#মেহেরজান
#পর্ব-৩৩
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
গাছ থেকে ধপ করে নামলেন মোহিনী। নিজের ওড়নাটা মেলে ধরতেই কতগুলো কাঁচা আম বেরিয়ে এলো।
“ধ্যাৎ! কাপড়ে কষ লেগে গেছে।”
“বলেছিলামই তো সোজা নিচে ফেল। আমি ধরে ফেলবো।”
“তুই যে কত ধরতে পারবি তা আমার জানা আছে। শেষে আমাকেই পাঠাতি আবার আমগুলো ধুয়ে আনতে। তার ওপর আবার একটা এসে যদি তোর মাথায় পড়তো, কী কান্ডটাই না করতি তখন।”
পদ্মাবতী নিজের আঁচলে একটা আম ভালো করে মুছে নিলেন। এরপর কামড় বসাতে বসাতে বললেন,
“বললেই হলো? উফ! নুন, তেল, লংকা ছাড়া এভাবে খাওয়া যায় নাকি। এত্তো টক! দাঁত তো একদম টকে গেল।”
“এখন ওসব কে এনে দেবে তোকে?”
পদ্মাবতী গাছে টাঙানো দোলনায় বসে বললেন,
“ধাক্কা দে।”
মোহিনী ধাক্কা দিতে লাগলেন।
“থাক, হয়েছে। আর দিতে হবে না। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। আমি বরং এখন যাই।”
“ইশ, বস তো দু’দন্ড। কতদিন হয়ে গেল কথাই হয় না তোর সাথে ঠিকমতো।”
“তুই বাড়িতে না এলে কথা হবে কী করে? আজও তো এলি না। এখন চল যাই।”
“উঁহু। সময় হলে আসবো।”
“বাড়িতে আসতেও আবার সময় হতে হবে? হ্যাঁ রে, আজ হঠাৎ এভাবে ডেকে পাঠালি যে?”
“ওইযে বললাম। তোর সাথে কথাই হয় না ঠিকমতো।”
পদ্মাবতী উঠে দাঁড়ালেন।
“না, আর দেরি করতে পারবো না। বড়মা খুব বকবেন। এখন আমি যাই।”
মোহিনী পদ্মাবতীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন।
“তোকে খুব মনে পড়বেরে পদ্মা।”
মোহিনীর আচরণ ঠিক লাগছে না পদ্মাবতীর। নিশ্চয়ই তার মাথায় কিছু একটা ঘুরছে। তবে এসব নিয়ে পদ্মাবতীর কোনো দুশ্চিন্তা নেই। মোহিনীর কোনো পরিকল্পনাই যেন সফল না হয় তার ব্যবস্থা তিনি আগেই করে রেখেছেন। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,
“এমন বলছিস কেন? আমি তো এখানেই আছি। মনে পড়ার আবার কী আছে? যখন ইচ্ছে তখন দেখতেই তো পারছিস।”
“তবুও।”
“এখন যাই।”
মোহিনী মুচকি হেসে পদ্মাবতীকে বিদায় দিলেন। একদৃষ্টিতে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করতে লাগলেন,
“আমাকে ক্ষমা করিস পদ্মা। এতো বড় একটা পদক্ষেপ নিচ্ছি কিন্তু তোর থেকে লুকোচ্ছি। কারণ আমি জানি তুই আমাকে কোথাও যেতে দিবি না। হয়তো আজই আমাদের শেষ দেখা ছিল বা আবার কোনোদিন দেখা হবে। ভালো থাকিস তুই।”
.
.
.
দেওয়ালঘড়ির দিকে তাকালেন মোহিনী। অনেক দেরি হয়ে গেছে। ঝটপট নিজের কয়েকটা পোশাক ব্যাগে ভরে নিলেন।
“সত্যিই চলে যাবি মেহের?”
চকিতে পেছনে ঘুরলেন মোহিনী। তারানাকে দেখে ভয়ে একদম কাঠ হয়ে গেলেন।
“তারামা!”
“কী ভেবেছিলি? তুই পালাবি আর আমি জানতেও পারবো না? মা ডাকিস তুই আমাকে। তারামা। মা আর মেয়ের সম্পর্ক হলো সবচেয়ে কাছের। মেয়ের মনে কী চলছে তা মা বুঝতে পারবে না ভেবেছিস?”
মোহিনী দৌঁড়ে এসে তারানার হাত ধরে ফেললেন।
“আমাকে আটকিও না তারামা। আমার কাছে যে আর কোনো উপায় নেই।”
“আটকাবো না।”
মোহিনী কিছুটা অবাক হলেন।
“কি রে? অবাক হচ্ছিস? ভুল কিছু শুনিসনি তুই। এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে যদি তুই ভালো থাকিস তাহলে তুই পালিয়েই যা। শুধু এই বুড়িটাকে ভুলে যাস না। এই নে, এটা তোর মায়ের। অনেক পুরনো। কিন্তু এখনো ভালো রয়েছে। আমি যত্ন করে তুলে রেখেছিলাম।”
মোহিনীর দিকে একটা থলে এগিয়ে দিলেন তারানা। থলেটা খুলতেই একটা বোরকা বের হয়ে এলো মোহিনীর হাতে।
“এটা পরে নে। কেউ দেখে ফেললেও চিনতে পারবে না। আর এতে তুই নিরাপদও থাকবি। আমি নিজে তোকে ঘাটে দিয়ে আসবো।”
মোহিনী তারানাকে জড়িয়ে ধরলেন। এরপর তাড়াতাড়ি বোরকাটা পরে নিলেন। দু’জনকে ঘর থেকে বের হতে দেখেই আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন রজনী। তাদের কথা আড়ি পেতে শুনছিলেন তিনি। তারানা আর মোহিনী বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই তাদের পেছন পেছন রজনীও বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু তার পথ আলাদা। তিনি চলে এলেন পদ্মাবতীর সাথে দেখা করতে। ভাগ্যিস বাইরে দারোয়ানটা ঘুমাচ্ছিল। তাই এতো সহজেই বাড়ির ভেতর ঢুকতে পেরেছেন তিনি। কিন্তু এখানেও ঘটলো আরেক বিপত্তি। এ বাড়ির কিছুই তিনি চেনেন না। পদ্মাবতীর ঘর কোনটা সেটা কিভাবে খুঁজে বের করবেন?
“এই মেয়ে, কে তুমি?”
একেই বলে ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়।’ এতো রাতে যে কেউ জেগে আছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি রজনী। আর তিনি যে তার সামনে এসেই পরবেন এটাই বা কে জানতো। তার থেকেও বড় কথা, যার সামনে পরেছেন, তিনি আর অন্য কেউ নন বরং আম্রপালি স্বয়ং। আম্রপালিকে দেখে রজনীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। আম্রপালি আবার বলে উঠলেন,
“কী হলো? বলছো না কেন কে তুমি? মুখ থেকে চাদরটা সরাও তো দেখি।”
আম্রপালি টান দিয়ে চাদরটা সরিয়ে নিলেন। সাথে সাথেই রজনীর মাথায় একটা বুদ্ধি উঁকি দিল। যে কথাটা তিনি পদ্মাবতীকে জানাতে এসেছেন তা আম্রপালিকে জানালেও মন্দ হয় না। উল্টো দেখা গেল দুজনেই খুশি হয়ে তাকে কিছু দিয়ে দিলেন।
“তুমি! তোমাকে তো আমি সেদিন ও-বাড়িতে দেখেছিলাম। তুমি এখানে এসেছো কোন উদ্দেশ্যে? মোহিনী পাঠিয়েছে তোমায়? কী হলো? কথা বলছো না যে?”
রজনী কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দিলেন,
“না, আমাকে কেউ পাঠায়নি। আমি নিজে থেকেই এসেছি। আপনার সাথে দেখা করতে।”
“আমার সাথে! কেন?”
“ওই মোহিনী আর আপনার ছেলে আজ পালাবে। মোহিনী ঘাটে অপেক্ষা করছে তার জন্য। আপনাকে এটা জানাতেই এসেছি।”
“তোমার কথা আমি কেন বিশ্বাস করবো?”
“এখন বিশ্বাস না করলেও একটু পর ঠিকই বুঝতে পারবেন। তখন আফসোস করবেন না আবার।”
“বের হও বাড়ি থেকে। এখনই বেরিয়ে যাও।”
রজনী চলে যেতে উদ্যত হতেই আম্রপালি বললেন,
“দাঁড়াও।”
নিজের গলা থেকে একটা হার খুলে রজনীর হাতে দিয়ে বললেন,
“এটা রাখো। আর এই কথা যেন কেউ না জানে।”
রজনী বাঁকা হেসে বিনা বাক্যব্যয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ বাদেই সিড়ি দিয়ে অর্ণবকে নামতে দেখলেন আম্রপালি। পেছন থেকে বললেন,
“পালাচ্ছিস অর্ণব?”
আম্রপালির কথায় অর্ণব দাঁড়িয়ে পড়লেন। পেছনে ঘুরে শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন,
“না।”
“মিথ্যে বলছিস আমাকে? পালানোর কথা চিন্তা করার আগে একবার আমার কথা মনে পড়লো না তোর?”
“আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি পালাচ্ছি?”
আম্রপালি ভালো করে একবার অর্ণবকে দেখে নিলেন। সাথে ব্যাগবোঁচকা কিছুই নেই।
“আমি পালাচ্ছি না মা। মেহেরকে বোঝাতে যাচ্ছি। উনি অপেক্ষা করছেন আমার জন্য।”
“কোথাও যাবি না তুই। আর ওই মেয়ের সাথে দেখা করতে তো একদমই না। ও তোকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঠিকই দূরে কোথাও নিয়ে চলে যাবে।”
“আপনার কথা ভেবে যখন আমি পালাবো না বলেছি তেমন মেহেরের কথা ভেবেও তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। আমি তাকে বলেছি, আমি আসবো।”
“তোকে আমার দিব্যি অর্ণব। তুই যাবি না।”
“আমাকে কোনো দিব্যি দেবেন না মা। এসব বলে আমাকে আটকাতে পারবেন না।”
অর্ণব দরজার দিকে ঘুরলেন। আম্রপালি বলে উঠলেন,
“এ-বাড়ির চৌকাঠ পেরোলে তুই আমার মরা মুখ দেখবি অর্ণব। বিষ খাবো আমি। চাস চিত্রার পর আবার আমার লাশ দেখতে?”
অর্ণব আম্রপালির দিকে ঘুরলেন।
“কী চান আপনি?”
.
.
.
দিগন্তের আড়াল থেকে উঁকি দেওয়া সূর্যের আলো এসে লাগছে মোহিনীর গালে। মাঝি একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন,
“কি রে মা, সেই ওতো রাইতের বেলায় আমারে বাড়ি থেইকা ডাইকা নিয়া আইলি নদী পার হওনের লাইগা। সারারাইত বইয়া রইলাম, সূর্যও উইঠা গেল। কেউ তো আইলোনা। কই যাবি তুই?”
মোহিনীর শান্ত চোখ দুটো চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ভাষায় প্রকাশ করতে না পারা হাজারো বুলি যেন এই চোখ দিয়ে প্রকাশ করতে চাইছেন। কিন্তু পারছেন না। মাঝি মোহিনীকে আপাদমস্তক ভালো করে দেখে বললেন,
“বাড়ি থেইকা পালাইছিস?”
মোহিনী দুবার উপরনিচ মাথা নাড়লেন।
“আমিও পালাইছিলাম। তোর চাচিরে নিয়া। ওপার থেইকা পালাইয়া এপারে আইছিলাম দুইজনে। তারপর বিয়া কইরা এইহানেই থাইকা গেছি। আর ফিরা যাই নাই। তুই কার লগে পালাইছিস মা? হে কই?”
মোহিনী জবাব দিলেন না। মাঝি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
“ওহ, বুঝছি। হে আহে নাই। কথা তো সবাই দেয়। তাই বইলা সবাই কি আর কথা রাহে রে মা? তুই বাড়ি ফিরা যা।”
মোহিনী উঠে দাঁড়ালেন। নৌকা থেকে নেমে বললেন,
“চাচা, আপনার পয়সা।”
মাঝির দিকে টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন মোহিনী। মাঝি হেসে উত্তর দিলেন,
“কিয়ের পয়সা দিবি? তোরে তো নদী পার কইরা দিলামই না। এই পয়সা আমি নিবার পারমু না। তোর কাছেই রাখ।”
মাঝি নৌকার দড়ি খুলে জলে বৈঠা বাইতে শুরু করলেন। নদীর ওপারে যেতে যেতে গান ধরলেন,
“নদীর এ-কূল ভাঙে ও-কূল গড়ে
এইতো নদীর খেলা।।”
দরজায় ধাক্কা দিতেই তারানা এসে দরজা খুলে দিলেন। মোহিনীকে দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ। কিছু বলতে গিয়েও আশেপাশে মেয়েরা থাকায় চুপ করে গেলেন। মোহিনী নিঃশব্দে ওপরে চলে গেলেন। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলেন। এক মেয়ে বলে উঠলো,
“মোহিনী এখান থেকে পালিয়েছিল। তুমি ওকে কিছুই বললে না আম্মা?”
রজনী বললেন,
“আম্মা আর কী বলবে? আম্মা নিজেই তো ওকে পালাতে সাহায্য করেছিল। তাই না আম্মা?”
তারানার চোখ রাঙানিতে সবাই চুপ হয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে বেলা গড়াতে শুরু করলো। সকাল গড়িয়ে দুপুর। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। এখন পশ্চিমাকাশে সূর্যের লাল আভাটাও আর দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু মোহিনী এখনো ঘর থেকে বের হননি। মাঝে তারানা নিজে গিয়েও কয়েকবার ডেকে এসেছেন। হঠাৎ দরজায় কেউ জোরে জোরে কড়া নাড়তে শুরু করলেন। রজনী দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিলেন। এক মেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢূকলেন। গায়ে দামী শাড়ী, গয়না। সিঁথিতে সিঁদুর। তাকে দেখে সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। কিন্তু কেউ-ই তাকে চিনতে পারছেন না। পেছন থেকে চরণ বললেন,
“ম্যানে বহুত সমঝয়া ইসকো। লেকিন ইয়ে মানেই নেহি। সিধা অন্দর চলি আয়ি।”
তারানা বলে উঠলেন,
“তুমি কে? কী চাই তোমার?”
“মোহিনী কই?”
তারানা হাত দিয়ে দোতলার একটা ঘর দেখিয়ে দিলেন। মেয়েটা কিছু না বলে সোজা সেদিকে চলে গেলেন। গায়ের সব জোর দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন আর মোহিনীকে ডাকছেন।
“এই মোহিনী, মোহিনী। দরজা খোল। তাড়াতাড়ি দরজা খোল। এই মোহিনী।”
মোহিনী দরজা খুলে দিলেন।
“শেফালী!”
“সর্বনাশ হয়ে গেছে। যাকে তুই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতিস, সেই তোর পিঠে ছুরি মেরেছে।”
“কী বলছিস তুই? কার কথা বলছিস?”
“অর্ণবদা আর পদ্মার বিয়ে হচ্ছে। পদ্মা তোর আর অর্ণবদার ব্যাপারে সব আগে থেকেই জানতো। সব জানার পরও বিয়ে করছে। আমি অনেক কষ্টে বাড়ি থেকে লুকিয়ে এসেছি এখানে। তুই চল তাড়াতাড়ি।”
মোহিনী একদম পাথর হয়ে গেলেন। অর্ণব আর পদ্মাবতী বিয়ে করছেন এটা ছাড়া যেন তিনি আর কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছেন না। যত দ্রুত সম্ভব দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন মোহিনী। তার পেছন পেছন শেফালীও। অর্ণবদের বাড়ির সামনে পৌঁছুলে রামু তাকে আটকে ফেললেন।
“আমাকে যেতে দাও কাকু।”
“মাফ কইরেন মোহিনীমা। কিন্তু আপনেরে আমি ভিতরে যাইতে দিতে পারুম না। মালকিনের কড়া নিষেধ। আপনেরে বাড়ির সীমানায় ঢুকতে দিতে মানা করছেন।”
মোহিনী বুঝতে পারলেন এদিক দিয়ে তিনি ঢুকতে পারবেন না। দৌড়ে বাড়ির পেছনের দিকে যেতে লাগলেন। ওটাই একমাত্র রাস্তা। এদিকে এসেও দেখলেন দু’জন টহলদার টহল দিচ্ছেন। কিন্তু তাদের চোখ এড়িয়ে আম বাগানের ভেতর দিয়ে আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি মোহিনীর। বাড়ির সদরদরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখলেন পদ্মাবতী দাঁড়িয়ে আছেন। সিঁথিতে সিঁদুর পরা। কত সুন্দর করে বউ সাজানো হয়েছে তাকে! আরও অনেক লোকজন রয়েছে তার আশেপাশে। কিন্তু অর্ণবকে দেখতে পেলেন না। কেউ একজন বলে উঠলেন, “আমাদের নতুন বর অর্ণবটা কই গেল রে? বিয়ে করে আবার বউয়ের ভয়ে পালালো নাকি ছেলেটা?”। এতোটুকুই কানে এলো মোহিনীর। আর কিছু শুনতে পেলেন না। আর শোনার প্রয়োজনও নেই। যা বোঝার এতেই বুঝে গেছেন। শেফালী মিথ্যে বলেনি। অর্ণব আসলেই বিয়ে করেছেন। আর দাঁড়িয়ে না থেকে সামনের পথ দিয়েই চলে গেলেন মোহিনী। তাকে ভেতর থেকে আসতে দেখে অবাক হলেন রামু। বাড়ি ফিরে এসে মাথায় এক ঘটি জল ঢেলে দরজার চৌকাঠেই বসে পড়লেন মোহিনী। তারানা এসে তাকে ধরতেই বলে উঠলেন,
“আমি যাদের আমার সবথেকে আপন ভাবতাম, তারাই আমাকে পর করে দিয়েছে তারামা। বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।”
.
.
.
রজনীর কাছে সোনার হার দেখেই গালে চড় বসিয়ে দিলেন তারানা। সবকিছু যেন একমুহূর্তেই বুঝে ফেলেছেন তিনি।
“কোথায় পেয়েছিস এটা? বল কোথায় পেয়েছিস?”
রজনীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চুলের মুঠি ধরে ক্রমাগত চড় মারতে লাগলেন তারানা।
“এসব তাহলে তুই করেছিস? কার কথায় করেছিস বল। কে করতে বলেছে? এসবের লোভে পড়ে মোহিনীর সাথে এমন করেছিস? ও-বাড়িতে সব খবর তাহলে তুই পৌঁছুতিস। শয়তান মেয়ে, কী ভেবেছিলি? আমি জানতে পারবো না কিছু? তুই আমার খেয়ে, আমার পরে, আমার বাড়িতে থেকে কিনা আমার সাথেই বেইমানি করেছিস।
“ও মাগো। মরে গেলামগো। আর মেরো না আম্মা। মরেই যাবো। এবার ছাড়ো আমাকে।”
তারানা এবার হাতে লাঠি তুলে নিলেন। লাঠি দিয়ে আবার মারতে শুরু করলেন। আর সহ্য করতে পারলেন না রজনী। এক ধাক্কায় তারানাকে ফেলে দিলেন।
“যা বুড়ি। কিছু বলছি না বলে যা খুশি তাই করবি? বয়স ভুলে গেছিস? বুড়ি হয়েও গায়ের জোর দেখাতে এসেছিস? সেই তো এক ধাক্কায় পড়ে গেলি। ও মাগো! গা ব্যথায় জ্বলে যাচ্ছে আমার।”
সবাই এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেই যাচ্ছিলেন। তারানাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতেই এক মেয়ে দৌড় এসে তারানাকে ওঠালেন। এরপর রজনীর গালে চড় মেরে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে বাড়ি থেকে বের করে দরজা লাগিয়ে দিলেন।
.
.
“ভুল করলেন মা। অনেক বড় ভুল করলেন আপনি। আজ না বুঝলেও একদিন ঠিক বুঝতে পারবেন। আমি প্রমাণ করে দেব যে আপনি কত বড় ভুল করেছেন।” বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে এটাই ছিল অর্ণবের বলা শেষ কথা, যা এখনো কানে বাজছে আম্রপালির। পদ্মাবতী, আম্রপালি, শকুন্তলা আর অনুরাধাসহ আরও কয়েকজন মহিলা বসে আছেন ঘরে। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও শেফালীকেও থাকতে হচ্ছে সেখানে। খোশগল্পে ব্যস্ত তারা। অনুরাধা বলে উঠলেন,
“এতো রাত হয়ে গেল, অর্ণব তো এখনো এলো না আম্রপালি।”
শকুন্তলা জবাব দিলেন,
“আজ তো কালরাত্রি। আজ ওর কী দরকার? সকাল হোক। নিজেই চলে আসবে।”
একজন ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন,
“অর্ণব ওভাবে বেরিয়ে গেল কেনগো আম্রপালি? ছেলের বিয়েতে মত ছিল না নাকি?”
এবারও শকুন্তলা বললেন,
“মত থাকবে না কেন? আসলে হুট করে বিয়ে হয়ে গেল তো। তাই আর কী।”
আম্রপালির দিকে আসা সব প্রশ্নের উত্তর যেন শকুন্তলা আগেই তৈরি করে রেখেছিলেন। এখন শুধু ঠিকমতো বলার পালা।
“অনেক রাত হয়ে গেছে। আমাদেরও এখন ওঠা উচিত।”
আম্রপালি বলে উঠলেন,
“সেকি! এখনই চলে যাবেন আপনারা?”
“যেতে তো হবেই। আমাদেরও তো ঘর সংসার আছে।”
“আসলে বিয়েটা এমন হঠাৎ করে হবে আমরা কেউ ভাবিনি। তাই খুব একটা আয়োজনও করা হয়নি। কোনো আত্মীয়স্বজনও আসতে পারেনি। আপনারা তো আশেপাশেরই লোক। তাই অল্প সময়ে আপনাদের জন্য যা একটু করার চেষ্টা করেছি।”
“তাও অনেক করেছো আম্রপালি। আশীর্বাদ করি যেন সবসময় ভালো থাকো।”
“আশীর্বাদ পদ্মাকে করুন। এখন ওর এটা বেশি প্রয়োজন।”
“ওর জন্য তো আমাদের আশীর্বাদ সবসময়ই আছে।”
সবাই একে একে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। আম্রপালি, শকুন্তলা আর অনুরাধাও গেলেন তাদের এগিয়ে দিতে। পদ্মাবতী খাটে বসে একদৃষ্টিতে হাতে আঁকা কলকার দিকে তাকিয়ে আছেন। পাশে থেকে শেফালী বলে উঠলেন,
“কী ভাবছিস? অর্ণবদা তোকে এতো সহজে মেনে নেবেন?”
“কথা শোনানোর অপেক্ষায় ছিলি বুঝি?”
“কথা শোনাচ্ছি না। বাস্তবটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি। কে জানে কোন স্বপ্ন দেখে তুই এই কাজ করলি। হ্যাঁ রে, মোহিনীর সাথে এমনটা করতে তোর একবারও বুক কাঁপলো না?”
পদ্মাবতী দু’দিকে মাথা নাড়লেন। বললেন,
“কাঁপলো না।”
“তুই তো এমন ছিলি না পদ্মা। কত ভালোবাসতিস মোহিনীকে। শেষে কিনা ওর সাথেই এমন করলি? এতোটা স্বার্থপর কবে হলি?”
“কেন করলাম বলতে পারিস?”
“সে তুই-ই ভালো জানিস। আমি শুধু একটা কথাই বলতে চাই তোকে। যা পেছনে ফেলে এসেছিস, তা ফিরে পাওয়ার সব রাস্তাই বন্ধ। তাই আর ফিরে তাকাস না। সামনে এগিয়ে চল। নিজের সংসারটাকে এখন কিভাবে বাঁচাবি সেটা ভাব। মোহিনী এসব এমনি এমনি যেতে দেবে না। বাকিটা তুই দেখ।”
.
.
মশায় একদম ঝেঁকে ধরেছে রজনীকে। চৌকাঠের বাইরে সিড়িতে বসেই দরজা খোলার অপেক্ষা করছেন তিনি। সেই কখন বের করে দিয়েছে তাকে। এতোগুলা ঘন্টা হয়ে গেল তবুও কেউ দরজা খুললো না।
“ধুর, এভাবে আর কতক্ষণ মশার কামড় সহ্য করবো? এর চেয়ে তখন আম্মার মারগুলো সহ্য করে নিলেও ভালো হতো। অন্তত এভাবে বাইরে বসে মশার কামড় তো খেতে হতো না। কেন যে তখন আম্মাকে ধাক্কা দিতে গেলাম। সত্যি সত্যিই আবার তাড়িয়ে দিল না তো আমাকে? এভাবে কোথায় যাবো আমি? না আছে কাপড়চোপড় আর না আছে টাকাপয়সা। গয়না আর টাকাগুলো হাতে থাকলেও একটা কথা ছিল। এক মুহূর্তও দাঁড়াতাম না এখানে। অন্য কোথায় চলে গিয়ে মানুষের বাড়ি কাজ করে খেতাম। তাও ভালো ছিল।”
নিজের মনেই বিড়বিড় করছিলেন রজনী। হঠাৎ বাইরের গেইট জোরে খুলে যাওয়াতে ছিটকে উঠলেন। ওদিকে ভালো করে তাকাতেই দেখলেন কেউ এলোমেলো পায়ে ঢুলতে ঢুলতে এদিকেই এগিয়ে আসছেন। আরেকটু কাছে আসতেই বুঝতে পারলেন ওটা অর্ণব। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে আছেন তিনি। সিড়িতে পা লেগে হোঁচট খেয়ে দরজার সামনে পড়ে যেতেই রজনী লাফ দিয়ে সরে গেলেন। মাতাল কণ্ঠে বারবার মেহেরজান বলে ডেকে চলেছেন অর্ণব। জানালা খুলে বাইরে তাকালেন মোহিনী। এমন সময় হঠাৎ করে দরজাটা খুলে গেল।
চলবে…
#মেহেরজান
#পর্ব-৩৪
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
“বাড়ি চলেন অর্ণব বাবা। মালকিন আপনের লাইগা অনেক চিন্তায় আছেন। খাওয়াদাওয়াও ছাইড়া দিছেন। একদম অসুস্থ হইয়া পড়ছেন।”
বেশ মনোযোগ দিয়ে মোহিনীর সাথে দাবা খেলছিলেন অর্ণব। নিজের চালটা চেলে জবাব দিলেন,
“আসলেই অসুস্থ নাকি আমাকে বাড়ি ফেরানোর জন্য আবার কোনো নতুন নাটক করছেন উনি? যেমনটা বিয়ে করানোর জন্য করেছিলেন।”
“আসলেই তার শরীলডা তেমন ভালা না। আটদিন হইয়া গেল আপনে বাড়িতে নাই। আপনের চিন্তায় চোখের নিচে কালি পইড়া গেছে একদম। উপায় না পাইয়া সেই আবার আমারেই পাঠাইছেন আপনেরে নিয়া যাওনের লাইগা।”
“কেন? ওনার আসতে কী অসুবিধা ছিল?”
রামু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
“ওইযে কইলাম না? তার শরীলডা ভালা না তেমন। তাই আমারেই পাঠাইছে।”
মোহিনী বলে উঠলেন,
“বাড়ি ফিরে যান অর্ণব। আপনার মা, স্ত্রীসহ সকলে অপেক্ষা করছেন আপনার জন্য। এভাবে আর কতদিন?”
‘স্ত্রী’ শব্দটা বেশ জোর দিয়েই বললেন মোহিনী। অর্ণব চোখ তুলে তার দিকে তাকালেন। মোহিনীর দিকে দৃষ্টি রেখেই বললেন,
“আপনি চলে যান কাকু। আমার যখন মনে হবে তখন আমি নিজেই ফিরে যাব।”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রামু। আজ তৃতীয়বারের মতো অর্ণবকে বোঝানোর জন্য এসেছিলেন তিনি। কিন্তু এবারও তাকে খালি হাতেই ফিরতে হবে। নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
“এখানে থেকে কী বোঝাতে চাচ্ছেন আপনি? আমাকে খুব ভালোবাসেন?”
“আপনাকে ভালোবাসি তা আবার বোঝানোর প্রয়োজন আছে?”
“সেদিন বললাম পালিয়ে যেতে। আপনি এলেন না। কখনো ভাবিওনি এভাবে বিয়ে করে ফেলবেন।”
“আমি আপনাকে তখনই বলেছিলাম যে পালানো কোনো সমাধান নয়।”
“তাহলে সমাধান কী ছিল? পদ্মাকে বিয়ে করা?”
“আমি আপনাকে আগেও বলেছি আর আবারও বলছি। বিয়েটা আমার ইচ্ছেতে হয়নি। তাই এটা নিয়ে বারবার কথা শোনাবেন না।”
“এমনভাবে বলছেন যেন কিছুই হয়নি। বাচ্চা নাকি আপনি যে আপনার ইচ্ছে না থাকলেও ধরে বেঁধে বিয়ে করিয়ে দেবে?”
“মনে করুন তাই-ই। বাচ্চা না হলেও বিয়েটা আমাকে ধরে বেঁধেই করানো হয়েছে। আমি তখন কোন পরিস্থিতিতে ছিলাম তা আপনি জানেন না মেহের। তাই বুঝতেও পারবেন না।”
“তো এখন যান না নিজের বউয়ের কাছে। এখানে এসে পড়ে আছেন কেন?”
“যাবো না। আপনার কাছেই থাকবো। কী করবেন আপনি?”
মোহিনী মুখ বাঁকা করে বসে রইলেন। তার এমন কান্ড দেখে মুচকি হাসলেন অর্ণব। খুব খাটাখাটুনির পর মোহিনীর রাগ গলাতে পেরেছেন তিনি। দ্বিতীয়বার আর তার ক্রোধের অনলে পুড়তে চান না।
.
.
.
রামুকে এবারও খালি হাতে ফিরতে দেখে হতাশ হলেন আম্রপালি। সেসময় অর্ণবের চলে যাওয়াটায় তেমন একটা গুরুত্ব না দিলেও এখন বুঝতে পারছেন বিষয়টা বেশ গুরুতর। নিজের সিদ্ধান্তের ওপরই সংশয় হচ্ছে তার। আদৌও কি তিনি সঠিক নাকি অনেক বড় ভুল করে ফেললেন। দেওয়ালের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন পদ্মাবতী। কপোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তা মুছে নিয়ে নিজের মনকে শক্ত করলেন। সবে তো শুরু। কে জানে কপালে কী আছে তার। সোজা রান্নাঘরে চলে এলেন তিনি। দেখলেন শেফালী কলার মোচা কাটছেন। শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে তিনিও কাজে লেগে পড়লেন।
“অর্ণবদা এবারও এলেন না?”
“না।”
নিচু স্বরে বললেন পদ্মাবতী।
“তুই কী আশা করেছিলি? আসবেন উনি? মেনে নেবেন সব?”
“আশা করা ছেড়ে দিয়েছি আমি। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।”
“এখন সব ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না পদ্মা। কই? বিয়ের আগে তো ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিসনি। বুদ্ধি দিয়ে নিজের করে নিয়েছিস অর্ণবদাকে।”
“নিজের করতে পারলাম কই? উল্টো জোর করে ঘাড়ে চেপে বসেছি বলতে পারিস। কাঁটার মতো বিঁধে আছি ওনার গলায়। না পারছেন গিলতে আর না পারছেন উগলে দিতে। সব ছেড়ে ছুড়ে নিজের প্রেমিকার কাছে গিয়ে পড়ে আছেন।”
“শোন পদ্মা, এসব এতো ছোট করে দেখিস না। মোহিনী অর্ণবদার প্রেমিকা ছিল। আর এখন তুই অর্ণবদার বউ। কীভাবে মেনে নিচ্ছিস এসব? আমি হলে তো পারতাম না শমিতকে অন্য কোনো মেয়ের সাথে দেখতে।”
“তোদের বিষয়টা ভিন্ন। তোরা ভালোবাসতিস একে অপরকে। আমাদের তো আর তা নয়।”
“তাতে কী? পুরুষ মানুষের মন বলে কথা। কখন কার ওপর আসে বলা যায় না। বিয়ের আগে ভালোবাসেনি বলে বিয়ের পরে বাসবে না এটা কী করে বলিস? সবাই কি আর প্রেম করে বিয়ে করে নাকি?”
“কী বলতে চাস তুই?”
“মোহিনীর প্রতি অর্ণবদার যে ভালোবাসাটা ছিল সেটা নিজের জন্য অর্জন কর। সরিয়ে দে মোহিনীকে তোদের জীবন থেকে। একদম ভুলিয়ে দে ওকে।”
তাচ্ছিল্যভরে হাসলেন পদ্মাবতী।
“হাসছিস কেন? ভুলটা কী বলেছি আমি?
“যার ভালোবাসার ধারের কাছেও আমি নেই, তার ভালোবাসা নাকি আবার অর্জন করবো!”
“তা নয়তো কী?”
“যার জন্য এসব করবো সে নিজেই তো এখানে নেই। করবো কী করে?”
“চিন্তা করিস না। আজ রাতে শমিত ফিরবে। ওকে আমি আগেই টেলিফোনে বলেছি তোদের বিয়ের কথা। এলে আবার খুলে বলবো পুরোটা। ও ঠিকই অর্ণবদাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফিরিয়ে আনবে দেখিস তুই।”
.
.
.
শমিত স্নানঘর থেকে হাতমুখ ধুয়ে বের হতেই শেফালী তার দিকে একটা তোয়ালে এগিয়ে দিলেন। মুখ মুছে শমিত বললেন,
“জানো, আমার এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে অর্ণব আর পদ্মার বিয়ে হয়ে গেছে।”
“বিশ্বাস না করে উপায় নেই। তাই কষ্ট হলেও বিশ্বাস করে নাও।”
“অর্ণব আছে কই এখন?”
“মোহিনীর ওখানে।”
“কী! তুমি তো আমাকে বলেছিলে অর্ণব বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু মোহিনীর ওখানে যে গেছে, এটা তো বলোনি।”
“ওভাবে কী আর এতোকিছু বলা যায়? এখন তুমি এসেছো। আস্তেধীরে আবার শুরু থেকে বুঝিয়ে বলবো সব।”
“তা বলো। কিন্তু এখন খেতে দাও। এতোটা রাস্তা এসেছি। আসতে আসতে খিদে পেয়েছে খুব। পেটে খিদেই চো চো করছে।”
“অপেক্ষা কর কিছুক্ষণ। রান্না বসিয়ে এসেছি। তুমি এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবে তা তো আর আগে জানতাম না। ভেবেছিলাম রাত হবে অনেক।”
“আমিও তো তাই-ই ভেবেছিলাম।”
“ব্যবসা কেমন চলছে?”
“সে চলছে বেশ।”
“মামা এলেন না?”
“দু’জনই চলে আসলে ওদিকটা কে দেখবে? ওখানেও তো কাউকে থাকতে হবে নাকি?”
“তাও ঠিক।”
“বাদ দাও ওসব। আগে বলো তুমি কেমন আছো?”
“যেমনটা ছেড়ে গিয়েছিলে।”
“আমি কি আর ইচ্ছে করে গিয়েছি নাকি? কতদিন তোমাকে দেখিনি। মনে হচ্ছে যুগ পেরিয়ে গেছে।”
“কী করবে বলো? তোমার মা তো আমাদের আলাদা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। রাতে একঘরে থাকতে দেন কিনা দেখ।”
“ধুর। আবোলতাবোল বলো না তো। মা এতোটাও খারাপ না যতটা তুমি ভাবো।”
“কেন? ভুল তো বলিনি। বিয়ের পর তুমি যতদিন বাড়িতে ছিলে, তোমার ধারের কাছেও থাকতে দেননি উনি আমাকে। রাতে পদ্মার ঘরে ঘুমোতে হতো। এরপর জোর খাটিয়ে এ-ঘরে ঢুকতে হয়েছে আমাকে। আমার স্বামীর ঘরে আমি থাকবো না তো কে থাকবে?”
শেফালীর কথা শুনে সামান্য হাসলেন শমিত। বললেন,
“তুমিই থাকবে। কার এতো সাহস যে তোমাকে এ-ঘরে থাকতে দেবে না।”
“থাকবে কয়দিন এখানে?”
“এসেছি তো দু’সপ্তাহের জন্য। এখন দেখি ক’দিন থাকতে পারি। যতদিনই আছি, তোমাকে খুব আদর করবো। কতদিন পর বউটাকে কাছে পেলাম আমার।”
হাত ধরে এক টানে শেফালীকে কাছে টেনে নিলেন শমিত। চেঁচিয়ে উঠলেন শেফালী।
“এই কী শুরু করলে? ছাড় আমাকে। দরজা খোলা আছে। কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ।”
“কিসের সর্বনাশ? আমার বউকে আমি আদর করছি। তাতে কার কী?”
শেফালীর গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে। শমিতের চোখে চোখ মেলাতে পারছেন না তিনি।
“ছাড় আমাকে। রান্না পুড়ে যাবে। তুমি না বললে তোমার খিদে পেয়েছে। নিচে আসো। আমি খাবার বাড়ছি।”
নিজেকে কোনোমতে ছাড়িয়ে দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন শেফালী।
চলবে…