মেমসাহেব পর্ব-৫+৬

0
4

🔴মেমসাহেব (পর্ব :৫, ৬)🔴
– নিমাই ভট্টাচার্য

আমি দিল্লী ফিরে এসেছি, কিন্তু কদিন এমন অপ্ৰত্যাশিত ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটালাম যে, কিছুতেই তোমাকে চিঠি লেখার সময় পাইনি। তাছাড়া ইতিমধ্যে দু’দিনের জন্য তোমাদের বন্ধু মাধুরী চ্যাটার্জি আর তাঁর স্বামী এসেছিলেন। মাধুরীকে মনে পড়ছে তোমার? প্রেসিডেন্সীতে ফিলসফি নিয়ে পড়ত। পার্কসার্কাস-বেগবাগানের মোড়ে থাকত।

দিল্লীতে আসার পর নিত্য-নৈমিত্তিক পরিচিত আধা-পরিচিত অনেকেই আসেন আমার আস্তানায়। কেউ ইণ্টারভিউ দিতে, কেউ অফিসের কাজে, কেউ বা আবার ডেরাডুন-মূসৌরী-হরিদ্বারের পথে লালকেল্লা-কুতুবমিনার আর রাজঘাট-শাস্তিবনা দেখার অভিপ্ৰায়ে। মাধুরী চালাৰু মেয়ে। হাজার হোক তোমাদেরই বন্ধু তো! স্বামী এসেছিলেন অফিসের কাজে; আর উনি এসেছিলেন স্বামীকে অনুপ্রেরণা দিতে। এখনও সেই আগের মতনই হৈ-হুল্লোড় করে। স্বামীকে সকাল বেলায় অফিসে রওনা করিয়ে দিয়ে সারা দিন নিজে হৈ-হৈ করে চক্কর কেটে বেড়াত আমার সঙ্গে। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। কিন্তু মাধুরী হতো না। বিকেল বেলায় স্বামী এলে আমাদের সেকেণ্ড ইনিংস শুরু হতো।

যাই হোক বেশ কাটল দু’টো দিন। মাধুরীর কাছে তোমার একটা শাড়ী আর পেটুক খোকনদার জন্য খানিকটা শোনহালুয়া পাঠিয়েছি। শাড়ীটা তোমার পছন্দ হলো কিনা জানিও।

এদিকে আমার মনের ওপর দিয়ে নীলিমার ঝড় বয়ে যাবার পর পরই হঠাৎ সাংবাদিকতা শুরু করলাম। আমার জীবনের সে এক মাহেন্দ্ৰক্ষণ। জীবনের সমস্ত হিসাব-নিকাশ। ওলট-পালট হয়ে গেল। মধ্যবিত্ত বাঙালী ঘরের ছেলে। ম্যাট্রিক পাশ করে আই-এ পড়ে, আই-এ পাশ করে বি-এ পড়ে। তারপর ইউনিভার্সিটির দেওয়া পাশপোর্ট নিয়ে চোদ্দ আনা ছেলে নেমে পড়ত জীবনযুদ্ধের পাওয়ার লীগ খেলতে। বাকি দু’ আন আরো এগিয়ে যেত। তাদের মধ্যে কেউ ফাস্ট ডিভিশনে, কেউ আই-এফএ শীল্ডে বা রোভার্স খেলত। কেউ কেউ আবার আরো এগিয়ে যেত।

আমি পাওয়ার লীগে খেলবার জন্যই জন্মেছিলাম ও তারই প্ৰস্তুতি করছিলাম। মাঝে মাঝে অবশ্য স্বপ্ন দেখতাম ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবো। অথবা অধ্যাপক হয়ে কেঁচা দুলিয়ে কলেজে আসব, মেয়েদের পড়াব, ছেলেদের পড়াব। ছাত্রীদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পাবার জন্য মন আকুল ব্যাকুল হলেও আমি কিছুতেই তার প্রকাশ করব না। কিন্তু তবু ছাত্রীরা আমার কাছে ছুটে আসবে নানা কারণে, নানা প্ৰয়োজনে। ইলোরাদের বাড়ি একদিন চায়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করায় অনেক সরস কাহিনী ছড়াবে সমগ্ৰ নারীজগতের মধ্যে। তারপর ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি আর কি!

আমাদের আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে কেউ কোনদিন খবরের কাগজে চাকরি করা তো দূরের কথা, খবরের কাগজের অফিসে পৰ্যন্ত যান নি। তাইতো কেউ কল্পনা করেন নি তাদের বংশের এই কুলাঙ্গার খবরের কাগজে চাকরি করবে। দেশটা দুটুকরো। হবার আগে আমাদের সমাজজীবন কয়েকটা পরিচিত ধারায় বয়ে গেছে। পরিচিত সীমানার বাইরে যাবার প্রয়োজন বা তাগিদ। বিশেষ কেউই বোধ করেন নি। দেশটা স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গেই অতীত দিনের সে সব রীতিনীতি, নিয়ম-কানুন প্রয়োজন কোথায় যেন তলিয়ে গেল। এই শান্ত-ম্বিন্ধ পৃথিবীটা যেন কোটি কোটি বছর পেছিয়ে অগ্নি-বলয়ে পরিণত হলো। জৈব প্রয়োজনটা চরম নগ্নভাবে প্ৰকাশ করল। ইতিহাসের বলি হয়ে মানুষগুলো বাঁচবার প্রয়োজনে উন্মাদের মত ছুটে বেড়াল চারদিকে। সেদিনের সে অগ্নি-বলয় পৃথিবীর যে যেখানে পারল আস্তানা করে নিল। লক্ষপতির ছেলে কলেজ ষ্ট্রীটে হকার হলো, আমার-তোমার চাইতেও বনেদী ঘরের অনেক মেয়ে-বৌ বৌবাজার আর লিণ্ডসে স্ট্রীটের ম্যাসেজ-বাথে গিয়ে দেহ বিক্রয় করতে বাধ্য হলো।

বৌবাজারের রথের মেলায় বা বিজয়া দশমীর দিন কুমুরটুলীর ঘাটে লক্ষ লক্ষ লোকের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট বাচ্চাদের দেখেছি? দেখেছি কেমন হাউ হাউ করে কঁদে? লক্ষ্য করেছি বাবা-মা’কে হারিয়ে অসহায় হয়ে, ব্যাকুল হয়ে অর্থহীন ভাষায় সবার দিকেই কেমন তাকায়? আমিও সেদিন এমনি করে অর্থহীন ভাষায় চারদিকে তাকাচ্ছিলাম একটু ভবিষ্যতের আশায়। কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ, কোনটা সহজ, কোনটা কঠিন-ত ভাববার সময় বা ক্ষমতা কোনটাই সেদিন আমার ছিল না। তাইতো অপ্ৰত্যাশিতভাবে খবরের কাগজের রিপোর্টার হবার সুযোগ পেয়ে আমি আর দ্বিধা না করে এগিয়ে গেলাম।

রামায়ণে পড়েছি সতীত্বের প্রমাণ দেবার জন্য সীতাকে অগ্নি-পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। অগ্নি-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও স্বামীর পাশে সীতার স্থান হয় নি। রাজরাজেশ্বরী সন্তানসম্ভবা সীতাকে প্রিয়হীন বন্ধুহীন নিঃস্ব হয়ে গভীর অরণ্যে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। জান দোলাবৌদি, আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় সীতার গর্ভেই বোধহয় বাঙালীর পূর্বপুরুষদের জন্ম। তা না হলে সমগ্ৰ বাঙালী জাতটা এমন অভিশাপগ্ৰস্ত কেন হলো? স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য চরম অগ্নি-পরীক্ষা দেবার পরও কেন তার রাহুমুক্তি হলো না? স্বাধীন সার্বভৌম ভারতবর্ষের নাগরিক হয়েও কেন তাদের চোখের জল পড়া বন্ধ হলো না?

সত্যি দোলাবৌদি, সেদিনের কথা মনে হলে আজও শরীরটা শিউরে ওঠে, মাথাটা ঘুরে যায়, দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়। সেই দুর্দিনের মধ্যেই আমি নতুন পথে যাত্রা শুরু করলাম। সকালবেলার টিউশানি দু’টো ছাড়লাম না; কিন্তু বিকেলের ছাত্র পড়ান বন্ধ করলাম। দুপুরে কলেজ করে সাড়ে তিনটে কি চারটে বাজতে বাজতেই নোট-বই পেন্সিল নিয়ে চলে যেতম সভাসমিতি বা কোন প্রেস কনফারেন্সে। তারপর অফিস। রাত বারোটা-একটা পর্যন্ত রোজই কাজ করতে হতো। কোন কোনদিন আবার বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত তিনটে-চারটেও হয়ে যেত।

দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এমনি করে চালিয়েছি। বিনিময়ে কি পেয়েছি? প্ৰথম বছর একটি পয়সাও পাইনি। নিজের টিউশানির রোজগার দিয়ে ট্রাম-বাসের খরচ চালিয়েছি। পরের বছর থেকে মাসিক দশ-টাকা রোজগার শুরু করলাম। ইতিমধ্যে বিজ্ঞান সাধনার প্রথম পর্ব শেষ করলাম। পিতৃদেব ফতোয় জারী করলেন, সাংবাদিকতার খেলা শেষ করে একটা রাস্ত ধর। সত্যি তখন অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক পরিস্থিতি এমনসঙ্কটাপন্ন ছিল যে, কিছু একটানা করলে চলছিল না। আমার বন্ধু-বান্ধবরাও এই একই সমস্যার সম্মুখীন হলো। সবাই উপলব্ধি করছিল। কিছু একটা করতেই হবে। কিন্তু কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে-তা কেউই জানত না। ডাক্তারী-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার মত রসদ কারুরই ছিল না। তাই ওদিকে আর কেউ পা বাড়াল না। আমি রিক্রুটিং অফিস থেকে শুরু করে খিদিরপুর বারাকপুরের সমস্ত কল-কারখানার দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ালাম একটা পঞ্চাশ টাকার অ্যাপ্রেনিটিসশিপের জন্য। জুটল না। তাই এবার বিজ্ঞান সাধনায় ইস্তফা দিয়ে সাহিত্যসাধনা আর সাংবাদিকতা নিয়েই পরবর্তী অধ্যায় শুরু করলাম।

তোমাকে এত কথা লিখতাম না। তাছাড়া হয়ত কিছু কিছু তুমি শুনেছি বা জেনেছি। কিন্তু এই জন্যই এসব জানাচ্ছি যে, আমার জীবনের কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে মেমসাহেবকে পেয়েছিলাম, তা না জানালে তুমি ঠিক গুরুত্বটা উপলব্ধি করবে না।

যৌবনে প্ৰায় সব ছেলেমেয়েই প্রেমে পড়ে। এটা তাদের ধর্ম, কর্ম। প্ৰয়োজনও বটে কিছুটা। তাছাড়া শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে পূর্ণতা লাভ করার এটা সব চাইতে বড় প্ৰমাণ। কলেজের কমনরুমে বা থিয়েটারের গ্ৰীনরুমে অনেক প্রেমের কাহিনীরই আদি-পৰ্ব রচিত হয়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার মেয়াদ ক্ষণস্থায়ী। সামান্য একটু হাসি, সামান্য একটু গল্প, একটু মেলামেশার পর অনেক ছেলেমেয়েই প্রেমের নেশায় মশগুল হয়ে ওঠে। জীবনকে উপলব্ধি না করে, ঘাত-প্ৰতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনের অগ্নি-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়ে যারা প্ৰেম করে বলে দাবী করে, তারা হয় বোকা, নয় মিথ্যাবাদী। দুটি মন, দুটি প্ৰাণ, দুটি ধারা, দুটি অপরিচিত মানুষ একই সঙ্গে কোরাস গাইবে অথচ তার পরিবেশ থাকবে না, প্ৰস্তুতি থাকবে না, তা হতে পারে না। এই পরিবেশ আর প্রস্তুতি থাকে না বলেই আমাদের দেশের কলেজ রেস্তোরাঁর প্ৰেম প্রায়ই ব্যর্থ হয়। দুধ জমিয়ে ভাল মিষ্টি দই খেতে হলে অনেক তদ্বির, তদারক ও প্ৰস্তুতির প্রয়োজন। একটু হিসাব-নিকাশ বা তদ্বিার-তদারকের গণ্ডগোলে হয়। দই জমে না, অথবা জমলেও দইট টক হয়ে যায়।আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার

দুটি নারীপুরুষকে নিয়ে একটা সুন্দর ছন্দোবদ্ধ জীবন গড়ে তুলতে হলে শুধু চোখের নেশা আর দেহের ক্ষুধাই যথেষ্ট নয়। আরো অনেক কিছু চাই। তাছাড়া জীবনে এই পরম চাওয়া চাইবারও একটা সময় আছে। কিছু পেতে হলেও সে পাওয়ার অধিকার অর্জন করতে হয়।

বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে ও পরিবেশে অনেককেই অনেক সময় ভাল লাগে। হাসপাতালে হাসিখুশি ভরা নার্সদের কত আপন, কত প্রিয় মনে হয়। কিন্তু হাসপাতালের বাইরে? সমাজ জীবনের বৃহত্তর পরিবেশে? ক’জন পারে তাদের আপনি জ্ঞানে সমাদর করতে?

আমার জীবনটা যদি সুন্দর, স্বাভাবিক ও ছন্দময় হয়ে এগিয়ে যেত তাহলে হয়ত যে কোন মেয়েকে দিয়েই আমার জীবনের প্রয়োজন মিটত। কিন্তু আমি জীবনের প্রতিটি মুহুর্তের জন্য তিলে তিলে দগ্ধ হচ্ছিলাম। একটু সম্রামের সঙ্গে বাঁচবার জন্যে অসংখ্য মানুষের স্বারে দ্বারে ঘুরে ঘুরেও কোন ফল হয় নি। মাত্র একশ পঁচিশ টাকার একটা সামান্য রিপোর্টারের চাকরির জন্য কতজনকে যে দিনের পর দিন তৈল-মৰ্দন করেছি, তার ইয়ত্তা নেই। তবুও বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দের যোগ্য বংশধরদের মন গলে নি।

কেন, আত্মীয়-বন্ধুর দল? পাঁচশ বা পঞ্চাশ টাকা মাইনের রিপোর্টারের সঙ্গে আবার আত্মীয়তা কিসের? নিতান্ত দু’চারজন মুৰ্থ বন্ধু ছাড়া আর সবার কাছেই আমি অস্পৃশ্য হয়ে গেলাম।

দোলাবৌদি, আমার সে চরম দুর্দিনের ইতিহাস তোমাকে আর বেশী লিখব না। তুমি দুঃখ পাবে। তবে জেনে রাখা তোমাদের ঐ কলকাতার রাজপথে আমি দীর্ঘদিন ধরে উন্মাদের মত ঘুরে বেড়িয়েছি, একটি পয়সার অভাবে সেকেণ্ড ক্লাশ ট্রামে পৰ্যন্ত চড়তে পারিনি। দু’চারজন নিকট আত্মীয়ের প্রতি কর্তব্য পালন করে বহুদিন নিজের অদৃষ্ট দুবেল অন্ন জোটাতেও পারিনি। কিন্তু কি আশ্চর্ষ। বিধাতাপুরুষ যত নিষ্ঠুর হয়েছেন আমার প্রতিজ্ঞাও তত প্ৰবল হয়েছে। বিধাতার কাছে কিছুতেই হার মানতে চায় নি আমার মন।

এমনি করে বিধাতাপুরুষের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে প্রায় সাত-আট বছর কেটে গেল। তবুও কোন কুল-কিনারা নজরে পড়ল না। এই সাত-আট বছরে আমার দৃষ্টিভঙ্গীর অনেক পরিবর্তন হয়েছিল। সাত-আট বছর আগে শুধু বেঁচে থাকবার জন্য আমি কর্মজীবন শুরু করেছিলাম, কিন্তু সাত-আট বছর পরে আমি শুধু বাঁচতে; চাইনি। লক্ষ লক্ষ মানুষের অরণ্যের মধ্যে আমি হারিয়ে যেতে চাইনি। চাইনি শুধু অন্ন-বস্ত্ৰ-বাসস্থানের সমস্যার সমাধান করতে। মনে মনে আরো কিছু আশা কয়ছিলাম।

কিন্তু আশা করলেই তো আর সবকিছু পাওয়া যায় না। তাছাড়া শুধু আশা করে আর কতদিন নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্ৰাম করা যায়? আমি হঁাপিয়ে উঠলাম। মনের শক্তি, দেহের তেজ যেন আস্তে আস্তে হারাতে শুরু করলাম। হাজার হোক ধৈর্ষেরও তো একটা সীমা আছে।

কাজকর্মে ফাঁকি দিতে শুরু করলাম। ঘুরে-ফিরে নিত্য-নতুন খবর যোগাড় করার চাইতে নিউজ ডিপার্টমেণ্টে সাব-এডিটরদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়াই আমার কাছে বেশী আর্কষণীয় হলো। শুধু আমাদের অফিসে নয়, আরো অনেক আড্ডাখানায় যাতায়াত শুরু করলাম। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কেমন যেন দার্শনিকসুলভ ঔদাসীন্য দেখা দিল। মোদ্দা-কথায় আমি বেশ পাল্টাতে শুরু করলাম।

বেশীদিন নয়, আর কিছুকাল এমনি করে চললে আমি নিশ্চয়ই চিরকালের মত চিরদিনের জন্য হারিয়ে যেতাম। ঠিক এমনি এক চরম মুহুর্তে ঘটে গেল সেই অঘটন।

শান্তিনিকেতন থেকে ফিরছিলাম। কলকাতা। বোলপুর স্টেশনে দানাপুর প্যাসেঞ্জারে আমার কামরায় আরো অনেকে উঠলেন। ভিড়ের মধ্যে কোনমতে এক পাশে জায়গা করে আমি বসে। পড়লাম। জানলার পাশে মাথাটা রেখে আনমনা হয়ে কিছুক্ষণ কি যে দেখছিলাম। দু’চারটে স্টেশনও পার হয়ে গেল। বীরভূমের লালমাটি আর তালগাছ কখন যে পিছনে ফেলে এসেছি, তাও খেয়াল করলাম না। বাইরে অন্ধকার নেমে এলো। উদাস। দৃষ্টিটাকে ঘুরিয়ে কামরার মধ্যে নিয়ে এলাম। ভাবছিলাম। কামরাটাকে একটু ভাল করে দেখে নেব। কিন্তু পারলাম না। বৃষ্টিটি। সামনের দিকে এগুতে গিয়েই আটকে পড়ল। এমন বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জল গাভীয় ঘনকালো টানা-টানা দুটি চোখ আগে কখনও দেখিনি। একবার নয়, দুবার নয়, বার বার দেখলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে আবার দেখলাম। আপাদ-মস্তক ভাল করে দেখলাম। অসত্যের মত, হাংলার মত আমি শুধু ঐ দিকেই চেয়ে রইলাম।

আমি যদি খোকনদার মত সাহিত্যের ভাল ছাত্র হতাম ও সংস্কৃত সাহিত্য পড়া থাকত, তাহলে হয়ত কালিদাসের মেঘদূতের উত্তরমেঘ থেকে কোট করে বলতাম-তম্বী শুষ্ঠামা শিখরিদশনা পাকবিশ্বাধরোষ্ঠী, মধ্যে ক্ষমা চকিতহরিণীপ্ৰেক্ষণা নিন্মনাভিঃ। কালিদাসের মত আমি আর এগিয়ে যেতে পারিনি। এইখানেই আটকে গেলাম। তাছাড়া দানাপুর প্যাসেঞ্জারের ঐ কামরায় অতগুলো প্যাসেনঞ্জারের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে এর চাইতে বেশী কি এগুতে পারা যায়?

পরে অবশ্য মেমসাহেবকে আমি আমার সেদিনের মনের ইচ্ছার কথা বলেছিলাম। ক’মাস পর আমি আর মেমসাহেব দানাপুর প্যাসেঞ্জারেই শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা ফিরছিলাম। বর্ধমানে এসে কামরাটা প্ৰায় খালি হয়ে গেল। ও পাশের বেঞ্চিতে শুধু এক বৃদ্ধি-বৃদ্ধ ছাড়া আর কোন যাত্রী ছিল না। মেমসাহেব আমার হাতের পর মুখটা রেখে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। আমিও যেন কি ভাবছিলাম। হঠাৎ মেমসাহেব আমাকে একটু নাড়া দিয়ে বলল, শোন।

আমি ঠিক খেয়াল করিনি। মেমসাহেব। আবার আমাকে ডাক দিল, শোন না।

কিছু বলছ?

মেমসাহেব হাত দিয়ে আমার মুখটাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। আঙুল দিয়ে আমার কপালের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিল। দু’চার মিনিট শুধু চেয়ে রইল আমার দিকে। একটু হাসল। সলজ দৃষ্টিটা একটু ঘুরিয়ে নিল নিজের দিকে।

এবার আমি ওর মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম আমার দিকে। জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কিছু বলবে?

আমার দিকে তাকাতে পারল না। ট্রেনের কামরার ঐ স্বল্প আলোয় ঠিক বুঝতে পারলাম না, কিন্তু মনে হলো যেন লজ্জায় ওর মুখটা লাল হয়ে গেছে। দেখতে বেশ লাগছিল। দু’চার মিনিট আমি ওকে প্রাণভরে দেখে নিলাম। তারপর কানে কানে ফিসফিস করে বললাম, লজ্জা করছে?

মেমসাহেব জবাব দিল না। শুধু হাসল। একটু পরে আমার কানে কানে বলল, একটা কথা বলবো?

বল।

প্ৰথম যেদিন তুমি আমাকে এমনি ট্রেনে যাবার সময় দেখেছিলে, সেদিন আমাকে তোমার ভাল লেগেছিল?

মনে হয়েছিল–
তম্বী শ্যামা শিখরিদশনা পাকবিম্বাধরোষ্ঠী,
মধ্যে ক্ষামা চকিতহরিণী প্ৰেক্ষণ নিম্ননাভিঃ।
শ্রোণীতারাদলসগমনা স্তোকনম্রা স্তনাভ্যাং,
যা তত্ৰ স্যাদযুবতিবিষয়ে সৃষ্টিরাদ্যেব ধাতুঃ।।।

মেমসাহেব ঠাস করে আমার গালে একটা চড় মেরে বলল, অসভ্য কোথাকার।

ছি, ছি, মেমসাহেব, তুমি আমাকে অসভ্য বললে। অসভ্য বলতে হলে কালিদাসকে অসভ্য বলো।

আমি একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি রামায়ণ পড়েছ?

কেন? এবার বুঝি রামায়ণের একটা কোটেশন শোনাবো?

আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।

পড়েছি।

মূল রামায়ণ বা তার অনুবাদ পড়েছ?

মূল সংস্কৃত রামায়ণ পড়িনি, কিন্তু অনুবাদ পড়েছি।

ভেরী গুড়। দণ্ডকারণ্যে সীতাকে প্ৰথম দেখার পর রাবণ কি বলেছিলেন জান?

সীতার রূপের তারিফ করেছিলেন, কিন্তু ঠিক কি বলেছিলেন, তা মনে নেই।

বেশ তো আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। রাবণ সীতাকে বলেছিলেন–

মেমসাহেব বাধা দিয়ে বললে, তোমার আর শোনাতে হবে না। ঠিক লাইনগুলো মনে না থাকলেও আমি জানি রাবণ কি ধরনের সংঘাতিক বর্ণনা করেছিলেন।

একটু থেমে দৃষ্টিটা একবার ঘুরিয়ে নিয়ে আমার মুখের কাছে মুখটা এনে বলল, তুমিও তো আর এক রাবণ। ডাকাত কোথাকার! দিনে দুপুরে কলকাতা শহরের মধ্যে আমাকে চুরি করলে।

যাকগে সেসব কথা। সেদিন শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েছিলাম। চুরি করে দেখতে দেখতে একবার ধরা পড়লাম। চোখে চোখ পড়তেই আমি দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিলাম। কিন্তু মিনিটখানেক পরেই আবার চেয়েছি। আবার ধরা পড়েছি। আবার চেয়েছি, আবার ধরা পড়েছি।

মসাহেবের আর দুটি বন্ধু কিছু ধরতে না পারলেও হাওড়া স্টেশনে পৌঁছবার পর কামরা থেকে বেরুবার সময় আমার মনটা যে খারাপ হয়ে গিয়েছিল, তা ও বেশ বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু কি করা যাবে? দুজনের কেউই কিছু বলতে পারিনি। জীবনের বর্ষণমুখর পথ চলতে গিয়ে এমনি একটু-আধটু বিদ্যুতের চমকানি তো সবার জীবনেই দেখা দিতে পারে। তাতে আশ্চৰ্য হবার কিছু নেই। অস্বাভাবিকতাও কিছু নেই।

ওরা তিন ও বন্ধু কামরা থেকে নামবার বেশ কিছুক্ষণ পরে আমি নোমলাম। ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলছিলাম গেটের দিকে। আরেকবার তাকিয়ে নিলাম ওর দিকে। মনে মনে ভাবছিলাম, এইত এক্ষুনি গেট পার হলেই দুজনে হারিয়ে যাব। কলকাতা শহরের জনারণ্যের মধ্যে। আর হয়ত জীবনেও কোনদিন দেখা হবে না। হয়ত কেন? নিশ্চয়ই কোনদিন দেখা হবে না। হঠাৎ গেটের দিকে তাকাতে নজর পড়ল, মেমসাহেব একবার মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরল। আমি দূর থেকে হাত নেড়ে ওকে বিদায় জানালাম।

কেউ বুঝল না, কেউ জানল না, কি ঘটে গেল। এমন কি আমিও ঠিক বুঝতে পারিনি। কি হয়ে গেল। আমি তো এর আগে কোনদিন কোন মেয়ের দিকে অমন করে দেখিনি, কোন মেয়েও তো। অমন করে আমাকে মাতাল করে তোলে নি। কেন এমন হলো? শুধু বুঝেছিলাম, বিধাতাপুরুষের নিশ্চয়ই কোন ইঙ্গিত আছে। আর মনে মনে জেনেছিলাম, দেখা আমাদের হবেই।

বিশ্বাস কর দোলাবৌদি, শুধু আমার চোখের নেশা নয়, শুধু মেমসাহেবের দেহের আকর্ষণও নয়, আরো কি যেন একটা আশ্চৰ্য টান অনুভব করেছিলাম মনের মধ্যে। মনে মনে বেশ উপলব্ধি করলাম যে, আমার জীবনযুদ্ধের নতুন সেনাপতি হাজির! এই নতুন সেনাপতি আমাকে সহজে পরাজয় বরণ করতে দেবে না, আমাকে পিছিয়ে যেতে দেবে না। আমাকে হারিয়ে যেতে দেবে না। ভবিষ্যতের অন্ধকারে।

অদৃষ্ট যে মানুষকে কোথায় নিয়ে য়েতে পারে, কি আশ্চৰ্যভাবে দুটি অপরিচিত মানুষকে নিবিড় করে এক সূত্রে বেঁধে দেয়, তা ভাবলে চমকে উঠি।

পরের দিন বেশ দেরি করে অফিসে গেলাম। চীফ রিপোর্টার আশা করেন নি। আমি অফিসে আসব। তাই ওয়েলিংটন স্কোয়ারের মিটিং আর গোটা তিনেক প্রেস কনফারেন্স কভার করার ব্যবস্থা দেখে আশ্চৰ্য হলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার?

তুমি দৌড়ে একবার পার্ক স্বীট আৰ্ট ইন ইণ্ডাষ্ট্ৰতে গিয়ে যামিনী রায়ের একজিবিশনটা দেখে এসো। আজই শেষ দিন। ওর একটা রিভিউ না বেরুলে দোতলায় উঠতে পারছি না।

বুঝলাম উপরওয়ালারা বার বার বলা সত্ত্বেও একজিবিশনটার রিভিউ ছাপা হয় নি এবং এডিটর সাহেব বেশ অসন্তুষ্ট।

কলকাতার অন্যান্য রিপোর্টারদের মত আমিও নৃত্য-গীত বা শিল্পকলা বুঝতাম না, কিন্তু প্ৰয়োজনবোধে কলমের পর কলম রিপোর্ট লিখতে পারতাম ওসব নিয়ে। কেন তানসেন-সাদারঙও তো কভার করেছি। বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেব গাইবার আগে স্টেজের পাশে ব্ল্যাকবোর্ডে রাগ ইত্যাদি লিখে দিত। আমার মত সঙ্গীতবিশারদ রিপোর্টারের দল সেই ফমূল ভাঙিয়েই বেশ এক প্যারা লিখে দিতাম। শেষে আবার বাহাদুরী করে হয়ত মন্তব্য লিখতাম, গতবারের চাইতেও এবারের খ্যা সাহেবের গান অনেক বেশী মেজাজী হয়েছিল। অথবা লিখেছি, রাগ রাগেশ্বরীতে সেতার বাজিয়ে মুগ্ধ করলেন রবিশঙ্কর। অনেক ভিন্নমত পোষণ করলেও আমার মনে হয় রাগ রাগেশ্বরীতেই রবিশঙ্কর তাঁর শিল্পীসত্তাকে সব চাইতে বেশী প্ৰকাশ করতে পারেন।

কেন মহাজাতি সদনের রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলনে? রোজ অন্তত এক কলম লিখতেই হতো। লিখেছি, আজকের অধিবেশনের সব চাইতে উল্লেখযোগ্য শিল্পী ছিলেন। দ্বিজেন মুখার্জি। বিশেষ করে তাঁর শেষ গানখানি ভরা থাক ভরা থাক স্মৃতি-সুধায় বিদায়ের পাত্ৰখানি বহুদিন ভুলতে পারব না। গত বছরের সম্মেলনে এই গানখানিই আর এক’জন খ্যাতনামা শিল্পী গেয়েছিলেন। ভালই গেয়েছিলেন। কিন্তু তবুও যেন এত ভাল লাগে নি। বোধ করি দরদের অভাব ছিল। তাছাড়া কিছু কিছু গান আছে যা বিশেষ বিশেষ শিল্পীর কাছেই ভাল লাগে। চৈত্র দিনের ঝরা পাতার পুখে অনেকেই গাইতে পারেন, কিন্তু পঙ্কজ মল্লিকের মত কি আর কেউ গাইতে পারবেন? কেন সায়গলের গাওয়া আমি তোমায় যত’ বা কানন দেবীর সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে?–

এমনি করে কিছুটা কমনসেন্স আর কলমের জোরে রিপোর্টারের দল বেশ কাজ চালিয়ে যান। খবরের কাগজের রিপোর্টাররা অনেকটা মফঃস্বলের ডাক্তারবাবুদের মত। কিছুতেই বিশেষজ্ঞ নন, অথচ সব কিছু রোগেরই চিকিৎসা করেন। প্রয়োজনবোধে ছুরি-কঁচি নিয়ে একটা ছেড়া অ্যাপ্রন গায় চাপিয়ে পঞ্চানন চাটুজ্যে বা মুরারী মুখার্জির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেও দ্বিধা করেন না।

সুতরাং আমিও দ্বিধা না করে চলে গেলাম যামিনী রায়ের একজিবিশন রিভিউ করতে।

একেই একজিবিশনের শেষ দিন, তারপর আর্ট ইন ইণ্ডাস্ট্রির ছোট্ট ঘর। বেশ ভিড় হয়েছিল। তবুও আমি ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে কিছু কিছু নোট নিচ্ছিলাম। একটা হলের দেখা শেষ করে। পাশের হলটায় যাবার মুখে অকস্মাৎ দেখা পেলাম মেমসাহেবের। ভাবলে আশ্চর্য লাগে, কিন্তু হাজার হোক Truth is stranger than fiction.

প্ৰায় দুজনেই একসঙ্গে বললাম, আরে আপনি?

আপনি বুঝি যামিনী রায়ের ভক্ত?–আমাকে প্রশ্ন করে মেমসাহেব।

পঞ্চাশ টাকা মাইনের রিপোর্টারী করি বলে এই আধ-ঘণ্টার জন্য ভক্ত হয়েছি।

আপনি বুঝি রিপোর্টার?

নির্লজ্জ আর বেহায়াপনা দেখে এখনও বুঝতে কষ্ট হচ্ছে?

ছি, ছি, ওকথা কেন বলছেন? পাশের পেন্টিংটা এক নজর দেখে মেমসাহেব মন্তব্য করল, রিপোর্টারদের তো ভারী মজা।

আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললাম, নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস…

শেষ করতে হয় না। তার আগেই বলল, আপনি দেখছি রবীন্দ্ৰনাথেরও ভক্ত।

হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আর একটু পরে দেখবেন আমি আপনারও ভক্ত।

লোকের ভিড়ের মধ্যে আর কথা হলো না। এই দু’এক মিনিটের মধ্যেই কিছু কিছু কলারসিক বেশ এক ঝলক আমাদের দেখে নিলেন।

পাশের হলটা চটপট ঘুরে দেখে নিয়ে আমরা দুজনেই একসঙ্গে বেরিয়ে এলাম।

এখন রাত প্ৰায় দেড়টা বাজে। তাই আজ আর লিখছি না। কালকে সকাল সকাল উঠতে হবে। নটার সময় প্ৰাইমমিনিস্টারের মান্থলি প্রেস কনফারেন্স। সুতরাং তুমি বেশ বুঝতে পারিছ কাল সকালে আমার কি দুর্ভোগ আছে।

কাল তো তোমাদের দুজনেরই ছুটি। তোমরা নিশ্চয়ই এখনও ঘুমোওনি। বেশ কল্পনা করতে পারছি খোকনদা তোমার কোলের পর মাথা দিয়ে শুয়ে আছে আর তুমি তোমার ঐ বিখ্যাত বেসুরে গলায় তাঁকে একটা পচা প্রেমের গান শোনাচ্ছি। তাই না?

পর্ব ৫ শেষ📌

🔴পর্ব :৬🔴

তুমি যেদিন প্ৰথম খোকনদার দেখা পেয়েছিলে, সেদিন খোকনদা তোমাকে কি বলে সম্বোধন করেছিল, কি ভাষায় কথা বলেছিল, কি সে বলেছিল, আমি সেসব কিছুই জানি না। সেদিন তুমি কিভাবে ওকে গ্ৰহণ করেছিলে, তাও জানি না। তবে বেশ কল্পনা করে নিতে পারি তুমিই আগে খোকনদার মাথাটা খেয়েছ। কিছু কবচ-মাদুলী ধারণ করেছিলে কিনা জানি না; তবে কিছু না কিছু একটা নিশ্চয়ই করেছিলো। নয়ত খোকনদার মত ছেলে…

তুমি রাগ করছ? রাগ করে না। তবে তোমাদের ব্যাপারটার ঐ রহস্যভরা আদি পর্বটা জানা থাকলে আমার অনেক সুবিধে হতো। তাইতো সেদিন আর্ট ইন ইণ্ডাষ্টি থেকে বেরুবার পর কি বলব, কি করব কোথায় যাব, কিছুই তেবে পাচ্ছিলাম না। পার্ক স্ট্রট ছেড়ে চৌরঙ্গী ধরে এসপ্ল্যানেডের দিকে এগুতে এগুতে শুধু বলেছিলাম, আমি জানতাম আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে।

সত্যি?

সত্যি।

আজই দেখা হবে, একথা জানতেন?

‘না, তা জানতাম না। তবে জানতাম দেখা হবেই।

মেমসাহেব থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘাড় বেঁকিয়ে আমার দিকে ফিরে বেশ একটু আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল, কি করে জানতেন যে আমাদের দেখা হবেই?।

আমি সরাসরি উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করি, আপনার বাবা কি লিগ্যাল প্ৰাক্‌টিশনার?

‘হঠাৎ একথা জিজ্ঞাসা করছেন? সন্দেহের রেখা ফুটে উঠল মেমসাহেবের কপালে।

ভয় পাবেন না, আমি দস্যু মোহন বা ডিটেকটিভ কিরীটী রায় নই।

কিড্‌ স্ট্রট পার হলাম। বেশ বুঝতে পারলাম মেমসাহেবের মন থেকে সন্দেহের মেঘ কেটে যায় নি। তাইতো বললাম, আপনি যে ল পড়েন নি, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে যেভাবে জেরা করতে শুরু করেছিলেন, তাতেই মনে হলো, আপনি বোধহয় ল-ইয়ায়ের-মেয়ে।

মেমসাহেব এবার হেসে ফেললো। বোধহয় মনটাও একটু হালকা হলো।

মিনিট কয়েক দুজনেই চুপচাপ। মিউজিয়াম পার হয়ে এলাম, ওয়াই-এম-সি-এ পিছনে ফেললাম। লিণ্ডসে স্ট্রীটের মোড়ে এসে পড়লাম। আরো এগিয়ে গেলাম। ফিরপো পার হয়ে আর সোজা না গিয়ে রক্সীর দিকে ঘুরলাম। মৌনতা ভাঙলাম আমি, চা খাবেন?

চা? বিশেষ খাই না, তবে চলুন খাওয়া যাক।

পাশের রেস্তোরাঁর একটা কেবিনে বসলাম। বেয়ারা এলো। হাতের তোয়ালে দিয়ে পরিষ্কার টেবিলটা আর একবার মুছে দিল। নোংরা মেনু কার্ডটা আমার সামনে দিয়ে এক নজর দেখে নিল

মেমসাহেবকে।

দু’টো ফিস ফ্রাই, দু’টো চা।

বেয়ারা বিদায় নিল। কিছু বলব বলব ভাবতেই ক মিনিট কেটে গেল। ইতিমধ্যে বেয়ারা দু’টো ফর্ক আর দু’টো ছুরি এনে আমাদের দুজনের সামনে সাজিয়ে দিয়ে চলে গেল। আবার ভাবছি কিছু বলব। কিন্তু বলা হলো না। বেয়ারাটা আবার এলো। এক শিশি সস আর দু গেলাস জল দিয়ে গেল। বুঝলাম, বেয়ারাটা বুঝেছে নতুন জুড়ী এবং সেজন্য ইন্‌ষ্টলমেণ্টে, কাজ করছে। ফিস ফ্রাইএর প্লেট দু’টো নিয়ে বেয়ারাটা আসবার আগেই জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু ভাবছেন?

আঁচলটা টেনে নিয়ে মেমসাহেব বলল, না, তেমন কিছু না।

তেমন কিছু না ঝলেও কিছু তো ভাবছেন?

ফিস ফ্রাই এসে গেল। আমি একটা টুকরো মুখে পুরলাম কিন্তু ফর্কটা হাতে নিয়ে মেমসাহেব কি যেন ভাবছিল। জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু বলবেন?

একটা কথা বলবেন?

নিশ্চয়ই।।

আমাদের দেখা হবে, একথা। আপনি জানলেন কি করে?

কি করে জানলাম তা জানি না, তবে মনের মধ্যে স্থির বিশ্বাস ছিল যে আপনার সঙ্গে দেখা হবেই।

শুধু মনের বিশ্বাস?

হ্যাঁ।

সেদিন একে প্ৰথম সাক্ষাৎকার তারপর ঐ ছোকরা বেয়ারাটার অতিরিক্ত কর্তব্যপরায়ণতার জন্য আর বিশেষ কথা হলো না। তবে ঐ কেবিন থেকে বেরুবার আগে আমার নোটবই-এর একটা পাতা ছিড়ে অফিসের টেলিফোন নম্বরটা লিখে দিলাম। শুধু বলেছিলাম, সম্ভব হলে টেলিফোন করবেন।

কিছুটা লজ্জায় আর কিছুটা ইচ্ছা করেই আমি ওর নাম-ধাম ঠিকানা কিছুই জানতে চাইলাম না। মনে মনে অনেক কিছু ইচ্ছা! করছিল। ইচ্ছা করছিল বলি, তুম মুখাতিব ভী হো, করিব ভী হো, তুমকো দেখু, কী তুমসে বাত করু।–তুমি আমার কাছে বসে আছ, কথা বলছি। তুমিই বল, তোমাকে দেখব, না তোমার সঙ্গে কথা বলব।

আবার ভাবছিলাম, না, না। তার চাইতে বরং প্রশ্ন করি, আঁখো মে হি রহে হো, দিলসে নেহি গ্যায়ে হে, হয়রান হাঃ সঙ্কনী আঁই তুষে কঁহাসে?–সব সময় তুমি আমার চোখে, তুমি আমার হৃদয়ে রয়েছ। ভাবতে পারি না কি ভাবে তুমি আমার হৃদয়-মাঝে এমন তবে নিজের আসন বিছিয়ে নিলে।

সত্যি বলছি দোলাবৌদি, ওকে কাছে পেয়ে, পাশে দেখে বেশ অনুভব করছিলাম, এ তে সেই, যার দেখা পাবার জন্য আমি এত দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছি, এত দীর্ঘদিন সংগ্ৰাম করেছি। মনে মনে বেশ অনুভব করছিলাম। এবার আমার দিন আগত ঐ।

আরো অনেক অনেক কিছু ভেবেছিলাম। সে সব কথা আজ আর লিখে এই চিঠি অযথা দীর্ঘ করব না। তবে শুধু জেনে রাখ, মেমসাহেব এক এবং অদ্বিতীয়া। এই পৃথিবীতে আরো অসংখ্য কোটি কোটি মেয়ে আছেন, তাঁদের প্ৰেম-ভালবাসায় কোটি কোটি পুরুষের জীবন ধন্য হয়েছে। তাঁদের স্পর্শে অনেকেরই ঘুম ভেঙেছে। আমি তাদের সবার উদ্দেশে আমার শ্রদ্ধা জানাই, কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি জানি আমার কালো মেমসাহেবের চাইতে অনেক মেয়েই সুন্দরী, অনেকেই ওর চাইতে অনেক বেশী শিক্ষিতা। তবে একথাও জানি আমার জন্য এই পৃথিবীতে একটিমাত্র মেয়েই এসেছে এবং সে আমার ঐ মেমসাহেব। মেমসাহেব ছাড়া আর কেউ পারত না আমাকে এমন করে গড়ে খুলতে। মাটি দিয়ে তো সব শিল্পীই পুতুল গড়ে। কিন্তু সব শিল্পীর শিল্প-নৈপুণ্য কি সমান? মেমসাহেব আমার সেই অনন্য জীবন-শিল্পী যে কাদামাটি দিয়ে আমার থেকে আজ একটা প্ৰাণবন্ত পুতুল গড়ে তুলেছে। তুমি শুনলে অবাক হবে। আমি সেদিন ওর বাসে পর্যন্ত ওঠার অপেক্ষা করলাম না। আমি আগেই একটা বাসে চড়ে অফিসে চলে এলাম। মনে মনে তাবলাম, আমি তো ওর জন্য অনেক তেবেছি, ভাবছি। এবার না-হয় রেকর্ডের উণ্টে দিকটা দেখা যাক। দেখা যাক না ও আমার জন্য ভাবে কিনা!

রাত্রে অফিসে ফিরেই দেখি বেশ চাঞ্চল্য। সন্ধ্যার পরই টেলিপ্রিস্টারে নিউজ এজেন্সীর খবর এসেছে পূর্ব-পাকিস্থানের বাগেরহাটে খুব গণ্ডগোল হয়েছে। কি ধরনের গণ্ডগোল হলো এবং কলকাতায় কি প্ৰতিক্রিয়া দেখা দেয়, সেই চিন্তায় সবাই। উৎকষ্ঠিত। পরের দিন আমার ডিউটি পড়ল। শিয়ালদহ স্টেশনে। পূর্ব-পাকিস্থানের ট্রেনের যাত্রীদের সঙ্গে দেখা করে সেখানকার পরিস্থিতি জানতে হবে। রিপোর্ট করতে হবে। পরের দিন খুলনার ট্রেনটি এসেছিল, তবে অনেক দেরি করে। প্ল্যাটফর্ম থেকে আজে-বাজে লোক আগে থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিছু সরকারী কর্মচারীও উপস্থিত ছিলেন। বাগেরহাটের পরিস্থিতি জানিবার পর ওরা সবাই আগত যাত্রীদের হুশিয়ার করে দিলেন, অযথা বা মিথ্যা গুজব ছড়াবেন না।

যাত্রীদের কথাবার্তা শুনে বেশ বুঝতে পারলাম অবস্থা বেশ গুরুতর। কোথা থেকে কিভাবে যে গণ্ডগোল হলো, সেকথা কেউ বলতে পারলেন না। তবে যাত্ৰাপুরের এক ভদ্রলোক জানালেন যে, বাগেরহাটের এক জনসভায় পশ্চিম-পাকিস্থানের এক নেতা বক্তৃতা দেবার পরই ওখানে প্ৰথমে কিছু লুটপাট শুরু হয়। দু-তিন দিন পরে ছুরির খেলা শুরু হলো। গুণ্ডাদের হাতে প্ৰথম দিনেই প্ৰাণ দিলেন লুৎফর রহমান।

শিয়ালদহ স্টেশনের বুকিং অফিসের সামনে দু’টো ট্রাঙ্কের পর বসে আমরা দুজনে কথা বলছিলাম। কথা বলছিলাম নয়, কথা শুনছিলাম। ভদ্রলোক আগে একটা ছোট্ট স্কুলে মাস্টারী করতেন।

অনেকদিন মাস্টারী করেছেন ঐ একই স্কুলে। বাগেরহাটের সবাই ওঁকে চিনতেন, ভালবাসতেন। অধিকাংশ ছাত্ৰই মুসলমান ছিল কিন্তু তা হোক। ওরাও ওকে বেশ শ্রদ্ধা করত। লুৎফর সাহেব যখন ঐ স্কুলের সেক্রেটারী ছিলেন, তখন স্কুলবাড়ি দোতলা হলো, ছেলেদের ভলিবল খেলার ব্যবস্থা হলো, দশ-পনের টাকা করে মাস্টার মশাইদের মাইনেও বাড়ল। কি জানি কি কারণে পরের বছর সরকার স্কুল-কমিটি বাতিল করে দিলেন। ক’ মাস পরে স্কুলের তহবিল তছরূপের অভিযোগে লুৎফর সাহেবকে গ্রেপ্তার করা হয়, কিন্তু কোর্টে সেসব কিছুই প্ৰমাণিত হলো না।

ইতিমধ্যে স্কুলের নতুন কর্তৃপক্ষ ভদ্রলোকের চাকরি খতম করে দিলেন অযোগ্যতার অভিযোগে। অনন্যোপায় হয়ে একটা দোকান খুললেন। প্ৰথম প্ৰথম বিশ্ৰী লাগত দোকানদারী করতে। কিন্তু কি করবেন? পরে অবশ্য মন লেগেছিল ব্যবসায়ে। ব্যবসাটাও বেশ জমে উঠেছিল। পোড়া কপালে তাও টিকল না। এবারের গণ্ডগোলে দোকানটা পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

এসব কাহিনী আমার না জানলেও চলত, কিন্তু কি করব। আর এমন কোন যাত্রী পেলাম না। যার কথায় ভরসা করে রিপোর্ট লেখা যায়। তাই চুপচাপ বসে শুনছিলাম। তবে এতক্ষণ ধৈৰ্য ধরে এত কথা শোনার পুরস্কার পেলাম পরে।

লুৎফর সাহেব ছাত্রজীবনে ছাত্ৰ-কংগ্ৰেসে ছিলেন। পরে ওকালতি করার সময় রাজনীতি প্ৰায় ছেড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু পূৰ্বপাকিস্থানের রাজনৈতিক আবহাওয়া জটিল হবার সঙ্গে সঙ্গে লুৎফর সাহেব। আবার রাজনীতি শুরু করলেন। সারা খুলনা জেলা লুৎফর সাহেবের কথায় উঠত, বসত। সারা জেলার মধ্যে কোন অন্যায় অবিচারের কথা শুনলেই গর্জে উঠেছেন। খুলনা ডকের কয়েক হাজার বাঙালী মুসলমান শ্ৰমিক অনেক দিনের অনেক অত্যাচার আর অপমানের বিরুদ্ধে প্ৰথম গর্জে উঠেছিল লুৎফর সাহেবেরই নেতৃত্বে।

পূর্ব-পাকিস্থানের মসনদ থেকে ফজলুল হক সাহেবকে অপসারিত করে ইস্কান্দার মির্জা পূর্ব বাংলাকে শায়েস্তা করবার জন্য ঢাকায় আসার কিছুকালের মধ্যেই লুৎফর সাহেবকে ডেকে পাঠান লুৎফর সাহেব লাটসাহেবের নেমস্তন্ন খেতে ঢাকা গিয়েছিলেন। তবে একবেলা বুড়ীগঙ্গার ইলিশ খাইয়েই সে নেমস্তন্ন খাওয়া শেষ। হয় নি। দুটি বছর ঢাকা সেন্টাল জেলে বিশ্রাম নেবার পর লুৎফর সাহেব খুলনা আসার অনুমতি পান।

খুলনা ফেরার পর লুৎফর সাহেব আরো বেশী রুখে দাঁড়ালেন।

আমার অফিসে ফিরে রিপোর্ট লিখতে হবে। এত দীর্ঘ কাহিনী শোনার অবসর ছিল না। তাই ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, লুৎফর সাহেব আজকাল কি করেন?

—লুৎফর সাহেব আর নেই। এই দাঙ্গায় বাগেরহাটের প্রথম বলি হলেন লুৎফর।

সে কি বলছেন?

আমাদেরও তো ঐ একই প্রশ্ন।

তবুও কি মনে হয়?

বাগেরহাটের লাহোর কটন মিলে অনেকদিন ধরেই শ্রমিক ধর্মঘট চলছে। লুৎফর সাহেব ওদের লীডার। কিছুদিন ধরেই আমরা শুনছিলাম। লুৎফর সাহেবকে শায়েস্তা করার জন্য শহরে নাকি বাইরের অনেক গুণ্ড এসেছে। আমরা কেউ বিশ্বাস করিনি।; কারণ-বাগেরহাট শহরে লুৎফর সাহেবের গায় হাত দেবার সাহস স্বয়ং ইস্কান্দার মির্জারও হয় নি। কিন্তু এরই মধ্যে সর্বনাশা দাঙ্গা শুরু হলো বুধবার সন্ধ্যার দিকে। পরের দিন বাড়ির থেকে বাইরে যাইনি। শুক্রবার সকালে দোকানটা দেখতে গিয়ে শুনি লুৎফর সাহেব শেষ।

আমি বেশ বুঝতে পারলাম। লুৎফর সাহেবকে সরাবার জন্যই লাহোর কটন মিলের মালিকদের চক্রান্তে বাগেরহাটে গণ্ডগোল বাধানো হয়েছে। কেননা, শহরের অবস্থা স্বাভাবিক থাকলে লুৎফর সাহেবকে শেষ করা যেত না।

অফিসে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হলো। বেশ ক্লান্ত বোধ করছিলাম। তবুও চটপট করে বাগেরহাটের দাঙ্গার নেপথ্য কাহিনী লিখে ফেললাম।

তাই সারাদিন মেমসাহেবের কথা ভাববার ঠিক সময় পেলাম না।

পরের দিন আমার উইকলি অফ ছিল। অফিসে গেলাম না। তার পরের দিন আমার টেলিফোন ডিউটি ছিল। তাই একটু দেরি করেই অফিসে গেলাম।

এখনকার মত তখন ডায়াল ঘুরালেই নম্বর পাওয়া যেত না। অপারেটরের ওপর নির্ভর করতে হতো। খবরের কাগজের রিপোর্টারের নাইট-টেলিফোন ডিউটি একটা বিচিত্র ব্যাপার। পুলিস, হাসপাতাল, এ্যাম্বুলেন্স, ডক, রেল-পুলিস, রেল স্টেশন, দমদম এয়ারপোর্ট ইত্যাদি জায়গার থেকে দৈনন্দিন টুকটাক লোক্যাল নিউজ পাবার জন্যে প্ৰায় শতখানেক টেলিফোন করতে হতো। আমাদের কাগজের পাড়াতে এবং একই টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আরো চার-পাচটি কাগজের অফিস ছিল। এক্সচেঞ্জের অপারেটররা প্ৰতি রাত্রে এই লাইন দিতে দিতে প্ৰায় রিপোর্টার হয়ে উঠেছিলেন। নাম্বার বলবার প্রয়োজনও হতো না; শুধু বললেই হতো, রিভার পুলিস দেবেন নাকি?

উত্তর আসত, রিভার পুলিস এনগেজ। টাইমস অফ ইণ্ডিয়া কথা বলছে।

এখনকার মত তখন এরারপোর্ট রিপোর্টার বলে কিছু ছিল না। তাই সাধারণ ছোটখাটো খবরের জন্য এয়ারপোর্ট পুলিস-সিকিউরিটিতে রোজ রাত্তিরে ফোন করতে হতো। তাইতো রিভার পুলিস না পেয়ে বলতাম, এয়ারপোর্ট দিন।

অপারেটর সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিতেন, সিকিমের মহারাজার এ্যারাইভাল ছাড়া আর কিছু নেই।

সঙ্গে সঙ্গেই আবার হয়ত বলতেন, এবার নীলরতনের সঙ্গে কথা বলুন। কি একটা সিরিয়াস অ্যাকসিডেণ্টের খবর আছে।

সব অপারেটরই যে এইরকম সাহায্য করতেন, তা নয়। তবে অধিকাংশ মেয়েই খুব সহযোগিতা করতেন। রাত্রে টেলিফোন ডিউটি করতে করতে বহু অপারেটরের সঙ্গে অনেক রিপোর্টারেরই বেশ মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নানা অবস্থায় রিপোর্টাররাও যেমন অপারেটরদের সাহায্য করতেন, তেমনি অপারেটররাও রিপোর্টারদের যথেষ্ট উপকার করতেন।

কোন কোনদিন খবরের চাপ বিশেষ না থাকলে অনেক সময় আমরা নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা বলতাম। এইরকম কথাবার্তা বলতে বলতেই আমরা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অনেক কাহিনী শুনেছিলাম। জানতে পেরেছিলাম। অনেক অফিসারের আনটোল্ড স্টোরি। কিছু কিছু কাগজে ছাপিয়ে ফাস করেও দেওয়া হয়েছিল। অপারেটরদের উপর অনেক অফিসারের খাম-খেয়ালিপনা বন্ধ হয়েছিল।

অপারেটররাও আমাদের কম উপকার করতেন না। কৈলাশনাথ কাটজু তখন পশ্চিম বাংলার গভর্নর। আর ডাঃ রায় মুখ্যমন্ত্রী। কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে দুজনের মধ্যে তীব্ৰ মত-বিরোধ দেখা দিয়েছে বলে নানা মহলে গুজব শোনা গিয়েছিল, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও মত-বিরোধের সঠিক কারণগুলো কেউই জানতে পারছিলাম না। শেষে একদিন অকস্মাৎ এক টেলিফোন অপারেটর জানালেন, জানেন, আজ একটু আগে টেলিফোনে গভর্নরের সঙ্গে চীফ মিনিস্টারের খুব একচোট…

দুদিন বাদে এই ঝগড়ার কাহিনীই আমাদের কাগজের ব্যানার স্টোরি হলো। মোটা মোটা অক্ষরে চার-কলম সামারিতে লেখা হলো, রাজভবনের সহিত সংশ্লিষ্ট অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য মহলের নিকট হইতে জানা গিয়াছে যে রাজ্য পরিচালনার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে রাজ্যপালের সহিত মুখ্যমন্ত্রীর মত-বিরোধ দেখা দিয়াছে।–

শুধু বাংলা দেশের জনসাধারণ বা রাইটার্স বিল্ডিংস-এর কিছু অফিসার নয়, স্বয়ং ডাঃ রায় ও কাটজু সাহেব পৰ্যন্ত চমকে গিয়েছিলেন এই খবরে। অনেক তদন্ত করেও ওঁরা জানতে পারেন নি। কি করে এই চরম গোপনীয় খবর ফাঁস হয়ে গেল।।

আমরা অফিসে বসে শুধু হেসেছিলাম। আর ভাবছিলাম ইচ্ছা করলে আরো কত কি আমরা ছাপতে পারতাম। কিন্তু ছাপিনি।

এইরকম আরো অনেক চমকপ্ৰদ খবর পেতাম। আমাদের অপারেটর বান্ধবীদেৱঃ মারফত ও মাঝে মাঝেই বাজার গরম করে তোলা হতো। মন্ত্রী আর অফিসারের দল কানামাছি ভেঁ-ভেঁা করে মিছেই হাতড়ে বেড়াতেন, আর আমরা মুচকি হাসতে হাসতে ঐ মন্ত্রী ও অফিসারদের ঘরে বসে। ওদের পয়সায় কফি খেয়ে বেড়াতাম।

সেদিন রাত্রে অফিসে এসে যথারীতি টেলিফোনটা তুলে জিজ্ঞাসা করলাম, কে কথা বলছেন?

কণ্ঠস্বর অপরিচিত নয়। তাই উত্তর আসে, আমি গার্গী।

এক মুহুর্ত পরেই আমাকে প্রশ্ন করেন মিস গার্গী চক্রবর্তী, অনেকদিন পর আজ আপনার টেলিফোন ডিউটি পড়ল, তাই না?

উত্তর দিই, না। অনেকদিন কোথায়…

গার্গী মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে জানতে চায়, কাল আর পরশু। আপনি অফিসে আসেন নি?

কেন বলুন তো।

আগে বলুন কোথায় ছিলেন দুদিন।

কোথায় আবার থাকবে, কলকাতাতেই ছিলাম। তবে। কালকে আমার অফ ছিল। আর পরশু অনেক রাত্রে অফিসে এসেছিলাম।’

তাই বুঝি?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

গার্গী চক্রবর্তী টেলিফোন ছাড়ে না। ইনিয়ে-বিনিয়ে দু’চারটে আলতু-ফালতু কথার পর জিজ্ঞাসা করল, তারপর আপনি কেমন আছেন?

হঠাৎ আজ পঞ্চাশ টাকা মাইনের রিপোর্টারের এত খবর নিচ্ছেন, কি ব্যাপার?

যাস্ট এ মিনিট বলে গার্গী অন্য কাউকে লাইন দিতে গেল। আমি টেলিফোন ধরে রইলাম। একটু পরেই ফিরে এলে আমার লাইনে। বলল, কাল-পরশু আপনার অনেক টেলিফোন এসেছিল।

আমি গার্গীকে দেখতে পাই না। কিন্তু বেশ অনুভব করতে পারছিলাম ওর হাসিখুশী ভরা মুখখানা। আমি এবার একটু ঠাট্টা করে বললাম, আমি তো মিস গার্গী চক্রবর্তী নই যে আমার অনেক টেলিফোন আসবে।

তাই বুঝি?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

গলার স্বরে একটু অভিনবত্ব এনে গার্গী বলে, অনেকে না হোক এক’জনও তো অনেকবার টেলিফোন করতে পারে-যাস্ট এ মিনিট…

গার্গী আবার লাইন দিতে চলে যায়।

আমি ভাবি কে আমাকে অনেকবার টেলিফোন করতে পারে। মেমসাহেব হয়ত একবার টেলিফোন করতে পারে। কিন্তু অনেকবার কে করল?

গার্গী এবার ফিরে এসে বলল, সত্যি বলছি। এক’জন আপনাকে অনেকবার…

কিন্তু তাতে আপনাকে এত ইণ্টারেস্ট!

কিছুই না। তবে এতদিন আপনার এই ধরনের টেলিফোন আসত না বলেই আর কি…

এবার আমার মনে সন্দেহ দেখা দিল। তবে কি মেমসাহেবই?

গার্গী বলল, ধরুন, আমি তাঁর সঙ্গে কানেকশন কয়ে দিচ্ছি।

আপনি বুঝি নাম্বারটাও জেনে নিয়েছেন?

ওদিক থেকে গার্গীর গলার স্বর শুনতে পেলাম না। একটু পরেই বলল, নিন, স্পীক হিয়ার।

আমি বেশ সংযত হয়ে শুধু সম্বোধন করলাম, নমস্কার।

নমস্কার। কি খবর বলুন?

কি আর খবর। আপনারই তো দুদিন পাত্তা নেই।

মেমসাহেব দুদিন ধরে আমাকে খোজ করেছে জেনে বেশ সুখী হলাম। তবুও ন্যাকামি করে প্রশ্ন করলাম, আপনি কি টেলিফোন করেছিলেন?

কি আশ্চৰ্য। আপনাকে কেউ বলেন নি?

আমাদের অফিস আর হরি ঘোষের গোয়ালের মধ্যে যে কোন পার্থক্য নেই সেকথা মেমসাহেবকে কি করে বোঝাই। তাই বললাম, খবরের কাগজের অফিসে এত টেলিফোন আসে যে কারুর পক্ষেই মনে রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া রোজই তো ডিউটি বদলে যাচ্ছে।

মেমসাহেব সঙ্গে সঙ্গে বলল, কেন। ঐ অপারেটর ভদ্রমহিলা আপনাকে বলেন নি?

গার্গী হঠাৎ আমাদের দুজনের লাইনে এসে বলে গেল, বলেছি। মেমসাহেব চমকে গেল। আমি কিন্তু জানতাম গার্গী আমাদের লাইন ছেড়ে পালাবার পাত্রী নয়।

মেমসাহেব ঘাবড়ে প্রশ্ন করল, কে উনি?

মিস গার্গী চক্রবর্তী।

হাজার হোক মেয়ে তো! গার্গীর নাম শুনেই মেমসাহেবের মনটা সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। হয়ত বা ঈর্ষাও। তাই হেঁয়ালি করে জানতে চায়, আপনার সঙ্গে বুঝি মিস চক্রবর্তীর বিশেষ পরিচয় আছে?

আমি আপন মনেই একটু হেসে নিই। আর বলি, অধিকাংশ অপারেটরের সঙ্গেই আমাদের প্রায় সব রিপোর্টারদেরই যথেষ্ট পরিচয় আছে।

আমি আবার টিল্পানী কেটে জিজ্ঞাসা করি, কোন ছোট প্রেমের গল্পের প্লট এলো নাকি আপনার মাথায়?

বোধ করি মেমসাহেব বুঝেছিল, গার্গীর বিষয়ে আর প্রশ্ন করার প্রয়োজন নেই। বললে, কালকে আপনার সঙ্গে দেখা করে প্লটটা ঠিক করব।

আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করি, কাল দেখা হবে?

বিকেলের দিকে হতে পারে।

বিকেল পাঁচটায় লিণ্ডসে স্ট্রীটের মোড়ে আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। আসবেন।

হ্যাঁ, আসব।

দোলাবৌদি, তুমি তো জানি কলকাতার শহরে মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েদের একটু প্ৰেম করা কি দুরূহ ব্যাপার। প্রেম করা ত্বে দূরের কথা, একটা গোপন কথা কইবার পর্যন্ত জায়গা নেই কলকাতায়। আমাদের শৈশবে লেকে গিয়ে প্ৰেম করার প্রথা চালু ছিল, কিন্তু পরে লেকের জলে এতগুলো ব্যর্থ প্রেমিক-প্ৰেমিকা আত্মহত্যা করল যে লেকে গিয়ে প্রেম করা তো দূরের কথা, একটু বেড়ানও অসম্ভব হলো।

এমন একটা আশ্চর্য শহর তুমি দুনিয়াতে কোথাও পাবে না। শুধু কলকাতা বাদ দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত শহরে-নগরে কত সুন্দর সুন্দর বেড়াবার জায়গা আছে। নিত্যনতুন আরো সুন্দর সুন্দর বেড়াবার জায়গা তৈরি হচ্ছে কিন্তু আমাদের কলকাতা? সেই জব চার্নক আর ক্লাইভ সাহেবের ওভারসিয়ারবাবুরা যা করে গেছেন, আমাদের আমলে তাও টিকল না। কলকাতার মানুষগুলোকে যেন একটা অন্ধকূপের মধ্যে ভরে দিয়ে চাবুক লাগান হচ্ছে অথচ তাদের চোখের জল ফেলার একটু সুযোগ বা অবকাশ নেই।

সমস্ত যুগে সমস্ত দেশের মানুষই যৌবনে প্ৰেম করেছে ও করবে। যৌবনের সেই রঙীন দিনগুলোতে তারা সবার থেকে একটু দূরে থাকবে, একটু আড়াল দিয়ে চলবে। কিন্তু কলকাতায় তা কি সম্ভব? নতুন বিয়ে করার পর স্বামী-স্ত্রীতে একটু নিভৃতে মনের কথা কইবার জায়গা কোথায়? মাতৃহারা শিশু বা সন্তানহারা পিতামাতা গলা ফাটিয়ে প্ৰাণ ছেড়ে কাঁদতে পারে না। কলকাতায়। এর চাইতে আর কি বড় ট্র্যাজেডী থাকতে পারে মানুষের জীবনে?

কেতাবে পড়েছি ও নেতাদের বক্তৃতায় শুনেছি বাঙালী নাকি সৌন্দর্যের পূজারী, কালচারের ম্যানেজিং এজেন্টস। রুচিবোধ নাকি শুধু বাঙালীরই আছে। কিন্তু হলপ করে বলতে পারি কোন নিরপেক্ষ বিচারক কলকাতা শহর দেখে বাঙালীকে এ অপবাদ নিশ্চয়ই দেবেন না। রবীন্দ্রনাথ যে কিতাবে চিৎপুর-জোড়ার্সাকোয় বসে কবিতা লিখলেন, তা ভেবে কুলকিনারা পাই না। শেক্সপিয়র বা বায়রন বা অধুনাকালের টি এস ইলিয়টকে চিৎপুরে ছেড়ে দিলে কাব্য করা তো দূরের কথা একটা পোস্টকার্ড লিখতে পারতেন না।

আশ্চৰ্য, তবুও বাঙালীর ছেলেমেয়েরা আজো প্ৰেম করে, কাব্যচর্চা করে, শিল্প-সাধনা করে। যেখানে একটা কৃষ্ণচুড়ার গাছ নেই, যেখানে একটা কোকিলের ডাক শোনা যায় না, দিগন্তের দিকে তাকালে যেখানে শুধু পাটকলের চিমনি আর ধোয়া চোখে পড়ে, সেই বিশ্বকর্মার তীর্থক্ষেত্রে আমি আর মেমসাহেবও নতুন জীবন করলাম।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে