#মেহেরজান
#পর্ব-২৮
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
“এটা কী জিনিস?”
হাতের জিনিসটা উল্টেপাল্টে দেখে অর্ণবের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন মোহিনী।
“মুঠোফোন। কলকাতায় নতুন এসেছে। তাই আনিয়েছি আপনার জন্য।”
“মুঠোফোন! সেটা আবার কী জিনিস?”
“দূরাভাষ যন্ত্র।”
“মানে?”
“এটা দিয়ে আপনি যেকোনো জায়গায় যোগাযোগ করতে পারবেন। আপনি যত দূরেই থাকুন না কেন, চাইলেই এটার সাহায্যে কথা বলতে পারবেন আমার সাথে।”
“আপনাদের বাড়িতে যে আছে টেলিফোন। ওটার মতো?”
“কিছুটা।”
“যেকোনো জায়গায় যোগাযোগ করতে পারবো?”
“হ্যাঁ। তবে অপরজনের কাছেও এটা থাকতে হবে।”
“যাহ। তা কী করে সম্ভব? এটায় তো তারই নেই।”
“এটায় তারের প্রয়োজন পড়ে না। বেতার।”
“কীভাবে? এ আবার হয় নাকি?”
অর্ণব নিজের কাছে থাকা আরেকটা মুঠোফোন দিয়ে মোহিনীর হাতে থাকাটায় কল করতেই সেটা বেজে উঠলো। অর্ণব ইশারা করে মোহিনীকে কলটা ধরতে বললেন। সবুজ বোতামটা চেপে কানে ধরতেই অর্ণব বললেন,
“কী? এবার বিশ্বাস হলো তো?”
মোহিনী অর্ণবের দিকে তাকিয়ে দু’বার ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকালেন।
.
.
.
বাড়ি ফিরতেই একটা শোরগোল কানে এলো অর্ণবের। বাড়ির সবাই উপস্থিত সেখানে। কেউ বাদ নেই। অতিরিক্ত আরও তিন-চারজনকে দেখলেন। তাদের মধ্যে একজন শেফালী। বউয়ের সাজে এককোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে কাঁদছে মেয়েটা। অর্ণব সেখানে দাঁড়িয়েই ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন যে কী হয়েছে। একজন ভদ্রলোক হাত জোর করে অনুরাধার কাছে আকুতি করছেন। কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে উনি শেফালীর বাবা।
“দয়া করুন। গ্রামে আমাদেরও একটা মান সম্মান আছে। আমাদের বিষয়টা একটু বোঝার চেষ্টা করুন।”
অনুরাধা চড়া গলায় বললেন,
“মান সম্মান? কিসের মান সম্মানের কথা বলছেন? আপনার ছোট মেয়ে কেন মরেছে তা বুঝি কেউ জানে না ভেবেছেন? এরপরও মান সম্মানের কথা বলছেন?”
“আমার মেয়ে যে লগ্নভ্রষ্টা হয়ে যাবে। পরে কে বিয়ে করবে ওকে?”
“সেটা তো আমাদের দেখার বিষয় না। আপনার উচিত ছিল নিজের মেয়েকে ধরে রাখা। আপনি পারেননি সেটা আপনার ব্যর্থতা।”
পাশে থেকে আরেকজন লোক উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,
“দেখুন, আপনার ছেলের জন্য আমার ভাইঝির বিয়ে ভেঙেছে। ও রাস্তায় বরের গাড়ি থামিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে তাদের ফেরত পাঠিয়েছে। তা নাহলে ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়ে কেন ভাঙতে যাবে? আপনি যদি শমিতের সাথে শেফালীর বিয়ে না দেন তবে কিন্তু আমরা পুলিশের সাহায্য নিতে বাধ্য হব। পুরো গ্রাম জানে আপনার ছেলে আমাদের মেয়ের পেছনে ঘোরে।”
“হুমকি দিচ্ছেন আমাকে আপনি? হুমকি দিচ্ছেন? যা পারেন করেন। আমি আমার ছেলেকে এমন পরিবারের এমন একটা মেয়ের সাথে কখনোই বিয়ে দেব না। আমার ছেলেকে আমি নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করাবো। আপনারা বের হন বাড়ি থেকে। নাহলে দারোয়ান ডেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করাবো।”
শেফালী অনর্গল কেঁদেই চলেছেন। অনুরাধা তার সামনে গিয়ে বললেন,
“এই মেয়ে, লজ্জা বলতে কিছু নেই তোমার? আমার ছেলেকে ফাঁসিয়ে ওর ঘাড়ে চেপে বসতে চাইছো? লজ্জা করে না? নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে কোথাকার।”
শেফালী আরও জোরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। শেফালীর বাবা তার হাত ধরে বললেন,
“চল এখান থেকে।”
“বাবা।”
স্ব জোরে শেফালীর গালে চড় বসিয়ে দিলেন তিনি। এরপর টানতে টানতে তাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। মেয়েটা করুণ চোখে একদৃষ্টিতে শুধু শমিতের দিকেই চেয়ে রইলো। অর্ণব শমিতকে দেখে বেশ অবাক হলেন। এতোকিছু হয়ে গেল, তার মা তার প্রেমিকা আর প্রেমিকার পরিবারকে এতোকিছু বললেন, অপমান করলেন অথচ তিনি একবারও এর প্রতিবাদ করলেন না। অনুরাধার রাগ দেখে আজ কেউ আর তাকে থামায়নি। চাইলেও পারতো না। অর্ণব নিজেও তো শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেই গেলেন। আচ্ছা, এমনটা যদি মোহিনীর সাথে হতো তাহলে তিনি কি পারতেন চুপ থাকতে? একদমই না। অবশ্যই এসবের প্রতিবাদ করতেন। সবাই চলে গেলে অর্ণব শমিতকে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুই সত্যিই শেফালীর বিয়ে ভেঙেছিস?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“ভালোবাসি ওকে। কী করে বিয়ে হয়ে যেতে দিতাম?”
“সত্যিই ভালোবাসিস? তাহলে নিচে কিছু বললি না কেন? পিসির কথার প্রতিবাদ করলি না কেন?”
“বিশ্বব্রহ্মাণ্ড উল্টে গেলেও মায়ের মুখের ওপর কথা বলার, তার অবাধ্য হওয়ার, বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস আমার নেই।”
“কেন?”
“তার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর ভয়।”
“নিজের মাকে ভালোবাসিস আর ওই মেয়েটার সাথে শুধু ভালোবাসার নাটক করে গেছিস এতোদিন?”
“এমনটা নয় অর্ণব। তুই আমার পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা কর। আমার জায়গায় যদি তুই থাকতিস, মা আর শেফালীর জায়গায় যদি বড় মামি আর মোহিনী থাকতো তাহলে তুই পারতিস বড়মার বিরুদ্ধে যেতে?”
অর্ণব কিছু সময় চুপ রইলেন। এরপর বললেন,
“অবশ্যই পারতাম। মা যদি ভুল করতেন তাহলে আমি অবশ্যই তার প্রতিবাদ করতাম।”
“বলা সহজ অর্ণব। করা নয়। মায়ের আমি ছাড়া কেউ নেই। আমি তাকে কষ্ট দিতে পারবো না।”
“তাহলে তুই এখন কী করবি?”
“জানি না। যাই করি, তার অবাধ্য হয়ে তাকে কষ্ট দেওয়া সম্ভব নয়। তুই আমাকে এ নিয়ে এখন আর কিছু বলিস না। আমার মাথা ঠিক নেই। পরে কথা বলবো।”
শমিত চলে গেলেন। পুরো বাড়িটায় একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ধীরে ধীরে আবার সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু এসবের মাঝে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে অস্থির হয়ে উঠেছেন চিত্রা। প্রচন্ড ঘামছেন তিনি। একটা ভয় তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। হাত দিয়ে নিজের পেট চেপে ধরে বসে পড়লেন তিনি।
.
.
.
“তুমি কথা দিয়েছিলে শ্যামল। তুমি বলেছিলে তুমি আমাকে বিয়ে করবে। যে করেই হোক মা-বাবাকে বোঝাবে। তাহলে এখনো আসছো না কেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে?”
“তোর কী মনে হয়? আমি এখনো তোকে বিয়ে করবো? তোর ভাইয়ের জন্য আমার বোনের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। এরপরও ভাবলি কী করে যে আমি তোকে বিয়ে করবো?”
“তুমি এভাবে কথা বলছো কেন আমার সাথে?”
“তো কীভাবে কথা বলবো? তোকে আমি বিয়ে করবো না। বুঝেছিস?”
“করবে না মানে? তাহলে আমার সাথে সম্পর্ক করলে কেন? তোমার বাচ্চা আছে আমার পেটে। বিয়ে না করলে সবাইকে বলে দেব।”
এতোক্ষণ কেঁদে কেঁদে করুণ স্বরে কথা বললেও এবার চিত্রা শাসিয়ে উঠলেন। তার কথায় কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন শ্যামল।
“বাচ্চা মানে? কার বাচ্চা? আমি কিছু জানি না। এর দায় আমি নিতে পারবো না।”
চিত্রা দু’হাতে শ্যামলের পোশাকের কলার টেনে ধরলেন।
“কুত্তারবাচ্চা। নিবি না মানে? আমার জীবন নষ্ট করে তুই বেঁচে যাবি ভেবেছিস? ভুলে গেছিস আমি কোন বাড়ির মেয়ে? আমি মুখ খুললে সবাই একদম পিষে ফেলবে তোকে।”
নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন শ্যামল।
“যাকে যা খুশি বল। প্রমাণ করবি কী করে এটা আমার বাচ্চা? আর করলেও লোকে তোকে দোষ দেবে। তুই হবি সবার চোখে দুশ্চরিত্রা।”
নিজের কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বসে পড়লেন চিত্রা।
“ভুল তো আমি করেছি। তোর মতো একটা কাপুরষকে ভালোবেসেছিলাম। দাদার কথা শুনে যদি তোর থেকে দূরে থাকতাম তো আজ আমার এই সর্বনাশ হতো না। হায় ভগবান! এ কী করলাম আমি? সমাজে মুখ দেখাবো কী করে?”
হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন চিত্রা। অবস্থা বেগতিক দেখে শ্যামল দৌঁড় লাগালেন। পেছন থেকে চিত্রা চোর চোর বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। দেওয়াল টপকাতে যাবেন ঠিক এমন সময় কেউ শ্যামলের পা টেনে ধরলেন। চিত্রা দূর থেকে দেখলেন রামু শ্যামলকে ধরে ফেলেছেন। চৌকিদারও দৌঁড়ে আসছে। তাকে কেউ দেখে ফেলার আগেই অন্ধকারে সেখান থেকে পালিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে কয়েকজনের ভীড় হয়ে গেলে। সবার হাতেই লাঠি। যে যেমন পারছে ইচ্ছেমতো পেটাচ্ছে শ্যামলকে। ঘরে ফিরে ভালো করে দরজা বন্ধ করে দিলেন চিত্রা। থরথর করে কাঁপছেন তিনি। টেবিলের ওপর থেকে কাগজ কলম নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তার হাত কাঁপছে বিধায় ঠিকমতো লিখতেও পারছেন না। ভাঙা ভাঙা কয়েকটা শব্দে লেখা শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি।
.
.
প্রতিদিনের মতো একটা নতুন সূর্যের উদয় হলো। একটা নতুন দিন। কিন্তু এই দিনটাই পুরো বাড়িতে কালো মেঘের ছায়ার মতো ঘনিয়ে এলো। কারও চিৎকার কানে আসছে অর্ণবের। চোখ খুললেন তিনি। আড়মোড়া ভেঙে উঠে এসে ঘর থেকে বের হতেই চিৎকারটা আরও স্পষ্ট শুনতে পেলেন। শকুন্তলা ডাকছেন চিত্রাকে। চিত্রার ঘরের দরজার সামনে কয়েকজনের ভীড় হয়ে গেছে। তার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আম্রপালি আর নিচ থেকে অনুরাধাও চলে এলেন। অর্ণব এগিয়ে গেলেন সেখানে।
“কী সমস্যা এখানে?”
“পদ্মাকে পাঠিয়েছিলাম চিত্রাকে ডাকতে। দরজা খোলেনি। এখন আমি এসে সেই কখন থেকে ডাকছি তাও দরজা খুলছে না।”
শকুন্তলা আরও কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিলেন। অর্ণব বললেন,
“আপনি একটু সরুন। আমি দেখছি।”
শকুন্তলা সরে গেলে অর্ণব দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে চিত্রাকে ডাকলেন কয়েকবার। কিন্তু কাজ না হওয়ায় দরজা ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন। দরজায় জোরে একটা লাথি দিলেন। কিন্তু কিছুই হলো না। আবারও দিলেন। এবারও ভাঙলো না। এবার আরেকটু জোরে লাথি দিতেই দরজাটা খুলে গেল। মেঝেতে চিত্রার নিথর দেহটা পড়ে আছে। মুখ দিয়ে সাদা ফেনার মতো কী যেন পড়ে দাগ হয়ে আছে। হাতের কিছুটা দূরেই বিষের শিশিটা। শকুন্তলা ভেতরে ঢুকেই আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ধপ করে নিচে বসে পড়লেন। এক মুহূর্তেই চারদিক একদম নীরব হয়ে গেল। পদ্মাবতী দৌঁড়ে চিত্রার কাছে গিয়ে ওকে ডাকতে লাগলেন। সবার আগে ওর কান্নার শব্দটাই কানে ভেসে এলো সকলের। চিত্রার বা’হাতে একটা ভাজ করা কাগজ দেখতে পেলেন অর্ণব। তার হাত থেকে নিয়ে খুলে পড়তে শুরু করলেন। এমন সময় শকুন্তলা চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন।
চলবে…
#মেহেরজান
#পর্ব-২৯
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
“মরা ছাড়া আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি যে আমি। জানি আমার মৃত্যুতে সবাই অনেক কষ্ট পাবে। মা কাঁদবে অনেক। কিন্তু বেঁচে থাকলে হয়তো তিনিই আফসোস করতেন এমন মেয়ে জন্ম দেওয়ার জন্য। দাদা আমাকে সাবধান করেছিল। কিন্তু আমি তার কথায় কান না দিয়ে নিজের সর্বনাশ নিজেই করেছি। একবার যদি শুনতাম দাদার কথাগুলো তাহলে আজ আমাকে এভাবে বিষ খেয়ে মরতে হতো না। তবুও একটা আশা ছিল। হয়তো বেঁচে থাকতাম। কিন্তু আজ পিসি যখন শেফালী আর ওর পরিবারকে অপমান করে বের করে দিল, সে আশাটাও সেখানেই ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। শ্যামল শুধু একটা অজুহাত খুঁজছিল আমাকে ছাড়ার। আর সেটা পেয়েও গেল। আমি যে ভুল করেছি তা যেন আর কেউ না করে।”
চিঠিটা পড়ে পাশে রাখলেন শমিত। অনেকদিন পর ছাদে দুই ভাই মদ আর সিগার নিয়ে বসেছেন। অর্ণবের দিকে হাত বাড়াতেই অর্ণব মদের বোতলটা এগিয়ে দিলেন তার দিকে। বোতলে যতটুকু বাকি ছিল শমিত পুরোটা ঢকঢক করে খেয়ে ফেললেন। আজ প্রথমবারে মতো মদে হাত লাগিয়েছেন শমিত। পাঞ্জাবির হাতায় দু-চোখ মুছে নিয়ে বললেন,
“কাল রাতে শেফালীর বাবাও মারা গেছেন। ফাঁসি দিয়ে। আর আমাদের বোনটা…।”
কথা সম্পূর্ণ করলেন না শমিত। অর্ণবও কোনো জবাব দিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শমিত আবার বললেন,
“কিছু সময়ের ব্যবধানে দুটো পরিবারের দু’জন মারা গেল। এর জন্য আমিই দায়ী। তাই না রে অর্ণব?”
অর্ণব এবারও চুপ রইলেন।
“দোষ করলাম আমি আর শাস্তি পাচ্ছে অন্যরা। মা ভুল ছিলেন। তবুও আমি চুপ রইলাম। আমি এভাবে চুপ করে না থাকলে আজ হয়তো তারা দু’জনেই বেঁচে থাকতো।”
চিত্রার চিঠিটা ছিড়ে ফেলে দিয়ে অর্ণব বললেন,
“তুই নিজের ভুল বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছিস। এখন আর কিছুই করার নেই।”
আবারও কিছু সময় দু’জনেই চুপ রইলেন। এরপর শমিত বললেন,
“শেফালীর বাবা আর চিত্রাকে তো ফেরাতে পারবো না কিন্তু…।”
“কিন্তু?”
“আমি নিজের ভুলটা শোধরাতে চাই অর্ণব। তুই আমার সাথে থাকবি তো?”
“কাল সকালে দেখা যাবে। আজ বাড়ির কারও মন ভালো নেই। তুই ঘুমাতে যা।”
“উঁহু। যা করার আজই করবো।”
অর্ণব কিছুসময় শমিতের দিকে চেয়ে রইলেন। এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা একটা বাড়ির উঠোনে উপস্থিত হলেন। তিনদিকে তিনটা বড় বড় টিনের ঘর। আর অন্যদিকে ছোট্ট একটা রান্নাঘর। মাঝখানে বেশ বড় একটা উঠোন। বাড়ির ভেতর থেকে শেফালীর মা আর তার পেছন পেছন শেফালীও বের হয়ে এলেন। শমিত হাত জোর করে তাদের সামনে দাঁড়ালেন।
.
.
.
শমিতের হাত আঁকড়ে ধরে তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন শেফালী। অনুরাধা রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,
“এসব হচ্ছেটা কী অর্ণব?”
অর্ণব চেয়ারে আয়েসি ভংগিমায় বসে বললেন,
“দেখতেই তো পারছেন পিসি। বিয়ে করেছে ওরা।”
“বিয়ে করেছে বললেই হলো? আমি মানি না এই বিয়ে।”
“এখন আর আপনার মানা না মানায় কিছু যায় আসে না। এর চেয়ে ভালো আপনি বরং ওদের মেনেই নিন।”
সাবিত্রী সেখানে দাঁড়িয়েই সব শুনছেন। চিত্রার মৃত্যুর খবর পেয়ে কাল যতদ্রুত সম্ভব ছুটে এসেছেন এখানে। অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,
“কাল তোমার বোনটা মারা গেল। আর আজই তুমি এমন একটা কাজ করলে? তোমাকে দিয়ে এটা আশা করিনি।”
“ক্ষমা করবেন কিন্তু আপনার এই বিষয়ে কিছু না বলাই ভালো।”
সাবিত্রী চুপ হয়ে গেলেন। আম্রপালি বলে উঠলেন,
“অর্ণব, কীভাবে কথা বলছিস তুই?”
“আমি দুঃখিত মা। তবে আপনিও দয়া করে এব্যাপারে জড়াবেন না। আমি পিসির সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই। শুধু শমিত আর শেফালী থাকবে এখানে।”
অর্ণবের কথা শুনে আম্রপালি আর সাবিত্রী বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। কিন্তু কোণায় পদ্মাবতী আগের মতোই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তার উদ্দেশ্যে অর্ণব বললেন,
“তোমাকে কি আলাদা করে বলতে হবে?”
পদ্মাবতী নাবোধক মাথা নাড়লেন।
“তাহলে?”
অর্ণব প্রশ্ন করা মাত্রই পদ্মাবতী দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। উঠে দাঁড়ালেন অর্ণব। বললেন,
“জানেন পিসি, এ বাড়ি থেকে চিত্রার লাশ ওঠার আগে শেফালীদের বাড়ির একজনের লাশ উঠেছিল। কে জানেন? শেফালীর বাবা। যাকে আপনি যা-তা বলে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। অথচ দোষটা কিন্তু আপনার ছেলেরই ছিল। আর যে দু’জন মারা গেল, তাদের মৃত্যুর জন্য কে দায়ী জানেন? আপনি।”
“আমি কীভাবে? চিত্রা কেন মরেছে সেটা আমি কীভাবে জানবো?”
“সেটা আমি এখন আপনাকে বোঝাতে পারবো। আসলে জানাতেই চাই না। কিন্তু শেফালীর বাবার মৃত্যুর জন্য আপনিই দায়ী এটা কি মানেন?”
অনুরাধা জবাব দিলেন না। অর্ণব আবার বললেন,
“না মানলেও কিছু করার নেই। এতে সত্য বদলাবে না। এবার বলুন, দু’জনের মৃত্যুর বোঝা মাথায় নিয়ে বাঁচতে পারবেন শান্তিতে?”
পাশে থেকে শমিত তাকে ডেকে উঠলে হাতের ইশারায় শমিতকে থামিয়ে দিলেন তিনি। অনুরাধার উদ্দেশ্যে আবার বললেন,
“পারবেন না পিসি। তাই ওদের বিয়েটা নিয়ে আর অশান্তি বাড়াবেন না। আর মেয়েটাকেও এবাড়িতে শান্তিতে বাঁচতে দিন।”
অনুরাধা শমিতের উদ্দেশ্যে বললেন,
“কিরে? কিছু বলবি না তুই? ও আমাকে এসব মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে আর তুই চুপ করে আছিস?”
“অর্ণব কিছু ভুল বলছে না মা। আর আমিও কোনো ভুল করিনি। তাই আমাদের বিয়েটা আপনার মেনে নেওয়াই ঠিক হবে।”
অনুরাধা হতভম্ব হয়ে শমিতের দিকে তাকিয়ে রইলেন। পেছনে শেফালীর অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো কেমন যেন চকচক করে উঠেছে। ঠোঁটে বাঁকা হাসি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এরপর অর্ণবের দিকে তাকালেন। তার শান্ত চেহারার ঠোঁটে হাসির স্মিত রেখা ফুটে উঠছে। অনুধারার চোখ জলে ভরে গেল। আবার শমিতের দিকে ঘুরে বললেন,
“এইদিন দেখার জন্য তোকে পেটে ধরেছিলাম আমি? আমার ভালোবাসার এই প্রতিদান দিলি তুই?”
শমিত কিছু বলতে যাবেন তার আগেই অনুরাধা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। শমিত তাকে আঁটকাতে যাবেন তখনই অর্ণব থামিয়ে দিলেন তাকে।
“দাঁড়া।”
“কিন্তু মা?”
“পিসি নিজেই শান্ত হয়ে যাবেন। তুই চিন্তা করিস না।”
.
.
.
“অর্ণব এটা কেমন কাজ করলো আম্রপালি? চিত্রাটা মারা গেল দু’দিনও হলো না আর ও শমিতকে নিয়ে এমন একটা কাজ করলো। তুমি আগে থেকেই জানতে এসব। তাই না?”
“বিশ্বাস করুন মাসিমা। আমি এসবের কিচ্ছু জানতাম না। অর্ণবের মধ্যে আজ যে পরিবর্তনটা দেখলাম তা আগে কখনো দেখিনি।”
“কাল সারারাত ছেলে দু’টো বাড়িতে ছিল না। মন মেজাজ ভালো নেই বলে সেদিকে তেমন একটা খেয়াল ছিল না কারও। কিন্তু ওরা যে এমন একটা কাজ করে বসবে তা ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পায়নি।”
কথা বলতে বলতে দু’জনে শকুন্তলার ঘরে ঢুকলেন। খাটের ওপর উল্টো দিকে ঘুরে শুয়ে রয়েছেন শকুন্তলা। একদম ভেঙে পড়েছেন তিনি। একদিনেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পদ্মাবতী আগে থেকেই সেখানে ছিলেন। শকুন্তলাকে উঠিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলেন। সাবিত্রী তার পাশে বসে আম্রপালি আর পদ্মাবতীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“তোমরা কাল থেকে ওর সাথেই আছো। এখন নিজেদের ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও। তাছাড়াও তোমাদের অন্যান্য কাজও আছে। আমি আছি শকুন্তলার সাথে। তোমরা যাও।”
“কিছু লাগলে আমাদের জানাবেন মাসিমা।”
“ঠিকাছে।”
আম্রপালি আর পদ্মাবতী চলে গেলে শকুন্তলা বললেন,
“বাড়িতে তখন কিসের চেঁচামেচি হলো মা?”
“শমিত বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে।”
শকুন্তলা তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বললেন,
“এদিকে আমার মেয়ে মরলো আর ওদিকে ওরা বিয়ে করছে।”
“আরে ওই অর্ণব করিয়েছে ওদের বিয়ে।”
“অর্ণব?!”
“হ্যাঁ।
“অভ্র আসেনি মা?”
“এখনো তো না।”
“আসবেও না দেখে নিও তুমি। ও কখনো চিত্রাকে নিজের মেয়ে ভেবেছে নাকি? জন্মের সময়ও আসেনি আর এখন মরেছে তবুও আসবে না।”
“আহ। এমন কথা বলছিস কেন? যতই হোক চিত্রা ওর মেয়ে। তখন না হয় সেই বিলেতে ছিল বলে আর আসতে পারেনি। তাই বলে কি এখনো আসবে না?”
“কী করবে ও এসে? চিত্রা কি এখনো আছে নাকি? সারাজীবন যে নিজের মেয়েকে একবার ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নেয়নি, এখন সে মেয়ে মরার পর কী দেখতে আসবে? তুমি খুঁজে খুঁজে আমাকে এমন একটা লোকের সাথে বিয়ে দিলে যার কাছে নিজের স্ত্রী আর মেয়ের কোনো মূল্যই নেই।”
“এসবে তোর তো কোনো দোষ নেইরে মা। অভ্র ছেলে চেয়েছিল। হয়েছিলোও তো। কিন্তু মরা বাচ্চা হলে সেখানে তোর কী দোষ? দেখিস, ও ঠিক একদিন তোর কষ্টটাও বুঝবে।”
“ওর আর ওর সহানুভূতির কোনো প্রয়োজন আমার নেই। আমার যা ছিল সব চিত্রাই ছিল। আর সেও নেই এখন। সব শেষ হয়ে গেল। দোষ তো আমার মেয়েটারও ছিল না মা। ও কেন মরলো?”
সাবিত্রীর গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন শকুন্তলা। নিজের ভেজা চোখ দুটো মুছে তার মাথায় হাত রাখলেন সাবিত্রী। কী একটা বলতে গিয়েও কেন যেন বললেন না। হঠাৎ-ই বাইরে থেকে অভ্র বাবুর কণ্ঠ ভেসে এলো।
চলবে…