মেয়েটি যেন ভিন্নরকম পর্ব-০৪

0
16

#মেয়েটি_যেন_ভিন্নরকম

(৪র্থ পর্ব)

বিয়ের দিন সকাল থেকে হৈ হুল্লোড়। সাত’টা ছাগল জবাই হয়েছে ভোরের আলো ফোটার আগেই। সেগুলো কাটাকুটি করে রান্নাবান্না করছে স্থানীয় বাবুর্চিরা। মশলার ঘ্রাণে জায়গাটা ম ম করছে। চেনা, অচেনা, আধা চেনা আত্নীয় স্বজনে ভরে গেছে ঘর৷

এতো লোকজনের মাঝে অদিতির অস্বস্তি হয়। বিশেষ করে যখন কেউ বলে – ও তুমি আহসানের মেয়ে না? তা ডাগর হয়ে উঠছো তো। তোমারও তো বিয়ে দেয়া উচিৎ।

অদিতির হাসি পায়। বিয়ে হওয়া ছাড়া মেয়েদের বুঝি আর কোন কাজ নেই! কিন্তু অদিতি রাগ করে না বিরক্ত হয় না। কারণ এসবে লাভ নেই। বরং একটা হাসি হাসি মুখ করে। ভাবখানা এমন যে অদিতি তো বিয়ের জন্য রেডিই, ছেলে একজন আসলেই সে নিজেই ‘কবুল’ বলে ফেলবে। অবশ্য অন্য ধরণের কথাও শুনেছে।

– এই বয়সের মেয়ে একটু বেশি সাইজ্জা গুইজা মেকাপ করে ঘুরবা তা না তোমারে দেখে বুঝাই যায় না যে বিয়ে বাড়িতে আসছো!

রঙ চঙে সঙ সাজার কোন ইচ্ছাই অদিতির নেই। তবে শম্পা আপুকে সেই সুন্দর লাগছে। মানুষ এজন্যই বলে বিয়ের পানি পড়কে নাকি মেয়েরা সুন্দর হয়ে যায়! উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের শম্পা আপু শাড়ি গহনায় একদম জ্বলজ্বল করছে যেন।

দুপুর দুইটা নাগাদ বরপক্ষ আসলো। আসার কথা ১০০ জন কিন্তু এসেছে ১৫০ জন, ছোট মোট বাচ্চা কাচ্চা ধরলে আরো বেশিই হবে। অদিতিদের আত্নীয় স্বজনদের খাওয়া এর আগেই শুরু হয়েছে কারণ বড় ফুফুর মতো কিছু লোক আছেন যারা আবার বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারেন না বা তাড়াহুড়ায় সকালে নাকি খেতেই পারেন নি! অদিতির আবারও হাসি পায়। এসব মানুষের বিয়ে বাড়ি আসলেই এতো ক্ষুধা পায়! এর সাথে আছে এর জন্য একটু মিষ্টি দাও, ও আসতে পারে নাই তার জন্য একটু পোলাও রোস্ট বক্সে ভরে দাও। কনের বাবা মায়ের একটা শোক এবং কষ্ট থাকে, এতো বছর ধরে বুকে ধরে রাখা আদরের মেয়েকে অচেনা জায়গায় পাঠাতে হচ্ছে কিন্তু এসব আত্মীয় স্বজনের জন্য সেই শোকটুকু করারও সময় সুযোগ পায় না।

বরের বাড়ির লোকজন আসলে গেট ধরাধরি হলো কিন্তু কিছু আদায় হলো না। তারা নাকি এসব আজেবাজে খরচ করতে রাজি না। অদিতির বাবার ধমকে বাড়ির ছেলে মেয়েরা সরে গেলো। খাবারের সময় পার হয়ে যাচ্ছে, এজন্য অদিতির বাবা চাচারাই বরপক্ষকে বললো আগে খেয়ে নিতে, এরপর না হয় বিয়ে পড়ানো হবে। এতো তাড়াহুড়োর কি আছে । এদিকে খাসির মাংস জমে যাচ্ছে, পোলাও ঠান্ডা হচ্ছে। সুতরাং ঝালর দেয়া বিশাল সামিয়ানার নিচে বরযাত্রীদের বিশাল বহর বসে গেলো খেতে। ভাত তেমন কেউ নেয় না, একেক জনের পাতে মাংসের পিরামিড। খেতে পারুক বা না পারুক মাংস নিয়ে সাজিয়ে রেখেছে স্তুপ করে। হাড়ি হাড়ি দই খালি হতে লাগলো।

জম্পেশ খাওয়া দাওয়া শেষে পানি খাওয়ায় (সেভেন আপ, কোকাকোলা) যখন সবাই ব্যস্ত তখন অদিতির বাবা এগিয়ে গেলো ছেলের বাবার দিকে, বিয়ে পড়ানোর অনুমতি নিতে। স্থানীয় কাজী সাহেব উপস্থিত, নীল রঙের কাবিননামায় লেখার জন্য প্রস্তুত। বর কনের আইডি কার্ডের খোঁজ করছেন।

এমন সময় হঠাৎ করে চিকন স্বরে কান্নার শব্দ। প্রথমে সবাই ভাবলো কনে বা কনের মা বুঝি কনে বিদায়ের বেদনায় কাঁদছেন কিন্তু শব্দ আসছে কনে যে ঘরে বসে আছে তার পাশের ঘর থেকে। সেখানে তো বরের বাড়ির মহিলারা বসে আছেন। তাহলে?

খোঁজ নিয়ে দেখা গেলো কাঁদছেন বরেন মা। কারণ মেয়ে পছন্দ হয় নাই! শম্পাকে দেখতে এসেছিলো বর, তার বাবা, চাচা ও এক বন্ধু। বরের মা মোবাইলে ছবি দেখেছেন, সবার পছন্দে তারও পছন্দ। ভালো ঘরের লক্ষী মেয়ে, সংসারী। কিন্তু এখন সরাসরি দেখার পর তার মনে হয়েছে, তার ঘরের বড় বউ এর গায়ের রঙ আরেকটু উজ্জ্বল না হলে এবং আরেকটু লম্বা না হলে মান সম্মান থাকে না। দুই একজন বোঝাতে আসায় এমন চিৎকার দিয়ে কান্না। এক কথা মেয়ে পছন্দ হয় নাই! বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে অদিতির বাবা চাচারা। ভদ্রতার খাতিরে বলতেও পারছেন না যে, খাওয়া দাওয়ার পরে আপনাদের এ কী নাটক!

বর উঠে মায়ের কাছে গেলো। অদিতিরা কয়েকজন বরের মা যে রুমে আছে তার সামনে দাঁড়ানো। বরকে জড়িয়ে ধরে তার মা কেঁদে চলেছেন। একটাই কথা – আব্বা, এই মেয়ে তোর যোগ্য না। বরের বাড়ির দুই একজন মহিলা আত্নীয় এমনকী অদিতিদের দুই একজন বোঝানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু মহিলা নাছোড়বান্দা, উনি এই বিয়েতে রাজী না। এর মধ্যে বরের বাপও চলে এসেছে। তার কথা তো শুনছেই না, তার কারণেই নাকি ছেলের এমন খারাপ বিয়ে হচ্ছে! অগত্যা বরের বাপ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিছুক্ষণ এই নাটক চলছে। ঐদিকে অদিতির চাচী ওর মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন, উনার মেয়ের কপাল বুঝি ভাঙলো। শম্পার মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে। অনুভূতিহীন। সারা বাড়িতে কানাঘুষা – বরের মায়ের মেয়ে পছন্দ না, এজন্য কাঁদছে।

আর সহ্য হলো না অদিতির। বরের মায়ের সামনে গিয়ে জোরে বলে উঠলো

– নাটক কম করেন। বিয়ে ঠিক হওয়ার এক মাস পরে বিয়ে হচ্ছে, আর বিয়ের দিন এসে ভরপেট খাওয়ার পরে আপনার মনে হলো যে, মেয়ে পছন্দ না! ইয়ার্কি পেয়েছেন।

বরের মা কান্না বন্ধ করে হা করে অদিতির দিকে তাকিয়ে আছে। অদিতির আত্নীয় স্বজন দুই একজন রে রে করে ছুটে আসছিলো, ঠেকালো অদিতির বাবা। উনি এই বরপক্ষের উপর যথেষ্ট বিরক্ত।

– যোগ্য না কে? আমাদের মেয়ে? মোটেও না। আপনার ছেলে, আপনাদের পুরো পরিবার আমার শম্পা আপুর যোগ্য না। আমাদের তো আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ যে খাবারের উপর দিয়ে, টাকা পয়সার উপর দিয়ে ধাক্কা গেছে। শম্পা আপুর জীবনের উপর দিয়ে যায় নি। বিয়ে হলে তো এই নাটুকে মহিলা আমার বোনের জীবন ছারখার করে দিতো।

অদিতির এমন কথায় মুখ খুলতে যায় বর। কিন্তু তাকে চুপ করিয়ে অদিতি কন্ঠের জোর আরো বাড়িয়ে বলে উঠে

– আপনি কোন কথা বলবেন না। আপনার মুরোদ বোঝা হয়ে গেছে। আমার বাবা চাচারা ভদ্র বলে আপনাদের পিঠ বেঁচে আছে এখনো। ভালোই ভালোই বের হয়ে যান আপনারা। খাবারের দাম ধরছি না, এই আপনাদের কপাল। ভাবছেন হাত পা ধরে বিয়ের জন্য রাজী করাবো? মোটেও না। আপনাদের মতো ছোটলোকের সাথে বোন বিয়ে দেয়ার কোনই ইচ্ছা নেই আমাদের। আর কোন নাটক করলে ভিডিও করে ফেসবুকে পোস্ট করে দেবো। তখন কিন্তু সমাজে মুখ দেখাতে পারবেন না।

অদিতির কথায় উৎসাহিত হয়ে এর মধ্যেই ওর কিছু চাচাতো ভাই মোবাইলে ভিডিও শুরু করে দিয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে, বরযাত্রীরা সুড় সুড় করে বের হয়ে যায়৷

বেলা শেষের দিকে। বর যাত্রীদের সাথে অদিতিদের আত্নীয় স্বজনরাও সবাই চলে গেছে। বড় ফুফুর মতো কিছু লোকজনের যদিও ইচ্ছা ছিলো আরো কয়েকদিন থাকার, এই বিয়ে ভাঙা নিয়ে খোঁচাখুঁচি করার কিন্তু অদিরির অগ্নিরূপের কথা স্মরণ হয়ে, থাকলে আরো হিতে বিপরীত হতে পারে ভেবে তারাও চলে গেছে।

বাড়িতে আছে অভুক্ত অদিতির বাবা, চাচা, মা, চাচী সহ ভাই বোনেরা, হাঁড়ি পাতিলের নিচে পড়ে থাকা কিছু খাবার, খাবারের সন্ধানে ঘুর ঘুর করা কয়েকটা কুকুর আর ভাবলেশহীন কনের সাজে বসে থাকা শম্পা।

বরযাত্রীরা তো যথেষ্ট শিক্ষা নিয়ে চলে গেলো৷ অন্যেরা গেলো ভরপেট খেয়ে। কিন্তু শম্পার কি হবে? এই চিন্তায় এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মাথায়।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে