মেয়েটি যেন ভিন্নরকম পর্ব-০৫

0
16

#মেয়েটি_যেন_ভিন্নরকম

(৫ম পর্ব)

সন্ধ্যা নামছে যেন অতি ধীর গতিতে। ডেকোরেটরের লোকজন তাদের হাঁড়ি, কড়াই, গ্লাস, প্লেট সব গুছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাড়তি খাবারগুলো নেয়ার কেউ নেই। অদিতির বাবা বলে দিয়েছেন ওদের নিয়ে যেতে। অদিতিরা কেউই খায় নি। ভেবেছিলো বিয়ে পড়ানো হলেই খেতে বসবে। কিন্তু বিয়েও হলো না, বাড়ির কারো খাওয়াও হলো না।

গ্রামের বাড়ি হলেও অদিতির চাচারা বেশ সুন্দর করে উঠান রেখেই একতলা পাকা বাড়ি করেছেন। রান্নাঘর আর স্নানের ঘর বাইরে৷ বাড়ির মাঝের একটা ঘরে সবাই বসে অনেকটা বসার ঘরের মতো। সেখানেই খাটের উপর বসে আছে অদিতির মা এবং চাচী। চেয়ারে অদিতির চাচা এবং বাবা। অদিতি আর ওর ভাই শোভন গেলো সেখানে।

– ঝোঁকের মাথায় তো বিয়ে ভেঙে গেলো, এখন কি হবে বুঝতে পারছি না।

অনেকটা ভাঙা গলায় বললেন অদিতির চাচা সিরাজুল হক।

– আমার মেয়েটার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। কে বলেছিলো বড়দের বিষয়ে নাক গলাতে!

ফুঁসে উঠেন অদিতির মা লুৎফা। মেয়ের পাকনাকি ভীষণ অপছন্দ। বিয়ে ভেঙে গেলে গ্রাম এলাকায় আবার বিয়ে হওয়া যে কি কঠিন, এই পিচ্চি মেয়ে কি বুঝবে!

– আমরা যেটা করতে পারি নি, অদিতি সেটাই করেছে। বরং দরকার ছিলো ওদের গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া। তোমাদের কি মনে হয়, হাত পা ধরে বিয়ে দিলে শম্পাকে ওরা আদরে রাখতো? ঐ মহিলা প্রতিনিয়ত জ্বালাতো। আর ছেলেটাও তো ওর মায়ের কথার কোন প্রতিবাদ করে নাই। এমন মেরুদন্ডহীন ছেলের কাছে বিয়ে না দিয়েই ভালো হয়েছে।

গম্ভীর গলায় অদিতির বাবা মেয়েকে সাপোর্ট দেন।

– কিন্তু শম্পাকে কি বলবো? কিভাবে বোঝাবো? মেয়েটা তো এখনো বিয়ের সাজগোজ খোলে নি।

অদিতির চাচী কান্নার সুরে বলতে থাকে।

– আমিই সাজ উঠাতে, কাপড় চেঞ্জ করতে নিষেধ করেছি। কারণ শম্পা আপুর আজই বিয়ে হবে!

ঘরে যেন কোন বোমা ফেটেছে। সবাই অবাক হয়ে হতবিহ্বল হয়ে অদিতির দিকে তাকিয়ে আছে। অদিতির মায়ের মুখ শুকিয়ে যায়। এই মেয়েটা না জানি আবার কি অকান্ড করে!

– চাচা, আপনি ভালো করেই জানেন এই গ্রামের সালাম ভাই শম্পা আপুকে পছন্দ করে। আপনার কাছে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে। কিন্তু আপনি রাজী হন নি। কারণ সালাম ভাই চাকরি করে না, গ্রামেই ব্যবসা করে। সালাম ভাই কিন্তু এম এ পাশ কিন্তু উনি আর দশটা ছেলের মতো চাকরি না খুঁজে, ঘুষ দিয়ে চাকরির চেষ্টা না করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। এটা কি অপরাধ? অযোগ্যতা? চাকরি করলে উপযুক্ত ছেলে আর না করলে বা ব্যবসা করলে অনুপযুক্ত, এই ধারণা একদম ভুল। আমি যতো দূর জানি সালাম ভাই সদালাপী, বিনয়ী ছেলে। পাকা বাড়িও আছে। আর সেখানে বিয়ে হলে তো শম্পা আপু গ্রামেই থাকতো, যখন তখন দেখতে পারতেন।

– সে তো মা যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন এই বিয়ে ভাঙা মেয়েকে কে বিয়ে করবে!

– চাচা, সালাম ভাই অবশ্যই এখনো রাজী হবেন। আর উনার তো মা বাবা কেউই বেঁচে নেই, উনার অভিভাবক নেই। এজন্যই তো আরো বেশি এই প্রস্তাবে রাজী ছিলেন না, তাই না চাচা? অথচ মাতৃ পিতৃহীনদের আরো বেশি ভালোবাসা উচিৎ। এখন দেখেন এটাই শাপে বর হবে। আমি শিউর সালাম ভাই রাজী হবেন। আর উনার বাবা মা না থাকায় ‘বিয়ে ভাঙা’ মেয়ে এমন অপবাদ দেয়ার কেউ নেই।

– তুই চুপ কর। জীবনটা নাটক সিনেমা পেয়েছিস নাকি? যা ইচ্ছা করে যাচ্ছিস, বলে যাচ্ছিস। তোকে এখানে কে ডেকেছে? আর তোমাকেও বলি মেয়েকে ঠেকাও। আদর দিয়ে আর সব কথায় সায় দিয়ে আর মাথায় তুলো না।

খেঁকিয়ে উঠেন লুৎফা। মেয়ের কথা বার্তা আর সহ্য হচ্ছে না।

-মেয়ে যথেষ্ট বড় হয়েছে। ওর সাথে এমন ব্যবহার করবে না। অদিতির কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। আজই বিয়ে দিতে পারলে ভালো। কারণ গ্রাম এলাকায় যতো সময় যাবে ততই নানান কথার হাত পা হবে। কিন্তু তার আগে শম্পার সাথে কথা বলা সবার আগে জরুরী। কারণ মেয়েটা একটা ট্রমার মধ্যে পড়েছে। সেখানে একটু সময় না দিয়ে আজই আরেক জায়গায় বিয়ে দেয়ার কথা মানতে পারবে তো!

এই কথায় শম্পার মায়ের যেন হুঁশ হয়। তাই তো উনার তো আগে মেয়ের পাশেই থাকা উচিৎ। অবশ্য নিজের ছোট বোনকে বসিয়ে রেখে এসেছিলেন। তবুও সবার কথা বার্তার মাঝেই ছুটে যান মেয়ের কাছে। মেয়েটাকে তো ধাতস্ত করতে হবে। ওর মনের অবস্থাও জানতে হবে।

এদিকে ভায়ের সাথে আরো দুই একটা কথা বলে অদিতির বাবাও গেলো শম্পার ঘরের দিকে। সালামের বিষয়টা একটু শুনতে হবে। অদিতির কথাই ঠিক। সালাম ছেলেটা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো কিন্তু ব্যবসা করে বাপ মা নেই এজন্য শম্পার বাবা রাজী হয় নি। এখন নিজেই সেই কথা স্বীকার করলেন। চাকরিজীবী ছেলে দেখে আরো ভালো করে খোঁজ না নেয়ার জন্য আফসোস করলেন।

শম্পার রুমে ঢোকার আগে অদিতির বাবা আগে ধরলেন অদিতিকে। এ কিভাবে সালামের কথা জানলো! তবে কি শম্পার সাথে সালামের কোন সম্পর্ক ছিলো!

– বাবা, আমি জানতাম তুমি আমার কাছে আসবা আর আরো জানি কি জিজ্ঞাসা করবা

দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে অদিতি। আহসানুল হক মেয়ের সরলতা, বুদ্ধিমত্তা এবং সাহসিকতায় মুগ্ধ হন। মেয়েকে কিছুই জিজ্ঞাসা করেন না। মাথায় হাত দিয়ে বলে

– এমনি থাকিস মা।

এরপর শম্পার ঘরে ঢুকে ওর পাশে বসেন। নরম স্বরে বলতে থাকেন

– মা রে জানি খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু হাত পায়ে ধরে এই বিয়ে হলে আমরা যে আরো চিন্তায় থাকতাম। যা হয়েছে সব আল্লাহর ইচ্ছা। অদিতি কোন একটা ছেলের কথা বলছিলো – সালাম নামে। চিনো নাকি? অদিতি তো তার সাথে বিয়ের কথা বলছিলো।

– চাচা, সালামকে আমি গ্রামের একজন হিসেবেই চিনি। শুনেছিলাম সে বিয়ের প্রস্তাব দিলে আব্বা রাজী হয় নাই, কারণ সে এতীম। এই বিষয়টা আমার ভালো লাগে নাই। তার চরিত্র খারাপ বা অসৎ, অলস হলে আলাদা কথা। কিন্তু বাবা মা নেই বলে কি তার বিয়ে হবে না! এটাই একদিন অদিতিকে বলেছিলাম। আর বিয়ে ভাঙাতে আমি মোটেও দু:খ পাই নি। এই যুগেও যারা গায়ের রঙ আর কতোটুকু লম্বা সেই হিসেব করে সুন্দর অসুন্দরের মাপ করে আর কবুল বলার আগ মুহূর্তে বিয়ে ভেঙে দেয় সেখানে বিয়ে না হওয়ায় আশীর্বাদ।

– মা, তুমি কি এই ছেলেটার উপর আরেকটু ভরসা করবে?

– চাচা, অদিতি এতো সাহসী, এতো ভালো কেন জানেন? কারণ তার বাবা আপনি। আমি আপনাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি।

আহসানুল হক বের হয়ে এখানে সেখানে ফোন দিয়ে সালামের খোঁজ খবর নেয় এবং আরো দুই একজন নিয়ে হাজির হয় সালামের সামনে।

গ্রামে কারো জানতে বাকি নেই যে শম্পার বিয়ে ভেঙেছে। সালামও জানে। ঘরে বসে টিভি দেখছিলো, এমন সময় আহসানুল হক অনেকটা করজোড়ে দাঁড়ায়।

সালাম আহসানুল হককে চিনে। ছুটে এসে হাত ধরে। আহসানুল হক সালামের হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলেন

– তোমার বাবা মা নেই বলে বিয়ে হয় নি। দেখো তো বাবা, আমাকে বাবা হিসেবে মানতে পারো কিনা। তাহলে আমি না হয় তোমার বাবা হয়ে আর শম্পার চাচা হয়ে বিয়েটা দিতাম।

মনে মনে হয়তো ভাবছো মেয়ের বিয়ে ভাঙায় এসব বলছে। সেটা সত্যি কথা, অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার মেয়েপক্ষের লোক হয়ে হাত পা ধরতেও আপত্তি নেই। তবুও আমাদের মেয়েটা আর কষ্ট না পাক।

– আপনি মেয়েপক্ষ না, ছেলেপক্ষ।

ধরা গলায় বলে সালাম।

সেদিন রাত ১২ টায় সালাম শম্পার বিয়ে হয়। অদিতি জোরে গান ছেড়ে পিচ্চিদের নিয়ে নাচতে থাকে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে