মেহেরজান পর্ব-২২+২৩

0
389

#মেহেরজান
#পর্ব-২২
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

প্রতিদিনের মতো আজও বিন্দু বিন্দু শিশির জমা দূর্বার ওপর থেকে শিউলি কুড়িয়ে নিচ্ছেন পদ্মাবতী। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখলেন কুয়াশার চাদর ভেদ করে ক্রমশ একটা অবয়ব এগিয়ে আসছে তার দিকে। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। অবয়বটি ঘাসের ওপর পড়ে থাকা শিশিরভেজা শিউলিগুলো মারিয়ে একদম সামনে চলে আসতেই সেই চিরচেনা মুখটা ভেসে উঠলো পদ্মাবতীর সামনে। দিঘির জলের মতো শান্ত মনটা হঠাৎ করেই স্রোতস্বিনীর মতো অস্থির হয়ে উঠলো। মনে হাজারো কথা জমিয়ে রেখেও মুখে কিছু প্রকাশ করতে পারছেন না তিনি। অর্ণবকে স্পর্শ করার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতেই কোথা যেন বালতি ভরা জল এসে পড়লো তার ওপর। মুহুর্তেই সব ওলট-পালট হয়ে গেল। বিছানা থেকে “মাগো” বলে লাফিয়ে উঠলেন তিনি। গায়ে থেকে জল ঝারতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সামনে মোহিনীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সব পরিষ্কার হয়ে গেলো তার কাছে যে কী হয়েছিল কিছুক্ষণ আগে। গায়ে মোটা কম্বল জড়িয়ে বেশ আরাম করে ঘুমাচ্ছিলেন তিনি। মোহিনী এসে একটা পাত্র ভরে জল ঢেলে দিয়েছেন তার ওপর। গায়ের শাড়িটা খুব এলোমেলো হয়ে আছে। তা-ই ঠিক করতে করতে বললেন,

“কী করল তুই এটা?”

“আমার কোনো দোষ নেই। আমি তো আরও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তুই মরে গেছিস ভেবে। জানিস কত্তোবার ডেকেছি তোকে?”

“তাই বলে এভাবে জল ঢেলে দিবি? তাও এমন শীতে?”

“এখন আর এমন কী শীত?”

পদ্মাবতী জানালা খুলে দিতেই একটা হিম করা শীতল বাতাস এসে গায়ে লাগলো তার। একে তো ভেজা গা, তার উপর এমন বাতাসে যেন জমে গেলেন তিনি। কয়েকবার দাঁতে দাঁত লেগে এলো। বাইরে তাকালেন তিনি। কুয়াশায় সব ঢেকে আছে। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না।

“বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না আর তুই বলছিস শীত নেই?”

“আছে কিন্তু তেমন একটা না। এমনিতেই শীত চলে যাচ্ছে। তাই চল বাইরে গিয়ে পরিবেশটা একটু উপভোগ করে আসি।”

পদ্মাবতী ঘড়ির দিকে তাকালেন। ছয়টা বাজে। বললেন,

“তোর মেজাজ বেশ ফুরফুরে মনে হচ্ছে। ছয়টা বাজে কেবল। এতো সকালে কই যেতে চাস তুই?”

“যেখানে ইচ্ছে করবে। জায়গার অভাব নাকি এখানে?”

“আরেকটু ঘুমাতে দে না মোহিনী।”

“আচ্ছা, ঘুমা তুই।”

পদ্মাবতী অবাক হলেন। এতো সহজে মেনে নেওয়ার মেয়ে নয় মোহিনী। তাহলে কারণ কী? পদ্মাবতী বিছানার দিকে তাকাতেই দেখলেন শোয়ার জায়গাটা একদম ভিজে গেছে।

“বিছানা তো দিয়েছিস একদম ভিজিয়ে। এখন তো বলবিই ঘুমাতে। দাঁড়া একটু। আমি শাড়ি পাল্টে আসছি।”

পদ্মাবতী শাড়ি পাল্টে আসতেই দু’জনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

ঘন কুয়াশা ভেদ করে এগিয়ে চলেছেন দু’জনে। যতই এগুচ্ছেন, রাস্তা ততই দৃশ্যমান হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে বাজারের দিকটায় চলে এসেছেন। বাজারের একদম মাঝখানে বিশাল বড় বটগাছটার চারপাশে গোল করে ইট-সিমেন্ট দিয়ে বাধাঁনো চত্বরের ওপর একটা পাগল শীতে কাচুমাচু করে শুয়ে আছে। সারাদিন বাজারেই ঘুরে বেড়ায় আর রাতে এই গাছটার নিচে ঘুমায়। দোকানপাট তেমন একটা খোলেনি এখনো। একটা টঙের দোকান আর একটা ভাপা আর চিতই পিঠার দোকান খুলেছে মাত্র। টঙের দোকানে বসে কতগুলা লোক চা খাচ্ছিলেন। মোহিনী আর পদ্মাবতীকে আসতে দেখে কিছু সময় তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার নিজেদের কাজে মনোনিবেশ করলেন তারা। পিঠার দোকানে একজন বৃদ্ধা বসে বসে পিঠা বানাচ্ছেন আর পাশে বসে থাকা বৃদ্ধ লোকটা সেগুলো ক্রেতাদের দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন। লোকজনগুলো সেখানে বসেই মরিচ, কালোজিরা, ধনিয়া, সরিষার মতো বিভিন্ন বাটা দিয়ে গরম গরম ভাপ ওঠা চিতই খেতে ব্যস্ত। পদ্মাবতী বললেন,

“ইশশশ, আগে জানলে সাথে করে টাকা নিয়ে আসতাম। খেতে ইচ্ছে করছে খুব।”

“উড়ে তো যাচ্ছে না কিছু। পরে এসে খাস।”

“তাও ঠিক।”

“দৌঁড় লাগাবি পদ্মা? আগে যেমন লাগাতাম?”

“এখন?”

“হ্যাঁ, সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটা শেষ সীমানা।”

মোহিনী আর কথা না বাড়িয়ে দৌঁড়াতে শুরু করলেন। উপায় না পেয়ে পদ্মাবতীও তার পেছন পেছন দৌঁড় লাগালেন। শাড়ি পরে দৌঁড়ানোটা তার কাছে একটু কষ্টসাধ্যই বটে। বেশ অনেকটা রাস্তা দৌঁড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে এসে থেমে পড়লেন মোহিনী। প্রতিবারের মতো এবারও তিনিই জিতলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে গাছের নিচে থাকা বাঁশের তৈরি বেঞ্চে বসে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যে পদ্মাবতীও চলে এলেন। থেমেই হাঁপাতে শুরু করলেন।

“তুই আমার সাথে কোনোদিনও পেরে উঠলি নারে পদ্মা।”

“তুই সবসময় আমার শাড়ি পরার সুযোগ নিস। এটা পরে এতো জোরে দৌঁড়ানো যায় নাকি?”

“থাক, আর অজুহাত দিস না।”

“একদম অজুহাত দিচ্ছি না।”

পদ্মাবতী মোহিনীর পাশে বসে পড়লেন। বসে বসে এদিক-ওদিক চোখ ঘোরাতে লাগলেন মোহিনী। কুয়াশা আগের তুলনায় এখন অনেকটা কমে গেছে। দূরে কতগুলো বাচ্চা গোল হয়ে বসে আগুন পোহাচ্ছে। উদাম গায়ে কাঁপতে কাঁপতে হাত দুটো গরম করে পুরো শরীরে উষ্ণতা ছড়ানোর বৃথা চেষ্টা করছে তারা। পদ্মাবতী বললেন,

“অনেক হাঁপিয়ে গেছি। জল খাবো।”

“এখন কোথায় জল পাবি তুই?”

পদ্মাবতী এদিক-ওদিক তাকালেন। কাউকে আসতে দেখলেন এদিকে। বললেন,

“জল না পেলাম। রস খেয়েই না হয় তৃষ্ণা মেটাই।”

লোকটা যখন আরেকটু কাছে আসলো, মোহিনী দেখলেন রোগাপটকা একটা ছেলে। তার চেয়ে ছোটই হবে। সামনে আসতেই পদ্মাবতী তার উদ্দেশ্যে বললেন,

“এখন নিয়ে আসলে গাছ থেকে?”

ছেলেটা পদ্মাবতীর চেনা। তিনি বললেন,

“হ্যাঁ, মাত্রই পেরে আনলাম হাড়ি দুটো।”

“আমাদের একটু দিয়ে যাও। অনেক তেষ্টা পেয়েছে।”

ছেলেটা তাদের হাতে মাটির পেয়ালায় খেজুরের রস এগিয়ে দিতেই দুজনে ঢকঢক করে খেয়ে ফেললেন। পদ্মাবতী বললেন,

“এখন সাথে করে টাকা আনিনি। বিকেলে বাড়িতে এসে তোমার দামটা নিয়ে যেও। পারবে তো?”

“আচ্ছা দিদি। আপনাদের তো আমি চিনিই। কোনো সমস্যা নেই।”

“ঠিকাছে।”

ছেলেটা চলে যেতেই মোহিনী উঠে দাঁড়ালেন।

“কী হলো?”

“বসে থাকতে ভাল্লাগছে না।”

“ফিরে যাবি?”

“কী করবো আর?”

“আমাকে নিয়ে এলি কেন তাহলে? জানতাম তুই এমনই করবি।”

“ঠিকাছে। আর রাগিস না। পরে যাবো বাড়িতে। চল নদীর দিকটায় যাই।”

পদ্মাবতী কিছু সময় মোহিনীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর চেঁচিয়ে বললেন,

“ভাল্লাগে না আমার। তোর সকাল সকাল কোনো কাজকর্ম নেই তাই এমন শুরু করেছিস। সাথে আমাকেও জ্বালাচ্ছিস। একবার এখানে যাই আবার ওখানে যাই। কোথাও একটু ঠিকমতো বসে থাকতেও দিচ্ছিস না। এখন নদীতে যাবি কী করতে?”

“তোকে মাঝ নদীতে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলতে যাবো।”

মোহিনী পদ্মাবতীর হাত ধরে টানতে টানতে তাকে নিয়ে গেলেন।

নদীর জল অনেকটা কমে গেছে। জলে পা ভিজিয়ে ঘাটে বসে রয়েছেন মোহিনী। তার থেকে অনেকটা দূরে পদ্মাবতী বসে আছেন। ইচ্ছে করেই মোহিনীর থেকে দূরে বসেছেন তিনি। কারণ তিনি জানেন মোহিনী চাইলেই সত্যি সত্যি তাকে নদীতে ফেলে দিতে পারেন। মোহিনীর মধ্যে আজ একটা অস্থিরতা কাজ করছে। যা অন্যান্য দিনের থেকে আলাদা। পদ্মাবতীর চোখে সেটা ঠিকই ধরা পরেছে। কিন্তু এর কারণটা বুঝতে পারছেন না তিনি। মোহিনী পেছনে ঘুরে পদ্মাবতীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলেন। পদ্মাবতীও তার উদ্দেশ্যে একটা হাসি ফিরিয়ে দিলেন।
.
.
.
স্নান সেরে ছাদে বসে সকালের মিষ্টি রোদ পোহাচ্ছেন চিত্রা। শ্যামলের সাথে দেখা হয় না তাও অনেকদিন হলো। আজ যে করেই হোক দেখা করতে হবে। কীভাবে দেখা করা যায় তারই পরিকল্পনা করতে ব্যস্ত এখন তিনি। হঠাৎ শকুন্তলার ডাক শুনতে পেলেন। সেই ডাকে সাড়া দিলেন তিনি।

“আসছি মা।”

কথাটা বলেই উঠে পড়লেন চিত্রা। ছাদে থেকে নেমে শমিতের ঘরের সামনে দিয়ে আসতেই দরজার কোণায় একটা ভাজ করা কাগজ পড়ে থাকতে দেখলেন। সেটা তুলে নিয়ে খুলে পড়তেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল চিত্রার। একটা চিঠি। মোহিনীর উদ্দেশ্যে লেখা অর্ণবের চিঠি। চিত্রার বুঝতে সমস্যা হলো না যে শমিত এব্যাপারে সব জানেন। বর্তমানে তাদের যোগাযোগের মাধ্যম শমিত। এভাবে আরও কত চিঠি শমিত আদান-প্রদান করেছেন তা জানেন না চিত্রা। তবে এটাই যে প্রথম নয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত। সাথে সাথে কাগজটা আবার ভাজ করে নিজের কাছে লুকিয়ে ফেললেন তিনি। এটাই হয়তো ছিল আজ মোহিনীর এতো চঞ্চলতার কারণ। হয়তো মোহিনীর অজান্তেই চিঠিটা এখানে পড়ে গেছে।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-২৩
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

গাছের ঝরা পাতাগুলো পাঁকা রাস্তার উপরে বেশ মোটা একটা আস্তরণ তৈরি করেছে। তার ওপর দিয়ে হাঁটলেই শুকনো পাতার মড়মড় আওয়াজ হচ্ছে। রাস্তার পাশের অধিকাংশ গাছগুলোতেই এখন একটা পাতাও নেই। কেমন একটা অপূর্ণ মনে হচ্ছে। তবে কিছু গাছের নতুন আসা কচি পাতাগুলো যেন তা কিছুটা হলেও আড়াল করতে পেরেছে। মোহিনী আর এদিক-ওদিক না তাকিয়ে দ্রুত পা ফেলে হাঁটতে শুরু করলেন। ওইতো, সামনেই অর্ণবদের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। গেইটের দুই ধারের ফুলে হলুদ হয়ে যাওয়া রাধাচূড়া গাছ দুটো দেওয়ালের ওপার থেকে উঁকি দিচ্ছে। যেন কারও আসার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মোহিনীর মনে হচ্ছে এবাড়িতে আসার রাস্তাটা যেন দিন দিন আরও দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। সে যতই কাছে আসে, বাড়িটা যেন আরও দূরে সরে যায়। রাস্তাটা শেষই হতে চায় না। বাগান অতিক্রম করে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখলেন আম্রপালি যেন কার সাথে টেলিফোনে কথা বলছেন। মোহিনীকে দেখে মুচকি হাসলেন। মোহিনী কাছে আসতেই টেলিফোনটা নামিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে নিচু স্বরে বললেন,

“ঠিক সময় এসেছিস। রান্নাঘরে দেখ লাড্ডু বানিয়ে রেখেছি। ওটা নিয়ে সোজা পদ্মার ঘরে চলে যা।”

“কার জন্য রেখেছেন?”

“তোর জন্যই।”

“কিভাবে জানলেন আমি আজ আসবো?”

“ওইভাবেই। এখন যা।”

মোহিনী চলে গেলে আম্রপালি আবার টেলিফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মোহিনী রান্নাঘরে এসে দেখলেন আম্রপালি একটা থালা ভরে লাড্ডু রেখে দিয়েছেন। এরপর নিজেই বিড়বিড় করতে লাগলেন।

“এতোগুলো লাড্ডু আমার জন্য? মানলাম আমি খেতে পছন্দ করি তাই বলে এতোগুলো? বড়মা কি আমার খাওয়া নিয়ে খোঁটা দিলেন? ধুর, একটু বেশিই ভাবি আমি। কম রাখলে তো পরে আমি নিজেই বলতাম আরেকটু বেশি রাখতে পারলেন না?”

মোহিনী একটা লাড্ডু মুখে পুরে দিয়ে থালাটা নিয়ে সোজা দোতলায় চলে গেলেন।

পড়ন্ত বিকেলের আলো এসে লাগছে পদ্মাবতীর মুখে। চোখ দুটো ছোট ছোট করে জানালার পাশে রাখা টেবিল চেয়ারে বসে গাছে কয়টা নতুন পাতা এলো তা খুব মনোযোগ সহকারে গুনছেন তিনি। কাজকর্ম না থাকলে সময় পার করার একটা দারুণ পন্থা। বেশ কয়েকদিন ধরে মোহিনী আসছেন না। অবশেষে সময় কাটানোর জন্য এই রাস্তাটাই বের করেছেন পদ্মাবতী। সামনের শিমুল গাছটায় একটা বেনেবউ এসে বসেছে। অনেক সময় পরে এই পাখিটাকে আবার দেখলেন পদ্মাবতী। পরক্ষণেই ভাবতে লাগলেন কেউ কি আসবে বাড়িতে? কে আসতে পারে? অর্ণব? না, তিনি আসতেও এখনো অনেকদিন বাকি। তবে? হঠাৎ কেউ টেবিলে লাড্ডুর থালাটা রাখতেই চমকে উঠলেন পদ্মাবতী।

“লাড্ডু!”

উচ্ছ্বসিত হয়ে থালার দিকে হাত বাড়াতেই কেউ হাতে আঘাত করলেন। ঘুরে তাকাতেই দেখলেন মোহিনী।

“তোর জন্য নয় এগুলো।”

“মানে? তাহলে কার জন্য?”

“আমার জন্য।”

“তোর জন্য তাহলে তুই আমার ঘরে কেন নিয়ে এসেছিস?”

“বড়মাই তো বললেন।”

করুণ চোখে মোহিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

“আমাকে রেখে একা একা খেতে পারবি তুই?”

মোহিনী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

“এভাবে তাকাস না তো তুই। এভাবে তাকিয়ে তুই আমাকে দিয়ে যা খুশি তাই করাতে পারিস। এই যেমন এখন ইচ্ছে না থাকা স্বত্তেও তোর সাথে ভাগাভাগি করে খেতে হচ্ছে।”

মোহিনীর কথা শেষ হতে না হতেই পদ্মাবতী খাওয়া শুরু করলেন।

“খাচ্ছে কীভাবে দেখো। আস্ত একটা রাক্ষসী। আর সবাই বলে আমি নাকি বেশি খাই।”

“এসব কথা বাদ দে তো। আগে বল, বেঁচে আছিস তুই?”

“বেঁচে না থাকলে এখন কি আমার ভূতের সাথে কথা বলছিস তুই?”

“বেঁচে আছিস তাহলে। আমি তো ভেবেছিলাম মরেই গেছিস। একটা নয়, দুটো নয়, পুরো তেরোটা দিন! কোথায় ছিলি এতোদিন?”

“বাড়িতেই।”

“একবারে জন্যও আসলি না তাই? আমার সাথে কথা না বলে তুই থাকিস কী করে বলতো। আমার যে কী অবস্থা হয়েছিল জানিস তুই? কোনো কাজ-কর্ম নেই। বড়মার কাছে যাই, তিনিও কিছু করতে দেন না। ছোটমাও কিছু বলেন না। আর পিসিমা তো পিসিমাই। কারও সাথে ঠিক মতো কথা বলতে পারি না। চিত্রাকে খুঁজেও পাওয়া যায় না। শেষে উপায় না পেয়ে গাছের পাতা গুনতে শুরু করেছি।”

“ক’টা হলো?”

“কী ক’টা হলো?”

“গাছের পাতা?”

“গুনছিলামই তো। কিন্তু মাঝে তুই এসেই তো সব গুলিয়ে দিলি।”

“পরে আবার গুনে নিস। এখন চল ছাদে যাই। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর।”

দুজনে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে দ্রুত ছাদে উঠে এলেন। ছাদে রাখা চন্দ্রমল্লিকার গাছগুলো ফুলে একদম ভরে গেছে। ছাদের এক কিনারে এসে বসলেন তারা। কোথায় থেকে কোকিলের কুহুতান ভেসে আসছে। সেই সাথে কোকিলের ডাক নকল করে আরও একটা আওয়াজ। বসন্ত যে এসে গেছে তা জানান দিতে কোকিলের ডাকটাই যথেষ্ট। দূর থেকে শমিতকে আসতে দেখে পদ্মাবতী বললেন,

“শমিতদা আর শেফালীর প্রেমতো ভালোই চলছে মনে হয়। এখন নিশ্চিত ওর সাথেই দেখা করে ফিরছে।”

“তুই কবে জানলি ওদের প্রেমের কথা?”

“অনেক আগেই।”

“জেনেছিস এটাই অনেক। তুই তো আবার চোখ থাকতেও অন্ধ। না বললে কিছু বুঝিসই না।”

“যাই হোক, খুব তাড়াতাড়িই মনে হয় একটা বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে পাবো আমরা।”

“কাদের বিয়ে?”

“কাদের আবার? শমিতদা আর শেফালীর।”

“তোর মনে হয় পিসিমা ওদের বিয়ে হতে দেবেন?”

“দেবেন না কেন?”

“তা জানি না। তবে আমার মনে হয় না হতে দেবেন। উনি তো পারলে শমিতদাকে কোনোদিন বিয়ে না করিয়ে নিজের আঁচলের সাথেই বেঁধে রাখেন।”

“হবে কি হবে না তা ভগবানই ভালো জানেন। আমরা শুধু ওদের জন্য প্রার্থনাই করতে পারি।”

“তাহলে তাই কর।”

হঠাৎ দূরে অনেক লোকজনকে একসাথে দেখে পদ্মাবতী বলে উঠলেন,

“ওখানে এতো লোকজন কেন?”

“কিজানি। দেখে তো মনে হচ্ছে শবযাত্রা।”

“কে মরলো আবার?”

“বুঝতে পারছি না।”

চিত্রা পেছন থেকে বললেন,

“তোরা এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? আর আমি সারা বাড়ি খুঁজে মরছি। জেঠিমা ডাকছেন তোদের। নিচে চল।”

দ্রুত পেছনে ঘুরলেন দু’জনে। চিত্রা কখন এসেছেন তারা টেরই পাননি। হয়তো এইমাত্রই এসেছেন। পদ্মাবতী বললেন,

“কে মারা গেছেরে চিত্রা? তুই জানিস কিছু? কার যেন শবযাত্রা যাচ্ছে।”

“শেফালীর বোন আছে না মিতালি? ওরই শবযাত্রা।”

“কী?! মিতালি মারা গেছে? হঠাৎ? কীভাবে হলো?”

“এতো মায়া দেখাস না। মায়া দেখানোর মতো কোনো কাজ ও করেনি। পেটে বাচ্চা নিয়ে আত্মহত্যা করেছে।”

মোহিনী বললেন,

“মানে? কী বলছিস এসব?”

“ঠিকই বলছি। কে জানে কোন ছেলের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে পেটে বাচ্চা এনেছে। এখন বিয়ে করেনি দেখে উপায় না পেয়ে বিষ খেয়েছে। নষ্টা মেয়ে একটা।”

পদ্মাবতী বললেন,

“তোরা যাবি আমার সাথে একবার দেখতে?”

চিত্রা উচ্চস্বরে বললেন,

“ভুলেও না। একদম যাবি না তোরা কেউ।”

“কেন?”

“শমিতদা গিয়েছিল। একটু আগে ওখান থেকেই এলো। পিসিমা খুব রেগে আছেন শমিতদার ওপর। কথাও শুনিয়ে দিয়েছেন কতগুলো।”

“তাহলে আর কী করার। ছেলেটার কোন খোঁজ খবর জানিস যে কে করলো এটা?”

“ও এই পাড়ার না। তাই চিনিও না তেমন।”

“কোনো শাস্তি হয়নি?”

“ছেলে তো সম্পুর্ণ অস্বীকার করে দিয়েছে। শেফালীর বাবা-মাও আর থানা-পুলিশের ঝামেলায় যেতে চায়নি বলে তাড়াতাড়ি লাশ নিয়ে যাচ্ছে শ্মশানে।”

পদ্মাবতী আফসোস করে বললেন,

“অল্পবয়সী একটা মেয়ে। কত বড় ভুলটাই না করলো।”

“তোরা নিচে চল এখন তাড়াতাড়ি।”

“তুই যা। আমরা আসছি।”

চিত্রা চলে যেতেই পদ্মাবতী বললেন,

“মিতালির জন্য আসলেই খারাপ লাগছে। একজন ভুলের মাশুল চুকাতে চিতায় উঠলো। আরেকজন দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। ক’দিন পর বিয়ে করে সুখে শান্তিতে সংসারও করবে।”

“ছাড়তো ওদের কথা। যেমন কর্ম তেমন ফল। পাপের শাস্তি দুজনেই পাবে দেখিস।”

“তা-ই ভালো। মাঝখান থেকে একটা নিষ্পাপ প্রাণ চলে গেল। বাচ্চাটার কী দোষ ছিল বলতো?”

“দোষ না থাকলেও ওকে সবাই পাপের ফলই বলতো। ভালোই তো হয়েছে, জন্মানোর আগেই মরে গেছে।”

“এমন ভাগ্য যেন আর কারও না হয়। শেফালী আর ওর বাবা-মায়ের কী অবস্থা এখন ভাব একবার।”

“পরে কোনো সময় গিয়ে একবার দেখা করে আসিস। এখন নিচে চল। কে জানে বড় মা কেন ডাকছেন।”

মোহিনী হাঁটতে শুরু করলেন। তার পেছন পেছন পদ্মাবতীও চলে এলেন। নিচে আসতেই আম্রপালি বললেন,

“মোহিনী, তোকে আমি বলেছিলাম তোর জন্য রান্নাঘরে লাড্ডু রেখে দিয়েছি আলাদা করে। তুই ওটা রেখে কোনটা নিয়েছিস?”

“কেন? আপনি যেটা বলেছিলেন সেটাই তো নিয়েছিলাম। বড় একটা থালায় করে সাজিয়ে রেখেছিলেন।”

“তুই ওই থালার সব খেলে ফেললি?”

“আমি একা খাইনি তো। পদ্মাও খেয়েছে আমার সাথে। কিন্তু কী হয়েছে সেটা তো বলুন।”

আম্রপালি মোহিনীকে একটা বাটি দেখালেন। সেখানে আরও বেশ কয়েকটা লাড্ডু রাখা।

“আমি এটার কথা বলেছিলাম তোকে। আর তুই এটা রেখে বাকি সব নিয়ে গিয়েছিস।”

“রান্নাঘরে তো ওই থালাটাই ছিল বড়মা।”

“ওটার পাশে এটাও ছিল। ঢেকে রেখেছিলাম। তোর মনে হয় ওতোগুলো লাড্ডু একসাথে একা একজন মানুষের পক্ষে খাওয়া সম্ভব যে আমি ওতোগুলো রাখবো?”

“একবার মনে হয়েছিল। কিন্তু অন্যের খবর জানি না, আমার পক্ষে তো সম্ভব। তাই ভেবেছিলাম ওটাই হয়তো। আমার কী দোষ?”

“উফ, তোকে নিয়ে আর পারলাম না। এখন আমাকে আবার সব বানাতে হবে।”

“আপনি এতো চিন্তা করবেন না তো বড়মা। পদ্মা আছে কী করতে? আপনাকে কিচ্ছু করতে হবে না। সব পদ্মা বানিয়ে দিবে।”

মুহুর্তেই পদ্মাবতীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মোহিনীকে চিমটি দিয়ে কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন,

“এই, কী বলছিস তুই এসব? আমি এতোগুলো লাড্ডু কীভাবে বানাতে পারবো?”

“এমন ভাব করছিস যেন না জানি কতগুলো। কেন? খাওয়ার আগে মনে ছিল না? খাওয়ার সময় তো ঠিকই আমার সাথে পাল্লা করে খেলি।”

“তাই বলে এভাবে ফাঁসাবি?”

আম্রপালি বলে উঠলেন,

“তোরা ফিসফিস করে কী কথা বলছিস এতো?”

“তেমন কিছু না বড়মা। আজ পদ্মা বলছিল ওর নাকি কোনো কাজকর্ম নেই। আপনারা কেউ কিছু করতে দেন না। ওর এভাবে বসে থাকতে ভাল্লাগে না। তাই এখন একটা কাজ পেয়ে খুশিই হয়েছে।”

“তুই তাহলে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে যা পদ্মা। কিছু লাগলে বলিস আমাকে।”

“আচ্ছা বড়মা।”

পদ্মাবতী অসহায় এর মতো রান্নাঘরে চলে গেলেন। মোহিনী খুব কষ্ট করে নিজের হাসি চেপে রাখলেন। ওদিক থেকে চলে আসতেই শমিত ডাক দিলেন তাকে।

“এই মোহিনী, এদিকে আয়।”

মোহিনী আসতেই প্রশ্ন করলেন,

“কী হয়েছে বলো।”

“ব্যাপার কী তোর? আজ-কাল তো তোর দেখাই মেলে না। অর্ণব নেই বলে এখানে আসতেও মন চায় না নাকি?”

“এমন কিছুই না।”

“এই নে।”

মোহিনী শমিতের হাত থেকে একটা কাগজ হাতে নিতে নিতে বললেন,

“এটা কী?”

“কী আবার। তোর প্রেমিকের চিঠি। শালা খুব খাটায় আমাকে। এতো খাটাখাটুনি তো নিজের প্রেমেও করিনি। যাই হোক, আগের চিঠিটা রেখে দিয়েছিস তো সাবধানে? কেউ পায়নি তো?”

“উম, ওটা তো হারিয়ে ফেলেছি। কই যে পড়েছিল আর খুঁজেই পাইনি।”

“কারও হাতে না পড়লেই হলো। নয়তো তোদের সাথে আমি ফাঁসবো।”

“এতো চিন্তা করো না তো। কেউ পায়নি। পেলে অনেক আগেই জানাজানি হয়ে যেত সব। অনেকদিন তো হয়ে গেছে।”

“তাই যেন হয়। আমি আসি এখন।”

শমিত চলে যেতেই মোহিনী চিঠিটা খুললেন। আগের মতো এতো বড় চিঠি নয় এটা। শুধু দুটো বাক্য লেখা।

“প্রিয় মেহেরজান,
অতি শীঘ্রই আমাদের অপেক্ষার সময় শেষ হতে চলেছে। আমি ফিরছি, আপনার কাছে।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে