মেহেরজান পর্ব-৩৭+৩৮

0
339

#মেহেরজান
#পর্ব-৩৭
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

দূর থেকে শেফালীকে দেখছেন আম্রপালি। দু’দিনেই কেমন শুকিয়ে গেছেন। সবসময় মনমরা হয়ে থাকেন। কিন্তু শমিত থাকা অবস্থায় এমন ছিলেন না। তখন সবসময় হাসিখুশি থাকতেন। ওদিকে কাজের চাপ বাড়ায় অভ্র বাবু বারবার তাড়া দিচ্ছিলেন শমিতকে ফেরার জন্য। তাই সময় পুরো হওয়ার দু’দিন আগেই ফিরে যেতে হলো ছেলেটাকে। তারপর থেকেই শেফালী যেন একদম চুপচাপ হয়ে গেলেন।

“এই শেফালী, এদিকে আয়।”

আম্রপালি ডাকা মাত্র দৌঁড়ে চলে এলেন শেফালী।

“বলুন।”

“বস এখান আমার পাশে।”

“কেন?”

“আহ! বস তো। এতো কথা বলিস কেন তুই?”

শেফালী তার পাশে বসে পড়লেন। আম্রপালি সুঁই সুতো দিয়ে কাপড়ে ফুলের নকশা তুলছিলেন। শেফালীকে দেখিয়ে বললেন,

“সেলাই পারিস?”

“হুম। ছোটবেলা থেকেই। মা শিখিয়েছিল আমায়।”

“এইনে। এটায় কর।”

শেফালী আম্রপালির হাত থেকে সুঁই সুতো নিয়ে নিজে সেলাই তুলতে লাগলেন।

“মায়ের কথা মনে পড়ে না তোর?”

“পড়বে না কেন? পড়ে তো। খুব মনে পড়ে। কিন্তু কী আর করবো?”

“তাহলে দেখা করতে যাস না কেন?”

“উনি যেতে দেবেন?”

“কে?”

“কে আবার? আমার শ্বাশুড়ি।”

“কেন যেতে দেবেন না? আর তুই-ই তো বলিস, উনি নাকি সবসময় তোকে এই বাড়ি থেকে বের করার ফন্দি আঁটেন।”

“আঁটেন না আবার?”

“তাহলে? তুই তোর মায়ের বাড়ি গেলে উনি খুশিই হবেন। বলবেন, যাক বাবা, বাঁচলাম অবশেষে এই মেয়েত হাত থেকে।”

শেফালী হেসে উঠলেন।

“কী করবো তাহলে? যাবো?”

“কাছেই তো। গিয়ে থেকে আয় দু’দিন। তোর মন ভালো হবে।”

“আমার মন খারাপ কখন হলো?”

“দেখছি তো আমি। শমিত যাওয়ার পর থেকে সবসময় মনমরা হয়ে থাকিস।”

“ঠিক তা নয়। কিন্তু মাকে বললে যদি যেতে নিষেধ করেন?”

“বলিস না ওনাকে। তুই চুপচাপ যা। আমি পরে জানিয়ে দেব।”

“যদি রেগে যান।”

“সামলে নেব আমি। চিন্তা করিস না।”

শেফালীর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।
.
.
বাইরে যাচ্ছিলেন অর্ণব। সদরদরজা দিয়ে বের হতেই কাউকে আসতে দেখলেন। হাতে মিষ্টির হাড়ি। অর্ণব সামনে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“আপনি?”

অপরজন দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বললেন,

“নমস্কার। আমি শ্যামল। শেফালীর দাদা। ওকে নিয়ে যেতে এসেছি। ভালো আছেন তো আপনি?”

অর্ণবের মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল একথা শুনে। কোনোদিন না দেখলেও ও কে তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি অর্ণবের। শ্যামল বললেন,

“শেফালী ভেতরে তো? আমি বরং ওকে নিয়ে আসি।”

অর্ণব কোনো জবাব দিলেন না। শ্যামল বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। হঠাৎ পেছন থেকে অর্ণব বলে উঠলেন,

“শেফালী ভেতরে নেই।”

দাঁড়িয়ে পড়লেন শ্যামল। অর্ণবের দিকে ঘুরে বললেন,

“ভেতরে নেই! তাহলে কোথায়?”

“বাগানে।”

“হ্যা?”

“বাড়ির পেছনের বাগানে। ওদিকেই যেতে দেখলাম কিছুক্ষণ আগে ওকে। আপনার জন্য ওখানেই অপেক্ষা করছে।”

শ্যামল কিছুটা অবাক হলেন।

“ওখানে যেতে বলেছে আমায়?

“হুম। চলুন আমি নিয়ে যাই।”

শ্যামলকে নিয়ে অর্ণব বাড়ির পেছন দিকে যেতে লাগলেন। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে বাগানের পর দিঘি ছাড়িয়ে চলে এলেন। শ্যামল একটা শুকনো ঢোক গিললেন। অর্ণবের দিকে না তাকিয়েই বললেন,

“শেফালী কোথায়? ওকে তো দেখছি না।”

অর্ণবের কোনো জবাব এলো না। এখন ভয় লাগতে শুরু করলো শ্যামলের। কোনো ভূতপ্রেত এর পাল্লায় পড়লেন নাকি ভেবেই গলা শুকিয়ে গেল তার। এমনিতেই সন্ধেবেলা। এদিকটাও যেন দেখতে কেমন কেমন। এমন সময় একা এখানে আসলে ভয়ে যেকেউ অজ্ঞান হয়ে যেত। হাত দিয়ে কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে অর্ণবের দিকে ঘুরলেন তিনি। সাথে সাথেই চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। এরই মাঝে অর্ণব কোথা থেকে যেন একটা লাঠি নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। শ্যামল কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। তার আগেই অর্ণব লাঠি দিয়ে ইচ্ছেমতো পেটাতে শুরু করলেন তাকে। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করে চলেছেন। মুখে শুধু একটাই কথা “আজ শুধু তোর জন্য আমার বোন আত্ম/হ/ত্যা করেছে। তুই মে/রে/ছিস ওকে, খু/নি তুই।” মাথায় জোরে আঘাত করতেই গলগল করে রক্ত পড়তে লাগলো শ্যামলের।

আম্রপালি বেশ জোরে দরজা খুলে শেফালীর ঘরে ঢুকে পড়লেন। তাকে দেখেই শেফালী বলে উঠলেন,

“দেখুন না বড় মামি। সেই কখন বাড়িতে খবর পাঠিয়ে বিকেল থেকে তৈরি হয়ে বসে আছি। দাদা নাকি নিতে আসবে। অন্ধকার হয়ে গেল কিন্তু এখনো নিতে এলো না কেউ।”

“যেতে হবে না তোকে। তোর দাদা আসবে না।”

“কেন?”

“কে যেন তোর দাদাকে মে/রে রক্তাক্ত করে ক্ষেতে ফেলে রেখেছিল। দু’জন জেলে ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় অচেতন অবস্থায় পেয়েছে ওকে। তারপর তোদের বাড়ি খুঁজে বের করে দু’জন ধরাধরি করে ওকে দিয়ে এসেছে।”

বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন শেফালী।

“কী!”

“হুম। চিন্তা করিস না তুই এখন আর। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শুনলাম।”

আম্রপালির কথাগুলো শুনে শেফালী একদম হা হয়ে গেছেন। বিশ্বাসই করতে পারছেন না কিছুতে।
.
.
.
বহুদিনের পুরনো ভাঙা পরিত্যক্ত এক শিবমন্দিরে বসে আছেন মোহিনী। তার একটু দূরেই অর্ণব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগার খাচ্ছেন। এর গন্ধ মোহিনীর সহ্য হয় না। তাই মোহিনীর সামনে সিগার না জ্বালানোর যথাসম্ভব চেষ্টা করেন অর্ণব। চাঁপা ফুলের তীব্র গন্ধ ভেসে আসছে। কাছেপিঠেই কোথাও চাঁপা ফুটেছে। কিন্তু মোহিনীর হাতে কদম। ফুলের সাদা অংশটা একটা একটা করে তুলে ফেলে দিচ্ছেন তিনি। তার মাথায় চলছে অন্য চিন্তা। মোহিনী নিজে যে কষ্টটা পেয়েছেন তার শতগুণ কীভাবে পদ্মাবতীকে ফিরিয়ে দেওয়া যায় তা-ই ভাবছেন। কিন্তু এর জন্য তার অর্ণবকে প্রয়োজন। অর্ণবের মাধ্যমেই তাকে নিজের কার্যসিদ্ধি করতে হবে। এতে অর্ণবের ওপর কী প্রভাব পড়বে তাতে মোহিনীর কিছু যায় আসে না। যার জন্য এতোকিছু হলো, সে কেন ছাড় পাবে? অর্ণব ফিরতেই মোহিনী বলে উঠলেন,

“আমায় বিয়ে করবেন অর্ণব?”

“করবো। কিন্তু তার আগে পদ্মাবতীকে ছাড়তে হবে।”

“আমি চাই আপনি এখনই আমাকে বিয়ে করুন।”

“সেটা সম্ভব নয় মেহের।”

মোহিনী উত্তেজিত হয়ে বললেন,

“কেন? পদ্মাকে তো ঠিকই বলার সাথে সাথে বিয়ে করে ফেলেছিলেন।”

“কতবার আপনাকে বলেছি মেহের? আর কতবার বলবো? বিয়েটা আমার ইচ্ছেতে হয়নি। তবুও আপনি কথায় কথায় এই বিষয়টা বারবার টেনে আনেন।”

অর্ণবকে ঠিক কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে তা বেশ ভালো করেই জানেন মোহিনী। উঠে অর্ণবের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,

“ঠিকাছে। অন্তত সিঁদুরটা তো পরিয়ে দিন। কিসের ভরসায় থাকবো আমি আপনার?”

অর্ণবের সামনে ছোট্ট একটা সিঁদুর কৌটা তুলে ধরলেন মোহিনী।

“বাচ্চাদের মতো আচরণ করবেন না মেহের। আর এটা আপনি কোথায় পেলেন?”

“যেখানেই পাই। আমাকে এটা পরিয়ে দিতে আপনার সমস্যাটা কোথায়? নাকি সাহস নেই?”

“আমার সাহস নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না মেহের। আপনি জানেন আমি কী কী করতে পারি।”

“বেশ। এতোই যখন সাহস তাহলে সিঁদুরটা পরিয়ে দিন আমাকে। ভয় পাচ্ছেন কেন?”

“আমি ভয় পাচ্ছিনা।”

“পাচ্ছেন। আমাকে সিঁদুর পরানোর এতটুকুও সাহস নেই আপনার।”

অর্ণব আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলেন না। মোহিনীর বলা কথাগুলোর একেকটা শব্দ যেন তার গায়ে এসে খোঁচা মেরে যাচ্ছে। অগত্যা সিঁদুরটা মোহিনীর সিঁথিতে পরিয়ে দিতে হলো তাকে।

“খুশি এবার?”

মোহিনীর চেহারায় হাসি ফুটে উঠেছে। কিন্তু অর্ণবের হাতে শুধু সিঁদুর পরাটা মোহিনীর উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য পূরণের জন্য পরবর্তী কাজটা করলেন তিনি। অর্ণবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। তার সাদা পাঞ্জাবীতে সিঁদুরের দাগ লাগিয়ে দিলেন।

“অনেক খুশি।”

মোহিনীকে ছাড়িয়ে নিলেন অর্ণব। নিজের খুব একটা কাছে আসতে দেননা তিনি মোহিনীকে, যদি না মোহিনী নিজে থেকেই হঠাৎ করে এসে পড়েন তো। তার বিবেক তাকে বাঁধা দেয় এ কাজে।

“এখন আপনার বাড়ি ফেরা উচিত।”

“পৌঁছে দিয়ে আসুন। এতোরাতে একা যেতে পারবো না।”

অর্ণব অধর প্রশস্ত করলেন। তিনি জানেন মোহিনী একাই যেতে পারবেন। তবুও তাকে পৌঁছে দিতে বলছেন।

“চলুন।”

মোহিনীকে তার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজে বাড়িতে ফিরলেন অর্ণব। ভুল করে নিজের ঘরে ঢুকে পদ্মাবতীকে দেখতেই আবার ঘুরে যাচ্ছিলেন অর্ণব। পেছন থেকে পদ্মাবতী ডেকে উঠলেন।

“শুনুন।”

না চাইতেও দাঁড়ালেন অর্ণব।

“কী সমস্যা?”

পদ্মাবতী অর্ণবের সামনে এসে কিছু বলতে যাবেন তখনই তার চোখ পড়লো পাঞ্জাবীতে লেগে থাকা সিঁদুরের ওপর। সবকিছু যেন মুহূর্তেই তালগোল পাকিয়ে গেল তার৷ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন,

“আপনি বিয়ে করেছেন? ঘরে বউ থাকতে আরেকটা বিয়ে করেছেন আপনি?”

পদ্মাবতীর এমন আচরণে অর্ণবও কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলেন। এরপরই এমন ব্যবহারের কারণ খুঁজে পেলেন। সিঁদুরের দাগটা আগে খেয়াল করেননি তিনি। কিছু বলতে যাবেন কিন্তু তাকে বলার সুযোগ না দিয়েই পদ্মাবতী আবার বলতে শুরু করলেন,

“ওই মেয়েটাকে বিয়ে করেছেন না? ওই মোহিনীকে বিয়ে করেছেন? কোন সাহসে? কোন সাহসে ওই নোংরা মেয়েটাকে বিয়ে করলেন আপনি?”

অর্ণব স্ব জোরে পদ্মাবতীর গালে চড় বসিয়ে দিলেন। এরপর নিজের ওপরই রাগ হলো তার। আগে কখনো কোনো মেয়ের গায়ে হাত তোলেননি তিনি। নিজেকে শক্ত রেখে বললেন,

“মেহেরের ব্যাপারে একটা খারাপ কথাও শুনতে চাই না আমি। তোমার এতো বড় স্পর্ধা হলো কী করে ওকে কিছু বলার? এতো সাহস কে দিল তোমায়? আর কোনোদিন তোমার মুখে ওর নামটাও শুনতে চাই না আমি। মনে থাকে যেন।”

পদ্মাবতীকে আঙুল তুলে শাসিয়ে গেলেন অর্ণব। গালে হাত দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন পদ্মাবতী। নিজের চোখের জলকে আটকাতে গিয়ে বারবার কেঁপে উঠছেন তিনি।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৩৮
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

জরুরী একটা কাজে যেতে হবে অর্ণবকে। কিন্তু মোহিনীকে কিছুতেই যাওয়ার কথা বলতে পারছেন না তিনি। বললে যে মোহিনী রেগে যাবেন তা নিশ্চিত। কিন্তু কাজটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। না গিয়ে উপায় নেই। একটু পর পরই হাতঘড়িতে সময় দেখছেন তিনি। বিরক্ত হয়ে মোহিনীই জিজ্ঞেস করলেন,

“আপনার সমস্যা কী বলুনতো? একটু পর পর সময় দেখছেন কেন?”

“আমার একটা ছোট্ট কাজ ছিল। যেতে হবে আমাকে।”

“কিসের কাজ?”

“সেটা বলা যাবে না এখন। একটু গোপনীয়। পরে জানতে পারবেন।”

অর্ণবের কথায় যেন মোহিনীর রাগ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

“মিথ্যে বলছেন আপনি। আপনার কোনো কাজ নেই।”

“আশ্চর্য তো! আমার কোনো কাজ থাকতে পারে না?”

“কোনো চাকরি-বাকরি তো আর করেন না আপনি। বাড়িতেই থাকেন সবসময়। কিসের কাজ তাহলে আপনার? নাকি অন্য কিছু?”

মোহিনীর কথায় খোঁটা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন অর্ণব। তার হাত শক্ত করে ধরে বললেন,

“অন্য কিছু মানে? কী বলতে চান আপনি?”

“বউয়ের কথা খুব মনে পড়ছে তাই না? পদ্মার কাছে যাবেন নিশ্চয়ই?”

“অনেক হয়েছে মেহের। আপনি এখন সীমা অতিক্রম করে ফেলছেন।”

মোহিনী ঝ্যাংটা দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,

“সীমা আমি না আপনি অতিক্রম করছেন। আপনার মধ্যে পরিবর্তন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি।”

“চুপ করুন মেহের। অযথা বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলবেন না দয়া করে।”

“মিথ্যে বলছি না আমি। যা দেখতে পাচ্ছি সেটাই বলছি। আজকাল আপনার মন একটু বেশিই বাড়িতে পড়ে থাকে। কেন বলুন তো? নাকি পদ্মার প্রতি আপনার অনুভূতি তৈরি হচ্ছে?”

অর্ণব ধমকের সুরে বলে উঠলেন,

“ব্যস মেহের। অনেক বেশি বলে ফেলেছেন। আর একটা শব্দও উচ্চারণ করবেন না আপনি।”

মোহিনী ভয়ে একবার কেঁপে উঠলেন। কিছু বলতে গেলে অর্ণব তাকে থামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। অনুশোচনায় নিজের দু’গালে দুটো চড় মে/রে বসে পড়লেন মোহিনী। প্রচুর রাগ হতে লাগলো নিজের ওপর। অর্ণবকে সবসময় একটা অপরাধবোধে রেখে তার থেকে আরও বেশি ভালোবাসা পেতে চান মোহিনী। কিন্তু আজ মনে হয় একটু বেশিই বলে ফেলেছেন তিনি। প্রচন্ড রেগে গেছেন অর্ণব। আগে কখনো এভাবে রাগতে দেখেননি তাকে। এমনকি উচ্চস্বরে তার সাথে কথা পর্যন্ত বলেননি কখনো। রাগে টেনে টেনে নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে মোহিনীর।
.
.
.
মেঘলা আকাশ। যেকোনো সময়ই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামবে। সাদা কালো মেঘের মাঝেই উড়ছে রঙ-বেরঙের ঘুড়ি। দূরে একদল বাচ্চারা ওড়াচ্ছে। পদ্মাবতীর হাতেও একটা রয়েছে। ঘুড়ির লাটাই হাতে নিয়ে ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু তিনি ঘুড়ি ওড়াতে জানেন না। মোহিনী জানতেন। সবসময় তিনিই ওড়াতেন। পদ্মাবতী তার সাথে থাকতেন। তাদের ঘুড়িটা উড়তো সবচেয়ে উচুতে। সবার ঘুড়ি ছাড়িয়ে। মোহিনীর কথা মনে পড়লেই অর্ণবের দেওয়া সকল যন্ত্রণার কথা মনে পড়ে যায় পদ্মাবতীর। প্রথমবার কেউ হাত তুলেছে তার গায়ে। তার ভালোবাসার মানুষটাই। যাকে কি-না সবথেকে বেশি ভালোবাসেন তিনি। যার জন্য মোহিনীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে দু’বার ভাবেননি তিনি। সেই মোহিনীর জন্যই অর্ণব তাকে চড় মা/রলেন। মনের মধ্যে একটা তীব্র ব্যথা অনুভব করলেন পদ্মাবতী। ভেতরে ভেতরে প্রলয় বয়ে গেলেও বাইরে থেকে সবসময় নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছেন। অর্ণবকে বাড়িতে ফিরতে দেখলেন ওপর থেকে। কিছুক্ষণ বাদেই আবার দ্রুত বেরিয়ে যেতে দেখলেন। গায়ে জ্বলুনি উঠে গেল তার। ছাদের কিনারা থেকে ধাক্কা দিয়ে একটা ফুলের টব নিচে ফেললেন। বিকট শব্দে টবটা পড়ে ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে তা থেকে সব মাটি ছড়িয়ে পড়লো। অর্ণব ফিরেও তাকালেন না। নিজের মতো চলে গেলেন। কিন্তু রামু আওয়াজ পেয়ে দৌঁড়ে এলেন। নিচে ভালো করে দেখে ওপরে তাকালেন। পদ্মাবতীকে দেখতেই ডাক দিলেন। কিন্তু পদ্মাবতী কোনো উত্তর না নেওয়ায় তিনি আবার চলে গেলেন। পদ্মাবতী অপলকভাবে সামনে তাকিয়ে রইলেন। রাগ, দুঃখ, অনুশোচনা একত্রে গ্রাস করছে তাকে। তবুও নিজের মনকে বুঝ দিতে লাগলেন তিনি। নিজের মনেই বিড়বিড় করতে লাগলেন,

“আমি নিজের সিদ্ধান্তে অনুতপ্ত নই। উনি আমাকে ভালোবাসেন না তাতে কী? আমি তো বাসি। এতে আমার কোনো অনুশোচনা নেই। মোহিনী ওনাকে যতটা ভালোবাসে, তার চেয়েও হাজার গুন বেশি আমি ভালোবেসেছি ওনাকে। তাকে পাওয়ার অধিকারও একমাত্র আমার। শুধু আমার।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলতে লাগলেন,

“তুই দেখিস মোহিনী, উনি ভুলে যাবেন তোকে। চিরকালের জন্য ভুলে যাবেন। আমি ভুলিয়ে দেব। তারপর উনি শুধু আমাকে ভালোবাসবেন।”

অসতর্কতাবশত ঘুড়ির সুতোয় আঙুল কেটে গেল পদ্মাবতীর। অজান্তেই “আহ” করে চেঁচিয়ে উঠলেন। আঙুল থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। সাথে সাথে আঙুল মুখে নিয়ে চেপে ধরলেন। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি। দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে নিচে বসে পড়লেন কাঁদতে কাঁদতে। মেঘ গর্জে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় ভিজে যাচ্ছে তার শরীর। কিন্তু বর্ষার এই বারিধারা তার দেহের উত্তাপ কমাতে পারলেও অনুশোচনার অনলে পুড়তে থাকা তার হৃদয়কে রক্ষা করতে ব্যর্থ।
.
.
.
একশো দুই ডিগ্রি জ্বর। আম্রপালি ওষুধ খাইয়ে দিলেন পদ্মাবতীকে। একবার কপালে আর গালে হাত রাখলেন। বললেন,

“ভিজেছিস কেন বৃষ্টিতে?”

“এমনি ইচ্ছে করলো একটু ভিজতে।”

“ঠিকই জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছিস। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে একদম। ওষুধটাও খাসনি। ভাগ্যিস আমি এখনো জেগে ছিলাম। এদিকে না আসলে তো জানতেও পারতাম না।”

“আমি কি জানতাম নাকি যে এই অল্পতেই জ্বর আসবে? আর ভিজবো না বৃষ্টিতে।”

“জ্বর বাঁধিয়ে বলছিস আর ভিজবো না। এজন্যই বলে চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।”

পদ্মাবতী বিছানায় শুয়ে পড়লেন। আম্রপালি তার গায়ে একটা কাঁথা টেনে দিয়ে বললেন,

“ঘুমিয়ে পড়। আমারও ঘুম পাচ্ছে প্রচুর।”

পদ্মাবতী হালকা ঘাড় কাত করলেন। আম্রপালি দরজা ভেজিয়ে চলে গেলেন। চোখ বুজে রইলেন পদ্মাবতী। কিন্তু ঘুম আসলো না তার। সময় গড়াচ্ছে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। ঘামতে শুরু করেছেন তিনি। জ্বর ছাড়ছে। গরম লাগছে এখন। গা থেকে কাঁথা সরিয়ে দিলেন। ঘড়ির দিকে তাকালেন। ঘড়ির কাঁটা তিনটা ছুই ছুই। বাইরে বৃষ্টির শব্দ কানে আসছে। উঠে গিয়ে জানালাটা খুলে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লেন। ঠান্ডা বাতাস আসছে। সাথে হালকা বৃষ্টির ছিটা এসেও মুখে লাগছে তার। ভালো লাগছে এখন।

গভীর রাত। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ক’টা বাজে খেয়াল নেই অর্ণবের। মদের নেশায় চূড় হয়ে এলোমেলো পা ফেলছেন তিনি। এরই মাঝে দু’বার পিছলে পড়েছেন কাদায়। এবার তৃতীয়বারের মতো পড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,

“ধুর সালা। কোথাও দু’দন্ড শান্তি নেই। না বাইরে, না বাড়িতে। বাইরে প্রেমিকা অবিশ্বাস করে আর বাড়িতে বউয়ের যন্ত্রণা। বউ! ওই একটা জিনিসই তো সব নষ্টের গোড়া। ওই একটা মেয়েই আমার জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে। আর আমি অর্ণব, কিচ্ছু করলে পারলাম না। আমার জীবনের ওপর আমারই কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যে যেমন পারছে চালাচ্ছে। আর আমি কাঠেরপুতুলের মতো তাদের ইশারায় চলছি।”

বলতে বলতে নিজেই হেসে উঠলেন অর্ণব। বাড়িতে চলে এসেছেন তিনি। কিন্তু চারিদিক অন্ধকার। বিদ্যুৎ নেই। ঝড়-বৃষ্টিতে এই এক যা সমস্যা। একটু হাওয়া বইলেই বিদ্যুৎ চলে যায়। এতোক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়ির সবাই ঘুমিয়েও পড়েছে। ধীরে ধীরে সিড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসলেন তিনি। বহুদিনের অভ্যেস। সহজে বদলায় না। তাই নেশার ঘোরে ভুল করে নিজের ঘরেই চলে আসলেন। দরজা খুলতেই দেখলেন পদ্মাবতী গুটিসুটি মে/রে উল্টোদিকে ঘুরে বিছানায় শুয়ে আছেন। কোমরে একটা গভীর ভাজ পড়েছে তার। শাড়িটা এলোমেলো হয়ে কোনোরকম গায়ে জড়িয়ে আছে। ঠান্ডায় একটু পরপর কেঁপে উঠছেন তিনি। অর্ণব আরেকটু ভালো করে দেখতেই বুঝলেন কাঁপছেন না তিনি। কাঁদছেন! নিঃশব্দে কাঁদছেন। আর একটু পরপর পিঠটা ফুলে ফুলে উঠছে। অর্ণবের হাতের ধাক্কায় কিছু একটা পড়ে যেতেই তার শব্দে চমকে উঠে দাঁড়ালেন পদ্মাবতী। সামনে এসে দাঁড়ালেন অর্ণবের। ভেজা সাদা পাঞ্জাবী ভেদ করে বুকের কালো তিলটা দৃশ্যমান তার। পদ্মাবতী না চাইতেও সেদিকে চোখ চলে গেল। সাথে সাথে আবার নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন তিনি। চোখের দিকে তাকালেন তার। অর্ণব মাতাল চোখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। পদ্মাবতীর পদ্মপাপড়ির মতো, দীর্ঘপল্লববিশিষ্ট চোখ দুটো জলে টলমল করছে। ঠোঁট দুটো মৃদু কাঁপছে। যেন কিছু বলতে চাইছে। মনে হচ্ছে বারবার সামনে মোহিনীকে দেখছেন অর্ণব। ভুল দেখছেন না সঠিক দেখছেন তা পরখ করার মতো অবস্থায় নেই তিনি। কী ভেবে কে জানে, পদ্মাবতীকে কাছে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন তিনি। নিজের অধরদ্বয় মিশিয়ে দিলেন তার অধরে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে