#মেয়েটি_যেন_ভিন্নরকম
(দশম পর্ব)
“তুমি না হয় সূর্য হলে
আমি অহর্নিশ তোমাকে ঘিরে
প্রদক্ষিণ করলাম।”
অদিতির মনে আজ কাল এমন কিছু কথা ঘুরপাক খায়। অচেনা আবেগে উদ্বলিত হয়। সেদিনেই সেই এক্সিডেন্ট, অচেনা ছেলের সান্নিধ্যে আসা আর এখন এই অচেনা আবেগ – সবকিছুই অন্য রকম লাগে অদিতির। এর মধ্যে গায়ে আজ কয়েকদিন ধরে জ্বর। জ্বরের ঘোরে আরো যেন কল্পনা বাস্তব মিলিয়ে ফেলে। মাঝে মধ্যে মনে হয় সেই ছেলেটি এসেছে, ওর কপালে যেন হাত রেখে বলছে- ‘চিন্তা নেই, একদম ঠিক হয়ে যাবেন।’
আবার পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে, এই সবই স্বপ্ন ছিলো। আসলেই কি স্বপ্ন ছিলো?
আমান হলো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো লোক। জি ঠিকই ভাবছেন এই আমানই সেদিন অদিতিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। এরপর অদিতির বাবা মা আসা পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি যা করার আমানই করেছে। এমনকি পরেও যথেষ্ট ঝামেলা নিয়েছে কারণ অদিতির বাবা মা বয়স্ক হওয়াতে আমান তাঁদের কিছুই করতে দেয় নি। অদিতির ভাই শোভন ব্যবসার কাছে শহরের বাইরে ছিলেন। অন্যের বিপদে অনেকেই ছুটে আসে, বড় জোর হাসপাতালে ভর্তি করা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু এই ছেলেটা অনেক বেশি আন্তরিক, ভীষণ আপন আপন।
হাতের ফ্রাকচারের চেয়েও জ্বরটা বেশি ভোগালো অদিতিকে। আজ দুপুরের পর থেকে জ্বর নেই। মুখটা কেমন তেতো তেতো। বাসায়ই আছে, একদিনই হাসপাতালে ছিলো। বড় রকমের কোন সমস্যা না থাকায় পরেরদিনই ছাড়পত্র পেয়ে যায়। লুৎফা বেগম বেশি করে মরিচ দিয়ে ঝাল মুড়ি নিয়ে আসেন। মেয়েটা কিছু খেতে পারছে না, একটু যদি মুখে দিতে পারে।
– এই তো এখন জ্বর নেই। জ্বরের ঘোরে কি সব বকছিলি। সাগরের ঢেউ দেখবো, হাত ধরো হাবিজাবি। তুই বুঝতে পেরেছিস কিনা জানি না, আমান ছেলেটা এসেছিলো। তোর ধুম জ্বর, রুমে এসে তোকে দেখে চলে গেছে।
অদিতির সারা শরীর আবার শির শির করে উঠে, আবার জ্বর আসবে নাকি! আমান তাহলে ঠিকই এসেছিলো, ও জ্বরের ঘোরে ভুল দেখে নি। কিন্তু কপালে হাত দেয়ার বিষয়টা হয়তো মনের কল্পনা মাত্র৷
আমান, বাবা মা হারা অনেকটা ছন্নছাড়া যুবক। ছন্নছাড়া বলতে বিপদগামী, চালচুলোহীন নয়। ওর চাচা আশরাফ খান বেশ ধনী একজন ব্যবসায়ী, তিন কন্যার পিতা, আমানের অভিভাবক। আমানকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসেন বরং আরো বেশিই বলা যায়। আমানের কোন দোষ ত্রুটি যেন উনার চোখেই পড়ে না। অপত্য স্নেহ আমানের জন্য। কিন্তু আমান যেন বন্য ঘোড়া, নিজের ইচ্ছা মতো ঘুরে বেড়ায়, মানুষের উপকার করার নেশায় ছুটতে থাকে।
এমন না যে আমান চাচার টাকায় ঘোরে, বরং বেশ ভালো একটা চাকরি করে। ইমপ্লোয়ী হিসেবেও দক্ষ কিন্তু দোষ একটাই হুটহাট গায়েব হয়ে যায়। এই যেমন সেদিন মার্কেটের পাশে এক বৃদ্ধ হাউমাউ করে কাঁদছে। ছেলের কাছে এসেছিলো, রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। ঠিকানা ঠিকঠাক বলতে পারে না। ছেলের ফোন নাম্বার একটা আছে কিন্তু সেই নাম্বারে কেউ কল রিসিভই করে না। আমান সাথে করে রেলস্টেশনে আসে, টিকিট কেটে গ্রামে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু ঠিক ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে আমানের মনে হয়, বয়স্ক মানুষ আবার যদি হারিয়ে যায়! ছেলে তো মনে হয় ইচ্ছা করেই দায়িত্ব এড়ানোর জন্য ফোন ধরছে না। ব্যস আরেকটা টিকিট কেটে চলে যায় বৃদ্ধের সাথে সেই সুদূর রংপুর।
এই হলো আমান। যা মনে হয় তাই করাই ওর স্বভাব। বোর্ডিং আর হোস্টেলে কেটেছে অনেকটা সময়। এরপর ওর চাচা খুব চেয়েছিলো নিজের কাছে রাখতে কিন্তু সে রাজী হয় নি। একটা কথাই বলেছিলো- চাচী আমাকে ভালোবাসেন, আমি চাই এই ভালোবাসা অটুট থাকুক। তবে এটা ঠিক আশরাফ সাহেবের হস্তক্ষেপ না থাকলে আমানের চাকরি করাই কঠিন হতো, যদিও এটা ওর তৃতীয় চাকরি গত দুই বছরে।
এই কিছুটা ছন্নছাড়া ছেলেটার প্রেমেই মজেছে অদিতি। মেয়েগুলো কেন জানি ঠিক এই ধরণের ছেলের প্রেমেই বেশি মগ্ন হয়। কিছুটা আবেগে কিছুটা মায়ায়৷ অদিতি সুস্থ হয়ে আমানের ফোন নাম্বারটা নেয়। বাবার কাছেই নাম্বারটা ছিলো। দুইদিন ফোন দিয়ে দেখে বন্ধ। সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না জানায়। চিন্তিত হয় অদিতি, ফোন নাম্বার কি তাহলে ঠিক নেই! তবুও পরেরদিন আবার ফোন দেয়, এবার রিং বাজে। অদিতির বুকে ধুকপুক ধুকপুক করতে থাকে।
– হ্যালো, কে বলছেন প্লিজ
– আমি অদিতি
অদিতির মনে হয় – ও ভুল করছে, শুধু নাম বললে কি আর চিনবে! কিন্তু অদিতির ‘ভুল করেছে’ ভাবনাটাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ফোনের ওপার থেকে একটা প্রানোচ্ছ্বল কন্ঠ বলে উঠলো
– আরে অদিতি, আপনার জ্বর কমেছে? হাতের কি অবস্থা? প্লাস্টার কবে খুলবে? আপনি তো মনে হয় খাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আন্টি তো তাই বলছিলো। না খেলে সুস্থ কিভাবে হবেন বলেন তো?
একেবারে তব্দ খেলো অদিতি। এতো কথা সে আশা করে নি। কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য ফোন দিয়েছিলো।
– আমি এখন ভালো আছি। জ্বর নেই। দুই দিন পরেই প্লাস্টার খুলবে। আমি আসলে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য ফোন দিয়েছি। আপনি আমার জন্য যেভাবে দৌড়াদৌড়ি করেছেন তা আপন আত্নীয় ছাড়া কেউ করে না।
– তা আমাকে আপন আত্মীয়ই মনে করুন না, তাহলে আর এই কৃতজ্ঞতা জানানোর মতো এতো ফরম্যাল কাজ করা লাগে না।
– না মানে আমি আসলে সেটা বুঝাতে চাই নি।
– অদিতি, আমি এখন কোথায় জানেন? আমি এখন বান্দবানে। গত দুই দিন ট্রেকিং করেছি। এসব পাহাড়ে বা সমুদ্রে আসলে নিজেকে খুব ছোট্ট মনে হয়। তখন জাগতিক সব দু:খ, কষ্ট সব তুচ্ছ মনে হয়। এই যে আপনি এতোটা ফরমাল হয়ে বলছেন, সামাজিক জীব হিসেবে একদম পারফেক্ট বিষয় কিন্তু এই পাহাড়ি পরিবেশে মনে হচ্ছে এসবও কতো তুচ্ছ।
– এটা তুচ্ছ হতে পারে কিন্তু এভাবে অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া তো তুচ্ছ নয়। কয়জন পারে এমন, বলেন? এমন মানুষকে কদর করাও তো দরকার, সেটাও কিন্তু তুচ্ছ কোন বিষয় নয়। আমরা এই ধরণের মানুষের মূল্যায়ন করি না বলেই আজ সমাজে স্বার্থপর মানুষে ভরে যাচ্ছে।
– অদিতি আপনার কথাগুলো এবং কথা বলার স্টাইল দারুণ। উহু এভাবে ফোনে হবে না। সামনাসামনি চা বা কফির কাপে আপনার সাথে যুক্তি পাল্টা যুক্তির ঝড় তুলতে হবে। দেখা হবে শিঘ্রীই। ততক্ষণে ভালো থাকুন।
অদিতিকে অবাক করে দিয়ে ফোন রাখলো আমান। অদিতি খালি ভাবতে থাকলো- এটা কি হলো!
(চলবে)