মেহেরজান পর্ব-৩১+৩২

0
376

#মেহেরজান
#পর্ব-৩১
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

বাড়ির পেছনের দিঘির পাশে সিড়িতে বসে আছেন অর্ণব আর মোহিনী। হাতে সামান্য জল নিয়ে অর্ণবের দিকে ছুড়ে মারতেই অর্ণব খপ করে তার হাত ধরে ফেললেন। দূরে বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাদের দেখে চলেছেন সাবিত্রী। কথাবার্তা না শোনা গেলেও দেখে কিছু বুঝতে বাকি নেই তার। এরপর দ্রুত পায়ে শকুন্তলার ঘরে চলে এলেন।

“আজকালকার ছেলেমেয়েরা যে কী শুরু করেছে। নিজেদের কী মনে করে কে জানে।”

“কার ছেলেমেয়েরা কী করলো না করলো তাতে তোমার কী মা? যে যা খুশি করুক।”

“বাইরের কেউ হলে বলতাম না। কিন্তু এরা তো নিজের ঘরেরই।”

“মানে?”

“ছাদে থেকে দেখলাম অর্ণব আর মোহিনী দিঘির পাশে বসে আছে। জল ছোড়াছুড়ি, হাত ধরাধরি আরও কত কী।”

শকুন্তলা কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললেন,

“এখানে আমরা কী করবো? কিছু বললে দিদি নিজেই বলবে। অর্ণব তো আর আমার সন্তান না।”

চিত্রার মৃত্যুতে একদম চুপচাপ হয়ে গেছেন শকুন্তলা। আগের মতো চঞ্চলতা আর নেই তার মাঝে। সাবিত্রী কিছুক্ষণ আমতাআমতা করে বললেন,

“আচ্ছা তোকে একটা কথা বলবো?”

“কী?”

“তোর মেয়ের সাথে কারও সম্পর্ক ছিল?”

“না।”

“ছিল। তুই জানিস না। তোর মেয়ে পোয়াতি ছিল।”

“কী সব যা-তা বলছো তুমি?”

“ও যখন আমাদের বাড়িতে এসেছিল তখন ওর মাঝে আমি অনেক লক্ষণ দেখেছি। একে জিজ্ঞেসও করেছিলাম। কিন্তু অস্বীকার করেছে। তারপরের দিনই তো কিছু না বলেই চলে এলো এখানে। আমার মনে হয় চিত্রা এই জন্যই আত্মহত্যা করেছে।”

শকুন্তলা সাবিত্রীর মুখ চেপে ধরলেন।

“এসব কথা আর বলবে না মা। ভুলেও আর কোনোদিন মুখে আনবে না। কেউ যেন না জানে এসব।”

আম্রপালি ঘরে আসতেই শকুন্তলা সাবিত্রীর মুখ ছেড়ে দিলেন।

“ভুল সময় এসে পড়লাম কী?”

“না না। ভুল সময় আসবে কেন? আমি আর মা দু’জনে বসে গল্পই করছিলাম। তুমিও এসো।”

আম্রপালি ভেতরে এসে বসার কিছুক্ষণ পরেই পদ্মাবতী আসলেন। ওষুধ বের করে শকুন্তলাকে খাইয়ে দিলেন। তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,

“দুপুরে আপনারা কী খাবেন বলুন। আমি রান্না বসিয়ে দেব।”

আম্রপালি বললেন,

“তোর যা ইচ্ছা তাই রান্না কর।”

“যা ইচ্ছা তাই করবো মানে? আপনারা কী খাবেন তা আমি কী করে জানবো?”

“আরে বাবা বললাম তো তোর ইচ্ছে মতো রাঁধ। তুই যা রাঁধবি তাই খাবো। তোর সব রান্নাই তো অনেক সুস্বাদু হয়।”

“তাহলে পরে কিন্তু আবার বলবেন না এটা রেঁধেছি কেন? ওটা রেঁধেছি কেন?”

“বলবো নাহ। যা তুই।”

“ঠিকাছে। মনে থাকে যেন।”

“থাকবে।”

পদ্মাবতী চলে যেতেই আম্রপালি বললেন,

“মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে! পুরো বাড়িটা এখন একাই সামলাচ্ছে।”

সাবিত্রী বললেন,

“সত্যিই। ক’দিন পরে বিয়েও দিয়ে দিতে হবে।”

“আমার ভাবতেই অবাক লাগে পদ্মাটার বিয়ে হয়ে গেলে ওকেও এ-বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে।”

“চাইলে বিয়ের পরও এখানেই রেখে দিতে পারো।”

শকুন্তলা বললেন,

“তা আবার কীভাবে হবে? বিয়ের পর তো শশুরবাড়ি যেতেই হবে ওকে।”

“আরে হবেরে হবে।”

আম্রপালি আর শকুন্তলা দু’জনেই কৌতূহলী দৃষ্টিতে সাবিত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। আম্রপালি বললেন,

“কীভাবে?”

“তুমি কী ভুলে যাচ্ছো আম্রপালি বাড়িতে বিয়ের উপযুক্ত তোমারও একটা ছেলে আছে? ওকে তো আর সারাজীবন বিয়ে না করিয়ে রাখবে না।”

এই প্রথম যেন এই মহিলার কোনো উপদেশ আম্রপালির পছন্দ হলো। ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো তার। পরক্ষণেই কপালে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে তুলে জিজ্ঞেস করলেন,

“কিন্তু অর্ণব? ও কি মানবে? আর পদ্মা কী বলবে?”

“পদ্মাকে একবার বলেই দেখো না। আর রইল কথা অর্ণবের। ও তোমার কথা মানবে না? প্রথমে না করলেও তুমি বুঝিয়ে বললে ঠিকই মেনে নেবে দেখো।”

“তবুও। কেন যেন মনে হচ্ছে অর্ণব…।”

আম্রপালির কথা শেষ করার আগেই সাবিত্রী বললেন,

“তোমাকে একটা কথা বলি আম্রপালি। জানি না তুমি কীভাবে নেবে কিন্তু তোমার জানা উচিত এটা।”

“কী ব্যাপারে?”

“অর্ণবের ব্যাপারেই।”

“অর্ণবের?!”

“হ্যাঁ।”

“কী কথা?”

“কীভাবে যে বলি তোমাকে? শোনো তাহলে। অর্ণবের সাথে মোহিনীর মেলামেশাটা তোমার চোখে পড়েছে কিনা জানি না। কিন্তু আমার চোখে ব্যাপারটা ঠিক লাগছে না।”

সাবিত্রীর কথা শুনে যেন আম্রপালি আকাশ থেকে পড়লেন।

“মোহিনী!”

“আমার মনে হয় ওদের মাঝে কোনো সম্পর্ক আছে।”

“মোহিনীর সাথে যদি অর্ণবের সম্পর্ক থাকে তাহলে আপনি অর্ণব আর পদ্মার বিয়ের কথা বলছেন কেন?”

“তুমি কি বোকা আম্রপালি? মোহিনীর মতো একটা মেয়ের সাথে নিজের ছেলের বিয়ে দেবে? গাঁয়ের লোক কী বলবে ভেবে দেখেছো? তুমি মাত্র একটা বছর নেচেছিলে। তাতেই তোমার এ-বাড়িতে বিয়ে হওয়ায় লোকে কম নিন্দে করেনি এ-বাড়ির। এমনকি এখনো করে। আর মোহিনী, সে সেই কবে থেকে নেচে চলেছে। গাঁয়ের কম লোক যায় না সেখানে। লোকে একটা বিয়ের কথা ভুলতে না ভুলতেই আরেকটা করাতে চাও? আর তাছাড়াও তোমার জন্য তোমার মা ছিলেন। ওনার পর তারানা আগলে রেখেছিল তোমাকে। আর মোহিনীর তো কোনো পরিচয়ই জানা নেই। মা কে? বাবা কে? কিচ্ছু না। মোহিনীকে যে এখনো কোনো পুরুষ ছোঁয়নি সেটা কীভাবে বলছো?”

“মোহিনী একদমই এমন মেয়ে নয়। আর ওকে আগলে রাখার জন্যও তারানা আছে সেখানে।”

“তবুও আম্রপালি। লোকে তো আর এসব দেখবে না। আর ঐ মেয়ে তো আমাদের ধর্মেরও না। ও কী বুঝবে শাখা সিঁদুর এর মূল্য?”

আম্রপালি চুপ করে রইলেন।

“আমার কথাগুলো একটু ভেবে দেখো আম্রপালি। তোমাদের পরিবারের ভালোর জন্যই বলছি আমি।”

“ঠিকাছে। আমি অর্ণব আর পদ্মাবতীর সাথে কথা বলবো। তুই কিছু বলছিস না যে শকুন্তলা?”

শকুন্তলা ম্লান হেসে বললেন,

“আমার মেয়েটা মরার একমাস হতে না হতেই নিজের ছেলের বিয়ের আনন্দে মেতে উঠতে চাইছো দিদি?”

“এভাবে কেন বলছিস শকুন্তলা? আমি চিত্রাকে ততটাই ভালোবাসতাম যতটা ভালোবাসি অর্ণবকে। চিত্রা আমার কাছে নিজের সন্তানের থেকে কম ছিল না।”

“কিছু মনে করো না দিদি। কিছুক্ষণের জন্য একটু স্বার্থপর হয়ে গেছিলাম। তুমি বিয়ের ব্যাপারটা দেখো।”

“তুই নিশ্চিত তো?”

“হ্যাঁ, এই ফাঁকে হয়তো আমার মনটাও কিছুটা ভালো হয়ে যাবে।”

“বেশ। তাই করবো।”

“ভিতরে আসমু মালকিন?”

রামুর ডাক শুনতেই আম্রপালি পেছনে ঘুরলেন। বললেন,

“রামু, কিছু বলবি? আয়, ভেতরে আয়।”

“আপনে নতুন যেই মাইয়ারে কামের লিগা রাখছিলেন না? ও ঘর ঝাড়ু দিবার যাইয়া এইডা পাইছে অর্ণব বাবার ঘর থিকা। আইনা আমারে দিল তাই আমি আপনের কাছে দিয়া গেলাম।”

আম্রপালির হাতে একটা কানের দুল ধরিয়ে দিয়ে রামু চলে গেলেন। আম্রপালি ভালো করে দেখে বললেন,

“এমন গয়না তো আমাদের বাড়ির কেউ পরে না। দেখে তো মনে হচ্ছে ও-বাড়ির কারও। কার এটা?”

সাবিত্রী বললেন,

“মোহিনী ছাড়া এ-বাড়িতে আর কে যাওয়া আসা করে? ও ছাড়া আর কার হবে? আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি। সকাল সকাল শ্বেতকাঞ্চন পাওয়ার দিন অনেক আগেই ফুরিয়েছে তোমার। চুলে পাঁকও ধরেছে। এবার নিজের ছেলের প্রতি একটু নজর দাও। আজ শমিত এমন একটা কান্ড করেছে। কাল অর্ণব যে এমন কিছু করবে না তার তো কোনো ভরসা নেই। এখন তুমিই সব সামলাও আম্রপালি।”
.
.
.
নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন আম্রপালি। সামনে শেফালীকে দেখে বললেন,

“এই শেফালী, এদিকে শোন তাড়াতাড়ি।”

শেফালী দৌঁড়ে আম্রপালির সামনে এলেন।

“আস্তে আস্তে। বিয়ে হয়ে গেল অথচ বুদ্ধি হলো না। বাচ্চাদের মতো বাড়ির ভেতরে ওভাবে দৌঁড়াতে বলেছে কে?”

“আপনিই তো বললেন তাড়াতাড়ি আসতে। তাই-ই তো দৌঁড়ে এলাম।”

“আচ্ছা ঠিকাছে। এখন যেমন দৌঁড়ে এলি তেমন দৌঁড়ে ছাদেও যা। বাইরের অবস্থা তেমন ভালো না। পদ্মা ছাদে গেছে কাপড় আনতে। ওর সাথে কাপড়গুলো নিয়ে আয়। আর পদ্মাকে ওর ঘরে যেতে বল। আমি আসছি একটু পর।”

“আপনার ঘরেই পাঠিয়ে দিই?”

“না থাক। আমিই যাবো। তুই শুধু ডেকে বলে দিস ওকে।”

“আচ্ছা।”

শেফালী দৌঁড়ে ছাদের দিকে চলে গেলেন। আম্রপালি নিজের ঘরে যাওয়ার রাস্তা বদলে অর্ণবের ঘরের দিকে গেলেন। কিন্তু ঘরে এসে কাউকে দেখতে পেলেন না। ফিরে আসার সময় টেবিলের ওপর চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়ালেন তিনি। এগিয়ে এসে ঘুঙুরটা হাতে তুলে নিলেন। কিছুক্ষণ ভেবে ঘুঙুরটা নিজের শাড়ির আঁচলের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে চলে গেলেন।

বাইরে প্রচন্ড জোরে বাতাস বইছে। আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে খুব বড় ঝড় উঠবে আজ। সামনের সুপারি গাছগুলো খুব জোরে জোরে এদিক-ওদিক দুলছে। পদ্মাবতী এক এক করে তার থেকে কাপড়গুলো তুলে নিচ্ছেন। শেফালী এসে তাকে সাহায্য করতে লাগলেন। এতো বাতাসের মধ্যে চোখ খুলে রাখা মুশকিল। ধুলো বালি উড়ে চোখে ঢুকে যাচ্ছে। কোনো রকম দু’জনে নিজেদের চোখ দুটো খুলে রেখেছেন। কাপড়গুলো নিয়ে শেফালী বললেন,

“এই পদ্মা, তাড়াতাড়ি ঘরে যা নিজের। বড় মামি ডেকেছেন তোকে।”

“কী? বড়মার ঘরে যাবো? আবার বল। শুনতে পাইনি ঠিকমতো।”

“আরে না না। তোর নিজের ঘরে যা। বড় মামি ওখানেই আছেন।”

“ঠিকাছে যাচ্ছি।”

পদ্মাবতী কাপড়গুলো শেফালীর কাছে দিলেন। চলে যাওয়ার সময় গাছে একটা অলকনন্দা ফুটে থাকতে দেখলেন। বাতাসে খুব জোরে জোরে দুলছে গাছটা। ফুলটা ছিড়ে নিজের কানের ওপরে গুঁজে নিলেন। শেফালীকে দেখিয়ে বললেন,

“কেমন লাগছেরে?”

“আরে কেমন লাগছে ওটা বাদ দিয়ে ঘরে যা না। বললাম বড় মামি ডেকেছেন।”

পদ্মাবতী ছুটে চলে গেলেন। ঘরে ফিরতেই দেখলেন আম্রপালি বসে আছেন।

“ডেকেছেন বড়মা?”

“হ্যাঁ। বস আমার পাশে।”

পদ্মাবতী তার সামনে এসে বসলেন।

“কিছু বলবেন?”

“হ্যাঁ, কিন্তু কীভাবে যে বলি সেটাই বুঝতে পারছি না।”

পদ্মাবতী ভ্রুকুটি করলেন।

“কী হয়েছে বড়মা?”

“দেখ, আমি সোজাসাপটাভাবেই বলছি। অর্ণবকে তোর কেমন লাগে বলতো। সত্যি করে বলবি কিন্তু।”

আম্রপালির কথায় পদ্মাবতী কিছুটা হকচকিয়ে উঠলেন।

“মানে?”

“আমি তোকে নিজের থেকে দূরে করে দিতে চাই না। আমি অর্ণবের বিয়েটা তোর সাথে দিয়ে দিতে চাই। করবিরে?”

আম্রপালি পদ্মাবতীর হাত ধরে ফেললেন। পদ্মাবতী সাথে সাথে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

“কেন? আমি আপনার থেকে দূরে যাবো কেন যে যার জন্য অর্ণববাবুকে বিয়ে করতে হবে?”

“ওমা। বড় হয়েছিস তুই। বিয়ে করবি না? একদিন তো বিয়ে করে শশুরবাড়ি যেতেই হবে তোকে। তাহলে অর্ণবকে বিয়ে করে এ-বাড়িই থেকে যা না একেবারে।”

“কেন? আমাকে বিয়ে দিতে হবে কেন? আমি কী খুব বেশি খাই? নাকি অনেক খরচা করি? এমনিই রেখে দিলে কী সমস্যা? তার জন্য বিয়ে কেন করাতে হবে? মেয়ে বানিয়ে রেখে দিন না। বউ কেন বানাতে হবে?”

পদ্মাবতীর চোখ ইতোমধ্যেই জলে ভরে গেছে। আম্রপালি তার মাথায় হাত রেখে বললেন,

“ধুর পাগলি। তোকে চাইলে তো সারাজীবনই রেখে দিতে পারি। কিন্তু বিয়ে তো করতেই হবে তোকে। তখন চলে যাবি না? এজন্যই তো অর্ণবের সাথে তোর বিয়েটা দিতে চাইছি যাতে তুই বিয়ের পরও আমাদের সাথেই থাকিস।”

পদ্মাবতী কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। হঠাৎ নিজের মনটা কেমন যেন কঠিন হয়ে এলো। একটা শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল তার মনে। আম্রপালি আবার বললেন,

“কি রে? করবি বিয়েটা? রাজি হয়ে যা না। থেকে যা সারাজীবন আমাদের কাছেই।”

“আপনি যা চাইবেন তাই হবে বড়মা। আমি রাজি।”

আম্রপালি খুশিতে আত্মহারা হয়ে পদ্মাবতীকে জড়িয়ে ধরলেন।

“আমি অর্ণবের সাথে কথা বলে তাড়াতাড়িই তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করবো। এখন আসি। বাকিদের সাথেও কথা বলতে হবে।”

আম্রপালি বেরিয়ে গেলেন। আয়নায় নিজেকে দেখে জগতের সবচেয়ে বড় স্বার্থপর মনে হচ্ছে পদ্মাবতীর। মোহিনী আর অর্ণবের ব্যাপারে সবটা জানার পরও কীভাবে রাজি হয়ে গেলেন তিনি বিয়েতে? যদিও বিয়েটা হবে কি হবে না তা তিনি জানেন না। অর্ণব নিশ্চয়ই বিয়ের প্রস্তাবটা নাকোচ করে দেবেন। তবুও অর্ণবকে পাওয়ার একটা শেষ সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন পদ্মাবতী। হয়তো অর্ণবের প্রতি সুপ্ত ভালোবাসাটাই আজ তাকে এতোটা স্বার্থপর হতে বাধ্য করেছে। কিন্তু কিছুতেই নিজের মনের মধ্যে শান্তি খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। মোহিনীর সাথে এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা করে ভালো থাকতে পারবেন তিনি? না শান্তিতে বাঁচতে পারবেন? হঠাৎ বিকট শব্দ করে একটা গাছের ডাল ভেঙে পড়লো। দৌঁড়ে জানালার কাছে গেলেন তিনি। জানালার কাছের নিমগাছের একটা ডাল ভেঙে পড়েছে। পদ্মাবতী দৌঁড়ে নিচে চলে এলেন। বাড়ির বাইরে এসে দেখলেন গাছের ডালটায় থাকা পাখির বাসাটাও পড়ে সেখানে থাকা পাখির ডিমগুলোও ভেঙে গেছে। একটা দুটো ফোঁটা পড়তে পড়তে ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে পড়লো।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৩২
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

অর্ণবের দেওয়া নুপুরজোড়া পায়ে পরছিলেন মোহিনী। হঠাৎ সামনে ঘুঙুর এসে পড়তেই চমকে উঠলেন। কেউ ছুড়ে মেরেছে। চকিতে দরজার দিকে তাকাতেই দেখলেন আম্রপালি দাঁড়িয়ে আছেন। বহুবছর পর এ-বাড়িতে পা পড়েছে তার।

“নর্তকীর পায়ে ঘুঙুর মানায়, নুপুর নয়।”

আম্রপালির কথায় বিস্মিত হলেন মোহিনী। প্রতিত্তোরে কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। কী হচ্ছে তাও তার বোধগম্য হচ্ছে না। ঘুঙুরটার দিকে ভালো করে তাকাতেই মনে পড়লো এটা অর্ণবকে দিয়েছিলেন তিনি ঠিক করে দেওয়ার জন্য। এবার ঘটনা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন তিনি।

“বড়মা…।”

হাত উঁচু করে তাকে থামিয়ে দিলেন আম্রপালি।

“আমাকে আর ভুলেও কখনো বড়মা বলে ডাকবে না। সেই অধিকার হারিয়েছো তুমি। আমার খেয়ে, আমার পড়ে, আমার পিঠেই ছুরি মেরেছো।”

মোহিনী বুঝলেন নরমভাবে কথা বললে কিছুই হবে না। কিছু মুহূর্তের ব্যবধানেই আম্রপালির থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছেন তিনি। নিজেকের শক্ত করলেন। উঠে আম্রপালির সামনে এসে বললেন,

“আপনার ছেলে তো তাহলে একদম আপনার বিপরীত হয়েছেন।”

“কী বলতে চাইছো?”

“অর্ণব বলেছিলেন আমার পায়ে নাকি ঘুঙুরের চেয়ে নুপুর বেশি মানায়। আর আপনি বলছেন ঠিক তার উল্টোটা। তাই বললাম আপনার ছেলে একদম আপনার বিপরীত হয়েছেন। কার মতো হয়েছেন বলুন তো? নিশ্চয়ই নিজের বাবার মতো। নাহলে এতো মেয়ে ছেড়ে একটা নর্তকীকে কেন পছন্দ করবেন?”

“নিজেকে আমার সাথে তুলনা করছো? এতো বছর নেচেও আমার নখের কাছেও আসতে পারনি তুমি। একটা বছর নেচেছিলাম শুধু। তাতেই পুরো গ্রাম আমাকে এক নামে চিনতো। কত দূর থেকে লোকজন ছুটে আসতো শুধু আমায় এক ঝলক দেখার জন্য জানো তুমি? প্রতি সন্ধ্যায় আলোকসজ্জায় ভরে উঠতো এই রঙ মহল।”

মোহিনী মলিন হেসে জবাব দিলেন।

“আপনার সমকক্ষ হওয়ার যোগ্যতা আমার কোনোদিনও ছিল না আর হবেও না। আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা অতীতে যেমন ছিল, ভবিষ্যতেও তেমনই থাকবে। কিন্তু এতোগুলো বছর আপনার আমার প্রতি যে স্নেহ-মমতা ছিল তা এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেল? কেন?”

“তখন তো আর বুঝিনি যে দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষছি। যেটা বড় হয়ে আমাকেই ছোবল দেবে।”

আম্রপালি চলে যেতে উদ্যত হতেই মোহিনী পেছন থেকে বললেন,

“আমি আপনার ছেলেকে নয়, আপনার ছেলে আমাকে ভালোবেসেছিল। আমি তাকে বাধ্য করিনি আমাকে ভালোবাসতে।”

আম্রপালি ঘুরে দাঁড়ালেন।

“আফসোস। যদি তুমি বলতে পারতে তোমরা দু’জন দু’জনকে ভালোবেসেছিলে। কিন্তু তুমি সব দোষটা শুধু অর্ণবের ওপর দিয়ে দিলে।”

আম্রপালি আর একমুহূর্তও দেরি না করে চলে গেলেন। তারানাসহ বাকি সবাই সেদিকে হা করে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। মোহিনী স্বজোরে নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলেন। রাগে কাঁপছেন তিনি। সেই সাথে দুঃখও হচ্ছে। কী থেকে কী হয়ে গেল এসব। কে জানে আর কতকিছু হারাতে হবে তাকে। সামনে অর্ণবের দেওয়া মুঠোফোনটা দেখতে পেলেন। এটা ব্যবহার করা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি মোহিনী। নিজের রাগ কমানোর জন্য এটাই তুলে এক আছারে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেললেন।
.
.
.
বেশ রাগান্বিত ভঙ্গিতে আম্রপালির ঘরে প্রবেশ করলেন অর্ণব। অর্ণবকে এভাবে আসতে দেখে আম্রপালি ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। অর্ণব উচ্চস্বরে বললেন,

“আমি যা শুনছি তা কি সত্যি মা?”

“আস্তে অর্ণব। এতো জোরে কথা বলছিস কেন? কী শুনেছিস তুই?”

“আপনি আমার আর পদ্মাবতীর বিয়ে দিতে চাচ্ছেন?”

আম্রপালি আবার নিজের কাজে মনোনিবেশ করতে করতে বললেন,

“হ্যাঁ। কী এমন হয়েছে তাতে?”

“কী এমন হয়েছে মানে? আপনি একবারও আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন এব্যাপারে?”

“জিজ্ঞেস করার কী আছে। তোর বিয়ে। তুই তো জানতেই পারবি।”

“জানতে পারা না পারার বিষয় না। আমি এই বিয়েতে রাজি নই।”

“কেন? মোহিনীর জন্য?”

আম্রপালির কথায় কিছুটা অবাক হলেন অর্ণব।

“ওহ, আপনি তাহলে জানেন এব্যাপারে। আমিও অবশ্য আপনার থেকে কিছু লুকোতে চাইনি। তা আপনি কি এজন্যই পদ্মাবতীর সাথে আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছেন?”

“মোটেও না।”

“তাহলে সবকিছু জানার পরও মোহিনীর সাথে বিয়ে ঠিক করলেন না কেন আপনি?”

“কারণ ওকে আমার পছন্দ না। আমি পদ্মাবতীকে এ-বাড়ির বউ করতে চাই।”

“কাল পর্যন্তও তো দুটো মেয়ে আপনার কাছে সমান ছিল। আজ এমন কী হলো আপনার যে মোহিনীকে পছন্দ না আপনার? যার জন্য আপনি পদ্মাবতীর সাথে বিয়ে ঠিক করলেন? তাহলে আমার এটা বলা কি ভুল হবে যে আপনি মোহিনীকে সরানোর জন্যই পদ্মাবতীর সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইছেন?”

“সে তুই যা খুশি ভাব। তোর বিয়ে পদ্মার সাথেই হবে এটা জেনে নে।”

“তাহলে আপনিও এটা ভালো করে জেনেনিন মা, আমি শমিত নই যে তার মায়ের সব অন্যায় আবদার মেনে নেবে। আমি অর্ণব। মোহিনীকে আমি ভালোবাসি আর চিরদিন ওকেই ভালোবাসবো। ওকে ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

দরজার বাইরে কান পেতে সবকিছু শুনছিলেন পদ্মাবতী। এমনটা হবে তা তিনি আগে থেকেই জানতেন। কিন্তু এতো সহজে হার মানতে পারেন না তিনি। কিছু একটা তো করতেই হবে তাকে।
.
.
.
“কী চাই তোমার? এতো রাতে আমাকে এখানে ডেকে পাঠিয়েছো কেন? জানো এভাবে এখানে আসতে কতটা অসুবিধা হয়েছে আমার? আমি এখানে এসেছি আম্মা জানলে জানে মেরে ফেলবে আমাকে।”

“এতো কথা কেন বলছো? যে জন্য ডেকেছি সেটা শোনো।”

“কী?”

“মোহিনীর ওপর নজর রাখো। ওর সব খবরাখবর আমাকে দেবে। বিয়ে আঁটকানোর জন্য ও যেকোনো কিছু করতে পারে। ওর আর অর্ণবের করা সব পরিকল্পনা নষ্ট করবে তুমি।”

উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন রজনী।

“আস্তে। এতো জোরে হাসার জন্য তোমাকে এভাবে আসতে বলেছি আমি? যাতে সবাই জেনে যায়।”

রজনী হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“এখানে আমার কী লাভ?”

পদ্মাবতী এবার নিজের কাছে লুকোনো থাকা একটা খাম বের করলেন। রজনীর হাতে দিয়ে বললেন,

“এটা রাখো। আশা করি এখন বুঝতে পারবে এতে তোমার কী লাভ।”

খাম খুলে দেখতেই টাকার কতগুলো কড়কড়ে নোট বের হলো। রজনীর চোখ চকচক করে উঠলো।

“এতো টাকা!”

“আস্তে কথা বলো। কাজ ঠিকমতো করতে পারলে আরও পাবে।”

টাকাগুলো আবার খামের ভেতরে ভরে রজনী বললেন,

“তোমাকে এতোদিন যতটা সহজ-সরল আর বোকা ভাবতাম, তুমি ঠিক ততটা সহজ-সরল বা বোকা নও। আসলে বোকাই নও। প্রচন্ড চালাক একটা মেয়ে। ধারণার বাইরে। নিজের বোনের মতো বান্ধুবীর সাথে এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে বিবেকে বাঁধবে না তোমার?”

মুহুর্তেই পদ্মাবতীর বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। নিজেকে শক্ত করে পদ্মাবতী বললেন,

“এতোকিছু তোমার না ভাবলেও চলবে। তোমাকে যা বলা হয়েছে সেটা করো।”

পদ্মাবতী গায়ের চাদর টেনে ভালো করে মুখ ঢেকে চলে গেলেন। রজনী নিজের লাভটা দেখে বেশ খুশিই হয়েছেন। সেখান থেকে ফেরার সময় সামনে মোহিনীকে দেখে দ্রুত অন্ধকারে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন। মোহিনী অর্ণবদের বাড়ির দিকে চলে গেলে তিনিও সেখান থেকে বের হয়ে চলে গেলেন।

সবার অগোচরে খুব সাবধানে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেছেন মোহিনী। ভেতরে এসে সোজা অর্ণবের ঘরে চলে এসেছেন। মাত্রই স্নান করে বের হয়েছেন অর্ণব। এতোরাতে মোহিনীকে দেখে বেশ অবাক হলেন।

“মেহেরজান! আপনি এতোরাতে?”

“আমাকে এভাবে দেখে অবাক হওয়ার তো কিছু নেই। আমি আগেও এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে এসেছি এখানে। আপনি এতোরাতে স্নান করলেন কেন?”

“গরম পড়েছে প্রচুর।”

“সে যাই হোক। আমার কথা শুনুন এবার।”

“কী কথা?”

নিজের সর্বশক্তি দিয়ে অর্ণবকে জড়িয়ে ধরলেন মোহিনী। জড়িয়ে ধরেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। খুব কমই মোহিনীকে কাঁদতে দেখেছেন অর্ণব। সহজে মেয়েটার চোখ দিয়ে জল পড়ে না। তাই বুঝতেই পারছেন বিষয়টা গুরুতর।

“কী হয়েছে মেহের? কাঁদছেন কেন এভাবে?”

“আজ বড়মা গিয়েছিলেন আমার সাথে দেখা করতে। তার কথায় আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। আমাকে অনেক দূরে করে দিয়েছেন তিনি।”

অর্ণব এর কারণটা সহজেই বুঝতে পারলেন। তাই মোহিনীকে আর দ্বিতীয়বার কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। নিজের আর পদ্মাবতীর বিয়ের ব্যাপারে ওঠা কথাটাও চেপে গেলেন। অযথা মোহিনী আর পদ্মাবতীর সম্পর্ক নষ্ট করতে চান না তিনি।

“মন খারাপ করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। মা আবার আপনাকে আগের মতোই ভালোবাসবেন।”

মোহিনী নিজের চোখ মুছে বললেন,

“উঁহু। আমি বড়মাকে চিনি। উনি একবার যখন আমার দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিয়েছেন, আর ঘুরেও তাকাবেন না কোনোদিন। দূরে সরিয়ে দেবেন আপনার থেকে।”

অর্ণব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মোহিনী আবার বললেন,

“আমার একটা কথা রাখবেন অর্ণব?”

“কী?”

“পালাবেন আমাকে নিয়ে?”

“বাচ্চামো করবেন না মেহের। পালিয়ে যাওয়া কোনো সমাধান হতে পারে না।”

“পারে। অবশ্যই হতে পারে। আমি আপনার জন্য আমার সবকিছু ছাড়তে রাজি আছি তাহলে আপনি কেন পারবেন না অর্ণব?”

“আপনাকে যে কীভাবে বোঝাই।”

“আমি কিচ্ছু বুঝতে চাই না। আপনি আমাকে এখান থেকে দূরে নিয়ে চলুন। এরা সবাই আমাদের বিরুদ্ধে। আমাদের আলাদা করে দিতে চায়।”

“মেহের, শান্ত হন আপনি। শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন। কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না আমাদের।”

“আপনি কিচ্ছু জানেন না অর্ণব। প্রমিতাদিকে সবাই মিলে মেরে ফেলেছিল। আমাদের সবাইকেও মেরে ফেলতে চেয়েছিল। তখন বড়মা বাঁচিয়েছেন আমাদের। কিন্তু এখন তো তিনিই আমাদের বিরুদ্ধে অর্ণব। আপনি আমার কথা বোঝার চেষ্টা করুন। পালিয়ে চলুন এখান থেকে।

মোহিনীকে শান্ত করার জন্য অর্ণব বললেন,

“ঠিকাছে। পালিয়ে যাবো আমরা। এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাবো। শান্ত হন আপনি।”

অর্ণবের কথায় যেন মোহিনী কিছুটা স্বস্তি পেলেন। মোহিনীকে এতোটা অস্থির হতে আগে কখনো দেখেননি অর্ণব। মোহিনী বললেন,

“কাল রাত দুটোর সময় আমি অপেক্ষা করবো আপনার জন্য নদীর পাড়ে। আপনি আসবেন তো?”

“আমি আসবো। আপনি যা বলবেন তাই হবে। এখন নিজের কান্না থামান।”

মোহিনী নিজের কান্না থামিয়ে নাক টানতে লাগলেন। অর্ণব তাকে নিয়ে সাবধানে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে