#মেহেরজান
#পর্ব-১
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন নারী বেশভূষায় থাকা এক তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি। মুখে প্রসাধনীর মোটা আস্তরণ একদম লেপ্টে আছে। মুখ বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছেন। হাত দিয়ে মেয়েটার দুই গাল চেপে ধরে বললেন,
“খুব রঙ লেগেছে না মনে? রাত করে বৃষ্টিতে ভেজা হচ্ছে? বৃষ্টিতে যে ভিজলি এখন জ্বর আসলে নাচবি কি করে? তোর মা এসে নেচে যাবে?”
“ভুল হয়ে গেছে আম্মা। ক্ষমা করে দাও।”
“হুহ। ক্ষমা করে দাও! তোর মায়ের মনেও এমন রঙ লেগেছিল। তাই তো তুই এখন এখানে। তোর মা ভুল না করলে তোকে এখানে থাকতে হতো না।”
“বার বার মাকে কেন টানছো তুমি?”
তারানা মেয়েটির গালে আবারও স্বজোরে চড় মেরে বললেন,
“মায়ের জন্য দরদ উথলে উঠছে একদম তাই না? তোর কোন মা এসে পেলে তোকে এতো বড় করেছে? একদিনের বাচ্চা ছিলি যখন তোকে এখানে ফেলে গিয়েছিল তোর মা।”
মেয়েটি আর কিছু বলার সাহস পেলো না। তারানা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,
“এই কে কোথায় আছিস? এটাকে নিয়ে যা তো এখান থেকে। আর ছাদের দরজায় এখনই তালা দে। কোনো মেয়ে যেন ছাদে যেতে না পারে।”
তারানা পুরো বাড়ি দৌঁড়াদৌঁড়ি করে সবাইকে দরজা জানালা বন্ধ করার তাগাদা দিয়েই চলেছেন। এদিকে হঠাৎই বিদ্যুৎ চলে গেল। এমন সময় এক ব্যক্তি হাতে হ্যারিকেন নিয়ে ছুটে আসলেন। আর জোরে জোরে তারানাকে ডাকতে লাগলেন।
“আম্মাজি। জলদি আইএ।”
“কি হয়েছে চরণ? এতো চেঁচাচ্ছিস কেন? কানের পোকা তো বের করে ফেললি।”
“বাহার তুফান ম্যে পেড়কে নিচে এক অওরাত পরি হ্যে। পাকিস্তানসে হ্যে শায়াদ। লগতা হ্যে বচ্চা হোনেওয়ালি হ্যে।”
“বলিস কি! চলতো তাড়াতাড়ি।”
তারানা সাথে দুটো মেয়েকে নিয়ে ছুটে বাহিরে আসলেন। দেখলেন সত্যিই গাছের নিচে শুয়ে এক মহিলা ব্যথায় কাতরাচ্ছে।
“তোরা তাড়াতাড়ি ধর একে আমার সাথে। বাড়ির ভেতরে নিয়ে চল। আর চরণ, তুই গিয়ে দাইকে ডেকে নিয়ে আয়।”
.
.
.
বাইরে একটু পর পর বজ্রপাতের বিকট শব্দ হচ্ছে। হাসপাতালের বেঞ্চে বসে আছেন দুজন নারী। একজনের কোলে দুমাসের বাচ্চা। বজ্রপাতের শব্দের বাচ্চাটা বারবার কেঁদে ওঠায় সে তাকে সামলাতে ব্যস্ত। অপর দিকে আরেকজন চিন্তিত হয়ে বসে আছেন। বাচ্চাটাকে বারবার কেঁদে উঠতে দেখে বললেন,
“তুই বাড়ি যা শকুন্তলা। ও ভয় পাচ্ছে। আর আমার সাথে তো এখানে রামু আছেই।”
“না দিদি। তোমাকে একা রেখে আমি এখান থেকে এক পাও নড়ছি না।”
বৃষ্টিতে কাঁকভেজা হয়ে একটা লোক দ্রুত পা চালিয়ে আসছে তাদের দিকে। হাতে দু কাপ চা। দু’জনের দিকে দুটো কাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“এই নেন চা। দুইজনে খাইয়া নেন আগে।”
“তুই এই বৃষ্টিতে ভিজে চা আনতে গিয়েছিলি?”
“হ।”
“এই ঝড়ের মধ্যে দোকান খোলা ছিল?”
“ছিল তো একটা। হাসপাতালের বাইরেই তো। দূরে না বেশি। ওইখান থিকাই নিয়া আইছি।”
“রেখে দে নাহয় তুই খেয়ে নে। আমি খাবো না।”
তার কথার জবাবে রামু আর কিছু বললো না। কারণ সে জানে তিনি যখন একবার খাবেন না বলেছেন তো কখনোই খাবেন না। হঠাৎ এক শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো। নার্স এসে বাচ্চাটিকে মহিলাটির কোলে দিতে দিতে বললেন,
“মেয়ে হয়েছে আম্রপালি। দেখো কি মিষ্টি দেখতে।”
“একদম মায়ের মতো হয়েছে। পারমিতা কেমন আছে?”
“ওকে বাঁচানো যায়নি। তুমি ডাক্তারের সাথে বলো।”
আম্রপালির চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। বললেন,
“তার দরকার নেই। শকুন্তলা, তাড়াতাড়ি বাড়ি চল এখন। মৃতদেহটা সৎকারের ব্যবস্থাও করতে হবে।”
কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দুজনেই সেখান থেকে চলে গেলেন। বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই বাড়ির কয়েকজন কাজেরলোক ছুটে আসলো। আর নয় বছর বয়সী বাচ্চা একটা ছেলে দৌঁড়ে এসে আম্রপালিকে আঁকড়ে ধরলো। তার কোলে আরেকটা বাচ্চা দেখে ভ্রুকুঞ্চিত করে বললো,
“চিত্রা তো ছোট মায়ের কোলেই মা। আপনার কোলে এটা কে?”
তার কথা শুনে শকুন্তলা উচ্চস্বরে হেসে উঠে বললেন,
“তোমার মা তোমার জিনিসে ভাগ বসানোর জন্য আরেকটা বোন নিয়ে এসেছে অর্ণব।”
শকুন্তলার কথা শুনে অর্ণব তীব্র আক্রোশ নিয়ে আম্রপালির দিকে তাঁকালো।
“কেন? চিত্রা কি কম পরে গিয়েছিল নাকি? আমার আর কোনো বোন চাইনা। আপনি তাড়াতাড়ি এটাকে বিদায় করুন। আমার বাড়িতে আমি ওকে থাকতে দেবো না।”
অর্ণবের কথায় আম্রপালি সামান্য হাসলেন। নিচু হয়ে বসে বললেন,
“ওকে যদি আমরা তাড়িয়ে দিই তাহলে ও থাকবে কার কাছে? ওর তো বাবা-মা নেই।”
“ওর বাবা-মা নেই?”
“উহু।”
“ঠিকাছে। তাহলে ওকে আমি আমার বাড়িতে থাকতে দেবো। কিন্তু একটুখানি।”
“হাহাহা। আচ্ছা। তুমি যা বলেছো তাই হবে। ও একটুখানিই থাকবে। কিন্তু এতো রাত হয়ে গেছে আর তুমি এখনো ঘুমাওনি কেন?”
“ঘুম আসেনি তাই। আপনি ঘুম পাড়িয়ে দিবেন। ওর নাম কি মা?”
পাশে থেকে শকুন্তলা বলে উঠলেন,
“সত্যিই তো দিদি। ওর নাম কি রাখবে? কিছু ঠিক করেছো?”
“হুম। পারমিতা বলেছিল আমাকে একবার। ওর মেয়ে হলে নাকি নাম রাখবে পদ্মাবতী। তাই ওর নাম হবে পদ্মাবতী।”
“বাহ। খুব সুন্দর নাম। অর্থ কি গো?”
“পদ্মে আরোহন করে যিনি অর্থাৎ দেবী লক্ষী।”
চলবে…