#মেহেরজান
#পর্ব-৪
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
শেষরাতে আবারও একদফা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তাঘাটে জল জমে আছে। সূর্যের আলো ফুঁটতে শুরু করেছে। এখনো আবছা অন্ধকার। আম্রপালি সবেমাত্র স্নান সেরে ছাদে উঠেছে। ছাদটা এখনো ভেজা। হালকা হালকা জল জমে থাকা ভেজা ছাদে খালি পায়ে হাঁটতে ভালোই লাগছে তার। প্রতিদিন ঠিক আলো ফোঁটার আগে ছাদে আসা একপ্রকার অভ্যেস আম্রপালির। তার মতে প্রকৃতির কাছে আসার জন্য এই সময়টা সবচেয়ে ভালো। পাখির কলকলানি ছাড়া কোনো বাড়তি শব্দ নেই যা শব্দদূষণ ঘটাতে পারে। শান্ত প্রকৃতির সাথে নিজের মধ্যে নিজের হারিয়ে যাওয়ার জন্য এই সময়টাই সেরা। আম্রপালি ধীরে ধীরে ছাদের কিনারায় এসে দাঁড়ালেন। অহনার রশ্মি এসে তার গায়ে লেগে খেলা করতে লাগলো। তার চোখ পরলো নিচে কিছুটা দূরে আবছা আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তির উপর। পরনে ধূসররঙের পাঞ্জাবী। সাথে একটা কালো চাদর। উষ্কখুষ্ক চুল, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। বরাবরের মতোই হাতে একটা শ্বেতকাঞ্চন। লোকটা একনজরে আম্রপালির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। এরপর ফুলটা মাটিতে রেখে চলে গেলেন। এতোক্ষণে সূর্য পুরোপুরি উঠে গেছে। আম্রপালি দ্রুতপদে ছাদ থেকে নেমে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসলেন। ফুলটা তুলে নিলেন। পুরনো দিনের স্মৃতিগুলো দোলা দিয়ে উঠলো তার মনে।
রাস্তার পাশেই একটা বিশাল বটগাছে। তার ছায়ায়ই বসে আছে আম্রপালি। একটা ছেলে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আসছে তার দিকে। এসেই বললো,
“দেখ তোর জন্য কি এনেছি।”
নিজের পোশাকে করে আনা সবগুলো ফুল ঢেলে দিলো আম্রপালির সামনে।
“এতো রকমের ফুল! কই পেলি?”
“পেয়েছি।”
“চুরি করেছিস?”
“ওই আরকি।”
“চুরি করেও কোনো লাভ হলো না। আমার পছন্দের ফুলই তো নেই এখানে।”
“তোর পছন্দের ফুল কি?”
“শ্বেতকাঞ্চন।”
“শ্বেতকাঞ্চন! এটা তোর সবচেয়ে পছন্দের ফুল? সবার তো গোলাপ, বেলি এসব ফুল পছন্দ হয়। আর তোর কিনা শেষে শ্বেতকাঞ্চন পছন্দ। হাহাহা।”
“তুই যা ইচ্ছে তাই বল। আমার ওটাই পছন্দ। তোর যখন এতই সমস্যা তাহলে কথা বলিস না আমার সাথে হুহ। গেলাম আমি।”
“এই আম্র, দাঁড়া। কই যাচ্ছিস। আমি তো এমনিই বলছি। দাঁড়া।”
ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলেন আম্রপালি। নিজের ঘরে এসে টেবিলের উপর ফুলটা রেখে দিলেন। বিছানায় চোখ যেতেই মনটা ভালো হয়ে গেলো একদম। দুটো ছোট্ট পরী ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। আম্রপালি দুজনের কপালে চুমু খেয়ে চারদিকে ভালো করে বালিশ দিয়ে দিলেন। নিজের খোলা চুল হাত খোপা করে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন।
.
.
নিজের শ্বাশুড়ির জন্য আলাদাভাবে রান্না করেন আম্রপালি। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে শান্তি দেবী খুবই বাছ বিচারী মানুষ। নিজের খাবারের আশেপাশেও আমিষের ছোঁয়া লাগতে দেন না। তার খাবার রাঁধার জন্য আলাদা হাড়ি-পাতিলের ব্যবস্থা নিজেই করেছেন। আর রান্নার দায়িত্ব দিয়েছেন আম্রপালিকে। আম্রপালি এখন তা-ই পালন করতে ব্যস্ত। পাশে রুমকি আঁশবটি নিয়ে বসেছেন সবজি কাঁটতে। আম্রপালি তার উদ্দেশ্যে বললেন,
“তাড়াতাড়ি হাত চালা রুমকি। আরও কতো কাজ বাকি রয়েছে। জলদি সবজিগুলো কাঁট। তরকারি করতে হবে।”
“কাঁটছি তো। এর চেয়ে বেশি যে আর হাত চলে না।”
“তরু কইরে?”
“ও ঘর ঝাড় দিচ্ছে।”
“আর রানী?”
“ওর জ্বর হয়েছে। ঘরে শুয়ে আছে। আর রামু কই গেছে তা জানি না।”
“ওকে আমি বাজারে পাঠিয়েছি দুধ আনতে। রানী ওষুধ খেয়েছে?”
“বলেছিল তো খেয়েছে।”
“বাড়িতে এতোগুলো লোক অথচ কাজ শেষ হয় না।”
“মাছও কি কাঁটতে হবে?”
“তা নয়তো কি আস্ত খাবো?”
রুমকি সবজি কাঁটা শেষ করে মাছের আঁশ ছাড়াতে শুরু করলেন। বেশ ঝটপট মাছগুলোকে কেঁটে ধুঁয়ে পরিষ্কার করে রাখলেন। শকুন্তলা রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
“তুই বাচ্চাদের কাছে যা রুমকি। এদিকে বাকিটা আমি আর দিদি সামলে নেবো।”
“ঠিকাছে। ভাত বসিয়েছি। হয়ে গেলে নামিয়ে নিও।”
রুমকি চলে গেলে শকুন্তলা ভাতের হাড়ি নামিয়ে নিলেন। এক চুলায় গরম পানি আর অন্য চুলায় তরকারি বসিয়ে দিলেন। আম্রপালি শ্বাশুড়ির জন্য রান্না করা খাবার নামিয়ে আলাদা করে ঢেকে রেখে দিলেন। মাছে মসলা মাখিয়ে তেলে দিতেই হাঁচি চলে এলো।
“ময়দাটা মেখে রাখিস শকুন্তলা। লুচি আর পায়েসও করবো। আর তরকারি হয়ে গেলে মাংসটাও রেঁধে ফেলিস।”
“আজ কেউ আসবে দিদি?”
“না তো। কেন?”
“এতোকিছু রাঁধছো যে তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
আম্রপালি মাছ ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন,
“ভালো মন্দ রাঁধার জন্য অতিথি আসতে হবে কেন? এমনিই তো করা যায়। আজ ভালো লাগছে তাই করছি।”
“ইশশশ। অর্ণবকে শুধু শুধু পাঠালে। কবে থেকে তোমার হাতের লুচি পায়েস খেতে চাইছিল। আর আজ যখন বানাবে তখন ও-ই নেই।”
“জানতে পারলে বলবে, -আমি না থাকলেই আপনারা সব মজার মজার রান্না করেন। কই, আমি থাকলে তো করেন না।”
কথাটা বলেই দু’জনে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। কিছুক্ষণ নিরব থেকে শকুন্তলা বলে উঠলেন,
“ওই লোকটা কে গো দিদি?”
“কোন লোকটা?”
“ওইযে সেই লোকটা যে কয়েকমাস পর পরই আসে বাড়ির সামনে। হাতে একটা শ্বেতকাঞ্চন নিয়ে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফুলটা রেখে আবার চলে যায়। তোমার জন্যই তো আসে। তাই না?”
আম্রপালির বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো। শকুন্তলার দিকে না তাকিয়েই বললেন,
“জানি না তুই কার কথা বলছিস?”
“মিথ্যা বলবে না। আমি জানি সে তোমাকে দেখতে আসে। আর তোমাকে দেখেছিও ফুলটা তুলে আনতে। আমি জানি সে কে?”
“কে?”
“খোঁজ নিয়েছি। ওর নাম রুদ্র। তোমার ছোটবেলার বন্ধু।”
“জানিসই যখন তাহলে আবার জিজ্ঞেস করলি কেন? আমাকে আর কোনদিন এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করবি না।”
“চাইলেই তো নিজের জীবনটা আবার নতুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে পারো দিদি।”
“মাথা ঠিক আছে তোর? কি বলছিস ভেবে বলছিস তো? সতেরো বছর বয়সে এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছিলাম। বছর পেরতে না পেরতেই মা হয়ে গেছি। দোতলার ঘরে যে লোকটাকে শুয়ে থাকতে দেখছিস না? দশ হয়ে গেছে তার সাথে আছি। তার ভালো সময়ে থাকবো আর খারাপ সময়ে ছেড়ে যাবো তা তো হয় না। আর কখনো এইসব উল্টোপাল্টা কথা বলবি না।”
“কিন্তু তাকে তো তুমি ভালোবাসো না।”
“চুপ কর শকুন্তলা। আর একটা কথাও শুনতে চাই না এ ব্যাপারে।”
রামু এসে ডাকাডাকি শুরু করলে আম্রপালি চুলার আঁচ কমিয়ে রান্নাঘর থেকে বাইরে এলেন। শকুন্তলাও তার পেছন পেছন আসলেন। দুধের কলসি রেখে মাথার উপর থেকে বাজারের ডালা নামাতে নামাতে বললেন,
“সবকিছু ঠিকমতো নিয়া আইছি। মিলাইয়া দেইখা নেন।”
“কিরে? তোকে তো আমি পাঠালাম শুধু দুধ আনতে। তুই এতো বাজার করে এনেছিস কেন?”
“খালি দুধ আনতে কইছিলেন?”
“তা নয় তো কি?”
“বাজার এগুলা দরকার নাই?”
“না।”
রামু মাথা চুলকাতে-চুলকাতে বললেন আবার বললেন,
“একটু দেইখা কন। যদি লাগে?”
আম্রপালি দুধের কলসি তুলে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,
“লাগবে না।”
“আরেকটা জিনিস আনছি।”
“আবার কি এনেছিস?”
“এইডা আপনের জন্যে না। এইডা ছোট মালকিনের জন্যে আইছে।”
“আমার জন্য? কি এসেছে?”
রামু পকেট থেকে কিছু একটা বের করে শকুন্তলার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“চিঠি।”
“চিঠি! কে পাঠিয়েছে?”
“তা তো জানি না। আপনে খুইলা দেখেন না।”
শকুন্তলা চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলেন। পড়া শেষ করে বড় করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন।
“কার চিঠি শকুন্তলা?”
“তোমার দেবরের।”
“কি লিখেছে?”
“এখন আসতে পারবেন না বললেন। কিসের কাজে যেন আঁটকে গেছেন।”
“তুই মন খারাপ করিস না। হয়তো জরুরি কোনো কাজে আঁটকে গেছে।”
“কি এমন কাজ বলো তো দিদি। মেয়েটা হওয়ার পরেও এখনো একবার দেখতে আসার সুযোগ পেল না?”
“বললাম তো মন খারাপ করিস না। আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি। তুই গিয়ে মায়ের ঘরে দিয়ে আয়।”
.
.
.
জানালার ধারে টেবিলে বইপত্র নিয়ে একসাথে পড়তে বসেছে অর্ণব আর শমিত। বাইরে গাছের ডালে বসে কাঁকভেজা দুটো শালিক এখন রৌদ্রস্নানে মত্ত। অর্ণব কলম কামড়াতে কামড়াতে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সেদিকে। কিছুক্ষণ আগেই এখানে বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখন আবার রোদে চারদিক ঝলমল করছে।
“কিরে? অংক কষা বাদ দিয়ে তুই ওদিকে তাকিয়ে কলম কামড়াচ্ছিস কেন?”
এমন সময় পেটে ক্ষুধা অনভব করলো অর্ণব। শমিতের প্রশ্নের উত্তরে বললো,
“ধুর। খিদে পেয়েছে তো। খালি পেটে এতো পড়া যায় নাকি। সেই সক্কালে পিসি কিসের যেন একটা তেঁতো কি খেতে দিল।”
“নিমপাতার রস ছিল ওটা। আমি রোজ সকালে খাই। পেট ভালো থাকে।”
“তোর তো অভ্যেস আছে। আমার তো আর নেই। এখানে ঘুরতে আসতে খুব ভালো লাগে কিন্তু পিসির এসব নিয়ম একটুও ভাল্লাগে না। আগে তো কয়েকদিন থাকতাম তাই মানা যেত। এবার তো পুরো একমাস।”
“মা তো বললো দু’সপ্তাহ।”
“তুই ঠিক শুনেছিস পিসি বলেছে এমন?”
“হ্যাঁ।”
“কখন বলেছে?”
“আজ সকালে।”
“সত্যি বলছিস তো? পিসি সত্যিই তাই বলেছে?”
“ধুর। আমি মিথ্যে বলবো কেন তোকে? বিশ্বাস করলে কর না করলে না কর। এখন চুপচাপ পড়।”
“খিদে পেয়েছ আমার। আমি পড়তে পারবো না। দু’ঘন্টা হয়ে গেল পড়তে বসেছি। এখন তো ছুটি। ছুটিতে এতো কিসের পড়ারে?”
“কিছু করার নেই। এখন আটটা বাজে। মা ন’টায় খেতে দেবে।”
“তুই কিছু একটা কর।”
শমিত দু’বার এদিক ওদিক তাকালো। তারপর বললো,
“দাঁড়া দেখছি।”
“কি দেখবি?”
শমিত হাত দিয়ে জানালার বাইরে ইশারা করে দূরে একটা আমগাছ দেখিয়ে বললো,
“কাঁচা আম খাবি? নুন তেল দিয়ে মাখিয়ে খেতে দারুণ লাগবে। আমার তো এখনই জিভে জল চলে এসেছে।”
“খালি পেটে টক খাবো?”
“তুই না বললি তোর খিদে পেয়েছে।”
“হ্যাঁ, বলেছি তো।”
“চল তাহলে। রবিদের গাছে এবার প্রচুর আম এসেছে। আমরা কয়টা নিলে কিছুই বলবে না।”
“পিসি যদি বকে?”
“মা মনে হয় এখন ঠাকুরঘরে। আরতি করছে। উঠতে উঠতে আমরা বেরিয়ে যাবো।”
“আচ্ছা চল তাহলে।”
সব বইপত্র ওভাবেই ফেলে দু’জনে পা টিপেটিপে সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো। কোনো রকম শব্দ না করেই দরজা সামান্য খুলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
এক দৌঁড়ে বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে অর্ণব আর শমিত। আমগাছ তলায় এসে দুজনেই হাঁপাতে লাগলো। শমিত বললো,
“নে। এবার গাছে ওঠ।”
“আমি কেন উঠবো? তুই ওঠ।”
“তুই ওঠ।”
“উহু। তুই আম খাওয়ার কথা বলেছিস। তাই তুই উঠবি।”
“ঠিক আছে। আমিই উঠছি।”
শমিত গাছে উঠতে গিয়ে বললো,
“এইরে, গাছ তো ভেজা। যদি পিছলে পরে যাই।”
“পরবি না। আস্তে আস্তে ওঠ। আর আমি এখানেই আছি।”
“ঠিকাছে। এখানেই থাকিস কিন্তু।”
শমিত ধীরে ধীরে গাছে উঠে গেল। অর্ণব পাশেই কিছুটা সামনে একটা কুয়ো দেখতে পেল। এক মেয়ে কুয়ো থেকে জল তুলছে। গায়ে কমলা রঙের শাড়ী, মাথায় ঘোমটা দেওয়া, হাতে শাখা-পলা, সিঁথিতে লম্বা করে সিঁদুর দেওয়া আর গায়ে সামান্য গয়না। দেখেই বোঝা যাচ্ছে নববধূ। মেয়েটা দূর থেকে তাকে ইশারায় ডাকলেন। অর্ণব সেদিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে শমিত বলে উঠলো,
“কিরে? কোথায় যাচ্ছিস আমাকে একা রেখে?”
“তুই থাক এখানে। আমি এক্ষুনি চলে আসবো।”
কথা না বাড়িয়ে অর্ণব দৌঁড়ে মেয়েটার সামনে এসে দাঁড়ালো। মেয়েটা তার দিকে একটা জল ভর্তি কলসি এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“ধরো।”
অর্ণব তার থেকে কলসিটা নিয়ে নিল। মেয়েটা নিজে আরেকটা কলসি তুলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলেন,
“নাম কি তোমার?”
“তুমি আমাকে চেনো না?”
“ওমা। আমি তোমাকে কি করে চিনবো?”
“আমাকে তো এখানে সবাই চেনে। আমি প্রতিবছরই এখানে আসি। তোমাকে তো আগে দেখিনি। তুমি এখানে নতুন এসেছো?”
“ঠিকই ধরেছো। আমি এখানে নতুনই এসেছি। বিয়ে করে। তোমার নাম বললে না যে?”
“অর্ণব চৌধুরী।”
“কার বাড়িতে এসেছো?”
“আমার পিসির বাড়ি।”
“তোমার পিসির নাম কি?”
“অনুরাধা। তোমার নাম কি?”
“রাশমণি।”
অর্ণব তার সাথে তার বাড়িতে চলে এলো। উঠোনে বসে এক বিধবা মহিলা চাল থেকে পাথর বাছছেন। গায়ে সাদা থান জড়ানো। মাথায় ছোট ছোট আধাপাকা চুল। অর্ণবকে দেখেই মাথায় ঘোমটা তুলে আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে নিলেন। অর্ণব বুঝলো না তিনি এমন কেন করলেন। কিন্তু তাকে দেখে তার নিজের দিদিমার কথা মনে পরলো। রাশমণি কলসি দুটো রান্নাঘরে রেখে বললেন,
“তুমি আমগাছ তলায় কি করছিলে?”
“খিদে পেয়েছিল। তাই শমিত আম পারতে গাছে উঠেছিল। আর আমি নিচে ওর জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
“তুমি তোমার বন্ধুকে ওখানে একা ফেলে চলে এলে?”
“তুমি ডাকলে যে।”
“মোয়া খাবে?”
“হ্যাঁ।”
রাশমণি অর্ণবের হাতে মোয়া দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার বাড়ি কই?”
“কুঞ্জনগর।”
“ওহহহ। দু’গ্রাম পরেই তো।”
“হ্যাঁ।”
“কে কে আছে বাড়িতে?”
“মা, বাবা, দাদিমা, ছোটমা, কাকু, ছোটবোন,পদ্মা আরও অনেকজন।”
“তোমার পরিবার তো তাহলে অনেক বড়। পদ্মা কে?”
“ওইযে মা সেদিন যে মেয়েটাকে বাড়িতে নিয়ে এলো ওই পদ্মা। ওর জন্যই তো এবার শাস্তি পেয়ে এখানে এসেছি। এমনিতে তো আমি প্রতিবছরই পিসির বাড়ি ঘুরতে আসি। কিন্তু এবার এসেছি শাস্তি পেয়ে।”
“শাস্তি পেয়ে! কেন?”
“পদ্মার জন্য ফুল চুরি করতে গিয়ে ধরা পরেছিলাম। তাই মা শাস্তি দিয়েছেন।”
“হাহাহা। আহারে। পদ্মা কি হয় তোমার?”
অর্ণব কিছু বলার আগেই সেখানে শমিত চলে এলো।
“কিরে অর্ণব? তুই এখানে কি করছিস? তাড়াতাড়ি বাড়ি চল। আর একটু দেরি করলে মা না খাইয়ে রাখবে।”
অর্ণব শমিতকে আপাদমস্তক দেখে বললো,
“তোর এই অবস্থা কেন শমিত? জামায় কাদা লাগালি কি করে?”
“গাছ থেকে নামতে গিয়ে পিছলে কাদায় পড়ে গিয়েছি।”
“আম এনেছিস?”
“না। বাড়ি চল এবার।”
অর্ণব ঘুরে রাশমণির দিকে তাঁকালো। তিনি বললেন,
“তোমার বন্ধু?”
“হ্যাঁ। ভাইও। আমি তাহলে আসি।”
“ঠিক আছে। আবার এসো কিন্তু তোমার এই দিদির বাড়িতে।”
“আসবো।”
অর্ণব আর শমিত দুজনে ছুটে চলে গেল।
.
.
বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই অনুরাধার সামনে পরলো তারা। বেশ রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন তিনি। ভয়ে দুজনেই সেখানে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিললো। অনুরাধা জিজ্ঞেস করলেন,
“কই গিয়েছিলি তোরা?”
শমিত বললো,
“এখানেই ছিলাম মা। বাইরে একটু খেলছিলাম।”
“তোর জামায় কাদা লাগলো কি করে?”
“পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম।”
“জামা বদলে হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয় দুজনে। আমি খাবার বাড়ছি।”
কথাটা বলেই অনুরাধা চলে গেলেন। তার এমন ব্যবহারে দুজনেই বেশ অবাক হলো। শমিত বললো,
“বাবা এসেছে মনে হয়।”
“কি করে বুঝলি?”
“বাবা থাকলে মা বেশি বকাবকি করে না।”
কথা শেষ করে দুজনেই হেসে উঠলো।
চলবে…