🔴মেমসাহেব (পর্ব :১, ২, ৩, ৪)🔴
– নিমাই ভট্টাচার্য
ওয়েস্টার্ণ কোর্ট
জনপদ
নিউদিল্লী
দোলাবৌদি,
তোমার চিঠি পেলাম। অশেষ ধন্যবাদ। তুমি আমাকে ভালবাস, স্নেহ করা। তাইতো স্বপ্ন দেখ আমি ঘর বাঁধি, সুখী হই। একটা রাঙা টুকটুকে বৌ আসুক আমার ঘরে। আমাকে দেখাশুনা করুক, একটু ভালবাসুক, আমার জীবনের একটা অবলম্বন হোক। তাই না? ভাবতে বেশ লাগে। আমার এই ছন্নছাড়া জীবনে একটা জুনিয়র দোলা এসে দোলা দিলে মন্দ হতো না! হয়ত তাঁর আবির্ভাব হলে নিজের জীবনটাকে নিয়ে এমন জুয়া খেলতাম না, ভবিষ্যত নিয়ে ছিনিমিনি করতাম না। হয়তো তাঁর ছোঁয়া পেলে বুকের ব্যথাটা সেরে যেত, হয়ত নিকট ভবিষ্যতে মূসৌরী বা নৈনীতালের কোন নার্সিংহোমে যাবারও প্রয়োজন হতো না। হয়ত আরো অনেক কিছু হতো। নিজের কাছ থেকে নিজেকে এমনভাবে লুকিয়ে রেখে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতাম না। তাই না দোলাবৌদি?
সত্যি কথা বলতে কি, বিয়ে করতে আমার সম্মতি না থাকলেও যদি কোন মেয়ে আমাকে বিয়ে করে তাতে আমার বিশেষ অসম্মতি নেই। বরং বেশ আগ্রহই আছে। আর তাছাড়া আগ্ৰহ না থাকার কি কারণ থাকতে পারে?
তুমি তো নিজেই আঠারো কি উনিশ বছর বয়স থেকে খোকনদাকে দোলা দিতে শুরু করেছিলো। ইউনিভার্সিটির দুই গেট দিয়ে দুজনে বেরুতে। তুমি ইউনিভার্সিটির দোরগোড়া থেকে ২-বি বাসে চাপতে আর খোকনদা মেডিক্যাল কলেজের পিছন থেকে ননম্বর বাসে চাপত। দুজনে দুটি বাসে চাপলে কি হয়। দুজনেই তো নেমে পড়তে লিণ্ডসে স্ট্রটএর মোড়ে। ডিসেম্বরের হাড়কঁপানো শীতে ফাঁকা দাৰ্জিলিং উপভোগ করেছ তোমরা দুজনে। এসব আমি জানি। আরো জানি তুমি নিজের হাতের কঙ্কণ আর গলার মোটা হারটা বিক্ৰী করেছিলে বলেই খোকনদা অত দিন ধরে রিসার্চ করে পি-এইচ-ডি হতে পারল। এমনি করে দোলা দিতে দিতে একদিন অকস্মাৎ নিজের দোলনায় তুলে নিলে খোকনদাকে।
এসবই তো নিজের চোখে দেখা। আরো অনেককেই তো দেখলাম। মঞ্জরী, লিপি, কণিকারাই কি কম খেল দেখাল। আমার প্রথম যৌবনের সেই সবুজ কাঁচ দিনগুলিতে তোমরা সবাই আমাকে যথেষ্ট ইনফ্লুয়েন্স করেছিলো। হয়ত আজো সে ইনফ্লুয়েন্স শেষ হয় নি। আর ঐ অনুরাধা? কত বড় বড় কথা, কত লেকচার, কত তর্ক-বিতর্ক। বিয়ে? সরি! শেষ পৰ্যন্ত একটা পুরুষের তৃষ্ণা মেটাবার জন্য আমাকে শিকার করবে? নেভার, নেতার, নেতার!
মনে পড়ে দোলাবৌদি? অনুরাধা শেষকালে চীৎকার করে হেনরি ফিল্ডিংকে কোট্ করে বলত, His designs were strictly honourable, as the saying is : that to rob a lady of her fortune by way of marriage.’
আমাদের সেই অনুরাধাও একদিন বর্ধমানের নীতীশের গলায় মালা পরাল। আমি দিল্লীতে ছিলাম না। তাই অনুরাধার আমন্ত্রণ পেতে একটু দেরী হওয়ায় সে দৃশ্য দেখার সুযোগ আমার হয় নি। কিন্তু তার বৌভাত-ফুলশয্যার দিন আমি বর্ধমান না গিয়ে পারিনি। প্ৰাচীন কাব্যে আছে অনন্তযৌবন উর্বশীর ক্যাবারে ডান্সের ঠেলায় স্বৰ্গরাজ্যের ম্যানেজিং ডাইরেকটরদের সব কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছিল। কিন্তু মুনি-ঋষিদের নাচে উর্ষণীয় ধ্যানভঙ্গ? না, পড়িনি। তবে দেখলাম অনুরাধার বেলায়। একটা ভাঙা জীপগাড়ি, দু’টো কনেস্টবল আর একটা পেটমোটা সাব-ইন্সপেকটরের ঘাড়ে চড়ে আই-পি–এস নীতীশ এমন নাচই নাচল যে, অনুরাধাও ক্লিন বোল্ড হয়ে গেল।
ঐ উৎসবের বাড়িতেই লোকজনের ভিড় একটু পাতলা হলে আমি কানে-কানে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, অনু, এ কি হলো? ছিঃ ছিঃ। শেষ পর্যন্ত পুরুষের তৃষ্ণা মেটাবার শিকার হলে?
তুমি তো অনুরাধাকে ভালভাবেই জান। ও ভাঙবে কিন্তু মাচকাবে না। তাই শেকসপিয়ারের অ্যান্টনি অ্যাণ্ড ক্লিওপেট্ৰ থেকে কোট করে বলল, My salad days when I was green in judgement.’
চমৎকার! তোমাদের এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে আমার বিয়ে করার ইচ্ছা হওয়া কি স্বাভাবিক নয়? মাঝে মাঝেই ভাবি আমিও যদি খোকনদা বা নীতীশের মত…।
যাকগে ওসব। আচ্ছা দোলাবৌদি, তাছাড়া পাত্র হিসেবে কি আমি খুব খারাপ? বোধ হয় না, তাই না? লেখাপড়া না শিখলেও কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে গেছি কবছর। খবরের কাগজের স্পেশ্যাল করাসপেনডেণ্টের চাকরিটাও নেহাত মন্দ নয়। বেশ চটক আছে। মাইনেও নেহাত কম পাই না। বাড়ি না। থাকলেও গাড়ি আছে, নায়েব না থাকলেও স্টেনে তো আছে। তাছাড়া শুনেছি আজকালকার মেয়েরা বিলেত-ফেরত দুষ্ট ছেলেদের বেশ পছন্দ করে। মেয়েদের বাপ-মা স্মার্ট-সফিসটিকেটেড বলে। ঐসব দুষ্ট ছেলেদের জামাই করতে আপত্তি করেন না। সেদিক থেকে আমি ওভার-কোয়ালিফায়েড! একবার নয়, বহুবার গেছি। বিলেত। লোকে বলে দুষ্টুমিও নাকি করেছি।
আরো একটা ব্যাপার আছে। পটলডাঙার গোবিন্দ বিলেতফেরত বলে বিয়েতে ফিল্মস্টারদের মত ইনক্যাম ট্যাকস ফ্রি দশ হাজার টাকা ব্ল্যাকমানি পেয়েছিল। সুতরাং আমার ভবিষ্যতও বেশ উজ্জল মনে হয়। আর তাছাড়া তোমার মত হাই ফাস্টক্লাশ পাওয়া এজেণ্ট যখন আছে। পয়সাওয়ালা বোকা বোকা লোকের একটা উদ্ভুত উড়ু, মেয়ে শিকার করা অধ্যাপিকা দােলা সরকারের পক্ষে নিশ্চয়ই খুব কষ্টকর নয়।
তবে তার আগে মেমসাহেব উপাখ্যানটা তোমাদের সবার জেনে নেওয়া দরকার। আমার ঐ কালো মেমসাহেবকে নিয়ে তোমরা অনেকদিন হাসি-ঠাট্টা করেছ। হয়ত কিছু ধারণাও করেছ মনে মনে। শুধু তুমি কেন, অনেকের মনেই আমার মেমসাহেবকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন। কেউ-কেউ ভাবে মেমসাহেব বলে কেউ নেই। পুরোটাই গুল, ফোরটোয়েন্ট। আবার কেউ-কেউ ভাবেন মেমসাহেবকে আমি শুধু ভালবাসিনি, বিয়েও করেছি। নানা ধরনের নানা লোকজনের কাছ থেকে মেমসাহেব সম্পর্কে চিঠিপত্রও কম পাই না।
যার সঙ্গেই নতুন আলাপ হয়, তিনিই প্রশ্ন করেন, মেমসাহেব কে? ছেলেমেয়ে বুড়ো-বুড়ী সবারই ঐ এক প্রশ্ন। এইত কদিন আগে দিল্লী ইউনিভার্সিটির এক তথ্বী-শ্যামার সঙ্গে আলাপ হলো। বাড়িতে নিয়ে গেলেন। দু’টো থিন-এরারুট বিস্কুট, একটা প্যাড়া সন্দেশ আর এক কাপ চা দিয়েই মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, মা জানতে চাইছিলেন মেমসাহেবের আসল নাম কি?
বছরখানেক আগে সিউড়ি থেকে এক বৃদ্ধ পার্শেল করে একটা লাল টুকটুকে সিল্কের শাড়ী পাঠিয়েছিলেন। সঙ্গে একটা ছোট্ট চিঠি ছিল। লিখেছিলেন, তোমার মেমবৌকে এই শাড়ীটা আশীৰ্বাদী পাঠাচ্ছি। বিদেশী মেমকে এই শাড়ীটা পরলে ভালই লাগবে। মাতৃতুল্য স্নেহাতুর বৃদ্ধাকে আমি লিখেছিলাম, মা, শাড়ীটা আপনি সাবধানে রেখে দিন। সময় মত আপনার মেমবৌকে নিয়ে ওখানে গিয়েই শাড়ীটা গ্ৰহণ করব।
মেমসাহেবকে নিয়ে আরো কত কি কাণ্ডই হয়। তাইতো এবার ভেবেছি তোমাদের সঙ্গে এমন করে আর লুকোচুরি না খেলে পুরো ব্যাপারটাই খুলে বলব। তাছাড়া আমার জীবনের এইসব ইতিহাস না জানলে তোমার পক্ষে ঘটকালি করারও অসুবিধা হতে পারে। তোমাকে সব কিছু লেখার আগে নৈতিক দিক থেকে মেমসাহেবের একটা অনুমতি নেওয়া দরকার। কিন্তু আজ সে এতদূরে চলে গেছে যে, তার অনুমতি যোগাড় করা প্ৰায় অসম্ভব। আর হ্যাঁ, তাছাড়া ঠিকানাটাও ঠিক আমার জানা নেই।
পর্ব ১ শেষ 📌
🔴পর্ব :২🔴
মনে হলো তুমি আমার চিঠি পড়ে ঘাবড়ে গেছ। গত চিঠিতে বিশেষ কিছুই লিখি নি, এমন কি গৌরচন্দ্রিকাও পূর্ণ হয় নি। সুতরাং এখনই নার্ভাস হবার কি আছে? তাছাড়া তুমি না মেয়ে? অন্যের প্রেমের ব্যাপারে তোমাদের তো আগ্রহের শেষ নেই। শিক্ষিতাই হোক, আর অশিক্ষিতাই হোক, প্ৰেমপত্র সেন্সর করতে মেয়েরা তো শিরোমণি! ইউনিভার্সিটির জীবনে তো দেখেছি লেকচার শোনা, কফিহাউসে আড্ডা দেবার মত অন্যদের প্ৰেমপত্ৰ হাত করাও প্ৰায় সব মেয়েদের নিত্যকার কাজ ছিল। গণ্ডগ্রামে যাও, সেখানেও দেখবে পারুল-বৌদির চিঠি অন্নপূর্ণ-ঠাকুরঝি না পড়ে কিছুতেই ছাড়বে না। শুনেছি স্কুল-কলেজে মেয়েদের চিঠি এলে দিদিমণিরা একবার চোখ না বুলিয়ে ছাড়েন না। ছাত্রীদের অভিভাবকত্ব করবার অছিলায় চুরি করে প্রেমপত্র পড়াকে কিছুটা আইনসম্মত করা যেতে পারে মাত্র; কিন্তু তার বেশী কিছু নয়।
তাছাড়া প্রেমের কাহিনী জানতে মেয়েদের অরুচি? কলিকালে না জানি আরো কত কি দেখব, শুনব। মেয়ের বিয়ে হলে মা পৰ্যন্ত জানতে চান, হ্যারে খুকী, জামাই আদর-টোব্দর করেছিল তো? হাজার হোক মা তো! ঠিক খোলাখুলিভাবে সব কথা জিজ্ঞাসা করতে পারেন না। তাই ঘুরিয়ে আদর-টাব্দর করার খবর নেন। বাসরঘর তো মাসি-খুড়ি থেকে দিদিদের ভিড়ে গিজ-গিজ করে।
আর সেই সতী-সাবিত্রী সীতা-দময়ন্তী থেকে শুরু করে। আমাদের মা-মাসিরা যে সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধ্বজ বহন করে এনেছেন, শত বাধা-বিপত্তি অগ্ৰাহ্য করে যে ঐতিহ্যের ধারা অম্লান রেখেছেন, আজ তুমি সেই মহান আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে, আমি ভাবতে পারিনি।
সর্বোপরি আমি যখন নিজে স্বেচ্ছায় তোমাকে সব কথা বলছি, তখন তোমার লজ বা সঙ্কোচের কি কারণ থাকতে পারে? আর তোমাকে ছাড়া আমার এই ইতিহাস কাকে জানাব বলতে পারো? তুমি আমার থেকে মাত্র এক বছরের সিনিয়র হলেও তোমাকে। আমি সেই প্ৰথম পরিচয়ের দিন থেকেই ভালবেসেছি, শ্ৰদ্ধা করেছি। খোকনদার প্রতি তোমার শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালবাসা যেদিন থেকে আবিষ্কার করেছি। সেইদিন থেকেই তুমি আমার দোলাবৌদি; হয়েছ। ছাত্রজীবনের সেই শেষ দিনগুলিতে আর আমার কর্মজীবনের প্রথম অধ্যায়ে তুমি আর খোকনদা যেভাবে আমাকে সাহায্য করেছ, সহানুভূতি জানিয়েছ, তার তুলনা হয় না। তাইতো জীবনের সমস্ত সুখে-দুঃখে প্ৰথমেই মনে পড়ে তোমাদের।
মেমসাহেবের ব্যাপারটা ইচ্ছা করেই জানাই নি। তোমরা অবশু-কিছু কিছু আঁচ করেছিলে কিন্তু খুব বেশী জানতে পার নি। ভগবানের দয়ায় আমি দিল্লী চলে আসায় নাটকটা আরো বেশী জমে উঠেছিল। আমি ভেবেছিলাম, তোমাকে আর খোকনদাকে একটা সারপ্রাইজ দেব। তাই কিছু জানাই নি। কিন্তু আর দেরি করা ঠিক হবে না। তুমি যখন আমার বিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছ। তখন সব কিছু না জানান অন্যায় হবে।
আর শুধু মেমসাহেবের কথাই নয়, আমার জীবনে যেসব মেয়েরা এসেছে, তাদের সবার কথাই তোমাকে লিখব। সব কিছু তোমাকে জানাব। কিছু লুকাব না। আর কিছু না হোক, তোমাকে হলপ করে এইটুকু গ্যারান্টি দিতে পারি যে, আমার এই কাহিনী তোমার খুব খারাপ লাগবে না। যদি ভাষাটাকে একটু এডিটু করে, তাহলে হয়ত ছাপা হয়ে বই বেরুতে পারে।অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন
সুতরাং হে আমার দোলাবৌদি। ধৈৰ্য ধরা! হে আমার খোকনদার প্রাণের প্রিয় দোলে দোদুল দোলে দোলনা দোলা। তোমার ভ্রাতৃসম লক্ষ্মণ-দেবরের প্রতি কৃপা করি, তার ইচ্ছা পূৰ্ণ কর!
পর্ব ২ শেষ 📌
🔴পর্ব :৩🔴
সেদিন কি তিথি, কি নক্ষত্র, কি লগ্ন ছিল, তা আমি জানি না। জীবন-নদীতে এত দীর্ঘদিন উজান বইবার পর বেশ বুঝতে পারছি যে সেদিন বিশেষ শুভলগ্নে আমি পৃথিবীর প্রথম আলো দেখিনি। এই পৃথিবীর বিরাট স্টেজে বিচিত্র পরিবেশে অভিনয় করার জন্য আমার প্রবেশের কিছুকালের মধ্যেই মাতৃদেবী প্ৰস্থান করলেন। একমাত্র দিদিও আমার জীবন-নাট্যের প্রথম অঙ্কেই জামাইবাবুর হাত ধরে শ্বশুরবাড়ি কেটে পড়ল। আমার জীবনের সেই প্ৰাগৈতিহাসিক তিনটে কপিও পাওয়া গিয়েছিল। নিয়মিত বাসাবাদলের দৌলতে দু’টি কপি নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তৃতীয় কপিট দিদির সংসারে ক্ষুধার্ত উইপোকার উদরের জ্বালা মেটাচ্ছে। মানুষের জীবনে প্ৰথম ও প্ৰধান নারী হচ্ছে মা। তাঁর স্নেহ, তার ভালবাসা, তাঁর চরিত্র, আদর্শ প্রতি পুত্রের জীবনেই প্রথম ও প্রধান সম্পদ। আমি সেই স্নেহস্পৰ্শ, ভালবাসা ও সম্পদ থেকে চিরবঞ্চিত থেকে গেছি।–তাইতো আমার জীবনে নারীর প্রয়োজন ও গুরুত্ব উপলব্ধিতে অনেক সময় লেগেছে।
ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে ও আশপাশে কোন বোন বা অন্য কোন নারীচরিত্র না থাকায় মেয়েদের সম্পর্কে আমার শঙ্কা ও সঙ্কোচ, বহুদিন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় নি। আমার কৈশোরের সেই সেদিনের কথা মনে হলে আজও হাসি পায়।…
তখন ক্লাশ নাইন থেকে টেনএ উঠেছি। সবে পাখনা গজান শুরু হয়েছে। হাফ প্যাণ্ট ছেড়ে মালকেঁচা দিয়ে ধুতি পরা ধরেছি। ফুলহাতা শার্টের হাত না গুটিয়ে পরলে বোকা বোকা মনে হয়।, শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল পেটাতে বেশ আত্মসম্মানে লাগে। বিকেলবেলার একমাত্ৰ রিক্রিয়েশন দু’চারজন বন্ধু মিলে পাড়ার এদিক-ওদিক ঘুরেফিরে আডা দেওয়া। মণ্টু দার বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল, হৃদ্যতা ছিল। দু’একবার পৌষসংক্রান্তির দিন মণ্টুদার মা আমাকে আদর করে পিঠে-পায়েসও খাইয়েছেন। শুনেছি দিদির বিয়ের সময় মন্টুদাদের বাড়ির সবাই খুব সাহায্য করেছিলেন। ঐ বাড়ির সবার সঙ্গেই আমার পরিচয় ছিল,–ওদের পরিবারের অনেক খবরই আমি জানতাম। জানতাম না। শুধু নন্দিনীর কথা। ছোটনাগপুরের মালভূমি থেকে মন্ট দ্বার এই চঞ্চল। কিশোরী ভাইঝি কবে আকস্মাৎ মহানগরীতে আবিভূতি। হয়েছিলেন, সে খবর আমি রাখিনি। তিনিও যে নাইন থেকে টেনএ উঠে মীর্জাপুরের বীণাপাণি বালিকা বিদ্যালয়কে ধন্য করার জন্য কলকাতা এসেছেন, তাও জানতাম না। জানতাম না আরো অনেক কিছু। জানতে পারিনি যে চোদ্দ বছর বয়সেই তিনি তার জীবন-নাট্যের নায়ক খুঁজতে বেরিয়েছেন। এসব কিছুই আমি জানতাম না।
একদিন মণ্টুদাদের বাড়ি থেকে দু একটা গল্পের বই নিয়ে। বেরুবার সময় মাথার ওপর একটা কাগজের প্যাকেট এসে পড়ায় চমকে গেলাম। কুড়িয়ে নিয়ে দেখলাম একটা খাম। নাম ঠিকানা কিছুই লেখা ছিল না। শুধু লেখা ছিল, তোমার চিঠি। তোমার চিঠি। মানে আমার চিঠি! মুহুর্তের জন্য ঘাবড়ে গেলাম। দু’এক মিনিট বোধহয়। থমকে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর একটু হলেই চীৎকার করে মণ্টুদাকে ডাক দিতাম। কিন্তু হঠাৎ যেন কে আমার মাথায় বুদ্ধি জোগাল। চারপাশটা একনজরে দেখে নিলাম। শুধু বুড়ো কাকাতুয়া পাখীটা ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলাম না। খামটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলাম। উপরের লেখাটা বারিকয়েক পড়লাম, তোমার চিঠি। তারপর দৃষ্টিটা দোতলার দিকে ঘুরিয়ে নিতেই কোনার ঘরের জানলায় হাসিখুশিভরা একটা সুন্দরী কিশোরীকে দেখলাম।অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন
অনেকদিন আগেকার কথা সবকিছু ঠিক মনে নেই। তবে আবছা আবছা মনে পড়ে কি যেন একটা ইশারা করে নন্দিনী লুকিয়েছিল। নারী চরিত্র সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞতা না থাকলেও আমার বুঝতে কষ্ট হয়নি চিঠিটি নন্দিনীরই লেখা।
প্ৰায় ছুটতে ছুটতে বাসায় এলাম। ঘরের খিল বন্ধ করে চিঠিটা একবার নয়, অনেক বার পড়লাম। চিঠির ভাষাটা আজ আর মনে নেই। কিন্তু ভাবটা একটু একটু মনে পড়ে। কিছুটা উচ্ছ্বাস, কিছুটা আবেগ ছিল চপলা, কিশোরী নন্দিনীর ঐ চিঠিতে। চিঠিটা পেয়ে তালও লেগেছিল, ভয়ও লেগেছিল। তার চাইতে আরো বেশী লেগেছিল অবাক। ধনীর দুলালীর জীবন-উৎসবে আমার আমন্ত্রণ! আমার মত একটা ভাঙা ডিঙ্গি নৌকা চড়ে, নন্দিনী জীবন-সাগর পাড়ি দেবে? আমি কল্পনাও করতে পারিনি।
নন্দিনী চিঠির উত্তর চেয়েছিল কিন্তু আমার সাহস হয় নি। উৎসাহও আসে নি। উত্তর দিইনি, তবুও আবার চিঠি পেয়েছিলাম। ইঙ্গিত পেয়েছিলাম, আমি নাকি তার মানসরাজ্যের রাজপুত্র। পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে নন্দিনীকে নিয়ে অভিষিক্ত করব আমার জীবন-সঙ্গিনীরূপে। আরো অনেক স্বপ্ন দেখেছিল। সে। জীবন যার প্রাচুর্যে ভরা, বিলাসিত করা যার স্বভাব, তার পক্ষে এমন অহেতুক স্বপ্ন দেখা হয়ত স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মত দৈন্যভরা কিশোরের পক্ষে এমন স্বপ্ন দেখা সম্ভব ছিল না। তাইতো তার সে আমন্ত্রণ আমি গ্ৰহণ করতে পারিনি। সে আমন্ত্রণ গ্ৰহণ করার ক্ষমতা বা সাহসও আমার ছিল না।
নন্দিনীকে আমি ভালবাসিনি। কিন্তু প্ৰাণচঞ্চল এই কিশোরীকে ভুলব না কোনদিন। সে আমার জীবনযজ্ঞের উদ্বোধনসঙ্গীত গেয়েছিল। এই কিশোরী আমার জীবন-নাট্যমঞ্চে শুধু একটু উকি দিয়েই সরে গিয়েছিল, বিশেষ কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করার অবকাশ পায় নি, কিন্তু তবু তার এক অনন্য ভূমিকা রয়ে গেছে আমার কাছে। বি-এ বা এম-এ পাশ করার পর জীবনের বৃহত্তর পটভূমিকায় অতীতের অনেক স্মৃতি হারিয়ে যায়, কিন্তু হারিয়ে যায় না পাঠশালার গুরুমশায়ের স্মৃতি। নন্দিনী আমার তেমনি একটি অমূল্য স্মৃতি। সে আমার তোরের আকাশের একটি তারা। সে তারার জ্যোতিতে আমি আমার জীবন-পথ চলতে পারিনি বা তার প্রয়োজন হয় নি। তা না হোক। তবুও সে আমার জীবন দিগদর্শনে সাহায্য করেছিল। সর্বোপরি সে আমাকে আমার আমিত্ব আবিষ্কারে সাহায্য করেছিল।
ভালবাসা কি এবং তার কি প্রয়োজন, সেদিন আমি বুঝিনি, জানিনি। নন্দিনী কেন আমাকে ভালবেসেছিল, কি সে চেয়েছিল,, কি পেয়েছিল–কিছুই আমি জানি না। শুধু এইটুকুই জানি আমার সুখে সে সুখী হতো, আমার দুঃখে সে লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জলও ফেলেছে। ছন্দোবদ্ধভাবে এইসব অনুভূতির প্রকাশ করবার সুযোগ কোনদিনই সে পায় নি। কিন্তু যখনই সে সুযোগ এসেছে, নন্দিনী তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে।
সরস্বতী পূজার আগের ক’দিন মরবার অবকাশ থাকত না। খাওয়া-দাওয়া তো দূরের কথা ঘুমুবার পর্যন্ত সময় পেতাম না। সারা দিন-রাত্তিরই রিপন স্কুলে কাটাতাম। নন্দিনী ঠিক জানত আমি কোন গরম জামা নিয়ে যাই নি। সন্ধ্যার পর এক ফাঁকে। একটা আলোয়ান নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দিয়ে আসত। বলত, তোমার কি ঠাণ্ডাও লাগে না? যদি জ্বরে পড়, তাহলে কি হবে বল তো!
একবার সত্যি সত্যিই আমি খুব অসুস্থ হয়েছিলাম। নটা বাজতে না বাজতেই বাবা বিদায় নিতেন। ফিরতে ফিরতে সেই রাত দশটা! অখিল মিস্ত্রী লেনের ঐ বিখ্যাত ভাঙা বাড়িটার অন্ধকার কক্ষে আমি একলা থেকেছি। মণ্টুদাদের বাড়ি থেকে আমার পথ্য সরবরাহের ব্যবস্থা হয়েছিল নন্দিনীর আগ্রহেই। দুবেল স্কুলে যাতায়াতের পথে নন্দিনী আমাকে দেখে যেত। হয়ত একটু সেবা-যত্নও করত।
এসব অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। শুধু আমার জন্য এক’জন পথ চেয়ে বসে থাকবে, আমাকে ভালবেসে, সেবা করে, যত্ন করে, কেউ মনে মনে তৃপ্তি পাবে, আমি ভাবতে পারতাম না। নন্দিনী আমার জীবনে সেই অভাবিত অধ্যায়ের সূচনা করে।
ম্যাট্রিক পাশ করার পরই নন্দিনী বোম্বে চলে গেল। আমার জীবনের সেই ক্ষণস্থায়ী অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। কিন্তু তবুও সে আমার জীবন থেকে একেবারে বিদায় নিল না। চিঠিপত্ৰ নিয়মিত আসত। আর আসত আমার জন্মদিনে একটা শুভেচ্ছা। আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা নেতাজী নই। আমার মত সাধারণ মানুষের জন্মদিনে যে কোন উৎসব বা অনুষ্ঠান হতে পারে, তা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। আমার জন্মদিনে বাবা ধান-দূর্বা দিয়ে আশীৰ্বাদ করেই অফিসে দৌড় দিতেন। সেবারেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় নি। বিকেলবেলায় নন্দিনী টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে আমার জন্য সামান্য কিছু উপহার এনে চমকে দিয়েছিল।
নন্দিনী আজ অনেক দূরে চলে গেছে। সুখে-শাস্তিতে স্বামীপুত্র নিয়ে ঘরসংসার করছে। তার আজ কত কাজ, কত দায়িত্ব। কিন্তু তবুও একটা গ্ৰীটিংস টেলিগ্রাম পাঠাতে ভোলে না। আমার জন্মদিনে।
কলকাতা থেকে বিদায় নেবার পর আমার সঙ্গে নন্দিনীর আর দেখা হয় নি। এম-এ পড়বার সময় ওর বিয়ে হলো এক আই-এ–এস পাত্রের সঙ্গে। নিমন্ত্রণাপত্রের সঙ্গে একটা ব্যক্তিগত অনুরোধপত্রও এসেছিল। কিন্তু আমার পক্ষে তখন বোম্বে যাওয়া আদৌ সম্ভব ছিল না। টিউশানির টাকা আগাম নিয়ে পনের টাকা দামের একটা তাঁদের শাড়ী পাঠিয়েছিলাম। ইতিমধ্যে আমি আমার জীবন-যুদ্ধে এমন মেতে উঠেছিলাম যে নন্দিনীকে মনে করার পর্যন্ত ফুরসত পেতাম না।
প্ৰায় বছর দশেক পরে আমি গ্যাংটক গিয়েছিলাম কি একটা কাজে। তিন-চারদিন পরে কলকাতার পথে শিলিগুড়ি ফিরছিলাম। পথে আটকে পড়লাম। সেবক ব্রীজের কাছে কিছুটা ধ্বস নেমে রাস্তা বন্ধ হয়েছিল। কুলি-মজুরের দল রাস্তা পরিষ্কারে ব্যস্ত। আমার মত অনেকেই প্ৰকৃতির এই খামখেয়ালীপনায় বিরক্ত হয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছিলেন। রাস্তা পরিষ্কার হতে আরো ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। এই দীর্ঘ অবসরে অনেকের সঙ্গেই আলাপ-পরিচয় হলো। কার্শিয়াং-এর তরুণ এস-ডি-ওর সঙ্গেও বেশ ভাব হয়ে গেল।
মাসিকয়েক পর আবার কর্মব্যাপদেশে দাৰ্জিলিং যাচ্ছিলাম। পথে কার্শিয়াং পড়বে। মনে মনে ঠিক করেছিলাম। এস-ডি-ও সাহেবের সঙ্গে দেখা করব। শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়াং এলাম। হঠাৎ অফিসে গিয়ে হাজির হওয়ায় এস-ডি-ও সাহেব চমকে গেলেন। পরপর দুকাপ কফি গিলেই পালাবার উপক্রম করছিলাম কিন্তু এস-ডি-ও সাহেব বললেন, তা কি হয়। আমার কোয়ার্টারে যাবেন, লাঞ্চ খাবেন। তারপর বিকেলের দিকে দাৰ্জিলিং যাবেন।
আমার কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই এস-ডি-ও সাহেব কোয়ার্টারে টেলিফোনে স্ত্রীকে জানালেন, নন্দা, আমার এক বন্ধু এসেছেন কলকাতা থেকে। লাঞ্চে নিয়ে আসছি। তুমি একটু ব্যবস্থা করো।
গোটা বারো নাগাদ এস-ডি-ও সাহেব আমাকে নিয়ে কোয়ার্টারে গেলেন। ড্রইংরুমে আমাকে বসিয়ে রেখে স্নান করবার জন্য বিদায় নিলেন। মিনিট কয়েক পরে আর কেউ নয়, স্বয়ং নন্দিনী কফির কাপ হাতে নিয়ে আমার সামনে হাজির হলো। দুজনেই একসঙ্গে বলেছিলাম, তুমি?
সেদিন কার্শিয়াং পাহাড়ের সমস্ত কুয়াশা ভেদ করেও নন্দিনীর চোখেমুখে যে উজ্জ্বলতা, যে আনন্দ দেখেছিলাম, তা কোনদিন ভুলব না। এস-ডি-ও সাহেবকে বলেছিলাম, আপনি যে মণ্টুদাদের বাড়ির জামাই, তা তো জানতাম না। সংক্ষেপে জানালাম ওর শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আমাদের হৃদ্যতার কথা। গোপন করিনি যে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ছোটবেলায় খেলাধুলা করেছি।
এস-ডি-ও আমাকে শ্বশুরবাড়ির দূত মনে করে আনন্দে মেতে উঠলেন। লাঞ্চের টেবিলে এক গেলাস স্কোয়াস হাতে নিয়ে আমার হেলথ এর জন্য প্রপোজ করতে গিয়ে ঘোষণা করলেন, মিস্টার জার্নালিস্ট আজ রাত্রে এক স্পেশ্যাল ডিনারে চীফ গেস্ট হবেন এবং কাশিয়াংএ রাত্রিবাস করবেন।
আমি বললাম, তা কি হয়।
এস-ডি-ও সাহেব বললেন, ভুলে যাবেন না। আমি শুধু অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন চালাই তা নয়, বিচারও করি। আমি কার্শিয়াংএর চীফ জাস্টিস কাম প্ৰাইম মিনিস্টার।
নন্দিনী বলল, এতদিন পর যখন দেখা হলো, একটা দিন থাকলে কি তোমার খুব ক্ষতি বা কষ্ট হবে?
সত্যি খুব আনন্দ করে সেই দিনটি কাটিয়েছিলাম। নন্দিনী ঠিক এতটা আদর-যত্ন করবে, ভাবতে পারিনি।
কর্মজীবনের পাকচক্ৰে আমি ছিটকে পড়েছি বহুদূরে। নন্দিনীর সঙ্গে আমার আর দেখা হয় নি, ভবিষ্যতে কোনদিন দেখা হবে। কিনা, তাও জানি না। তবে ভুলব না তার স্মৃতি।
জান দোলাবৌদি, আমি কার্শিয়াং ত্যাগের আগে নন্দিনী বলেছিল, একটা অনুরোধ করব?
আমি বলেছিলাম, তার জন্য কি অনুমতির প্রয়োজন?
না তা নয়। তবে বলো আমার অনুরোধটা রাখবে।
বিদায় নেবার প্রাক্কালে মনটা নরম হয়েছিল। কোনকিছু তর্ক করার প্রবৃত্তি ছিল না। বললাম, নিশ্চয়ই রাখব।
তোমার পুত্রবধূর নাম রেখে নন্দিতা। রাখবে তো? আমি স্তম্ভিত হয়েছিলাম ওর ঐ বিচিত্ৰ অনুরোধ করার জন্য। ঠোঁটটা কামড়াতে কামড়াতে কথা বলতে পারিনি। শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলাম।
এই চিঠি আর দীর্ঘ করব না। তাছাড়া তুমি তো আমার চিঠি। একবার পড়ে ক্ষান্ত হও না। আর যাই কর আমার এসব চিঠি তুমি কলেজে নিয়ে ক্লাশে বসে পড়ে না। তিন-চারদিনের জন্য এলাহাবাদে যাচ্ছি। ফিরে এসে আবার চিঠি দেব।
পর্ব ৩ শেষ 📌
🔴পর্ব :৪🔴
ভেবেছিলাম তিন-চার দিনের মধ্যেই এলাহাবাদ-বাস শেষ হবে। আশা করেছিলাম। এই কদিনের মধ্যেই ভারতবর্ষের ভাষা সমস্যার একটা হিল্পে হবে। দেশটা এমন একটা স্তরে এসে পৌচেছে যে আমাদের কোন আশাই যেন আর কোনদিন পূর্ণ হবে বলে মনে হয় না। ভাষা নিয়েও তাই আমাদের আশা পূর্ণ হলো না এবং আমার এলাহাবাদ ত্যাগ করাও সম্ভব হয় নি। আমি আজও এলাহাবাদে আছি; আগামী কাল ও পরশুও আছি। হয়ত আরো অনেক দিন থাকতে পারি।
ক’দিন শুধু টাইপরাইটার খট্খটু করে প্রায় অ্যালার্জি হবার উপক্রম হয়েছে। তাইতো একটু মুখ পাণ্টে নেবার জন্য তোমাকে আমার মেমসাহেব কাহিনী আবার লিখতে শুরু করলাম।
নন্দিনীর বিদায়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবন সংগ্ৰাম শুরু হলো। তুমি তো জান বাংলাদেশটা দুটুকরো। হবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মত লক্ষ লক্ষ বাঙালী যুবক-যুবতীদের অদৃষ্টও টুকরো টুকরো হয়ে গেল। কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণে এমন করে কালবৈশাখী দেখা দেবে। ভাবিনি। জীবনের সমস্ত দিগন্ত এমনভাবে অন্ধকারে ভরে যাবে।
রিপন স্কুল ত্যাগ করে রিপন কলেজে ভর্তি হলাম। সবার মুখেই শুনছিলাম আর্টস পড়লে কোন ভবিষ্যত নেই; সায়েন্স না। পড়লে দেশ ও দেশের যুবকদের মুক্তির কোন উপায় নেই। বাপ-ঠাকুর্দার সঙ্গে জ্ঞানের পরিচয় থাকলেও চোদপুরুষের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু তবুও আমি বিজ্ঞান সাধনা শুরু করলাম। তবে দেশের অবস্থা এমন অদ্ভুত জটিল হয়েছিল যে শুধু বিজ্ঞান সাধনা করেই দিন কাটান সম্ভব ছিল না, লক্ষ্মীর সাধনাও শুরু করলাম।
কলেজে গিয়ে লেখাপড় করা মুখ্য হলেও সকাল-সন্ধ্যায় টিউশানি করে রসদ যোগাড় করার কাজটাও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এই দেটিানার মধ্যে প্ৰাণান্ত হবার উপক্রম হয়েছিল। নিজেয় দিকে ফিরে তাকাবার অবকাশ পাচ্ছিলাম না। ছোটবেলায় কলেজ জীবন সম্পর্কে অনেক রূপকথার কাহিনী শুনতাম। স্কুলে পড়বার সময় তাই অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বপ্ন দেখতাম, ধুতি-পাঞ্জাবি পরে হাতে খাতা দোলাতে দোলাতে কলেজে ঘুরে বেড়াচ্ছি, মাস্টার মশাইদের মত প্রফেসাররা অযথা ছাত্রদের বকাবিকি করছেন না, ক্লাশ ফাঁকি দেবার অবাধ স্বাধীনতা এবং আরো অনেক কিছু। আশা করেছিলাম কলেজ জীবন সাফল্যপূর্ণ বৃহত্তর জীবনের পাশপোর্ট তুলে দেবে আমার হাতে। এই ক’বছরের শিক্ষা-দীক্ষা ও সৰ্বোপরি অভিজ্ঞতা আমার চোখে নতুন স্বপ্ন, নতুন আশা এনে দেবে, সম্ভব করে তুলবে তাদের বাস্তব রূপায়ণ। লুকিয়ে লুকিয়ে মনে মনে হয়ত এ আশাও করেছিলাম আমি সার্থক, সাফল্যপূর্ণ ও পুর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে সগৰ্বে এগিয়ে যাব আগামী দিনের দিকে।
সেদিন জানতাম না বাংলা দেশের সব যুবকই কলেজ জীবনের শুরুতে এমনি অনেক স্বপ্ন দেখে এবং সে স্বপ্ন চিরকাল শুধু স্বপ্নই থেকে যায়। বোধহয় একজনের জীবনেও এসব স্বপ্ন বাস্তব হয়ে দেখা দেয় নি। তবুও বাঙালীর ছেলে স্বপ্ন দেখে; স্বপ্ন দেখে হাসিতে গানে ভরে উঠবে তার জীবন। জীবন পথের চড়াই উতরাই পার করতে সাহায্য করবে। আদর্শবতী জীবন-সঙ্গিনী এবং আরো অনেক কিছু।
লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বাঙালী যুবকদের মত হয়ত আমিও এমনি স্বপ্ন দেখেছিলাম কোন দুর্বল মুহুর্তে। অতীতের ব্যর্থতার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিইনি, পূর্বসূরীদের অভিজ্ঞতা আমাকে শাসন করতে পারে নি, সংযত করতে পারে নি।
তবে আমি আমার কল্পনার উড়োজাহাজ উড়িয়ে বেশিদূর উড়ে যাই নি। রিপন কলেজের এয়ারপোর্ট থেকে টেক অফ করার পরপরই ক্রাশ ল্যাণ্ড করে সন্বিত ফিরে পেয়েছিলাম।
একদিকে অর্থ চিন্তা ও অন্যদিকে ভবিষ্যতের চিন্তায় আমি এমন প্ৰমত্ত থাকতাম যে আশপাশে কোন ভ্ৰমর আমার মধু খাবার জন্য উড়ছে কিনা, সে খেয়াল করার সুযোগ পেতাম না। জীবনটার সঙ্গে সঙ্গে মনটাও কেমন যেন সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছিল। আমার সীমিত জীবনের মধ্যে যে ক’টি নারী-পুরুষের আনাগোনা ছিল তাদের দিকে ফিরে তাকাবারও কোন আগ্রহ বা উৎসাহ ছিল না।
কিন্তু কি আশ্চৰ্য, কিছুকাল পর হঠাৎ আবিষ্কার করলাম কে যেন আমার মনোবীণার তারে মাঝে মাঝে ঝঙ্কায় দিচ্ছে। চোখের দৃষ্টিটা কেমন যেন একটু রঙীন মনে হলো। ক’দিন আগে পর্যন্ত যে আমার মুহুর্তের ফুরসত ছিল না নিজের দিকে তাকাবার, সেই আমি নিজের দিকে ফিরে তাকান শুরু করলাম। আরো একটা গেরুয়া পাঞ্জাবি তৈরী করলাম। কায়দা করে ধুতি পরাও ধরলাম। পাড়ার সেলুনে চুল কাটা আর রুচিসম্মত মনে হলো না। পরের মাসে টিউশানির মাইনে পাবার পর একজোড়া হাল ফ্যাশানের কোলাপুরী চটিও কিনলাম।
এমনি আরো অনেক ছোটখাটো পরিবর্তন এলে আমার দৈনন্দিন জীবনে। আগে দু’টো একটা বই আর খাতা নিয়ে কলেজে যেতাম। এখন বই হাতে করে কলেজে যেতে আত্মসম্মানে বাধতে লাগল। বই নেওয়া ত্যাগ করে শুধু খাত হাতে করে কলেজ যাওয়ার নিয়মটা পাকাপাকি করে নিলাম। মোদ্দা কথা আমি এক নতুন ধর্মে দীক্ষিত হলাম। বাসাংসি জীর্ণানি করে আমি এক নতুন আমি হলাম।অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন
অদৃষ্ট নেহাতই তাল। বেশিদূর এগুতে হলো না। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। আজ আত্মজীবনীর সেই রঙীন দিনগুলোর কথা মনে হলে হাসি পায়। সেদিন। কিন্তু হাসি পায় নি। মরীচিকাকেই সেদিন জীবনের চরম সত্য বলে মনে করে। ছুটেছিলাম। ঘটনাটা নেহাতই সামান্য।
বারাকপুর-টিটাগড় বা খিদিরপুরের বড় বড় কলকারখানার মত তখন আমাদের কলেজও তিন শিফটএ হতো। সকালে মেয়েদের, দুপুরে ছেলেদের, রাত্ৰিতে প্ৰৌঢ়দের ক্লাশ হতো। বেথুন বা লেভী ব্ৰাবোর্মের ছাত্রীদের মধ্যে যুবতী কুমারীদের মেজরিটি থাকলেও আমাদের কলেজের মর্নিং সেকসনের চেহারা ছিল আলাদা। নীলিমা সরকারের মত সদ্য প্ৰস্ফুটিত গোলাপের সংখ্যা খুব বেশী ছিল না। দেশটা স্বাধীন হবার পর অনেকের সংসারেই আগুন লাগল। এক টুকরো বস্ত্ৰ আর এক মুষ্টি অন্নের জন্য, রুগ্ন শিশুর একটু পথ্যের জন্য, জীবনধারণের নিতান্ত প্ৰয়োজনীয় দাবী মেটাবার জন্য বাংলা দেশের হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ গৃহস্থ বধুদের ডালহৌসী স্কোয়ারের রঙ্গমঞ্চে নামতে হলো। তাইতো এই ডালহৌসী রঙ্গমঞ্চে আসবার পাশপোর্ট যোগাড় করার জন্য অনেক বৌদি আর ছোট মাসিমারাই আবার কলেজে পড়া শুরু করলেন। তাছাড়া আর একদল মেয়েরা নতুন করে উচ্চ শিক্ষা নিতে সে সময় শুরু করলেন। দেশটা স্বাধীন হবার পর অনেক অন্ধকার ঘরেই হঠাৎ বিংশ শতাব্দীর আলো ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের কলেজের বীণামাসির মত যারা কোন অন্যায় না করেও স্বামী ও শ্বশুর-বাড়ির অকথ্য অত্যাচার দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সহ করেছেন, যারা বিবাহিতা হয়েও স্ত্রীর মর্যাদা পাননি, স্বামীর ভালবাসা পাননি, সন্তানের জননী হয়েও যাঁরা মা হবার গৌরব থেকে বঞ্চিতা হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই বন্দীশালার অন্ধকূপ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলেন। অজানা, অজ্ঞাত, ভবিষ্যতের সঙ্গে মোকাবিলা করবার জন্য এদের অনেকেই আবার কলেজে ভর্তি হলেন। আমাদের কলেজেও অনেকে ভৰ্তি হয়েছিলেন।
দিনের বেলায় হাফ আদর্শবাদী, হাফ ভাবুক, হাফ পলিটাসিয়ান, হাফ অভিনেতা, হাফ গায়ক, হাফ খেলোয়াড়দেরই সংখ্যা ছিল বেশী। সন্ধ্যার পর যারা আসতেন। তাঁদের অধিকাংশই ডালহৌসী-ক্যানিং স্ট্রট-ক্লাইভ স্ট্রট থেকে অধমৃত অবস্থায় ছুটতে ছুটিতে কলেজে আসতেন।
সওয়া দশটায় মেয়েদের ক্লাশ শেষ হতো আর ছেলেদের ক্লাশ শুরু হতো। আমার ক্লাশ কোনদিন সওয়া দশটায়, কোনদিন এগারটায় শুরু হতো। সওয়া দশটায় ক্লাশ থাকলে ছেলেরা কোনদিন লেট করত না। বরং দশটা বাজতে বাজতেই কমনরুম ছেড়ে দোতলা-তিনতলার দিকে পা বাড়াত। সওয়া দশটার সন্ধিলয়ের প্রতি অন্যান্য ছাত্রদের মত আমারও আকর্ষণ ছিল। কিন্তু সকালবেলায় দুদু’টো টিউশানি করে কলেজে আসতে আসতে প্ৰায় সাড়ে দশটা হয়ে যেত। তাইতো সওয়া দশটার ক্ষণিক বসন্তের হাওয়া আমার উপভোগ করার সুযোগ নিয়মিত হতো না।
বীণামাসির সঙ্গে প্রায়ই পূরবী সিনেমার কাছাকাছি দেখা হতো। বীণামাসি বিবাহিত যুবতী। কিন্তু সিঁদুর পরত না। বীণামাসি বলত, বিয়ে করেও যখন স্বামীকে পেলাম না, শ্বশুরবাড়িতেও স্থান পেলাম না, তখন সিন্দুর পরব। কার জন্য? কিসের জন্য? ফুটপাথের এক পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা দু’চার মিনিট কথাবার্তা বলতাম। কলেজের ছোকরা অধ্যাপক ও ছাত্রদের কেউ কেউ পাশ দিয়ে যাবার সময় একটু সরস দৃষ্টি দিয়ে চাইতেন। বীণামাসি ও আমি দুজনেই তা লক্ষ্য করতাম। কিন্তু গ্ৰাহ করতাম না।
পর পর ক’দিন বীণামাসির সঙ্গে দেখা হলো না। প্ৰথম ক’দিন বিশেষ কিছু ভাবিনি। পুরো একটা সপ্তাহ দেখা না হবার পর একটু চিন্তিত না হয়ে পারলাম না। অথচ বীণামাসিদের বাড়ি গিয়ে খোজ করব সে সময়ও হয় না। কলেজ শেষ হতে না হতেই আবার টিউশানি করতে ছুটতে হয়।
সেদিনও কলেজে আসবার পথে বীণামসির দেখা পেলাম না। কিন্তু ঐ পূরবী সিনেমার কাছাকাছিই হঠাৎ একটা জীবন্ত বারুদের ভূপ আমার সামনে থমকে দাঁড়াল। বললো, শুনুন। বীণাদির খুব অসুখ। আপনাকে যেতে বলেছেন।
সকাল সাড়ে দশটার সময় হ্যারিসন রোডের পর পূরবী সিনেমার পাশে এমনভাবে এক’জন সুন্দরী আমাকে বীণামাসির সমন জারী করবে, কল্পনাও করতে পারিনি। মুহুর্তের জন্য ভড়কে চমকে গিয়েছিলাম। একটু সামলে নেবার পর অনেক প্রশ্ন মনে এসেছিল। কিন্তু গলা দিয়ে সেসব প্রশ্ন বেরুতে সাহস পায় নি। শুধু বলেছিলাম, আপনি জানলেন কি করে?
–আমি বীণাদির বাড়ি গিয়েছিলাম।
সেই দিনই বিকেলবেলা বীণামাসিকে দেখতে গিয়েছিলাম। আমি যেতেই বীণামাসি আমাকে প্রশ্ন করল, নীলিমার কাছে খবর পেয়েছিস বুঝি?
আমি বললাম, কোন নীলিমা?
ঐ যে আমাদের সঙ্গে পড়ে নীলিমা সরকার…
তা জানিনে, তবে আজ সকালেই পূরবীর কাছে একটা সুন্দর ধরনের মেয়ে…
বীণামাসি আর এগুতে দিল না। বললে, হ্যাঁ, হ্যাঁ ঐ তো নীলিমা।
আমি বললাম, তাই বুঝি?
বীণামাসির কাছে আমি আমার চিত্তচাঞ্চল্যের বিন্দুমাত্ৰ আভাস দিলাম না। নিজেকে সংযত করে নিলাম। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে সেদিনের মত বিদায় নেবার আগে বীণামাসিকে জিজ্ঞাসা করলাম, কলেজ থেকে কেউ তোমাকে দেখতে আসেন না।
হ্যাঁ, অনেকেই আসে।
তিন-চারদিন পরে আবার বীণামাসিকে দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি সেদিনের সেই নীলিমা সরকারও বসে আছেন। নমস্কার বিনিময় করে আম পাশের মোড়াটায় বসলাম। বীণামাসি চাদরটা গলা পর্যন্ত টেনে নিয়ে পাশ ফিরে বললে, জনিস নীলিমা, বাচ্চা আগে আমাদের পাড়াতেই থাকত। আমাদের এই পাড়ায় থাকবাযর সময়ই ওর মা মারা যান…
নীলিমা বললো, তাই নাকি?
আমি বললাম, আমার জীবন কাহিনী শোনার অনেক অবকাশ পাবেন, আজ থাক। যদি লিখতে পারত তবে বীণা মাসি আমার জীবন নিয়ে একটা রামায়ণ লিখত। ভাগ্য ভাল বীণামাসির কলম চলে না, শুধু মুখ চলে। কিন্তু তার ঠেলাতেই আমি অস্থির।
নীলিমার সঙ্গে সেই আমার প্রথম আলাপ-পরিচয় হলো। দশ-বারে দিন পরে বীণামসির ওখানেই আমাদের আবার দেখা। সেদিন দুজনেই একসঙ্গে বেরুলাম। তারপর কলেজ স্কোয়ার পর্যন্ত একসঙ্গে হেঁটে গিয়ে দুজনে দুদিকে চলে গেলাম।
ঐ সামান্য আলাপ-পরিচয়তেই আমি যেন কেমন পালটে গেলাম। সকালবেলার টিউশানিতে একটু একটু ফাঁকি দিয়ে ও স্নানআহারের পর্ব কিঞ্চিৎ ত্বরান্বিত করে দৌড়ে দৌড়ে সওয়া দশটার আগেই কলেজে আসা শুরু করলাম। কোনদিন দেখা হয়, কোনদিন হয় না; কোনদিন কথা হয়, কোনদিন হয় না। কোনদিন আবার দূর থেকে একটু তিৰ্যক দৃষ্টি আর মুচকি হাসি-বিনিময়। তার বেশী আর কিছু নয়। কিন্তু তবুও আমি কেমন স্বপ্নাতুর হয়ে পড়লাম। নীলিমাকে কো-পাইলট করে আমি আমার কল্পনার উড়ো-জাহাজ নিয়ে টেক অফ করলাম। ভাব-সমুদ্রে ভেসে বেড়ালাম।
ঐ শুধু একটু মুচকি হাসি ও ক্ষণিকের দৃষ্টি-বিনিময়কে মূলধন করে আমি অনেক, অনেক দূর এগিয়ে গেলাম। টোপর মাথায় দিয়ে নীলিমার গলায় মালা পরিয়েছিলাম, পাশে বসে বাসর জেগেছিলাম। বৌভাত-ফুলশয্যার দিন গভীর রাত্রে অতিথিদের বিদায় জানিয়ে আমি নীলিমার ঘরে এসে দরজাটা বন্ধ করলাম। নীলিমার পাশে বসে একটু আদর করলাম। তারপর ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে সুইচটি অফ করতে গিয়েই দারুণ শক লাগল। আমার কল্পনার জাহাজ ক্রোশ ল্যাণ্ড করল। কো-পাইলট নীলিমাকে আর কোথাও খুজে পেলাম না।
সাহস করে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারিনি। মহা উৎকণ্ঠায় দিন কাটছিল। নীলিমা-বিহীন জীবন প্ৰায় অসহ্য হয়ে উঠিল। বৈরাগ্যের ভাব মনের মধ্যে মাঝে মাঝেই উকি দিতে লাগল। আর কয়েক দিনের মধ্যে খবর না পেলে হয়ত কেদার বদ্রীর পথেই পা বাড়াতাম। ভগবান করুণাময়। তাই সে যাত্রায় আর সংসার ত্যাগ করতে হলো না, নীলিমার দেখা পেয়ে গেলাম।
দেখা পেলাম বীণামাসির বাড়িতেই। নীলিমার কপালে অতি বড় একটা সি দুরের টিপ দেখে বেশ আঘাত পেয়েছিলাম মনে মনে। প্ৰথমে ঠিক সহজ হয়ে কথাবার্তাও বলতে পারিনি। নীলিমা বোধহয় আমার মানসিক দ্বন্দ্বের ভাষা বুঝেছিল। তাই সে নিজেই বেশ সহজ সরল হয়েছিল আমার সঙ্গে।
জান দোলাবৌদি, নীলিমার বিয়ে হবার পরই আমাদের দুজনের বন্ধুত্ব হলো। কোন কাজে-কর্মে সাউথে গেলেই কালীঘাটে নীলিমার সঙ্গে দেখা করে এসেছি। নীলিমার স্বামী সন্তোষবাবু আজ আমার অন্যতম বিশেষ বন্ধু ও শুভাকাজক্ষী। ওরা এখন আমেদাবাদে আছেন। সন্তোষবাবু একটা বিরাট টেকসটাইল মিলের চীফ অ্যাকাউন্ট্যাণ্ট। এক গাদা টাকা মাইনে পান। নীলিমা আমেদাবাদ টেগোর সোসাইটির সেক্রেটারী। তোমার বোধহয় মনে আছে সেবার গোয়া অপারেশনস কভার করে দিল্লী ফেরার পথে দমন গিয়েছিলাম এবং আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। গত্যন্তর না পেয়ে সন্তোষবাবুকেই একটা আর্জেণ্ট টেলিগ্রাম পাঠাই। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ছুটে এসেছিলেন আমাকে নিয়ে যাবার জন্য। দু-সপ্তাহ ওদের সেবা-যত্নে আমি সুস্থ হবার পর নীলিমা মেমসাহেবকে আমেদাবাদ আনিয়েছিল। দু’সপ্তাহ অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও কোন খবর না দেবার জন্য মেমসাহেব ভীষণ রেগে গিয়েছিল। আমি কিছু জবাব দিতে পারিনি। নীলিমা ওর দুটি হাত ধরে বলেছিল, তোমার সেবা পাবার মত অসুখ হলে নিশ্চয়ই খবর দিতাম। ডক্টর মৈত্রকে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম। উনি বললেন, তাড়াহুড়ো করে ওকে আনাবার কোন কারণ দেখি না। একটু সুস্থ হলেই খবর দেবেন।
একটু থেমে দু’হাত দিয়ে মেমসাহেবের মুখটি তুলে ধরে নীলিমা বলেছিল, তাছাড়া ভাই, আমি বা তোমার দাদাও বাচ্চা কে ভালবাসি। তোমার অভাব আমাদের দ্বারা না মিটলেও ওর সেবাযত্নের কোন ত্রুটি করিনি। আমরা।
মেমসাহেব তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে হাসিতে ভরিয়ে তুললো নিজের মুখটা। বললো, নীলিমাদি, আমি তো আপনাদের দুঃখ দিতে চাইনি। তবে আগে এলে হয়ত নিজে মনে মনে একটু শান্তি পেতাম, তাই আর কি…
নীলিমা আর এগুতে দেয় নি। ঐ অধ্যায়ের ঐখানেই সমাপ্তি হলো।
তারপর আরো এক সপ্তাহ ছিলাম। আমেদাবাদে। কাকারিয়ার লেকের ধারে রোজ বেড়িয়েছি আমরা। কত আনন্দ, কত হৈ-চৈ করেছি। আমরা। যাকগে সেসব কথা।
নন্দিনী যখন আমার জীবনে উকি দিয়েছিল, তখন আমি চমকে গিয়েছিলাম। ভাবতে পারিনি, ভাববার সাহস হয় নি যে একটি মেয়ে আমার জীবনে আসতে পারে বা আমাকে কোন মেয়ে তার জীবনরথের সারথী করতে পারে। যেদিন নীলিমার দেখা পেলাম, সেদিন কি করে এই সংশয়ের মেঘ কেটে গেল জানি না। তবে একথা সত্য যে রূপকথার রাজকুমারীর মত নীলিমার ছোয়ায় আমার ঘুম ভেঙেছিল, আমি কৈশোর থেকে সত্যি সত্যিই যৌবনের সিংহদ্বারে এসে উপস্থিত হলাম।
নীলিমার কথা আজ পর্যন্ত কাউকে জানাই নি। এসব জানাবার নয়। এ আমার একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। এমন কি নীলিমাও জানে না, হয়ত ভবিষ্যতেও জানতে পারবে না।
তবে মেমসাহেবকে বলেছিলাম। মেমসাহেব কি বলেছিল। জান? বলেছিল, সুন্দরী মেয়ে দেখলে যে তোমার মাথাটা ঘুরে যায়, তা আমি জানি। আমার মত কালো কুচ্ছিৎ মেয়েকে যে তোমার পছন্দ হয় না, সে কথাটা অত ঘুরিয়ে বলার কি দরকার?
আমি শুধু বলেছিলাম :
“প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস–
তোমার চোখে দেখেছিলাম। আমার সর্বনাশ।
এ সংসারের নিত্য খেলায় প্ৰতিদিনের প্রাণের মেলায়
বাটে ঘাটে হাজার লোকের হাস্য-পরিহাস–
মাঝখানে তার তোমার চোখে আমার সর্বনাশ।”
একটা চাপা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেছিলাম, তোমার পোড়া কপাল। কি করবে বল। যদি পার পালটে নেবার চেষ্টা কর।
আলোচনা আর দীর্ঘ না করে মেমসাহেব মুচকি হেসে জিভ ভেংচি কেটে পালিয়ে যেত।
চলবে।