মেয়েটি যেন ভিন্নরকম পর্ব-৭+৮

0
12

#মেয়েটি_যেন_ভিন্নরকম
(৭ম পর্ব)
বেশিরভাগ মেয়েদের বৃষ্টি ভীষণ পছন্দ। কিন্তু অদিতির একদম পছন্দ নয়। কারণ তার মারাত্মক এলার্জি। বৃষ্টির পানি গায়ে লাগলেই হাঁচি শুরু হয়ে যায়। এরপর আসে জ্বর।

ক্লাস, পড়ার ফাঁকে টিউশনি করে অদিতির সময়গুলো বেশ তির তির করে চলে যাচ্ছে। তাবাসসুম বেশ ভক্ত হয়ে গিয়েছে, খালি মিনিট বিশেক ওর সাথে কে ড্রামা আর হাল ফ্যাশান নিয়ে আলোচনা করতে হয়। অদিতির জন্য এটা কষ্টকর বটে কারণ কাজল, লিপস্টিক আর ফেস পাউডার ছাড়া মেকাপের আর কোন কিছু আছে বলে ওর জানা নেই। এখন গুগল, ইউটিউব আর ফেসবুকের কিছু পেইজের ভরসার দায় সারে অনেকটা। একদিন টিউশনিতে যাওয়ার পথে বৃষ্টিতে পড়লো অদিতি। সকালে এমন রোদ মনেই হয় নি যে বৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু দুপুরের পর থেকেই মেঘের আনাগোনা। ঠিক যখন রিক্সা ছেড়ে তাবাসসুমদের বাসার লনে পা রাখলো, একদম ঝুম বৃষ্টি। অদিতির এমন রাগ হলো। সে আকাশের দিকে মুখ তুলে অনেকটা রাগতস্বরেই বলো উঠলো- ‘এইটা কোন কথা? অসময়ে কেন বৃষ্টি!’ অদিতির মুখভঙ্গি দেখলে যে কারো হাসি লাগবে এবং হাসলোও একজন। যাকে অদিতি দেখতে পায় নি।

তাবাসসুমের ভাই তানভীর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। সাধারণত সে এই সময় বাসায় থাকে না। এজন্য অদিতিকে কখনো দেখে নি। কিন্তু তাবাসসুমের বকবকানির কল্যাণে অদিতির বিষয়ে জানতে বাকি নেই। বোন’টাকে অসম্ভব ভালোবাসে তানভীর। যতো ব্যস্ততায় থাকুক, প্রতিদিন এক ঘন্টা বরাদ্দ বোনের জন্য। তাবাসসুম খুব সরল, এই বয়সের কিশোরী মেয়ের মধ্যে কী জটিলতাই বা থাকবে! কিন্তু কিছুতেই পড়ার টেবিলে বসানো যাচ্ছিলো না। নতুন মিস পড়ানো শুরু করার পর থেকে তাবাসসুমের বেশ উন্নতি হয়েছে। সন্ধ্যায় নিয়মিত পড়তে বসছে। ক্লাস টেস্টে এই প্রথম ভালো করেছে। এজন্য তানভীর ভাবছিলো অদিতির সম্মানী আরো বাড়িয়ে দেয়া উচিৎ। আর তাছাড়া ওদের মা বলেন, অদিতি মোটেও সময় হিসাব করে পড়ায় না। এটাও মেয়েটার আন্তরিকতার লক্ষণ অবশ্যই।

আজ অদিতিকে প্রথম দেখলো তানভীর। খুব সাদামাটা বেশভূষায়। মেয়েটা লিপস্টিক পর্যন্ত দেয় না! এমন মেয়ে কিভাবে ওর বোনকে বশ করলো, ভাবতেই অবাক লাগে তানভীরের। তাবাসসুমের হাল ফ্যাশান আর মেকাপের প্রতি তীব্র আকর্ষণ। অদিতি নামের মেয়েটাকে ওর খুব ইন্টারেস্টিং মনে হলো।

সেদিন পড়াতে পড়াতেই অদিতির হাঁচি শুরু হলো। ইশ! এই ভয়টাই পাচ্ছিলো অদিতি। তাবাসসুম যদিও টিস্যু বক্স এনে দিয়েছে কিন্তু অদিতির মনে হলো ওর গামছা হলেই ভালো হয়! গঙ্গা যমুনা সব যেন ওর নাম দিয়ে বইছে! কিন্তু বিপত্তি হলো আরেকটা, তাবাসসুমের ভাই দেখা করতে চায়। তাবাসসুমের ভাই’কে দেখার ইচ্ছা অদিতিরও ছিলো, এতো গল্প শুনেছে তার। কিন্তু এই অবস্থায় দেখা করার মোটেও ইচ্ছা নেই। এদিকে তাবাসসুম নাছোড়বান্দা। অগত্যা না করার উপায় থাকলো না।

– আপনাকে তো দেখি অসুস্থ দেখাচ্ছে। সালাম বিনিমিয়ের পরে তানভীর প্রথম এই কথা’টাই বললো৷

অদিতি চরম বিব্রত। কোন রকমে বললো

– আমার আসলে বৃষ্টির পানিতে এলার্জি হয়। আজ গায়ে বৃষ্টির পানি লেগেছে।

তানভীর উঠে বাইরে যেয়ে আবার ফিরে আসলো।

– আপনার জন্য আদা মশলা দিয়ে চা দিতে বললাম, একটু আরাম পাবেন। আর এতো বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। মানুষের অসুস্থতা, অসুখ বিসুখ থাকবেই। এটা তো আমাদের জীবনেরই অংশ। আমি আসলে আপনাকে ধন্যবাদ দেয়ার জন্য এসেছি। তাবাসসুমের তো হাউজ টিউটিরই টিকে না। ও তো বেশ দুষ্টু আর একদম পড়তে চাইতো না। কিন্তু আপনি যেন যাদু করেছেন। বোন’টা আমার নিয়মিত পড়তে বসছে। আমরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।

– কি যে বলেন, এতো কৃতজ্ঞতা জানানোর কিছু নেই। ও আসলে মেধাবী মেয়ে। কিন্তু বন্ধুর অভাব, সঙ্গীর অভাব। এই বয়সের মেয়েরা ভাবে- কেউ আমাকে বোঝে না, আমি বড়ো একাকী, বাবা মা আমাকে বুঝতে চায় না। আর সবচেয়ে বড় কথা, কিশোর কিশোরীরা শাসন মানতে চায় না। বিদ্রোহ করে, ওদের খুব সময় নিয়ে বোঝাতে হয়। বন্ধুর মতো মিশতে হয়। আমি জাস্ট এটাই চেষ্টা করেছি।

অদিতির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতায় তানভীর মুগ্ধ হয়। ওর মনে হয় এই মেয়েটা অন্যরকম। খুব গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করে। এতো সাধারণ ভাবে এখনকার মেয়েরা চলে না। আবার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আর কথা বলার ধরণই বলে দেয় প্রবল আত্নসম্মানবোধ সম্পন্ন। ভালো লাগে তানভীরের।

– আপনি তো বাসায় ফিরবেন। আমিও বাইরে যাবো। তাবাসসুম বলছিলো আশেপাশেই আপনাদের বাসা। তার উপরে অসুস্থ, আপনাকে পৌঁছে দিই।

– অনেক ধন্যবাদ। দারোয়ানকে বলে একটা সিএনজি ডেকে দিলেই হবে।

নাক মুছতে মুছতে বলে অদিতি।

মেয়েটা আসকেই অন্য টাইপের। মনে হয় কিছুটা অহংকারীও, কি জানি! মনে মনে এটা ভাবতে ভাবতে বের হয়ে যায় তানভীর। ও আসলে কিছুটা আহত হয়েছে। এভাবে যেচে কাউকে লিফট দিতে চাইলো আর প্রত্যাখাত হলো, ভাবতেই পারে নি। তরুণীদের মধ্যে বেশ কদর আছে তানভীরের। আর অহমেও একটু লাগলো বুঝি।

অদিতির এসবে মাথাব্যথা নেই। কারণ ঠান্ডায় ওর আসলেই মাথাব্যথা করছে। বাসায় ফিরে ওষুধ না খাওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই।

(চলবে)

#মেয়েটি_যেন_ভিন্নরকম
(অষ্টম পর্ব)

ইগো একটা অদ্ভুত জিনিস। কেউ কারো প্রতি আগ্রহ দেখালে বিতৃষ্ণা লাগে আবার এড়িয়ে গেলে আগ্রহ বাড়ে। এই যেমন অদিতির কোন ছেলের প্রতিই কোন আকর্ষণ নেই কিন্তু এই যে তার বিতৃষ্ণা এতে আরেকজনের আগ্রহ বেড়েছে – তানভীরের।

দুপুরে বা বিকালে তানভীর কখনোই বাসায় থাকতো না। সকালে বের হয়ে বেশ রাত করেই ফিরতো। কিন্তু ইদানীং তাকে বিকালের দিকে মাঝে মধ্যেই চায়ের কাপ হাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ঠিক যে সময়ে অদিতি পড়াতে আসে। অদিতি তাকে দেখে কি দেখে না, তানভীর ঠিক বুঝতে পারে না। তানভীর আসলে অদিতির সাথে একটু কথা বলতে চায়, পরিচিত হতে চায়। অদিতির সম্পর্কে জানতে চায়। কিন্তু অবাক হয় এটা দেখে যে, অদিতির নূন্যতম আগ্রহ নেই। এমন না তরুণীদের কাছে তানভীরের কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই, বরং ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। স্মার্ট, সুদর্শন এবং সর্বোপরি ধনী পরিবারের এস্টাবলিশ তানভীরের জন্য বাস্তবেই অনেকে লাইন দিয়ে আছে।

তানভীর বিষয়টা ইনজয় করে কিন্তু পাত্তা দেয় না। ওর অনেক বন্ধুদের এই পাত্তা দিয়ে ধরা খেতে দেখেছে। কোথায় যায়, কোথায় খায়, কি করে, কেন করে – এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বেচারারা নাজেহাল একেবারে। উফ অসহ্য লাগে তানভীরের। ন্যাকা মেয়েদের এতো কেনা গোলাম টাইপের সম্পর্কে সে জড়াবে না।

কিন্তু অদিতি এমন একেবারে এড়িয়ে যাবে, সেটা তানভীরের পুরুষত্বে লাগে। আজ এজন্য ইচ্ছা করেই লিভিং রুমে বসে বেশ গুরুত্বের সাথে পত্রিকা পড়ছিলো । পত্রিকাতে আসলে পড়ার কিছুই নাই, জাস্ট সময় কাটানো। আসল উদ্দেশ্য অদিতির সাথে দেখা করা। লিভিং রুম দিতেই তাবাসসুমের রুমে যাবে। অদিতি যেমনই হোক, একটু হাই হ্যালো না করে কি পারবে!

– হাই কেমন আছেন?

অদিতিকে ব্যস্ত হয়ে রুম পার হতেই তড়িঘড়ি করে তাকে থামিয়ে দেয় তানভীর।

– জি ভালো। বাহ আপনি তো মুরুব্বিদের মতো করে বসে আগামীকালের খবর আজ তাও বিকালে পড়ছেন! এখনকার জেনারেশন তো অনলাইনেই মুহূর্তের মধ্যে তাজা খবর পড়ে ফেলে!

ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায় তানভীর। নাহ এই মেয়েটি একদমই সুবিধার না। চুপ করে বসে পড়ে তানভীর। অদিতি সেই একই গতিতে তাবাসসুমের রুমে চলে যায়।

রাতে খাওয়ার টেবিলে অদিতির মা বেশ গরম হয়ে উঠেন। প্রসঙ্গ অদিতির বিয়ে। মেয়ের অনার্স শেষ হয়ে যাচ্ছে, এখন বিয়ে না দিলে আর ভালো পাত্রই পাওয়া যাবে না।

– আমি পড়া শেষ না করে বিয়ে করবো না, মা

– সেই পর্যন্ত কোন রাজপুত্র তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকবে?

– আমার কোন রাজপুত্রের প্রয়োজন নেই, আমি নিজে খুব সাধারণ ঠিক তেমনি সাধারণ একজন ছেলে হলেই হবে।

– কবে পড়া শেষ হবে, সে পর্যন্ত তোমাকে বসায়ে খাওয়াবো? বাপের অবস্থাও তো দেখতে পারো।

– ভায়ের পড়া শেষ হয়েছে আরো দুই বছর আগে। ভাইয়াকে যদি বাপ বসিয়ে খাওয়াতে পারে, আমাকেও নিশ্চয় পারবে!

– তুমি দিন দিন বেয়াদব হচ্ছো। ভায়ের সাথে তোমার কি তুলনা। ভাই তো চাকরি নিয়ে অন্য কোথাও যাচ্ছে না, তুমি তো শ্বশুরবাড়িতে আজ হোক কাল হোক চলে যাবা। আয় ইনকাম যদিওবা কিছু করো আমাদের কি যায় আসে? এক প্যাকেট মিষ্টি কিনে বছরে একদিন আসবা কিনা সন্দেহ!

– লুৎফা, তুমি কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি করছো আজ!

– হ্যাঁ, আমি তো সত্য কথা বলি এজন্য কারো ভালো লাগে না। পাইছে বিনা বেতনের বান্দী। সারাদিন কাজ করো, চরকির মতো ঘুরো কিন্তু কিছু বলা যাবে না। এই মেয়েকে বুড়ী করে পস্তাবে বললাম। আর দুই বছর পরেই রিটায়ার্ড হবা, তখন বুঝবা আমার কথার মানে।

অদিতির মুখ, সারা শরীর যেন তেতো হয়ে উঠে। না খেয়েই উঠে পড়ে। রাতে ভালো ঘুম হয় না। মা আজীবন তাকে এমনই পর পর করে চলেছে। ভায়ের সাথে তাকে এতোটাই বৈষম্য করে যে মেনে নেয়া কষ্টকর। মাঝে মধ্যে মনে হয় বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু বাবার কথা মনে হলেই ওর মন শান্ত হয়ে আসে। বাবার জন্য সে সব করতে পারে। বাবার মনে কষ্ট দেয়ার কথা ভাবতেও পারে না।

সকালে না খেয়েই ভার্সিটিতে চলে যায়। তীব্র ক্ষুধা লাগে দুপুরে। ক্যান্টিনে খেয়ে নিয়ে বিকালে ছোটে তাবাসসুমকে পড়াতে। আজো তানভীর দাঁড়িয়ে আছে, ব্যালকনিতে। অদিতি ঠিক বুঝতে পারে কিন্তু পাত্তা দেয় না। বড়লোকদের নানা রকম বিলাসিতা, নানা রকম ফ্যান্টাসী থাকে। ভালোবাসা নামের ভালো লাগা তেমনই এক ফ্যান্টাসী। অদিতি তানভীরকে গুরুত্ব দিচ্ছে না বলেই সে এখন অদিতির প্রতি মরিয়া। কিন্তু অদিতি জানে সে কেন এই বাড়িতে আসে, সমাজে ওর অবস্থান কোথায় এবং কোন সীমারেখায় থাকতে হবে। নাহ, এর একটা বিহীত করতে হবে- মনে মনে ভাবে অদিতি।

আজ তাবাসসুমকে পড়ানো শেষে ওর মা’কে ডেকে সুন্দর করে বলে যে, এই মাস পরে অদিতি আর পড়াবে না। সামনে ওর নিজেরও পরীক্ষা। তাবাসসুম একথা শুনে খুব আপত্তি করছিলো কিন্তু অদিতি বুঝায়ে বললো। কিছু মায়া কাটানোর কাজ শুরুতেই করতে হয়।

অসম্ভব ঘটনা ঘটলো পরদিন। তাবাসসুমকে পড়াতে লিভিং রুম ক্রস করতেই তানভীর সামনে আসলো

– আপনি আর পড়াবেন না কেন?

– কারণ আপনি!

– আ আ আমি! আমি কি করেছি?

– আপনি প্রতিদিন ঠিক আমার আসার সময়ে হয় ব্যালকনিতে না হয় লনে কিংবা লিভিং রুমে বসে থাকেন। আগে তো কখনো আপনাকে দেখিনি। এর কারণ কি?

– আমি আমার বাসায় থাকলে আপনার কি সমস্যা?

– আর আমি আমার পারসোনাল কারণে পড়ানো ছাড়লে আপনার কি সমস্যা?

– কারণ আমার বোনের ক্ষতি হবে। প্রয়োজনে আমি আর আপনার সামনে আসবো না।

– দেখুন, আপনার মা খুব বিশ্বাস নিয়ে আপনার বোনকে আমার কাছে পড়াতে দিয়েছে। আমি যদি সেই সুযোগে আপনার সাথে গল্প করি কিংবা কথা বলি কিংবা কোন কথা না হওয়া সত্ত্বেও আপনি এইভাবে আমার আসার সময়ই এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন, আপনার মা অবশ্যই বুঝবেন যে কোন না কোন ঘাপলা আছে। আর উনি ঘটনা কিছুই না হওয়া সত্ত্বেও দায়ী করবেন আমাকে। আমাকে সুবিধাবাদী ভাববেন আর আমাকে শুধু নয় প্রয়োজনের তাদিগে টিউশন করতে আসা সব মেয়েদেরই উনি খারাপ ভাবতে শুরু করবেন। এজন্য এটাই ভালো যে আমি আর না পড়াই, এখানে আর না আসি। ভালো থাকবেন।

গট গট করে হেঁটে গেলো অদিতি। তানভীর সত্যিকার অর্থেই হাঁ করে রইল!

মাসের শেষ পাঁচদিন তানভীরকে আর দেখা যায় নি। মাস পূর্ণ হলে অদিতিও ছেড়ে দেয় তাবাসসুমকে পড়ানোর কাজ।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে