#মেয়েটি_যেন_ভিন্নরকম
(শেষ পর্ব)
আজ দুই দিন ধরে আমান অদিতির ফোনে ম্যাসেজ দিচ্ছে। কিন্ত অদিতি ইগ্নোর করছে। কারণ, অদিতি সত্যিই বিরক্ত। আমানকে ও অন্য রকম ভেবেছিলো, নি:সন্দেহে আমান অনেক কেয়ারিং। কিন্তু না জেনে কেন এভাবে মন্তব্য করবে?
রাতের বেলা খাবার টেবিলে বসতেই হঠাৎ করেই আমান এসে টেবিলে বসে। বিরক্তিতে অদিতি ভ্রু কুঞ্চিত করে। আমান! এখানে! অদিতির বাবা এখনো খেতে আসে নি। আর মা রান্নাঘরে।
– অদিতি, আমি সরি। আপনি আমার কোন ম্যাসেজেরই উত্তর দিচ্ছেন না, এজন্য এভাবে অনাহুতের মতো আসতে বাধ্য হলাম৷
– আপনি অনাহুত কেন হবেন? আমার বাবা মা তো আপনাকে বাড়ির সদস্যের আসন দিয়েছেন।
– আপনি তো দেন নি!
– মানে?
-মানে খুব সহজ। আমি মানছি আমার এভাবে কথা বলা উচিৎ হয় নি। কিন্তু আমাকে তো আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া উচিৎ ছিলো। আমার ‘সরি’ বলার সুযোগটুকু তো দেবেন। আমার বাবা মা মারা যান ছোটবেলায়। এরপর বোর্ডিং স্কুলে তারপর হোস্টেল, হল আর এখন একটা স্টুডিও এপার্টমেন্টে এভাবেই চলছে জীবন। এই যে আপনি খাওয়ার টেবিলে বসে আছেন, আপনার মা রান্নাঘরে কাজ করছেন একটু পরেই আপনার বাবা আসবেন – একসাথে বসে রাতের খাবার খাবেন। ঠিক এমন একটা জীবন আমার কাছে স্বপ্ন। দেখুন, আমি আজীবন বাউন্ডুলে গোছের। মানুষের জন্য দৌড়াই ঠিকই কিন্তু মানুষ আমাকে কতোটা ভালোবাসে? কতোটা মনে রাখে? প্রয়োজনের সময় আমাকে কল দেয় – ভাই এক ব্যাগ রক্ত লাগবে, যোগাড় করে দিতে পারবেন? কিন্তু প্রয়োজন মিটলে একবার জানতে চায় না, এই যে আমি সকাল থেকে রক্ত যোগাড়ে ছুটছি, আমার আদৌ সারাদিন খাওয়া হয়েছে কিনা! আরেক দল আছে, ঠিক খোঁজ নেয় কিন্তু সে বড় স্বার্থের জন্য। কারণ আমার চাচা অনেক ধনী, অনেক প্রভাবশালী, অনেক জায়গায় তাঁর জানাশোনা। এর বাইরে কেউ কখনো মাথা হাত রাখে নি, জিজ্ঞাসা করে নি – কেমন আছি, দুপুরে খেয়েছি কিনা!
আপনার বাবা, মা সর্বপ্রথম আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে – বাবা, আজ সারাদিন বড্ড ছোটাছুটি করেছো, আজ আর কোথাও যেও না। আমাদের সাথে খেয়ে, এখানেই ঘুমিয়ে থাকো। আপনার মা যখন শুনেছে আমার কেউ নেই, দুপুরে দুপুরে ফোন দেয় – আমান, বেটা খেয়েছো? নিজের দিকে খেয়াল রেখো।
বিশ্বাস করেন, এমন করে কেউ কখনো বলে নি। এমন করে কেউ আমাকে ভালোবাসে নি।
একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে থামে আমান। ওর গলা ধরে এসেছে। চোখের কোণে জল। অদিতি বুঝতে পারে আমানের কষ্ট। অদিতির এতোটা রিএ্যাক্ট করা বোধ হয় ঠিক হয় নি!
– তবে অদিতি আপনার যুদ্ধটা কিন্তু আমার চেয়ে কম কঠিন না। বরং অনেক সময় আরো বেশি। আমি বুঝি আপনি মেধাবী কিন্তু শুধুমাত্র বাবা মায়ের সাথে থাকার জন্য অন্য কোন চাকরির চেষ্টা করেন নি। এর চেয়ে বড় কষ্ট যেটা আপনাকে প্রতি নিয়ত স্বীকার করতে হচ্ছে, তা হলো – এভাবে বিয়ে না করে থাকা। আমাদের সমাজ সম্পর্কে আমি ভালো করেই জানি। একটা বয়সের পরে বিয়ে না করলে বা না হলে সমাজ তাকে যেভাবে হেনস্থা করে, এ যেন মৃত্যু সমতুল্য। আপনার বাবা মাও ভীষণ দু:শ্চিন্তায় থাকেন। আমি আপনাকে একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। আপনি ভাবতে থাকেন। পজিটিভ হলে ভালো, নেগেটিভ হলে আমি আপনার সামনে আসবো না।
প্রশ্নবোধক চোখে তাকায় অদিতি। আমান কি বলবে? কিসের প্রস্তাব?
– অদিতি আপনি সুন্দরী, বুদ্ধিমতী। আপনাকে যে কেউ পছন্দ করবে। সত্যি বলতে আমিই পছন্দ করি। এখন তো প্রেম করার বয়স নেই। যদি জীবনে চলার পথের সঙ্গী হিসেবে আমাকে কিছুটা হলেও পছন্দ হয়, জানাবেন। অবাক হবেন না, আমি জানি যে আমি কিছুটা বোহেমিয়ান। তবে এটুকু নিশ্চিত থাকেন, আমি দায়িত্বজ্ঞানহীন নই। যাদেরকে আমি ভালোবাসি, যারা আমার পরিবার, তাদের জন্য আমার সব প্রায়োরিটি। তাদের জন্য আমি জীবন দিতে পারি।
– আচ্ছা, আগে দেখতাম মেয়েকে পাওয়ার জন্য বাবা মা’কে পটানো হতো। কিন্তু এই ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বাবা – মা’কে পাওয়ার জন্য মেয়ে’কে পটানো হচ্ছে! নট ব্যাড। ভেবে দেখি – আমি আমার বাবা- মা’কে হারাতে চাই কিনা!
– কে বললো, বাবা – মা’কেই শুধু চাই? বরং এক্ষেত্রেও এটাই সত্য যে, মেয়ে’কে পাওয়ার জন্যই বাবা – মা’কে পটাচ্ছিলাম!
অদিতির চোখের দিকে তাকিয়ে আবেগী কন্ঠে বলে আমান। অদিতি লজ্জা পায়। কিন্তু অদিতি তো দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। অনেকেই তাকে ‘আয়রন লেডি’ বলে!
– এটা প্রমাণ করতে হবে। আর এই বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত আমার একার! কারণ আমি জানি আমার বাবা মা বায়াসড, সব আপনার পক্ষে!
মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে আমান। নাহ, মেয়েটা আসকেই অন্য রকম – মনে মনে ভাবে আমান। অদিতি কিছুটা মুচকি হেসে সরে পড়ে। এতোক্ষণে বাবা মা কেউ ডাইনিং এ আসলো না, তার মানে সবাই সবকিছু জানে! ওকে আমিও দেখবো- কিভাবে খেলা জমে!
‘আমি বাউন্ডুলে ঘুড়ি
যে আমাকে বাসবে ভালো
তার আকাশেই উড়ি
আমি বৃষ্টি ইলশেগুঁড়ি
মাথায় করে রাখলে আমায়
খেলবো লুকোচুরি
খেলবো লুকোচুরি’
অদিতি গান শুনছিলো। অনুপম রায়ের গান ওর ভালো লাগে। এই গান’টা শুনতে ওর ভালোই লাগে আবার আমানের কথাও মনে হয়ে হাসি পায়। আমান তো নিজেকে বাউন্ডুলে বলে। আমানের সাথে অদিতির বাবা মা মিলে বিয়ের জন্য খুব লেগেছে কিন্তু অদিতির একটাই কথা – আমান যে ওকে পছন্দ করে এর প্রমাণ কি? আমান নিশ্চিত বাবা মায়ের ভালোবাসার লোভে অদিতিকে বিয়ে করতে চায়!
কি অদ্ভুত কথা? তাই হয়? – লুৎফা বেগম বলেন। কিন্তু আসল বিষয়টা আহসানুল হক বুঝতে পারেন। আমানের কানে টিপস দেন – মেয়ে পটাও, এ যুগের ছেলে হয়ে এটুকু বুঝো না?
ব্যাস, একে তো নাচুনি বুড়ি তার উপরে ঢোলের বাড়ির মতো অবস্থা হলো যেন। আজ গোলাপ, কাল দোলনচাঁপা। এরপর অন্য কোন ফুল এভাবেই রোজ সকালে কিছু না কিছু হাতে আমান দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর দুই দিন পর পর কফি খাওয়ার দাওয়াত। নানা রকম শাড়ির গিফট। মাঝ রাতে কল – অদিতি, বাসার নিচে আছি, এক কাপ চা হবে!
অদিতির ভালো লাগে অবশ্যই। কিন্তু বোঝাতে দেয় না। এই সময়গুলো আসলেই দারুণ লাগে। বিয়ে তো হবেই, অদিতির রাজী না হওয়ার কোন কারণ নেই। কারণ, অদিতির মূল চিন্তার বিষয় হলো বাবা মা৷ সেখানে আমান বাবা মা’কে মাথায় করে রাখে, সুতরাং ‘না’ বলার তো কারণই নাই! কিন্তু আমানের এই পাগলামিগুলো অদিতি ইনজয় করে। খুব ভালো লাগে।
কিন্তু একদিন সকালে আমান আর আসলো না। সারাদিন আর খোঁজ নেই। পরের দিনই না। অদিতি উদ্বিগ্ন হয়, আমানের নাম্বারে কল দেয় – বন্ধ। বাবা মা’ও কিছু বলতে পারেন না। এমন তো হয় না? বাবা মা’কে কিছু না বলে তো কোথাও যায় না! তাহলে? উফ আর ভাবতে পারে না অদিতি, ওর মাথা ছিঁড়ে যায় যেন।
পরের দিন স্কুল থেকে ফিরে দেখে বাবা মা ব্যাগ গুছিয়ে বসে আছে। তাদের চোখে মুখে চিন্তার ছায়া।
– অদিতি, গুছিয়ে নে। আমান কক্সবাজারে। আমাদের সেখানেই যেতে হবে। এয়ারের টিকিট কেটেছি। এক্ষুণি যেতে হবে!
বাবার কন্ঠে এমন কিছু ছিলো যে অদিতি আর প্রশ্ন করতে সাহস পায় না। যা পারে গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন। কোন এ্যাকসিডেন্ট? খুব খারাপ অবস্থা না হলে এয়ারে যাচ্ছে কেন! মুখ শুকিয়ে যায়।
কক্সবাজারে নেমে বাবা ওদের নিয়ে একটা অভিজাত হোটেলে উঠলে অদিতি প্রশ্নবোধক চোখে তাকায়
– আমানের চাচা ঠিক করে দিয়েছেন। ব্যাগ রেখে ফ্রেস হয়েই আমানকে দেখতে যাবো।
– বাবা, আমার ফ্রেস হওয়ার দরকার নেই।
– আচ্ছা, রুমে ব্যাগ রেখে আয়।
অনিচ্ছায় রুমের চাবি নিয়ে চলে যায়। পেছনে বাবা মা মিটিমিটি হাসতে থাকে।
অদিতি দরজা খুলতেই চমকে যায় – আমান হাঁটু গেড়ে বসে আছে। হাতে একটা রিং
– আমাকে কি তোমার জীবন সঙ্গী করবে অদিতি? প্লিজ
– একদমই না। কতো বড় বাটপাড়, আমাকে মিথ্যে বলে এনেছে। আমি চিন্তায় মরে যাচ্ছিলাম।
রেগে বের হয়ে যাচ্ছিলো অদিতি। আমান জোর করে জড়িয়ে ধরে। থমকে যায় অদিতি।
– এছাড়া কোন রাস্তা পাচ্ছিলাম না প্রিয়া। তুমি এতো ঘুরাচ্ছিলে কেন? আর কতো ঘুরবো? সারা’টা জীবন তো ঘুরেই গেলাম। এখন একটু শান্তির গৃহকোন চাই।
অদিতির কানে ফিসফিস করে বলে আমান। এরপর ওকে ছেড়ে দেয়। হাত ধরে রুমের ব্যালকনিতে নিয়ে যায়৷ ব্যালকনি থেকে সমুদ্র দেখা যায়।
– কি সুন্দর তাই না অদিতি? এখানে বাবা মা কেউ নেই। শুধু তুমি আর আমি। এখানে আমাকে গ্রহণ করো প্লিজ!
অদিতি কাঁপা হাত বাড়িয়ে দেয়। আমান আংটি পরিয়ে দেয়। আংটি পরিয়ে শক্ত করে হাত ধরে থাকে। সামনে আদিগন্ত সমুদ্র, সীমাহীন আকাশ। অদিতি – আমান সেদিকে তাঁকিয়ে নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে থাকে।
সমাপ্ত।