ে থাকেন।”

“এটা আবার কেমন নিয়ম? নাতির বিয়ে হওয়া পর্যন্ত যদি ঠাকুমা না বাঁচেন?”

অর্ণব ভ্রু কুঁচকালেন। এরপর আবার স্বাভাবিকভাবে বললেন,

“সে আমি জানি না। এরকম আরও একটা ছিল। কিন্তু সেটা বহুবছর আগেই চিতায় উঠেছিল। যিনি প্রথম এগুলো বানিয়েছিলেন তার সাথে, তার ইচ্ছায়। আমার দাদার দাদার দাদার সময়েরও অনেক আগে। শুধু এটাই রয়ে গেছে। আর হাত বদলে এক জনের থেকে আরেকজনের কাছে আসছে। ঠাম্মা এটা আমার কাছে দিয়ে বললো আপনাকে পরিয়ে দিতে।”

বলেই অর্ণব বালাটা মোহিনীর হাতে পরানোর চেষ্টা করতে লাগলেন।

“আমাকে পরাতে বলেছে নাকি আপনার স্ত্রীকে?”

“আমি এটা ঠিক জায়গায়ই নিয়ে এসেছি।”

এতো চেষ্টার পরও অর্ণব বালাটা মোহিনীর হাতে ঢোকাতে পারছেন না। মোহিনী হেসে বললেন,

“আপনার এই বালা পরতে হলে আমাকে আরও শুকাতে হবে মনে হচ্ছে।”

অর্ণব হেসে ফেললেন।

“সেটা আপনার দ্বারা সম্ভব হবে না। এক ঘন্টা না খেয়ে থাকতে পারেন কিনা সন্দেহ।”

“আপনি বলছেন আমি বেশি খাই? অবশ্য বলতেই পারেন। মিথ্যে তো আর নয়।”

“তা বললাম কখন?”

অর্ণব এখনো বালাটা মোহিনীকে পরানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছেন। মোহিনী বললেন,

“ছেড়ে দিন অর্ণব। এটা আমার হাতে লাগবে না। আর আমি পরবোও না।”

“কেন?”

“যেদিন মনে হবে আমি এটার সত্যিকার হকদার, সেদিন পরবো। আপনার হাতেই। এখন এটা ফিরিয়ে নিয়ে যান।”

অর্ণব নিজের বৃথা চেষ্টা বন্ধ করে বালাটা বিছানার ওপর ছুড়ে ফেললেন। বললেন,

“আমি এটা ফিরিয়ে নিয়ে যাবো না। আবার পরানোর চেষ্টা করবো। ততদিন যত্ন করে রেখে দেবেন।”

অর্ণব চলে যেতে উদ্যত হলেন।

“অর্ণব।”

“কী?”

“যখন তখন এ-বাড়িতে চলে আসতে আপনার ভয় করে না?”

“কীসের ভয়?”

“লোকলজ্জার।”

অর্ণব যেতে যেতে উত্তর দিলেন,

“না, করে না।”
.
.
.
কামিনী ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। অর্ণবের ঘরের বারান্দায় দাঁড়ালে গন্ধটা আরও ভালোভাবে পাওয়া যায়। পদ্মাবতী প্রাণভরে একটা শ্বাস নিলেন। শেফালী এসে বললেন,

“বড় মামী ডাকছেন তোকে।”

“কেন?”

“জানি না। বলেননি আমাকে। অর্ণবদাও আছেন ঘরে।”

“ওহ, বুঝতে পেরেছি। ঠিকাছে। আমি যাচ্ছি।”

আম্রপালির ঘরে ঢুকতেই দেখলেন অর্ণব বসে আছেন। পদ্মাবতীকে দেখে আম্রপালি তার হাতের কাগজটার দিকে ইশারা করে বললেন,

“আমার হাতে এটা কী জানিস? বুঝেছিস নিশ্চয়ই।”

পদ্মাবতী চুপ করে রইলেন। আম্রপালি আবার বলে উঠলেন,

“তোর আর অর্ণবের বিবাহবিচ্ছেদের কাগজ।”

দেখেই বোঝা যাচ্ছে আম্রপালি প্রচন্ড রেগে আছেন। অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“এসবের মানে কী অর্ণব?”

“এটাই তো হওয়ার কথা ছিল মা। নাকি আপনি ভেবেছিলেন আমি সবটা মেনে নিয়ে এভাবেই থাকবো?”

“কাকে ছাড়তে চাইছো তুমি? একটু পরিষ্কার করে বলো তো।”

“মানে?”

“মানে নিজের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নাকি তোমার অনাগত সন্তানের মাকে?”

আম্রপালির কথা শুনে অর্ণব কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল তার। তিনি বললেন,

“কী বলতে চাইছেন?”

“বুঝছো না আমি কী বলতে চাইছি? খুব শীঘ্রই তুমি একজন পিতা হতে চলেছো। তাই এসব উল্টাপাল্টা চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। কাল থেকে দূর্গাপূজো। অনেক কাজ। এসব ছাড়াছাড়ির কথা বাদ দিয়ে পূজোটা একসাথে উপভোগ কর। আশা করি সব বুঝতে পেরেছো। এখন যেতে পারো।”

অর্ণবের কাছে এখনো সবকিছু এলোমেলো লাগছে। নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। তিনি কি ভুল শুনলেন? নাকি এটাই সত্যি? কিচ্ছু বুঝতে পারছেন না। কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। পদ্মাবতী আম্রপালির দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছেন। আম্রপালি চোখের ইশারায় তাকে কিছু বললেন। পদ্মাবতী কী বুঝলেন কে জানে। তারপর তিনিও চুপচাপ চলে গেলেন। অর্ণবের সামনে আসতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

“মা যা বললেন তা কি সত্যি?”

“মিথ্যে বলার কোনো কারণ আছে?”

“একদম হেঁয়ালি করে কথা বলবে না। তুমি জানো আমি মেহেরকে ভালোবাসি। তোমার সাথে সংসার করা অসম্ভব।”

“কেন? এতোদিন কি সংসার করেননি? তাছাড়া রাতের পর রাত যখন আমার সাথে কাটাতেন তখন মনে পড়েনি আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন? তাহলে এখন হঠাৎ ছেড়ে দিতে চাইছেন কেন? নাকি মন ভরে গেছে?”

“একদম বাজে কথা বলবে না।”

“বড়মা মিথ্যে বলছেন এমন কেন মনে হচ্ছে আপনার? এমন তো নয় যে আপনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। নাকি মোহিনীকে কী করে মুখ দেখাবেন সেটা ভেবে ভয় পাচ্ছেন?”

পদ্মাবতীর কোনো কথারই জবাব দিতে পারছেন না অর্ণব। কারণ মিথ্যে বলছেন না তিনি। শুধু নিজের ওপর রাগ, লজ্জা, ঘৃণায় চোখ লাল হয়ে উঠছে অর্ণবের।
.
.
.
“নোংরা লোক একটা। লজ্জা করলো না আমাকে ভালোবাসার কথা বলেও পদ্মার সাথে সম্পর্কে জড়াতে?”

“পদ্মাবতীর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই মেহের। আমি শুধু আপনাকে ভালোবেসেছি।”

“এখনো মিথ্যে বলছেন আমাকে? সম্পর্ক নেই তাহলে বাচ্চা আসলো কোথা থেকে?”

“মেহের, আমাকে আর একটা সুযোগ দিন। শেষবারের মতো ক্ষমা করে দিন।”

“কিসের ক্ষমা? এতোকিছুর পরও আপনি বলছেন আপনাকে আরও সুযোগ দিতে? লোকে আমাদের চরিত্রহীন ভাবে। আসল চরিত্রহীন তো আপনারা। মেয়ে দেখলে হুশ থাকে না, না?”

“মেহের, আমাকে অন্তত কিছুটা সময় দিন আপনাকে সব বুঝিয়ে বলার জন্য।”

“আর কী বোঝাবেন আমাকে? ভুল তো আমি করেছি, আপনাকে বিশ্বাস করে। আপনার মুখও আর কোনোদিন দেখতে চাই না আমি।”

“যাবেন না মেহেরজান। আমাকে ছেড়ে যাবেন না। মেহেরজান…”

বিড়বিড় করতে করতেই ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়লেন অর্ণব। গায়ের পাঞ্জাবীটা ঘামে একদম ভিজে গেছে। প্রচন্ড হাঁপাচ্ছেন তিনি। গ্লাসে জল ঢেলে এক নিঃশ্বাসে ঢকঢক করে খেয়ে ফেললেন। দেওয়ালঘড়িতে দেখলেন রাত প্রায় তিনটে বাজে। কিছু ভেবে না পেয়ে শমিতকে কল করলেন। ওপাশ থেকে ঘুম ঘুম কণ্ঠে জবাব এলো,

“কে বলছেন?”

“শমিত, আমি অর্ণব।”

শমিতের উঠে বসার শব্দটা ওপাশ থেকে শোনা গেল।

“অর্ণব! তুই এতো রাতে?”

“আমি কলকাতায় যাবো। তোদের ওখানে।”

“কলকাতায় আসবি ভালো কথা। তাহলে সেদিন মামার সাথে চলে এলেই তো পারতি। আর তুই এটা বলার জন্য এতো রাতে আমার ঘুম ভাঙালি? ওখানে সব ঠিক আছে তো?”

“কিচ্ছু ঠিক নেই শমিত। কিচ্ছু ঠিক নেই এখানে।”

“অর্ণব, কী হয়েছে বলতো আমায়। আমার তো র’ক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে তোর কথা শুনে।”

“বলবো। সব বলবো তোকে। আমাকে আসতে দে আগে।”

“ঠিকাছে। তুই শিগগিরই চলে আয় এখানে।”

“কালই আসছি আমি।”
.
.
.
“মেহেরজান,

আপনার মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই আমার। আমার সব ভুল ক্ষমা করলেও এই ভুলটা হয়তো আপনি কোনোদিনও ক্ষমা করবেন না। আমি চেয়েছিলাম আপনার সাথে নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিতে। কিন্তু আমিই আপনার আর আমার এক হওয়ার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছি। আপনাকে নিজের বলে দাবি করার অধিকারটাও হারিয়েছি। জগৎটা আমাদের ভালোবাসার বিরুদ্ধে কেন বলতে পারেন? আপনাকে যত পেতে চেয়েছি, তত হারিয়েছি। এখন আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে সবকিছু ঠিক করার উপায়টুকুও নেই। আপনাকে পাওয়ার শেষ আশাটাও নিঃশেষ হয়ে গেছে। আপনাকে হারিয়ে ফেলেছি আমি, চিরকালের জন্য। আমাদের ভালোবাসাটা নাহয় পরের জন্মের জন্যই তোলা রইলো। আবার যখন জন্মাবো তখন চিনতে পারবেন তো আমায়? ক্ষমা করবেন তো আমাকে? সে জন্মে আপনার আর আমার মাঝে অন্য কেউ থাকবে না। তখন আপনি শুধু আমার হবেন। আমার মেহেরজান। -অর্ণব।”

অর্ণবের পাঠানো চিঠিটা পড়া শেষ করে সামনে তাকালেন মোহিনী। এই চিঠির অর্থ তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। কারণটাও জানেন। পূর্বার কাছে কাল রাতে শুনেছেন পদ্মাবতী অন্তঃসত্ত্বা। দূরের রাস্তাটা দিয়ে মাত্রই অর্ণবের গাড়িটা চলে যেতে দেখলেন। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু এখন কপোল বেয়ে পড়ছে তার।

“কী অদ্ভুত দেখুন, অর্ণব। এক শরতে আমাদের প্রণয় হলো, পরের শরতেই বিচ্ছেদ। এক বছরের মধ্যে সব যেমনভাবে শুরু হয়েছিল, তেমনিই শেষ হয়ে গেল। আপনি বলেছিলেন আমাকে নিয়ে অনেক দূরে কোথায় চলে যাবেন। কিন্তু আপনি তো আমাকে ফেলে একাই চলে গেলেন।”

পেছন থেকে মোহিনীর কাঁধে হাত রাখলেন তারানা। মোহিনী পেছন ফিরতেই দেখলেন তার চোখে জল। তারানা জল মুছে দিয়ে বললেন,

“কাঁদিস না মেহের। তোর চোখে জল মানায় না। তুই তো সম্পূর্ণটাই আগুন। এই সামান্য জল সেটাকে নেভাতে অক্ষম। তাই অযথা কেঁদে এই জলকে বৃথা যেতে দিস না।”

“আমি আর কাঁদবো না তারামা।”

“ও-বাড়িতে পূজো শুরু হয়েছে। আজ অন্তত যা। দেখে আয়।”

“ও-বাড়ির দরজা আমার জন্য অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে তারামা। শুধু শুধু নিজের অপমান করতে কেন যাবো? ও-বাড়িতে আমার বলে যে ছিল, সেও চলে গেল। এখন কার ভরসায় যাবো আমি ওখানে?”

তারানা জবাব দিলেন না। মোহিনী বাক্স থেকে নিজের ঘুঙুরজোড়া বের করলেন।

“যার জন্য আমি তোদের ছাড়লাম, সে আমায় ছেড়ে গেল। কিন্তু তোরা ছাড়লি না। এখনো আমার সাথেই রয়ে গেলি।”

মোহিনীকে ঘর থেকে বের হতে দেখে তারানা বললেন,

“কোথায় যাচ্ছিস?”

“জলসাঘরে। অনেকদিক ধরে মুজরা করা হয়না। এখন আর নিষেধ করারও কেউ রইলো না।”

“আবার নাচবি তুই?”

“হ্যাঁ, নাচবো। আজ সন্ধ্যায় শহর থেকে অনেক বাবুরা আসবেন, না? আমি চাই না আমি ওদের সামনে ভুলভাল নাচি। তাই এখন তার প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছি। দেখো তুমি, আজ এই মোহিনীর ওপর থেকে কেউ নজর সরাতে পারবে না।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে