#মেহেরজান
#পর্ব-৩০
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
নদীর পাড়ে একটা গাছের ছায়ায় বসে আছেন অর্ণব। হঠাৎ মাথায় কারও কোমল হাতের আলতো স্পর্শ অনুভব করলেন। অপার দিগন্তে আবদ্ধ দৃষ্টি সরিয়ে চোখ বন্ধ করলেন তিনি। মুচকি হেসে মোহিনী হাত ধরে ঘুরিয়ে সামনে নিয়ে এলেন। চোখ খুলে মোহিনীকে একনজর দেখে টান দিয়ে নিজের পাশে বসালেন।
“হঠাৎ এতো ভালোবাসা দেখাচ্ছেন কেন মেহের?”
“আপনাকে দেখাবো না তো আর কাকে? এখানে এভাবে একা একা বসে আছেন কেন?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন অর্ণব। বললেন,
“চিত্রার মৃত্যুটা আমি এখনো মেনে নিতে পারছি না মেহেরজান। তার ওপর বাড়িতেও কিছু ঠিক নেই। পিসি এখনও রেগে আছেন।”
“চিন্তা করবেন না অর্ণব। আপনি কোনো ভুল করেননি। যা করেছেন ঠিক করেছেন। দেখবেন খুব তাড়াতাড়িই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”
“তাই যেন হয়।”
“এটা আমার খুব পছন্দের। কিন্তু ছিড়ে গেছে। আপনি ঠিক করে এনে দেবেন?”
অর্ণবের সামনে একটা ঘুঙুর উঁচু করে ধরলেন। অর্ণব ঘুঙুরটা হাতে নিয়ে সামান্য হেসে বললেন,
“দেবো। তবে একটা শর্তে।”
“কী শর্ত?”
“এটা আর কোনোদিন আপনি পায়ে পরবেন না।”
“মানে?”
“নাচ ছেড়ে দিন।”
মোহিনী নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।
“কী হলো? পারবেন না?”
“কিন্তু হঠাৎ করে…।
“আমি বাড়তি কোনো শব্দ শুনতে চাই না। আমি আমার শর্ত রেখেছি। এবার আপনি এক শব্দে জবাব দিন। পারবেন কিনা?”
মোহিনী আবারও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
“পারবো। আপনার জন্য সব করতে পারবো। আপনি যা বলেছেন তাই হবে। আর নাচবো না আমি।”
“বাড়িতে গিয়ে কী বলবেন?”
“যেটা সত্যি সেটাই। আর তারামা আমার কথা ঠিকই রাখবেন। তার মুখের ওপরে কিছু বলার কারও সাহস হবে না। আপনি এটা নিয়ে ভাববেন না।”
মোহিনী গালে একহাতে আলতোভাবে স্পর্শ করলেন অর্ণব।
.
.
.
রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন শেফালী। গায়ে ঝলমলে রঙ্গিন শাড়ি। গা ভরা গয়না। চেহারায় হালকা প্রসাধনীর ছাপ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে নতুন বউ। তাকে দেখেই অনুরাধা রান্নাঘরের কাজ ফেলে উঠে যাচ্ছিলেন। শেফালী তার পথ আঁটকে বললেন,
“আপনার আমাকে নিয়ে এখনো এতো কিসের সমস্যা মা? আমি আপনারই ছেলের বউ।”
“এই মেয়ে, খবরদার। একদম মা ডাকবে না আমাকে।”
“শাশুড়ীকে মা ডাকবো না তো কী ডাকবো? শাশুড়ী, ও শাশুড়ী?”
“তুমি আসলেই নির্লজ্জ একটা মেয়ে।”
অনুরাধা চলে যাওয়ার চেষ্টা করতেই শেফালী তার বাহুতে ধরে ঝাঁকিয়ে আবার নিজের সামনে দাঁড় করালেন।
“এই মেয়ে, হচ্ছেটা কী? ছাড়ো আমাকে।”
“কোথায় যাচ্ছেন? দাঁড়ান এখানে। চুপচাপ দাঁড়ান বলছি। আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।”
অনুরাধা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। শেফালী তাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“আপনার কী মনে হয়? আপনার ছেলের প্রেমে পাগল হয়ে আমি এবাড়িতে এসেছি?”
“নাহ। একদম না। তুমি তো এসেছো লোভে পড়ে। এতো বড় বাড়ির বউ হওয়ার লোভ সামলাতে পারোনি। তাই আমার ছেলেটাকে ফাঁসিয়ে উঠে এসেছো এবাড়িতে। তোমাকে আমি চিনি না ভেবেছো?”
শেফালী সামান্য হেসে বললেন,
“আপনি আসলেই আমাকে চেনেন না মা। আমি এখানে প্রেমের টানেও আসিনি আর লোভে পড়েও আসিনি। এসেছি আপনাদের জীবন দূর্বিষহ করে তুলতে। আপনার আর আপনার ছেলের জন্য আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। এখনো ভালোবাসা থাকবে ভেবেছেন? দেখুন না, আপনাদের মা, ছেলের জীবনটা কীভাবে বিষিয়ে দিই আমি। আর আপনি কিচ্ছু করতে পারবেন না।”
“তোমার চাওয়া কোনোদিনও পূরণ হবে না। আমি হতে দেব না। আজ রাতে অভ্র কলকাতায় ফিরছে। ওর সাথে জানো আর কে যাচ্ছে? শমিত। যাও, ঘরে গিয়ে নিজের স্বামীর ব্যাগ গোছাও। আর দেখেও এসো ভালো করে। আবার কবে দেখতে পারবে তার তো ঠিক নেই। হয়তো আর দেখতেই পারবে না। কারণ দেখার জন্য তুমি নাও থাকতে পারো।”
“এসব হুমকি অন্য কাউকে দেবেন। আমাকে না। আমাকে এসব বলে আঁটকানো যাবে না।”
কথাটা বলেই শেফালী চলে গেলেন। অনুরাধা বড় বড় চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। ঘরে এসেই দেখলেন মোহিনী আগে থেকেই তার ঘরে এসে বসে আছেন।
“কিরে? তুই কখন এলি?”
“কিছুক্ষণ আগে। তুই ছিলি না। কোথায় গিয়েছিলি?”
শেফালী একটা ব্যাগ আর শমিতের জামাকাপড় বের করলেন। মোহিনীর সামনে বসে সেগুলো ভাজ করে ব্যাগে ভরতে ভরতে বললেন,
“রান্নাঘরে। মায়ের সাথে কথা বললাম।”
“মা?”
“আমার শাশুড়ী।”
“আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তুই বিয়েটা করেছিস। যাদের জন্য নিজের বাবাকে হারালি, তাদেরই আপন করে নিলি।”
“বিশ্বাস না করে তো উপায় নেই। বিয়ে তো করেছিই। কিন্তু কেন করেছি? কী মনে হয় তোর?”
“সে তোর নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে। এতোটুকু তো তোকে আমি চিনিই।”
“ঠিক বলেছিস। একটু আগে মাকেও সেই কথাই বললাম।”
“কী বললি?”
“বলেছি আপনাদের মা ছেলের জীবন বিষিয়ে দিতে এসেছি।”
মোহিনী উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“তারপর?”
“তারপর আর কী? আমাকে এটা ওটা কথা শোনালেন। হুমকি-ধমকি দিলেন। আর সবথেকে বড় কথা কী জানিস?”
“কী?”
“শমিতকে মামার সাথে কলকাতায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন আজ। এজন্যই তো ওর কাপড়চোপড় গোছাচ্ছি। উনি ভেবেছেন এতে আমার কিছু যায় আসে। কিন্তু জানিস, শমিতকে আমি যেমন ঘৃণা করি তেমন ভালোওবাসি। যতই হোক, পুরোনো স্মৃতি তো আর ভোলা যায় না। এজন্য অর্ণবদার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। তুই অনেক ভাগ্য করে অর্ণবদার মতো একজনকে পেয়েছিসরে। যে কাপুরুষের মতো তোকে কখনো ছেড়ে যাবে না। দুঃসময়ে শমিতের মতো পিছিয়ে যাবে না।”
মোহিনী ফ্যালফ্যাল করে শেফালীর দিকে তাকিয়ে আছেন।
“কিরে? ওভাবে কী দেখছিস? ওহ, বুঝেছি। ভাবছিস আমি কী করে জানলাম?”
মোহিনী হ্যাঁবোধক মাথা নাড়লেন।
“শমিত আমার কাছে কিচ্ছু লুকোয় না। ও-ই বলেছিল।”
“কে জানে আর কে কে জেনে গেছে। আমি তো এখনো পদ্মাকেও কিছু বলিনি। কিন্তু দেখ, ওর আগে তুই ঠিকই জেনে গেছিস।”
“পদ্মা এতোটাও বোকা না যে না বললে বুঝবে না। আমার তো মনে হয় ও জানে। শুধু ও কেন? এপাড়ার সবাই জানে। প্রায়ই তো অনেকেই দেখেছে তোদের একসাথে। কানাঘুঁষাও শুনেছি আমি। এবাড়ির মানুষ জানতেও দেরি নেই বোধহয়।”
“জানলে জানবে। বেশিদিন লুকিয়ে রাখা তো সম্ভব নয়।”
“সাবধানে। এখানে তো সবাই মুখোশ পরে থাকে মনে হয়। বাইরে এক আর ভেতরে আরেক।”
“এমন বললি কেন?”
“তেমন কিছু না। সময় হলেই বুঝবি।”
চলবে…