মেয়েটি যেন ভিন্নরকম পর্ব-১২

0
5

#মেয়েটি_যেন_ভিন্নরকম
(পর্ব ১২)

লুৎফা আর আহসানুল হকের মুখে খালি আমানের নাম। উনারা উঠতে বসতে খালি এই নাম জপ করে। অদিতি সেদিন না পেরে বলে উঠে

– আচ্ছা মা আমানের মধ্যে কি পেলে বলো তো? আমার নামও এতোবার নাও না, যতোবার আমানের নাম নাও!

অদিতি মোটেও ঈর্ষান্বিত নয়। বরং ভীষণ ভালো লাগে। একশ একবার এই নাম জপলেও ওর খারাপ লাগবে না। কিন্তু সমস্যা হলো এই নাম শুনলেই ওর বিবশ লাগে। কাজ কর্মে ব্যাঘাত হয়।

– অদি, আমান এতীম ছেলে এটা ভুলিস না!

পাশ থেকে গম্ভীর গলায় বলেন আহসানুল হক।

– হুম এতীম কিন্তু অসহায় নয়। নিজে জব করে আবার গার্ডিয়ান হিসেবে আছে বড়লোক আন্তরিক চাচা।

– আচ্ছা ভাব, একদিন বৃষ্টির দিনে ওর খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করলো কিন্তু চিৎকার করে বলতে পারে না – মা, আজ কিন্তু খিচুড়ি রান্না করবে। বলতে পারে না, বাবা অনেকদিন ইলিশ মাছ কিনছো না কেন?

গম্ভীরমুখে বলেন লুৎফা বেগম। পরিবেশটা গুমোট হয়ে যায়। আসলেই, বাবা মা যাদের নেই তারাই বোঝেন কতোটা ভালোবাসাহীন তারা।

– আমাদের বাসায় রান্না করলো কি ভীষণ উৎসাহ নিয়ে। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে নাকি রান্না শিখেছে, আমাদের নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবে৷ তোর মা কতো নিষেধ করলো কিছুতেই শুনলো না। এরপর ওর রান্নার প্রশংসা করলে খুশিতে চোখ মুখ কেমন জ্বল জ্বল করছিলো। এখন বল এমন ছেলের কথা কে না বলবে? যে কীনা চেনা অচেনা যে কারো বিপদে দৌড়ে যায়!

অদিতি চুপ করে থাকে। আসলেই বাবা মা আমানকে বেশ পছন্দ করে আর এই পছন্দের অন্যতম কারণ বুঝি শূণ্যস্থান পূরণ। শোভন আলাদা হয়ে যাওয়ার পরে তাদের মনে যে একটা শূণ্যস্থানের তৈরী হয়েছে কিছুটা হলেও প্রলেপ লেগেছে। প্রকৃতিই শূণ্যস্থান পছন্দ করে না, কাউকে না কাউকে দিয়ে সেই শূণ্যস্থান ভরাট করে দেয়।

এরপরের দিনগুলো বেশ নাটকীয়তায় চলে যাচ্ছে। আমানের সাথে অবশ্য অদিতির তেমন দেখা সাক্ষাৎ হয় না। কিন্তু প্রায় দিনই তার কোন না কোন সুকর্মের ঘটনা অদিতির কানে আসে। এই যেমন আজ আহসানুল হককে জোর করে মর্ণিং ওয়ার্কে নিয়ে গেছে, আসার সময় কোথা থেকে টাটকা সবজী আর মাছ নিয়ে এসেছে। কিংবা অদিতির মা’কে চেক আপ করতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। তারপর মাঝে মাঝেই রান্না, গল্প, আড্ডা তো আছেই। আমান আমান শুনতে শুনতে অদিতির তো একটু একটু ঈর্ষা যে লাগছে না তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু বাবা মা যে ভালো আছেন, উচ্ছ্বল আছেন এটাই অদিতির বড় পাওয়া।

অবশেষে একদিন রাতে অদিতির হোয়াটসঅ্যাপে সেই কাঙ্খিত ম্যাসেজ – কাল কখন ফ্রি থাকবেন?
অদিতি বিকালেই ফ্রি থাকে। সেটাই জানালো। স্থান ঠিক হলো, নিরিবিলি একটা কফিশপে। কিন্তু এরপরই ঘুম হারাম হলো অদিতির। কি বলতে চায় আমান?

নানান রকম চিন্তা ভাবনায় রাত এবং দিনটা কেটে বিকালে নির্ধারিত ক্যাফেতে আসে অদিতি। ইচ্ছা করেই আজ শাড়ী পরেছে। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেয়ার পর থেকে অদিতি অবশ্য মাঝে মধ্যেই শাড়ী পরে। এই পোষাকের মধ্যে একটা আলাদা আভিজাত্য, সৌন্দর্য আছে সেটা একদম সাদামাটা সুতি শাড়ি হলেও। অদিতি তাঁতের সুতি শাড়ীই পরে বেশি৷ ওর মনে হয় দেশীয় শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সবার নৈতিক দায়িত্ব আর দামে কম এবং ভালো মান।

এমনি একটা নীল জমিনে চিকন লাল পাড়ের একটা শাড়ি পরে অদিতি ক্যাফেতে আসে। শরৎ শুরু হলেও গরমটা কমে নি। ওর নাকের ডগায় শিশির বিন্দুর মতো ঈষৎ ঘাম জমে আছে। চুলগুলো পেছনে একটা পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আঁটকানো। আমান একটু বোহেমিয়ান টাইপের হলেও ওর একটা গুণ হলো কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে পারলে সময়ের দু পাঁচ মিনিট আগে উপস্থিত হয়। আজো তার ব্যতিক্রম নয়। হালকা গ্রে কালারের একটা টি শার্ট আর জিন্স পরেছে, এক মাথা চুল কিছুটা এলোমেলো তাতে আরো ভালোই লাগছে যেন। অদিতিকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে সামনে এগিয়ে এলো।

– বাহ, শাড়ীতে তো আপনাকে দারুণ লাগে!

চোখে মুখে একটা মুগ্ধতা নিয়ে বলে আমান। এটা যে ও মন থেকেই বলছে তা ওর চেহারা দেখেই বোঝা যায়।

– শাড়ীতে সব মেয়েকেই ভালো লাগে।

বসতে বসতে বলে উঠে অদিতি।

– বলেন কি খাবেন? আগে অর্ডার দিই।

মেন্যু কার্ড হাতে নিয়ে অদিতির দিকেই এগিয়ে দেয়।

– শুধুই এক কাপ গরম কফি। আর তার আগে বলুন এভাবে সমন দিয়ে ডাকার কারণ কি?

অদিতির এই কথায় ওর স্বভাব সুলভ চরিত্রের অংশ হিসেবে হা হা করে হেসে উঠে আমান।

– বাহ আপনার তো ভালো সেন্স অফ হিউমার আছে। আমি তো ভাবতাম পদার্থ বিজ্ঞানের ম্যাডাম যখন, কিছুটা খটোমটো টাইপের। এখন দেখি না, ভালোই রসিক আছেন!

অদিতি অপ্রস্তুত হয়। চুপ করে থাকে, ঠিক কি বলবে বুঝতে পারে না। আমানেরই তো কথা বলা উচিৎ, কি বলতে চায় সে!

– আসলে অদিতি আপনাকে ডেকেছি কারণ আমার মনে হয়েছে আপনার বাবা এবং মা’কে আপনার আরেকটু সময় দেয়া উচিৎ। কথা’টা ঠিক কিভাবে নেবেন জানি না, হয়তো অহেতুক নাক গলানোও মনে হতে পারে। কিন্তু আসলেই তাদের আরেকটু যত্ন দরকার, আরেকটু সময় দেয়া প্রয়োজন।

সত্যিই রাগ হয় অদিতির। আমান কতোটুকু জানে ওদের সম্পর্কে? অদিতির প্রচেষ্টা সম্পর্কে? না জেনে এভাবে উপদেশ দেয়া কেন!

– আমান, আমাদের সম্পর্কে আপনি কতোটুকু জানেন আমি জানি না। কিন্তু আপনি আমার বাবা মা’কে নিয়ে ভাবছেন, তাদের মঙ্গল কামনায় এই কথাগুলো বলছেন এজন্য আমি কৃতজ্ঞ। আরো কৃতজ্ঞ আমার বাবা মা’কে সময় দেয়ার জন্য। কিন্তু দেখুন আমান, চোখের দেখার বাইরেও একটা জগৎ আছে। এই যেমন আমি বাবা মা’কে সময় দিতে পারি না। কারণ আমাকে তাঁদের জন্যই, তাঁদের স্বপ্ন পূরণের জন্য ছুটতে হয়। আমার লজ্জা করছে যে এগুলো আপনাকে বলছি। হয়তো কখনোই বলতাম না, কিন্তু আপনি প্রসঙ্গ উঠানোতে বলছি। আমরা যে বাসায় থাকি সেটা ভাড়া বাসা। অথচ বাবার আজীবনের ইচ্ছা যে নিজেদের একটা টিনসেড হলেও বাড়ি হবে, একটা আঙ্গিনা থাকবে। তার পেনশনের সব টাকাই তো ভাইয়া নিজের ব্যবসায় লাগিয়ে আলাদা হয়ে দিব্যি নিজের মতো আছে। কিন্তু আমি রাত দিন এক করে ছুটে চলেছি এই স্বপ্ন পূরণে। মা তো বিয়ে সংসারের কথা বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে বাদ দিয়েছে কিন্তু আপনিই বলুন এই বয়স্ক শিশু দুইজনকে রেখে আমি কোথায় যাবো?

একটানা অনেক কথা বলে থামে অদিতি। ওর খুব বিরক্ত লাগছে। নিজের উপর নাকি আমানের উপর নাকি অফিশপে ঠিকমতো কাজ না হওয়া এসি’র উপর অদিতি তা বুঝতে পারে না। চুপ করে বসে থাকে। আমানও যেনো কিছুটা অপ্রস্তুত। চুপচাপ কফি শেষ করে।

– এবার তাহলে আসি, কফির জন্য ধন্যবাদ ।

আর কোন কথা না বলে, কোন উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে বের হয়ে যায় অদিতি৷ কফিটা কি বেশি তিতকুটে ছিলো? জিহবা, মন সব এমন তিতে হয়ে গেলো কেন!

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে