মেঘ বিয়োগের মৌসুম পর্ব-২৯

0
656

#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_২৯

সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হয়েছে অনেক্ষণ। মৌয়ের বাবা-মা চলেও গিয়েছে। বেলা নিজের রুমে এসে সোজা ওয়াশরুমে চেঞ্জ করে বিছানায় এসে বসে। বেলার মনে এখন হাজারটা প্রশ্ন। কেমন আছে ও বাড়ির লোকজন? তাকে ছাড়া নিশ্চয়ই খুব ভালো আছে! থাকবে না-ই বা কেন? ভালো থাকার জন্যই তো ওসব করেছিল। ধ্রুব নিশ্চয়ই তার বউকে নিয়ে খুব ভালো আছে।

বেলা আর সুমু সামনা-সামনি বসে আছে। দুজনের কারো মুখে কোনো কথা নেই। বেলা এদিক ওদিক তাকিয়ে আছে আর সুমু বেলার দিকে।

নিরবতা ভেঙে সুমু বলে ওঠে,” তোমাকে দেখে ভীষণ ভালো লাগছে জানো, ভাবি? সেদিন আমি কোনোভাবে চাইনি তোমার সংসার ভেঙে যাক আর আজ মনে হচ্ছে সংসার তোমার ভালোর জন্যই ভেঙেছিল। ”

বেলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,” কেমন আছে ওরা সবাই?”

সুমু নড়েচড়ে বসে। বেলার দিকে গভীর দৃষ্টি দিয়ে বলে,” আ*গুনে জ্বলছে। একটা ভালো মেয়ের চোখের পানি ঝরিয়ে কি ভালো থাকা যায়? জ্ব*লেপু*ড়ে মর*ছে সবাই। একজন, দুজন না সবাই।”

বেলা নির্জীব গলায় জিজ্ঞেস করে,” কেন?”
” তুমি চলে আসার পর কয়েকদিন খুব ভালো ছিল। রিমি তো আমাকে ডেকে ডেকে ওর ভাবির গুণগান গাইতো। তোমার শাশুড়িও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছেলের বউয়ের সুনাম করতো। দুই তিন মাস যাওয়ার পর থেকে বাড়িতে ঝামেলা শুরু হতে থাকে। কিছুসময় বাড়ির আশপাশ দিয়ে যাতায়াতের সময় বাড়ির ভেতরের চেঁচামেচি শোনা যেত। ধ্রুব ভাই নাকি মেসেঞ্জারে অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলে। সেদিন রাত দুইটার দিকে ওদের বাড়িতে চেঁচামেচি শুনে মানুষ জড়ো হয়েছিল। ধ্রুব ভাইয়ার বউ ঘুমাচ্ছিল আর সে ব্যক্তি রাতে বউকে লুকিয়ে লুকিয়ে কার সাথে যেন কথা বলছিল। বউয়ের ঘুম ভেঙে গেলে বুঝতে পারে বারান্দায় কেউ কথা বলছে। এগিয়ে গিয়ে স্বামীকে ফোনে কথা বলতে দেখে ফোন কেড়ে নিয়ে কানে নিয়ে দেখে মেয়ের গলা ব্যাস সেদিন থেকে অশান্তি শুরু। তোমার ডিভোর্সের সময় টাকা দিয়েছিল মাঠের জায়গা বিক্রি করিয়ে গলায় পাড়া দিয়ে টাকা নিয়েছে। শাশুড়িকে দিয়ে আর ননদকে দিয়ে সব কাজ করাচ্ছে। আমার তো বেশ ভালো লাগছে এসব দেখে। আমি শুধু মাকে বলি তোমার কথা। তোমার দীর্ঘশ্বাস ওদের সংসার জ্বা*লিয়ে পু*ড়িয়ে দিয়েছে। ওই মেয়ে যেমন তোমার সংসার ভেঙেছিল ঠিক তেমন তার সংসারও জ্বল*ছে। ”

সুমুর কথা শুনে বেলার মুখে তাচ্ছিলের হাসি ফুটে যায়। বলে,” পৃথিবীতে কারো ঋণ থাকে না, ইহজীবনে পূর্ণ না হলেও পরকালে ঠিকই পূর্ণ হয়। যে যেটা করবে তার ফল তাকে পেতেই হবে। আমাকে কয়েকদিন রিমি কল দিয়েছিল। কান্নাকাটি করেছে, তখনই বুঝেছি আমাকে ভালো না রেখে তারাও ভালো নেই। ধ্রুবও কয়েকবার কল দিয়েছিল৷ পরে আমার ভাইয়া নম্বর চেঞ্জ করে দিয়েছে। আমি আসলে ওদের নিয়ে ভাবতেই চাই না। যাদের জন্য আমার জীবনের পাঁচটা বছর শেষ করেছি তারা তো আমার জীবনটাই শেষ করে দিচ্ছিল, আল্লাহ বাঁচিয়ে নিয়েছে।”

সুমু খোলা চুলগুলো খোপা করতে করতে বলে,” ওরা ওদের শা*স্তি ঠিক পাবে। ওসব বাদ দাও এখন বলো ডাক্তারবাবু তোমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে ছিল কেন? আমি কিন্তু সব খেয়াল করেছি। তুমি যখন আমার সাথে কথা বলছিলে তখন ওরা ভাইবোন কথা বলছিল। আমি সবাই থাকাকালীন খেয়াল করে দেখেছি উনি তোমার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল। ”
বেলা মৃদু হেসে বলে,” কী যে বলো না! উনি সম্পর্কে আমার বেয়াই হয়।”
” ওহ হো, বেয়াইসাব?”
” হুম বেয়াইসাব।”
” তা, আর কোনো সম্পর্ক নেই?”
” আর কী সম্পর্ক থাকবে?”
” এই পছন্দ করার বিষয়।”
” সুমু, ভুল ভাবছো তুমি। আচ্ছা রিমির বিয়ের কথাবার্তা হয় না?”
” না, কই জানি না তো! তবে তোমার শাশুড়ি ভীষণ ফ্যাসাদে আছে। সবাই সবার কর্মফল নিশ্চয়ই পাবে দেখো। তুমি বলো, বিয়েটিয়ে করবে না?”
” না গো। আমি এখন বিয়ে, সংসার এসব নিয়ে আর ভাবছি না। অনেক তো হলো সংসার করা। আপাতত সংসারের স্বপ্ন আর নেই। ”

সুমুর ফোনে কল আসায় ফোনটা কেটে দেয় সে। বেলা ইতস্তত করতে করতে বলে,” ফোন রিসিভ করতে পারো। দরকারি হয়তো।”
” দরকারি না, বফ কল দিয়েছে। তোমার মতো সিঙ্গেল নই আমি।”

বেলা একটা বড়ো শ্বাস নিয়ে বলে,” সুমু, আমি বাহিরে যাচ্ছি পড়তে। এই এই সপ্তাহতেই। বাংলাদেশে আমার সময় আর নেই। হাতে মাত্র ক’টা দিন।”

সুমু উচ্ছ্বসিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,” সত্যি বলছো? আমার এখন আর কোনো আক্ষেপ নেই। তোমার খুব ভালো হোক, ভাবি। খুব ভালো হোক। ”

দুজনের মধ্যে কথা চলতে থাকে। এতগুলো মাসের জমানো কথা যেন আজ বেরিয়ে আসছে দুজনের।
জমে থাকা কথাগুলো, দুঃখগুলো, আক্ষেপগুলো ভাগাভাগি করে নিচ্ছে দুজনে।
_____

বেলা তৈরি হচ্ছে। রোদ তার তেজ হারিয়েছে। শহরে যারা পরিচিত ছিল তাদের সাথে আজকের বিকেলটা কাটাবে সে। যাদের সাথে কম্পিউটার ক্লাস করেছিল, বন্ধুত্ব হয়েছে আজকের বিকেলটা তাদের জন্য বরাদ্দ করে রেখেছে সে।

বেলা রেডি হয়ে রুম থেকে বের হবে ঠিক তখনই মৌ এসে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।

সহাস্যমুখে বলে,” কী ব্যাপার? শাড়ি পরে বের হচ্ছো যে?”
বেলা শাড়ির আঁচলটা তুলে নিয়ে বলে,” কেমন লাগছে বলো?”

মৌ এগিয়ে এসে বলে,” আমার ননদকে কখনো খারাপ লাগতেই পারে না। তবে কোথায় বেরোচ্ছ তুমি? বাহিরে যাবে সেটা তো বলোনি?”
” ঘণ্টাখানেক আগে ঠিক হয়েছে বের হওয়ার কথা। তুমি তো ঘুমোচ্ছিলে তাই আর ডেকে বলিনি। ”
” কোথায় যাচ্ছ?”
” সেদিন যে মাঠে গিয়েছিলাম ফুসকা খেতে, ওখানে যাব। আমার সাথে আমার ওই বান্ধবীগুলো যাবে।”
” কোন বান্ধবী?”
” ওই কম্পিউটার ক্লাস করতাম ওখানকার।”
” তোমাকে একটা কথা জানানো হয়নি। নুসরাত নামের মেয়েটার কেসের আসা*মীদের নিয়ে আরেকটা মাম*লা চলছিল গতকাল রায় দিয়েছে আদালত। সতেরো বছরের জে*ল।”

বেলা ভ্রু কুচকে বলে,” কই শুনিনি তো!”
” তোমাকে বলা হয়নি। ছেলেগুলোর পরিবার বাহির করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল পরে কারা যেন আবার এসব করেছে।”
” ঠিক হয়েছে। ফাঁ*সি হলে ভালো হতো, জানো*য়ার সবগুলো।”

মৌ বেলার হাত ধরে বাহিরে নিয়ে এসে বলে,” আচ্ছা বের হওয়ার সময় এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। তুমি যাও বের হও। বের হতে দেরি হলে আসতেও দেরি হবে। ”

বেলা মৌয়ের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায়৷ মৌ বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেলাকে দেখছিল। নিচে গিয়ে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে সে। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠায় মৌ নিজের রুমে চলে যায়। ফোনটা বিছানায় রাখা ছিল। ফোনের স্ক্রিনে ফারাজের নম্বর জ্বলজ্বল করছে। মৌ সময় অপচয় না করে কলটা রিসিভ করে।

” হ্যাঁ, ভাইয়া বল।”
” কী করছিস?”
” ঘুম থেকে উঠলাম। দুপুরে একটু ঘুমিয়েছিলাম। ”
” রাতে বাসায় আয়।”
” কেন? কোনো দরকার?”
” দরকার না। তোর ননদ তো চলেই যাচ্ছে। আম্মা দাওয়াত দিয়েছে এখানে।”
” ওয়াজিহা তো বাহিরে গেল। ”
” কেন?”
” বলল, ওর বান্ধবীদের সাথে দেখা করবে।”
” ওহ আচ্ছা। তাহলে আগামীকাল আয়। আম্মা বলেছে আসতেই হবে।”
” আচ্ছা দেখছি।”
_____

বেলা মাঠের পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির জন্য। সন্ধ্যা হয়েছে অনেকক্ষণ আগেই। এই সময়ে রিকশা একটু কম পাওয়া যায়। তার বান্ধবীদের বাড়ি একটু দূরে হওয়ায় যে রিকশা পেয়েছিল তারা তিনজনে সেটা নিয়ে চলে গিয়েছে।

বেলা স্টেশনের দিকে হেটে এগিয়ে যেতে থাকে এই ভেবে যে একটু হাটলেই রিকশা পাওয়া যেতে পারে। বিকেলে বের হওয়ার সাথে সাথে মৌ কল করে বলেছে সে যেন বাসায় না ফিরে তাদের বাসায় একেবারে চলে যায়। সেখানে আজ দাওয়াত পড়েছে।

বেলা হাটছে এমন সময় ফোনটা বেজে ওঠে। বেলা ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে দেখে মৌ-এর নম্বর। রিসিভ করবে ঠিক তখনই একটা বাইক এসে বেলার একদম কাছে এসে থেমে যায়। বেলা এক মুহূর্তের মধ্যে সেখান থেকে সরে দাঁড়ায়।

বাইকে থাকা ব্যক্তিটি মাথার হেলমেট খুলে চুল ঠিক করতে করতে বলে,” উঠে বসুন। এখন রিকশা পাবেন না।”

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে