🔴মেমসাহেব (পর্ব :১১, ১২, ১৩)🔴
– নিমাই ভট্টাচার্য
তুমিও জান, আমিও জানি, সবাই জানে মানুষের জীবনের গতিপথ ও গতিবেগের পরিবর্তন হয় মাঝে মাঝেই। আমার জীবনেও হয়েছে, হয়ত বা ভবিষ্যতেও হবে। আমার জীবনে মেমসাহেবের উদয় হবার আগে আমার জীবন এমন বিশ্ৰী টিমোতালে চলছিল যে, তা উল্লেখ করারই প্ৰয়োজন নেই। মেমসাহেবকে পাবার পর বেশ কিছুকাল এমন একটা অদ্ভুত নেশায় মশগুল ছিলাম যে, নিজের ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে মাথা ঘামাবার অবকাশ বা প্ৰয়োজন বোধ করিনি।
কিন্তু তারপর মনের আকাশ থেকে অনশ্চিয়তার মেঘ কেটে যাবার পর আমার জীবনে এক আশ্চৰ্য জোয়ার এলো। প্ৰথম প্ৰথম মুহুর্তের আদর্শন অসহ্য, অসম্ভব মনে হতো। মনে হতো বুঝিবা হারিয়ে গেল, বুঝিবা কিছু ঘটে গেল। আমার মত মেমসাহেবের মনেও এমনি অনেক অজানা আশঙ্কা আসত। পরে দুজনে যখন দুজনকে সমস্ত মন প্ৰাণ দিয়ে পেলাম এবং সে পাওয়ার আনন্দে যখন সমস্ত মনটা মন্দির হয়ে গেল, তখন আস্তে আস্তে আজে-বাজে দুশ্চিন্তা বিদায় নিল।
মেমসাহেবের ঐ হাতটা নিজের হাতের মধ্যে না পেলে, মেমসাহেবের বুকে কান পেতে ঐ পরিচিত স্পন্দন না শুনলে প্ৰথম প্ৰথম মনে মনে বড়ই অস্বস্তি পেতাম। পরিচয়ের গণ্ডি পেরিয়ে ভালবাসার সেই প্ৰথম অধ্যায়ে মনটা বড়ই সংকীর্ণ হয়েছিল। শুধু মেমসাহেবকে কাছে পাওয়া ছাড়া যেন আর কোন চিন্তাই মনের মধ্যে স্থান পেত না। বিশ্ব-সংসারের আনন্দমেলায় আমাদের দুজনকে ছাড়া আর কাউকে কল্পনা করতে পারতাম না। দুনিয়ার আর সবাইকে কেমন যেন ফালতু অপ্রয়োজনীয় মনে হতো। জীবনের শুধু একটি দিক, একটি অঙ্গকেই সমগ্র জীবন ভেবেছিলাম। ধীরে ধীরে আমরা যত আপন হলাম, সঙ্গে সঙ্গে এইসব ভুল ধারণাও বিদায় নিল। তাছাড়া মেমসাহেবের ভালবাসা ক্ৰমে ক্ৰমে আমার সমগ্র জীবনকে, জীবনসত্তাকে আলিঙ্গন করল। শুধু আমার ব্যক্তিগত জীবনের একান্ত প্ৰিয়সঙ্গিনী নয়, শুধু যৌবনের আনন্দমেলার পার্শ্ববর্তিনী নয়, মেমসাহেব আমার সামগ্রিক জীবনের অংশীদার হলো।
তুমি তো জান আমাদের পূর্বপুরুষরা শুধু জানতেন পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভাৰ্যা। আমাদের দেব-দেবীদের ইতিহাস পড়লে একএকজনের শত শত সহস্ৰ সহস্ৰ সন্তানের জননী হবার কাহিনী জানা যায়। সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সহস্র বা শত সন্তানের জননী হওয়ার কাহিনী অতীতের ইতিহাসের পাতায় বন্দী হয়েছে। কিন্তু তবুও স্বামীর শয্যা আর রান্নাঘরের মধ্যেই আমাদের নিরানব্বই ভাগ নারীর জীবন সীমিত।
এই ত ইদানীংকালে কত ছেলেমেয়েকে ভালবাসতে দেখলাম, দেখলাম স্বপ্ন দেখতে। ভালবাসা পেয়ে অনেক মানুষের জীবনধারাই পাল্টে যায়। সত্য কিন্তু আমার মেমসাহেব আমাকে শুধু পাণ্টে দেয় নি, সে আমাকে নতুন জীবন দিল। আমাকে ভালবেসে সে অন্ধ হয় নি। রাত্রির অন্ধকারে আমার তপ্ত শয্যায় পলাতকার মত সে আশ্রয় চায় নি, চেয়েছিল আমার সামগ্রিক জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে কিছু-না-কিছু ভূমিকা গ্রহণ করতে।
পুরুষের জীবনে কর্মজীবনের চাইতে বড় কিছু আর হতে পারে। না। কর্মজীবনে ব্যর্থতা, কর্মক্ষেত্রে পরাজয়, পুরুষের মৃত্যু সমান। কর্মজীবনে ব্যৰ্থ, পরাজিত, অপদস্থ পুরুষের জীবনে নারীর তালবাসার কি মূল্য? কোথায় স্বীকৃতি? মেমসাহেব এই চরম বাস্তব সত্য উপলব্ধি করেছিল। আমি কিন্তু, প্রেমের ঘোরে মশগুল ছিলাম। অত শত ভাবনআ-চিন্তা আমার ছিল না। মাদ্রাজ থেকে ঘুরে এসে নতুন কাজ বেশ মন দিয়ে করছি, কিছু টাকাপয়সারও আমদানি হচ্ছে। আমার মনটা খুশীতে ভরে গেল। তাছাড়া কলকাতায় কন্ধে না পেলেও সুদূর মাদ্রাজের একটি ইংরেজী দৈনিক পত্রিকায় কাজ পাবার জন্য সরকারী ও সাংবাদিক মহলে আমার কিছুটা মৰ্যাদা বেড়ে গেল। মনে মনে বোধহয় আমি একটু অহঙ্কারীও হলাম। আবার একদিন মেমসাহেব আমার চৈতন্যে কষাঘাত করল, এবার আর কিছু ভাবছ?
তোমার কথা-না, আমার কথা?
মেমসাহেব চীৎকার করে ওঠে, আঃ! বাজে বকো না।
আমি আশ্চৰ্য হয়ে যাই। তুমি রাগছ কেন?
মেমসাহেব দুই হাঁটুর ওপর মুখখান রেখে কি যেন ভাবছিল। আমার প্রশ্ন শোনা মাত্রই রাগ করে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল।
আমি ডাক দিলাম, মেমসাহেব।
জবাব এলো না।
আবার ডাকলাম, মেমসাহেব শোন না! তবুও কোন জবাব এলো না। একটু চিন্তিত হলাম। একটু কাছে এগিয়ে গেলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, রাগ করছি কেন?
উত্তর এলো, একটু সরে বস। এটা তোমার নিজের ফ্ল্যাটের ডুইং রুম নয়, কলকাতার ময়দান।
বুঝলাম আবহাওয়া খারাপ। ফোর্সল্যাণ্ড করলে আমার প্লেনটাই ক্ষতিগ্ৰস্ত হবে, কোন মঙ্গল হবে না। তাই আবহাওয়ার উন্নতির আশায় আমি উপরে ঘুরপাক খেতে লাগলাম।
বেশ কিছুক্ষণ পরে মেমসাহেব বলল, নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোন মানুষ যে এত নির্বিকার হতে পারে, তা তোমাকে দেখার আগে কল্পনা করতে পারিনি।
হঠাৎ এ-কথা বলছ?
সে-কথা বুঝলে কি আমার কপালে কোন দুঃখ থাকত।
আজ তোমার মুড়-টা খারাপ। s
হ্যাঁ। এবার আমার দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে বলে, বলব, কেন?
বল না?
আপ্রিয় সত্য বলব?
নিশ্চয়ই।
সহস্থ করতে পারবে?
আমি বীরের মত উত্তর দিলাম, ও-তয়ে কম্পিত নয় বীরের হৃদয়।
একটু ঈষৎ বিদ্রূপের হাসি হাসল মেমসাহেব। বললো, আজেবাজে বকতে লজা করে না? কোথায় নিজেকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করবে-তা নয় শুধু—-
এইত সবে নতুন একটা কাজ শুরু করেছি। আবার নতুন কি করব?
তুমি কি করবে তুমি তা জান না?
আমি সত্যি সত্যিই ভাবনায় পড়ি। ভেবে পাই না কি বলতে চায় ও। আমি ওর হাতটা চেপে ধরে বলি, লক্ষ্মী মেমসাহেব, ফ্রাঙ্কলি বল না কি বলতে চাইছ। রাগারগি করে কি লাভ আছে?
মেমসাহেব বলে, এই নতুন কাজটা পাবার পর মনে হয় তুমি যেন আর কিছু চাও না। তাই না?
নিশ্চয়ই চাই কিন্তু চাইলেই যে পাওয়া যায় না, সে-কথা তো
তুমি জানি।
শুধু মেমসাহেবের কথা ভাবলে জীবনে আর কোনদিন কোন কিছুই পেতে হবে না। নতুন কিছু পেতে হলে ঘুরতে হয়, লোকজনের সঙ্গে দেখাশুনা করতে হয়, পরিশ্রম করতে হয়।।
ও-কথাটা ঠিকই বলেছিল। দৈনন্দিন কাজকর্ম করে বাকি সময়টুকু মেমসাহেবের জন্য গচ্ছিত ছিল।
মেমসাহেব আবার বলে, আমাকে তো অনেক পেয়েছ, প্ৰাণভরে পেয়েছ। এখন তো আমার পক্ষে আর কোন চুলোয় যাওয়া সম্ভব হবে না। আমি চাইলেও কেউ আমাকে নেবে না। সুতরাং তুমি তো নিশ্চিন্ত। এবার তাই বলছিলাম, তুমি নিৰ্ভয়ে নিজের কাজ করতে পার।
আমি নতুন কাজটা পেয়ে একটা ধাপ এগিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে থমকেও দাঁড়িয়েছিলাম। অন্ততঃ কিছুদিন নিশ্চিন্তে থাকবার বাসনা ছিল। মেমসাহেবের তা সহ্য হলো না। মেমসাহেব চাইল কর্মজীবনে যতদিন স্থিতি, মৰ্যাদা না। আসবে, ততদিন বিশ্রাম করার কোন প্ৰশ্নই উঠতে পারে না।
কাগজে তো কত লোক কত আর্টিকেল, কত ফিচার, কত গল্প লেখে, তুমিও তো লিখলে পার।
কোনদিন তো ওসব লিখিনি। রিপোর্ট লেখা ছাড়া আর কিছুই তো লেখার সুযোগ আসে নি।
সুযোগ আসে না, সুযোগ করে নিতে হয়।
তোমাকে তো আগেই লিখেছি ও আমার মত বেশী বক বক করত না। অল্প অল্প কথা দিয়েই মেমসাহেবের মনের ভাব বেরিয়ে আসত।
দোলাবৌদি, আজকাল একদল ডাক্তার যেমন পেটেণ্ট ওষুধ, ক্যাপসুল, ট্যাবলেট, ইনজেকশন দিয়েই সমস্ত চিকিৎসা করে, তেমনি খবরের কাগজের প্রায় সব রিপোর্টাররাই বাধাধরা গদে রিপোর্ট লিখতে পারে। রোগীর জন্য একটা মিকশচারের প্রেসক্রিপশন করতে হলে ডাক্তারবাবুর মস্তিষ্কের ব্যায়াম করতে হয়। মামুলি খবরের কাগজের রিপোর্ট লেখার বাইরে কিছু লিখতে গেলেও রিপোর্টারবাবুদের কিছু কেরামতি থাকা দরকার। আমার সে কেরামতি কোনকালেই ছিল না, আজও নেই। কিন্তু ঠেলার নাম বাবাজী। মেমসাহেবের চোখের জল, দীর্ঘনিঃশ্বাস সহ করা অসম্ভব বলেই আমি বাধ্য হয়ে কলম নিয়ে কেরামতি শুরু করলাম।
আমার সে কি দুর্দিন, তুমি তা কল্পনা করতে পারবে না। কাগজ-কলম নিয়ে বসলেই বুক ফেটে কান্না আসত; তবুও থামতে পারতাম না। কিন্তু চেষ্টা করলেই কি সবকিছু সম্ভব? আমার পক্ষেও সম্ভব হলো না।
শেষকালে কি করলাম জান? প্ৰবন্ধ লেখা শুরু করলাম। কিছু বইপত্তর আর ম্যাগাজিন পড়ে প্ৰবন্ধ লেখা চালু করলাম। এ-কাজে নিজের বিদ্যার প্রয়োজন ছিল না, প্ৰয়োজন ছিল কিছুটা বুদ্ধির। আস্তে আস্তে সেগুলো ছাপা হতে লাগল, কিঞ্চিৎ অর্থপ্ৰাপ্তিও ঘটত।
একদিন মেমসাহেবকে বললাম, দেখছি কেমন সুন্দর ঠকিয়ে রোজগার করছি।
নিজের বিদ্যা-বুদ্ধি দিয়ে রোজগার করাকে ঠকান বলে না। ‘ਚ বুঝি মেমসাহেব সেদিন বলেছিল, রাম নাম জপ করে যাও। অতশত ভাবতে হবে না, হয়ত একদিন ডাকতে ডাকতেই ভগবানের দেখা পেয়ে যাবে।
মেমসাহেবের পাল্লায় পড়ে সেই যে আমি কলম নিয়ে রাম নাম জপ শুরু করেছি, আজও তা থামাতে পারিনি। বিধাতার বিচিত্র খেয়ালে মেমসাহেব কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। জানি ও হয়ত আমার লেখা পড়তে পায় না বা পারে না। মাঝে মাঝেই মনে হয় কার জন্য লিখব? কিসের জন্য লিখব? ভগবানের কৃপা হলে পঙ্গুও উত্তঙ্গ গিরি লঙ্ঘন করতে পারে। আমি ভগবানের কৃপা লাভ করিনি, ভবিষ্যতেও নিশ্চয়ই করব না। জীবনে যা-কিছু পেয়েছি, যা-কিছু করেছি, তা সবই ঐ পোডাকপালীর জন্য। ভালবাসা দিয়ে মেয়েটা আমাকে পাগল করে দিয়েছে এবং সেই পাগলামি করতে করতে আমি আমার জীবকূটাকে নিয়ে জুয়া খেলেছি। &স্বাভাবিক অবস্থায়, সুস্থ মস্তিকে কোন মানুষ আমার। মত জীবনটাকে নিয়ে এমন খেলা করতে সাহস পাবে না। আমি পেরেছি, আজও কিছু কিছু পারছি কিন্তু আগামীকাল থেকে আর পারব না। পারব কেমন করে বল? ঐ পোড়াকপালী আমাকে গাছে চড়িয়ে দিয়ে মইটা নিয়ে পালিয়ে গেছে। ডালে ডালে, পাতায় পাতায় আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিন্তু কত কাল? সবকিছুরই তো একটা সীমা আছে।…
কি লিখতে গিয়ে কি লিখে ফেললাম। মেমসাহেবের কথা লিখতে গেলে আমার মাথাটা ঘুরে উঠে, বুদ্ধিভ্রংশ হয়। উচিতঅনুচিত বিচার করতে পারি না। জীবনে কোনদিন ভাবিনি মেমসাহেবের কথা লিখব। কিন্তু অবস্থার দুর্বিপাকে তোমাকে বাধ্য হয়েই লিখছি। আর কাউকে এসব নিশ্চয়ই লিখতাম না। তবে কি জান, চিঠিগুলো লিখে মনটা অনেক হাল্কা হচ্ছে। ভয়ও হচ্ছে। ডাক্তারবাবুরা যেমন নিজেদের প্রিয় স্ত্রী-পুত্রের চিকিৎসা করতে সঙ্কোচবোধ করেন, আমিও তেমনি আমার মেমসাহেবের কথা লিখতে ভয় পাচ্ছি। ভাব দিয়ে ভাষা দিয়ে, মেমসাহেবের প্রতি সুবিচার করা আমার পক্ষে নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। রাগ, অভিমান, ভালবাসার মধ্য দিয়ে ও যে কি আশ্চৰ্যভাবে আমার জীবন-নৌকায় পাল তুলে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, তা ঠিক করে বলা বা লেখার ক্ষমতা আমার নেই।
খবরের কাগজের রিপোর্টারি করার একটা নেশা আছে। সে নেশা প্ৰতিদিনের। একদিনের উত্তেজনা, নেশ কাটতে না কাটতেই নতুন উত্তেজনার জোয়ার আসে রিপোর্টারদের জীবনে। তাছাড়া সে উত্তেজনার বৈচিত্ৰ্য রিপোর্টারদের আরো বেশী মাতাল করে তোলে। সেই উত্তেজনার ঘোরেই অধিকাংশ রিপোর্টারদের জীবন কেটে যায়। ইচ্ছা বা ক্ষমতা থাকলেও বিশেষ কিছু করা কারুর পক্ষেই সম্ভব হয় না। মেমসাহেব চায় নি আমার জীবনটা শুধু এমনি অহেতুক উত্তেজনায় ভরে থাকুক। সে চেয়েছিল আমার কর্মক্ষেত্ৰকে আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত করতে।
বোটানিক্যাল গার্ডেনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে মেমসাহেব আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে বললে, অত দূরে দূরে যাচ্ছ কেন?
এটা তো তোমার ড্রইংরুম নয়—
মেমসাহেব প্ৰায় বিদ্যুৎবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরে একটা গাছের আড়ালে নিয়ে গেল। দু’হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললে, তুমি রাগ করেছ?
পাগল। রাগ করব কেন?
খুব বেশী রাগ করেছ, তাই না?
বিন্দুমাত্র রাগ করিনি। ভাল চাকরি পেতে হলে ইউ. পি. এস. সির পরীক্ষা দিতে হয়, পাশ করতে হয়; তেমনি তোমাকে পেতে হলেও তো আমাকে কিছু কিছু পরীক্ষা দিতে হবে, পাশ করতে হবে…
ও হাত ধরে আমার মুখটা চেপে ধরে বলে, বাজে কথা বলো না।
বাজে না মেমসাহেব। ইচ্ছা করলে আমার চাইতে অনেক বেশী সুপ্রতিষ্ঠিত কাউকে তুমি তোমার জীবনে পেতে পারতে কিন্তু একবার যখন আমার খেয়াঘাটে পিছলে পড়ে গেছ, তখন আমাকেই তৈরি করার চেষ্টা করছি।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে মেমসাহেব বললো, তোমার মনটা আজ বিক্ষিপ্ত। তাই আজ বলব না, দু’চারদিন পরে বলব।
পরে কেন? আজই বল।
আজি বললে তুমি বিশ্বাস করবে না। তোমার ওপর রাগ করতে পারি। কিন্তু অবিশ্বাস কোনদিন করব না।
ঠিক?
ঠিক।
মেমসাহেব আমার হাতটা টেনে নিয়ে নিজের মাথার উপর দিয়ে বলে, আমার মাথায় হাত দিয়ে বল তুমি অবিশ্বাস করবে না।
অত রাগ, অত দুঃখ, অত অভিমানের মধ্যেও আমার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। আমি ওর মাথায় হাত দিয়ে বললাম, সত্যি বলছি তোমাকে কোনদিন অবিশ্বাস করব না।
দুজনে একটু এগিয়ে একটু ছায়ায় বসলাম। মেমসাহেব বললো, কর্মজীবনে সুপ্ৰতিষ্ঠিত অন্য কোন ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হতে পারত, হয়ত সে তোমার চেয়ে ঢের ঢের বেশী রোজগার করত। কিন্তু আমার মনে হয় অতি সুপ্রতিষ্ঠিত পুরুষের হৃদয়ে স্ত্রীর প্রতিষ্ঠা পাওয়া খুব দুর্লভ।
একটু থামে। আবার বলে, দ্যাখ, ঠিক পয়সাকড়ির প্রতি আমার খুব বেশী মোহ নেই। একটু সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে ইচ্ছা! করে ঠিকই কিন্তু তাই বলে বেশী পয়সাকড়ি হলে মনটা নষ্ট হয়ে যায়। আমি তা চাই না।
আমি বললাম, তুমি যে প্ৰায় উদয়ের পথের ডায়ালগ বলা শুরু করলে।
মেমসাহেব আমার হাতটা চেপে ধরে বললে, তুমি আমাকে অমন করে অপমান করো না। ইচ্ছা–করলে শাসন করতে পার, বকতে পার। কিন্তু আমার ভালবাসা নিয়ে তুমি ঠাট্টা করো না।
মেমসাহেবের গলার স্বরটা বেশ ভারী হয়ে এসেছিল। আমি বেশ বুঝলাম, এর পরের ধাপেই ঝরঝর করে নেমে আসবে শ্ৰাবণধারা। ওর ঐ চোখে জল আমি ঠিক সহ্য করতে পারব না। বলে তাড়াতাড়ি ওর গাল টিপে বললাম, তুমি কি পাগল হয়েছে? তোমার ভালবাসা নিয়ে আমি ঠাট্টা করব?
মেমসাহেব একটু শান্তি পায়, স্বস্তি পায়। আমার কাঁধের ’পর মাথাটা রাখে। আমি ওর মুখে মাথায় হাত দিয়ে আদর করি। মেমসাহেব আরো আমার কাছে আসে। বলে, কেন যে তোমাকে ভালবেসেছি তা জানি না। হয়ত তুমি আমাকে অমন করে। চেয়েছিলে বলেই আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারিনি। অনেকদিন রাত্রে একলা একলা চুপচাপ তোমার কথা ভেবেছি।
তাই নাকি?
তবে কি! ভাবিয়ে ভাবিয়ে তো তুমি আমাকে শেষ করলে!
তা তো বুঝলাম। কিন্তু আমার কাজকর্ম নিয়ে অত খিটখিটে কর, কেন?
মাথাটা নাড়িয়ে মেমসাহেব বলে, খিটখিট করব না? তোমার মত ফাকিবাজ, আড্ডাবাজ, স্ত্রৈণ লোককে খিটখিটে না করলে কাজ করান সম্ভব?
যার স্ত্রী নেই, সে আবার স্ত্রৈণ হবে কেমন করে?
বাজে বকো না। বিয়ে না করেই যা করছি সে আর বলার নয়। না জানি বিয়ে করলে কি করবে?
জান দোলাবৌদি, মেমসাহেব ভীষণ দুষ্টুমি করত। আমি আদর করলে গলে পড়ত, ভালবাসলে মুগ্ধ হতো, দুষ্টুমি করলে উপভোগ করত। কিন্তু পরে আমাকে টিপ্পানী কাটার বেলায় এমন একটা ভাব দেখাত যে ওরা যেন কোন তাগিদ নেই, প্রয়োজন নেই; সব কিছুই যেন আমার প্রয়োজন।
যাই হোক সেদিন বোটানিক্যাল গার্ডেনে বসে বসে কি বলেছিল। জান? বলেছিল, আমি চাই তুমি অনেক অনেক বড় হও। কেউ যেন বলতে না পারে। আমি আসায় তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। এইত নিজেকে গড়ে তোলার সময়। এর পরে সংসারধর্মে জড়িয়ে পড়লে আর কি এত অবসর পাবে? পাবে না। এখন তুমি একটি মুহুৰ্তও নষ্ট করবে না, আমি নষ্ট করতে দেব না। আমার সমস্ত স্বপ্ন, সাধনা, শক্তি দিয়ে তোমাকে আমি বড় করবই।
আমি বলি, তুমি নিজেও তো এগিয়ে যাবে। বিদেশ যেতে পার, রিসার্চ করতে পার…
মেমসাহেব অবাক হয়ে বলে, আমি? বিয়ের পর আমি কিছু করব না। চাকরি-বাকরি সব ছেড়ে দেব।
তবে কি করবে?
কি আবার করব? ঘর-সংসার করব।
তাই বলে চাকরি ছাড়বে কেন?
চাকরি করলে আর ছেলেমেয়ে মানুষ করা যায় না। তাছাড়া তোমার যা অদ্ভূত কাজ। কাজের তো কোন ঠিক-ঠিকানাই নেই। সুতরাং দুজনেই বাইরে বাইরে থাকলে চলবে কেন?
আবার পরে বলল, ঘর-সংসারের কাজকর্ম করে তোমার কাজকর্মে একটু সাহায্য করার চেষ্টা করব। তোমার মত জার্নালিস্ট না হতে পারি অন্তত তোমার সেক্রেটারী তা হতে পারব।
এমনি করে একদিন অকস্মাৎ পিছন ফিরে দেখি আমার কর্মজীবনে একটা বিরাট পরিবর্তন এসে গেছে। দৈনন্দিন রিপোর্ট করা ছাড়াও নিত্য নতুন লেখার কাজে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ক্লিপিং করা, ফাইল করা, লাইব্রেরীতে গিয়ে নোটস নেওয়া, বইপত্তর পড়া, তারপর লেখা এবং সে লেখা ছাপাবার ব্যবস্থা করা নিয়ে সারাটা দিন বেশ ব্যস্ততার মধ্যে কেটে যায়। রোজ রোজ মেমসাহেবের সঙ্গে দেখা করারও সময় হয় না।
ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গে সর্বনাশা বন্যা দেখা দিল। ঘরবাড়ি রেললাইন ভেসে গেল, জমিজমা ডুবে গেল, হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোক হাহাকার করে উঠল। নিউজ এডিটরের নির্দেশে আমাকে ছুটিতে হলো সেই বিধ্বংসী বন্যার রিপোর্ট করতে। মেমসাহেবকে কলেজে টেলিফোন করে খবরটা দিলাম। স্টেশনে এসে আমার হাতে নির্মাল্য দিয়ে বলেছিল, কালীঘাটের মার নির্মাল্য। কাছে রেখো, কোন বিপদ হবে না।
শুধু নির্মাল্য দিয়েই শান্তি পায় নি। বিস্কুট-জ্যাম-জেলীর একটা বিরাট প্যাকেট দিয়ে বলেছিল, ফ্লাড এরিয়ায় নিশ্চয়ই খাওয়াদাওয়ার মুশকিল হবে। এগুলো রেখে দাও।
দিন পনের বাদে আমি ঘুরে এলাম। মেমসাহেব তো আমাকে দেখে চমকে উঠল, তোমার এ কি অবস্থা?
কি আবার অবস্থা?
কি হয়েছে তোমার শরীর!
অনিয়ম-অত্যাচার হলে শরীর খারাপ হবে, তাতে আশ্চৰ্য হবার–কি আছে? কদিন পরে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
সেদিন ও আর বিশেষ কিছু বলল না। পরের দিন এক বোতল টনিক নিয়ে হাজির। হুকুম হলো, দুবেলা দু’ চামচ করে খাবে। ভুল হয় না যেন। আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা খাওয়াটা বন্ধ করা তো।
চা খাওয়া বন্ধ করব?
কথাটা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লে বলে মনে হচ্ছে। প্ৰায় তাই। সাকসেসফুল জার্নালিস্টর হুইস্কি আর আনসাকসেসফুল জার্নালিস্টরা চা খেয়েই তো বেঁচে থাকে। সেই চা ছাড়লে কি এবার হুইস্কি ধবর?
নিশ্চয়ই! তা না হলে আমার কপাল পোড়াবে কেমন করে?
আমি নিয়ম-কানুন ছাড়া, বন্ধনহীন উন্মত্ত পদ্মার মত বেশ জীবনটা কাটাচ্ছিলাম। ছন্নছাড়া জীবনটা বেশ লাগত। কিন্তু এই মেয়েটা এসে সব ওলট-পালট করে দিল। আমাকে প্ৰায় ভদরলোক করে তুলল। সর্বোপরি আমার চোখে, আমার প্রাণে একটা সুন্দর শান্ত সংসার-জীবনের স্বপ্ন এঁকে দিল।
পর্ব ১১ শেষ 📌
🔴পর্ব :১২🔴
বহুজনকে দীর্ঘদিন তৈলমর্দন করেও কলকাতার কোন পত্রপত্রিকায় যখন কোন চাকরি জোটাতে পারলাম না, তখন এক্সপ্রেস আর ক্রনিকেলের ঐ সামান্য অস্থায়ী কাজও বড় ভাল লেগেছিল। কিন্তু কতকাল? মেমসাহেবকে নিয়ে আমার জীবনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোন অনিশ্চয়তা ছিল না। কর্মজীবনে সে অনিশ্চয়তা আমাকে এবার ধীরে ধীরে উদ্বিগ্ন করতে লাগল।
দৈনন্দিন রিপোর্টিং ছাড়া প্ৰবন্ধ ফিচার ইত্যাদি লেখা ঠিকই চলছিল। কখনও এ কাগজে, কখনও সে কাগজে এসব লেখা ছাপাও হচ্ছিল। কোন কোন লেখা অমনোনীতও হচ্ছিল। মাঝে মাঝে দশ-পনের-বিশ টাকার মানিঅর্ডার বা চেকও পাচ্ছিলাম। মন্দ লাগিছিল না। কিন্তু সাংবাদিক ফেরিওয়ালা হয়ে তো জীবন কাটাতে পারি না। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে মেমসাহেবকে তো টেনে আনতে পারি না। তাছাড়া আমাকে পাশ কাটিয়ে অনেক পরিচিত নতুন ছেলেছোকরার দল আলিগলি দিয়ে কর্মজীবনের রেড রোড ধরে ফেলল। নিজেকে বড়ই অপদাৰ্থ, অকৰ্মণ্য মনে হল।
মেমসাহেবকে আমি কিছু বলতাম না। নিজের মনে মনেই অনেক কথাই চিন্তা করতাম। একবার ভাবলাম চুলোয় যাক জার্নালিজম। যদি খেতে পরতে না পেলাম। তবে আবার জার্নালিজম-এর শখ কেন? দুর্বল মুহুর্তে অন্য চাকরি-বাকরি নেবার কথাও তাবলাম। কিন্তু পরের মুহুর্তে নিজের মনকে শাসন করেছি। বুঝিয়েছে, না তা হয় না। এতবড় পরাজয় আমি মেনে নিতে পারব না। যৌবনেই যদি কর্মজীবনের এত বড় পরাজয় মেনে নিই, তবে ভবিষ্যতে কি করব? কি নিয়ে লড়াবা?
আবার তেবেছি কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে যাই। দিল্লী, বোম্বে বা লণ্ডন চলে যাই। কিন্তু পালিয়ে যাওয়া বললেই তো আর পালিয়ে যাওয়া যায় না। বিলেতে যেতে অনেক টাকার প্রয়োজন। সে টাকা আমার ছিল না। তাছাড়া বিলেত গিয়ে কি করতাম। বিলেত গিয়ে কেরানীগিরি বা বাস কণ্ডাকটর হয়ে এ্যাণ্টনি সাহেব হবার শখ কোনদিনই আমার ছিল না। কয়েকটা দেশী কাগজের কাজ নিয়ে বিলেতে যাবার পরিকল্পনা অনেক দিন মনের মধ্যে উকিঝুকি দিয়েছিল। কিন্তু তার জন্যও দেশের মধ্যে অনেক ঘোরাঘুরি প্রয়োজন ছিল। আমার পক্ষে তাও সম্ভব হয় নি। রাসবিহারী এভিন্যুর পোস্টাফিসে মেমসাহেবের কিছু টাকা ছিল। আমার কল্যাণে ইতিমধ্যেই তাতে দু’একবার হাত পড়েছিল। সুতরাং ওদিকে হাত বাড়ানোর কথা আর ভাবতে পারলাম না।
দু’একবার অত্যন্ত আজেবাজে চিন্তাও মাথায় এসেছে। ভেবেছি মেমসাহেবকে কিছু না জানিয়ে অকস্মাৎ একদিন যেখানে হোক উধাও হয়ে যাই। যৌবনে প্ৰাণবন্ত সব ছেলেমেয়েরাই প্ৰেমে পড়ে। ক’জন সে প্ৰেম আঁকড়ে ধরে থাকতে পারে?
আমিও না হয় পারলাম না। কি হয়েছে তাতে? মেমসাহেব দু-চারদিন কান্নাকাটি করবে, দু’এক বেলা হয়ত উপবাস করবে। কেউ কেউ হয়ত কয়েকদিন উপহাস করবে, কেউ বা হয়ত কিছু কিছু অপ্রিয় মন্তব্য করবে। কিন্তু তার পর? নিশ্চয়ই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। ডেভেলপমেণ্ট ডিপার্টমেন্টের আমেরিকা ফেরত ফিসারি এক্সপার্ট সুবোধবাবু নিশ্চয়ই মেমসাহেবকে অপছন্দ করবেন না। তারপর শুভদিনে শুভক্ষণে বুড়ো সাজ্জাদ হোসেনের সানাই বেজে উঠলে সুবোধবাবু জামাই বেশে হাজির হবেন। কিছু পরে মেমসাহেব বধু বেশে কলাতলায় সুবোধকে মালা পরাবে, পুরোহিত মন্ত্র পড়ে সম্পত্তি ট্রান্সফার পাকাপাকি করবেন। তারপর বাসর। একটু হাসি, একটু ঠাট্টা, একটু তামাশা। লোকচক্ষুর আড়ালে হয়ত একটু স্পৰ্শ, একটু অনুভূতি। দেহমনে হয়ত বা একটু বিদ্যুৎ প্রবাহ।
আমার মাথাটা একটু ঝিমঝিম করল। তবে সামলে নিলাম। পরের দিনটার জন্য খুব বেশী চিন্তা হয় না। কিন্তু তার পরের দিন। ফুলশয্যার কথা ভাবতে গিয়েই মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠল। রজনীগন্ধা দিয়ে সাজান ঐ ফোমড রবারের শয্যায়। মেমসাহেবের একচ্ছত্র অধিপতিরূপে সুবোধ। তিলে তিলে ধীরে ধীরে যে মুকুল চব্বিশ-পঁচিশ বসন্তে পল্লবিত হয়ে আমার মানস-প্রতিমা মেমসাহেব হয়েছে, যার মনের কথা, দেহের উত্তাপ, বুকের স্পন্দন শুধু আমি জেনেছি, পেয়েছি ও অনুভব করেছি, সেই মেমসাহেবের অঙ্গে সুবোধের স্পর্শ। অসম্ভব। তাছাড়া যে মেমসাহেব তার জীবন সর্বস্ব দিয়ে নৈবেদ্য সাজিয়ে আমাকে সুখী, সার্থক করতে চেয়েছে, তাকে এভাবে বঞ্চিত করে পালিয়ে যাব? না, না, তা হয় না।
তবে?
তবে কি করব, তা ভেবে কোন কুলকিনারা পাচ্ছিলাম না। মনে মনে অবশ্য ঠিক করেছিলাম। কলকাতায় আর বেশীদিন থাকব। না। খবরের কাগজের রিপোর্টার হবার দৌলতে বাংলাদেশের বহু প্ৰথিতযশা লব্ধপ্ৰতিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে পরিচিত হবার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল।
দুর্ভাগ্য!
হ্যাঁ, দুর্ভাগ্য। দুৰ্ভাগ্য নয়ত কি বলব বল? কলকাতার ময়দানে মনুমেণ্টের নীচে লক্ষ লক্ষ মানুষ এদের বক্তৃতা শোনে, হাততালি দেয়, গলায় মালা পরায়। প্ৰথম প্ৰথম এদের কাছে এসে নিজেকে কৃতাৰ্থ মনে করতাম। শিক্ষা-সংস্কৃতির ধ্বজা উড়িয়ে যাঁরা সিনেট হল—ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট—মহাবোধি সোসাইটি হল গরম করে তুলতেন, তাঁদের সবাইকেও ঠিক শ্ৰদ্ধা করে উঠতে পারলাম না। সাড়ে তিন কোটি বাঙালী নারী-পুরুষ-শিশুর দল যাঁদের মুখ চেয়ে বসে আছে, যাদের বক্তৃতা আমরা নিত্য খবরের কাগজের পাতায় ছাপছি, তাঁদের স্বরূপটা প্ৰকাশ হওয়ায় আমি যে কি দুঃখ, কি আঘাত পেয়েছিলাম, তা ভাষায় প্ৰকাশ করতে পারব না। কি কি কারণে এদের আমি শ্রদ্ধা করতে পারিনি, সে-কথা লেখার অযোগ্য। বিদ্যাসাগরের বাংলাভাষা দিয়ে এদের কাহিনী লিখলে বিদ্যাসাগরের স্মৃতির অবমাননা করা হবে, বাংলাভাষার অপব্যবহার করা হবে। তবে যদি এইসব মহাপুরুষের কথা লিখতে পারতাম, যদি সে-ক্ষমতা আমার থাকত, তবে বাংলাদেশের কিছু মানুষ। নিশ্চয়ই বাঁচতে পারত।
তুমি ভাবছি আমি বাচালতা করছি। তাই না? সত্যি বলছি দোলাবৌদি, আমি একটুও বাচালতা করছি না। ইংরেজীতে যাকে বলে ট্রাডিশন, তা তো বাঙালীর আছে। শিক্ষা-দিক্ষ-আদৰ্শ ও দেশপ্রেমের অভাব তো বাংলাদেশে নেই। গ্রামে গ্রামে দরিদ্র গৃহিণীরা আজও ক্ষুধার অন্ন দিয়ে অতিথির সেবা করতে কাৰ্পণ্য করেন না। উদার বাংলা বুক পেতে সারাদেশের মানুষকে আসন বিছিয়ে দিয়েছে। ভারতবর্ষের দিগ দিগন্তর থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ এসেছেন বাংলাদেশে। কিন্তু কই আর কোন প্রদেশের মানুষ তো এমনি করে। সারাদেশের মানুষকে নিয়ে সংসার করবার উদারতা দেখাতে পারে নি। রাজনীতির কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। শিক্ষায়-দীক্ষায়, শিল্পে-সংগীতে বাঙালীর ঔদার্য অতুলনীয়। অতীতের ইতিহাস ওল্টাবার কোন প্ৰয়োজন নেই। ইদানীং কালের ইতিহাসই ধরা যাক। প্ৰমথেশ বড়ুয়া, কুন্দনলাল সায়গল, লীলা দেশাই বাঙালী নন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে এদের অকলঙ্কিত আসন চিরকালের জন্য রইবে। বড়ে গোলাম আলি খা-র গান শোনার জন্য একমাত্র বাংলাদেশের অতিসাধারণ মানুষই সারা রাত্তির রাস্তার ফুটপাথে বসে থাকে। টি আও, আপ্পা রাও, মেওয়ালাল বা লালা অমরনাথ, মুস্তাক আলিকে বাঙালীর ছেলেরা যা ভালবাসা দিয়েছে, তার কি কোন তুলনা হয়? হয় না দোলাবৌদি। হবেও না।
শিক্ষা-দীক্ষা-আদর্শ ও সর্বোপরি হৃদয়বত্তা সত্ত্বেও বাঙালী কেন মরতে চলেছে? বাঙালীর ঘরে ঘরে কেন হাহাকার? কান্না? সারাদেশের মানুষ যখন নতুন প্ৰাণস্পন্দনে মাতোয়ারা, তখন বাঙালীর এ-দুরবস্থা কেন? সাড়ে তিন কোটি বাঙালীর মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিল কে? কেন সারা জাতটা সর্বহার হলো?
আগে সবকিছুর জন্য অদৃষ্টকে ধিক্কার দিতাম। কৈশোরযৌবনের সন্ধিক্ষণে আশা করতাম। ময়দানে মনুমেণ্টের তলায় নেতাদের গলায় মালা পর্যালে, তাঁদের বক্তৃতা শুনলে হাতে তালি দিলে বাঙালীর সর্বরোগের মহৌষধ পাওয়া যাবে। রিপোর্টারী করতে গিয়ে বড় আশা নিয়ে এদের কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু হা ভগবান! মনে মনে এমন ধাক্কাই খেলাম যে তা বলবার নয়।
ব্যক্তিগত জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা নিশ্চয়ই খুব জরুরী ব্যাপার। কিন্তু সাংবাদিকতা করতে গিয়ে সমাজ-জীবন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা অসম্ভব। তাই তো সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে ক্ষয়রোগ দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। তাই তো কলকাতার জীবন আমার কাছে আরো তেতো মনে হতে লাগল।
এইসব নানা অশান্তি মনকে তোলপাড় করে তুলেছিল। মুখে কিছুই প্ৰকাশ করছিলাম না। বন্ধুবান্ধব সহকর্মীদের কেউই কিছু জানতে পারছিল না। আমার মনের মধ্যে কত চিন্তা-ভাবনার যে কি বিচিত্র লড়াই চলছিল, সে-খবর কেউ জানতে পারল না। তবে মেমসাহেবকে ফাঁকি দিতে পারিনি।
সেদিন দুজনে ন্যাশানাল লাইব্রেরীতে গিয়েছিলাম। নোটস নেওয়ার কাজ শেষ করে একটা গাছতলায় এসে বসলাম দুজনে। আমি বোধহয় দৃষ্টিটা একটু অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে কি যেন দেখছিলাম। মেমসাহেব বললো, ওগো, চিনেবাদাম কিনে আনবে?
আমি গেটের বাইরে থেকে দু। আনার চিনেবাদাম আর দু’টো ম্যাগনোলিয়া আইসক্রিীম কিনে আনলাম। আইসক্ৰিীম, চিনেবাদাম খাওয়া শেষ হয়েছে। মেমসাহেব তখনও একটু একটু ঝাল-নুন খাচ্ছে আর জিভ দিয়ে রসাস্বাদনের আওয়াজ করছে। ওর কখন ঝাল-নুন খাওয়া শেষ হয়েছে, কখন আমার কাছে রুমাল চেয়েছে, তা আমি খেয়াল করিনি।
মেমসাহেব হঠাৎ আমাকে একটা ঝাকুনি দিয়ে বললো, ওগো, রুমালটা দাও না!
আমি রুমাল দিলাম। রুমাল দিয়ে হাতটা মুখটা মুছে আবার আমাকে ফেরত দিল, এই নাও।
রুমালটা পকেটে রাখতে রাখতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার রুমাল কি হলো?
সর্বমঙ্গলার নির্মাল্য বেঁধে তোমাকে দিলাম না।
ও! তাইতো!
মেমসাহেব প্রশ্ন করল, একটা কথা বলবে?
কেন বলব না?
কি এত ভাবছ আজকাল?
কই? কিছু না তো।
ও একটু হাসল। বললো, আমাকে ছুঁয়ে বলতে পার তুমি কিছু ভাবছ না?
কথা শেষ হতে না হতেই ও আমার হাতটা টেনে নিয়ে বুকের ওপর রেখে বলে, বল।
আমি হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলি, কি ছেলেমানুষি করছ! মেমসাহেব একটু হাসে, একটু ভাবে। বোধহয় আমার কথায় একটু দুঃখ পায়। ঐ ঘন কালো দু’টো চোখ যেন শ্রাবণের মেঘের মত ভারী হয়ে ওঠে। আমি এক ঝলক দেখে নিয়ে দৃষ্টিটা সরিয়ে নিল।
মেমসাহেবের একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল। আমি দৃষ্টিটা আবার ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। জানতে চাই, কি এত ভাবছ?
জেনে তোমার লাভ?
আমি ভেবেছিলাম সহজ সরলভাবে মেমসাহেবকে এড়িয়ে যাব। কিছু বলব না। কিন্তু গভীর ভালবাসায় ওর দৃষ্টিটা এত স্বচ্ছ হয়েছিল যে, আমার মনের গভীর প্রদেশের ও কোন কিছু লুকান সম্ভব ছিল না। ও স্থির জেনেছিল আমার মনটা একটু বিক্ষিপ্ত আছে। কিন্তু কি কারণে মনটা বিক্ষিপ্ত তা জানতে না পারায় মেমসাহেবের দুঃখ হওয়া স্বাভাবিক। সে-কথা উপলব্ধি করেও ওকে ঠিক সত্য কথাটা বলতে আমার বেশ কুণ্ঠা হলো।
দু’চার মিনিট দুজনেই চুপচাপ রইলাম।
তারপর মেমসাহেব ডাকে, শোন।
বল।
তুমি কি আজকাল এমন কিছু ভাবছ যা আমাকে বলা যায় না।
তুমি কি পাগল হয়েছ!
তবে বলছ না কেন?
অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল। বললাম, কি বলব মেমসাহেব! নতুন কিছুই ভাবছি না। ভাবছি নিজের কর্মজীবনের কথা। আর কতকাল এমনি অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকব। তাই খালি ভাবছি।
মেমসাহেব উড়িয়েই দিল আমার কথাটা। বললো, তা এত ভাববার কি আছে? কেউ একটু আগে, কেউ বা একটু পরে জীবনে দাঁড়ায়। তুমি না হয় দু’বছর পরেই জীবনে দাঁড়াবে, তাতে কি ক্ষতি হলো?
ভাবব না? হকারের মত ফিরি করে রোজগার করতে আর ভাল লাগে না। হাজার হোক বয়স তো হচ্ছে!
মেমসাহেব তাড়াতাড়ি আমাকে কাছে টেনে নেয়। দু’হাত দিয়ে আমার মুখটা তুলে ধরে বলে, ছি ছি, নিজেকে এত ছোট ভাবছ কেন?
ছোট ভাবতাম না। তবুও যদি ভদ্রলোকের মত রোজগার করতে পারতাম।
তোমার কি টাকার দরকার?
‘না, না, টাকার আবার কি দরকার!
বল না। আমি তো মরে যাইনি।
মেমসাহেব বড়ই উতলা হলো আমার কথায়। জানতে চাইল, আর কি ভাবছ?
বলব?
নিশ্চয়ই।
ভাবছি আমার এই অনিশ্চয়তার জীবনে তোমাকে কেন টেনে আনলাম। একটা আধাবেকার জার্নালিস্টের সংসারে তোমাকে এনে কেন তোমার জীবনটা নষ্ট করব, তাই ভাবছি।
মেমসাহেব রেগে ওঠে, চমৎকার। হাততালি দেব?
কেন ঠাট্টা করছ?
তোমার কথা শুনে আমি অবাক না হয়ে পারছি না। তোমার টাকা না থাকলে আমি তোমার কাছে ঠাই পাব না? তুমি আমাকে এত ছোট, এত নীচ ভাব?
পাগল কোথাকার। তোমাকে আমার সংসারে এনে যদি সুখ, শান্তি, মৰ্যাদা দিতে না পারি। তবে……
ও আর এগুতে দিল না, তুমি দুপাঁচশ’ টাকা রোজগার করলেই আমার শান্তি? টাকা হলেই বুঝি সবাই সুখী হয়?
না তা হবে কেন? তবুও ভদ্রভাবে বাঁচবার জন্য কিছু তো চাই।
আমার বা আমার সংসারের চিন্তা তোমার করতে হবে না। তুমি নিশ্চিন্ত মনে কাজ করে যাও তো।
কথায় কথায় বেলা যায়। সূৰ্যটা আস্তে আস্তে নীচে নামতে থাকে, গাছের ছায়া দীর্ঘতর হয়। বেলভিডিয়ারের সুবিস্তীর্ণ প্ৰাঙ্গণ। সূৰ্যরশ্মির বিদায়বেলায় মিষ্টি আলোয় ভরে যায়।
মেমসাহেব আমার কাঁধে মাথা রাখে। ওগো, বল তুমি এসব আজেবাজে কথা ভাববে না। আজ না হয়। ভগবান নাই দিলেন। কিন্তু একদিন তিনি নিশ্চয়ই ভরিয়ে দেবেন। তোমাকে।
তুমি বুঝি সবকিছু জান?
একশবার। ওয়েলিংটন স্কোয়ার আর মনুমেণ্টের মিটিং কভার করেই তোমার জীবন কাটাতে হবে না।
তবে কি করব?
কি না করবে। তাই বল। তুমি দেশদেশান্তরে ঘুরবে, কত বড় বড় লোকের সঙ্গে তোমার পরিচয় হবে, তুমি কত কি লিখবে…
তারপর?
মেমসাহেব আমার গাল টিপে বলে, তারপর আর বলব না। তোমার অহঙ্কার হবে।
আমার হাসি পায় মেমসাহেবের প্রলাপ শুনে। তুমি কি বোম্বে যাচ্ছ?
ও অবাক হয়ে বলে, আমি কেন বোম্বে যাব?
হিন্দী ফিল্মের স্টোরি লেখার জন্য।
অসভ্য কোথাকার।
সেদিন আমি শুধু একটা মোটামুটি ভাল চাকরির স্বপ্ন দেখতাম। আর? আর ভাবতাম। অফিস থেকে আমাকে একটা টেলিফোন দেবে। আমি অফিসের গাড়ি করে রাইটার্স বিল্ডিং, লালবাজার যাব, পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর অফিসে ঘুরে বেড়াব। চীফ মিনিস্টারের সঙ্গে দাৰ্জিলিং যাব। রাইটার্স বিল্ডিং-এর সেক্রেটারী ডেপুটি সেক্রেটারীরা আমাকে উইস করবেন, পুলিস কমিশনার ভিড়ের মধ্যেও আমাকে চিনতে পারবেন, শ্যামপুকুর থানার ও-সি আমাকে কাটলেট খাওয়াবেন।
স্বপ্ন দেখারও একটা সীমা আছে। তাইতো আমি আর এগুতে পারতাম না। আজ সেসব দিনের কথা ভেবে হাসি পায়। কোনদিন কি তেবেছি আমি নেহেরু-শাস্ত্রী-ইন্দিরার সঙ্গে পৃথিবীর পঞ্চ মহাদেশ ঘুরে বেড়াব? কোনদিন কল্পনা করতে পেরেছি। বছর বছর বিলেত যাব? কোনদিন কি ভাবতে পেরেছি। প্ৰাইম মিনিস্টারের সঙ্গে এয়ার ফোর্সের স্পেশ্যাল প্লেনে দমদমে নামিব? রাজভবনে থাকিব? আরো অনেক কিছু ভাবিনি। ভাবিনি। ভারতবর্ষের টপ লীডরেরা আমার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে গোপন আলোচনা করবেন, হুইস্কি খেতে খেতে অ্যাম্বাসেডরদের সঙ্গে ইণ্টারন্যাশনাল এ্যাফেয়ার্স ডিসকাস করব।
মেমসাহেব বোধহয় এসব ভাবত। কোথা থেকে, কেমন করে এসব ভাবনার সাহস সে পেত, তা আমি জানি না। তবে আমার কর্মজীবনের কৃষ্ণপক্ষেও সে-আশা হারায় নি। তাইতো যতবার আমি নিরাশায় ভেঙে পড়েছি, যতবার আমি পরাজয় মেনে নিয়ে কর্মজীবনের পথ পাণ্টাতে চেয়েছি, ও ততবার আমাকে তুলে ধরেছে। আশা দিয়েছে, ভরসা দিয়েছে, ভালবাসা দিয়েছে।
কখনও কখনও শাসনও করেছে।
সবই বুঝি মেমসাহেব। কিন্তু এই কলকাতায় পরিচিত মানুষের দ্বারে দ্বারে আর কৃপা প্ৰাথী হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারছি না।
মেমসাহেব স্পষ্ট বললো, কলকাতাতেই যে তোমার থাকতে হবে, এমন কি কথা আছে। যেখানে গিয়ে তুমি কাজ করে শান্তি পাবে, সেইখানেই যাও।
এক মুহুর্ত চুপ করে ও আবার বললো, আমি তো তোমাকে। আমার আঁচলের মধ্যে থাকতে বলি না।
মেমসাহেব জীবনে একটা লক্ষ্য স্থির করেছিল। সে-লক্ষ্য ছিল আমার কল্যাণ, আমার প্রতিষ্ঠা। আর চেয়েছিল প্রাণভরে ভালবাসতে, তালবাসা পেতে।
মধ্যবিত্ত সংসারের কুমারী যুবতীর পক্ষে এমন অদ্ভূত লক্ষ্য স্থির করে অগিয়ে যাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। মেমসাহেবের পক্ষেও সহজ হয় নি। বাধা এসেছে, বিপত্তি এসেছে, এসেছে প্ৰলোভন। এইত সুবোধবাবু আমেরিকা ফেরার পর যখন ইঙ্গিত করলেন মেমসাহেবকে তাঁর বেশ পছন্দ, তখন বাড়ির অনেকই অনেক দূর এগিয়েছিলেন।
মেমসাহেব কি বলেছিল জান? বলেছিল। মেজদি, মা-কে। একটু বুঝিয়ে বলিস রেডিমেড জাম-কাপড় দেখতে একটু চকচক করে। কিন্তু বেশীদিন টেকে না, তার চাইতে ছিট কিনে মাপমত নিজের হাতে তৈরি করা জিনিস অনেক ভাল হয়, অনেক বেশী সুন্দর হয়।
মেজদি ইঙ্গিত বুঝেছিল। তবে আমার সঙ্গে ঘুরেফিরে বেড়ান নিয়ে মেমসাহেবের আত্মীয় মহলেও গুঞ্জন উঠেছিল। অপ্রিয় অসংযত আলোচনাও হতো মাঝে মাঝে। ও সেসব গ্রাহ্য করত না। দেখ খোকনদা, আমি কচি মেয়ে নই। একটুআধটু বুদ্ধিসুদ্ধি আমার হয়েছে। কিছু কিছু ভালমন্দও বুঝতে শিখেছি।
সব মিলিয়ে কলকাতার আকাশটা বেশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে উঠল। মেমসাহেবও ধীরে ধীরে উপলব্ধি করল আর বেশীদিন কলকাতায় থাকলে দুজনেরই মাথাটা খারাপ হয়ে উঠবে।
ওগো, সত্যি তুমি এবার কোথাও যাবার ব্যবস্থা কর। আশপাশের কতকগুলো অপদাৰ্থ মানুষের ভালবাসার ঠেলায় প্ৰাণ বেরিয়ে যাচ্ছে।
আমাকে ছেড়ে তুমি থাকতে পারবে?
পারব। তবে যখন যেদিন দুজনে মিলবো, সেদিন তো আর কেউ বিরক্ত করতে পারবে না।
আত্মীয়বন্ধুর দল কেউ জানতে পারলেন না। ধীরে ধীরে আমি দিল্লী যাবার উদ্যোগ আয়োজন শুরু করলাম। গোপনে গোপনে কিছু কিছু কাগজপত্রের অফিসে গিয়ে আলোচনা করলাম। শেষে একদিন অকস্মাৎ এক অপ্ৰত্যাশিত মহল থেকে এক নগণ্য সাপ্তাহিকের সম্পাদক বললেন, দিল্লীতে আমার এক’জন করসপানডেন্টের দরকার। তবে এখন তো একশ টাকার বেশী দিতে পারব না।
কুচপরোয়া নেই। একশ টাকাই যথেষ্ট।
কথা দিলাম, ঠিক আছে আমি যাব।
কবে থেকে কাজ শুরু করবেন?
আপনি যেদিন বলেন।
অ্যাজ আলি অ্যাজ ইউ ক্যান গো।
মেমসাহেব পরের শনিবার ভোরবেলায় আমাকে নিয়ে কালীঘাটে গিয়ে পূজা দিল, প্ৰসাদ দিল, নির্মাল্য দিল। এই নির্মাল্যাটা সব সময় কাছে রেখো।
সন্ধ্যেবেলায় দুজনে মিলে ডায়মণ্ডহারবারের দিকে গেলাম। বেশী কথা বলতে পারলাম না কেউই।
মেমসাহেব বললো, আমার মন বলছে তোমার ভাল হবেই। আমার যদি ভালবাসার জোর থাকে, তাহলে তোমার অমঙ্গল হতে পারে না।
আমি শুধু বললাম, তোমার দেওয়া নির্মাল্য আর তোমার ভালবাসা নিয়েই তো যাচ্ছি। আমার আর কি আছে বল?
সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার নামতে শুরু করেছিল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, চল এবার যাই।
ও উঠল না। বসে রইল। ডাকল, শোন।
বল।
কাছে এস। কানে কানে বলব।
কানে কানে কি বললো জান? বললো, আমাকে একটু জড়িয়ে ধরে আদর করবে?
আবছা অন্ধকার আরো একটু গাঢ় হলো। আমি দু’হাত দিয়ে মেমসাহেবকে, টেনে নিলাম বুকের মধ্যে। সমস্ত অন্তর দিয়ে, সমস্ত মন-প্ৰাণ দিয়ে অনেক আদর করলাম।
তারপর মাথায় আঁচল দিয়ে ও আমাকে প্রণাম করল। আশীৰ্বাদ করে আমি যেন তোমাকে সুখী করতে পারি।
যুধিষ্ঠির রাজত্ব ও দ্ৰৌপদীকে পণ রেখে পাশা খেলেছিলেন। আমার রাজত্ব ছিল না। তাই নিজের জীবন আর মেমসাহেবের ভালবাসা পণ রেখে আমি কর্মজীবনের পাশা খেলতে যুধিষ্ঠিরের স্মৃতিবিজড়িত অতীতের ইন্দ্ৰপ্ৰস্থ, বর্তমানের দিল্লী এলাম।
পর্ব ১২ শেষ 📌
🔴পর্ব :১৩🔴
বাঙালীর ছেলেরা ঘর ছেড়ে বেরুতে চায় না বলে একদল পেশাদার অন্ধ রাজনীতিবিদ অভিযোগ করেন। অভিযোগটি সর্বৈব মিথ্যা। মহেঞ্জোদাড়ো বা হরপ্পার যুগের কথা আমি জানি না। তবে ইংরেজ রাজত্বের প্রথম ও মধ্যযুগে লক্ষ লক্ষ বাঙালী সমগ্ৰ উত্তর ভারতে ছড়িয়েছেন। রুজি-রোজগার করতে বাঙালী কোথাও যেতে দ্বিধা করে নি। সুদূর রাওয়ালপিণ্ডি, পেশোয়ার, সিমলা পৰ্যন্ত বাঙালীরা গিয়েছেন, থেকেছেন, থিয়েটার করেছেন, কালীবাড়ী গড়েছেন।
এই যাওয়ার পিছনে একটা কারণ ছিল। প্ৰথমতঃ বাঙালীরাই আগে ইংরেজী শিক্ষা গ্ৰহণ করে সরকারী অফিসে বাবু হবার বিশেষ যোগ্যতা অর্জন করেন। সবাই যে কুইন ভিক্টোরিয়ায় অ্যাপয়েণ্টমেণ্ট লেটার হাতে করে হাওড়া স্টেশন থেকে পাঞ্জাব মেলে চাপতেন, তা নয়। তবে রাওয়ালপিণ্ডি মিলিটারী একাউণ্টস অফিসে কোন না কোন মেশোমশাই পিসেমশাই-এর আমন্ত্রণে অনেকেই বাংলা ত্যাগ করেছেন।
পরে বাঙালী ছেলেছোকরার বোমা-পাটকা ছুড়ে ইংরেজদের ল্যাজে আগুন দেবার কাজে মেতে ওঠায় সরকারী চাকুরির বাজারে বাঙালীর দাম কমতে লাগল। ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের দিকে দিকে ইংরেজী শিক্ষার প্রসার হওয়ায় সরকারী অফিসের বাবু যোগাড় করতে ইংরেজকে আর শুধু বাংলার দিকে চাইবার প্ৰয়োজন হলো না। বাঙালীর বাংলার বাইরে যাবার বাজারে ভাঁটা পড়ল।
জীবনযুদ্ধে ধীরে ধীরে বাঙালীর পরাজয় যত বেশী প্ৰকাশ হতে লাগল, মিথ্যা আত্মসন্মানবোধ বাঙালীকে তত বেশী পেয়ে বসল। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালীর এই আত্মসম্মানবোধ তাকে প্ৰায় বাংলাদেশে বন্দী করে তুললে। বাংলাদেশের নব্য যুবসমাজ চক্রান্ত ভাঙতে পারত, গড়তে পারত নিজেদের ভবিষ্যৎ, অগ্ৰাহ করতে পারত অদৃষ্টের অভিশাপ। কিন্তু দুঃখের বিষয় তা সম্ভব হলো না। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, সুচিত্ৰা-উত্তম, সন্ধ্যা মুখুজ্যে-শ্যামল মিত্তির, বিষ্ণু দে-সুধীন দত্ত, সত্যজিৎ-তপন সিংহ থেকে শুরু করে নানাকিছুর দৌলতে বেকার বাঙালীও চরম উত্তেজনা ও কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যে জীবন কাটায়। এই উত্তেজনা, কর্মচাঞ্চল্যের মোহ আছে সত্য কিন্তু সার্থকতা কতটা আছে তা ঠিক জানি না।
কলকাতায় রিপোর্টারী করতে গিয়ে বাংলাদেশের বহু মনীষীর উপদেশ পেয়েছি, পরামর্শ পেয়েছি কিন্তু পাইনি অনুপ্রেরণা। নিজেদের আসন অটুট রেখে, নিজেদের স্বাৰ্থ বজায় রেখে তাঁরা শুধু রিক্ত নিঃস্ব বুভুক্ষু বাঙালী ছেলেমেয়েদের হাততালি চান। সাড়ে তিন কোটি বাঙালীকে বিকলাঙ্গ করে সাড়ে তিন ডজন নেতা আনন্দে মশগুল।
উদার মহৎ মানুষের অভাব বাংলাদেশে নেই। প্রতিটি পাড়ায় মহল্লায়, গ্রামে-শহরে-নগরে বহু মহাপ্ৰাণ বাঙালী আজও রয়েছেন। কিন্তু অন্যায়, অবিচার, অসৎ-এর অরণ্যে তাঁরা হারিয়ে গেছেন।
কলকাতার এই বিচিত্র পরিবেশে থাকতে থাকতে আমার মনটা বেশ তেঁতে হয়েছিল। আশপাশের অসংখ্য মানুষের অবহেলা আর অপমান অসহ্য হয়ে উঠেছিল। সবার অজ্ঞাতে, অলক্ষ্যে মন আমার বিদ্রোহ করত। কিন্তু রাস্তা খুজে পেতাম না। এক পা এগিয়ে তিন পা পিছিয়ে যেতাম! সমাজ-সংসার-সংস্কারের জাল থেকে নিজেকে ভক্ত করে বেরুতে গিয়ে ভয় করত। ঘাবড়ে বোতাম।
নিজের মনের মধ্যে যে এইসব দ্বন্দ্ব ছিল, তা মেমসাহেবকেও বলতাম না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমি চঞ্চল হয়ে উঠেছিলাম। তাইতো নিয়তির খেলাঘরে মেমসাহেবকে নিয়ে খেলতে গিয়ে যেদিন সত্যিসত্যিই ভবিষ্যতের অন্ধকারে ঝাঁপ দিলাম, সেদিন মুহুর্তের জন্য পিছনে ফিরে তাকাইনি। মনের মধ্যে দাউ-দাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছিল। হয়ত প্ৰতিহিংসা আমাকে আরো কঠোর কঠিন করেছিল।
আর? মেমসাহেবকে আর দূরে রাখতে পারছিলাম না। জীবনসংগ্রামের জন্য প্রতিটি মুহুর্ত তিলে তিলে দগ্ধ হওয়ায় দিনের শেষে রাতের অন্ধকারে মেমসাহেবের একটু কোমল স্পর্শ পাবার জন্য মনটা সত্যি বড় ব্যাকুল হতো। জীবনসংগ্ৰাম কঠোর থেকে কঠোরতর হতে পারে, সে সংগ্রামে কখনও জিতব, কখনও হারব। তা হোক। কিন্তু দিনের শেষে সূৰ্যাস্তের পর কর্মজীবনের সমস্ত উত্তেজনা থেকে বহু দূরে মানসলোকের নির্জন সৈকতে বন্ধনহীন মন মুক্তি চাইত মেমসাহেবের অন্তরে।
স্বপ্ন দেখতাম আমি ঘরে ফিরেছি। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই আমি সুইচটা অফ করে দিয়ে মেমসাহেবকে অকস্মাৎ একটু আদর করে তার সর্বাঙ্গে ভালবাসার ঢেউ তুলেছি। দুটি বাহুর মধ্যে তাকে বন্দিনী করে নিজের মনের সব দৈন্য দূর করেছি, সারাদিনের সমস্ত গ্লানি মুছে ফেলেছি।
মেমসাহেব আমার দুটি বাহু থেকে মুক্তি পাবার কোন চেষ্টা করে না, কিন্তু বলে, আঃ ছাড় না।
ঐ দুটি একটি মুহুর্তের অন্ধকারেই মেমসাহেবের ভালবাসার জেনারেটরে আমার মনের সব বালবগুলো জালিয়ে নিই।
তারপর মেমসাহেবকে টানতে টানতে ডিতানের পর ফেলে দিই। আমিও হুমডি খেয়ে পড়ি ওর উপর। অবাক বিস্ময়ে ওর দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। মেমসাহেবও স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থাকে। অত নিবিড় করে দুজনে দুজনকে কাছে পাওয়ায় দুজনেরই চোখে নেশা লাগে। সে নেশায় দুজনেই হয়ত একটু মাতলামি করি।
হয়ত বলি, জান মেমসাহেব, তোমার ঐ দু’টো চোখের দিকে তাকিয়ে যখন আমার নেশা হয়, যখন আমি সমস্ত সংযম হারিয়ে মাতলামী পাগলামি করি, তখন জিগর মুরাদাবাদীর একটা শের মনে পড়ে।
পাশ ফিরে আর শোয় না মেমসাহেব। চিৎ হয়ে শুয়ে দু’হাত দিয়ে আমার গলাটা জড়িয়ে ধরে বলে, বল না, কোন শেরটা তোমার মনে পড়ছে।
আমি এবার বলি, তেরী আঁখো কা কুছ কাসুর নেহি, মুঝকো খারাব হোনা থা।–বুঝলে মেমসাহেব, তোমার চোখের কোন দোষ নেই, আমি খারাপ হতামই।
চোখটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটু ঢলঢল ভাবে ও বলে, তাতো একশবার সত্যি! আমি কেন তোমাকে খারাপ করতে যাব?
আমি কানে কানে ফিসফিস করে বলি, আমার আবার খারাপ হতে ইচ্ছে করছে।
ও তিড়িং করে একলাফে উঠে বসে আমার গালে একটা ছোট্ট মিষ্টি চড় মেরে বলে, অসভ্য কোথাকার।
আরো কত কি ভাবতাম। ভাবতে ভাবতে আমি পাগল হবার উপক্রম হতাম। শত-সহস্ৰ কাজকর্ম চিন্তা-ভাবনার মধ্যেও মেমসাহেবের ছবিটা সবসময় আমার মনের পর্দায় ফুটে উঠত। তাইতো দিল্লী আসার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করলাম করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে হয়ে অদৃষ্টের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেকে প্ৰতিষ্ঠা করতে হবে কর্মজীবনে। আর? মেমসাহেবকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমার জীবনে।
দোলাবৌদি, আমি শিবনাথ শাস্ত্রী বা বিদ্যাসাগর নই যে আত্মজীবনী লিখব। তবে বিশ্বাস কর দিল্লীর মাটিতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে আমি একেবারে পাল্টে গিয়েছিলাম। যেদিন প্ৰথম দিল্লী স্টেশনে নামি, সেদিন এক’জন নগণ্যতম মানুষও আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন না। এতবড় রাজধানীতে একটি বন্ধু বা পরিচিত মানুষ খুজে পাইনি। একটু আশ্ৰয়, একটু সাহায্যের আশা করতে পারিনি কোথাও। দিল্লীর প্রচণ্ড গ্রীষ্মে ও শীতে নিঃস্ব রিক্ত হয়ে আমি যে কিভাবে ঘুরে বেড়িয়েছি তা আজ লিখতে গেলেও গা শিউরে ওঠে। কিন্তু তবুও আমি মাথা নীচু করিনি।
একটি বছরের মধ্যে রাতকে দিন করে ফেললাম। শুধু মনের জোর আর নিষ্ঠ দিয়ে অদৃষ্টের মোড় ঘুরিয়ে দিলাম। পার্লামেণ্ট হাউস বা সাউথ ব্লকের এক্সটারন্যাল অ্যাফেয়ার্স মিনিস্ট্র থেকে বেরুবার মুখে দেখা হলে স্বয়ং প্ৰাইম মিনিস্টার আমাকে বলতেন, হাউ আর ইউ?
আমি বলতাম, ফাইন, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার!
তুমি ভাবছহিয়ত গুল মারছি। কিন্তু সত্যি বলছি। এমনিই হতো। একদিন আমার সেই অতীতের অখ্যাত উইকলির একটা আর্টিকেল দেখাবার জন্য তিনমূৰ্তি ভবনে গিয়েছিলাম। আর্টিকেলটা দেখাবার পর প্রাইম মিনিস্টার জিজ্ঞাসা করলেন, আর ইউ নিউ টু দেলহি?
ইয়েস স্যার।
কবে এসেছ?
এইত মাস চারেক।
তারপর যখন শুনলেন আমি ঐ অখ্যাত উইকলির একশ টাকার চাকরি নিয়ে দিল্লী এসেছি, তখন প্রশ্ন করলেন, আর ইউ টেলিং এ লাই?
নো স্যার।
এই মাইনেতে দিল্লীতে টিকতে পারবে?
সার্টেনলি স্যার!
শেষে প্ৰাইম মিনিস্টার বলেছিলেন, গুড লাক টু ইউ। সী মী ফ্রম টাইম টু টাইম।
দেখতে দেখতে কত অসংখ্য মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো, ঘনিষ্ঠতা হলো। কত মানুষের ভালবাসা পেলাম। কত অফিসার, কত এম-পি, কত মিনিস্টারের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। নিত্যনতুন নিউজ পেতে শুরু করলাম। উইকলি থেকে ডেইলীতে চাকরি পেলাম।
আমি দিল্লীতে আসার মাসিকয়েকের মধ্যেই মেমসাহেব একবার দিল্লী আসতে চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, না এখন নয়। একটি মুহুর্ত নষ্ট করাও এখন ঠিক হবে না। আমাকে একটু দাঁড়াতে দাও, একটু নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ দাও। তারপর এসো।
ভাবতে পার মুহুর্তের জন্য যে মেমসাহেবের স্পর্শ পাবার আশায় প্রায় কাঙালের মত ঘুরেছি, সেই মেমসাহেবকে আমি দিল্লী আসতে দিইনি। মেমসাহেব রাগ করে নি। সে উপলব্ধি করেছিল। আমার কথা। চিঠি পেলাম
ওগো, কি আশ্চৰ্যভাবে তুমি আমার জীবনে এলে, সেকথা ভাবলেও অবাক লাগে। কলেজ-ইউনিভার্সিটির জীবনে, সোশ্যালরি-ইউনিয়ন বা রবীন্দ্রজয়ন্তী-বসন্তোৎসবে কত ছেলের সঙ্গে আলাপপরিচয় হয়েছে। কাউকে তাল লেগেছে, কাউকে ভাল লাগে নি। দু’এক’জন হয়ত আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে। আশুতোষ বিল্ডিং-এর ঐ কোণার ঘরে গান-বাজনার রিহার্সাল দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে মদন চৌধুরী হঠাৎ আমার ডান হাতটা চেপে ধরে ভালবাসা জানিয়েছে। বিয়ে করতেও চেয়েছে। তালতলার মোড়ের সেই যে ভাবতোলা দেশপ্রেমিক, তিনিও একদিন আত্মনিবেদন করেছিলেন আমাকে।
মুহুর্তের জন্য চমকে গেছি। কিন্তু থমকে দাঁড়াই নি। তারপর যেদিন তুমি আমার জীবনে এলে, সেদিন কে যেন আমার সব শক্তি কেড়ে নিল। কে যেন কানে কানে ফিসফিস করে বলল, এই সেই।
তুমি তো জান আমি আর কোনদিকে ফিরে তাকাই নি। শুধু তোমার মুখের দিকে চেয়ে আছি। তোমাকে আমার জীবনদেবতার আসরে বসিয়ে পূজা করেছি, নিজের সর্বস্ব কিছু দিয়ে তোমাকে অঞ্জলি দিয়েছি। মন্ত্র পড়ে, যজ্ঞ করে সর্বসমক্ষে আমাদের বিয়ে আজও হয় নি। কিন্তু আমি জানি তুমি আমার স্বামী, তুমি আমার ভবিষ্যত সন্তানের পিতা।
মেমসাহেব বেশী কথা বলত না কিন্তু খুব সুন্দর সুন্দর বড় বড় চিঠি লিখতে পারত। এই চিঠিটাও অনেক বড়। সবটা তোমাকে লেখার প্রয়োজন নেই। তবে শেষের দিকে কি লিখেছিল জান? লিখেছিল–…তুমি যে এমন করে আমাকে চমকে দেবে, আমি ভাবতে পারিনি। ভেবেছিলাম ঘুরে-ফিরে একটা কাগজে চাকরি যোগাড় করবে। কিন্তু এই সামান্য কমাসের মধ্যে তুমি এমন করে নিজেকে দিল্লীর মত অপরিচিত শহরে এত বড় বড় রখীমহারথীদের মধ্যে নিজেকে প্ৰতিষ্ঠা করতে পারবে, সত্যি আমি তা কল্পনা করতে পারিনি। তোমার মধ্যে যে এতটা আগুন লুকিয়ে ছিল, আমি তা বুঝতে পারিনি।…
যাই হোক তোমার গর্বে আমার সারা বুকটা ভরে উঠেছে। মনে হচ্ছে আমার চাইতে সুখী স্ত্রী আর কেউ হতে পারবে না। আমি সত্যি বড় খুশী, বড় আনন্দিত। তোমার এই সাফল্যের জন্য তোমাকে একটা বিরাট পুরস্কার দেব। কি দেব জান? যা চাইবে তাই দেব। বুঝলে? আর কোন আপত্তি করব না। আর আপত্তি করলে তুমিই বা শুনবে কেন?…
দোলাবৌদি, তুমি কল্পনা করতে পার মেমসাহেবের ঐ চিঠি পড়ে আমার কি প্রতিক্রিয়া হলো? প্ৰথমে ভেবেছিলাম দু’একদিনের জন্য কলকাতা যাই। মেমসাহেবের পুরস্কার নিয়ে আসি। কিন্তু কাজকর্ম পয়সাকড়ির হিসাবনিকাশ করে আর যেতে পারলাম না।
তবে মনে মনে এই ভেবে শান্তি পেলাম যে আমাকে বঞ্চিত করে কৃপণের মত অনেক ঐশ্বৰ্য ভবিষ্যতের জন্য অন্যায়ভাবে গচ্ছিত রেখে মেমসাহেবের মনে অনুশোচনা দেখা দিয়েছে। আমি হাজার মাইল দূরে পালিয়ে এসেছিলাম। মেমসাহেব সেই আদর, ভালবাসা, সেই মজা, রসিকতা কিছুই উপভোগ করছিল না। আমাকে যতই বাধা দিক, আমি জানতাম রোজ আমার একটু আদর না পেলে ও শান্তি পেত না। আমি বেশ অনুমান করছিলাম ওর কি কষ্ট হচ্ছে; উপলব্ধি করছিলাম। আমাকে কাছে না পাবার অতৃপ্তি ওকে কিভাবে পীড়া দিচ্ছে।
মনে মনে অনেক কষ্ট পেলেও ওর আসাটা বন্ধ করে ভালই করেছিলাম। দিল্লীতে আসার জন্য ও যে বেশ উতলা হয়েছিল সেটা বুঝতে কষ্ট হয় নি। তাইতো আরো তাড়াতাড়ি নিজেকে প্ৰস্তুত করবার জন্য আমি সর্বশক্তি নিয়োগ করলাম। ঠিক করলাম ওকে এনে চমকে দেব।
ভগবান আমাকে অনেকদিন বঞ্চিত করে অনেক কষ্ট দিয়েছেন। দুঃখে অপমানে বছরের পর বছর জ্বলে।পুড়ে মরেছি। কলকাতার শহরে এমন দিনও গেছে। যখন মাত্র একটা পয়সার অভাবে সেকেণ্ড ক্লাস ট্রামে পৰ্যন্ত চড়তে পারিনি। কিন্তু কি আশ্চৰ্য। দিল্লীতে আসার পর আগের সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। সে পরিবর্তনের বিস্তৃত ইতিহাস তোমার এই চিঠিতে লেখার নয়। সুযোগ পেলে পরে শোনাব। তবে বিশ্বাস কর অবিশ্বাস্য পরিবর্তন এলে আমার কর্মজীবনে। সাফল্যের আকস্মিক বন্যায় আমি নিজেকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম।
মাস ছয়েক পরে মেমসাহেব যখন আমাকে দেখবার জন্য দিল্লী এলো, তখন আমি সবে বোর্ডিং হাউসের মায়া কাটিয়ে ওয়েস্টার্ন কোর্টে এসেছি। নিশ্চিত জানতাম মেমসাহেব আমাকে দেখে, ওয়েস্টার্ন কোর্টে আমার ঘর দেখে, আমার কাজকর্ম, আমার জীবনধারা দেখে চমকে যাবে। কিন্তু আমি চমকে দেবার আগেই ও আমাকে চমকে দিল।
নিউদিল্লী স্টেশনে গেছি। ডিলুক্স এয়ার কণ্ডিশনড এক্সপ্রেস অ্যাটেণ্ড করতে। মেমসাহেব। আসছে। জীবনের এক অধ্যায় শেষ করে নতুন অধ্যায় শুরু করার পর ওর সঙ্গে এই প্ৰথম দেখা হবে।
লাউডস্পীকারে অ্যানাউন্সিমেণ্ট হলো, এ-সি-সি এক্সপ্রেস এক্ষুনি একনম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছবে। আমি সানগ্লাসটা খুলে রুমাল দিয়ে মুখটা আর একবার মুছে নিলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে দু’একটা টান দিতে না দিতেই ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়ল। এদিক-ওদিক দেখতে না দেখতেই মেমসাহেব দু নম্বর চেয়ার কার থেকে বেরিয়ে এলো।
কিন্তু একি? মেমসাহেবের কি বিয়ে হয়েছে? এত সাজগোছ? এত গহনা? মাথায় কাপড়, কপালে অতবড় সিঁদুরের টিপ।
মেসাহেবকে কোনদিন এত সাজগোছ করতে দেখিনি। গহনা? শুধু ডানহাতে একটা কঙ্কণ। ব্যাস, আর কিছু না। গলায় হার? না, তাও না। কোন এক বন্ধুর বিপদে সাহায্য করার জন্য গলায় হার দিয়েছেন। তাছাড়া মাথার কাপড় আর কপালে অতবড় একটা সি দুরের টিপ দেখে অবাক হবার চাইতে ঘাবড়ে গেলাম বেশী। মুহুর্তের জন্য পায়ের নীচে থেকে যেন মাটি সরে গেল। গলাটা শুকিয়ে এলো, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দে দিল। দুনিয়াটা ওলট-পালট হয়ে গেল।
প্ৰথমে ভাবলাম স্টেশন প্ল্যাটফর্মে ঐ কয়েক হাজার লোকের সামনে ওর গালে ঠাস করে একটা চড়, মারি। বলি, আমাকে অপমান করবার জন্য এত দূরে না এসে শুধু ইনভিটেশন লেটারটা পাঠালেই তো হতো।
আবার ভাবলাম, না, ওসব কিছু করব না, বলব না।
বিশেষ কথাবার্তা না বলে সোজা গিয়ে ট্যাক্সি চড়লাম।
ট্যাক্সিতে উঠেই মেমসাহেব আমাকে প্ৰণাম করল। আমার বাঁ হাতটা টেনে নিল নিজের ডান হাতের মধ্যে। জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ?
আমার কথা ছেড়ে দাও। এখন বল তুমি কেমন আছ? তোমার বিয়ে কেমন হলো? বর কেমন হলো? সর্বোপরি তুমি দিল্লী এলে কেন?
মেমসাহেব একেবারে গলে গেল, সত্যি বলছি, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। এমন হঠাৎ সবকিছু হয়ে গেল যে কাউকেই খবর দেওয়া হয় নি।…
ছেলেটি কেমন?
বেশ গর্বের সঙ্গে উত্তর এলো, ব্রিলিয়াণ্ট!
কোথায় থাকেন।
এইত তোমাদের দিল্লীতেই।
আমি চমকে উঠি, দিল্লিতে?
ও আমার গালটা একটু টিপে দিয়ে বলে, ইয়েস স্যার। তবে কি আমার বর আদি সপ্তগ্রাম বা মছলন্দপুর থাকবে?
ট্যাক্সি কনটপ্লেস ঘুরে জনপদে ঢুকে পড়ল। আর এক মিনিটের মধ্যেই ওয়েস্টার্ন কোর্ট এসে যাবে। জিজ্ঞাসা করলাম, এখন কোথায় যাবে?
কোথায় আবার? তোমার ওখানে।
ট্যাক্সি ওয়েস্টার্ন কোর্টে ঢুকে পড়ল। থামল। আমরা নোমলাম। তাড়া মিটিয়ে ছোট্ট সুটকেসটা হাতে করে ভিতরে ঢুকলাম। রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে লিফট্-এ চড়লাম। তিন তলায় গেলাম। আমার ঘরে এলাম।
মাথার কাপড় ফেলে দিয়ে দু’হাত দিয়ে মেমসাহেব আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আঃ কি শান্তি।
আমার বুকটা জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই থেমে গেল। ওর সিথিতে সিন্দুর না দেখে বুঝলাম…
এবার আমিও আর স্থির থাকতে পারলাম না। দু’হাত দিয়ে টেনে নিলাম বুকের মধ্যে। আদর করে, ভালবাসা দিয়ে ওকে। ক্ষতবিক্ষত করে দিলাম। আমি। মেমসাহেবও তার উন্মত্ত যৌবনের জোয়ারে আমাকে অনেক দূর ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আমার দেহে, মনে ওর ভালবাসা, আবেগ উচ্ছলতার পলিমাটি মাখিয়ে দিয়ে গেল। আমার মন আরো উর্বরা হলো।
এতদিন পরে দুজনে দুজনকে কাছে পেয়ে প্ৰায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিলাম। কতক্ষণ যে ঐ জোয়ারের জলে ডুবেছিলাম, তা মনে নেই। তবে সম্বিত ফিরে এলো, দরজায় নক করার আওয়াজ শুনে। তাড়াতাড়ি দুজনে আলাদা হয়ে বসলাম। আমি বললাম, কোন?
ছোট সাব, ম্যায়।
ও জিজ্ঞেসা করল, কে?
আমি বললাম, গজানন।
উঠে গিয়ে দরজা খুলে ডাক দিলাম, এসো, ভিতরে এসে। মেমসাহেবকে দেখেই গজানন দু’হাত জোড় করে। প্ৰণাম করল, নমস্তে বিবিজি!
ও একটু হাসল। বলল, নমস্তে।
আমি বললাম, গজানন, বিবিজিকে কেমন লাগছে? বহুত আচ্ছা, ছোট সাব। এক সেকেণ্ড। পরে আবার বলল, আমার ছোট-সাহেবের বিবি কখনও খারাপ হতে পারে?
আমরা দুজনেই হেসে ফেলি। মেমসাহেব বলল, গজানন, বাবুজি প্ৰত্যেক চিঠিতে তোমার কথা লেখেন।
গজানন দু’হাত কচলে বলে, ছোটসাবকা মেহেরবানি।
আমি উঠে গিয়ে গজাননের পিঠে একটা চাপড় মেরে বলি, জান মেমসাহেব, গজানন আমার লোক্যাল বস। আমার গার্ডিয়ান।
কিয়া করেগা বিবিজি, বাতাও। ছোটসাব এমন বিশ্ৰী কাজ করে যে কোন সময়ের ঠিক ঠিকানা নেই। তারপর কিছু সংসারী বুদ্ধি নেই। আমি না দেখলে কে দেখবে বল? গজানন প্ৰায় খুনী আসামীর মত ভয়ে ভয়ে জেরার জবাব দেয়।
গজানন এবার মেমসাহেবকে জিজ্ঞাসা করে, বিবিজি, ট্রেনে কোন কষ্ট হয় নি তো?
মেমসাহেব বললো, না, না, কষ্ট হবে কেন? গজানন চট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমাদের দুজনের ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসে। ব্রেকফাস্টের ট্রে নামিয়ে রেখে গজানন চলে যায়, আমি যাচ্ছি। একটু পরেই আসছি।
গজানন চলে যাবার পর আমি মেমসাহেবের কোলে শুয়ে পড়লাম। আর ও আমাকে ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিতে লাগল।
দোলাবৌদি, মেমসাহেব। আর আমি অনেক কাণ্ড করেছি। বাঙালী হয়েও প্রায় হলিউড ফিল্মে অভিনয় করেছি। শেষপর্যন্ত অবশ্য শরৎ চাটুজ্যের হিটু বই-এর মত হয়ে গেছে। আস্তে, আস্তে, ধীরে ধীরে সব জানবে। বেশী ব্যস্ত হয়ে না।
চলবে।