#মেহেরজান
#পর্ব-৩৯
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
শেফালী টেবিলের ওপর দু’কাপ চা রাখলেন। পদ্মাবতীর কপালে হাত রেখে বললেন,
“বড় মামি বললেন তোর নাকি জ্বর এসেছিল রাতে। এখন কেমন আছিস?”
পদ্মাবতী চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
“ভালো আছি এখন।”
শেফালী চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন,
“এখনো ঘর থেকে বের হলি না তাই ভাবলাম জ্বর-টর আবার বাড়লোই নাকি। তাই এসে পড়লাম দেখতে।”
“চা এনে ভালোই করেছিস। মাথাটা ধরেছিল একটু। এখন ভালো লাগছে।”
“অর্ণবদা কোথায় জানিস?”
“না, জানি না। আমি কী করে জানবো? উনি আমাকে বলে যান নাকি? কোথায় গেছেন?”
“কলকাতা। সকালে খাওয়া-দাওয়া করেই বেরিয়ে গেছেন।”
“হঠাৎ ওখানে কেন?”
“জানিনা। বললেন কাজ আছে। মামা যেতে বলেছেন হয়তো।”
“ফিরবেন কবে জানিস?”
“তা বলেনি। তবে থাকবে কিছুদিন বোঝাই যাচ্ছিলো। সাথে কাপড়ের ব্যাগ ছিল।”
“ওহ।”
“তুই কি আমার সাথে একটু বের হতে পারবি? যদি যেতে পারিস তো?”
“পারবো। কোথায় যাবি?”
“আমাদের বাড়িতে। একা একা যেতে ভালো লাগছে না। সেদিন যেতে চেয়েও যাওয়া হয়নি। তাই ভাবলাম আজ যাবো। রাতের মধ্যেই ফিরে আসবো।”
“আচ্ছা।”
দু’জনের চা খাওয়া শেষ। শেফালী কাপ দুটো নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,
“ঠিকাছে। দুপুরের খাবার খেয়েই বের হবো। তৈরি থাকিস তুই।”
পদ্মাবতী ঘাড় কাত করলেন। শেফালী চলে যেতে যেতে বলে উঠলেন,
“ওহ। আরেকটা কথা।”
“কী?”
“সকালে অর্ণবদাকে এ-ঘর থেকে বের হতে দেখলাম। কাল রাতে তোরা একসাথে ছিলি?”
পদ্মাবতী মুচকি হাসলেন।
.
.
.
কলকাতার এক সনামধন্য রেস্তোরাঁয় বসে আছেন অর্ণব। তার সামনাসামনি বসেছেন মধ্যবয়সী এক বিদেশিনী। নাম ব্রেন্ডা স্মিথ। বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে বাংলা বলেন তিনি। বিলেতে অভ্র বাবুর মাধ্যমে পরিচয় তার সাথে অর্ণবের। ছোটবেলায় এই মহিলার সাথে একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে তার। কিন্তু বড় হতে হতে তাতেও মরিচা পড়েছে। ব্রেন্ডাকে কী বলে সম্বোধন করবেন তা ঠিক করতে না পেরে তাকে নাম ধরে ডাকাতেই অভস্ত্য অর্ণব। কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই তিনি বললেন,
“আপনার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত ব্রেন্ডা।”
“অসম্ভব অর্ণব। আমি এতোদূর থেকে এখানে এসেছিই শুধুমাত্র অভ্রর সাথে দেখা করতে। ওর সাথে দেখা না করে আমি কিছুতেই ফিরে যাবো না।”
“কাকুর সাথে দেখা করা সম্ভব নয়। উনি আপনার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ রাখতে চান না।”
“এজন্যই তো আমি তোমার সাহায্য চাইছি অর্ণব। একমাত্র তুমিই বোঝাতে পারো অভ্রকে। বোঝাও ওকে। আমার সাথে দেখা করাও। কথা বলতে বলো।”
“কাকু আপনার সাথে যোগাযোগ রাখুক এটা আমিও চাই না ব্রেন্ডা।”
অর্ণবের কথায় এবার ব্রেন্ডা কিছুটা আশাহত হলেন। তার শেষ অবলম্বন ছিলেন অর্ণব। কিন্তু তিনিও এখন তাকে কোনো সাহায্য করবেন না বলে দিলেন। ব্রেন্ডা আকুতিভরা কণ্ঠে বললেন,
“দয়া করো অর্ণব। একটাবার আমাকে অভ্রর সাথে দেখা করাও।”
“দুঃখিত ব্রেন্ডা।”
এবার ব্রেন্ডা কিছুটা বিরক্ত হলেন। সাথে রাগান্বিতও। তার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। কটমট করে জিজ্ঞেস করলেন,
“আমি কি জানতে পারি কেন? কেন তুমি চাইছো না আমাকে ওর সাথে দেখা করতে দিতে?”
“আমার কাকু আপনাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। অথচ আপনি ভালোবেসেছেন তার টাকাকে। লুটেপুটে খেয়েছেন তাকে। কাকু যখন একদম নিঃস্ব হয়ে গেলেন। দীর্ঘদিন সম্পর্ক থাকার পরও আপনি তাকে ফেলে চলে গেলেন। যখন কি-না তার আপনার সাহায্য বেশি প্রয়োজন ছিল। এরপরও আপনি ভাবছেন আমি আপনাকে সাহায্য করবো? তার সাথে দেখা করতে দেব?”
ব্রেন্ডা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন,
“আমি আমার কাজের জন্য লজ্জিত। আমি জানি আমি ভুল করেছি। তবুও আমি একটাবার অভ্রর সাথে দেখা করতে চাই। আমাকে অন্তত তার কাছে ক্ষমাটা চাইতে দাও অর্ণব। একবার দেখা করাও।”
“আপনি এখন আসতে পারেন ব্রেন্ডা।”
কাজ হবে না বুঝতে পারলেন ব্রেন্ডা। তাই আর অযথা সময় নষ্ট করলেন না। একরাশ হতাশা নিয়ে উঠে চলে গেলেন। বড় একটা বোঝা যেন নেমে গেল অর্ণবের ঘাড় থেকে। অর্ণব চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিলেন। গতকাল এই মহিলাই চলে এসেছিলেন কুঞ্জনগড়ে। তাকে থামাতেই অর্ণব ছুটে ছিলেন রেলওয়ে স্টেশনে। কোনোরকম বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে পরের ট্রেনে উঠিয়ে দিয়েছিলেন। ভাগ্যিস অভ্র বাবু অর্ণবকে আগেই টেলিফোনে জানিয়ে দিয়েছিলেন সবটা। তা নাহলে উনি বাড়ি পৌঁছে গেলে কত বড় ঝামেলাটাই না হতো। মোহিনী শুধু শুধু তাকে ভুল বুঝলেন। বাড়ির কথা মনে পড়তেই অর্ণবের মনে পড়লো পদ্মাবতীর কথা। সেই সাথে কাল রাতের কথা। নিজের ওপর ঘেন্না হলো অর্ণবের। গা গুলিয়ে উঠলো। ব্রেন্ডা কোনোভাবে জানতে পেরে গিয়েছিলেন অভ্র বাবু কলকাতায় আছেন। তাই সরাসরি এখানে চলে এসেছেন। অভ্র বাবু এটা জানতে পেরে সকালে সাথে সাথে জানিয়েছিলেন অর্ণবকে। দ্রুত কলকাতাতে চলে আসতে বলেন তাকে। তখন বাড়ি থেকে এক প্রকার পালিয়েই এসেছিলেন অর্ণব। এখানে এসে যেন তিনি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। কাল রাতের মতো একই ভুল যেন দ্বিতীয়বার না হয় তার জন্য একটা ব্যবস্থা করতে হবে দ্রুত। কিন্তু সেজন্য বাড়ি ফেরা জরুরি। তবে এখন বেশ কিছুদিনের জন্য আর বাড়িমুখো হবেন না-ই ঠিক করেছেন অর্ণব।
.
.
রাতের নিকষ কালো অন্ধকারে বাড়ি ফিরছেন পদ্মাবতী আর শেফালী। তাদের সামনে রামু হাতে হ্যারিকেন নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আম্রপালি পাঠিয়েছিলেন রামুকে তাদের দু’জনকে সাবধানে নিয়ে আসতে। শেফালীর মা আজ খুব আপ্যায়ন করেছেন তাদের। বাপ মরা মেয়েটা শ্বশুরবাড়িতে কেমন আছে না আছে এটা ভেবেই রাতে ঘুম হতো না তার। কিন্তু যখন শেফালীর বেশভূষা দেখে বুঝলেন মেয়েটা খুব যত্নে আছে তখন তার চোখ থেকে আনন্দের অশ্রু ঝরতে লাগলো। বাইজীবাড়ির সামনে আসতেই পদ্মাবতী দাঁড়িয়ে পড়লেন। বাড়িটা সাজানো হয়েছে। জলসা হবে। নিশ্চয়ই অনেক জায়গা থেকে লোক এসেছে। পদ্মাবতী এই বাড়ির ভেতরে কোনোদিন যাননি। শকুন্তলার কড়া নিষেধ ছিল। বাইরে থেকেই কল্পনায় সাজাতে শুরু করলেন ভেতরের দৃশ্য। রামু আর শেফালী তার থেকে অনেকটা এগিয়ে গেছেন। পদ্মাবতী সবার পেছনে থাকায় কেউ খেয়াল করেননি। শেফালী খেয়াল করা মাত্রই আবার ফিরে আসলেন। বললেন,
“কি রে? দাঁড়িয়ে পড়লি যে। কী ভাবছিস?”
“কিছু না। বাড়ি চল।”
পদ্মাবতী হাঁটতে শুরু করলেন। তার ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। মোহিনীকে নিয়ে যেন তার আর দুশ্চিন্তা রইলো না। ভালোবাসা নামক খেলায় নিজেকে জয়ী মনে হচ্ছে তার। অর্ণবকে ঠিক এভাবেই ফেরাবেন তিনি নিজের কাছে। নিজের ভালোবাসা দিয়ে। তারপর অর্ণবের সবটা জুড়ে শুধু তিনি বিরাজ করবেন। মোহিনী নামে কারও অস্তিত্ব থাকবে না অর্ণবের জীবনে।
চলবে…
#মেহেরজান
#পর্ব-৪০
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
“রোজ রোজ এই এতো মানুষের জন্য আমি রান্না চড়াতে পারবো না বলে দিলাম। যার খিদে পাবে সে নিজে রেঁধে খাক। এই আমি শুধু নিজের জন্য উনুনে ভাত চাপিয়ে দিলাম।”
রান্নাঘর থেকে কথাগুলো বেশ জোরে জোরে বললেন অনুরাধা। যেন বাড়ির সকলেই শুনতে পায়। তার কথায় শকুন্তলা বা আম্রপালি কেউ-ই কান দিলেন না। যে যার মতো নিজের কাজে ব্যস্ত। পদ্মাবতী আর শেফালী একসাথেই বসেছিলেন। পদ্মাবতী ফিসফিসিয়ে বললেন,
“এই, কী হয়েছে বলতো? বাড়ির পরিবেশ এতো গম্ভীর কেন? আবার পিসিমা এসব বলছেন যে?”
“আরে দুপুরে ছোট মামির সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে ওনার। তাই সবাই চুপচাপ।”
“কখন হলো? আমি তো দেখলাম না।”
“তুই ছাদে ছিলিস। মা আর ছোট মামি রান্নাঘরে ছিলেন। আমি আর বড় মামি এখানেই ছিলাম। হঠাৎ মা চেঁচিয়ে ওঠেন। দু’জনে গিয়ে দেখি এই অবস্থা। তারপর ছোট মামি কোনো কথা না বলে চুপচাপ চলে গেলেন। এরপর আর দু’জনে একটা কথাও বলেননি। তবে তখন কী নিয়ে কথা হয়েছিল বলতে পারলাম না।”
“সে কী! একমুহূর্তে এতোকিছু! আর তুই আমাকে এখন জানাচ্ছিস?”
“কী আর বলতাম। এসব একটু-আধটু তো হয়েই থাকে সব পরিবারে। এ আর এমন কী?”
“এটাও ভুল বলিসনি।”
“তবে দোষটা নিশ্চিত আমার শ্বাশুড়িরই। কী যে বলেছেন ওই মহিলা।”
“শেফালী! কীভাবে কথা বলছিস তুই ওনার ব্যাপারে?”
“কী? ভুল কিছু তো বলিনি। আমাকে জ্বালিয়ে মারেন ওই মহিলা। শুধু শ্বাশুড়ি বলে কিছু বলি না। এই আমি বলেই ওনার ছেলের সংসার করছি। অন্য কোনো মেয়ে হলে না এমন ষড়যন্ত্রী শ্বাশুড়ির কাছে একদিনও টিকতে পারতো না। কীভাবে আমাকে শমিতের সামনে খারাপ বানানো যায় সেই মতলব আঁটেন সবসময়।”
কিছুক্ষণের জন্য রেগে গেলেও শেফালীর বলা শেষ কথাগুলো শুনে না হেসে পারলেন না পদ্মাবতী। সব ভুলে ফিক করে হেসে ফেললেন।
“হাসিস না, হাসিস না। এমন শ্বাশুড়ি তো আর তোর কপালে জোটেনি। মায়ের মতো শ্বাশুড়ি পেয়েছিস। তুই কী বুঝবি আমার জ্বালা?”
“হয়েছে হয়েছে। আর বলতে হবে না।”
শকুন্তলাকে নিজের ঘরের দিকে যেতে দেখে শেফালী বললেন,
“ছোট মামি তো রাতে না খেয়েই ঘরে চলে গেলেন।”
পদ্মাবতী ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন।
“যাক। আমি বরং তার ঘরে খাবার দিয়ে আসবো। এমনিতেও মনে হয় না আজ পিসিমার সাথে এক টেবিলে বসে খাবেন।”
“রান্নাও বসানো হয়নি এখনো। মা তো শুধু নিজের জন্য করছেন বলেই দিলেন।”
“তুই যা রান্নাঘরে। আমি আসছি।”
শেফালী উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। অনুরাধা নেই এখানে। উনুনে ভাতের হাড়ি। রান্না করার সবকিছু গোছাতে গোছাতে একটা দুষ্টু বুদ্ধি উঁকি দিল তার মনে। আশেপাশে কেউ আছে কিনা ভালো করে দেখলেন। কাউকে দেখতে না পেয়ে উনুনের আঁচ ধীরে ধীরে বাড়িয়ে দিলেন।
.
.
দরজায় কেউ কড়া নাড়তেই শকুন্তলা চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কে?”
“আমি ছোট মা। দরজা খুলুন।”
পদ্মাবতীর আওয়াজ পেতেই শকুন্তলা দরজা খুলে দিলেন। পদ্মাবতীকে খাবারের থালা হাতে দেখে তার মনে শান্তি লাগলো। ক্ষুধার জ্বালায় পেটের মধ্যে যেন ইঁদুর দৌঁড়াচ্ছিল এতোক্ষণ।
“ভেতরে আয়।”
পদ্মাবতী ভেতরে ঢুকতেই দেখলেন শকুন্তলা ইতোমধ্যেই শোয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। খাবারের থালাটা টেবিলের ওপর রেখে বললেন,
“না খেয়েই শুয়ে পড়ছিলেন?”
“যাক। এ-বাড়িতে কেউ তো আছে যার আমার জন্য চিন্তা হয়। আমার খোঁজ নিয়েছে। নাহলে আমি রাতে খাই আর না খাই, তাতে কার কী আসে যায়।”
“আসে যায়, আসে যায়। অনেককিছু আসে যায়। এজন্যই তো খাবার নিয়ে এসেছি।”
“এনেছিস ভালো কথা। কিন্তু আমি খাবো না। ওটা তুই ফেরত নিয়ে যা।”
“খাবো না বললেই হবে নাকি? খেতেই হবে। এখন নিজে খাবেন নাকি আমাকে খাইয়ে দিত হবে?”
“ঢং দেখো মেয়ের! আমাকে এসেছে খাইয়ে দিতে। না জানি কত বড় হয়ে গেছে। দু’দিন আগেও যে নাকি কেউ খাইয়ে না দিলে খাবার মুখে তুলতো না, সে এসেছে আমাকে খাইয়ে দিতে।”
পদ্মাবতী ভাত মাখাতে মাখাতে বললেন,
“আপনার ওই দু’দিন দশ বছর আগেই চলে গেছে ছোট মা।”
“সে যাক। তাতে কী হয়েছে? তুই তো আর বদলাসনি। আগে যেমন ছিলি, এখনও তেমনই আছিস। অল্পতেই কেঁদে ফেলিস।”
শকুন্তলার মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে পদ্মাবতী বললেন,
“একদম না। কই কাঁদি আমি? পারলে দেখান।”
“আরেকবার কাঁদতে দেখি। তখন বলবো।”
“পিসিমার সাথে কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল ছোট মা?”
শকুন্তলা চুপ মেরে গেলেন। পদ্মাবতী উৎসুক দৃষ্টিতে উত্তরের অপেক্ষা করছেন। শকুন্তলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
“শমিত এখন আর বেকার বসে নেই। কাজ করে। নিজের মা আর স্ত্রীকে দেখার মতো সামর্থ্য আছে ওর। তাই দিদিকে বলেছিলাম কতদিন আর ভাইয়ের সংসারে থাকবে। এখন আলাদা হলেও তো পারে। তাতেই উনি এমন উত্তেজিত হয়ে গেলেন।”
পদ্মাবতী বলার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেলেন না। চুপচাপ শকুন্তলার কথাগুলো শুনলেন।
“তুই-ই বল। আমি কি ভুল কিছু বলেছি? যা বলেছি ভালোই তো বলেছি।”
পদ্মাবতী মুখ ফুটে বলতে পারলেন না, “হ্যাঁ, আপনি ভুল বলেছেন। এটা পিসিমারও বাড়ি। উনি নিজের ইচ্ছে মতো এখানে থাকতে পারেন।” আর যাই হোক, এভাবে মুখের ওপর বলাটা হবে চরম বেয়াদবি। মোহিনীর কথা মনে পড়তেই মনে মনে হেসে ফেললেন তিনি। মোহিনী হলে নিশ্চয়ই ছোট মার মুখের ওপর এসব বলে দিত। এতে তার কেমন লাগলো না লাগলো সেটা দেখার ওর প্রয়োজন নেই। শকুন্তলার খাওয়া শেষ হলে চুপচাপ চলে এলেন পদ্মাবতী।
.
.
.
মোহিনীর মুখোমুখি দাঁড়াতেও লজ্জা করছে অর্ণবের। মনের মধ্যে তীব্র অপরাধবোধ কাজ করছে। তার প্রতি মেয়েটার বিশ্বাস ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। রাগে দুঃখে নিজের চুল টেনে ছিড়তে ইচ্ছে করছে এখন তার। মোহিনী অনেক্ষণ ধরেই তার উদ্দেশ্যে কিছু বলে চলেছেন কিন্তু অর্ণবের সেদিকে মন নেই। শুধু হুম, হ্যাঁ তে জবাব দিচ্ছেন। মোহিনীর সাথে পরীও এসেছে আজ। সে অর্ণবকে চেনে। তাদের বাড়িতে দেখেছে। কৌতূহলী হয়ে দরজার কাছে এসে উঁকি দিয়ে দেখতো অর্ণবকে। কিন্তু কথা বলেনি কখনো নিজে থেকে। অর্ণব ডাকলে দৌঁড়ে পালিয়ে যেত। অর্ণবকে শুধু হুম, হ্যাঁ করতে দেখে পরী মোহিনীর কানের কাছে এসে বললো,
“ও তোমার কথা শুনছে না মোহিনী দিদি।”
মোহিনী ভ্রুকুটি করে অর্ণবের দিকে তাকালেন। বললেন,
“আমি কী বলছি শুনছেন আপনি?”
“হুম।”
মোহিনী অর্ণবের কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকালেন।
“কী হয়েছে আপনার? কথা বলছেন না কেন ঠিক করে?”
“কিছু হয়নি মেহের।”
“রেগে আছেন আমার ওপর?”
“না, রেগে থাকবো কেন?”
“সেদিন আপনার সাথে ঝগড়া করলাম। তারপর থেকে তো আর একদিনও এলেন না। আমি প্রতিদিন আসতাম। আপনাকে না পেয়ে ফিরে যেতাম।”
“গ্রামের বাইরে ছিলাম এতোদিন। আজই ফিরেছি।”
“কোথায় ছিলেন?”
“কলকাতায়।”
“সেজন্যই তো বলি হঠাৎ করে এমন উধাও হয়ে গেলেন কী করে। জানেন আমি কত কষ্ট পেয়েছি?”
“আমি দুঃখিত মেহের। ক্ষমা করবেন না আমাকে?”
মোহিনী অর্ণবের কাঁধে মাথা রাখলেন। বললেন,
“ভালোবাসেন আমাকে?”
“হুম।”
“তাহলে আমিও ক্ষমা করে দিলাম। আপনার সব ভুল ক্ষমা করে দিলাম।”
পরী মোহিনীর উদ্দেশ্যে বললো,
“ও কী ভুল করেছে মোহিনী দিদি?”
মোহিনীর জবাব দেওয়ার আগেই অর্ণব পরীকে হাতে ধরে তার সামনে এনে দাঁড় করালেন। বললেন,
“এইযে তোমার মোহিনী দিদিকে কষ্ট দিয়েছি।”
“কাউকে কষ্ট দিলে ক্ষমা চাইতে হয়?”
“অবশ্যই।”
“মোহিনী দিদিকে তো আরও অনেকে কষ্ট দিয়েছে। তাহলে তারা কেন ক্ষমা চায় না?”
“কে কষ্ট দিয়েছে? নাম বলো আমাকে তাদের। আমি নিজে ওদের শাস্তি দেব।”
“তোমার বাড়ির লোকেরা।”
অর্ণব কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলেন। কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। পরীর কথায় মোহিনী মনে মনে খুশিই হয়েছেন। তবুও ধমকের সুরে বললেন,
“পরী! তোকে এসব কে বলেছে?”
“ঊর্মিলা দিদি।”
“আজকাল তুই একটু বেশিই ঊর্মিলার সাথে থাকছিস। ওর সাথে এতো থাকা বন্ধ করতে হবে।”
অর্ণব বললেন,
“তারা এখনো নিজের ভুল বুঝতে পারেনি পরী। যখন বুঝবে তখন তারা নিজেরাই এসে তোমার মোহিনী দিদির কাছে ক্ষমা চাইবে। এখন এসব বাদ দাও। আমাকে বলো তো, তুমি আমাকে দেখলে ভয় পেয়ে পালিয়ে যাও কেন? আমি বাঘ না ভাল্লুক যে খেয়ে ফেলবো তোমাকে?”
পরী দৌঁড়ে এসে মোহিনীর পেছনে দাঁড়ালেন। উঁকি দিয়ে বললেন,
“আমি ভয় পাই না তোমাকে। আমি চিনি তোমাকে।”
“আচ্ছা! আমাকে চেনো তুমি? কীভাবে চিনলে?”
“দেখেছি আমাদের বাড়িতে।”
“দেখলে কী হবে? তুমি তো আমার সাথে কথাই বলোনি কোনোদিন।”
“বলেছি।”
“কবে বললে? আমার তো মনে পড়ছে না?”
“আরও অনেকদিন আগে। যখন তুমি আর তোমার বন্ধু এসেছিলে মোহিনী দিদির নাচ দেখতে।”
অর্ণব বিব্রতবোধ করলেন। এই বাচ্চা মেয়েটার যে এতো পুরনো কথাও মনে থাকবে তা বুঝতে পারেননি তিনি। মোহিনী বললেন,
“লুকিয়ে লুকিয়ে তাহলে নাচও দেখতে আসতেন আপনি! হাহ, আর মুখেই যত কথা। আপনি আর নাচবেন না মেহের। এটা করবেন না। সেটা করবেন না। আরও কত কী।”
অর্ণব একটা শুকনো ঢোক গিললেন।
চলবে…