#মেঘ রোদ্দুরের আলাপন
#সূচনা পর্ব
#Writer:মারশিয়া জাহান মেঘ
১.
‘বিল পে কেউ এইভাবে করে? এনিওয়ে টাকাটা আমার হাতে দিন।
‘এই মেয়ে তুমি জানো? তুমি কার সাথে এতো রাগ দেখিয়ে কথা বলছো?
‘আমার এইসব দেখার দরকার নেই যে আমি কার সাথে কথা বলছি। দেখার বিষয় এইটা যে এইখানে অভদ্রতার পরিচয় সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে টাকাটা এইভাবে ছুঁড়ে টেবিলে ফেলে দিয়ে। ওনিতো টাকাটা আমার হাতেও দিতে পারতেন। কারণ আমি এইখানেই ছিলাম।
আর এইদিকে নিচের দিকে তাকিয়ে কোনো রকম রাগ কন্ট্রোল করছে সেইখানেই তাদের পাশে বসে থাকা তৃতীয় ব্যাক্তিটি।
‘ম্যানেজার ম্যানেজার…
‘ইয়ে…ইয়েস স্যার বলুন।
‘আপনাদের রেষ্টুরেন্টের মেয়ে ওয়েটারদের দেখি মুখে তেজের অভাব নেয়।
‘কি করেছে স্যার?
‘আমার স্যারের সাথে মিস বিহেভ করেছে আপনার এই ওয়েটার।
‘ওফ রিশ এইসব কি হচ্ছে? তুমি স্যারের সাথে মিস বিহেভ করেছো কেনো? তুমি জানো ওনি কে? টপ বিজনেস-ম্যান সেহের মেহেরিয়ার ছেলে জেইন মেহেরিয়ার।
‘স্যার ওনি কে এইসব আমার দেখার ইচ্ছে নেই। আমি এইখানে কাজ করি দায়িত্ব পালন করি। কিন্তু কারো নাম এটিটিউড দেখতে আসিনা। আমার যেমন দায়িত্ব এইখানে এসে প্রত্যেকটা কাস্টমারদের যত্ন সহকারে সেবা দেওয়া তেমনি ওনাদেরো দরকার আমাদের হাতে সুন্দর করে তার বিনিময় দেওয়া৷ ওনি খেয়ে দেয়ে বিল পে টা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে বলেছেন টাকাটা নিতে এইটা অবশ্য অন্যকারো কাছে অপমান জনক না হলেও আমার কাছে অপমান জনক। কথাগুলো বলেই রিশ সেইখান থেকে চলে যায়।
‘স্যার সরি।
‘ইটস ওকে ম্যানেজার সাহেব। তবে ওনাকে বলবেন নেক্সট টাইম যেনো আমার সামনে আর না আসে। জাস্ট না আসে।
এইটা বলেই জেইন উঠে চলে যায়। পেছনে যাচ্ছে তার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট স্বাদ।
‘স্বাদ….
‘ইয়েস স্যার, বুঝেছি স্যার আজকে বিকেলের মধ্যেই পেয়ে যাবেন।
২.
রিশ নেক্সট টাইম তুমি কোনো কাস্টমারের সাথে এমনভাবে কথা বললে তোমাকে এই চাকরি ছাড়তে হবে। আজকে তুমি যার সাথে মিস বিহেভ করেছো ওনি চাইলেই তোমাকে অনেক কিছু করতে পারতো। নেহাৎ ওনি নিজেকে কন্ট্রোল করেছে।
‘স্যার ওনি যেমন করেছেন আমিও ঠিক তেমনভাবেই ওনাকে বুঝিয়ে দিয়েছি কোনটা উচিৎ আর কোনটা অনুচিৎ। আর বাকি থাকলো আপনার চাকরি! চাকরি না থাকলে না থাকবে অন্য কোথাও নিয়ে নিবো চাকরি। তবে যেইখানে নিজের সেল্ফ রেসপেক্ট এর প্রায়োরিটি নেই সেইখানে রিশ ওয়াহিদ ও নেই…কথাটা বলেই সাইড ব্যাগটা নিয়ে চলে গেলো রিশ।
৩.
জেইনের গাড়ি থামে একটা বড় বাড়ীর সামনে। জেইনের দাদাভাই এই বাড়ীটা মার্বেল আকারের কিছু বিদেশী পাথর দিয়ে তৈরী করেছেন। রাজপ্রাসাদের থেকে কোনো দিক থেকে কম নয় বাড়ীটি। বাড়ীটির দুই পাশে ছড়ানো নানা বাহারের ফুল। যদিও এই বাগান টা সম্পূর্ণ জেইন নিজ দায়িত্বে করেছে।
জেইন বাড়ীর ভেতরে ঢুকতেই লাইন বাই লাইন দাঁড়িয়ে থাকা বডিগার্ডগুলো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। জেইন ভেতরে ঢুকছে আর সবার হাতে একটা একটা করে নিজের ঘড়ি,সুট খুলে খুলে সবার হাতে দিচ্ছে। সবশেষে জেইন সাদা শার্টের বোতাম গুলো খুলতে খুলতে একটা রুমে যায়। সেইখানে একজন বয়স্ক মহিলা চোখে চশমা পড়ে উপন্যাস পড়ছে। জেইন মুচকি হেসে ডাক দেয়
‘গ্রেনি’
‘দাদুভাই এসেছো?
‘হুম গ্রেনি। তুমি কি করছো? ঔষধ খেয়েছো?
‘না মানে..দাদুভাই…
জেইন বুঝতে পেরেছে যে তার গ্রেনি ঔষধ খায়নি৷ তাই রেগে চিৎকার করে সব সার্ভেন্টদের ডাকে। সবাই দৌড়েঁ আসে। এই বাড়ীর প্রত্যেকটা মানুষ জেইনকে ভয় পায়। কারণ জেইন যেমন গম্ভীর তেমন রাগী। আবার জেইন একমাত্র ভয় পায় তার বাবাকে। আর ভালোবাসে বেশি তার গ্রেনিকে।
‘গ্রেনির ঔষধ দাওনি?
‘দাদুভাই ছেড়ে দাও ওদের। ওরাতো এনেইছিলো আমিই খায়নি।
‘কি হলো সবাইকে প্রশ্ন করেছিতো।
জেইনের চিৎকারে সব সার্ভেন্ট কেঁপে উঠে। একজন কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
‘স্যা স্যার মানে আমরা এনেছিলাম ঔষধ কিন্তু দাদীমা খায়নি।
‘খাবেনা বললেই না খাইয়ে চলে যাবে তোমরা? যাও এইখান থেকে সবাই..জাস্ট আউট।
সবাই মাথা নিচু করে চলে যেতেই রেজিয়া মেহেরিয়া বললেন,
‘দাদু ভাই শুধু শুধু তুমি সবাইকে বকলে। আসলে ওদের কোনো দোষ ছিলোনা।
‘গ্রেনি ওদের দোষ ছিলোনা? তুমি খাবেনা বলেছো আর ওরা এইটাই মেনে নিলো? আর তুমি নেক্সট টাইম থেকে ঠিকমতো ঔষধ না খেলে আমি কিন্তু সত্যি আবার লন্ডনে চলে যাবো।
‘দাদু ভাই প্লিজ এমনভাবে বলোনা। তুমি ছাড়া এইখানে কেইবা আছে আমার? তোমার বাবাতো সারাদিন অফিস নিয়ে বিজি থাকে।
‘তাহলে বলো নেক্সট টাইম থেকে সবসময় ঠিকমতো ঔষধ খাবে।
‘আচ্ছা বাবা খাবো। এখন যাওতো ফ্রেশ হয়ে এসো আমরা দুজন একসাথে লাঞ্চ করবো।
‘ওকে গ্রেনি তুমি জাস্ট ৫ মিনিট ওয়েট করো আমি যাবো আর আসবো…এইটা বলে রিতা মেহেরিয়াকে একটু জড়িয়ে ধরে জেইন পা বাড়ালো নিজের রুমের দিকে।
৪.
রুমের লাইট টা অন করে সাইড ব্যাগটা টেবিলে রেখে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দেয় রিশ। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে তার হাত পা অবশ হয়ে যায়। রিশ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখে। তারপর উঠে ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে এসে রিশ দেখে বিছানায় বসে বসে ফোন টিপছে মিসকাত। মিসকাত রিশকে দেখে ফোনটা রেখে মুচকি হেসে বললো,
‘কখন এলি রিশ?
‘এইতো ১০ মিনিটের আপ হলো৷ আজকে তোর ক্যাফ তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিয়েছে নাকি মিসকাত?
‘নারে। আসলে আজ আমার একদম ভালো লাগছিলোনা তাই তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে এসে পড়েছি।
‘মিসকাত কফি খাবি? দাঁড়া আমি নিয়ে আসছি।
রিশ মিসকাতের জবাবের অপেক্ষা না করে পা বাড়ালো কিচেনে। ক্ষনিক সময় পর ফিরে এলো দুই কাপ গরম ধোঁয়া উঠা কফি নিয়ে।
‘এই নে কফি।
‘আচ্ছা রিশ তোর ভালো লাগে? সব ছেড়ে এইভাবে থাকতে?
‘হুম অনেক ভালো লাগে। কারণ নিজের যোগ্যতা প্রুভ করতে অনেক মানুষকে অনেক কিছু করতে হয়। ধরে নে আমিও তাই করছি।
‘তোর মম প্রতিদিন যে কল দিয়ে কান্না করে তোর খারাপ লাগেনা একটুও?
‘খারাপ! আর আমি দুটো দু জিনিস মিসকাত৷ যদি আমি মম এর মায়ায় আটকে যায় তাহলে নিজে আউট অফ কন্ট্রোলে চলে যাবো। এন্ড আই ডন্ট ওয়ান্ট দিস।
‘তোর মতো আমার হলে আমি কখনোই এমন অবস্থায় থাকতাম না।
মিসকাতের এমন কথায় রিশ জবাব না দিয়ে একটু আলতো হাসে।
৫.
জেইনের সামনে একটা ফাইল রাখে স্বাদ। জেইন পিসি’র’ দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,
‘Start telling all his details’
‘Okey Sir.
স্যার মেয়েটির নাম রিশ ওয়াহিদ। ডটার অফ শাহারিয়া ওয়াহিদ।
‘নেক্সট ‘
‘ওয়াহিদ ইন্ডাস্ট্রির ফিউচার Owner’
‘নেক্সট’
‘স্যার মেয়েটি তার ফ্যামিলি থেকে আলাদা থাকে। একটা মেয়ের সাথে একটা ফ্ল্যাট শেয়ারে দুজন একসাথে থাকে। আর রেস্টুরেন্টেে পার্ট টাইম জব করে। ভার্সিটির শেষ বর্ষের স্টুডেন্ট রিশ। আর তার সাথের মেয়েটির নাম মিসকাত৷ সেও একটা ক্যাফে জব করে।
‘কেনো?
‘স্যার মেয়েটির বাবার ধারণা যে মেয়েরা কিছুই পারেনা তাই তিনি তার মেয়ের থেকে তার ছেলেক প্রায়োরিটি বেশি দেয়।
‘তাহলে মেয়েটি ফিউচার Owner কিভাবে?
‘স্যার মেয়েটির বাবা মানে শাহারিয়া ওয়াহিদ মেয়েকে অনেক ভালোবাসেন। কিন্তু তিনি এই ধারণা কেনো পুষে রেখেছে জানিনা ‘যে মেয়েরা কিছুই পারেনা৷ তবে আমি ইনফরমেশন পেয়েছি রিশ ওয়াহিদ ইন্ডাস্ট্রির ফিউচার Owner’।
‘ওকে’ তুমি এখন আসতে পারো।
‘ওকে স্যার৷ আল্লাহ হাফেজ
আল্লাহ হাফেজ।
জেইন পিসি টা বন্ধ করে রেখে থুতনিতে হাত গুজে দিয়ে ভাবছে,’মেয়েটার বাবা মেয়েটাকে ভালোওবাসে আবার তুচ্ছ চোখেও দেখে?
স্ট্রেইন্জ।
৬.
In Wahid House….
রিলজেম তোমার জন্য আমার মেয়ে আমাকে ভুল বুঝে বাড়ি ছেড়েছে তবুও তোমার শান্তি হয়নি?
‘বাবা দেখুন। সবার সামনে আপনি দেখান যে আপনি আমাকে বেশি ভালোবাসেন কিন্তু সত্যিতো এইটাই যে আপনি রিশকে বেশি ভালোবাসেন। তাহলে আমি কিভাবে বিলিভ করি যে আপনার মেয়ে যোগ্য না হয়েও তাকে আপনি ফিউচার Owner’ করবেন না?
‘রিলজেম আমি তোমার কাছে জবাবদিহি দিতে বাধ্য নয়। আর শাহারিয়া ওয়াহিদ এতো নিচু মানসিকতা নিয়ে চলাফেরা করেনা যে যোগ্য না হয়েও যোগ্য বলবে।
‘বাবা রিশ বাড়ি ছেড়ে না যাক সেইটা আমিও চেয়েছিলাম। কিন্তু রিশ আর আপনারা কেনো বুঝতে চাইছেন না বাবা যে আমাকে যদি ইন্ডাস্ট্রির ফিউচার Owner’ না করেন তাহলে বন্ধু সমাজ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। আর রিলজেম ওয়াহিদ কারো হাসির পাত্র হতে চায়না।
‘রিলজেম তুমি ভুলে যেওনা ছোট থেকে আমরাই তোমাকে বড় করেছি সমাজ বড় করেনি।
‘বাবা…
“যা সত্যি তাই বলেছি। নিজের মমকে দেখেছো একবারো? মানুষটা মেয়ে শোকে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছে। তোমরা দুই ভাই বোন একে অপরের সাথী ছিলে। আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি ভাইয়ের জন্য বোন জেদ করে বাড়ী ছেড়ে দিবে। রিশ এর কথাতো বাদই দিলাম সে সবকিছু না ভেবে না বুঝে এতটুকু বুঝেই বাড়ী ছেড়েছে যে তার বাবাই তাকে তুচ্ছ ভাবে।
এইটা বলেই গম্ভীরতা নিয়ে শাহারিয়া ওয়াহিদ চলে গেলেন ড্রইং রুম থেকে।
রিলজেম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
চলবে,,