🔴মেমসাহেব (পর্ব :৮, ৯, ১০)🔴
– নিমাই ভট্টাচার্য
ইতিহাসের সে এক প্রাগৈতিহাসিক অধ্যায়ে কক্ষচ্যুত গ্রহের আকারে পৃথিবী মহাশূন্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। উদ্দেশ্যহীন হয়ে পৃথিবী কতদিন ঘুরপাক খেয়েছিল, তা আমার জানা নেই। জানা নেই কতদিন পর সে সূৰ্যকে কেন্দ্র করে আপনি কক্ষপথ আবিষ্কার করেছিল। তবে জানি প্রতিটি মানুষকেও এমনি উদ্দেশ্যহীন হয়ে মহাশূন্যে ঘুরপাক খেতে হয়। সময় কম-বেশী হতে পারে। কিন্তু কালের এই নির্মম রসিকতার হাত থেকে কেউ মুক্তি পায় না। আমিও পাই নি। তোমরাও তো পাও নি।
মেমসাহেবকে পাবার পর আমার সে অকারণ ঘুরপাক খাওয়া বন্ধ হল। ঠিকানাহীন চলার শেষ হলো। আপনি কক্ষপথ দেখতে পেলাম। দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়া বন্ধ হলো; দুনিয়াটাকে, জীবনটাকে বড় ভাল লাগল। তুমি তো জান আমি সব কিছু পারি; পারি না। শুধু কবিতা লিখতে। তাই কাব্য করে ঠিক বোঝাতে পারছি না।
বড়বাজার বা চিৎপুরের মোড়ের ফুলের দোকান দেখেছ? দেখেছ তো কত অজস্র সুন্দর সুন্দর ফুল বোঝাই করা থাকে দোকানগুলিতে? ঐ ভিড়ের মধ্যে এক একটি ফুলের সৌন্দৰ্য, বৈশিষ্ট্য যেন খুজে পাওয়া যায় না। কিন্তু ঐ দোকান থেকে সামান্য কটি ফুল কিনে একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে ফ্লাওয়ার-ভাস-এ রাখলে সারা ড্রইংরুমটা যেন আলোয় ভরে যায়। তাই না? হাওড়া ব্রীজের তলায়, জগন্নাথ ঘাটের পাশে মণ দরে বুড়ি বোঝাই করে রজনীগন্ধা বিক্ৰী হয়। কিন্তু সে দৃশ্য দেখা যায় না। তার চাইতে অর্গানের ওপর একটা লম্বা ফ্লাওয়ার-ভাসের মধ্যে মাত্র দু-চারটি স্টিক দেখতে অনেক ভাল লাগে, অনেক তৃপ্তি পাওয়া যায় মনে।
জগন্নাথ ঘাটের রজনীগন্ধার পাইকারী বাজার দেখে নিশ্চয়ই কোন কবির কাব্যচেতনা জাগবে না। কিন্তু প্ৰেয়সীরা অঙ্গে একটু রজনীগন্ধার সজ্জা অনেকের মনেই দোলা দেবে।
আমি রজনীগন্ধা না হতে পারি। কিন্তু ক্যাকটাস তো হতে পারি? মেমসাহেব সেই ক্যাকটাস দিয়ে জাপানীদের ঢং-এ চমৎকার গৃহসজা করেছিল। আমি আমিই থেকে গেলাম। শুধু পরিবেশ পরিবর্তনে আমার জীবন-সৌন্দর্যের প্রকাশ পেলে।,
ইডেন গার্ডেনের ধার দিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে আমরা দুজনে গঙ্গার ধারে হারিয়ে গেলাম। কয়েকটা বড় বড় জাহাজ পৃথিবীর নানা প্রান্ত ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গঙ্গাবক্ষে বিশ্রাম করছিল। ক্লান্ত আমিও নানা প্ৰান্ত ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গঙ্গাবক্ষে বিশ্রাম করছিল। ক্লান্ত আমিও মেমসাহেবের কাঁধে মাথা রেখে একটু বিশ্রাম করছিলাম।
মেমসাহেব আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে প্রশ্ন করল, এমনি করে কতদিন কাটাবে?
তুমি কি ঘর বাঁধার কথা বলছ?
সব সময় স্বাৰ্থপরের মত শুধু ঐ এক চিন্তা, মেমসাহেব মিহি সুরে আমাকে একটু টিল্পনি কাটল।
তুমি কি অন্য কিছু বলছ? আমি জানতে চাইলাম।
এবার মেমসাহেবের পালা। তুমি কি নিজের জীবন সম্পর্কে একটুও ভাববে না? শুধু মেমসাহেবকে ভালবাসলেই কি জীবনের সবকিছু মিটবে?
নিজের কথা ভাবতে ভাবতে কিছু হদিশ না পেয়েই তো তোমার ঘাটে এই ডিঙি ভিড়িয়েছি। এখন তো তোমার দায়িত্ব।
তাই বুঝি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
অন্ধকারটা একটু গাঢ় হলো। আমরা আর একটু নিবিড় হলাম। ঠিক সেই মুহুর্তে কোথা থেকে একটা চীনেবাদামওয়ালা হাজির হলো আমাদের পাশে। লজায় একটু সঙ্কোচবোধ করলাম দুজনেই। বাদাম চিবুবার কোন ইচ্ছা না থাকলেও ওর উপস্থিতিটা অসন্থ মনে হচ্ছিল বলে তাড়াতাড়ি দু’ প্যাকেট বাদাম কিনলাম।
আমি আবার একটু নিবিড় হলাম। বললাম, মেমসাহেব একটা গান শোনাবো?
এখানে নয়।
এখানে নয় তো তোমার কলেজের কমনরুমে বসে গান শোনাবো?
নির্বিকার হয়ে মেমসাহেব বলে, যখন আমরা কলকাতার বাইরে যাব, তখন তোমাকে অনেক গান শোনাব।
সেদিন মেমসাহেবের এই কথার কোন গুরুত্ব দিই নি। তেবেছিলাম এড়িয়ে যাবার জন্য ঐ কথা বলছে।
সপ্তাহ খানেক পরের কথা। দুজনে সন্ধ্যার পর বেলভেডিয়ারের ধার দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। মেমসাহেব হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করল, বেড়াতে যাবে?
কোথায়?
কলকাতার বাইরে?
কার সঙ্গে?
আমার সঙ্গে।।
সত্যি?
সত্যি।
আমি আর ধৈর্য ধরতে পারি না। সঙ্গে সঙ্গে জানতে চাইলাম, আজই যাবে?
তুমি কি কোনদিন সিরিয়াস হবে না?
তুমি কি চাও? আমি তোমার সঙ্গে ডিয়ারনেস এলাউন্স বা বাড়িভাড়া নিয়ে আলোচনা করি?
মেমসাহেব হাসে। দুজনে হাত ধরে হাটতে হাঁটতে আরো এগিয়ে যাই।
সেইদিন সন্ধ্যান্তেই আমার প্ল্যান হয়ে গেল। মেমসাহেবের কলেজ থেকে তিন-চার দল ছাত্রী আর অধ্যাপিকা তিন-চার দিকে যাবেন এডুকেশন্সাল টুরে। মেমসাহেবের যাবার কথা ঠিক থাকবে কিন্তু যাখে না। বাড়িতে জানবে মেমসাহেব কলেজের ছাত্রী আর সহকর্মীদের সঙ্গে বাইরে গেছে কিন্তু আসলে–
মেমবাহেব শুধু ইলাদিকে একটু টিপে দেবে। ইলাদি আবার মেজদির ক্লাশ ফ্রেণ্ড। সুতরাং ভবিষ্যতের জন্য একটু সতর্ক থাকাই ভাল।
কবে, কখন, কোথায় আমরা গিয়েছিলাম, সেসব কথা খুলে না। বলাই ভাল। জেনে রাখ, আমরা বাইরে গিয়েছিলাম। নগর কলকাতার লক্ষ লক্ষ মানুষের তিড়ের বাইরে মেমসাহেবকে পেয়ে আমি প্ৰায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিলাম।
তুমি হয়ত ভাবছ ফাস্ট ক্লাশ কম্পার্টমেন্টের কুপেতে করে আমরা দুজনে হনিমুন করতে বেরিয়েছিলাম। তা নয়। অত টাকা কোথায়? আমি তো মাত্র পনের টাকা নিয়ে বেরিয়েছিলাম। তবে আমার মেমসাহেব করুণাসাগর বিদ্যাসাগরের চাইতেও উদার ছিল। সেকেণ্ড ক্লাশেরই টিকিট কেটেছিল। গেস্টহাউসে দু’টো ঘর ভাড়া নিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, অযথা কেন খরচ করছি? একটা ঘর নিলেই তো হয়।
মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে মেমসাহেব বলেছিল, তুমি কি লাউঞ্জে রাত কাটাবে?
লাউঞ্জে?-না। তার চাইতে বরং ডাইনিং রুমের টেবিলে রাত কাটাব। কি বল?
আচ্ছা ওসব পরে বলব। ট্রেনের কম্পার্টমেণ্টে মেমসাহেবকে পাশে পেয়ে আমি যেন আর স্থির থাকতে পারছিলাম না। ইচ্ছা! করছিল, জড়িয়ে ধরি, আদর করি। তা সম্ভব ছিল না। যাত্রীদের সতর্ক দৃষ্টিকে যতদূর সম্ভব ফাঁকি দিয়ে মেমসাহেবকে পাশে পাবার দুর্লভ সুযোগ উপভোগ করার চেষ্টা করেছি। ও কখনো হোসেছে, কখনও চোখ টিপে ইশারা করেছে।
যখন একটু বাড়াবাড়ি করেছি, তখন বলেছে, আঃ। কি করছ?
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছি, এক্সকিউজ মী, আপনি আমাকে কিছু বলছেন?
আজ্ঞে আপনাকে? না, না, আপনাকে কি বলব?
থ্যাঙ্ক ইউ।
নো মেনশন।
আশপাশের ঘর-বাড়ি, বন-জঙ্গল, নদী-নালা পিছনে ফেলে। ট্রেনটা ছুটে চলে সামনের দিকে। আমাদের দুজনের মনটাও দৌড়তে থাকে ভবিষ্যতের দিকে। কত শত অসংখ্য স্বপ্ন উকি দেয় মনের মধ্যে। কত আশা, কত আকাঙ্ক্ষা রূপ নিতে চায়। ভবিষ্যতের সেই সব স্বপ্নকে ঘিরে।
নতুন কোন স্বপ্ন, নতুন কোন আশা আমার মনে আসে নি। চিরকাল মানুষ যা স্বপ্ন দেখেছে, যা আশা করেছে, আমি তার বেশী একটুও ভাবিনি। ভাবছিলাম, একদিন অনিশ্চয়তা নিশ্চয়ই শেষ হবে। মেমসাহেব কল্যাণীরূপে আমার ঘরে আসবে, আলো জ্বলে উঠবে আমার অন্ধকার ঘরে।
তারপর?
উপভোগ?
নিশ্চয়ই।
সম্ভোগ?
নিশ্চয়ই।
তবে ঐ সম্ভোগের মধ্যেই দ্বৈত জীবনের যবনিকা টানব না। দুজনে হাত ধরে এগিয়ে যাব। অনেক অনেক এগিয়ে যাব। দশজনের কল্যাণের মধ্য দিয়ে নিজেদের কল্যাণ করব। দশজনের আশীৰ্বাদ কুড়িয়ে আমরা ধন্য হবে।
ময়নার মত সুর করে মেমসাহেব ডাক দিল, শোন।
আমি ওর ডাক শুনেছিলাম। কিন্তু উত্তর দিলাম না। কেন? ওর ঐ শোন ডাকটা আমার বড্ড ভাল লাগত, বড্ড মিষ্টি লাগত। আমি মুখটা ঘুরিয়ে অন্যদিকে চাইলাম।
আবার সেই ময়নার ডাক, শোন।
ডাকছ?
হ্যাঁ।
মেমসাহেব কি যেন ভাবে, দৃষ্টিটা যেন একটু ভেসে বেড়ায় ভবিষ্ণুতের মহাকাশে। আমি ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসি আমার কাছে। ডাক দিই, মেমসাহেব!
মেমসাহেব সংক্ষিপ্ত সাড়া দেয়, কি?
আমাকে কিছু বলবে?
মেমসাহেব এবার ফিরে তাকায় আমার দিকে। ঘন গভীর মিষ্টি দৃষ্টি দিয়ে দেখে আমাকে।
আবার দু-চার মিনিট কেটে যায়। শুধু দুজনে দুজনকে দেখি।
একটা সত্যি কথা বলবে? মেমসাহেব এতক্ষণে প্রশ্ন করে।
বলব।
আবার মুহুর্তের জন্য মেমসাহেব চুপ করে। দৃষ্টিটা একটু সরিয়ে দিয়ে জানতে চায়, একদিন যখন আমরা দুজনে এক হবো, সংসার করব, তখনও তুমি আমাকে আজকের মত ভালবাসবে?
ইচ্ছা করল মেমসাহেবকে টেনে নিই বুকের মধ্যে। ইচ্ছা! করল। আদর ভালবাসায় ওকে স্নান করিয়ে দিয়ে বলি, সেদিন তোমাকে হাজার গুণ বেশি ভালোবাসব। কিন্তু পারলাম না। কম্পার্টমেন্টে আরো ক’জন যাত্রী ছিলেন। তাই শুধু মেমসাহেবের হাতটা টেনে নিয়ে বললাম, আমাকে নিয়ে কি আজও তোমার দুশ্চিন্তা হয়?
মেমসাহেব তাড়াতাড়ি দু’হাত দিয়ে আমার হাতটা চেপে ধরে। বলল, না, না। আমি জানি তুমি আমাকে অনেক অনেক বেশী ভালবাসবে। আমি জানি তুমি আমাকে সুখী করবে।
সত্যি?
সত্যি।
দোলাবৌদি, সে কদিনের কাহিনী আমার জীবনের আবিস্মরণীয় স্মৃতি। সে স্মৃতি শুধু অনুভবের জন্য, লেখার জন্য নয়। তাছাড়া অনেক দিন হয়ে গেছে। প্রতিটি দিনের প্রতিটি মুহুর্তের ইতিহাস মনে নেই। মনে আছে–
হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। কিসের যেন আওয়াজ ভেসে এলো কানে। প্ৰথমে ঠিক বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম মেমসাহেব দরজা নক করে ডাকছে, শোন। সেই ময়না পাখীর ডাক, শোন।
আমি শুনি কিন্তু জবাব দিই না। বেশ লাগে ঐ ডাকটা। কেমন যেন আদর-ভালবাসা আবেদন-নিবেদন, দাবী ইত্যাদি ইত্যাদির ককটেল থাকত ঐ ডাকে। তাই তো আমি তণ্ডামী করে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকি। বেশ বুঝতে পারছি ঘুমুবার সময় একলাই ঘুমিয়েছে কিন্তু আর পারছে না। এবার একটু ছুটে আসতে চাইছে আমার কাছে। হয়ত একটু আদর করতে চায়, হয়ত একটু আদর পেতে চায়। হয়ত আমার পাশে শুয়ে আমার হৃদয়ের একটু নিবিড় উষ্ণতা উপভোগ করতে চায়। হয়ত…
আবার দরজায় আওয়াজ! সঙ্গে সঙ্গে,…শোন…শুনছ?
আমি চীৎকার করে জিজ্ঞাসা করি, কে?
আমি। দরজা খোল।
বেশ জড়িয়ে জড়িয়ে উত্তর দিলাম, খুলছি।
একটু পরে গায় চাদরটা জড়িয়ে চোখ দু’টো প্ৰায় বন্ধ করা অবস্থায় দরজাটা খুলে দিলাম। চোখ দু’টো বন্ধ করা অবস্থাতেই আবার এসে ব্যপাং করে থাটের ওপর শুয়ে পড়লাম।
মেমসাহেব দরজাটায় পর্দাটা বেশ ভাল করে টেনে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, বাপরে বাপ! কি ঘুম ঘুঘুতে পার তুমি।
আমি ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকায় উত্তর দিলাম না। দেখলাম মেমসাহেব আস্তে আস্তে আমার কাছে এগিয়ে এলো। আমার চোখ দু’টো বন্ধ ছিল। কিন্তু ওর নিশ্বাস পড়া দেখে বেশ বুঝতে পারছিলাম যে কত নিবিড় হয়ে আমাকে দেখছিল। মুখে, কপালে হাত দিয়ে আদর করতে করতে জিজ্ঞাসা করল, ঘুমুচ্ছ?
আমি তবুও নিরুত্তর রইলাম। সজোরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে পাশ ফিরে শুলাম। মেমসাহেব আমার পাশে বসে বসে। অনেকক্ষণ আমাকে আদর করল। আমি আবার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে পাশ ফিরে ডান হাত দিয়ে মেমসাহেবকে জড়িয়ে ধরলাম। একটু অস্পষ্টভাবে ডাক দিলাম, মেমসাহেব।
এইত।
আমি আর কোন কথা বলি না।
মেমসাহেব বলে, শুনছ? কিছু বলবে?
আমি তবুও কোন জবাব দিই না। এমনি করে আরো কিছুক্ষণ কেটে যায়। তারপর মেমসাহেব একটু অভিমান করে বলে, তুমি কি জাগবে না? উঠবে না?
আমি হঠাৎ চোখ দু’টো খুলে স্বাভাবিকভাবে বলি, জাগব কিন্তু উঠব না!
মেমসাহেব আমার গালে একটা চড় মেরে বলে, অসভ্য কোথাকার। জেগে থেকেও কথার উত্তর দেয় না।
আমি শুধু বলি, আমি জেগে আছি জানলে কি অমন করে তুমি আমাকে আদর করতে? আবার অসভ্যতা? আমি আস্তে আস্তে মেমসাহেবকে কাছে আনি, বুকের মধ্যে টেনে নিই। একটু আদর করি, একটু ভালবাসি। মেমসাহেবকে একটু দেখে নিই। আদর-ভালবাসায় ওর চোখ দু’টো যেন আরো উজ্জ্বল হয়, গাল দু’টো যেন আরো একটু ফুলে উঠে, ঠোঁট দু’টো যেন কথা বলে।
তারপর?
বলতে পার দোলাবৌদি, তারপর কি হলো? দুষ্টুমি? হ্যাঁ, একটু করেছিলাম। বেশী নয়। শুধু ওর দুটি ওষ্ঠের ভাষা, ইঙ্গিত জেনেছিলাম, আর কিছু নয়। মেমসাহেব? মুখে কিছু বলে নি। চোখ বুজে। মুখ টিপে টিপে হাসছিল।
তারপর?
তারপর মেমসাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করল, গান শুনবে?
আমি বললাম, না।
বেশ করব আমি গান গাইব, তোমায় শুনতে হবে না।
মেমসাহেব ঘুরে বসল। কনুই-এ ভর দিয়ে হাতের ওপর মুখটা রেখে প্ৰায় আমার মুখের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তারপর খুব আস্তে আস্তে গাইল-মন যে কেমন করে মনে মনে, তাহা মনই জানে।
এমনি করেই শুরু হতো আমাদের সকাল। স্নান সেরে নটার মধ্যে ডাইনিং হলে গিয়ে মেমসাহেব ব্রেকফাস্ট খেয়ে আসত। কিন্তু আমি তখনও উঠতাম না। দুইনিং হল থেকে ফিরে এসে মেমসাহেব আমাকে একটা দাবড় দিত, ছি, ছি, তুমি এখনও ওঠনি?
একবার কাছে এস, তবে উঠব।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে মেমসাহেব বলে, না। আমি আর কাছে আসব না।
কেন?
কাছে গেলেই তুমি—
মেমসাহেব আর বলে না। আমি জিজ্ঞাসা করি, তুমি কি?
কি আবার? কাছে গেলেই তো আবার দুষ্টুমি করবে।
তাতে কি হলো?
ঐ টানা টানা ভ্রূ দুটো উপরে উঠিয়ে ও বলে, কি হলো? তোমার ঐ দাড়ির খোঁচা খেয়ে আমার সারা মুখটা এখনো জ্বলে যাচ্ছে।
আমি তিড়িং করে এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে মেমসাহেবকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরি। বলি, জ্বলে যাচ্ছে?
তবে কি!
বিষ দিয়ে বিষক্ষয় করে দিচ্ছি।
আবার অসভ্যতা?
আমি বাথরুম থেকে বেরুতে বেরুতেই মেমসাহেব আমার ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসে। আমি বলি, কি আশ্চৰ্য! একটা বেয়ারাকে বলতে পারলে না?
আজ্ঞে বেয়ারারা আপনার চাকর নয়। ন’টার পর ওরা ব্রেকফাস্ট সার্ভ করে না।
তাই বলে তুমি? যারা দেখল, তারা কি ভাবল বল তো?
ট্রে-টা নামিয়ে রেখে টোস্টে মাখন মাখাতে মাখাতে বলল, ভাবল আমার কপালে একটা অপদাৰ্থ কুঁড়ে জুটেছে।
বল দোলাবৌদি, এ কথার কি জবাব দেব? আমি জবাব দিতাম না। চুপটি করে ব্রেকফাস্ট খেয়ে নিতাম।
তারপর বারান্দায় দু’টো সোফায় বসে আমরা গল্প করতাম কিছুক্ষণ। কিছুক্ষণের জন্য একটু ঘুরে ফিরেও আসতাম। দুপুরবেলায় লাঞ্চ খাবার পর মেমসাহেব জিজ্ঞাসা করত, এখন একটু ঘুমোও।
কেন আজকে কি রাত্ৰি জাগবে?
আবার সেই গালে একটা চড়। আবার সেই মন্তব্য, অসভ্য কোথাকার।
দুপুরে ঘুমুতাম না। শুয়ে থাকতাম। আমার হাতটা ভুল করে একটু অবাধ্যতা করলে মেমসাহেব বলত, দয়া করে তোমার। হাতটাকে একটু সংযত কর।
কেন? আমি কি না বলিয়া পরের দ্রব্যে হাত দিতেছি?
পরের দ্রব্য না হইলেও আমি এখনও আপনার দ্রব্য হই নাই বলিয়া আপনি হাত দিবেন না। =
আমি চট করে উঠে পড়ে গায় জামাটা চাপিয়ে বেরুতে যাই। মেমসাহেব জানতে চায়, কোথায় যাচ্ছ?
বাজারে। কেন? মালা কিনতে, টোপর কিনতে।
মেমসাহেব হাসতে হাসতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, তাই বলে এই দুপুরে যেও না।
ও আমাকে টেনে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়। আমার পাশে কাত হয়ে শুয়ে শুয়ে বলে, এখনই যদি আমার জন্য এত পাগলামি কর, তবে ভবিষ্যতে কি করবে?
দেখ মেমসাহেব, রেশনের হিসাব মত চাল-গম বিক্ৰী করা চলতে পারে। কিন্তু ভালবাসা চলতে পারে না।
আমার কথা শুনে ও মুচকি মুচকি হাসে।
জান দোলাবৌদি, সমাজ-সংসার থেকে কটি দিনের জন্য আমরা দূরে চলে গিয়েছিলাম। ইচ্ছা করলে মুক্ত বিহঙ্গের মত সম্ভোগের মহাকাশে আমরা উড়ে বেড়াতে পারতাম। কিন্তু তা করিনি। মেমসাহেবকে অত কাছে পেয়ে, নিবিড় করে পেয়ে, স্বাধীনভাবে পেয়ে মাঝে মাঝে আমার চিত্ত চঞ্চল হয়েছে, শিরার মধ্যে দিয়ে উত্তেজনার বন্যা বয়ে গেছে, ন্যায়-অন্যায়ের সূক্ষ্ম বিচার-বুদ্ধি কখনও কখনও হারিয়ে গেছে কিন্তু তবুও শান্ত-স্নিন্ধ ভালবাসার ছোয়ায় মেমসাহেব আমাকে সংযত করে রেখেছে। প্রথম, কদিন ওকে কাছে পাবার সময় ওর এই সংযম, সংযত আচরণ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আমি হয়ত ওকে শ্রদ্ধাও করতে আরম্ভ করেছিলাম।
ভবিষ্যতের জন্য আমরা অনেক কিছু গচ্ছিত রাখলেও এই কটি দিনে অনেক কিছু পেয়েছিলাম। দেহের ক্ষুধা মিটাইনি। কিন্তু চোখের তৃষ্ণা, প্ৰাণের হাহাকার, মনের দৈন্য দূর হয়েছিল। আর? আর দূর হয়েছিল চিত্ত-চাঞ্চল্য ও মানসিক অস্থিরতা। আমার চোখের সামনে একটা সুন্দর শান্ত ভবিষ্যৎ জীবনের ছবি ফুটে উঠেছিল।
আর মেমসাহেব? আমার অনেক দুর্বলতার মধ্যেও মেমসাহেব আমার ভালবাসার গভীরতা উপলব্ধি করেছিল। অন্ধের যষ্টির মত আমার জীবনে তার অনন্য গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিল। শিক্ষিতাই হোক আর সুন্দরীই হোক, গরীব হোক বা ধনী হোক, মেয়েদের জীবনে এর চাইতে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে?
তাইতো হাসি, খেলা, গান ও রাত্ৰি জাগরণের মধ্য দিয়েও আমরা ভবিষ্যতের রাস্তা ঠিক করে নিয়েছিলাম। দুজনে মিলে প্ৰতিজ্ঞা করেছিলাম। শুধু কিছু হাসি আর খেলা করে জীবনটাকে নষ্ট করব না।
কলকাতা ফেরার আগের দিন রাত্ৰিতে মেমসাহেব সেই আমার দেওয়া শাড়ীটা পরেছিল। তারপর মাথায় কাপড় দিয়ে গলায় আঁচল জড়িয়ে আমাকে প্ৰণাম করেছিল। সেদিন আমার জীবনউৎসবের পরম মুহুর্তে কোন পুরোহিত মন্ত্র পড়েন নি, কোন কুলবধু শাখ বাজান নি, আত্মীয়-বন্ধু সাক্ষী রেখে মালা বদল করিনি। কিন্তু তবুও আমরা দুজনে জেনেছিলাম আমাদের দুটি জীবনের গ্ৰন্থিতে অচ্ছেদ্য বন্ধন পড়ল।
পর্ব ৮ শেষ 📌
🔴পর্ব :৯🔴
তোমার চিঠি পেয়েছি। একবার নয়, অনেকবার পড়েছি। তুমি হয়ত আমার মনের খবর ঠিকই পেয়েছ। কিন্তু আমার মনে অনেক দুঃখ থাকলেও আক্ষেপ নেই, বেদন থাকলেও ব্যর্থতার গ্লানি নেই। তার দীর্ঘ কারণ আজ বলব না, হয়ত তুমিও বুঝবে না। আমার এই কাহিনী যখন লেখা শেষ হবে, সেদিন আশা করি সবকিছু দিনের আলোর মত স্পষ্ট হবে।
তবে হ্যাঁ, আজ এইটুকু জেনে রাখা আমি জীবনে যে প্ৰেমভালবাসার ঐশ্বৰ্য পেয়েছি, তার তুলনা হয় না। হয়ত আরো অনেকে এই ঐশ্বৰ্য পেয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে আমার ঐশ্বর্যের কোন তুলনা করার মাপকাঠি আমার জানা নেই, প্রয়োজনও নেই। তবে এইটুকু নিশ্চয়ই জানি আমি পূর্ণ পরিপূর্ণ হয়েছি। আর জানি আমার এই ঐশ্বর্যের সঙ্গে পৃথিবীর কোন ধনীর কোন ঐশ্বর্ষের তুলনা হয় না। ধনী একদিন সমস্ত কিছু হারিয়ে দরিদ্র, তিখারী হতে পারে, সে ঐশ্বর্ষের হস্তান্তর হতে পারে, অপব্যয়, অপব্যবহার হতে পারে। কিন্তু আমার প্রাণ-মনের এই অতুলনীয় সম্পদ কোনদিন হারাবে না, হারাতে পারে না। যতদিন আমি এই পৃথিবীতে থাকিব, ততদিন ঐ ঘন কালো টান টানা গভীর দুটি চোখ আমার জীবন-আকাশে ধ্রুবতারার মত উজ্জল ভাস্বর হয়ে থাকবে। এই পৃথিবীর পঞ্চভূতের মাটিতে একদিন আমি মিশে যাব, আমার সমস্ত খেলা একদিন স্তব্ধ হয়ে যাবে, সবার কাছ থেকে আমি চিরতরে হারিয়ে যাব, কিন্তু আমার মেমসাহেব কোনদিন হারিয়ে যাবে না। আমার এই চিঠিগুলি যতদিন থাকবে, মেমসাহেবও ততদিন থাকবে। তারপর সে রইবে তোমার ও আরো অনেক অনেকের স্মৃতিতে। তারপরও ভারতবর্ষের অনেক শহরেনগরে গ্রামে গেলে মেমসাহেবের স্মৃতির স্পৰ্শ পাওয়া যাবে। উত্তর বঙ্গের বনানীতে, বোম্বাইএর সমুদ্রসৈকতে, বরফে-ঢাকা গুলমার্গের আশেপাশে নিস্তব্ধ রাত্ৰে কান পাতালে হয়ত মেমসাহেবের গান আরো অনেকদিন শোনা যাবে।
দোলাবৌদি, তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না, লিখতে পারব না। আমার মেমসাহেবের সবকিছু। জানাতে পারব না। আমার মনের ভাব, ভাষা, অনুভূতি। পৃথিবীর কত দেশ-দেশান্তর ঘুরেছি, কত অসংখ্য উৎসবে কত অগণিত মেয়ে দেখেছি। তাদের অনেককে কাছে পেয়েছি, নিবিড় করে দেখেছি। কতজনকে ভালও লেগেছে। কিন্তু এক’জনকেও পেলাম না যে আমার কাছে আমার মেমসাহেবের স্মৃতিকে স্নান করে দিতে পারে।
তুমি তো জান আমি বাচবিচার না করেই সবার সঙ্গে মেলামেশা করি। সমাজ সংসারের নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করেই মিশেছি অনেক মেয়ের সঙ্গে। রক্তকরবীর মত র্তাদের অনেকেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অনেকের রূপ-যৌবন লাবণ্য আমাকে মুগ্ধ করেছে, শিক্ষা-দীক্ষা-আদর্শ ভাল লেগেছে কিন্তু মুহুর্তের জন্যও আমার প্রাণের মন্দিরে নতুন বিগ্ৰহ প্ৰতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিনি। হেসেছি, খেলেছি, ঘুরেছি। অনেক মেয়ের সঙ্গে। আমার এই হাসি-খেলা নিয়ে তুমি হয়ত অনেকের কাছে অনেক কাহিনী শুনবে। দিল্লী ইউনিভার্সিটির বনানী রায়কে নিয়ে আজো ডিফেন্স কলোনীর অনেক ড্রইংরুমে আমার অসাক্ষাতে সরস আলোচনা হয়, আমি তা জানি। আমি জানি আমাদের লণ্ডন হাই কমিশনের থার্ড সেক্রেটারী অতসীকে নিয়ে আমার ব্ৰাইটন ভ্ৰমণকে কেন্দ্ৰ করে অনেক আরব্য উপন্যাসের কাহিনী বিলেত থেকে কলকাতার কফি হাউস পর্যন্ত গড়িয়েছে।
আমি কি করব বল? আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থাই এমন যে স্বামী-স্ত্রীর একটু স্বাধীন আচরণ আজও বহুজনে বরদাস্ত করতে পারেন না। সমাজ অনেক এগিয়েছে। সারা পৃথিবীর বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে আমরা অনেকেই মেলামেশা করছি কিন্তু রক্তের মধ্যে আজও অতীত দিনের সংস্কারের বীজ হয়ে গেছে। তাইতো ভাটপাড়ার কুপমণ্ডুক সমাজ থেকে হাজার মাইল দূরে বসেও দিল্লীর সফিসটিকেটেড বাঙালী গৃহিণীরা বনানীকে দুর্গাপূজার প্যাণ্ডেলে দেখলে আলোচনা না করে থাকতে পারেন না।
একটু কান পাতলে শোনা যাবে মিসেস দত্ত বলছেন, এই চন্দ্ৰিমা দ্ব্যাখ, দ্যাখ, বনানী এসেছে।
কই? কই?
ঐ তো।
একলা?
তইতো দেখছি।
চন্দ্ৰিমা একটু এদিক ওদিক দেখে বলে, ঐ তো সাদা হেরল্ড। রিপোর্টার সাহেব নিশ্চয়ই এসেছে।
বলাক সরকারও প্ৰায় ছুটে চলে আসে। চন্দ্ৰিমার কানে কানে বলে, দেখেছিস, মিসেস রিপোর্টার এসেছে।
অনেকক্ষণ দেখেছি?
বনানী এগিয়ে যায় প্ৰতিমার কাছে। হাত জোড় করে। প্ৰণাম করে। ইতিমধ্যে আমি পাশে এসে দাঁড়াই। বনানী গাড়িতে পার্সটা রেখে এসেছে; আমার কাছ থেকে একটা টাকা চেয়ে নিয়ে প্ৰণামী দেয়।
বলাকা, চন্দ্ৰিমা, মিসেস দত্ত ও আরো অনেকে তা দেখেন। আরো অনেক নবীন প্ৰবীণা দেখেন আমাদের।
বলাক বলে, যাই বলিস ভাই, দুজনকে বেশ ম্যাচ করে কিন্তু।
মিসেস দত্ত বলেন, ম্যাচ করলে কি হবে। ওরা তো আর বিয়ে করছে না, শুধু খেলা করছে।
চন্দ্ৰিমা বলে, না, না। নিশ্চয়ই বিয়ে করবে। তা নাহলে দুজনে মিলে এমন করে ঘোরাঘুরি করে।
আমরা দুজনে প্যাণ্ডেল থেকে বেরুবার জন্য এগিয়ে চলি। বনানীর সাইড-ভিউ বোধহয় বলাকার দৃষ্টি এড়াতে পারে না। তাইতো চন্দ্ৰিমাকে ফিসফিস করে বলে, যাই বলিস, সী হাজ এ ভেরী অ্যাট্রাকৃটিভ ফিগার?
বনানীর প্রশংসায় মিসেস দত্ত মুহুর্তের জন্য নিজের ফিগার সম্পর্কে সচেতন হয়ে পড়েন। শাড়ীর আঁচলটা আর একটু বেশী নিবিড় করে জড়িয়ে নেন। মনে মনে বোধহয় একটু ঈর্ষাও দেখা দেয়। তাইতো বনানীকে ছোট করার জন্য আমাকে একটু বেশী মৰ্যাদা দেন। বলেন, রিপোর্টারও তো কম হাণ্ডসাম নয়।
দূরে এক পুরোন বন্ধুকে দেখে বনানী নজর না করেই ডান দিকে ঘুরতে গিয়ে এক ভদ্রলোককে প্ৰায় ধাক্কা দিতে গিয়েছিল। আমি ওর হাত ধরে চট করে টেনে নিলাম।
বনানী শুধু বলল, থ্যাঙ্কস।
সান-গ্লাসের মধ্য দিয়ে দৃষ্টিটা একটু ঐ কোণার দিকে নিতেই বেশ বুঝতে পারলাম বনানীর হাত ধরার জন্যে অনেকের হাট অ্যাটাক হতে হতে হয় নি।
এসব আমি জানি। কি করি বল? সবার সঙ্গে আমি মিশতে পারি না। কিন্তু যাদের সঙ্গে মেলামেশা করি, তাদের সবার সঙ্গেই এমনি সহজ, সরল, স্বাভাবিকভাবেই মিশে থাকি। বনানী, অতসী। ও আরো অনেকেই একথা জানে। মেমসাহেব তো জানেই।
এই যে অতসী। যাঁরা জানেন না। তাঁরা কত কি কল্পনা করেন। আমাদের দুজনকে নিয়ে।
তুমি কি অতসীর কথা শুনেছি? ও যে জাস্টিস রায়ের একমাত্র কন্যা সে কথা নিশ্চয়ই জান। তারপর ওর মা হচ্ছেন অভারতীয়, আইরিশ মহিলা। সুতরাং সংস্কারের বালাই নেই, নেই অর্থের অভাব। লেখাপড়া শিখেছে পাবলিক স্কুলে, পরে বি-এ পাশ করেছে অক্সফোর্ড থেকে। এখন তো ফরেন সার্ভিসে।
অতসী যখন অক্সফোর্ডে পড়ে তখনই আমার সঙ্গে ওর। প্ৰথম পরিচয়। তার পরের বছর ও যখন দেশে ফেরে, তখন আমিও ইউরোপ ঘুরে দেশে ফিরছি। একই প্লেনে দুজনে লণ্ডন থেকে রওনা হই। পথে দুদিন বেইরুটে ছিলাম।
সেই দুটি দিন আমরা প্ৰাণভরে আন্ডা দিয়েছি। দিনের বেলায় বীচ। এ বসে, সন্ধ্যার পর সেন্ট জর্জ হোটেলের বার বা লাউঞ্জে বসে একটু আধটু ফ্রেঞ্চ ওয়াইন খেতে খেতে গল্প করেছি। দিল্লী রওনা হবার ঠিক আগের দিন গভীর রাত্রে অতসীর মাথায় ভূত চাপিল। বলল, চলুন, নাইট ক্লাব ঘুরে আসি।
এত রাত্ৰে?
হায়াটস রঙ ইন দ্যাটু?
নাইট ক্লাবগুলো তো গভর্নমেণ্ট অফ ইণ্ডিয়ার অফিস নয় যে দশটা-পাঁচটায় খোলা থাকবে। নাইট ক্লাব তো রাত্ৰেই খোলা থাকে।
অতসী আর একটি মুহুৰ্তও নষ্ট করতে রাজী নয় বলে, কাম অন। ফিনিশ ইওর গ্লাস।
চক্ষের নিমেষে বাকি শ্যাম্পেনটুকু গলা দিয়ে ঢেলে দিল অন্তরের অজানা গহবরে। ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু বাধ্য হয়ে আমিও শেষ করে উঠলাম। চলে গেলাম ব্লাক এলিফ্যান্ট!
পালামে মেমসাহেব এসেছিল আমাদের রিসিভ করতে। অতসী ওকে কি বলেছিল জান? বলেছিল, টোয়েন্টয়েথ সেঞ্চুরীর এক’জন জার্নালিস্ট যে এত কনজারভেটিভ হয়, তা আমি ভাবতে পারিনি।
মেমসাহেব একটু হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, কেন কি হয়েছিল?
মাই গড! কি হয় নি। তাই জিজ্ঞাসা কর। অতসী রায়ের ইনভিটেশনে নাইট ক্লাবে যেতে চায় না!
মেমসাহেব হাসতে হাসতেই একবার আমাকে দেখে নেয়। অতসী বলে, তুমি আর হাসবে না। যে অতসী রায়ের সঙ্গে লণ্ডনের ছোকরা ব্যারিস্টাররা এক কাপ কফি খেতে পেলে ধন্য হয়, সেই আমার সঙ্গে বেইরুটের ব্ল্যাক এলিফ্যাণ্টে বসে শ্যাম্পেন্ন খেতে দ্বিধা করে তোমায় এই অপদাৰ্থ প্রসপেকটিভ গার্ডিয়ান।
মেমসাহেব বাঁকা চোখে এক ঝলক আমাকে দেখে নিয়ে বলে, আই অ্যাম সরি অতসী। আই প্লীড গিল্টি…..
মেমসাহেবের গাল টিপে দিয়ে অতসী বলে, অত ভালবেসে না। ছোকরাটার মাথাটা খেলে।
যাই হোক সেবার ঢাকা থেকে লণ্ডন যাবার পথে প্ৰথমে কলকাতা, পরে দিল্লী এলো। কলকাতা থেকে সে যে মেমসাহেবকে নিয়ে এসেছে, তা জানতাম না। দিল্লী আসার খবরটাও আগে পাইনি। হঠাৎ একদিন সকালবেলায় অতসীর টেলিফোন পেয়ে চমকে গেলাম।
কি আশ্চৰ্য। আসার আগে একটা খবর দিলে না?
অতসী দুঃখ প্ৰকাশ করে, ক্ষমা চায়। শেষে একবার জরুরী কারণে তক্ষুনি হোটেলে তলব করে।
আমি কয়েক মিনিটের মধ্যেই ক্লারিজে হাজির হই। দোতলায় উঠেকরিডর দিয়ে একেরারে কোণার দিকে চলে যাই। দরজা নক করি।
কোন জবাব পেলাম না। আবার নক করলাম।
এবার উত্তর পাই, যাস্ট এ মিনিট।
দু’এক মিনিটের মধ্যেই অতসী দরজা খুলে অভ্যর্থনা করে। আদর করে ভিতরে নিয়ে যায়!
কি ব্যাপার? এবার যে একটা খবরও দিলে না?
বিলিভ মী, ইট অল হ্যাপেনড সাডেনলী। তাছাড়া কলকাতা থেকে বুকিং করতেই বড্ড ঝামালা পোহাতে হলো।
কদিন কলকাতায় ছিলে?
তিন দিন।
ডিড ইউ মীট মেমসাহেব?
মাই গড়। মেমসাহেব ছাড়া কি কোন চিন্তা নেই। আপনার মনে?
নিশ্চয়ই আছে। তবে আফটার মেমসাহেব।
হাত দিয়ে আমার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে অতসী জানতে চায়, আমিও তাই?
তুমি তো অন্য ক্যাটাগরীর।
অতসী কেমন যেন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। বলে, কেন, আমি কি আপনার মেমসাহেবের জায়গায়…
আমি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। শুধু বলি, অতসী আমার অনেক কাজ আছে। এখন চলি, পরে দেখা হবে।
অতসী সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। দু’হাত দিয়ে আমার দু’টো হাত চেপে ধরে। বলে, না, তা হবে না। আপনি এখন আমার কাছেই থাকবেন।
আমি অবাক হয়ে যাই। ভেবে কুলকিনারা পাই না। অতসীর এই বিচিত্র পরিবর্তনের কারণ। মুহুর্তের মধ্যে নারী-চরিত্রের বিচিত্রধারার নানা সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে নিলাম। ভাবলাম, মনের টান, না দেহের দাবী? বড়লোকের মেয়ের খামখেয়ালি নাকি…
অতসীকে নিয়ে আমার অন্ত শত চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলাম না। যা ইচ্ছে তাই হোক। আমি ফালতু ঝামেলায় জড়িয়ে না পড়লেই হলো।
আরো একটু চিন্তা করি। ডিপ্লোম্যাট হয়ে ডিপ্লোম্যাসী করছে না তো?
আমি বললাম, অতসী, ঘোড়ার গাড়ির একটা কোচোয়ানের হাতে ইমপালা দিয়ে খেলা করতে তোমার ভয় হচ্ছে না?
ওসব হেঁয়ালি ছাড়ুন। আই অ্যাম ফিলিং লোনলি, উড ইউ গিভ মী কম্পানী অর নট?
হোয়াই নট হ্যাভ বেটার কম্পানী?
আমার খুশী।
কিন্তু আমার তো খুশী নাও হতে পারে?
এক ঝলক অতসীকে দেখে নিলাম। দু’হাত দিয়ে অতসীর ডান হাতটা টেনে নিয়ে হাণ্ডসেক করে বললাম, গুড বাই!
আমি ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে করিডর দিয়ে হন।হন। করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম সিঁড়ির দিকে। হঠাৎ পিছন থেকে কানে ভেসে এলো, শোন।
থমকে দাঁড়ালাম। কিন্তু স্বপ্ন ভেঙে যাবার ভয়ে পিছন ফিরলাম না, মনের ভুল?
শোন?
আমার জীবন-রাগিণীর সুরকারের ঐ কণ্ঠস্বর দ্বিতীয়বার শোনার পর আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলাম না। পিছন ফিরলাম।
কি আশ্চৰ্য! মেমসাহেব!
অতসীর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসতে হাসতে মেমসাহেব ডাক দিল, এই শোন…
আমি প্ৰায় দৌড়ে গেলাম। মেমসাহেব আমাকে অভ্যর্থনা করার জন্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়েই রইল। আমি অবাক বিস্ময়ে বললাম, তুমি।
সেই শান্ত, স্নিগ্ধ, মিষ্টি গলায় মেমসাহেব বলল, কি করব বল, অতসী জোর করে নিয়ে এলো।
তুমি বেশ কল্পনা করতে পারছি তারপর ক্লারিজ হোটেলের ঐ কোণার ঘরে কি কাণ্ড হলো! প্ৰথম আনন্দে ও কৃতজ্ঞতায় আমি অতসীকে জড়িয়ে ধরে বললাম, টেল মী অতসী হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?
অতসী বলল, বেশী কিছু চাইব না। শুধু অনুরোধ করব। আগামী সাত দিন এদিকে এসে দুটি যুবতীকে বিরক্ত করবেন না।
প্ৰতিজ্ঞা করছি বিরক্ত করব না, তবে তোমাদের আনন্দ দেবার জন্য, সুখী করার জন্য নিশ্চয়ই আসব।’
মেমসাহেব টিল্পানী কেটে বলল, অতসী ওসব কল্পনাও করিস না। পুরুষদের যদি আত সংযম থাকত। তাহলে পৃথিবীটা সত্যি পাল্টে যেত।
আমি মেমসাহেবকে বলি, বিশ্বামিত্রের মত কাজকর্ম নিয়ে আমি তো বেশ ধ্যানমগ্ন ছিলাম। কিন্তু তুমি মেনকা দেবী এক হাজার মাইল দূরে নাচতে এলে কেন?
তারপর ঐ ঘরে বসেই তিনজনে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছিলাম। মেমসাহেব বলল, জান, অতসীর সঙ্গে আমার কি বাজী হয়েছে?
কি?
অতসী বলে, না, না, কিছু না।
আমি বলি, থাক মেমসাহেব, এখন বলে না। অতসী ঘাবড়ে গেছে।
অতসী কফির পেয়ালা নামিয়ে রেখে বলল, তাহলে আমিই বলি শুনুন, বাজী হয়েছিল যে আমি যদি আপনাকে ভোলাতে পারি। তাহলে কাজলদি আমাকে একটা শাড়ী প্ৰেজেণ্ট করবে। আর আমি হেরে গেলে আমি কাজলদিকে একটা শাড়ী প্রেজেন্ট করব।
এতক্ষণে বুঝলাম অসতী কেন আমার সঙ্গে অভিনয় করেছিল। আমি বললাম, অসতী তোমার কাজল দিকে তোমার শাড়ী কিনে দিতে হবে না। তুমি যে তোমার কাজলদিকে টেনে আনতে পেরেছ, সেজন্য তুমিই তো প্ৰথমে শাড়ী পাবে।
আমি দুজনকেই শাড়ী কিনে দিয়েছিলাম। দুজনেই খুশী হয়েছিল। আমিও খুশী হয়েছিলাম। একটা সপ্তাহ যেন স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে কেটে গেল।
অতসী আমাদের দুজনকে সত্যি ভালবাসে। ও মেমসাহেবকে কাজলদি বলে কেন জান? অতসী বলত মেমসাহেবের চোখ দুটিতে ইয়ং ভগবান সযত্নে কাজল মাখিয়ে দিয়েছেন। সেজন্যই অতসী। মেমসাহেবকে কাজলদি বলত। ভারী চমৎকার নাম, তাই না?
যাই হোক এদের আমি ভালবাসি, আমি এদের কল্যাণ কামনা করি। ওরাও আমার মঙ্গল কামনা করে। আমি ওদের প্রতি কৃতজ্ঞ কিন্তু মেমসাহেবের স্মৃতিকে মান করতে পারে না কেউ। পারবে কেন বল? আমার ভবিষ্যতের জন্য মেমসাহেব যে মূলধন বিনিয়োগ করেছিল, তার কি কোন তুলনা হয়? হয় না।
তাছাড়া আরো একটা ব্যাপার আছে। আমার জীবনের সেই অমাবস্যার রাতে শুধু মেমসাহেবই এসেছিল আমার পাশে। প্ৰেম দিয়েছিল, ভালবাসা দিয়েছিল, অভয় দিয়েছিল আমাকে। নিজের প্ৰাণের প্রদীপের মঙ্গল-আলো দিয়ে আমাকে সেই তিমির রাত্রি থেকে প্ৰভাতের দ্বারদেশে এনে দিয়েছে আমার সেই মেমসাহেব। তাইতো তার সে স্মৃতিকে মান করার ক্ষমতা শত সহস্ৰ বনানী বা অতসীর নেই।
সেবার বাইরে থেকে ঘুরে আসার পর মেমসাহেব আমাকে বলল, তোমার কাজকর্ম সম্পর্কে নতুন কিছু ভাবনি?
ভেবেছি বৈকি।
কি ভেবেছ?
ভেবেছি যে কলকাতার মায়া কাটিয়ে একটু বাইরে চেষ্টা করব।
তবে করছি না কেন?
কিছু অসুবিধা আছে বলে।
মেমসাহেব ছাড়ার পাত্রী নয়। তাছাড়া আমার জীবন সম্পর্কে উদাসীন থাকা আজ আর তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাইতো একদিন অপ্ৰত্যাশিতভাবে মেমসাহেব আমার হাতে দুশো টাকা গুঁজে দিয়েঃ বলল, একবার দিল্লী বা বোম্বে থেকে ঘুরে এসো। হয়ত একটা কিছু জুটেও যেতে পারে।
প্ৰথমে টাকাটা নিতে বেশ সঙ্কোচ বোধ হচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিয়েছিলাম। কারণ আমি জানতাম আমার কল্যাণই ওর কল্যাণ। সুতরাং আমার জন্য শুধু দুশো টাকা কেন, আরো অনেক কিছু সে হাসি মুখে দিতে পারে। তাছাড়া আমার কল্যাণ যজ্ঞে তার আহুতি প্ৰত্যাখ্যান করার সাহস আমার ছিল না। তবুও টাকাটা হাতে করে বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলাম।
কিছুক্ষণ পরে মেমসাহেব জিজ্ঞাসা করল, কি ভাবছ?
না, কিছু না।
তবে এমন চুপ করে রইলে?
এমনি।
মেমসাহেব আমার হাতটা টেনে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে বলল, আমি বলব তুমি কি ভাবছ?
বলো।
সত্যি বলব?
নিশ্চয়ই।
আমার টাকা নিতে তোমার লজ্জা করছে, অপমানবোধ হচ্ছে। তাই না?
না, না, তা কেন হবে। আমি উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করি।
মেয়েদের মন আমাদের চাইতে অনেক সতর্ক, অনেক হুশিয়ার। মেমসাহেব বলে, স্বীকার করতে লজ্জা করছে?
আমি কোন উত্তর দিই না। চুপ করেই বসে থাকি। মেমসাহেবও অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল।
মেমসাহেব। আবার শুরু করে, তুমি এখনও আমাকে ঠিক আপনি বলে ভাবতে পার না, তাই না?
আমি তাড়াতাড়ি মেমসাহেবের কাছে এগিয়ে যাই। ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলি, ছিছি, মেমসাহেব, ওকথা কেন বলছ?
একটু থামি।
আবার বলি, তোমার চাইতে আপন করে আর কাউকেই তো পাইনি।
আপন ভাবলে আজ তোমার মনে এই দ্বিধা আসত না।
আমি আরো কিছু সাস্তুনা দিলাম। কিন্তু একটু পরে খেয়াল করলাম। মেমসাহেবের চোখে জল।
তাড়াতাড়ি মেমসাহেবকে বুকের মধ্যে টেনে নিলাম। চোখের জল মুছিয়ে দিলাম। একটু আদরও করলাম। শেষে ওর ফোলা ফোলা গাল দু’টো চেপে বললাম, পাগলী কোথাকার।
মেমসাহেব আমার কোলের মধ্যে শুয়ে রইল। কিন্তু তবুও স্বাভাবিক হতে পারল না। কিছু পরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলল, তোমার এত কাছে এসেও তোমাকে পাব না, তা কল্পনা করতে পারিনি।
লক্ষ্মীটি মেমসাহেব আমার! তুমি দুঃখ করে না।
মেমসাহেব উঠে বসল। একটু স্থির দৃষ্টিতে চাইল আমার দিকে। মুহুর্তের জন্য চিন্তার সাগরে ডুব দিয়ে কোথায় যেন তলিয়ে গেল। তারপর বলল, আমাদের জীবনে সংস্কারের একটা বিরাট ভূমিকা আছে, তাই না?
হঠাৎ একথা বলছ?
ঠোঁটের কোণে একটু বিদ্রূপের হাসি এনে মেমসাহেব বলে, অপরিচিত দুটি ছেলে-মেয়েকে কলাতলায় বসিয়ে একটু মন্ত্র পড়ালেই তারা কত আপন হয়। ঐ সংস্কারটুকু ছাড়া যত কাছেই আসুক না। কেন, দুটি ছেলেমেয়ে ঠিক আপন হতে পারে না।
তারপর আমার দিকে ইশারা করে জিজ্ঞাসা করে, তাই না? তুমি আমাকে সন্দেহ করছ? আমাকে অপমান করছি? ছি, ছি, তোমাকে অপমান করব? শুধু বলছিলাম যে আমি যদি তোমার বিবাহিতা স্ত্রী হতাম। তাহলে আমার গয়না বিক্ৰী করে তোমার মদ্যপান বা যত্রতত্র গমনের অধিকার থাকত, কিন্তু…।
আমি তাড়াতাড়ি ওর মুখটা চেপে ধরে বলি, আর বলে না। মন্ত্র না পড়লেও তুমি আমার স্ত্রী, আমি তোমার স্বামী।
মেমসাহেব আমার বুকের মধ্যে লুটিয়ে পড়ল। একটু পরে গলায় আঁচল দিয়ে আমার পায়ে মাথা রেখে প্ৰণাম করল।
চাঁদটা হঠাৎ একটু মেঘে ঢাকা পড়ল। আর সেই অন্ধকারের সুযোগে আমি–
মেমসাহেব সঙ্গে সঙ্গে দাবিড় দিয়ে বলল, আবার অসভ্যতা। হেস্ট্রিংস থেকে এগিয়ে এসে আউট্রাম ঘাটের পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে আমরা আবার মিশে গেলাম নগর কলকাতার জনসমুদ্রে।
কিন্তু জান দোলাবৌদি, সে রাত্রে আনন্দে আর আত্মতৃপ্তিতে ঘুমুতে পারিনি। তোমার জীবনেও তো এমনি দিন এসেছিল। এবার কলকাতা গেলে সেদিনের কাহিনী না শোনালে তোমার মুক্তি নেই।
পর্ব ৯ শেষ 📌
🔴পর্ব :১০🔴
তুমি তো জান জীবনের এক একটা বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে মানুষেরও এক একটা রূপ, চরিত্র দেখা দেয়। যে ছেলেমেয়ের রাত ন’টার পর ঘুমে ঢুলতে থাকে, পরীক্ষার আগে তারাই নির্বিবাদ রাত দেড়টা-দু’টো অবধি পড়াশুনা করে। বিয়ের আগে যে মেয়ের রাত জাগতে পারে না, শুনেছি বিয়ের পর তারা নাকি ঘুমুতেই চায় না। তাই না? কেন সন্তানের মা হবার পর? ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও মায়ের দল জেগে থাকেন। দেহটা ঘুমের কোলে লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু মন? অতন্দ্ৰ প্রহরীর মত সারা রাত সে সন্তানকে পাহারা দেয়। সামান্য কটি মাসের ব্যবধানে কিভাবে একটা প্ৰমত্ত কুমারী শান্ত, স্নিগ্ধ কল্যাণী জননী হয়। সে কথা ভাবলেও আশ্চৰ্য লাগে।
মানুষের চরিত্রের আরো কত বিচিত্র পরিবর্তন হয়। সে পরিবর্তনের ফিরিস্তি দিতে গেলে মানব-সভ্যতার একটা ছোটখাটো ইতিহাস লিখতে হবে। তাছাড়া মনুষ্য-চরিত্রের এসব মামুলি কথা তোমাকে লেখার কোন প্রয়োজনও নেই। সেদিন গঙ্গার ধারে মেমসাহেবের কথা শুনে আর চোখের জল দেখে আমারও এক আশ্চৰ্য পরিবর্তন হলো। ঘর-কুনো মধ্যবিত্ত বাঙালীর ছেলে হয়ে কলকাতার ঐ গণ্ডিবদ্ধ জীবনের মধ্যে বেশ ছিলাম। মেমসাহেবের প্রেমের নেশায় নিজের কর্মজীবন সম্পর্কে বেণু উদাসীন হয়ে পড়েছিলাম।
সেদিন অকস্মাৎ মেমসাহেবের ভালবাসার চাবুক খেয়ে আমি চিন্তিত না হয়ে পারলাম না। ধুতি-পাঞ্জাবি আর কোলাপুরী চটি পরে জামাই সেজে মেমসাহেবের সঙ্গে প্রেম করলেই যে জীবনের সব কিছু প্ৰয়োজন মিটবে না, মিটতে পারে না সে কথা বোধ হয় সেদিনই প্ৰথম উপলব্ধি করলাম। তাছাড়া আর একটা উপলদ্ধি হলে আমার। মেমসাহেব আমাকে তালবাসে, আমাকে প্ৰাণমন দিয়ে কামনা করে। সে জানে একদিন আমারই হাতে তার সিথিতে সীমন্তিনী সিদুর উঠবে, আমার দীর্ঘায়ু কামনায় হাতে শাখা পারবে; সে জানত আরো অনেক কিছু। জানত, সে একদিন আমার সন্তানের জননী হয়ে সগর্বে পৃথিবীর সামনে দাঁড়াবে।আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার
সারা দুনিয়ার সমস্ত মেয়ের মত সেও ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল তার স্বামীকে কেন্দ্র করে। কিন্তু যৌবনের কালবৈশাখীর ধূলি ঝড়ে মেমসাহেবের স্বচ্ছ দৃষ্টি হারিয়ে যায় নি, ভবিষ্যতের স্বপ্ন বাস্তবের মাটি ছেড়ে আরব্য উপন্যাসের অলীক অরণ্যে পালিয়ে যায় নি। তাইতো সে চেয়েছিল তার ভালবাসায় আমার জীবন ভরে উঠুক। সে চায় নি। পৃথিবীর অসংখ্য কোটি কোটি স্বামী-স্ত্রীর দীর্ঘ তালিকায় শুধুমাত্র আর দুটি নামের সংযোজন।
তাইতো সেদিন ফেরার পথে মেমসাহেব আমাকে অন্যমনস্ক দেখে ডাকল, শোন।
আমি নিরুত্তর রইলাম। মেমসাহেব আমার পাশে এসে হাতটা ধরে ডাকল, শোন।
বল।
রাগ করেছ?
রাগ করব কেন?
আমাকে ছেড়ে তোমাকে বাইরে যেতে বললাম বলে।
না, না।
আমরা দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চললাম। মেমসাহেব। আবার শুরু করে, আমার সর্বস্ব কিছু দিয়েও যদি তোমার সত্যকার কল্যাণ করতে না পারি, তাহলে আমি কি করলাম दव्।’
একটু থামে। আবার বলে, তুমি শুধু আমার স্বামী হবে, শুধু আমিই তোমাকে মর্যাদা দেব, ভালবাসাব, তা আমি চাই না। আমি চাই তুমি আমাদের দুজনের গণ্ডির বাইরেও অসংখ্য মানুষের ভালবাসা পাও, তাঁদের স্নেহ-ভালবাসা পাও, তাদের আশীৰ্বাদ পাও।আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার
আবার একটু থামে, একটু হাসে। তারপর ফিস ফিস করে বলে, কত মেয়ে তোমাকে চাইবে অথচ শুধু আমি ছাড়া আর কেউ তোমাকে পাবে না।
হাত দিয়ে আমার মুখটা ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ভাবতে পাের, তখন আমার কি গৰ্ব, কি আনন্দ, কি আত্মতৃপ্তি হবে?
কি উত্তর দেব? আমি শুধু হাসি। বাসায় ফিরে অনেক রাত অবধি অনেক কিছু ভাবলাম। পরের কটা দিন নানা জায়গায় ঘুরে ফিরে নিজেও কিছু টাকা যোগাড় করলাম। বাইরের খবরের কাগজ সম্পর্কে কিছু কিছু খবরও জেনে নিলাম।
তারপর একদিন সত্যি সত্যিই আমি মাদ্রাজ মেলে চড়লাম। মেমসাহেব আমাকে বিদায় জানাতে এসেছিল। বলল, আমার মনে হয় তোমার নিশ্চয়ই কিছু হবে। তবে না হলেও ঘাবড়ে যেও না। সারা দেশে তো কম কাগজ নেই। আরো দু-চার জায়গায় ঘোরাঘুরি করলে কোথাও না কোথাও চান্স পাবেই।
আমি নিরুত্তর রইলাম। সামনের লাল আলো, সবুজ হলো, গার্ড সাহেবের বাঁশি বেজে উঠল।
মেমসাহেব বলল, সাবধানে থেকে। যেখানে সেখানে যা তা খেও না…চিঠি দিও।
আমি মুখে কিছু বললাম না। শুধু মেমসাহেবের মাথায় হাত দিয়ে আশীৰ্বাদ করলাম।
মাদ্রাজ মেলের কামরায় বসে হঠাৎ পুরানো দিনের কথা মনে হলো।…
রবিবার সকাল। আটটা কি সাড়ে আটটা বাজে। ঘুম ভেঙে গেলেও তন্দ্ৰাচ্ছন্ন হয়ে তখনো চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলাম। আমাদের সিনিয়র সাব-এডিটর শিবুদা এসে হাজিরা। ঘরে ঢুকেই নির্বিবাদে চাদরটা টান মেরে বললেন, ছি, ছি, এখনও ঘুমুচ্ছিস?
আমি বললাম, না, না, ঘুমুচ্ছি কোথায়। এমনি শুয়ে আছি। শিবুদা উপদেশ দেন, এত বেলা অবধি ঘুমোলে কি জীবনে কিছু করা যায়।
তবে রে। আমি প্ৰায় লাফ দিয়ে উঠে পড়ি। বলি, আচ্ছা! শিবুদা, কর্পোরেশনের যেসব কর্মচারীরা শেষ রাত্তিতে উঠে। গ্যাসপোস্টের আলো নিবিয়ে বেড়ায় আর রাস্তায় জল দেয়, তাদের ভবিষ্যৎ কি খুব উজ্জল?
শিবুদা দাবড় দেয়, তুই বড্ড বাজে বকিস। এই জন্যই তোর কিছু হবে না।
একটু আগে বললে, বেলা করে ঘুমুবার জন্য, এখন বলছ বেশী কথা বলার জন্য আমার কিছু…
আঃ তুই থামবি না শুধু শুধু তর্ক করবি?
উঠে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যে তৈরি হয়ে খোকার দোকান থেকে দুকাপ চা নিয়ে শিবুদার সম্মুখে হাজির হলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর শিবুদা, কি ব্যাপার? হঠাৎ এই সাত-সকালে?
শিবুদা নীল সুতোর লম্বা বিড়িটায় একটা টান মেরে সারা ঘরটা দুৰ্গন্ধে ভরিয়ে দিল। বলল, চল, একটা ইণ্টারেস্টিং লোকের কাছে যাব।
কার কাছে?
আগে চল না, তারপর দেখবি।
শিবুদার সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। সুতরাং অযথা সময় নষ্ট না করে . শিবুদার অনুসরণ করলাম। ট্রাম-বাসে উঠলাম, নামিলাম। কবার মনে নেই, তবে দু-তিনবার তো হবেই। তারও পরে পদব্ৰজে অলি-গলি দিয়ে বেশ খানিকটা। আর একটু এগিয়ে গেলে নিশ্চয়ই মহাপ্ৰস্থানের পথ পেতাম। কিন্তু সেই মুহুর্তে শিবুদা বলল, দাঁড়া, দাঁড়া, আর এগিয়ে যাস না।
একটা ভাঙা পোড়োবাড়ির মধ্যে ঢুকেই শিবুদা হঁক দিল, মধুদা।
উপরের বারান্দা থেকে একটা ছোট্ট মেয়ে জবাব দিল, শিবুকাকু। বাবা উপরে।
আমরা সোজা তিনতলার চিলেকোঠায় উঠে গেলাম। মধুদাকে দেখেই বুঝলাম, তিনি জ্যোতিষী। কিন্তু পেশায় ঠিক সাফল্য লাভ করতে পারেন নি।
মধুদার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন শিবুদা।
মধুদা কাগজপত্র সরাতে সরাতে বললেন, এর মধ্যেই একটু কষ্ট করে বসুন ভাই।
বসলাম। শিবুদ-মধুদা প্ৰায় ঘণ্টাখানেক ধরে শনি-মঙ্গল-রাহুকেতু নিয়ে এমন আলোচনা করলেন যে, আমি তার এক বর্ণও বুঝলাম না।
ঘণ্টাখানেক পরে শিবুদার অনুরোধে মধুদা আমার জন্ম সনতারিখ ইত্যাদি ইত্যাদি জেনে নিয়ে চটপট একটা ছক তৈরি করে ফেললেন। একটু ভাল করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, বেশ छाल।
শিবুদা প্রশ্ন করেন, ভাল মানে? মধুদা মনে মনে হিসাব-নিকাশ করতে করতেই জবাব দেন, ভাল মানে ভাল; তবে বেশ কাঠ-খড়ি পোড়াতে হবে।
নাকে একটু নস্য দিয়ে কর গুনতে গুনতে বলেন, তাছাড়া একটু বিলম্বে উন্নতির যোগ।
শিবুদা ছকটার ওপর ঝুকে পড়ে বলেন, হ্যাগো মধুদা, এর যে ত্রিকোণে মঙ্গল।
তবে নবমে নয়, পঞ্চমে। তবুও বেশ ভাল ফল দেবে।
মধুদা সেদিন অনেক কথা বলেছিলেন। আজ সবকিছু মনে নেই। তবে ভুলিনি একটি কথা। বলেছিলেন, শুক্ৰ স্থানটি বড় ভাল। কোন মহিলার সহায়তায় জীবনে উন্নতি হবে।
সেদিন কথাটি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আজ মাদ্রাজ মেলের কামরায় বসে কথাটা মনে না করে পারলাম না। আগে কোনদিন কল্পনা করতে পারিনি। আমার জীবনের রুক্ষ প্ৰান্তর মেমসাহেবের স্রোতস্বিনী ধারায় ধন্য হবে। নাটক-নতেলে এসব সম্ভব হতে পারে। কিন্তু আমার জীবনে? নৈব নৈব চ।
মাদ্রাজ মেলের কামরায় বসে মনে হলো মেমসাহেবের স্বপ্ন, সাধনা, ভালবাসা নিশ্চয়ই একেবারে ব্যর্থ হতে পারে না। সত্যি আমার মাদ্রাজ যাওয়া ব্যর্থ হলো না। সাদার্ন একসপ্রেসের এডিটর বললেন, কাগজে স্পেসের বড় অভাব। কলকাতার স্পেশ্যাল স্টোরি ছাড়া কিছু ছাপার স্পেস পাওয়াই মুস্কিল। তাইতো কলকাতায় ঠিক ফুলটাইম লোকের দরকার নেই।আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার
আমি মনে মনে দশ হাত তুলে ভগবানকে শতকোটি প্ৰণাম জানালাম। মাসে মাসে দেড়শ টাকা। আনন্দে প্ৰায় আত্মহারা হয়ে পড়লাম। দৌড়ে মাউণ্ট রোড টেলিগ্ৰাফ অফিসে গিয়ে মেমসাহেবকে আর্জেণ্ট টেলিগ্ৰাম করলাম, মিশন সাকসেসফুল রিমেমবারিং ইউ স্টপ স্টাটিং টুমরো মাদ্রাজ-মেল।
হাওড়া স্টেশনে মেমসাহেব আমাকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল, আর বেশী আড্ডা দেবে না। মন দিয়ে কাজ করবে।
নিশ্চয়ই, তবে—
বাঁকা চোখে মেমসাহেব বলে, তবে মানে?
সাত দিন পরে কলকাতা ফিরেই কাজ শুরু করবো?
তবে কি করবে?
একটা দিন অন্তত তোমাকে…
মেমসাহেব হাসতে হাসতে বলে, এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা…
শুধু আমার নয়, মেমসাহেবেরও তো ইচ্ছা করে আমার কাছে আসতে, প্ৰাণভরে আমাকে আদর করতে। তাছাড়া এই কদিনের আদর্শনের জন্য তার মনের মধ্যে অনেক ভাব, ভাষা পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছিল। কলকাতার এই জেলখানার বাইরে একটু মুক্ত আকাশের তলায় আমাকে নিবিড় করে কাছে পাবার জন্য। ওর মনটাও আনচান করছিল। ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। আমার নতুন জীবনের দ্বারদেশে আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। তাইতো আমার কাছ থেকে একটু ইঙ্গিত পেয়েই বিনা প্ৰতিবাদে প্ৰস্তাবটি মেনে নিল।
জানি তোমার মাথায় যখন একবার ভূত চেপেছে তখন কিছুতেই ছাড়বার পাত্ৰ তুমি নও, মেমসাহেব মন্তব্য করে।
তাই বুঝি, আমি বলি। তোমার যেন কোন কামনা-বাসনা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলে কোন কিছু নেই।
একটি দিনের জন্য আমরা দুজনে আবার হারিয়ে গেলাম। কলকাতার লক্ষ লক্ষ মানুষের কেউ জানল না গঙ্গা যেখানে সাগরের দিকে উদ্দামবেগে ছুটে চলেছে, যেখানে সমস্ত সীমা অসীম হয়ে গেছে, বন্ধন যেখানে মুক্তি পেয়েছে, সেই কাকদ্বীপের অন্তবিহীন মহাশূন্যে আমাদের দুটি প্রাণবিন্দু বিলীন হয়ে গেল।
মেমসাহেব আমার বুকের মধ্যে আত্মসমৰ্পণ করে বলল, আমি জানি তুমি এমনি করে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবে।
তুমি জান?
হ্যাঁ।
কেমন করে জানলে?
খবরের কাগজ বলতে তুমি যে পাগল সে কথাটা কি আমি জানি না? তারপর বেশ গর্ব করে মেমসাহেব বলল, খবরের কাগজকে না। তালবাসলে এমন পাগল কেউ হতে পারে না।
তাতে কি হলো?
কিছু হয় নি, মেমসাহেব বোধ করি আর আমার প্রশংসা করা সমীচীন মনে করে না।
একটা দমকা ঝড়ো হাওয়া এলো। সামনের সমুদ্রমুখী ভাগীরথীর অনন্ত জলরাশি ফুলে ফুলে নাচানাচি শুরু করে। ভাগীরথী যেন আরো তেজে, আরো আনন্দে সমুদ্রের দিকে দৌড়াতে লাগল।
মেমসাহেব উঠে বসে বলে, এই শান্ত গঙ্গা হিমালয়ের কোল থেকে প্ৰায় হাজার দেড়েক মাইল চলাবার পর সমুদ্রের কাছাকাছি এসে কত বিরাট, কত বেশী প্ৰাণচঞ্চল। মানুষও ঠিক এমনি। সঙ্কীর্ণ গণ্ডি থেকে বৃহত্তর জীবনের কাছে এলে মানুষ অনেক উদার, অনেক প্ৰাণচঞ্চল হয়। তাই না?
আমি চুপ করে থাকি। কোন কথা না বলে মেমসাহেবের উদার গভীর চোখ দু’টোকে দেখি।
মেমসাহেব খোপাটা খুলে আমার কাঁধের ওপর মাথাটা রেখে দেয়। সামনে বুকের পর দিয়ে তার দীর্ঘ অবিন্যস্ত বিনুনি লুটিয়ে পড়ে নীচে।
আমি বলি, আচ্ছা মেমসাহেব, তুমি তো আমার উন্নতির জন্য এত ভাবছি, এত করছি কিন্তু আমি তো তোমার জন্য কিছু করছ
আমার জন্য আবার কি করবে? আমার জন্যই তো তুমি তোমাকে তৈরি করছ।
কিন্তু তবুও—
এতে কোন কিন্তু নেই। হাজার হোক আমি মধ্যবিত্ত বাঙালীঘরের মেয়ে। যতই লেখাপড়া শিখি না কেন, স্বামী-পুত্ৰ নিয়েই তো আমার ভবিষ্যৎ।
মেমসাহেব থামে। দৃষ্টিটা তার চলে যায় দিগন্তের অন্তিম সীমানায়। মনটাও বোধহয় হারিয়ে যায়। ভবিষ্যতের অজানা পথে। আমি বেশ বুঝতে পারি। বর্তমান নিয়ে মেমসাহেব একটুও চিন্তা করে না। তার সব চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা আগামী দিনগুলিকে নিয়ে… সে স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন? না, না, স্বপ্ন কেন হবে? সে স্থির ধারণা করে নিয়েছে চাকরি-বাকরি ছেড়েছুড়ে দিয়ে সে মনপ্ৰাণ দিয়ে শুধু সংসার করবে, আমাকে সুখী করবে, আমার কাজে সাহায্য করবে। তারপর? তারপর, সে মা হবে।
ইদানীংকালে মেমসাহেব একবার নয়, বহুবার স্বামী-পুত্র নিয়ে সংসার করার কথা বলল। ওর ছেলে কি করবে, মেয়ে কেমন হবে, সে-কথাও বলেছে বেশ কয়েকবার। শুনতে ভালই লাগে। প্ৰথমে সারা মন আনন্দে, আত্মতৃপ্তিতে ভরে যায়, কিন্তু একটু পরে কেমন যেন খটকা লাগে। হাজার হোক মানুষের জীবন তো। কোথা দিয়ে কি হয়ে যায়, কে বলতে পারে? আমি বাস্তবের মুখোমুখি হয়েছি, দেখেছি অনেক মানুষ অনেক রকম স্বপ্ন দেখে কিন্তু কজনের জীবনে সে স্বপ্ন সার্থক হয়? তাইতো মেমসাহেবকে বুকের মধ্যে পেয়ে আনন্দ পাই কিন্তু তার ভবিষ্যৎ জীবনের আশাআকাঙ্ক্ষার কথা শুনলে আমার বুকের মধ্যে কেমন করতে থাকে।
সেদিন সমুদ্রগামী চঞ্চল আত্মহারা ভাগীরথীর পাড়ে বসে মেমসাহেবের কাছে আবার স্বামী-পুত্র নিয়ে সুখের সংসার করার কথা শুনে আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর আস্তে আস্তে ওর কপালে মুখে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বললাম, তুমি কি জান তুমি স্বামী-পুত্র নিয়ে সুখী হবেই?
ঐ লম্বা ভ্রূ দু’টো টান করে চোখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই? মেমসাহেবের ঠোঁটের কোণায় একটু বিদ্রূপের হাসি দেখা দেয়। বলে, কেন, তুমি কি আর কাউকে নিয়ে সুখী হবার কথা ভাবছ?
মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে কিন্তু তুমি কি ঘাড় থেকে নামবে?
আমি তোমার ঘাড়ে চেপেছি, না তুমি আমার ঘাড়ে চেপেছ? একটু থামে, আবার বলে, আর কেউ এসে দেখুক না। মজা দেখিয়ে দেব।
তাই বুঝি?
তবে কি? তোমাকে পূজা করব?
আগেকার দিনে পতিব্ৰতা স্ত্রীরা স্বামীকে সুখী করার জন্য বহুবিবাহে কোন দিন। আপত্তি করতেন না, তা জান?
শুধু আগেকার দিনের কথা কেন বলছ? আরও একটু এগিয়ে ‘প্ৰাগৈতিহাসিক দিনে, যখন জঙ্গলে বাস করতে তখন তো তোমরা পুরুষেরা আরো অনেক কাণ্ড করতে। সুতরাং এখনও তাই করা না!
একটু ঠাণ্ড মিঠে হাওয়া বয়ে যায়। মেমসাহেব এক মূহুর্তে বদলে যায়। দু’হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে বলে, আমি জানি তুমি আর কাউকে কোনদিন ভালবাসতে পারবে না।
জান?
একশবার, হাজার বার জানি।
কেমন করে জানলে?
সে তুমি বুঝবে না।
বুঝব না?
তুমি যদি মেয়ে হতে তাহলে বুঝতে।
তার মানে?
সন্তানের মনের কথা যেমন আমরা বুঝতে পারি, তেমনি স্বামীদের মনের কথাও আমরা জানতে পারি।
দোলাবৌদি তুমি তো মেয়ে। তাই বুঝবে কত গভীরভাবে সারা অন্তর দিয়ে ভালবাসলে এসব কথা বলা যায়।
সাদার্ন একসপ্রেসের কাজ শুরু করে দিলাম বেশ মন দিয়ে। মাঝে মাঝে মন চাইত ফাঁকি দিই, মেমসাহেবকে নিয়ে আড্ডা দিই, স্ফূর্তি করি। কিন্তু পারতাম না। ওকে ঠকাতে বড় কষ্ট হতো। যার সমস্ত জীবন-সাধনা আমাকে কেন্দ্ৰ করে, যে আমার মঙ্গলের মধ্য দিয়ে নিজের কল্যাণ দেখতে পায়, তাকে মুহুর্তের জন্যও বঞ্চনা করতে আমার সাহস বা সামর্থ্য হয় নি।
ঝড়ের বেগে না হলেও আমি বেশ নির্দিষ্টভাবে এগিয়ে চলেছিলাম। মেমসাহেবকে বুকের মধ্যে পেয়ে আমি আমার জীবন-নদীর মোহনার কলরব শুনতে পেতাম।
মান্স কয়েক পরে আমি আবার বাইরে বেরুলাম। এবার লক্ষ্মেী। কিছুকাল আগে ক্রনিকেলের এডিটরের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল এবং সে পরিচয়ের সূত্র ধরেই তার কাছে হাজির হলাম। বললেন, কলকাতার করসপণ্ডেণ্টের দরকার নেই। তবে সপ্তাহে একটা করে ওয়েস্টবেঙ্গল নিউজ লেটার ছাপতে পারি।
এডিটর মিঃ শ্ৰীবাস্তব খোলাখুলিভাবে জানালেন, বাট আই কাণ্ট পে ইউ মোর দ্যান ওয়ান হানড্রেড।
আমি বললাম, দ্যাটস অল রাইট। লেট আস মেক এ বিগিনিং।
আমার জীবনে এই পরম দিনগুলিতে মেমসাহেবকে স্মরণ ন করে পারিনি। তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে যেত। আকাশে কালো মেঘ দেখা দিলেই বৃষ্টিপাত হয় না। সে কালো মেঘে জলীয়বাষ্প থাকা প্ৰয়োজন। একটি ছেলের জীবনে একটি মেয়ের উদয় নতুন কিছু নয়। আমার জীবনেও হয়ত আরো কেউ আসত। কিন্তু আমি স্থির জানি পৃথিবীর অন্য কোন মেয়েকে দিয়ে আমার কর্মজীবনের অচলায়তনকে বদলান সম্ভব হতো না।
তাছাড়া মেয়ের একটু আদর পেতে চায়, ভালবাসা পেতে চায়। একটু সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, একটু বৈশিষ্ট্য প্ৰায় সব মেয়েরাই কামনা করে। সেই সুখ, সেই স্বাচ্ছন্দ্য পাবার জন্য অপ্রয়োজন হলে কোন মেয়ে আত্মত্যাগ করবে? খুব সহজ সরল চিরাচরিত প্ৰথায় মেমসাহেবের জীবনে এসব কিছুই আসতে পারত। কিন্তু সে তা চায় নি। সে চেয়েছিল, নিজের প্ৰেম-ভালবাসা, দরদ-মাধুৰ্য-অনুপ্রেরণা দিয়ে নিম্নবিত্ত বাঙালীঘরের একটি পরাজিত যোদ্ধাকে আবার নুতুন উদ্দীপনায় আত্মবিশ্বাসে ভরিয়ে তুলতে।
আমি জানতাম, আমার কর্মজীবনের এই সাময়িক সাফল্যের কোন স্থায়ী মূল্য নেই, নেই কোন ভবিষ্যৎ। কিন্তু তা হোক। এইসব ছোটখাটো অস্থায়ী সাফল্যের দ্বারা আমার হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস আমি ফিরে পেলাম। নিজের কর্মক্ষমতা সম্পর্কে একটু আস্থা এলো আমার মনে।
সর্বোপরি এ কথা আমি উপলব্ধি করলাম যে, শুধু কলকাতাকে কেন্দ্ৰ না করেও আমার ভবিষ্যৎ সাংবাদিক জীবন এগিয়ে যেতে পারবে। বরং একবার মাতৃনাম স্মরণ করে ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ রঙ্গমঞ্চে বেরিয়ে পড়লে ফল আরো ভাল হবে।
তুমি বেশ বুঝতে পারছি আমি কেন ও কার জন্য একদিন অকস্মাৎ কলকাতা ত্যাগ করে দিল্লী চলে এলাম। আজ আমার জীবন কত ব্যস্ত, কত বিস্তৃত। সাংবাদিক হয়েও সেই উত্তরে দাৰ্জিলিং, পূর্বে গৌহাটি, দক্ষিণে গঙ্গাসাগর ও পশ্চিমে চিত্তরঞ্জনসিন্ত্রীর মধ্যে আজ আমি বন্দী নই। বাংলাদেশকে আমি ভালবাসি। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে আপনজন মনে করি। কিন্তু সমস্যাসন্ধুল ও নিত্য নতুন চিন্তায় জর্জরিত হয়ে বাঁচবার কথা ভাবতে গেলে ভয় হয়। যদি আনন্দ করে বাঁচতে না পারলাম, যদি এই পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ-মাধুৰ্য উপতোগ করতে না পারলাম, তবে শুধু পিতৃপুরুষের স্মৃতিবিজড়িত মিউজিয়ামে জীবন কাটাবার মধ্যে মানসিক শান্তি পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু স্বস্তি নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে না।
আজ যত সহজে এসব কথা লিখছি ব্যাপারটি তত সহজ নয়। যে পরিবারে জন্মেছি, যে পরিবেশে মানুষ হয়েছি, কৰ্মজীবন শুরু করেছি, সেখানকার সবকিছু সীমিত ছিল। আজ জীবিকার তাগিদে। বহুজনকে বহুদিকে ছড়িয়ে পড়তে হয়েছে, কিন্তু সেদিন জীবিকার জন্য, জীবনধারণের জন্য আমার পক্ষে সোনার বাংলা ত্যাগ করা অত সহজ ও স্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু আমি সেদিন হাসিমুখেই হাওড়া স্টেশনে দিল্লী মেলে চড়েছিলাম।
চলবে।