মেহেরজান পর্ব-২৪+২৫

0
406

#মেহেরজান
#পর্ব-২৪
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

প্রতিবারের মতো এবারও চৌধুরী বাড়িতে বেশ বড় করে দোল উৎসব হচ্ছে। পাড়াপ্রতিবেশি সবাই এসে জড়ো হয়েছে এখানে। বাতাসে মিশে আছে নানা রঙের আবির। পরনের সাদা পোশাকগুলো রঙ লেগে একাকার। বাইরে সবাই হৈ-হুল্লোড়ে ব্যস্ত। অথচ এই আনন্দের দিনটাই পদ্মাবতীর জন্য হয়ে উঠেছে কষ্টের একটা দিন। সবাই যখন আবির আর গুলাল নিয়ে রঙ খেলায় মেতে উঠেছে, তখন তিনি নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ লুকিয়ে চাপাকান্নায় কাতর। হঠাৎ চিত্রা এসে দরজায় কয়েকটা ধাক্কা দিলেন।

“এই পদ্মা, সবাই বাইরে আর তুই ঘরে কী করছিস? তাড়াতাড়ি বের হ। সবাই নিচে কতো মজা করছে। আয় তাড়াতাড়ি।”

শোয়া থেকে উঠে বসলেন পদ্মাবতী। দুই গাল রঙে লাল হয়ে আছে। আর চোখ দুটো লাল হয়েছে কান্নায়। বিছানা থেকে নেমে চুল আর শাড়ি ঠিক করে নিলেন। বললেন,

“তুই যা। আমি একটু পরে আসছি। চোখে আবির ঢুকে গেছে। সেটাই পরিষ্কার করছি।”

“আচ্ছা। আমি গেলাম। আসিস কিন্তু তাড়াতাড়ি।”

স্নানঘরে ঢুকলেন পদ্মাবতী। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই চিনতে পারছেন না। কেঁদে চোখমুখ একদম ফুলিয়ে ফেলেছেন। এভাবে বাইরে গেলে যেকেউ বুঝে যাবে তিনি কান্না করেছেন। তারপর শুরু হবে হাজারো প্রশ্ন। কী হয়েছে, কেন কান্না করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যিই তো। কেন কান্না করেছেন তিনি? অর্ণব আর মোহিনীর কথা জানতে পেরে? অর্ণবের জন্য এভাবে কেঁদে চোখ ভাসিয়েছেন তিনি? হয়তো তাই। আজ সকালেও কী সুন্দর সবার সাথে আনন্দে মেতে ছিলেন। তার পাশে থেকেই অর্ণব যখন মোহিনীকে টেনে নিয়ে আবির লাগিয়ে ভালোবাসার কথা বললেন, নিজের চোখকান কোনোটাকেই বিশ্বাস করতে পারেননি তিনি। মুখে আবির লেগে থাকায় অন্যরা তাদের চিনতে পারেনি তাতে কী? তিনি তো ঠিকই চিনতে পেরেছেন তার ভালোবাসার মানুষটাকে। অথচ কালরাতেও কতটা আনন্দে ছিলেন অর্ণবের ফিরে আসা নিয়ে। আর ভাবতে পারলেন না তিনি। আবারও কেঁদে ফেললেন। চিৎকার করে। কিন্তু সেই চিৎকার কারও কানে পৌঁছালো না। কাঁদতে কাঁদতেই মুখে বারবার জলের ঝাপটা দিতে লাগলেন। কিন্তু সেই জলও তার চোখের জলকে ঢাকতে পারলো না। বহু কষ্টে নিজেকে শান্ত করলেন। হাতমুখ ধুয়ে স্নানঘর থেকে বের হলেন। গালে এখনো রঙের দাগ রয়েই গেছে। স্বাভাবিক হয়ে ঘর থেকে বের হতেই কই থেকে যেন মোহিনী এসে তার দুগাল আবার রঙে রাঙিয়ে দিলেন।

“সবার গালে আবির লেগে আছে। তোর গালে নেই কেন?”

“ধুয়ে ফেলেছিলাম।”

“কিরে, চোখ এমন লাল হয়ে আছে কেন? কেঁদেছিস নাকি?”

“কাঁদবো কেন? চোখে আবির ঢুকে গিয়েছিল। তাই জল পড়ছিল। এজন্যই তো চোখমুখ ভালো করে ধুয়ে আসলাম।”

“ব্যাপার না। বাইরে চল। আবার রঙ লাগাবো। ঘর নোংরা করলে তো বড়মা সেই তোকে আর আমাকে দিয়েই আবার সব পরিষ্কার করাবেন।”

“তুই যা। আমি আরও আবির নিয়ে আসছি। ছোটমার ঘরে রয়েছে।”

“ঠিকাছে। তাড়াতাড়ি আয়।”

“হুম।”

মোহিনী চলে যেতেই পদ্মাবতীর চোখ দুটো আবার ভরে উঠলো। কান্না দমিয়ে রাখতে গলায় কেমন যেন চাপ অনুভব করলেন। চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই সাথে সাথে মুছে ফেললেন তিনি।

“কয়েক মাসের ভালোবাসার জন্য এতো বছরের বন্ধুত্ব নষ্ট করতে পারবো না আমি। ভাগ্যিস মনের সুপ্ত অনুভূতিটা কখনো প্রকাশ করিনি। তোদের মাঝে আমি কখনো ছিলামও না আর আসবোও না। তোর অর্ণব তোরই থাকলো। কিন্তু আমাকে তো অন্তত একবার জানাতে পারতিস। কেন লুকালি মোহিনী?”

শকুন্তলার ঘরে এসে আবিরের থালা নিয়ে বাইরে চলে গেলেন পদ্মাবতী। কিন্তু এই ঘটনাটা শত চেষ্টা করেও কিছুতেই মন থেকে মুছতে পারছেন না তিনি। বারবার মনে হতেই কান্না উপচে আসছে।
.
.
.
নিজের ঘরে বসে পান সাজাচ্ছিলেন তারানা। রজনী ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলেন,

“মেহের এখনো বাড়ি ফেরেনি রজনী? সেই কোন সকালে না গেল।”

“ফিরলে তো দেখতেই পেতে আম্মা। ওকি আর এখন এখানে থাকবে?”

পান মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করলেন,

“কেন? হঠাৎ এ কথা বলছিস কেন?”

“কাল রাতে তো ওই ছেলেটা গ্রামে ফিরেছে শুনলাম। মোহিনীকে এখন আর এবাড়িতে কিভাবে আটকে রাখবে বলো?”

“মানে? কোন ছেলে? কার কথা বলছিস তুই?”

“আমার কাছে আর কিছু লুকাতে হবে না আম্মা। আমি অন্ধ নই। দেখতে পাই সব। আর এটাই জানি যে তুমি ওদের ব্যাপারে সব জানো।”

“বেশি কথা বলিস না তো রজনী। চুপ থাক।”

“আমি নাহয় চুপ থাকবো। তাই বলে কি এসব লুকানো যাবে? সেদিন তুমি জেনেছো, আজ আমি জেনেছি, কাল ও-বাড়ির লোকজন জানবে। এরপর আস্তে আস্তে গ্রামের সবাই জেনে যাবে। তখন আমরা এখানে টিকে থাকতে পারবো ভাবছো?”

তারানা কোনো জবাব দিলেন না। রজনী আবার বললেন,

“এমনেই গ্রামের সবাই ভাবে ওদের ঘরের ছেলেরা আমাদের জন্য নষ্ট হচ্ছে। আমাদের জন্য ওদের সংসার ভাঙছে। আচ্ছা, ওদের পুরুষরা যদি বাড়িতে ঝগড়া করে এখানে এসে মদ খেয়ে পড়ে থাকে তাহলে সেটার দায় কি আমাদের? চরণ তো তাও ওগুলোকে বের করে দিয়ে আসে। আমরা তো শুধু পেট চালানোর দায়ে একটু নেচে পয়সা কামাই।”

“কী করতে বলছিস তুই সরাসরি বলতো। এতো কথার কী আছে?”

“আমি কী বলবো? শুধু সময় থাকতে মোহিনীকে একটু সামলাও আম্মা। নয়তো ওর জন্য আমাদের ভুগতে হবে। প্রমিতার কথা মনে নেই? ওকে মারার পর কিন্তু সব লোকজন মিলে আমাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে মারতে চেয়েছিল আমাদের। শুধু ওই জমিদারের বউ বাঁধা দিয়েছিল বলে পারেনি। প্রতিবারই যে পারবে না এমন তো নয়। তাই বলছি সময় থাকতেই কিছু একটা করো তুমি।”

তারানা এবারও নিরবতা পালন করলেন। কিছু একটা ভাবতে লাগলেন। রজনী বললেন,

“কী হলো? কী ভাবছো?”

“কিছু না। তুই কী বলতে এসেছিলি?”

“ওই পরী ছাদে থেকে দেখেছিল বাইরে লোকজন আবির মেখে ঘোরাঘুরি করছে। তাই বায়না করছিল বাইরে বের হওয়ার।”

“বাইরে বের হতে হবে কেন? চরণকে টাকা দিয়ে বল আবির এনে দিতে। কোথাও বের হবি না তোরা। যা করার ছাদে কর।”

“এই কথাগুলো যদি তুমি মোহিনীকেও বলতে পারতে আম্মা!”

“আমার মুখের ওপর কথা বলিস না তো। খুব বাড় বেড়েছিস তোরা। যা এখান থেকে।”

“যাচ্ছি।”

বলেই রজনী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু তারানার মন থেকে চিন্তা দূর হলো না।
.
.
.
নিজের মনকে যতই শান্তনা দিক না কেন, তবুও আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারছেন না পদ্মাবতী। কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছেন। আগের মতো সবার সাথে আনন্দ করছেন না। ব্যাপারটা মোহিনীর নজর এড়ায়নি।

“কী হয়েছে তোর বলতো আমাকে।”

মোহিনীর কথায় চমকে উঠলেন পদ্মাবতী। মোহিনী স্থিরদৃষ্টিতে পদ্মাবতীর দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু পদ্মাবতী কিছুতেই তার চোখে চোখ রাখতে পারছেন না।

“কই? কিছু হয়নি তো। কী হবে আবার?”

“উহু, আমি খেয়াল করেছি। বাড়ির ভেতর থেকে বের হওয়ার পর থেকেই তুই যেন কেমন চুপচাপ মনমরা হয়ে আছিস। আনন্দ করছিস না আগের মতো। একা একা থাকার চেষ্টা করছিস। তাই বলছি ভালোয় ভালোয় আমাকে বলে দে কী হয়েছে।”

মোহিনীর কথায় পদ্মাবতী কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। কিন্তু মোহিনীকে তা বুঝতে না দিয়ে হঠাৎ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। হঠাৎ করে এভাবে হাসায় মোহিনী তাজ্জব বনে গেলেন।

“আজব তো। হাসছিস কেন গাধার মতো?”

হাসি থামিয়ে পদ্মাবতী বললেন,

“গাধাকে তুই কবে হাসতে দেখলি?”

“গাধাকে হাসতে দেখিনি কিন্তু তোকে দেখেছি। এবার বল হাসলি কেন ওভাবে?”

“তোর কথা শুনে। আজ-কাল কি চোখে বেশি দেখছিস নাকি তুই?”

“কেন?”

“তা নাহলে যা কেউ দেখছে না সেটা তুই কী করে দেখছিস?”

“তোকে কিছু জিজ্ঞেস করাই উচিত হয়নি। দাঁড়া, আমি বড়মাকে জানাচ্ছি। উনিই তোর পেট থেকে কথা বের করবেন।”

মোহিনী উঠে দাঁড়াতেই পদ্মাবতী তার হাত ধরে টান দিয়ে আবার বসিয়ে দিলেন।

“সবাই কি কম চিন্তায় যে তুই আবার তাদের নতুন করে চিন্তায় ফেলতে চাস? কিচ্ছু হয়নি আমার। ওসব তোর ভুল ধারণা। বস এখানে।”

পদ্মাবতী কিছু হয়নি বললেও মোহিনীর মন মানলো না। কিছু বলতে যাবেন তখনই শকুন্তলা দূর থেকে বললেন,

“রান্নাঘর থেকে মিষ্টির থালাগুলো নিয়ে আয় তো পদ্মা।”

“যাচ্ছি ছোটমা।”

পদ্মাবতী এক মুহুর্ত দেরি না করে চলে গেলেন। যেন মোহিনীকে এড়িয়ে যাওয়ারই একটা সুযোগ খুঁজছিলেন তিনি। মোহিনী আর কিছু বলতে পারলেন না। অর্ণবের দিকে তাকাতেই দেখলেন তিনি আগে থেকেই তার দিকে তাকিয়ে আছেন। একটা গাছের সাথে পা লাগিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু একটা খাচ্ছেন। মোহিনীকে ইশারা করে ডাকতেই তিনি মুখ বাঁকিয়ে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিলেন। ওদিকে পদ্মাবতীকেও মিষ্টির থালা নিয়ে আসতে দেখলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই মিষ্টিগুলো হাত থেকে পড়ে গেল তার। পায়ে হাতে দিয়ে চিৎকার করে বসে পড়লেন তিনি। সম্ভবত হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছেন। মোহিনী দৌঁড়ে কাছে যেতেই দেখলেন একটা গর্তে পা আঁটকে গিয়েছিল তার। পা’টা খুব বাজেভাবে মোচকে গেছে।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-২৫
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

“চিত্রা, তোর কোনো কাজকর্ম নেই? কী বুঝে এখন রঙ্গোলি দিচ্ছিস?”

“রঙগুলো দেখে এমনিই একটু দিতে ইচ্ছে করলো মা। কোনো কাজ থাকলে বলুন। আমি করে দেবো।”

“স্নানঘরে দেখ কাপড় কেঁচে রাখা আছে বালতিতে। জলদি ওগুলো রোদে দিয়ে আয়।”

“আর একটু বাকি আছে মা। এটা শেষ করে এক্ষুনি যাচ্ছি।”

শকুন্তলা আর কিছু না বলে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেলেন। চিত্রা পদ্মাবতীকে সিড়ি দিয়ে নামতে দেখে দৌঁড়ে গেলেন তাকে সাহায্য করতে। আজ অনেকদিন বাদে নিজের ঘর থেকে বেরোলেন পদ্মাবতী। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ ছিল বিছানা থেকে ওঠা নিষেধ। তবে পা’টা এখন আগের তুলনায় ভালো আছে। বিশেষ করে শান্তি দেবীর বলে দেওয়া কৌশলে এক বিশেষ তেল মালিশ করার ফল এটা। আম্রপালি প্রতিরাতে তেলটা খুব যত্ন করে তার পায়ে মালিশ করে দিতেন।

“কী রে? কষ্ট করে উঠে এলি কেন? কিছু লাগলে আমাকে বলতি।”

“কিছু লাগবে না।”

“তাহলে?”

“আর কতদিন এভাবে বিছানায় শুয়ে-বসে থাকা যায় বল? কার ভালো লাগে?”

“পা ঠিক আছে?”

“আগের তুলনায় অনেক ভালো।”

“তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে গেলেই ভালো। আমরা সবাই যে ভয় পেয়েছিলাম যে আবার ভেঙে টেঙেই গেল নাকি।”

চিত্রা পদ্মাবতীকে নিচে নিয়ে এসে একটা মোড়ায় বসতে দিলেন।

“এখানে রঙ্গোলি কে দিল?”

“আমি দিয়েছি।”

“ওহহ। আজ মোহিনী আসেনি চিত্রা?”

“আসলে তো দেখতেই পেতি। তোর ঘরেই আগে যেত।”

“তাও ঠিক।”

“ওই দেখ, ওর কথা বলতে না বলতেই চলে এসেছে।”

মোহিনীকে আসতে দেখে বললেন চিত্রা। রঙ্গোলিতে পা ফেলার আগেই চিত্রা চিৎকার করে উঠলেন।

“দাঁড়া।”

মুহুর্তেই নিজের পা পিছিয়ে নিলেন মোহিনী।

“এই ভরদুপুরে এখানে রঙ্গোলি দিল কে?”

“চিত্রা দিয়েছে।”

“তোর কী আর কোনো কাজ নেই চিত্রা?”

চিত্রা জবাব দিলেন না। পদ্মাবতীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“স্নানঘরে কাপড় কেঁচে রাখা আছে। তুই এখানেই বস। আমি ওগুলো ছাদে দিয়ে আসি।”

চিত্রা চলে গেলে মোহিনী ইশারায় পদ্মাবতীকে জিজ্ঞেস করলেন চিত্রার কী হয়েছে। জবাবে তিনি শুধু কাঁধ ঝাঁকালেন।

“তুই নিচে কী করছিস? পা ঠিক হয়ে গেছে?”

“আগের চেয়ে ভালো।”

মোহিনী পদ্মাবতীর গালে হাত রেখে বললেন,

“তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যা। কত্তোদিন আমরা একসাথে বের হই না।”

“আর ক’দিন বাদেই যেতে পারবো।”

“তুই থাক। আমি বড়মার সাথে দেখা করে আসি।”

পদ্মাবতী মাথা নাড়লেন। মোহিনীকে দোতলায় উঠে যেতে দেখলেন। এবাড়িতে শান্তি দেবী আর অনুরাধা বাদে প্রায় সবার ঘরই দোতলায়। তবে মোহিনীকে আম্রপালির ঘরের দিকে না গিয়ে তার উল্টো দিকে যেতে দেখলেন। বুঝতে অসুবিধা হলো যে মোহিনী আম্রপালির সাথে দেখা করার কথা বললেও এখন অর্ণবের সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন। পদ্মাবতীর কেন যেন প্রচন্ড খারাপ লাগতে শুরু করলো। নিজেকে সামলাতে না যত দ্রুত সম্ভব ছুটে গেলেন শান্তি দেবীর ঘরে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। চোখে চশমা না থাকায় ঠিকমতো দেখতে পেলেন না শান্তি দেবী। “কে কে” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। ফলস্বরূপ পদ্মাবতীর কান্নার গতি আরও বেড়ে গেল।

“কে কাঁদে? পদ্মা, তুই নাকি? ওমা, কাঁদছিস কেন ওভাবে? পায়ে কি আবার ব্যথা করছে নাকি?”

পদ্মাবতী জবাব দিলেন না। শান্তি দেবী আবার বললেন,

“কী হয়েছে বলবি তো?”

“কিছু হয়নি।”

“কষ্ট পেয়েছিস কারও কথায়?”

“না।”

“তবে?”

“চুপ বুড়ি। এতো কথা কেন বলিস? চোখ তো গেছেই, এবার কিন্তু ঠোঁট দুটোও সেলাই করে দেবো।”

“ওমা, রাগছিস কেন? কী হয়েছে বল আমায়।”

“বললাম না কিছু হয়নি।”

“তাহলে এমনি এমনিই কাঁদছিস?”

“হ্যাঁ, এমনি এমনিই কাঁদছি।”

“বুড়ি হয়ে গেছি বলে কি তোরা আমাকে পাগল ভাবিস নাকি? এমনি এমনি কেউ কাঁদে?”

“আমি কাঁদি। আর একবার যদি জিজ্ঞেস করো কেন কাঁদছি তাহলে আর কোনো দিনও মুখ দেখাবো না আমার।”

পদ্মাবতী দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার দৌঁড়ে চলে যাওয়ার সময় নুপুরের আওয়াজটাই শুধু শুনতে পেলেন শান্তি দেবী।

“একি কথা মেয়ের? পদ্মা, কই গেলিরে? আরে ও পদ্মাবতীই।”

কারও সাড়াশব্দ পেলেন না শান্তি দেবী। কপালে কতগুলো চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো তার।
.
.
.
ছাদে থেকে নামার সময় অর্ণবের ঘর থেকে মোহিনীকে বের হতে দেখলেন চিত্রা। সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন,

“দাঁড়া মোহিনী।”

মোহিনী তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন।

“কিছু বলবি?”

“কই গিয়েছিলি?”

“বড়মার ঘরে যাচ্ছিলাম।”

“কই যাচ্ছিস জিজ্ঞেস করিনি। কই গিয়েছিলি জিজ্ঞেস করেছি।”

চিত্রার কণ্ঠটা একটু অন্যরকম শোনালো মোহিনীর কাছে।

“অর্ণবের ঘরে গিয়েছিলাম। শমিতদা একটা কাজে ডাকতে বলেছে ওনাকে।”

“কাকে বোকা বানাচ্ছিস তুই?”

“মানে?”

“আমার সামনে নাটক করিস না মোহিনী। দাদা আর তোর মাঝে কী চলছে খুব ভালোমতোই দেখতে পাচ্ছি আমি। শমিতদাকে দিয়ে তো চিঠিও আদান-প্রদান করিয়েছিস। কী ভেবেছিলি? কেউ জানবে না?”

মোহিনী কোনো জবাব দিলেন না।

“খুব ভালোই তো ফাঁসিয়েছিস আমার ভাইকে। তুই কী আর তোর যোগ্যতা কী সেটা ভুলে যাস না। তাই এখনই সাবধান হয়ে যা।”

মোহিনী চুপচাপ তার কথাগুলো শুনে গেলেন। চিত্রা চলে গেলেন কিন্তু তার বলা শেষের কথাগুলো হজম করতে পারলেন না মোহিনী। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিচে নেমে এলেন। চলে যাওয়ার সময় সামনে চিত্রার করা রঙ্গোলিটা পড়লো। সাথে সাথে পা দিয়ে নষ্ট করে দিলেন পুরোটা। এতে যেন তার রাগ কিছুটা হলেও কমলো। মোহিনী চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে চিত্রা এসে দেখা মাত্রই চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন।

“কে করলো এটা? কতো কষ্ট করে দিয়েছিলাম আমি। কার সাহস হলো এতো?”

তার চেঁচামেচি শুনে সবাই সেখানে উপস্থিত হলেন। শকুন্তলা বললেন,

“এতো চেঁচাচ্ছিস কেন? কী হয়েছে?”

চিত্রা চড়া গলায় জবাব দিলেন,

“দেখতে পারছেন না? কে যেন আমার দেওয়া রঙ্গোলিটা নষ্ট করে দিয়েছে।”

আম্রপালি ধমকের সুরে বললেন,

“চিত্রা, মায়ের সাথে কীভাবে কথা বলছিস?”

চিত্রা চুপ করে রইলেন।

“বেড়াল টেরাল ঢুকেছিল হয়তো। ওটায়-ই নষ্ট করেছে। তুই রাগ করিস না। আমি তোকে আবার দিয়ে দেবো সুন্দর করে।”

“লাগবে না। আপনার পছন্দের বেড়ালই করেছে এটা। আমি জানি কার কাজ এটা।”

“মানে? কে করেছে?”

“কে আবার? আপনার আদরের মোহিনী।”

“ও এমন করবে কেন শুধু শুধু?”

“সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করবেন।”

চিত্রা রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন। পদ্মাবতী সেখানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন,

“আমি আবার দিয়ে দিচ্ছি বড়মা।”

“থাক। ওই পা নিয়ে তোকে আর কষ্ট করতে হবে না। একটু পরই দেখবি ওর রাগ চলে গেছে।”

দোতলায় চোখ পড়তেই দেখলেন অর্ণব দাঁড়িয়ে আছেন। পদ্মাবতীকে ইশারায় ওপরে আসতে বলে ঘরে গেলেন তিনি। এই পা নিয়ে বারবার সিড়ি বেয়ে ওঠানামা করাটা আসলেই কষ্টসাধ্য। তবুও পদ্মাবতী ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এলেন। অর্ণবের ঘরে আসতেই দেখলেন অর্ণবের হাতে একটা ইংরেজি বই। ভাবলেন এই লোকটা কি সবসময়ই বই পড়েন? নাকি তিনিই এমন সময় এ ঘরে আসেন?

“চিত্রা আর মোহিনীর মাঝে ঝগড়া হয়েছে?”

“এমন কিছু তো দেখিনি। ঝগড়া হলে আমি নিশ্চয়ই জানতাম।”

“তাহলে চিত্রা মোহিনীর ওপর রেগে আছে কেন?”

“জানি না। আজ দুপুরেও ঠিকমতো কথা বলেনি।”

“কেন?”

“তাও জানি না।”

“তাহলে জানোটা কী?”

পদ্মাবতী মাথা নিচু করলেন।

“আচ্ছা, তুমি যাও এখন।”

“শুধু এটা জিজ্ঞেস করার জন্য ডেকেছিলেন?”

“আর কিছু জিজ্ঞেস করার মতো তো কিছু মনে পড়ছে না আমার। তোমার পড়ছে?”

পদ্মাবতী নাবোধক মাথা নাড়লেন। বললেন,

“নিচে থাকতেই তো জিজ্ঞেস করতে পারতেন। আমি এতো কষ্ট করে আবার সিড়ি দিয়ে উঠলাম।”

“নিজের ঘরে যেতে সেই সিড়ি দিয়েই উঠতে হতো তোমায়। এখন ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও।”

প্রতিত্তোরে পদ্মাবতী শুধু একদিকে মাথা কাত করলেন।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে