#মেহেরজান
#পর্ব-২৬
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
ঘুমের মাঝেই একপাশ থেকে অন্যপাশে ঘুরলেন মোহিনী। এর মাঝে দুচোখ একবার হালকা খোলায় কাউকে যেন দেখতে পেলেন। কিন্তু যাকে দেখলেন সে আদৌও কি এখানে নাকি মনের ভুল? আলসেমিতে চোখ খুলে উঠতে ইচ্ছে করছে না তার। চোখ বন্ধ রেখেই আবার সেদিকে ঘুরলেন তিনি। এক চোখ বন্ধ রেখে আরেক চোখ হালকা খুললেন। অর্ণব আয়েসি ভংগিতে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছেন। তার ওষ্ঠাধর হাসছে। মোহিনীকে একচোখ খুলতে দেখে তার উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন অর্ণব। এক মুহুর্তেই উঠে বসলেন মোহিনী। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে আছে। একবার ভালো করে কচলে নিলেন। চোখে এখন আর ঘুমের কোনো চিহ্নই নেই। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। করবেনইবা কীভাবে? স্বপ্ন নাকি বাস্তব তা বোঝার জন্য নিজের হাতে জোরে চিমটি কাটলেন। ব্যথা অনুভব হওয়ায় মুহুর্তেই আবার হাত দিয়ে সে জায়গাটা ঘষতে লাগলেন।
“এবার বিশ্বাস হলো? স্বপ্ন দেখছেন না। বাস্তবই।”
মোহিনী অর্ণবের কাছে এসে তর্জনী দিয়ে তার দেহ ছুয়ে দেখলেন। অর্ণবের চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে গেল। চুটকি বাজাতেই তার চোখের দিকে তাকালেন মোহিনী। অর্ণব ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
“এখনো বিশ্বাস হয়নি?”
“আপনি এবাড়িতে ঢুকলেন কীভাবে?”
“যেভাবে সবাই ঢোকে। দরজা দিয়ে।”
“মানে বাড়ির সীমানায় ঢুকলেন কীভাবে? দেওয়াল টপকে?”
“আমি কী চোর যে আমাকে দেওয়াল টপকে আসতে হবে?”
“কেউ আঁটকালো না আপনাকে? সবাই আসতে দিল?”
অর্ণব পেছনের দিকে হেলান দিয়ে আরেকটু আরাম করে বসলেন। বললেন,
“কার এতো সাহস যে আমাকে আঁটকাবে?”
রজনী ঘরে ঢুকলেন। হাতে এক কাপ চা। অর্ণবকে দিতেই তিনি বললেন,
“ধন্যবাদ।”
“আর কিছু প্রয়োজন পড়লে ডাকবেন।”
“এখন আর তার প্রয়োজন পড়বে না।”
মোহিনী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। রজনী চলে যেতেই ধপ করে অর্ণবের পাশে বসে পড়লেন। সামনে আগে থেকেই একটা খালি চায়ের কাপ রয়েছে। অর্ণব চায়ে চুমুক বসাতেই মোহিনী জিজ্ঞেস করলেন,
“কখন এসেছেন আপনি?”
“হবে একঘন্টার মতো।”
“এতোক্ষণ বসে ছিলেন! আমাকে ডাকতে পারতেন।”
“ইচ্ছে করলো না।”
“কেন?”
“আপনার ঘুমন্ত মুখটা দেখার সৌভাগ্য আগে কখনো হয়নি। অপরুপ সুন্দর লাগছিল আপনাকে। তাই আর ডাকিনি।”
“ঘুমিয়ে থেকে ফুলে যাওয়া তৈলাক্ত মুখটা সুন্দর?”
“আপনাকে তো তাই লাগছিল। একদম নিষ্পাপ একটা বাচ্চার মতো করে ঘুমাচ্ছিলেন। হা করে।”
মোহিনী সামান্য হাসলেন।
“কেন এসেছেন?”
“আপনার সাথে দেখা করতে কারণের প্রয়োজন? আর যদি কারণের কথাই বলেন তাহলে আপনি যদি এভাবে এতো বেলা ঘুমিয়ে থাকেন, আমার সাথে দেখা করতে এতো অনিয়ম করেন তাহলে আমাকে তো আসতেই হবে।”
“মোটেও আমি এতো বেলা ঘুমাই না। সকালে উঠেছিলাম। নাস্তা করে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আচ্ছা, আপনাকে এখানে আসতে কেউ দেখেনি তো?”
“আমি লুকিয়ে লুকিয়ে আসিনি। যারা দেখার দেখেছে।”
“সম্পর্কটা কেন এতো আগাচ্ছেন অর্ণব? যার পরিণতির কোনো নিশ্চয়তাই নেই।”
অর্ণব চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন,
“পরিণতি কী হবে জানিনা। তবে আমি আপনার হাত কখনোই ছাড়বো না মেহেরজান।”
.
.
.
চৈত্রের কাঠফাটা রোদে বারান্দায় রাখা দোপাটি গাছটা নুয়ে পড়ছে একদম। তিনদিন আগেই গাছটা এনে বারান্দায় লাগিয়েছেন পদ্মাবতী। কিন্তু ঠিকমতো যত্ন না নেওয়ায় তার এই হাল। অন্যদিকে নীল অপরাজিতা আর কুঞ্জলতাটা এখনো বারান্দার শোভাবর্ধন করেই যাচ্ছে। পদ্মাবতী চায়ের জন্য কয়েকটা অপরাজিতা তুলে নিলেন। ঘরে এসে টেবিলের ওপর ফুলগুলো রাখতেই জানালার বাইরে চোখ পড়লো তার। মুহুর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেল। জানালার একদম কাছের নিমগাছটায় পাখি বাসা বেঁধেছে। ক’দিন পর ডিম পারবে। তারপর সেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে। সারাদিন কিচিরমিচির করবে। ভাবতেই খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে পদ্মাবতীর। কত শখ ছিল একটা পাখি পোষার। কিন্তু শকুন্তলার অনুমতি ছিল না বলে সে শখ আর পূরণ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এখন ঘরে না পুষলেও জানালা দিয়ে তো প্রতিদিন দেখতে পারবেন। আচ্ছা, কী পাখির বাসা এটা? পদ্মাবতী আশেপাশে দেখতে লাগলেন। কিন্তু কোনো পাখি দেখতে পেলেন না। হয়তো খাবারের সন্ধানে কোথাও উড়ে বেড়াচ্ছে। পরে আসলেই দেখতে পারবেন।
“পদ্মা।”
চকিতে পেছনে ঘুরলেন পদ্মাবতী। মটরশুঁটির ডালা হাতে আম্রপালি দাঁড়িয়ে আছেন। পদ্মাবতী ঝটপট এগিয়ে গিয়ে তার হাত থেকে ডালাটা নিয়ে বসে পড়লেন খোসা ছাড়াতে। তার সাথে আম্রপালিও বসলেন। খোসা ছিলতে ছিলতে বললেন,
“খেয়েছিস?”
“হুম।”
“কী খেলি?”
পদ্মাবতী একটু ভেবে বললেন,
“ওইতো গরম ভাত, মাছ, ডাল আর…”
আম্রপালি থামিয়ে দিলেন।
“আর মিথ্যে বলিস না। এসবের কিছুই রান্না হয়নি আজ।”
“তাহলে?”
“যদি খেতি তাহলেই দেখতে পেতি। খিচুড়ি, মাংস আর ডিমের তরকারি করেছিল শকুন্তলা।”
পদ্মাবতী শুকনো ঢোক গিললেন। সকালে একবার মাংসের গন্ধ এসেছিস তার নাকে। আরেকটু ভেবে যদি উত্তর দিতেন তাহলে আর ধরা পড়তে হতো না। এ ভেবে আফসোস করতে লাগলেন তিনি।
“মিথ্যে বললি কেন?”
“সত্যি বললে বকুনি দিতেন।”
“বকেছি এখন?”
পদ্মাবতী দুদিকে মাথা নাড়লেন।
“তাহলে? আর খাসনি কেন এখনো?”
“ইচ্ছে করছিল না।”
“ইচ্ছে না করলেই খাবিনা? আয়নায় মুখটা দেখেছিস? আরও শুকিয়ে গেছিস। চোখ দুটো একদম কোটরে চলে গেছে। খাওয়াদাওয়ায় এতো অনিয়ম করছিস কেন?”
“কই অনিয়ম করলাম? আজ খাইনি শুধু।”
“না খেয়ে থাকতে থাকতে মাথা ঘুরে যখন পড়বি তখন টের পাবি কই অনিয়ম করেছিস।”
“আর করবো না।”
“সবসময় এক কথা। আর করবো না! ইদানীং তোকে প্রায়ই দেখি মনমরা হয়ে থাকিস। কেন বলতো?”
“কই? না তো।”
“বললেই হলো? আমার কি চোখ নেই? সত্যি করে বল তোর কী হয়েছে? চিত্রা, মোহিনীর সাথে ঝগড়া হয়েছে?”
“ওদের সাথে আমার ঝগড়া হতে পারে?”
“তাহলে?”
“কিছুই হয়নি।”
“আজ মায়ের ঘরে গিয়েছিলাম। তার কাছে শুনলাম তুই নাকি কতদিন আগে তার ঘরে গিয়ে কাঁদছিলি?”
এবার পদ্মাবতী বুঝতে পারলেন আম্রপালি কোন উদ্দেশ্যে তার ঘরে এসেছেন। কিন্তু তিনি যাই করুন না কেন, পদ্মাবতী মুখ খুলছেন না কিছুতেই।
“আমি কেন কাঁদতে যাবো? তাও দিদার ঘরে গিয়ে। আমার কি ঘর নেই? দিদার তো এমনিতেই মাঝেমাঝে মাথা ঠিক থাকে না। কী বলতে কী বলেছে কে জানে।”
“তুই তাহলে যাসনি তার ঘরে?”
“যাই তো। শুধু ওষুধ খাওয়াতে যাই। তাছাড়া তো তেমন যাওয়া হয় না দিদার ঘরে।”
আম্রপালি ভ্রু কুঞ্চিত করে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণের জন্য ঘরের মধ্যে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। নীরবতা ভেঙে আম্রপালি বললেন,
“অর্ণব যে কই গেছে। সকাল থেকে দেখছি না।”
“ওনাকে তো সকালে বাইরে যেতে দেখলাম।”
“কোন দিকে গেছে?”
“তা জানি না। শমিতদার সাথে গেছেন হয়তো।”
“কিন্তু শমিতকে তো ওর ঘরেই দেখে এলাম।”
পদ্মাবতী ঠোঁট উল্টে কাঁধ ঝাঁকালেন।
“তাহলে জানি না।”
“ইদানীং প্রায়ই ও যেন কই যায়। কিন্তু কই যায় তা দেখতে পারিনি।”
“কোনো কাজেই যায় নিশ্চয়।এতো চিন্তা করবেন না। সে তো আর বাচ্চা না।”
“বাচ্চা না তাতে কী? সন্তান ছোট হোক আর বড় হোক, সন্তানের জন্য মায়ের মন সবসময়ই চিন্তিত থাকে।”
পদ্মাবতী ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেললেন।
চলবে…
#মেহেরজান
#পর্ব-২৭
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
আম্রপালি আর শকুন্তলা সেই সকাল থেকে একটা কাজেই ব্যস্ত। বিভিন্ন রকমের আচার, মোয়া, নাড়ু বৈয়ামে ভরছেন। সাথে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পিঠে আর মিষ্টির হাড়ি। রসগোল্লা, সরপুরিয়া, সীতাভোগ, বরফি, ছাড়াবড়া, পান্তুয়াসহ বাহারি সব মিষ্টি। তাদের সাথে পদ্মাবতীও বসেছেন। খালি বৈয়ামগুলো ভালো করে মুছে দিয়ে তাদের হাতে হাতে সাহায্য করছেন। তিনি এখন আগের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছেন। কোনোকিছু নিয়ে এখন আর খারাপ লাগে না। সবসময় ঠোঁটের কোণে একটা হাসি লেগে থাকে। এই যেমন এখন লেগে আছে। শমিত আশেপাশেই ঘুরঘুর করছেন। নিজের উদরপূর্তির উদ্দেশ্যে। যখনই সুযোগ পাচ্ছেন, এসে একটা করে মিষ্টি পেটে চালান করে চলে যাচ্ছেন। ঠিক এমন সময় তিনি আবার এসে উপস্থিত হলেন। রসগোল্লার হাড়ির দিকে হাত বাড়াতেই আম্রপালি টান দিয়ে হাড়িটা সরিয়ে ফেললেন।
“উফ মামি, মোহিনী ছাড়া যেন আর কেউ-ই এসব খেতে পছন্দ করে না। আমাকে কি চোখে পড়ে না আপনাদের?”
“রান্নাঘরে আছে। ওখান থেকে খা। এগুলো খেতে হবে কেন? তোদের জন্য একটা হাড়ি রেখে দিয়েছি।”
“আগে বলবেন তো। আমি শুধু শুধু মোহিনীর ভাগেরটা খাচ্ছিলাম। ও জানলে তো আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে।”
পদ্মাবতী ফিক করে হেসে ফেললেন। শমিত রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই অর্ণব এসে উপস্থিত হলেন।
“বাহ! নববর্ষ উপলক্ষে এতো আয়োজন?”
শকুন্তলা বললেন,
“এগুলো নববর্ষের জন্য না তো।”
“তাহলে? এগুলো কার জন্য?”
“মোহিনীর জন্য।”
“মোহিনীর জন্য?!”
অর্ণব কিছুটা অবাক হলেন।
“কেন?”
“আজ জন্মদিন ওর।”
“শুধু ওর একার না। আমাদের পদ্মারও। দুটো তো একসাথেই হয়েছিল এই পহেলা বৈশাখের দিনে।”
মিষ্টি খেতে খেতে কথাটা বললেন শমিত। ইতোমধ্যেই রান্নাঘর থেকে একটা রসগোল্লার হাড়ি নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন তিনি। অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,
“এইনে, হা কর। মিষ্টি খা।”
কিছুটা জোরপূর্বকই অর্ণবের মুখে মিষ্টি ঢুকিয়ে দিলেন তিনি। অর্ণব একটা মোড়া টেনে ওখানে বসে পড়লেন। এরপর পদ্মাবতীকেও একই কথা বললেন শমিত। কিন্তু পদ্মাবতী খাওয়ার জন্য হা করতেই শমিত মুখের কাছে মিষ্টি নিয়ে আবার ফিরিয়ে নিয়ে নিজে খেয়ে ফেললেন।
“ধুর।”
“তুই খাবি কেন? তোরই তো জন্মদিন।”
“তাই বলে কি আমার খাওয়া বারণ নাকি? কই? মোহিনীর জন্য তো এতো কিছু ঠিকই যাচ্ছে।”
“সে তো মোহিনী এসব খেতে পছন্দ করে বলে বড় মামি ওর জন্য প্রতিবছরই পাঠান। তুই কি আর এতো খেতে পারবি?”
পদ্মাবতী শমিতের উদ্দেশ্যে ভেংচি কাটলেন।
“দেখেছো কত বড় বেয়াদব হয়েছে! বড় দাদাকে ভেংচি কাটে!”
আম্রপালি বললেন,
“তো তুই ওকে খোঁচাচ্ছিস কেন?”
“আমি আবার কই খোঁচালাম?”
“সেই ছোটবেলা থেকে মেয়েটাকে না কাঁদানো পর্যন্ত থামতি না। আর বলিস কই খোঁচালাম?”
“আর ও কেঁদে কেঁদে আপনাদের কাছে গিয়ে বিচার দিত। যার মিথ্যা সাক্ষী দিত মোহিনী। অথচ ঘটনাস্থলের আশেপাশেও ও থাকতো না। পদ্মা কেঁদে কেঁদে নাক টেনে বলতো মোহিনীকে আর সেও রাজি হয়ে যেত। তারপর…”
“তারপর আর কী? অনুরাধা ঝাড়ু নিয়ে সারা গ্রাম তোর পেছন পেছন দৌঁড়াতো।”
অনুরাধাও চলে এলেন। মুহূর্তেই যেন কয়েকজনের গল্পের আসর বসে গেল। অনুরাধা এসেই বললেন,
“আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল?”
শকুন্তলা বললেন,
“তোমাকে নিয়ে না। পদ্মাবতীর কথা হচ্ছিল। সেই পুচকে মেয়েটা আজ কত্তো বড় হয়ে গেছে। আমার তো এখনো মনে পরে ওর এবাড়িতে আসার প্রথম দিনের কথা। অর্ণব কী কান্ডটাই না করেছিল।”
অর্ণবের চোখেমুখে কৌতূহল ফুটে উঠলো।
“কী করেছিল ও?”
“পদ্মাকে এবাড়িতে নিয়ে আসায় যা রেগে গিয়েছিল। ওকে তো থাকতেই দেবে না কিছুতে এখানে। এরপর দিদি বোঝানোর পরে রাজি হয়েছে। আবার তোমাদের বাড়ি থেকে যখন ছুটি কাটিয়ে এসে মোহিনীকে দেখলো তখন আবার সব উল্টো। তখন তো কেঁদেই ফেলেছিল এই বলে যে এখন ওরা সবাই আমার জিনিসে ভাগ বসাবে। মায়ের ঘরে গিয়ে কেঁদে কেঁদে আমার আর দিদির নামে সে কি নালিশ! তখন আবার মা বোঝানোর পরে সে শান্ত হলো।”
অর্ণব কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে এসব ঘটনা মনে করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে বললেন,
“আমি এমন করিনি।”
“বললেই হলো নাকি। আমাদের স্পষ্ট মনে আছে।”
অর্ণব একটু গলা খাঁকারি দিয়ে আম্রপালির উদ্দেশ্যে বললেন,
“মা, খিদে পেয়েছে।”
“একটু রান্নাঘরে গিয়ে নিয়ে নে না। ওখানে বেড়ে রাখাই আছে তোর জন্য। দেখছিস তো আমি কাজ করছি।”
অর্ণব আর কথা না বাড়িয়ে উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। খাবারের থালা বের করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,
“মা, এখানে তো পান্তা-ইলিশ আর কী কী ভর্তা যেন রয়েছে।”
“ওগুলোই তো।”
“মানে?”
“কী মানে?”
“পান্তা কেন?”
“বিলেতে থেকে কি সব ভুলে গেছিস? আজ পান্তা খাবি না তো কী খাবি? চুপচাপ খেয়ে নে।”
অর্ণব অন্য কোনো উপায় খুঁজে পেলেন না। বাড়িতে আর কিছু রান্না হয়নি আজ। ইশারা করে শমিতকে ডাকলেন সেখানে।
“কী হয়েছে বল।”
“মেহের কই জানিস?”
“মেহের?”
“মোহিনী।”
“ওহ। দু’ঘন্টা বাদে কবরস্থানে গিয়ে দেখিস। পেয়ে যাবি।”
“কবরস্থানে! কেন?”
“গেলেই বুঝতে পারবি।”
“ঠিকাছে। তুই যা এখন।”
শমিত চলে গেলে অর্ণব একবার হাতঘড়িতে সময়টা দেখে নিলেন।
.
.
.
কবরস্থানের বাইরে থেকেই মোহিনীকে একটা কবরের পাশে বসে থাকতে দেখলেন অর্ণব। কাছে গিয়ে পেছন থেকে বললেন,
“এখানে কী করছেন মেহের?”
অর্ণবের প্রশ্নে বিচলিত হলেন না তিনি। পেছনে না ঘুরেই জবাব দিলেন। যেন আগে থেকেই জানতেন অর্ণব আসবেন।
“এটা আমার মায়ের কবর। মুসলিম হওয়ায় কবর দেওয়া হয়েছিল তাকে এখানে। প্রতিবছর এই দিনটায় আসি তার সাথে দেখা করতে।”
“আমি দুঃখিত। আমি আপনার কষ্টটা বুঝি।”
“উঁহু। দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। আর আমি যেমন আপনার বাবা হারানোর কষ্ট বুঝি না তেমন আপনিও আমার মা হারানোর কষ্ট বুঝবেন না। যদি কেউ বোঝে তাহলে সে শুধু পদ্মা।”
“হয়তো ঠিক বলেছেন আপনি।”
“পদ্মা আর আমার মাঝে আকাশপাতাল তফাৎ থাকলেও এই জিনিসটায় আমাদের খুব মিল। দু’জনে একই দিনে জন্মেছি আর একই দিনে মা হারিয়েছি।”
“হুম।”
“কিন্তু জানেন, আমার না একটুও কষ্ট লাগে না মায়ের জন্য।”
“কেন?”
“আপনার বাবা যখন মারা গেলেন তখন আপনি সব বুঝতেন। তার আদর স্নেহও পেয়েছিলেন। আর পদ্মা, সে বড়মার কাছে ওর মায়ের সব গল্প শুনেছে। কিন্তু আমি? আমি তো আমার মায়ের সম্পর্কে কিছু জানিই না। কে ছিলেন? নাম কী? কিছুই জানি না। জন্মের পর তার স্পর্শ পর্যন্ত পাইনি। শুধু তারামার কাছে জেনেছিলাম, তিনি নাকি পাকিস্তানি ছিলেন। উর্দু বলছিলেন। এখন আপনিই বলুন। একজন অপরিচিত মানুষের জন্য আমার কেন কষ্ট হবে? যাকে কখনো দেখিনি। চিনি না। তার সম্পর্কে কিছুই জানি না।”
“মায়ের সাথে তার সন্তানের সম্পর্ক জন্মের ন’মাস আগেই তৈরি হয়। আপনার যদি খারাপ না লাগতো, মায়ের প্রতি টান অনুভব না করতেন তাহলে কেন বারবার তার কবরের কাছে ছুটে আসতেন?”
এবার মোহিনী পেছনে ঘুরলেন। এতোক্ষণ শক্ত গলায় কথা বললেও অর্ণব দেখতে পেলেন মোহিনীর চোখ দিয়ে অনর্গল জল ঝরছে। আজ প্রথমবারের মতো তাকে কাঁদতে দেখলেন অর্ণব। মোহিনীর অশ্রুসিক্ত চোখের সাথে কিছুতেই নিজের চোখ মেলাতে পারছেন না অর্ণব। তার পাশে বসে জল মুছে দিয়ে বললেন,
“আমার বাঘিনীটা হঠাৎ এমন ভিজে বেড়াল হয়ে গেল কী করে?”
মোহিনী না চাইতেও তার কথায় হেসে ফেললেন।
“বাড়ি যান অর্ণব। আমি একটু পর আসছি।”
“আপনাকে একা রেখে যাচ্ছি না।”
“একসাথে যাওয়া ঠিক হবে না। আপনি আগে যান।”
অর্ণব জোরে একটা শ্বাস ছাড়লেন।
“ঠিকাছে। তাড়াতাড়ি আসবেন।”
.
.
.
হাতঘড়িতে বারবার সময় দেখছেন অর্ণব। অর্ণবকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেও মোহিনীর কোনো হদিস নেই। তিনি আর আসেননি। এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বারবার দেখছেন কেউ এলো কিনা। এমন সময় মোহিনীকে ঢুকতে দেখলেন গেইট দিয়ে। মেরুন রঙের আনারকলি পরা। অর্ণব তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেলেন। নিচে আসতেই দেখলেন পদ্মাবতী, শমিত সবাই তৈরি হয়ে সেখানে বসে আছেন।
“তোরা কোথাও যাচ্ছিস?”
“মেলায়।”
“মেলায় মানে?”
“আরে এখানে খুব বড় করে বৈশাখী মেলা হয়। যাবি তুই আমাদের সাথে?”
“বাচ্চা পেয়েছিস নাকি আমাকে? মেলায় যাবো কী করতে?”
“মেলায় কী শুধু বাচ্চারা যায় নাকি?”
“তা নয়তো কী?”
“ধুর। যেতে হবে না তোকে।”
মোহিনী ভেতরে ঢুকেই বললেন,
“বের হবে তোমরা এখন?”
অর্ণব শমিতকে টান দিয়ে পাশে এনে নিচু স্বরে বললেন,
“মোহিনীও যাবে নাকি তোদের সাথে?”
“যাবে না আবার! ওকে ছাড়া চলবে নাকি?”
“আগে বলিসনি কেন? আমিও যাবো তোদের সাথে।”
“কেন? তুই কেন যাবি? ওখানে তো বাচ্চারা যায়। তাই না?”
অর্ণব জোরে চিমটি কাটতেই শমিত চিৎকার করে উঠলেন। উপস্থিত সবাই তাদের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। শমিত গলা নিচু করে বললেন,
“আচ্ছা আচ্ছা। অভিনয় শুরু কর।”
“ঠিকাছে।”
শমিত এবার বাকিদের শুনিয়ে শুনিয়েই বললেন,
“অর্ণব, বলছিলাম কী। তুই তো আমাদের সাথে কোনোদিন মেলায় যাসনি। আজ চল তাহলে। দেখে আয় একটু।”
“না না। তোরাই যা। আমার এসব ভাল্লাগে না।”
শমিত আবার গলা নিচু করে বললেন,
“বেশি ভাব নিস না। নয়তো না নিয়েই চলে যাবো। চুপচাপ রাজি হয়ে যা।”
“আচ্ছা।”
শমিত আবার জোরে জোরে বললেন,
“আরে চল না। একদিন গেলে কিছুই হবে না। দেখবি ভালোই লাগবে।”
“ঠিকাছে। চল তাহলে। একটা দিনই তো।”
পদ্মাবতী বলে উঠলেন,
“তোমরা বারবার কানে কানে কী কথা বলছিলে শমিতদা?”
“কানে কানে কথা বলছিলাম? কই না তো। তুই ভুল দেখেছিস।”
“না, আমি স্পষ্ট দেখেছি।”
“আচ্ছা দেখেছিস ভালো করেছিস। বাদ দে তো। চল এবার।”
“চিত্রাও সাথে থাকলে ভালো হতো।”
“ও কী করে থাকবে? ও তো গেছে ওর মামার বাড়ি।”
মোহিনী বললেন,
“গিয়ে এসেও পড়েছে। ওই দেখো।”
হাত দিয়ে বাইরে ইশারা করলেন। ব্যাগবোঁচকা নিয়ে চিত্রা আসছেন। শকুন্তলা সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে চিত্রাকে আসতে দেখে বললেন,
“কি রে, তুই না একসপ্তাহর জন্য গেলি? দু’দিন বাদেই চলে এলি যে?”
“একটুও ভালো লাগছিল না। বিশেষ করে আপনার মায়ের জন্য। কী পরিমাণ যে কথা বলতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। বাপরে বাপ! কানটা ঝালাপালা হয়ে যায়। বুড়ি হয়ে গেছে অথচ এখনো চাপার জোর কমেনি।”
মোহিনী হেসে ফেললেন। পদ্মাবতী বললেন,
“তুই কি আমাদের সাথে যাবি?”
“কোথায়?”
“মেলায়।”
“না, তোরা যা। আমি অনেক ক্লান্ত এখন। একটু ঘুমাবো।”
শমিত বললেন,
“তাহলে আর কী করার। আমরা এখন বের হই চল।”
অর্ণব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“দাঁড়া। আমি পোশাক পাল্টে আসছি।”
“এখন আবার পোশাক পাল্টাতে যাবি?”
“সমস্যা কই?”
“দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।”
“পোশাক পাল্টাবে আর কতই বা সময় লাগবে?”
“তবুও।”
“তোর এতো তাড়া কেন বলতো।”
“কই? আমার কোনো তাড়া নেই। তুই যা। পোশাক পাল্টে আয়। আমরা অপেক্ষা করছি।”
শমিত কথা শেষ করার আগেই অর্ণব দোতলায় চলে গেলেন। নববর্ষে পরার মতো একটা পাঞ্জাবি পরে কিছুক্ষণের মাঝেই ফেরত এলেন। তারা বের হয়ে কিছুদূর যেতেই সামনে শেফালীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। অর্ণব গাড়ি চালাচ্ছিলেন। শমিত তাড়াতাড়ি থামাতে বললেন। অর্ণব গাড়ি থামালে শেফালীও এসে যোগ দিলেন তাদের সাথে। এরপর একদম মেলার গেইটের সামনে গিয়ে গাড়ি থামালেন। সবাইকে নামিয়ে দিয়ে একটা নিরাপদ জায়গায় গাড়িটা রেখে এলেন। সবাই ইতোমধ্যেই ভেতরে চলে গেছেন। কিন্তু তাদের খুঁজে বের করতে খুব একটা সময় লাগলো না অর্ণবের। শমিত বললেন,
“অর্ণব, ও শেফালী।”
“দেখেছি তোর সাথে আগেও। এটাও জানি কে ও।”
“দেখলেও পরিচয় তো ছিল না। তাই পরিচয়টা করিয়ে দিলাম।”
পদ্মাবতীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“ভালো করে শোন পদ্মা। এবারও যদি হারিয়ে যাস তো ঝালমুড়ির দোকানে বসে কাঁদবি না। একদম গেইটের সামনে চলে যাবি। আমরা খুঁজে নেবো তোকে।”
“উঁহু, আমি এবার হারাবোই না। সাথে সাথে থাকবো তোমাদের।”
“ঠিকাছে। মনে থাকে যেন।”
“থাকবে।”
শেফালী বলে উঠলেন,
“এই, হাতির পিঠে চড়বে?”
“হাতি কোথায় পেলে?”
“আরে ওইযে, সামনে দেখছো না। চলো না, আমার অনেকদিনের শখ।”
“উঠবে? চলো তাহলে। আমরা সবাই যাই।”
“তার আগে কুলফি কিনে দাও।”
শমিত পাঁচটা কুলফি নিয়ে আসলো। শেফালীর হাতে একটা দিয়ে পদ্মাবতী আর মোহিনীর দিকে বাড়ালে তারা বললেন,
“আমি খাবো না।”
“আমিও না।”
“খাবি না কেন?”
“নারকেল আছে এতে। মোহিনী আর আমি দুজনেই এটা পছন্দ করি না।”
“নারকেল ছাড়া তো নেই।”
“তাহলে থাক।”
“অর্ণব, তুই নে।”
“না, আমার ঠান্ডার সমস্যা আছে।”
“যাব্বাবা, তাহলে কিনলাম কেন?”
শেফালী বলে উঠলেন,
“রাখো তো, আমিই খেয়ে ফেলতে পারবো সব। চলো এবার।”
শেফালী আগে আগে হাতির পিঠের ওপরে করা আসনে উঠে বসলেন। মোহিনী এগিয়ে গেলে অর্ণব সবার অগোচরে তার হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিলেন। এক হাতির উপর চারজন উঠতে পারবে দেখে বুদ্ধি করে আগেভাগেই মোহিনীকে সরিয়ে নিলেন। পদ্মাবতী আর শমিতও উঠে পড়লে অর্ণব মোহিনীকে নিয়ে আরেকটায় উঠলেন। হাতি উঠে দাঁড়ানোর সময় একটু হেলতেই মোহিনী অর্ণবের হাত একদম খামচে ধরলেন। খুব খুশি দেখাচ্ছে তাদেরকে। দূর থেকে দু’জনকে একসাথে এতো খুশি দেখে অজান্তেই পদ্মাবতীর ঠোঁটে একটা মলিন হাসি ফুটে উঠলো।
চলবে…