মেহেরজান পর্ব-১১+১২

0
449

#মেহেরজান
#পর্ব-১১
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

আজ চারদিন যাবৎ অর্ণব সকালে চা পান না। উপায়ন্তর না পেয়ে আজ শকুন্তলাকে বলে রেখেছেন যাতে সকালে চা দিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা নিয়ে চিত্রা এলেন তার ঘরে।

“আসবো দাদা?”

“ভেতরে আয়।”

চিত্রা এসে চায়ের কাপটা অর্ণবকে দিয়ে বললেন,

“আপনার আর কিছু লাগবে?”

অর্ণব চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন,

“আমাদের সম্পর্কটা এতোটাও দূরের নয়। তুই আমাকে তুমি করে বলতে পারিস।”

“আচ্ছা দাদা। আমি তা-ই বলবো।”

আজকের চায়ে সেদিনের মতো মজা পাচ্ছেন না অর্ণব। দ্বিতীয়বার আর খাওয়ার রুচি হলো না তার।

“আজকের চা’টা কে বানিয়েছে?”

“আমি বানিয়েছি। কেন? ভালো হয়নি?”

“হয়েছে। সবার চা তো পদ্মাবতী বানায়।”

“হ্যাঁ। ও-ই বানায়। কিন্তু ও তোমার ঘরে চা দেবে না বলেছে। তুমি নাকি আসতে বারণ করেছো ওকে?”

“অনুমতি ছাড়া ঘরে ঢুকতে বারণ করেছি। চা পাঠাতে বারণ করিনি।”

“আচ্ছা। আমি বলে দেব ওকে যেন রোজ তোমার ঘরে চা দিয়ে যায়।”

“বলিস।”

হঠাৎ অর্ণবের নাকে একটা গন্ধ এসে ঠেকলো। তার বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে এটা কিসের গন্ধ। তিনি চিত্রার উদ্দেশ্যে বললেন,

“শুটকি মাছের গন্ধ আসছে না?”

“হ্যাঁ তো।”

“এ বাড়িতে শুটকি কে খায়?”

“পদ্মা।”

“ওর এই অভ্যেস হলো কি করে?”

“জেঠীমা বলেছিল দিদা আর রামু কাকু দুজনেই তো পূর্ব বঙ্গের। সে সূত্রে দুজনেই নাকি শুটকির জন্য পাগল ছিল। দাদু মারা যাওয়ার পরে আর দিদা খায়নি এসব। এখন শুধু রামু কাকুই খায়। আর তার থেকেই পদ্মা শিখেছে। শুধু পদ্মা নয়, মোহিনীরও এই অভ্যেস আছে। কিভাবে যে খায় ওরা। পদ্মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে শুটকির সব পদের নাম গড়গড় করে বলে দিতে পারবে।”

“এই ব্যাপার তাহলে।”

“মা তো পদ্মাকে কতবার বলেছে এখানে রান্না না করতে। গন্ধে থাকা যায় না বাড়িতে। কে শোনে কার কথা।”

“ঠিকাছে। তুই এখন যা। আর শমিতকে পাঠিয়ে দিস তো আমার ঘরে।”

“আচ্ছা।”

কিছুক্ষণ বাদে অর্ণবের ঘরে আসতেই তাকে বই নিয়ে বসে থাকতে দেখলেন শমিত। বললেন,

“কিরে? সবসময় বইয়ে এতো কি পড়িস বলতো?”

“কেন? কিছু বলবি?”

“আমি কি বলবো। তুই-ই তো আমাকে ডেকে পাঠালি চিত্রাকে দিয়ে। কি বলবি বল।”

“তেমন কিছু না।”

“বলছিলাম যে এখানে এসেছিস পর থেকে তো বাইরে তেমন বেরই হোসনি। চল আজকে একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।”

“এই কথাটা তুই আমাকে সেদিনও বলেছিলি কাশফুল দেখতে যাওয়ার জন্য। আর কেন যেতে চাইছিলি তা বেশ ভালোই বুঝেছি।”

সেদিন শমিতের বলাতেই অর্ণব তার সাথে গিয়েছিলেন। যদিও সেখানে দুজনেরই স্বার্থ নিহিত ছিল।

“কখন বললাম?”

অর্ণব ঘুরে শমিতের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার ভাবসাব খুব একটা সুবিধার নয়। অন্তত এই বয়সে শমিত আবার অর্ণবের হাতে মার খেতে পছন্দ করবেন না। যা মারপিট হতো তা ছোটবেলা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকা ভালো। অবস্থা বেগতিক দেখে শমিত বললেন,

“এই দাঁড়া দাঁড়া। এভাবে তাকাস না। আমি মনে করছি।”

কথাটা বলেই শমিত ভাবতে শুরু করলেন।

“তুই তো এখানে আসার পর তেমন একটা বেরই হোসনি বাড়ি থেকে। চল আজকে কোথাও ঘুরে আসি।”

“কই যাবি?”

“নদীর মাঝে চর উঠেছে। কাশফুলে একদম ভরে গেছে। চিত্রারা সবাই গেছে ওখানে। চল আমরা যাই।”

“মেয়েদের মাঝে গিয়ে তুই কি করবি?”

“ধুর। মেয়েদের মাঝে যেতে যাবো কেন? আমরা তো যাচ্ছি কাশফুল দেখতে।”

“কাশফুল দেখতেই যাচ্ছিস নাকি অন্য কোনো ফুল আছে?”

শমিত আমতা আমতা করে বললেন,

“অন্য কোনো ফুল মানে? কিসের অন্য কোনো ফুল? তুই যাবি কিনা বল।”

“না। কাশফুল নাকে মুখে গেলে প্রচুর হাঁচি আসে।”

“ঠিকাছে। না গেলি। পদ্মা, মোহিনী, চিত্রারা নাহয় একাই চলে আসবে। মাঝে পথে বিপদাপদ হলে কার কি। আমাদের তো আর কোনো দায়িত্ব নেই।”

“ঠিকাছে ঠিকাছে। মেয়েদের মতো ন্যাকামি করিস না। যাচ্ছি।”

“এইতো বললি যাবি না। এখন আবার যেতে চাওয়ার কারণ কি বলতো।”

“তাহলে তুই চাস আমি না যাই। আচ্ছা, তাই হবে।”

শমিত বাহু দ্বারা অর্ণবের ঘাড় জাপটে ধরে বললেন,

“আরে আমি তো মজা করছি বন্ধু। রাগ দেখাস না। চল।”

অর্ণব হাতে থাকা বই দ্বারা শমিতকে আঘাত করতেই তার ভাবনায় ছেদ ঘটলো।

“মনে পড়েছে?”

“হ্যাঁ পড়েছে পড়েছে। থাক, কোথাও যেতে হবে না আজ তোকে। আমিও যাবো না। আপাতত চল ছাদে যাই।”

“ছাদে?”

“হ্যাঁ, ছোট মামি বীণা নিয়ে বসেছে। সবাই ওখানেই আছে।”

সবাই বলতে কারা অর্ণব তা জানেন না। তবুও একটা আশায় তিনি শমিতের সাথে যেতে রাজি হলেন।
.
.
.
ছাদে বসে বীণা বাজাচ্ছেন শকুন্তলা। চিত্রা আর মোহিনীও সেখানে রয়েছেন। অর্ণব এসে মোহিনীর সাথে একদম ঘেঁষে বসে পড়লেন। মোহিনী দ্রুত তার থেকে সরে বসলেন। অর্ণবের এমন ব্যবহারে প্রচন্ড বিরক্ত সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পদ্মাবতী আসলেন সেখানে। জায়গা না পেয়ে একদম অর্ণব আর মোহিনীর মাঝখানে বসে পড়লেন সে। অর্ণব পদ্মাবতীর কান্ড দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। না, এই মেয়েটা কখনোই তার কোনো কাজ ঠিকমতো হতে দেবে না। তবে অর্ণব যেন তাকে জ্বালানোর আরেকটা সুযোগ পেয়ে গেলেন। আর যাই হোক, পদ্মাবতীকে বিরক্ত করতে বেশ মজা পান অর্ণব। একটু নড়েচড়ে বসলেন তিনি। উঁকি দিয়ে এক নজর মোহিনীকে দেখে পদ্মাবতীর শাড়ির আঁচল নিয়ে নিজের আঙুলে প্যাচাতে লাগলেন তিনি। চিত্রা ভ্রকুটি করে তা দেখছেন। শমিত মিটিমিটি করে হাসছেন। পদ্মাবতী তা খেয়াল করে নিজের শাড়ির আঁচল টান দিতেই কতোগুলো সুতো এলোমেলো হয়ে গেল। বড় বড় চোখ করে অন্যদিকে তাকালেন অর্ণব। রাগে ফুঁসছেন পদ্মাবতী। তাকে বিরক্ত করে অর্ণব কি পান কে জানে। কিন্তু সুযোগ পেলে তা ছেড়ে দেন না তিনি। পদ্মাবতী উঠে দাঁড়াতেই তার শাড়ির নিচের বেশ খানিকটা ছিড়ে গেল। শমিত হো হো করে হেসে উঠলেন। এবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না পদ্মাবতী।

“দিলেন তো আমার শাড়ি ছিড়ে। আপনি সরে বসতে পারলেন না? এসে আমার শাড়ির উপরেই বসতে হলো আপনার?”

“তুমি পরে এসে বসেছো। আমি কিভাবে তোমার শাড়ির উপরে বসবো। পুরনো শাড়ি ছিল। তোমার নিজের পায়ের সাথে লেগেই ছিড়েছে আর দোষ চাপাচ্ছো আমার ঘাড়ে।”

পদ্মাবতী না পারছেন সইতে আর না পারছেন কিছু বলতে। শকুন্তলা বললেন,

“তোরা কি ঝগড়া করবি এখন? পদ্মা, তুই গিয়ে শাড়িটা পাল্টে নে না। তাহলেই তো হয়।”

“তুমি কিছু বলবে না ছোটমা? একে তো উনি আমার শাড়ি ছিড়েছেন। তার উপর বলে কি না আমার শাড়ি পুরনো?”

অর্ণব বললেন,

“তা নয় তো আবার কি?”

“কে বলেছে আপনাকে এটা পুরনো শাড়ি। এটা আমাকে বড়মা দিয়েছিলেন পূজোতে।”

অর্ণব পদ্মাবতীকে আরেকটু বিরক্ত করতে বললেন,

“দেখি তো শাড়িটা। আরে, এটা তো মায়ের শাড়ি। মা তো এখন এসব শাড়ি পরেন না। তার মানে সেই বিশ বছর আগের। মা পরেন না বলেই তোমাকে দিয়ে দিয়েছেন।”

“আমি নালিশ করবো আপনার নামে বড়মার কাছে।”

পদ্মাবতী দৌঁড়ে চলে গেলেন। শকুন্তলা বললেন,

“এতো জ্বালাস কেন মেয়েটাকে?”

“আমি কোথায় জ্বালালাম? প্রতিশোধ নিলাম মাত্র।”

অর্ণবও উঠে চলে গেলেন। শকুন্তলা শমিতের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,

“ও কিসের প্রতিশোধের কথা বলে গেল?”

“ঠান্ডা জলে স্নানের।”

“মানে?”

“আপনি বুঝবেন না।”

“কি বললি তুই?”

“না না। এটা বলতে চাইনি। মানে আপনি জানেন না এ ব্যাপারে কিছু তাই আর বললে বুঝতে পারবেন না।”

একে একে সবাই সবাই উঠে গেলেন সেখান থেকে। মোহিনী তখনও সেখানে বসে আছেন। ভাবনার সাগরে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছেন তিনি। নিজের চারপাশের সবকিছুই কেমন যেন অন্যরকম লাগছে তার কাছে। একদম নতুন অনুভূতি, যার সাথে পূর্বে কোনোদিন পরিচয় হয়নি তার। হঠাৎই আম্রপালির ডাকার শব্দ ভেসে এলো।

“মোহিনী, খেতে আয় নিচে।”

মোহিনী ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখলেন। আশেপাশে আম্রপালি নেই। বাড়ির ভেতর থেকে ডেকেছেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যে আবারও তার ডাকার শব্দ ভেসে এলো।

“কিরে? জলদি আয়।”

মোহিনী চেঁচিয়ে বলে দিলেন,

“আসছি।”

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-১২
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

গুলির বিকট শব্দে কতোগুলো পাখি উড়ে গেল। গাছে থাকা কামরাঙাটা টুপ করে মাটিতে পড়লো। শমিত গিয়ে ঝটপট তা তুলে ফেললেন। বললেন,

“তোর নিশানা তো খুব তীক্ষ্ণ অর্ণব। এক গুলিতেই কামরাঙাটা কেমন পেরে ফেললি।”

পদ্মাবতী দৌঁড়ে এসে উচ্চস্বরে হাসতে লাগলেন। হাতে কিছু একটা রয়েছে তার। শমিত বললেন,

“হাসছিস কেন তুই?”

পদ্মাবতী হাসি থামিয়ে বললেন,

“তোমাদের কান্ড দেখে। কামরাঙা পারতে বন্দুক লাগে নাকি। যেন মশা মারতে কামান।”

পদ্মাবতী আবার হাসতে শুরু করলেন।

“এই, তোর কোনো কাজ নেই? এখানে কি করছিস?”

“সব কাজ সেরে ফেলেছি। গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েই তো এদিকে এলাম। দাঁড়াও। তোমাদের আগে দেখিয়ে দেই কিভাবে কামরাঙা পারতে হয়।”

হাতে থাকা গুলতি দিয়ে নিশানা তাঁক করলেন পদ্মাবতী। পরক্ষণেই আরেকটা কামরাঙা মাটিতে পড়লো।

“দেখেছো? এবার থেকে পারবে আশা করি।”

“এই তুই যা তো। অর্ণব, তুই ওর কথায় কান দিস না। আমরা আমাদের কাজ করি।”

“যাচ্ছি যাচ্ছি। আমি তো শুধু একটু শেখাতে এসেছিলাম।”

পা বাড়াতেই হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পরার আগেই পদ্মাবতীর বেণি ধরে টান দিলেন অর্ণব। আর্তনাদ করে উঠলেন পদ্মাবতী।

“মা গো! আমার সব চুল ছিড়ে ফেললো গো।”

অর্ণব বিদ্রুপ করে বললেন,

“এসেছেন আমার কোথাকার কোন চুলওয়ালী। যেই না মাথার কেশ, অল্প দিনেই হবে শেষ। দু’দিন বাদেই তো মাথায় টাক পরবে। তখন সবাই বলবে টাকওয়ালী।”

“বললেই হলো? আমার চুলের মতো ঘন আর লম্বা চুল এ গ্রামে আর কারও মাথায় আছে নাকি? দেখাতে পারবেন? আর আমার না হাত আছে। হাত ধরে টানতে পারতেন। চুল টানার কোনো দরকার ছিল না।”

কথাটা বলেই দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে অর্ণবের সামনে ধরলেন পদ্মাবতী। অর্ণব পুনরায় নিশানা তাক করতে করতে বললেন,

“আমি যার তার হাত ধরি না।”

পদ্মাবতী চলে যাবেন এমন সময় আবার গুলির বিকট শব্দ কানে এলো। দু’হাতে কান চেপে ধরলেন পদ্মাবতী। কিন্তু এবার গাছ থেকে কোনো ফল পড়লো না। পরিবর্তে গাছের মগডালে বসা টিয়াপাখিটা পড়লো। একটা বিরক্তিভরা শব্দ বেরিয়ে এলো অর্ণবের মুখ থেকে। পদ্মাবতী দৌঁড়ে এসে পাখিটা তুলে নিলেন।

“ইশশশ। কি করলেন আপনি এটা? মেরে ফেললেন পাখিটাকে?”

“ওটাকে মারার উদ্দেশ্য ছিল না আমার।”

“অনিচ্ছাকৃতই হোক কিন্তু মেরেছেন তো।”

পদ্মাবতী পাখিটা ওখানেই রেখে উঠে এলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে মোহিনীও এলেন সেখানে। পদ্মাবতীর উদ্দেশ্য বললেন,

“কি হয়েছে এখানে?”

পদ্মাবতী জবাব দিলেন না। শমিত বললেন,

“দেখছিস না কি হয়েছে। অর্ণব ভুল করে গাছে থাকা পাখিটা মেরে ফেলেছে।”

মাটিতে পড়ে থাকা পাখিটা দেখে সামান্য হাসলেন মোহিনী। সকলে ভ্রুকুটি করে তার দিকে তাকালেন।

“কি হয়েছে তোর? হাসছিস কেন?”

“গাছে বসে থাকা পাখি কে না গুলি করে মারতে পারে। পারলে উড়ন্ত কিছুতে গুলি করে দেখাতে বলো।”

পদ্মাবতী বললেন,

“পাগল নাকি তুই? শমিতদা তো বললোই উনি ভুল করে মেরেছেন। আবার মারতে যাবেন কেন?”

“উনি তো তোদের নিজের বন্দুক চালানোর দক্ষতা দেখাচ্ছিলেন। এখন গাছে বসে থাকা পাখিকে গুলি করলে তো এটা বোঝা যাবে না যে উনি উড়ন্ত পাখিকে গুলি করতে পারবেন কিনা। আর উনি এমনিতেও লক্ষ্যচ্যুত হয়েই পাখিটাকে মেরেছেন। তাহলে উড়ে যাওয়া পাখি আর কিইবা মারবেন।”

আকাশে একঝাঁক শালিক উড়ে যাচ্ছিলো। অর্ণব সাথে সাথে বন্দুকে ভরে নিশানা তাক করলেন। গুলি ছুড়তেই একটা শালিক মাটিতে পড়লো। পদ্মাবতী চিৎকার করে উঠলেন। অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“কেমন মানুষ আপনি? আপনার মধ্যে কি এক বিন্দু পরিমাণও দয়ামায়া নেই? তখন না হয় ভুল করে মেরেছেন। কিন্তু এখন?”

“তোমার বান্ধুবীই তো বললো।”

“ও বললো আর আপনাকে মারতে হবে?”

“আমার দক্ষতা আর সাহসের ওপর কেউ আঙুল তুললে আমি দেখতে পারি না।”

“নীড়ে থাকা ওদের ছানাগুলোর কি হবে ভেবে দেখলেন না একবারও? ওরা এখন কি খাবে? বাঁচবে কিভাবে? মা ছাড়া বাঁচা কতটা কঠিন জানেন আপনি?”

অর্ণব তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। পদ্মাবতীর চোখ ভরে উঠেছে। হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল মুছে নিলেন তিনি। অর্ণব একটা সিগার জ্বালালেন। একবার টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তেই মোহিনী বললেন,

“ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এটা তো আপনার জানার কথা?”

“জানি। পুরনো দিনের অভ্যেস। এতো সহজে ছাড়বে না। বৃথা চেষ্টা না করে এটার সাথে বাঁচাই ভালো।”

“আমি ছাড়ার একটা সহজ উপায় বলবো?”

“কি?”

মোহিনী অর্ণবের হাত থেকে সিগারটা নিয়ে নিলেন। এরপর জ্বলন্ত সিগারটা তারই হাতে চেপে ধরলেন। অর্ণবের মুখের অভিব্যক্তি বিন্দুমাত্রও পরিবর্তন হলো না। পদ্মাবতী দ্রুত মোহিনীর হাত থেকে সিগারটা নিয়ে ফেলে দিলেন।

“কি করছিস তুই মোহিনী? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর?”

অর্ণবের হাত ধরে বললেন,

“ইশশশ। কতটা পুড়ে গেছে।”

পদ্মাবতী দৌঁড়ে বাড়িতে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবার একই গতিতে ফিরে এলেন। হাতে করে কিছু একটা নিয়ে এসেছেন তিনি। অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“হাত দিন।”

“কেন?”

“ওষুধ লাগাবো।”

পদ্মাবতী ভালোভাবে অর্ণবের হাতে ওষুধটা লাগিয়ে দিলেন। মুহুর্তেই হাতের জ্বালাটা কমে ঠান্ডা অনুভূতি হচ্ছে অর্ণবের। এখন বেশ আরাম লাগছে তার। দূর থেকে চিত্রা ডাকতেই পদ্মাবতী আসছি বলে আবার দৌঁড়ে চলে গেলেন। মোহিনী যেতে যাবেন ঠিক তখনই একই জায়গায় হোঁচট খেলেন যেখানে পদ্মাবতী খেয়েছিলেন। অর্ণব মোহিনীর হাত ধরে ফেললেন। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলে মোহিনী।

“বাঃ বাহ। হাতের জোর দেখছি এখনো কমেনি। আগের মতোই রয়েছে।”

মোহিনী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ড্যাবড্যাব করে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

“মানে?”

শমিত এতোক্ষণ শুধু দেখে যাচ্ছিলেন। এবার বললেন,

“তুই আর পদ্মা যখন ছোটবেলায় আমাদের কোলে থাকতি তখন প্রচুর খামচাতিস। এর জন্য তো আমি তোকে কোলেও নিতাম না খুব একটা।”

অর্ণব বললেন,

“আমার গালে খামচি দিয়ে দাগ বসিয়ে দিয়েছিলেন আপনি। জানেন?”

মোহিনী যেন কিছুটা লজ্জা পেলেন। চোখগুলো বড়ো বড়ো হয়ে গেছে তার। শমিত আবার বললেন,

“ভাগ্যিস তোর তখন দাঁত ছিল নারে মোহিনী। নয়তো কি যে হতো।”

“এখন দাঁত আছে। দেখাবো?”

কথাটা বলেই অর্ণবের হাতে কামড় বসিয়ে দিলেন মোহিনী। এবার আর অর্ণব শান্ত থাকতে পারলেন না। আর্তনাদ করে উঠলেন। এক ধাক্কায় মোহিনীকে কিছুটা দূরে সরিয়ে দিলেন। মোহিনী গিয়ে পাশে থাকা দীঘিতে পরবেন এমন সময় অর্ণব নিজেই আবার তার হাত ধরে ফেললেন। মোহিনী যেন আরও শক্ত করে তাকে ধরলেন। অর্ণব বললেন,

“তখন তো হাত ছাড়িয়ে নিলেন। এবার ধরলেন কেন? ছাড়ুন।”

“না। জলে পড়ে যাবো তো নইলে।”

“আমি ছাড়বো?”

“না না।”

“আপনি তো আবার সাঁতার জানেন। কেউ জলে পড়লে আগে আগে তাকে বাঁচাতে যান নিজের সাহসিকতার প্রমাণ দিতে। তো এবার নাহয় নিজেকেই বাঁচান।”

“দয়া করে এমন করবেন না।”

“লভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট।” অর্থ বোঝেন কথাটার? “প্রথম দর্শনে প্রেম।” এটা আপনাকে কেন বলছি জানেন?”

“কেন?”

“আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি মেহেরজান। যেদিন প্রথম দেখেছি আপনাকে, সেদিনই। তখন থেকেই আপনার প্রেমে জ্বলেপুড়ে ছারখার হচ্ছি আমি।”

“হা?”

বলতে বলতে মোহিনীর হাত ছেড়ে দিলেন অর্ণব। মুহুর্তেই দীঘির জলে তলিয়ে গেলেন মোহিনী।

—————————————

ভেজা গায়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়িতে ঢুকতেই তারানার সামনে পড়লেন মোহিনী। তারানা চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

“তুই আজও ভিজে বাড়িতে ফিরেছিস। সেদিন জ্বর বাঁধিয়ে সাধ মেটেনি তোর? জ্বর কমেওনি তেমন। তার আগেই আজ আবারও বাইরে গেলি। ইশশশ! কিভাবে থরথর করে কাঁপছিস।”

তারানা একটা চাদর দিয়ে মোহিনীকে পেঁচিয়ে ধরলেন। কপালে হাত রেখে বললেন,

“জ্বরে গা এখনো পুড়ে যাচ্ছে।”

“তুমি আমার জন্য এতো কেন ব্যস্ত হচ্ছো তারামা? ঠিক আছি আমি।”

“চুপ। একদম কথা বলবি না। কই ঠিক আছিস তুই? এবার শুধু জ্বর বাড়ুক আরও। আমি ধারের কাছেও যাবো না তোর। জ্বরে মরে গেলেও তো ডাক্তারের থেকে ওষুধ এনে খাওয়াবো না তোকে। এতো পয়সা নেই অযথা তোর পেছনে ভাঙার জন্য।”

“সেদিনও একই কথা বলেছিলে। কাল তো সারারাত জেগে ঠিকই জলপট্টি দিলে।”

“প্রতিদিন এভাবে ভিজিস কিভাবে তুই?”

“প্রেমের জলে ভিজিগো তারামা, প্রেমের জলে।”

“মানে?”

মোহিনী কিছু বলবেন তার আগেই দোতলা থেকে রজনীর চিৎকার ভেসে এলো। সকলে দৌঁড়ে সেখানে গেলেন। তারানা বললেন,

“কি হয়েছে? চিৎকার করলি কেন?”

রজনী হাত দিয়ে সামনে ইশারা করলেন। সেদিকে তাকিয়ে সকলেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। উপরে বৈদ্যুতিক পাখার সাথে ঝুলে আছে সৌদামিনীর নিথর দেহ।
.
.
.
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাত খুব একটা হয়নি। তবে গ্রাম হওয়ায় বাইরে তেমন লোকজন নেই। এই অন্ধকারেই খড়ের গাদার পেছনে একসাথে খুবই কাছাকাছি বসে আছেন চিত্রা আর শ্যামল। লোকচক্ষুর নজর এড়াতেই এভাবে দেখা করেছেন। খুবই নিচু স্বরে কথা বলছেন তারা।

“আমাকে এখন যেতে হবে শ্যামল। মা যদি দেখেন আমি বাড়িতে নেই তবে কেলেংকারী হয়ে যাবে।”

“মাত্রই তো এলে। এতো তাড়াতাড়ি যাবে কেন? আর কিছুক্ষণ থাকো।”

“না, আর এক মুহুর্তও দেরি করলে চলবে না। এখনই যেতে হবে।”

“ঠিকাছে। যাও তাহলে। আবার কবে আসবে?”

“সময় হলে জানাবো।”

“শোনো?”

“কী?”

“যাওয়ার আগে একটা চুমু খাবো তোমাকে?”

“একদম না।”

“না করো না তো। একটা চুমুই তো মাত্র।”

“বলেছি না একদম না।”

“কেন?”

“বিয়ের আগে আমি এসব একদম করবো না।”

“আমি কি বিয়ে করবো না বলেছি তোমাকে? আর কি এমন করতে বলেছি তোমাকে? একটা চুমুই তো খেতে চেয়েছি। এমন ভাব করছো যেন একটা চুমুতেই তুমি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যাবে।”

“ধ্যাত।”

শ্যামল জোর করে চিত্রাকে চুমু খেয়ে নিলেন। চিত্রা আঁটকাবার জন্য তাকে ধাক্কা দিতেই শ্যামলের পায়ের সাথে লেগে একটা কলসি গড়িয়ে পরলো। মুহুর্তেই কতোগুলো বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে উঠলো বাইরে। কলসি পড়ার শব্দ পেয়ে রামু কে কে বলে দৌঁড়ে যাচ্ছেন সেদিকে। বাইরে থেকে চৌকিদারও দৌঁড়ে আসছেন দেখতে। শ্যামল বলে উঠলেন,

“ধুর। এখানে কলসি রেখেছে কে?”

“ওরা দেখে ফেলার আগে তুমি তাড়াতাড়ি পালাও এখান থেকে।”

রামু আর চৌকিদার দুজনেই চোর চোর বলে চেচাচ্ছেন। পালানোর রাস্তা না পেয়ে শ্যামল গাছগাছালির মাঝখান দিয়ে দৌঁড় দিতেই গাছের শেকড়ের সাথে তার ধুতি আঁটকে গেল। উপায়ান্তর না পেয়ে নিজের ধুতি ফেলেই দেওয়াল টপকে পালালেন তিনি। বাইরে শোরগোল শুনে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন অর্ণব। বারান্দায় আসতে না আসতেই চিত্রাকে ঘোমটা দিয়ে বাইরে থেকে বাড়িতে ঢুকতে দেখলেন তিনি। রামুর উদ্দেশ্যে কিছুটা চেঁচিয়ে বললেন,

“কি সমস্যা কাকু? রাতেরবেলায় এমন চেঁচামেচি কিসের?”

“বাড়িতে মনে হয় চোর ঢুকছিল অর্ণব বাবা। কিন্তু কাউরেই তো খুঁইজা পাইলাম না। পালাইছে মনে হয়।”

“তোমার হাতে ওটা কি?”

“ধুতি। আমাগোর আসার শব্দ পাইয়া চোরে ধুতি খুইলা পালাইছে।”

কথাটা বলেই উচ্চস্বরে হাসতে লাগলেন রামু।

“ঠিকাছে। আপনি ওটা আমাকে দিয়ে যান।”

রামু একবার ধুতির দিকে তাকালেন, আবার অর্ণবের দিকে তাকালেন। এরপর বললেন,

“আপনে পরবেন এইডা?”

“আমি পরতে যাবো কেন?”

“তাইলে আপনে এইডা দিয়া কি করবেন?”

“চোরের ধুতি চোরকে ফেরত দেব।”

“অ্যা?”

“কি হলো? দিয়ে যান আমাকে।”

“ঠিকাছে। আসতাছি।”

বাইরে ঠিক কি চলছিল তা না জানলেও চিত্রাকে দেখে কিছুটা ধারণা করতে পেরেছেন অর্ণব। একবার এ বিষয়ে চিত্রার সাথে কথা না বললেই নয়।
.
.
.
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই অর্ণবের ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছেন চিত্রা। অর্ণব নিজেই তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।

“আসবো দাদা?”

“হ্যাঁ আয়।”

“কিছু বলবে? লাগবে তোমার কিছু?”

“না। তোকে কিছু দিতে ডেকে পাঠিয়েছি।”

“আমাকে? কি দেবে?”

অর্ণব ধুতিটা বের করে চিত্রার সামনে ধরলেন। ধুতিটা চিনতে ভুল হয়নি চিত্রার। কাল শ্যামল এটাই পরেছিলেন। একটা শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা গলায় বললেন,

“এটা কি?”

“চিনতে পারছিস না?”

“আমি কি করে চিনবো?”

“যাত্রাপালায় নাম দিয়েছিস নাকি? ভালোই তো অভিনয় করতে জানিস।”

“মানে?”

“আমার সামনে নাটক করিস না চিত্রা। তোকে আমি কাল রাতে চুপি চুপি বাড়িতে ঢুকতে দেখেছি।”

“মাকে বলো না দাদা।”

“ছেলেটা কে?”

“ও শেফালীর ভাই। মানে ওর জেঠুর ছেলে। নাম শ্যামল। ও খুব ভালো ছেলে দাদা।”

“কেমন ভালো দেখাই যাচ্ছে। ভালো ছেলেরা রাত-বিরেতে প্রেমিকাকে চুপিচুপি দেখা করতে ডাকে না। আর প্রেমিকার সাথে দেখা করতে এসে ধুতি খুলে পালায়, এমন আনাড়ির সাথে তুই প্রেম করলি কিভাবে?”

“তুমি যেমন ভাবছো ও তেমন নয় দাদা। তুমি ওর সাথে দেখা করলেই বুঝতে পারবে।”

“যা বোঝার বুঝেছি। আমাকে আর কিছু বুঝতে হবে না। ছেলেটার থেকে দূরে থাকাই তোর জন্য ভালো হবে। বিষয়টা আমি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেই ভালো। আশা করি তুই চাস না এ ব্যাপারে ছোটমা কিছু জানুক।”

চিত্রা হ্যাঁবোধক মাথা নাড়ালেন।

“যা এবার। আর শোন। ধুতিটা নিয়ে যাস। যার ধুতি তাকে ফিরিয়ে দিয়ে সম্পর্কটা শেষ করে আসিস।”

চিত্রা ধুতি হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। নিজের ঘরে এসে রাগে ফুঁসতে লাগলেন তিনি।

“হাহ, আমাকে কিনা বলে সম্পর্ক শেষ করতে। কি ভুল করেছি আমি? নিজে যে দু’দুটো মেয়েকে নিজের পেছনে ঘোরাচ্ছে সেটা যেন কারও চোখে পড়ে না ভেবেছে। আর আমি একজনের সাথে থাকতে চাইলেই দোষ। আমিও দেখে নেবো কি করতে পারো তুমি।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে