মেয়েটি যেন ভিন্নরকম পর্ব-০৯

0
5

#মেয়েটি_যেন_ভিন্নরকম

(নবম পর্ব)

অদিতির মা ওর বিয়ে নিয়ে ভীষণ ব্যতিব্যস্ত। মেয়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে। লোকজন কি বলবে, সমাজ কি বলবে, এরপর আর ভালো সম্বন্ধ হবে না – প্রতিদিন নানা কথায় মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। অদিতির সাথে এই নিয়ে প্রায় প্রতিদিন কথা কাটাকাটি হয়। এদিকে অনার্স পরীক্ষা শেষ, টিউশনি বা অন্য কিছু করছে না। তাবাসসুমকে পড়ানোর পরে আর কাউকেও পড়ায় নি। তানভীরের কথা মাঝে মাঝে মনে হয়, কিন্তু সে বুঝে শুনেই তানভীরকে পাত্তা দেয় নি।

তানভীর ধনীর দুলাল। তাবাসসুমের ভাই হিসেবে অসাধারণ সন্দেহ নেই কিন্তু অদিতি সামান্য হাউজ টিউটর। সে হিসেবে দূরত্ব বজায় রাখাই ঠিক আছে। বয়সের উন্মাদনায় আর ইগোর জন্য অদিতির প্রতি সাময়িক ভালো লাগার জন্ম নিতে পারে কিন্তু এগুলোকে প্রশ্রয় না দেয়ায় ভালো।
যাক সে চ্যাপ্টার শেষ। এখন কিছু না করলে মায়ের কথায় বাসায় টিকে থাকা দায়। এদিকে বাবাই অদিতিকে সব সময় সাপোর্ট দিয়ে আসছেন। কিন্তু তাঁরই চাকরি আছে আর ছয় মাস। এজন্য উনিও মানসিকভাবে একটু ভঙ্গুর অবস্থায় আছেন৷ তার উপরে মায়ের জোরাজুরিতে গ্রামের যেটুকু জমিজমা ছিলো, সব বিক্রি করে ভায়ের ব্যবসার পুঁজি করে দিয়েছেন। এটাতেও বাবা অনেক কষ্ট পেয়েছেন। সব মিলায়ে বাসার অবস্থা থমথমে।

অদিতি বসে না থেকে অনলাইনে কিছু কোর্স করে ফেলে, ফ্রিল্যান্সিং এর উপর। এরসাথে বাবার সাহায্যে ওদের কোয়ার্টারের পাশেই একটা হাইস্কুলে যোগদান করে৷ খুব ভালো স্কুল না, কিন্তু অভিজ্ঞতা তো বাড়বে। তাছাড়া তাবাসসুমকে পড়ানোর সময় বুঝতে পারে, ও আসলে পড়াতে ভালোবাসে। স্টুডেন্টদের মন বুঝতে পারে। মা এখন মাঝে মধ্যেই ‘মাস্টারনি’ বলে খোঁচা দিলেও অদিতি সেটা গায়ে মাখে না। আর ব্যস্ততাও একটা কারণ। ফ্রিল্যান্সিং এর সাথে স্কুলের ক্লাস – বেশ ব্যস্ত একটা জীবন।

অদিতি যে বিয়ে করতে চায় না, বিষয়টা এমন না।কিন্তু এখুনি নয়। আরো ভালো চাকরি পেতে চায়। বাবার পাশে দাঁড়াতে চায়, ঠিক যেভাবে ছেলেরা দাঁড়ায়। এজন্য হয়তো ভালো কোন পাত্র নাও পেতে পারে। কারণ তখন সমাজের চোখে বয়স বেশি মেয়ে হয়ে যাবে। তাতে অদিতির যায় আসে না। ওর একজন ভালো মনের জীবনসঙ্গী প্রয়োজন। তার অর্থ না থাকলেও কিংবা প্রচলিত অর্থে সফল না হলেও অদিতির কোন আপত্তি নেই।

সেদিন স্কুল বন্ধ। অদিতি একটু আরাম করে ঘুমাচ্ছিলো। বিকালের একটু আগেই ওর মা ঠেলে ঠুলে ঘুম ভাঙায়৷

– ওঠ তোর সাবিনা খালা এসেছে। যা মুখ ধুয়ে আয়।

সাবিনা খালা হলো অদিতির মায়ের চাচাতো বোন৷ এই মহিলাকে অদিতি দুই চোখে দেখতে পারে না। অসহ্য একটা মানুষ। নিজের পয়সার গরমে বাঁচে না। কিন্তু এখন ঘুম ভেঙে মায়ের সাথে ক্যাচাল করতে ভালো লাগছে না। উঠে হাত মুখ ধুয়ে বসার ঘরে ঢোকে।

– হ্যাঁ রে ও লুৎফা, মেয়ের বয়স হইছে খেয়াল করোস নাই? হায় হায় চোক্ষের নিচে কালি ফালাইয়ে কি হইছে! আরো আগে ক্যান বিয়া দেস নাই। কথায় কয় যৌবনে কাকও সুন্দর!

অদিতির মাথা দিয়ে আগুন বের হয় যেন। চোখ গোল করে মায়ের দিকে তাকায়। লুৎফা বেগম প্রমাদ গোনে। মেয়ের চরিত্র তো জানে, না জানি কি বলে বসে। সাবিনা আপাও সুবিধার লোক না। গলা শুকিয়ে যায় লুৎফার৷

– খালা তাহেরা আপা এখন কেমন আছে?

লুৎফাকে অবাক করে দিয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা শুরু করে অদিতি।

– আছে কুনু রকম।

বিরস মুখে বলেন সাবিনা। তাহেরা হলো সাবিনার বড় মেয়ে। ক্লাস টেনে থাকতেই বেশ বড়লোক পরিবারে বিয়ে দেয়। কিন্তু জামাই খুব মারধোর করে। একবার তো হাসপাতালেই ভর্তি থাকতে হয়েছিলো।

– ইশ তাহেরা আপার কি কপাল! এতো সুন্দরী একটা মেয়ে, কি তার গায়ের কালার, আর তাকে কিনা দুইবেলা জামাই এর মাইর খেতে হয়!

সাবিনার মুখ যেন একদম চুন হয়ে যায়। আর কথা বের হয় না। আরাম করে যে রসে টইটম্বুর রসগোল্লা খাচ্ছিলেন তা যেন গলায় আঁটকে যায়। বিষম খেয়ে তাড়াতাড়ি পানি মুখে দেন।

– লুৎফা আজ যাই রে। তোর ভাই আবার বাসায় এসে আমাকে খুঁজবে।

সাবিনা দ্রুত চলে যান। আজ বহুদিন পরে মা মেয়ে একসাথে অনেকক্ষণ ধরে হাসতে থাকেন।

এই ঘটনার পরে অদিতির মা লুৎফা অনেকটা নরম হয়ে যান। ভাবেন, মেয়ের কপালে বিয়ে থাকলে হবে, না হলে হবে না। এই নিয়ে আর বাসায় অশান্তি করতে উনারও ভালো লাগে না। অদিতির ভাই শোভন বেশ মন দিয়ে ব্যবসা করছে। ইলেকট্রনিকস এর ডিলারশিপ। এবার এতো গরম পড়েছে যে ফ্যান, এসি, এয়ারকুলারের ভীষণ চাহিদা।
অদিতি মাস্টার্স শেষ করে। এদিকে ফ্রিল্যান্সিং এ বেশ পোক্ত হয়ে উঠেছে। টাকা যা পায় হাতে কিছু রেখে বাবার হাতে তুলে দেয়। আহসান সাহেব নিতে চান না। কিন্তু অদিতি গোঁ ধরে

– বাবা, আমি মেয়ে বলেই কি তুমি আমার টাকা নিতে চাও না?

– না রে মা। এতো কষ্ট করে উপার্জন করিস। নিজের শখ আহ্লাদ পূরণ কর আর বাকি টাকা জমিয়ে রাখ, কাজে লাগবে।

– তুমিও তো কষ্ট করেই উপার্জন করে আমাদের পেছনে খরচ করেছো। আর নিজের কোন শখ আহ্লাদটা পূরণ করেছো শুনি? একটা ভালো পাঞ্জাবী পর্যন্ত তোমার নেই। আমি জানি তোমার বহুদিনের শখ আড়ং থেকে কাজ করা একটা পাঞ্জাবী কেনা। এই টাকা দিয়ে তুমি একটা পাঞ্জাবী কিনবে।

আহসানুল হক মেয়ের সাথে পেরে উঠেন না। সংকোচ লাগলেও মেয়ে যখন যা দেয় নেন। মেয়েটা বড্ড খুশি হয়।

মাস্টার্সের পরেই ভালো একটা হাইস্কুলে চাকরির প্রস্তাব পায় অদিতি। যোগদান করতে দ্বিতীয়বার ভাবে না। সরকারি চাকরি পাওয়া সময় সাপেক্ষ আবার বিভিন্ন জায়গায় ছুটতে হয়। অদিতি বাবা মায়ের কাছেই থাকতে চায়।

সেদিন স্কুল থেকে রিক্সা করে বাসায় ফিরছিলো। স্কুলটা কিছুটা দূরে । এখন তো বাবার চাকরি শেষ, একটা ভাড়া বাসায় থাকে। কোথা থেকে একটা সিএনজি দ্রুত পাশ কাটাতে গেলেই অদিতির রিক্সায় ধাক্কা লাগে। রিক্সা কাত হয়ে পড়ে যায়। অদিতিও পড়ে যায় কিন্তু সৌভাগ্যবশত একদাম রাস্তায় না পড়ে সাইডে পড়ে। হাতে বেশ ব্যথা পায়। আশেপাশের লোকজন দাঁড়িয়ে দেখে কিন্তু কেউ এগিয়ে আসার আগ্রহ দেখায় না। এমন সময় একজন তরুণ দৌড়ে আসে। অন্যদের তাড়া দিয়ে সাথে আনে৷ রিক্সা টেনে তোলে। রিক্সাওয়ালাকে ধরে। তরুণ ছেলেটি অদিতির কাছে এসে ভীষণ আন্তরিক কন্ঠে জানতে চায়- কোথায় লেগেছে। অদিতির মনে হয় ওর বাম হাত ভেঙে গেছে৷ ছেলেটা ওকে ধরে অপর একটা সিএনজি ডেকে মেডিকেলে নিয়ে যায়। অদিতির হাতে ফ্রাকচার হয়েছে!

ডাক্তার দেখানো,এক্স রে, রিপোর্ট, মেডিসিন নিয়ে ছেলেটা দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। অদিতির বাবা মা’কে সংবাদ দেয়া হয়েছে, উনারা আসছেন। কিন্তু অপরিচিত একটা মেয়ের জন্য এই ছেলেটার এতো দৌড়াদৌড়ি দেখে অদিতি মুগ্ধ হয়।

এই প্রথম অদিতি টের পায় হাতের ফ্রাকচারের সাথে মনেও কিছুটা গন্ডগোল হয়েছে!

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে