মেহেরজান পর্ব-১৫+১৬

0
397

#মেহেরজান
#পর্ব-১৫
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

সবেমাত্র তৈলচিত্রটা আঁকানো শেষ করেছিলেন পদ্মাবতী। এক নজর সেটার দিকে ভালো করে দেখতেই পেছন থেকে রঙের ছিটা এসে লাগলো তৈলচিত্রের গায়ে। সাথে সাথেই মেজাজ চরমে উঠে গেল তার। অগ্নিমূর্তি হয়ে পেছনে ঘুরতেই অর্ণবকে দেখতে পেলেন। মিটিমিটি হাসছেন তিনি। এ দেখে পদ্মাবতী আরও রাগান্বিত হয়ে বললেন,

“আমার কাজ নষ্ট করা ছাড়া কি আপনার আর কোনো কাজ নেই?”

“আমার তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে তোমার কাজ নষ্ট করতে যাবো।”

“দেখতেই তো পারছি কতো কাজ আছে। সারাদিন শুয়ে-বসে থাকলে এমনই। কাজ থাকলে এসব দুষ্টু চিন্তা মাথায় আসতো না।”

পদ্মাবতী ঘুরে রঙ ঠিক করতে লাগলেন। অর্ণব এক ঝটকায় আবার তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললেন,

“এই মেয়ে, কাজ নেই মানে? কী বলতে চাও তুমি?”

“কাজ থাকলে কী আর সারাদিন বাড়িতে থাকতেন? কাকুকে দেখলেন না কাজের জন্য আজ সকালে কলকাতা চলে গেলেন। আপনার কাজ থাকলে তো আপনিও চলে যেতেন। বাড়িতে বসে থাকতেন না।”

“তুমি যে আমাকে এসব বলছো, তুমি জানো আমি কত শিক্ষিত? এইসব ছোটখাটো ব্যবসা আমার দ্বারা হবে না।”

পদ্মাবতী আবার উল্টো দিকে ঘুরে রঙ ঠিক করতে লাগলেন। বললেন,

“শিক্ষিত না ছাই। সেই তো কাজ নেই। থাকেন শুয়ে-বসে। কী লাভ হলো তাতে? অথচ বয়স তো কম হলো না।”

অর্ণব আর নিতে পারছেন না। অন্তত এভাবে তাকে কেউ কখনো কাজ আর বয়সের খোটা দেয়নি। এমনকি দিবে তা ভাবতেও পারেননি তিনি। না পারছেন কিছু বলতে, না পারছেন কিছু সহ্য করতে। নিজেকে শান্ত রেখে বললেন,

“বয়সের খোটা দিচ্ছ মেয়ে? দাও দাও। তা আমি নাহয় কিছু করি না। তুমি কী করো?”

পদ্মাবতী সামনে ইশারা করে দেখালেন,

“দেখতে পারছেন না?”

অর্ণব হেসে উঠলেন।

“তা রোজ কত টাকা আয় করো?”

“আয় করি না ঠিকই কিন্তু এটার মধ্যে যে আনন্দটা পাই সেটা তো আর বিক্রি করা সম্ভব নয়।”

“কী সব ছাইপাঁশ ছবি যে আঁকো।”

“মোটেই না। আমি যথেষ্ট ভালো আঁকি। আপনার ছবিও এঁকে ফেলতে পারবো। বুঝেছেন?”

“বুঝেছি।”

হঠাৎ করেই পদ্মাবতীর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সহাস্যে বললেন,

“এই, আপনি আমার আঁকানো চিত্রগুলো দেখবেন?”

এতোক্ষণের সব ঘটনা যেন মেয়েটা একমুহূর্তে ভুলে গেছে। কেউ দেখলে বুঝবেই না যে তাদের মাঝে এতোক্ষণ ঝগড়া হচ্ছিল। অর্ণবের তেমন ইচ্ছে করলো না। তবে হাতে কোনো কাজ না থাকায় সময় ব্যয় করার এরচেয়ে ভালো কিছু খুঁজে পেলেন না। তাই রাজি হয়ে গেলেন। পদ্মাবতী এক এক করে অর্ণবকে নিজের আঁকানো সব চিত্র দেখাতে লাগলেন। হঠাৎ একটা চিত্রে চোখ আঁটকে গেল অর্ণবের। এটা যে মোহিনীর নৃত্যরত ছবি তা বুঝতে সময় লাগলো না। বেশ ভালোই এঁকেছেন পদ্মাবতী। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে আরেকটা চিত্র থেকে পর্দা উঠাতে যাবেন ঠিক তখনই পদ্মাবতী খপ করে তা নিয়ে নিলেন।

“কী হলো এটা?”

“কই?”

“ওটা নিয়ে নিলে কেন?”

“আপনি এটা দেখতে পারবেন না।”

“দেখতে পারবো না মানে? কেন দেখতে পারবো না? তুমিই নিয়ে এসেছো আমাকে এগুলো দেখাতে। এখন এ কথা বললে তো শুনবো না। দেখাও বলছি।”

“এখন আমিই বলছি যে দেখতে পারবেন না আপনি এটা।”

“কী এমন আছে ওতে যে দেখতে পারবো না?”

“বলতে পারবো না।”

হঠাৎ অর্ণবের উদ্দেশ্যে আম্রপালির ডাক শোনা গেল। অর্ণব তার ডাকে সারা দিয়ে আসছি বলে আবার পদ্মাবতীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“যা বলেছিলাম তাই-ই ঠিক। আঁকাও তো সেই ছাইপাঁশই। অথচ এমন ভাব করছো যেন কোথাকার কোন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী তুমি। তোমার থেকে ভালো আঁকতে তো আমি ছোটবেলায়ই পারতাম। তোমাকে তো পরে দেখে নেব।”

অর্ণব চলে গেলেন। যেতে যেতে মোহিনীর চিত্রটাও নিয়ে গেলেন। পদ্মাবতী অর্ণবের কথায় তেমন পাত্তা দিলেন না। এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিলেন। এতোদিনে অর্ণবের এসব আচরণে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তিনি। স্মিত হেসে চিত্রটা থেকে ধীরে ধীরে পর্দা উঠাতেই সুদর্শন এক যুবকের মুখ ভেসে উঠলো। ব্যক্তিটি আর কেউ নন বরং অর্ণব।
.
.
.
শমিত চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে মুখে দিতেই মিতালি বললেন,

“দাদা।”

“কী হয়েছে?”

“আজ একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দাও না।”

“কেন?”

“মাথাটা না প্রচন্ড ব্যথা।”

“মাত্রই তো পড়া শুরু করলি। আগে যেই অংকটা করতে দিয়েছি ওইটা কর। প্রতিদিন তোর একই বাহানা।”

“একই কই হলো? একদিন মাথাব্যথা তো একদিন পেটে ব্যাথা বলি। তাহলে এক কিভাবে হয়?”

“হ্যাঁ, আরও কত অজুহাতই তো আছে তোর কাছে। এসব অজুহাত দেওয়া বাদদে। এবার ভালো করে পড় একটু। নয়তো এবারও আর উপরের শ্রেণীতে উঠতে পারবি না। সেই একই শ্রেণীকক্ষে থেকেই বুড়ি হবি। শেফালীকে দেখেও তো শিখতে পারিস কিছু। সব পরীক্ষায় কত ভালো ফলাফল করে দেখেছিস। তোরা তো দু’বছরের ছোট বড়। কিন্তু দেখ শেফালী কত উপরে উঠে গেল আর তুই ফেল করতে করতে নিচেই পড়ে রইলি। অংকটা তাড়াতাড়ি কর দেখি।”

“আমি তো তোমার ভালোর জন্যই তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে বলেছিলাম।”

“এখানে আমার কী ভালো?”

“শেফালী দিদিই তো বললো।”

“কী বললো?”

“একটু আগে ছেড়ে দিলে তোমারও পরিশ্রম কম হয় আর কোনো দরকারি কাজ থাকলে সেটাও করে নিতে পারো।”

“এটা শেফালী বলেছে নাকি তোর বানানো কথা তা খুব ভালোই বুঝতে পারছি। কোনো তাড়াতাড়ি ছুটি হবে না।”

“ঠিকাছে। আমি তাহলে দিদিকে বলে দেব যে তুমি দেখা করতে পারবে না।”

“কোন দিদি?”

“কোন দিদি আবার? আমার তো একটাই দিদি। শেফালী দিদি।”

“কী বলেছে শেফালী?”

“বলতে তো চেয়েছিলাম কিন্তু বলেই বা কী হবে। তুমি তো আমাকে পড়াচ্ছো। যেতেই পারবে না।”

“দেখ মিতালি। মাথা গরম করিস না। এভাবে ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা না বলে ঠিকমতো খুলে বল পুরোটা।”

“আগে ছুটি দাও।”

“ঠিকাছে। আজ ছুটি।”

“আজ সন্ধ্যার আগে দিদি দেখা করতে বলেছে তোমাকে।”

“কোথায়?”

মিতালি একটা চিঠি বের করে শমিতের হাতে দিলেন।

“এই নাও। দিদির চিঠি। এতে সব লেখা আছে।”

শমিত চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। মিতালি উঠে যেতে যেতে আবার দাঁড়িয়ে পড়লেন। বইয়ের ভাজ থেকে টাকা বের করে শমিতের দিকে এগিয়ে দিলেন। বললেন,

“তোমার এ মাসের বেতন। মা আমার কাছে দিয়ে রেখেছিল তোমাকে দেওয়ার জন্য।”

মিতালি চলে গেলেন। শমিত পুনরায় চিঠি পড়তে মনোনিবেশ করলেন।
.
.
অর্ণবদের বাড়ির ছাদ থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। ছাদে দাঁড়িয়েই শমিত আর শেফালীকে হাত ধরাধরি করে যেতে দেখছেন তিনি। একটু পরপর হেসে উঠছেন তারা। কী সুন্দরই না লাগছে তাদের দেখতে। শমিত শেফালীর কানের পেছনে একটা জবা ফুল গুঁজে দিলেন। এরপর মাঠের মাঝখানে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে গিয়ে বসলেন তারা। পদ্মাবতী এসে অর্ণবের পাশে দাঁড়ালেন। অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“কী দেখছেন?”

অর্ণব মুখে কিছু বললেন না। সামনে ইশারা করে দেখালেন। পদ্মাবতী কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে চোখ ছোট ছোট করে দেখার চেষ্টা করলেন। এরপর অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে বললেন,

“ওটা শমিতদা আর শেফালী না?”

“এমন ভাব করছো যেন কিছু জানোই না।”

“ভাব করছি মানে? আমি আসলেও এ ব্যাপারে কিছু জানতাম না। জানলে তো পিসিমাকে সেই কবেই বলতাম।”

অর্ণব ভ্রুকুটি করে বললেন,

“জানতে না মানে? কোন জগতে থাকো তুমি? চোখের সামনে কী হয় তা দেখো না? দেখে কিছু বুঝতে পারো না? আর পিসিকে বলবে মানে? পিসিকে কে বলতে বলেছে তোমাকে?”

“তো জানাবো না?”

“কেন জানাবে? প্রেম করছে ওরা। তোমার কী সমস্যা? জানালে ওরা নিজে জানাবে। তুমি কেন জানাতে যাবে? এখম যদি আমি প্রেম করি তাও তুমি আমার মাকে গিয়ে জানাবে? আচ্ছা, তুমি প্রেম করলে জানাবে?”

“জানাবোই তো।”

“আবার!”

“না না না। কাউকে কিচ্ছু জানাবো না আমি। সত্যি বলছি। একদম চুপ থাকবো।”

অর্ণব নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো। আর কিছুক্ষণ বাদে অন্ধকারও নেমে আসবে। মোহিনী আজ সারাদিন একবারও এলেন না। অর্ণব পদ্মাবতীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“আরেকজন কই? এলেন না আজ সে?”

“কে?”

“তোমার সাথে যে থাকে।”

“ওহহ, মোহিনী। ওর পায়ে চোট লেগেছে। তাই আসতে পারেনি। আপনি কেন জিজ্ঞেস করছেন?”

“ভাবছিলাম তুমি আজ আমার পেছনে কেন পড়ে আছো। এখন বুঝতে পারলাম বিরক্ত করার মানুষ পাওনি আজ। তাই আমাকে জ্বালিয়ে মারছো।”

“আপনার সাথে আমার কথা বলতে আসাটাই ভুল হয়েছে। ক্ষমা করুন।”

“বুঝতে যখন পেরেছো তো যাও এখান থেকে।”

“আমি কেন যাবো? আপনি যান।”

অর্ণবের কথা বাড়াতে ইচ্ছে করলো না। তাই তিনি সিড়ির উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলেন।
.
.
.
রাতের খাবার শেষ করে অনেক্ষণ আগেই নিজের ঘরে এসেছেন অর্ণব। টুকটাক কাজ করে আলো নিভিয়ে শুয়েও পড়েছেন। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না তার। এরইমধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেলে বিরক্ত হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলেন তিনি। ঘরের মধ্যেই কিছুক্ষণ পায়চারি করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। হাজারো জোনাকির আলো যেন রাতের অন্ধকারকে ঘুচিয়ে দিয়েছে। অর্ণবের ঘরে আর মন টিকলো না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। এসে আবার সেই নদীর পাড়ে বসলেন। আজ মোহিনী আসবে কীনা তা জানা নেই। এ বিষয়ে কোনো কথা হয়নি তার সাথে। তবুও কেন যেন বারবার এখানে আসতে ইচ্ছে করছিল অর্ণবের। বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেল। অর্ণব একটা সিগার জ্বালালেন। প্রথম টান দিতেই পাশের রাস্তা দিয়ে কাউকে আসতে দেখলেন তিনি। হাতে হ্যারিকেন। অর্ণব সিগারটা ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। অন্ধকারে চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। আরেকটু কাছে আসতেই তাকে চিনতে পারলেন। কিন্তু যার আশা অর্ণব করেছিলেন, সে তিনি নন। তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে পদ্মাবতী এসে দাঁড়ালেন তার সামনে। হ্যারিকেনটা উঁচু করে ধরতেই তার আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো পদ্মাবতীর মায়া মাখা মুখাবয়ব। অর্ণব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সেদিকে।

চলবে..

#মেহেরজান
#পর্ব-১৬
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

আজ প্রচন্ড রোদ ওঠায় দুপুরের কড়া রোদে ছাদে আচার আর শুকনো লঙ্কা শুকাতে দিয়েছেন শকুন্তলা। পাহারা দেওয়ার জন্য রেখে গেছেন পদ্মাবতীকে। শকুন্তলার আদেশ মানতেই বিগত দেড় ঘন্টা যাবৎ পদ্মাবতী লাঠি হাতে নিয়ে ছাদে বসে আছেন। ঘেমে-নেয়ে একদম একাকার অবস্থা। একটা দুটো কাক এলেই লাঠি নিয়ে তাড়া করছেন যাতে কোনোকিছু নোংরা না করতে পারে। ছাদের দরজা দিয়ে মোহিনীকে খোড়াতে খোড়াতে ঢুকতে দেখে বললেন,

“সাবধানে আয়।”

মোহিনী এসে পদ্মাবতীর পাশে বসলেন।

“পা কাটলো কী করে তোর?”

“দেখতে পাইনি। ভুল করে ভাঙা কাঁচে পা রেখেছিলাম।”

“দেখতে পাসনি মানে? কোন দিকে তাকিয়ে হাঁটছিলি?”

মোহিনী জবাব দিলেন না। পদ্মাবতী মোহিনীর পায়ের দিকে একবার দেখে আবার বললেন,

“তুই শুধু শুধু আসতে গেলি কেন আজ? আর দু তিনদিন বিশ্রাম নিলেই পারতি।”

“তিনদিন তো ছিলামই। আর কতদিন থাকবো? তুই তো মনে হয় ভালোই ছিলি আমাকে ছাড়া।”

“একদম না।”

“আচারের বৈয়ামটা নিয়ে আয় তো।”

“এখনও খাবি?”

“সমস্যা কোথায় খেতে?”

“দাঁড়া। এনে দিচ্ছি।”

পদ্মাবতী আচারের বৈয়াম এনে মোহিনীর হাতে দিলেন। মোহিনী একবার খেয়েই রেখে দিলেন। পদ্মাবতী বললেন,

“কী হলো? রেখে দিলি কেন? আর খাবি না?”

“উহু।”

“কেন?”

“শুধু মিষ্টি। টক ঝাঁল কিছুই নেই। নিশ্চয় তুই বানিয়েছিলি।”

পদ্মাবতী হ্যাঁবোধক মাথা নাড়লেন। মোহিনী বললেন,

“এরপর বড়মার থেকে ভালো করে শিখে তারপর বানাবি।”

হঠাৎ করেই আকাশের অবস্থা পাল্টে গেল। মুহুর্তেই চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। পদ্মাবতী সব গোছাতে শুরু করলেন। চিত্রাও দৌঁড়ে ছাদে এসে পদ্মাবতীর সাহায্য করতে লাগলেন। দু’জনে মিলে সবকিছু চিলেকোঠায় নিয়ে রাখলেন। একটা, দুটো, তিনটা করে বৃষ্টির অসংখ্য ফোঁটা মোহিনীর হাতে মুখে পড়তে লাগলো। পদ্মাবতী তাকে ডাক দিলেন।

“এই মোহিনী, ভেতরে আয়। ভিজে যাবি তো।”

মোহিনী উঠে তাদের কাছে গেলেন। সেখানে রাখা ছোট্ট একটা খাটে বসতেই মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করলো। চিত্রা বললেন,

“একটু আগেই কী সুন্দর রোদ ছিল। এক মুহুর্তে সব বদলে গেল। দেখবি একটু পরই চলে যাবে।”

তারা সেখানে বসেই কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলেন। কিন্তু মোহিনী শুধু শুনেই গেলেন। কিছু বললেন না। পদ্মাবতী মাঝে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন সে এতো চুপচাপ কেন। মোহিনী এমনি বলে প্রশ্নটা কাঁটিয়ে নিয়েছেন। কিছুক্ষণ পরেই বৃষ্টি একদম থেমে গেল। চিত্রা বললেন,

“দেখেছিস? বলেছিলাম না একটু পরই চলে যাবে।”

“কিন্তু ছাদ তো একদম ভিজিয়ে দিয়ে গেল। শুকাতে দেব কোথায় আবার?”

“শুকাতে দিতে হবে না আর। রোদও নেই এখন। নিচে নিয়ে চল।”

চিত্রা পদ্মাবতী একটা একটা করে সব জিনিসপত্র নিয়ে নিচে নেমে এলেন। তাদের পেছন পেছন মোহিনীও এলেন। হঠাৎ কেউ তার হাত ধরে হেঁচকা টানে সরিয়ে নিয়ে এসে মুখ চেপে ধরলেন। চিত্রা পদ্মাবতী নিজেদের মতো চলে গেলেন। পেছনে কী হয়েছে তারা তা টেরই পাননি। শঙ্কিত চোখে অর্ণবকে দেখে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন মোহিনী। তবে অর্ণব তাকে বেশ শক্ত করেই ধরে রেখেছেন। মুখ চেপে ধরায় কিছু বলতেও পারছেন না। অর্ণব ধমকের সুরে বললেন,

“নড়বেন না একদম।”

মোহিনী শান্ত হয়ে দাঁড়ালেন। অর্ণব তার মুখ ছেড়ে দিলেন।

“কী হয়েছে?”

“ইদানীং আপনি একটু বেশিই অনিয়ম করছেন কিন্তু। অনিচ্ছায় নাকি ইচ্ছে করেই?”

“কী অনিয়ম করলাম?”

“এতোদিন পরপর আসছেন কেন? পায়ে ব্যথা?”

“হ্যাঁ। দেখছেন না?”

অর্ণব পায়ের দিকে তাকালেন। সুন্দর করে পট্টি বাঁধা। মনে পরলো সেদিন পদ্মাবতী একবার বলেছিলেন মোহিনীর পা কেটে গেছে।

“কাটলো কী করে?”

“তা আপনার না জানলেও চলবে।”

“সেদিন আমাকে আমাকে অপেক্ষায় রেখে আপনি আসেননি। এটা তারই শাস্তি ছিল। এলেন না কেন?”

“এসেছিলাম।”

“মিথ্যে বলবেন না একদম।”

“আমি মিথ্যে বলি না। আপনি যে গাছের নিচে বসে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলেন তা খুব ভালোভাবেই দেখেছি। আর পা না আপনার সাথে দেখা করতে গিয়েই কেটেছে।”

“আবার মিথ্যে বললেন। আমি নাক ডাকি না।”

“ডাকেন।”

“আমাকে ওঠালেন না কেন ঘুম থেকে?”

“প্রয়োজন বোধ করিনি।”

“তো ডেকেছিলেন কেন?”

“যার জন্য ডেকেছিলাম তা তো বলেই দিয়েছি। আর কী?”

“আমার জবাব কই?”

মোহিনী এবার অর্ণবকে ধাক্কা দিয়ে তার থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে দিলেন। চলে যেতে যেতে বললেন,

“সেদিন যেন কোন পাঞ্জাবীটা পরেছিলেন আপনি? গিয়ে ওটার পকেটে খুঁজে দেখুন।”

অর্ণব আর এক মুহুর্তও দাঁড়ালেন না। নিজের ঘরে এসে পাঞ্জাবী খুঁজতে লাগলেন। পাঞ্জাবীর পকেটে হাত দিতেই একটা চিরকুট পেলেন। যার মধ্যে গোঁটা গোঁটা করে লেখা “অর্ণব চৌধুরী, আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি আছি।”
.
.
.
নিজের ঘরেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে পায়চারি করছেন আম্রপালি। হাতে একটা খাম। খামের ওপর লেখা ঠিকানাটা দেখেই আঁতকে উঠেছেন তিনি। চিঠিটা সুন্দরপুর থেকে এসেছে। চিঠিটা খুলবেন কী খুলবেন না তা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন তিনি। পাত্রে জল ভরে ঢকঢক করে খেয়ে নিলেন। শান্ত হয়ে খাটে বসে খাম থেকে চিঠিটা বের করে পড়তে শুরু করলেন।

“সুজনীয়াসু,
আশা করি ভালো আছো। তুমি বয়সে আমার ছোট হবে। তাই তুমি করেই বলছি। আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই। তাই হয়তো চিনতে পারছো না। তবে আমি তোমাকে খুব ভালো করেই চিনি। আমি পারমিতার স্বামী অমলেন্দু বসাক এর দিদি। এবার চিনতে পেরেছো হয়তো। জেনেছি অমলেন্দু আর পারমিতার সন্তানকে মমতায় জড়িয়ে রেখেছো তুমি। সুন্দর একটা নামও দিয়েছো ‘পদ্মাবতী’। হয়তো ভাবছো হঠাৎ এতো বছর পরে আমার চিঠি তোমার কাছে কেন। আমি বেশি কথা বাড়াবো না। তাই সোজাসুজিই বলছি। আমার মা অর্থাৎ পদ্মাবতীর দিদিমা মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে এখন মৃত্যুশয্যায়। যেকোনো দিন গত হতে পারেন। তার শেষ ইচ্ছা তিনি একটিবারের জন্য পদ্মাবতীকে দেখবেন। তার শেষ ইচ্ছা রাখতেই তোমার কাছে আমার এ চিঠি লেখা। আমি তোমার কাছে মিনতি করছি, পুরনো সব কথা ভুলে যত শীঘ্রই পারো পদ্মাবতীকে এখানে কয়েকটা দিনের জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করো। সম্ভব হলে চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই।

ইতি,
শর্মিলা”

চিঠিটা রেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন আম্রপালি। কিন্তু এখন তার কী করা উচিত তা বুঝে উঠতে পারছেন না। পদ্মাবতীকে পাঠাবেন নাকি পাঠাবেন না, এ নিয়ে যেন আরও চিন্তায় পড়ে গেলেন। নিজেকে আর এতো প্রশ্নের সম্মুখীন না করে পদ্মাবতীকে ডেকে পাঠালেন। তিনি এলেন।

“আমায় ডেকেছিলেন বড়মা?”

“ভেতরে আয়।”

পদ্মাবতী আম্রপালির সামনে এসে বসলেন। আম্রপালি পুনরায় চিঠিটা পড়ে তাকে শোনালেন। জিজ্ঞেস করলেন,

“কী করবি? যেতে চাস নাকি চাস না? তুই যা বলবি তাই হবে।”

পদ্মাবতী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন,

“আমি যাবো না।”

“কেন?”

“আমার বাবা মারা যাওয়ার পর যারা কীনা গর্ভবতী অবস্থায় আমার মাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিন্দুমাত্র মায়াও দেখাননি। এতো বছর আমার কোনো খবর রাখেননি। আর আজ বিশ বছর পরে মৃত্যুশয্যায় এসে তার আমাকে দেখতে ইচ্ছে হলো? সত্যি বলতে তার এই অবস্থায় আমারও একবিন্দু মায়া হচ্ছে না। তাহলে শুধু শুধু কেন যাবো?”

“এভাবে বলিস না। মানুষ মৃত্যুকে নিজের সামনে না দেখলে পাপের কথা চিন্তা করে না। অনুতপ্তও হয় না। হয়তো আজ এতো বছর পর এসে সে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। তোর কাছে ক্ষমা চান। তোরও উচিত ক্ষমা করে দেওয়া।”

“সত্যিই ক্ষমা করে দেবো?”

আম্রপালি পদ্মাবতীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। পদ্মাবতী আবার বললেন,

“আমার মায়ের সাথে কী হয়েছিল তা তো আপনিই আমাকে জানিয়েছেন। যেখানে আমি শুধু শুনেই তাদের জন্য নিজের মনে এতো ঘৃণা পুষে রেখেছি সেখানে আপনি সবটা দেখেও আমাকে ক্ষমা করে দিতে বলছেন?”

“কারও জন্য মনে ঘৃণা পুষে রাখিস না পদ্মা। সুখী হতে পারবিনা। কুরে কুরে খাবে তোকে। ক্ষমা করে দেখিস কতো শান্তি লাগে। মনের বোঝা হালকা হয়।”

“আমি যাবো না। আপনিই বলেছেন আমি যা চাইবো তাই হবে। আর আমি যেতে চাই না।”

পদ্মাবতী দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কয়েকবার ডেকেও তাকে থামাতে পারলেন না আম্রপালি। মোহিনী আম্রপালির ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,

“ও ওভাবে দৌঁড়ে চলে গেল কেন?”

“সুন্দরপুর যেতে বলেছি বলে।”

“কেন যাবে?”

“চিঠি এছেসে। ওর দিদিমা অসুস্থ। ওকে একটাবার দেখতে চেয়েছে। তাই বলেছি ওদের ক্ষমা করে দিয়ে ওনাকে একবার দেখে আয়।”

“কেন ক্ষমা করবে? আর দেখতে চেয়েছে বলেই যেতে হবে নাকি?”

“তোর মধ্যে কি মায়াদয়া একদমই নেই? এই তোর সাথে থেকে থেকে মেয়েটা এমন নির্দয়া হয়েছে। কোথায় ওকে একটু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওখানে পাঠাবি। তা না করে কেন কেন করছিস।”

“তাহলে আপনি কী চাইছেন? আমার এখন কী করা উচিত?”

আম্রপালি মোহিনীর হাত ধরে অনুরোধের সুরে বললেন,

“ওকে একটু বোঝা না যেন ওখানে যায়।”

“যখন আমি ওর যাওয়া নিয়ে নিজেই রাজি নই তাহলে আমি এটা কেন করবো?”

আম্রপালি মোহিনীর হাত ছেড়ে দিলেন। উচ্চস্বরে বললেন,

“আমার জন্য করবি। এখনও আপত্তি আছে? যদি থাকে তাহলে পরে আসিস আমার কাছে কিছু চাইতে। দেখবো কে দেয়।”

“ঠিকাছে। রাগ করবেন না। আমি ওকে বোঝাবো।”

আম্রপালির মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

মোহিনী আম্রপালির ঘর থেকে পদ্মাবতীর ঘরে আসতেই পদ্মাবতী বলে উঠলেন,

“আমাকে একদম কিছু বোঝাতে আসবি না।”

“আমি কী বোঝাবো তোকে?”

“ওইযে বড়মা এতোক্ষণ যা বোঝালেন। একে ক্ষমা করে দে, ওকে ক্ষমা করে দে। আমি কি দয়ার পাহাড় নাকি?”

“আমার তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে তোকে ওসব বোঝাতে আসবো।”

“তাহলে কী করতে এসেছিস?”

“তুই সুন্দরপুর যাবি এটা বলতে এসেছি।”

“একদম না। সেই তো তুই একই কারণে এসেছিস এখানে।”

“একই কোথায়? আমি কী বলেছি ক্ষমা করে দে?”

“তাহলে?”

“শুনেছি ওই গ্রামটা নাকি অনেক সুন্দর। তুই ঘুরতে যা না।”

“মানে?”

“মানে তুই ক’দিন ওখানে ঘুরে বেড়িয়ে আয়। বড়মাও খুশি হবেন আর তোর মনটাও ভালো হয়ে যাবে।”

“ধুর। একটা মানুষ অসুস্থ। সেখানে থাকলে কখনো মন ভালো হবে?”

“ওই বুড়িটা এমনেও মরবে ওমনেও মরবে। তাতে তোর কী? মনে করবি তোর কেউ হয়ই না। তুই থাকবি তোর মতো।”

পদ্মাবতী কতক্ষণ মোহিনীর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলেন। এরপর বললেন,

“এসব চিন্তাভাবনা শুধু তোর মনেই আসা সম্ভব।”

“যাবি কিনা বল?”

পদ্মাবতী কিছু সময় ভেবে উত্তর দিলেন,

“ঠিকাছে। আমি যাবো।”

“তাহলে বড়মাকে জানিয়ে আয়।”

অন্য ঘর থেকে আম্রপালি যেন শুনতে পান সেজন্য পদ্মাবতী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মোহিনীর উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,

“আমি কাল সুন্দরপুর যাচ্ছি। কিন্তু শুধু তোর কথা রাখতে মোহিনী।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে