মেহেরজান পর্ব-৩৫+৩৬

0
347

#মেহেরজান
#পর্ব-৩৫
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

বাড়ির সদরদরজার সামনে পায়চারি করছেন শমিত। আর একটু পর পরই বাইরে উঁকি দিয়ে দেখছেন। অবশেষে অর্ণবকে আসতে দেখেই এগিয়ে গেলেন সেদিকে। তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন তিনি। শমিতের আসার খবর পেয়ে অর্ণবও আর সেখানে বসে থাকতে পারলেন না। চলে এলেন ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। কোলাকুলি করে শমিত বললেন,

“কী খবর বন্ধু?”

“খবর তো দেখতেই পারছিস।”

“এতোদিন পর দেখা হলো। চল ছাদে গিয়ে আড্ডা দেই। বাজার থেকে বড় বড় মিষ্টি আম আনিয়েছি তোর আর আমার জন্য। শেফালীকে বলে রেখেছি তুই এলে কেটে দিতে। হয়ে যাক আবার তোর আমার সেই ছেলেবেলার মতো আম খাওয়ার প্রতিযোগিতা।”

“দাঁড়া তাহলে। আমি ঘরে গিয়ে একটু হাতমুখ ধুয়ে আসছি।”

“আরে আমার ঘরে চল। একই তো হলো।”

শমিত অর্ণবকে তার ঘরে নিয়ে এলে অর্ণব চোখে মুখে জল ছিটিয়ে নিলেন। দুপুরে খাওয়ার পর লম্বা একটা ঘুম দিয়েছিলেন অর্ণব। ঘুম ভেঙেছে রামুর ডাকে। এরপর মোহিনীকে কোনোরকম জানিয়ে ঘুম ঘুম চোখেই চলে এসেছেন তিনি। তাকে বাড়ি পর্যন্ত দিয়ে রামুও নিজের কাজে চলে গেছেন। হাতমুখ ধুয়ে শমিতের সাথে ছাদে চলে গেলেন তিনি। কারও সাথে দেখা করার প্রয়োজনবোধ করলেন না।

“এবার বল। এসব হলো কী করে? মানে এমন কী হলো যে তোর আর পদ্মার বিয়ে হয়ে গেল?”

“তুই যাওয়ার পরে এখানে অনেককিছুই ঘটেছে। হঠাৎ করে মা যেন কেমন পাল্টে গেলেন। মোহিনীকে দেখতেই পারেন না একদম। পদ্মাবতীর সাথে বিয়ের জন্য চাপ দিতে লাগলেন। যেদিন বিয়েটা হলো সেদিন সকালে ঠাম্মা অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাই। ঠাম্মার অসুস্থতাকেই কাজে লাগিয়েছেন মা। আসলে সবই ছিল ছোটমার মায়ের বুদ্ধি। কে জানে কীভাবে কী বুঝিয়েছেন মা আর ঠাম্মাকে। প্রথমে তো শুধু মা ছিলেন। এরপর হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ঠাম্মাও একই কথা শুরু করলেন। বাধ্য হয়েই বিয়েটা করতে হয় আমাকে।”

“তার মানে সবকিছুর পেছনে ছিল ছোটমার মা। এই বুড়িটা তো দেখা যায় সুবিধার না একদমই। উনিই কিন্তু বলেছিলেন তোকে আর আমাকে মামার কাছে পাঠাতে। শুধু মা বাঁধা দিয়েছিলেন বলে আমাকে পাঠাতে পারেননি। তোকে একাই যেতে হয়েছে।”

“আছে নাকি এখনো বাড়িতে?”

“ছোটমার মা।”

“নাহ। আমি এসে তো দেখিনি। চলে গেছেন বোধহয়।”

“ঠাম্মাকে দেখেছিস? কেমন আছেন এখন?”

“হ্যাঁ, ঘরেই আছেন। দেখে তো সুস্থই মনে হলো। আদৌও কি অসুস্থ হয়েছিলেন নাকি এখানেও তোকে বোকা বানানো হয়েছে?”

শমিতের প্রশ্নে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন অর্ণব। তার কথা একদম ফেলে দেওয়ার মতো না। আগে এটা কেন মাথায় আসেনি অর্ণবের? শেফালী বড় একটা থালায় আম নিয়ে ছাদে আসলেন। তাদের সামনে থালাটা রেখে বললেন,

“কী খবর অর্ণবদা? আমাদের সবাইকে তো একদম ভুলেই গিয়েছিলেন মনে হয়। জানেন বড় মামি কত্তো দুশ্চিন্তা করছিলেন আপনার জন্য?”

“এইতো। আছি কোনরকম। ভালো আছিস তুই?”

শেফালীর দ্বিতীয় প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন অর্ণব।

“হ্যাঁ, অনেক ভালো আছি।”

“পিসির সাথে ঝগড়া করিস না তো আবার?”

“না না, উনিও আমাকে এড়িয়ে চলেন আর আমিও ওনাকে।”

তার কথায় অর্ণব, শমিত দু’জনেই হেসে উঠলেন। শেফালী চলে গেলে শমিত বললেন,

“তারপর, এখন কী করবি ঠিক করলি?”

“কোন বিষয়ে?”

“আরে তোর বিয়ের কথা বলছি। একদিকে মোহিনী আরেকদিকে তোর বউ। ইয়ে মানে পদ্মা। কী করবি তুই?”

“জানি না। তবে শীঘ্রই এর একটা সমাধান বের করবো।”

শমিত এ-বিষয়ে অর্ণবকে কোনো পরামর্শ দিতে পারলেন না। কারণ তিনি জানেন অর্ণবের জীবনে মোহিনীর গুরুত্ব ঠিক কতটা। আবার পদ্মাবতীকে ছেড়ে দিতেও বলতে পারেন না। যতই হোক, পদ্মাবতীকে নিজের বোনের থেকে কম মনে করেন না তিনি।
.
.
.
সাদা রঙের ফুলগুলো যেন একটু বেশিই প্রিয় পদ্মাবতীর। তাই বাড়ির সামনে গন্ধরাজ, টগর, শিউলি, হিমচাঁপা, বেলী আর কামিনীর চারা লাগিয়েছিলেন তিনি। সারাবছরই যখন কোনো না কোনো ফুল ফুটে থাকে,তখন মন আসলেই খুশিতে ভরে ওঠে তার। তবে আজ সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখতেও মন্দ লাগছে তার। ফুলে কেমন লাল হয়ে আছে গাছটা! মোহিনীর পছন্দে একটা নাগচাঁপা গাছ লাগিয়েছিলেন তিনি। এখন আর গাছটার যত্ন নেন না একদমই। তবুও দিব্যি কী সুন্দর ফুল দিয়ে যাচ্ছে গাছটা। বেলীর একটা চারা তুলে অর্ণবের ঘরে নিয়ে এলেন পদ্মাবতী। এ-ঘরের বারান্দাটা বড় হওয়ায় অর্ণবের অনুপস্থিতিতে টবে করে বেশ কিছু গাছ লাগিয়েছিলেন এখানে। বেলীর চারাটা ভালো করে পুতে জল দিয়ে হাত ধুয়ে নিলেন তিনি। এরপর অর্ণবের বইগুলো মুছে আবার গুছিয়ে তাকে রাখতে লাগলেন। বেশ ধুলো পড়ে গেছে বইগুলোর গায়ে। অর্ণব নিজের ঘরে ঢুকতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। পদ্মাবতীকে এখানে আশা করেননি তিনি। মাত্র কয়েকদিনে ঘরের নকশাই পাল্টে গেছে একদম। এবার বুঝতে পারলেন শমিত কেন তাকে তার ঘরে আসতে দিচ্ছিলেন না। জোর করে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন।

“তুমি এ-ঘরে কী করছো?”

“মানে? আমার তো এ-ঘরেই থাকার কথা। তাই না? অবাক হওয়ার তো কিছু নেই।”

অর্ণবের কথা বাড়াতে একদমই ইচ্ছে হলো না। পদ্মাবতী যে তার ঘরটা দখল করে নিয়েছেন তা বেশ ভালোই বুঝতে পারছেন। পোশাক বের করতে গিয়ে আলমারি খুলতেই আরেক দফা ধাক্কা খেলেন তিনি। এখানে শুধু পদ্মাবতীর শাড়ি। অর্ণবের একটাও পোশাক নেই। রাগান্বিত স্বরে বললেন,

“আমার জামাকাপড় কই? ওগুলো কী করেছো তুমি?”

“এতোক্ষণ ছাদে ছিলেন দেখেননি? ধুয়ে শুকোতে দিয়েছি ওগুলো। নিজের কাপড়-চোপড় ঠিক মতো ধুতে দেন না কেন আপনি? ঘামের গন্ধ আসছিল ওগুলো দিয়ে।”

“তাহলে এখন আমি কী পরবো?”

“নিচের তাকে দেখুন। আরও অনেকগুলো রাখা আছে। ওখান থেকে নিন। আমি ছাদে থেকে ওগুলো নিয়ে আসছি।”

অর্ণব দেখলেন তার সব পোশাক ধুয়ে ইস্ত্রি করে ভাজ করে রাখা আছে নিচের তাকে। ধুতি পাঞ্জাবী বের একটা তোয়ালে নিয়ে স্নানঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন,

“আমার জিনিসপত্র ধরবে না তুমি।”

পদ্মাবতী মুচকি হেসে ছাদে চলে গেলেন। অর্ণব স্নান করে বের হতেই দেখলেন ছাদে থেকে আনা তার সব কাপড় বিছানায় রেখে দিয়েছেন পদ্মাবতী। এতে কিছুটা বিরক্তও হলেন তিনি।

“আপনি আপনার জিনিস আমাকে ধরতে মানা করেছেন তাই এনে ওভাবেই রেখে দিয়েছি কাপড়গুলো। নিজে ভাজ করে রাখবেন।”

“নিজেকে খুব চালাক ভাবো তুমি?”

“কেন?”

“কী ভেবেছো? তোমার এই হাসিখুশি চেহারা দিয়ে বশ করে ফেলতে পারবে সবাইকে? মায়ায় জড়িয়ে ফেলবে? সুন্দর মুখটার আড়ালে লুকিয়ে থাকা তোমার কুৎসিত মনটা কেউ দেখতে পারবে না ভেবেছো?”

অর্ণবের বলা কথাগুলো যেন পদ্মাবতীর হৃদয়ে তীরের মতো বিঁধলো। তার ব্যথা এই নরম মনটা নিতে না পারায় অশ্রু হয়ে ঝরছে।

“কী করেছি আমি? এভাবে কেন কথা বলছেন?”

“এতোকিছু করার পরও বলো কী করেছো? আফসোস। বিশ বছর একসাথে থাকার পরও মেহের তোমাকে চিনতে পারেননি।”

“কোথায় যাচ্ছেন?”

“সে কথা তোমাকে বলতে হবে এখন?”

ঘর থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন অর্ণব। নিজের বাবার খালি পড়ে থাকা বন্ধ ঘরে ঢুকলেন। ঘরটা বন্ধ থাকলেও একদম পরিষ্কার। অর্ণব জানেন তার মা প্রতি সপ্তাহে ঘরটা পরিষ্কার করে যান। মায়ের কথা মনে পড়তেই মনে হলো তার ঘরে এখনো যাওয়া হয়নি। দেখা করা হয়নি এখনো তার সাথে। যাবেন কি যাবেন না একবার ভেবে আবার মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেরে ফেললেন অর্ণব। দরজা আটকে জানালা খুলে দিলেন। এ ঘরে কোনো বারান্দা নেই। জানালা খুলতেই চোখে পড়লো বাড়ির পেছনের বাগান আর দিঘিটা। বাগানটা কোনো জঙ্গলের থেকে কম মনে হয় না। কেমন একটা গা ছমছমে পরিবেশ। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নেমে আসবে। তখন এই বাগানটাই জোনাকির আলোয় ভরে উঠবে। বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিতেই যেন চোখে ঘুম চলে এলো। আজকাল ঘুমটা যেন হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে তার। দিনের বেশিরভাগটাই কাটে ঘুমিয়ে। তবুও যেন চোখে সবসময় ঘুম লেগে থাকে তার।

________________________

পাখির কলরবে ঘুম ভাঙলো শেফালীর। শমিতের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছেন তিনি। ঘুম ঘুম চোখে শমিতের দিকে তাকালেন। নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন তিনি।

“দেখ কেমন কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছে!”

শমিতের নাক চেপে ধরলেন শেফালী। মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে উঠলেন শমিত। নাক ছেড়ে দিয়ে হাসলেন শেফালী। বিছানা ছেড়ে উঠে জানালা খুলে দিতেই ভোরের আলো এসে লাগলো তার মুখে। শমিত আগের মতোই ঘুমাচ্ছিলেন। চোখে আলো লাগতেই উল্টো ঘুরে গেলেন। বাগানে অর্ণবকে হাঁটতে দেখলেন শেফালী। কাল অনেক রাতে দেখেছিলেন হাতে বেলীফুলের গোড় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে। নিশ্চয়ই মোহিনীর কাছে গিয়েছিলেন। একটা শাড়ি নিয়ে স্নানঘরে চলে গেলেন শেফালী। এরপর পূজো করে রান্নাঘরে যাবেন।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৩৬
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

“শুকনো মরিচের ডালাটা ঘরে নিয়ে যা তো, পদ্মা। দুপুরে যাও একটু রোদ ছিল। এখন তো একদম মেঘে ঢেকে গেছে আকাশ।”

শকুন্তলা বলতে না বলতেই পদ্মাবতী মরিচের ডালা নিয়ে চলে গেলেন। ছাদে শীতলপাটি বিছিয়ে বসেছেন আম্রপালি আর শকুন্তলা। বহুদিন হয়ে গেছে এভাবে ছাদে এসে বসা হয় না তাদের। তাই আজ একটু সুযোগ পেতেই চলে এসেছেন।

“অর্ণবটা এখনো আমার সাথে কথা বলে না।”

“সবুর করো দিদি। ক’দিনই বা রাগ করে কথা না বলে থাকবে? সবটা হচ্ছে মোহিনীর জন্য। অর্ণব প্রতি রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। নিশ্চিত মোহিনীই আমাদের নামে ওর কানে বিষ ঢালছে।”

“বিয়েটা দিয়ে আমি আবার কোনো ভুল করলাম না তো?”

“কী সব যা-তা বলছো? ভুল করবে কেন? তুমি একদম ঠিক করেছো। অর্ণবও এটা তাড়াতাড়িই বুঝতে পারবে।”

“কিচ্ছু ঠিক লাগছে না। সব কেমন ওলট-পালট হয়ে গেল মনে হচ্ছে। যে মেয়েটাকে আমি এতো ভালোবাসতাম। তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি।”

“মোহিনী তোমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ছিল? তোমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছে।”

“তবুও। কিচ্ছু ঠিক যাচ্ছে না শকুন্তলা। মনটা সবসময় কেমন অশান্ত হয়ে থাকে। কিচ্ছু ভালো লাগে না।”

“তুমি চিন্তা করো না বেশি। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। ভুলে যাও পুরনো সব কথা।”

“কত দিন হয়ে গেল মেয়েটাকে দেখিনা! ওকে বড্ড দেখছে ইচ্ছে করছেরে।”

“তুমি কি পাগল হয়ে গেলে দিদি? এখনও ওই মেয়েটার কথাই ভাবছো? ও তোমার ছেলের সংসার ছারখার করে দিচ্ছে সেটা দেখছো না?”

শকুন্তলা উঠে দাঁড়ালেন। ছাদের গাছগুলোতে জল দিতে লাগলেন। হলদে কবরীতে ভরে গেছে একটা গাছ। জল দিতে দিতে বললেন,

“ফুলগুলো দেখছো দিদি? যতটা সুন্দর তার চেয়েও বেশি বিষাক্ত। মোহিনী হলো ঠিক এমন। ওপরটা সুন্দর হলেও ভেতরটা বিষে ভরা।”

“কবরী যতই বিষাক্ত হোক। তবুও তো মানুষ গাছ লাগায়।”

শকুন্তলা বিরক্তি নিয়ে বললেন,

“আমাদের পরিবারটা ধ্বংস করে দিতে ওই একটা মেয়েই যথেষ্ট। এখন না বুঝলেও যেদিন আমাদের একটা বড় কোনো ক্ষতি করে দেবে, তখন বুঝবে।”

আম্রপালি জানেন শকুন্তলা ভুল কিছু বলেননি। এই পরিবারটা ভেঙে ফেলতে মোহিনীই যথেষ্ট। অর্ণবকে যেন তিনি একদম নিজের বশে নিয়ে ফেলেছেন। মোহিনীকে ছাড়া যেন অর্ণব আর কাউকে চেনেন না। এ-বাড়ির লোক যেন তার কেউ-ই নয়।
.
.
.
“ঠাম্মা।”

অর্ণব দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাক দিতেই শান্তি দেবী মুচকি হাসলেন। হাত দিয়ে ইশারা করে কাছে ডাকলেন তাকে। অর্ণব যেন এরই অপেক্ষায় ছিলেন। দ্রুত ভেতরে আসলেন তিনি। হামানদিস্তায় পান-সুপারি পিষছেন শান্তি দেবী। তাতেই ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। দাঁতে আর আগের মতো জোর নেই এখন তার। শান্তি দেবীর সাথে কথা বলার সময় অর্ণবের মুখে সবসময় একটা হাসি লেপ্টে থাকে। তার পাশে এসে বসে বললেন,

“ভালো আছো তো ঠাম্মা?”

শান্তি দেবী পান মুখে দিতে দিতে বললেন,

“আমি তো ভালোই। তুই ভালো আছিস নতুন বউ নিয়ে?”

“আমার জীবন এলোমেলো করে দিয়ে এখন জিজ্ঞেস করছো ভালো আছি কিনা?”

পদ্মাবতী, শান্তি দেবীর ঘরে ঢোকার সময় অর্ণবের কথার আওয়াজ পেতেই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দেওয়ালে কান লাগিয়ে চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন।

“এলোমেলো করেছি? কই?”

“এইযে পদ্মাবতীর সাথে বিয়ে করিয়ে।”

শান্তি দেবী ইতোমধ্যেই আরেকটা পান সাজাতে শুরু করেছেন।

“কেন? পদ্মা তো ভালো মেয়ে।”

“ভালো না ছাই। আমি মেহেরকে ভালোবাসি জেনেও মায়ের কথায় আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলো।”

“মেহের আবার কে? আগে তো শুনিনি এ নাম।”

“তোমাদের মোহিনী।”

“ওকে মেহের ডাকিস?”

“হ্যাঁ, ওর নাম মেহেরজান। ওর মায়ের দেওয়া নাম। যেটা আমার মা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন।”

“তুই ভালোবাসতিস ওকে?”

অর্ণব মুচকি হেসে বললেন,

“এখনো বাসি। তুমি জানতে না? মা বলেননি তোমাকে?”

শান্তি দেবীর কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। কিছু একটা ভাবতে লাগলেন তিনি।

“ঠাম্মা?”

“হুম।”

“সেদিন হঠাৎ করে অসুস্থ হলে কীভাবে তুমি?”

“কোন দিন?”

“আমার বিয়ের দিন।”

শান্তি দেবী কোনো উত্তর দিলেন না। অর্ণবের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।

“বাদ দাও। আয়ায়া।”

অর্ণব বড় করে হা করতেই শান্তি দেবী সাজানো পানটা তার মুখে ঢুকিয়ে দিলেন। অর্ণব পান চিবুতে চিবুতে দু’হাত মাথার নিচে রেখে শুয়ে পড়লেন। শান্তি দেবীর এখনো মনে আছে অর্ণব ছোটবেলায় প্রায়ই তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়তেন গল্প শোনার জন্য। তিনি মাঝেমাঝে এভাবেই পান সাজিয়ে তার মুখে দিয়ে দিতেন। পান চিবুতে চিবুতেই ঘুমিয়ে যেতেন অর্ণব। ঠোঁট দুটো একদম লাল টকটকে হয়ে যেত তার।
.
.
.
অন্ধকারে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন পদ্মাবতী। বারান্দার কোণায় রাখা বেলীফুলের গাছটা থেকে কী সুন্দর মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে। সন্ধ্যে থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। এখন মেঘ কেটে গিয়ে আকাশে মস্ত বড়ো একটা চাঁদ উঠেছে। তার রূপোলী আলোয় সাদা সাদা ফুলগুলো দেখা যাচ্ছে। কোথাও ঝিঁঝি পোকা ডেকে চলেছে একনাগাড়ে।

“অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কী করছিস পদ্মা?”

“এখানে আসুন বড়মা। আকাশে কত বড় চাঁদ উঠেছে দেখে যান।”

আম্রপালি পদ্মাবতীর পাশে এসে দাঁড়ালেন।

“আগেই দেখেছি আমি।”

“আপনি এখানে যে?”

“মাথাটা খুব ধরেছে। ঘরে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম তোকে একটু দেখে যাই।”

“চা খাবেন? আঁদা চা? দাঁড়ান, আমি বানিয়ে আনছি। এখানেই থাকুন।”

পদ্মাবতী আম্রপালির উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। দৌঁড়ে চলে গেলেন। সামান্য হাসলেন আম্রপালি। বিড়বিড় করে বললেন,

“মেয়েটার ছটফটানি এখনো গেল না।”

আম্রপালি সামনে তাকালেন। বাগানে হালকা আলো জ্বলছে। ওপর থেকে দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। সাজানো গোছানো পরিপাটি একটা বাগান। আগে বাগানটা ছিল না। পদ্মাবতীর দীর্ঘদিনের পরিশ্রম এটা। গাছ লাগাতে খুব ভালোবাসেন তিনি। ছোটবেলায় মেয়েটা যেখানে যে গাছ দেখতেন তা-ই তুলে সাথে করে নিয়ে আসতেন। খুব যত্ন করে লাগাতেন। অবশেষে আম্রপালি তাকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে তার পছন্দ মতো সব গাছ কিনে এনে দিয়েছিলেন। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই পদ্মাবতী দু কাপ চা নিয়ে চলে এলেন। আম্রপালি চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,

“অর্ণব কোথায়রে?”

পদ্মাবতীর মুখটা মলিন হয়ে গেল। মাথা নিচু করে বললেন,

“জানি না।”

“তুই ভালো আছিস তো পদ্মা?”

“ভালো না থাকার কী আছে?”

“আমার প্রতি তোর মনে রাগ পুষে রাখিসনি তো?”

“ছিঃ! তা হতে যাবে কেন?”

“এইযে নিজের ছেলের ভালোর জন্য তোর সাথে ওর বিয়ে দিয়ে দিলাম। তুই ভালো থাকবি না জেনেও।”

“আপনি তো আমাকে সবটা জানিয়েছিলেনই। তবুও আমি বিয়েতে রাজি ছিলাম। এখন ভালো থাকি আর খারাপ থাকি, তার দায়ভার তো আমারই।”

“বাদ দে এখন এসব কথা।”

পদ্মাবতী চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। কোথাও থেকে গানের সুর ভেসে আসছে ধীরে ধীরে। কেউ গান গাইছে।

“চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো।
ও রজনীগন্ধা তোমার, গন্ধসুধা ঢালো।”

“শকুন্তলা গান ধরেছে।”

“হুম। শুনছি।”

“খুব মিষ্টি গলা মেয়েটার। ভালো গায়।”

“আগে আমরা সবাই একসাথে বসে ছোটমার গান শুনতাম। আমি, চিত্রা, মোহিনী। এখন কেউ নেই।”

“ভুলে যা আগের কথা।”

“বড়মা, আমার জায়গায় মোহিনী বউ হয়ে আসলে কী হতো? উল্টো আজ সবকিছু আগের মতোই ভালো থাকতো।”

আম্রপালি পদ্মাবতীর মাথায় হাত রেখে বললেন,

“কী ভালো থাকতো, কী খারাপ থাকতো তা আমি জানি না। কিন্তু তুই এসেছিস, এর চেয়ে বেশি ভালো আর কিছু না।”

আম্রপালি কী বলছেন সেদিকে খেয়াল নেই পদ্মাবতীর। বাইরে থেকে শমিতকে আসতে দেখলেন। হাতে কাগজে মোড়ানো জুঁই ফুল। শেফালী ফুলগুলো পেয়ে খুব খুশি হবেন। শমিত বাড়ির সামনে আসতেই শেফালীকে দৌঁড়ে এগিয়ে যেতে দেখলেন। নিশ্চয়ই সদরদরজায় দাঁড়িয়ে শমিতের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। একইভাবে অপেক্ষা তো পদ্মাবতীও করে একজনের জন্য। পার্থক্য শুধু একটাই, একজনের অপেক্ষা শেষ আর আরেকজনের অপেক্ষার সময় কোনোদিন ফুরোবে না।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে